প্রেমময়ী তুমি পর্ব-৫৪+৫৫

0
495

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৫৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আমার মাঝেই তোমার ম’র’ণ লিখা আছে চাঁদ! বিশ্বাস না হয় তো তোমার বুকে হাত রেখে দেখো। বুকের ছাতিটা কতোখানি ফুলে আছে! এভাবে ফুলতে থাকলে তো নিশ্চিত আমার মাঝেই তোমার ম’র’ণ হবে তাইনা?”

চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো। তবে সেই হাসির একরত্তিও আওয়াজ হলোনা! গভীর প্রেমের নেশায় আসক্ত হয়ে সে নূরকে একান্তে, নিরিবিলি, নির্মলভাবে আলিঙ্গন করল। নিবিষ্ট হয়ে সে স্নিগ্ধ আঁখিযুগল বুজে নিলো। চাঁদের অতি রঞ্জিত আলিঙ্গনের মাত্রা যদিও সুঠাম দেহধারী নূরের তুলনায় এতোটা জোরালোভাবে নয় তবে সে তার পাতলা শরীরের সমস্ত শক্তি লাগিয়ে দিয়েছে নূরকে জড়িয়ে ধরতে! তাদের আলিঙ্গনের মাত্রা ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল। দুটো প্রেম পিপাসু হৃদয় ধীরে ধীরে এক হচ্ছিল। মন-প্রাণ-হৃদয় একান্তে মিশে যাচ্ছিল। পরম আবেশে সিক্ত হয়ে চাঁদ ঘোরে ডুবে যাচ্ছিল৷ সম্মোহনী গলায় বলল,,

“আপনি ঠিকই বলেছেন নূর ভাইয়া। সত্যিই আমি আমার ম’র’ণ দেখছি আপনার মাঝে! এতো প্রশান্তি কেন আপনার সান্নিধ্যে হ্যাঁ? এতো সুখ কেন আপনার ছোঁয়ায়? এতো অসীম কামনা, তৃপ্তি, সুকুন আমি সত্যিই সহ্য করতে পারছিনা নূর ভাইয়া। বুকের ভেতরে অসহ্য এক যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেনো বুকের ভেতরে কেউ ক্রমাগত হাতুড়ি পিটাচ্ছে। আমার মন-প্রাণ সব ছেদ করে রীতমতো আমাকে আহত করে তুলছে। বাঁচতে দিবেনা বুঝি এই ছেদ আমায়।”

আচমকা নূর নাটকের আশ্রয় নিলো! ঝট করে হাতের বাঁধনটা ছেড়ে দিলো। বেশ ভাব নিয়ে পিছু ঘুরে শার্টের কলারটা ঝাড়ল। নাটকীয় গলায় বলল,,

“ওকে ফাইন। ছেড়ে দিলাম। আব জিয়ো। জি ভারকে জিয়ো! আমাকে ছাড়াই জিয়ো।”

চাঁদ ঠোঁট উল্টালো। নির্বোধ দৃষ্টিতে নূরের পেছন পানে তাকিয়ে রইল৷ কী হলো না হলো সব তার মাথার উপর দিয়ে গেল। খারাপ কী এমন বলেছে সে? যার কারণে নূর তার সাথে এই বিরাট অভিমান করল? কিয়ৎক্ষণ নিজের মধ্যে আকাশকুসুম চিন্তা ভাবনা করে চাঁদ গলা ঝাড়ল। হঠকারি গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই? কী হলো ব্যাপারটা? হঠাৎ রাগ করলেন কেন?”

“কী হবে আবার? যা চাইছ তাই হইছে! তুমি তো বাঁচতে চাও তাইনা? আমাকে মে’রে তুমি বাঁচতে চাও! আমি আবার কাউকে মেরে টেরে আসামি টাসামি হতে চাইনা। এরচেয়ে বরং আমি একাই ম’রি। তোমার প্রেমের আগুনে একাই জ্বলে পুড়ে ম’রি।”

নূর বেশ অভিমান নিয়ে বুকের পাঁজরে হাত গুজে দাঁড়ালো। শরীর তার তীব্র অসুস্থতায় আক্রান্ত হলেও নাটক যেনো তার ঘুনাক্ষরেও কমছিলনা। রোগা শরীর নিয়েই সে প্রচণ্ড অভিমান দেখালো। আশায় রইল চাঁদ কখন তাকে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরবে! তার অভিমান ভাঙানোর জন্য প্রেমময়ী গলায় বলবে,,

“ম’র’ণ হলে হোক। তবুও আমি আপনাকে ছাড়ছিনা! প্রয়োজনে দুজনই প্রেমের আগুনে জ্বলে পুড়ে ম’র’ব।”

নূরের অভিমানের কারণ চাঁদ বেশ বুঝতে পারল! ইচ্ছে করছিল নূরকে আরও একটু ক্ষেপিয়ে দিতে! নূরের রাগী মুখটাকে প্রতিবারের ন্যায় আরও একবার দর্শণ করতে। দেখে দেখে শুধু মুগ্ধ হতে। তবে বর্তমানে নূরের শরীরের যা অবস্থা এই অবস্থায় তার সাথে অভিনয় করা তো দূরে থাক তাকে রাগানোটাই বোকামী হবে। অতিরিক্ত রাগের কারণে সে আরও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। আর নূর অসুস্থ হয়ে পড়লে হিতে চাঁদেরই কষ্ট পেতে হবে। তাই সে মিটিমিটি হেসে সত্যিই নূরের ভরসাকে সত্যি প্রমাণ করে দিলো! পেছন থেকে শক্তভাবে নূরকে জড়িয়ে ধরল! চোখ বুজে গভীর প্রেমমাখানো গলায় অস্পষ্ট সুরে বলল,,

“আপনার মাঝেই তো আমার জীবন-ম’র’ণ নূর ভাইয়া! যদি আপনার ভালোবাসায় ম’রেও যাই না? তবে আমার বিন্দুমাত্রও আফসোস থাকবেনা। কেন বলুন তো? কারণ, আপনার ভালোবাসাতেই আমি বারবার বেঁচে ফিরব! আর উপর ওয়ালা যেদিন সত্যি সত্যি আমার মরণ লিখে রাখবে না? সেদিন না হয় আপনার মাঝেই আমার শেষ মরণটা দেখব!”

নূর গম্ভীর হাসল! ঘাড়টা পেছন দিকে ঈষৎ বাঁকালো। বুকের মাঝখানে থাকা চাঁদের ডান হাতজোড়া শক্তভাবে আঁকড়ে ধরল। মলিন গলায় শুধালো,,

“এতদিন এত ভালোবাসা কোথায় ছিল হ্যাঁ? বি’ষ খেয়ে যে বি’ষ হজম করছিলাম চোখে পড়েনি তখন? আর একটু হলেই তো ম’রে যাচ্ছিলাম। পালঙ্কে উঠানোর পর আমার ভালোবাসা বুঝতে তাইনা?”

চাঁদ এবার প্রচুর ক্ষেপে গেল! নূরের মুখ থেকে এসব হৃদয়বিদারক কথা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। বেশ আঘাত হানল কথাগুলো তার ব্যাকুল মনে। তীর বিঁধে যাওয়ার মতো আঘাত করল। এক ঝটকায় সে নূরকে তার শরীর থেকে সরিয়ে দিলো! তুখোড় জেদ দেখিয়ে লাফিয়ে দাপিয়ে জায়গা পরিত্যাগ করল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“শুধু আমার না। আমার ভালোবাসাও কখনো আপনার চোখে পড়েনি! তাই বুঝেও বুঝেন নি আমনর অনুভূতিগুলো। এই মর্মান্তিক কথাগুলো না? আমার আপনাকে বলার ছিল। আর আপনি কিনা উল্টে আমাকে এসব বলে দিলেন? আর কখনো আমি আপনার সামনে আসবনা। কখনো না।”

চাঁদের অগ্নিঝরা ক্ষোভ দেখে নূর দৌঁড়ে গেল চাঁদের পেছনে পেছনে। চৌকাঠ পার হওয়ার পূর্বেই সে পেছন থেকে চাঁদের কোমর আঁকড়ে ধরল। কোলে তুলে তাকে সোজা রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো! দরজার খিলটা সজোরে আটকে সে হাঁপাতে হাঁপাতে রাগান্বিত চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অসুস্থ গলায় বলল,,

“শোনো? তোমার সাথে এখন ধস্তাধস্তি করার এনার্জি নেই আমার। শান্ত হয়ে বসো এখানে৷ আমাকেও একটু শান্ত হতে দাও। মাথাটা প্রচুর ঘুরছে।”

ঘর্মাক্ত হয়ে উঠল নূর। সারাশরীর বেয়ে টপটপ করে ঘাম ঝড়তে লাগল। শরীর তার ক্রমাগত দুর্বল হয়ে উঠছিল। গতকাল রাত থেকেই পেটে কোনো দানা পানি পড়েনি তার। পুরো পেট খাবার শূণ্য। তাই শরীরটা আরও বেশি অকেজো হয়ে উঠছিল তার। কোনো অঙ্গেই যেনো শক্তি খুঁজে পাচ্ছিলনা। কেবল বমি বমি ভাব হচ্ছিল। নূরের এই সূচনীয় অবস্থা দেখে চাঁদ তার অদম্য জেদ এবার ক্ষান্ত করল। উদ্বিগ্ন হয়ে নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ওড়না দ্বারা পরম যত্নে নূরের ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল মুছে দিলো। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কিছু খাননি এখনো?”

চোখ বুজে নূর অস্থির গলায় বলল,,

“না।”

“ইশশ কী যে করেননা আপনি।”

আর কোনো কথা বাড়ালো না চাঁদ। নূরকে টেনে ধরে বিছানার উপর বসিয়ে দিলো। ঘামে সিক্ত নূরের অগোছালো চুলগুলোকে সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে দিলো। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“আপনি বসুন এখানে। আমি খাবার নিয়ে আসছি। আর শরীর বেশি খারাপ করলে শুয়ে পড়ুন। রেস্ট নিন।”

তৎক্ষনাৎ নূর শরীরের সমস্ত শক্তি ছেড়ে দিলো! শটান করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কাতর হয়ে দুর্বল গলায় বলল,,

“তাড়াতাড়ি এসো। আমার কথা বলতেও খুব কষ্ট হচ্ছে।”

চাঁদ আর এক মুহূর্ত ব্যয় করলনা। দ্রুত বেগে হেঁটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। হন্ন হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই দেখল সামিয়া আহমেদ বেশ রেগে মেগে রান্নাঘরের জিনিসপত্র গুছাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আসবাবপত্রগুলোকে সজোরে আছাড়ও মারছেন! এ যেনো প্রখর রাগের এক বহিঃপ্রকাশ। চাঁদকে পাশে দেখে উনার রাগের মাত্রাটা যেনো আরও তড়তড় করে বেড়ে গেল! অস্থির হয়ে থাকা চাঁদের দিকে তিনি শাণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। রূঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“এই নূর তোর রুমে কী করছে হ্যাঁ?”

প্লেটে ভাত বেরে চাঁদ রুক্ষ দৃষ্টিতে সামিয়া আহমেদের দিকে তাকালো। অকপট গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী করছে মানে? এটা কোন ধরনের প্রশ্ন মা?”

“আমি তোকে যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে। নূর তোর রুমে কী করছে? একটা অবিবাহিত মেয়ের রুমে একটা অবিবাহিত ছেলে কী করছে?”

সামিয়া আহমেদের প্রশ্নকে তোয়াক্কা করলনা চাঁদ! সম্পূর্ণ গাঁ ছাড়া ভাব নিলো। সে বেশ বুঝতে পারল সামিয়া আহমেদ ঠিক কোনদিকে ইঙ্গিত করতে চাইছেন। তাই সে নিশ্চুপ হয়ে প্লেটে ভাত তরকারি বেরে নিলো। কাজ শেষ হওয়ার পর সে চোখ তুলে সামিয়া আহমেদের দিকে তাকালো। নির্ভেজাল দৃষ্টিতে তার মাকে নিরীক্ষণ করল। বিনয়ী সুরেই বলল,,

“নূর ভাইয়া কিছুদিন পর তোমার ছোটো মেয়ের জামাই হতে চলেছে মা! এবার বুঝে নাও উনি এই মুহূর্তে আমার রুমে কী করছে!”

যত দ্রুত সম্ভব জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো চাঁদ। রাগে সামিয়া আহমেদ গর্জে উঠলেন। চ্যাচিয়ে বললেন,,

“এই কী বললি তুই?”

চাঁদ আর পিছু ঘুরে তাকালো না। খাবারের প্লেট নিয়ে ছুটে চলল তার রুমের দিকে। তার মা ভীষণ ক্ষেপে গেছে। যা সে গলার স্বর শুনেই বেশ আঁচ করতে পারছে। এই মুহূর্তে তার মা কে আরও ঘাঁটিয়ে দেওয়া মানে বাড়িতে দক্ষ যজ্ঞ বাঁধিয়ে বসা৷ যা এই মুহূর্তে খুবই বেদরকারি। নূরকে খাওয়ানোটাই এই মুহূর্তে বিশেষ দরকারি। পরে সময় বুঝে যেকোনো সময়ে তার মায়ের সাথে এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলা যাবে। এই ভেবে সে ছুটে চলল তার রুমের দিকে।

এরমধ্যে আয়মনও হঠাৎ রান্নাঘরে গিয়েছিল পানি খেতে। ঘটনাচক্রে সামিয়া আহমেদের মুখোমুখি পড়ে গেল সে! সামিয়া আহমেদ কোমরে হাত গুজে আয়মনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। গড়গড় করে পানি খেতে থাকা আয়মনকে কড়া গলায় শুধালেন,,

“এই আয়মন কী হচ্ছে রে এসব? চাঁদ কী বলে গেল এখন? নূর নাকি আমার মেয়ের জামাই হতে চলেছে?”

সঙ্গে সঙ্গেই নাকেমুখে পানি ওঠে গেল আয়মনের! বিষম খেয়ে বসল সে। মৃদু কাশতে কাশতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল সে,,

“কী বলছ কী মামানি? কে বলল এসব তোমাকে?”

“কে আবার? চাঁদ বলল।”

কাশির মাত্রাটা আয়মনের আরও উর্ধ্বগতিতে এসে থামল! তাজ্জব গলায় বিড়বিড় করে বলল,,

“বাপরে! এর তো দেখছি রকেটের তুলনায়ও স্পিড বেশি! কী সুন্দর নিজেই নিজের বিয়ের কথা নিজের মাকে টুপ করে বলে দিয়ে চলে গেল? এর এত তাড়া কীসের হ্যাঁ নূরকে বিয়ে করার? পালিয়ে যাচ্ছে নাকি নূর? নাকি আমরা কেউ পালিয়ে যাচ্ছি?”

আয়মনের মৌনতা দেখে সামিয়া আহমেদ কপাল কুঁচকালেন। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“আরে বল না? সত্যিটা কী?”

আয়মন এক ঢোঁকে মুখে থাকা বাকি পানিটুকু গিলে খেলো। গ্লাসটা তাকের উপর রেখে সামিয়া আহমেদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। পরিস্থিতির চাপে পড়ে চাঁদকে ইন্ধন যুগিয়ে বলল,,

“নূরকে মানতে তোমার আপত্তি কীসের মামানি? মাশাআল্লাহ্ আমাদের নূর তো লাখের মধ্যে এক। নূরের ক্যারেক্টার, ওর স্টেটাস, ফ্যামিলি সম্পর্কে সবই তো জানা তোমার। তো এতে এত আপত্তির কী আছে?”

“নূর এখনো বেকার! চাকরী বাকরী করে কিছু?”

মেয়ের মা হিসেবে যদিও সামিয়া আহমেদের কথাটা অযৌক্তিক নয়৷ তবে আয়মন প্রাণপনে চেষ্টা করল সামিয়া আহমেদকে বুঝাতে। আশাবাদী গলায় সে বলল,,

“এখন করে না তো পরে করবে। ফাইনালের পর পরেই তো চাকরীর জন্য ট্রাই করবে। আশা করি ভালো একটা চাকরি পেয়েও যাবে। যথেষ্ট যোগ্যতা আছে নূরের। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করোনা মামানি। আমরা আছি তো। কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। এসব কোনো প্যারা খাওয়ার জিনিস হলো বলো? তুমি এখন প্যারা খাবা সোহানী আপুর বিয়ে নিয়ে। কীভাবে কী করলে বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট সুন্দর হবে এসব নিয়ে। তা না, তুমি আছো যতসব আজাইরা বিষয় নিয়ে চর্চা করতে।”

আজভাজ বুঝিয়ে আয়মন তোপের মুখ থেকে বেঁচে ফিরল। দ্রুত বেগে জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! সামিয়া আহমেদ বোকা বনে গেলেন! তাজ্জব দৃষ্টিতে আয়মনের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলেন। কিয়ৎক্ষণ টাস্কিত থাকার পর তিনি বিস্মিত গলায় বললেন,,

“কী যামানা এলো রে বাবা? ছেলে মেয়েরা এখন নিজেরাই ঠিক করবে কে কাকে বিয়ে করবে? এই বিষয় নিয়ে বাবা-মা কিছু বললেই বলবে সব আজাইরা প্যাচাল?”

___________________________________

তিথীর সাথে নিরিবিলি লাইন মারতে ব্যস্ত মাহিন! ছাদে দাঁড়িয়ে দুজন বেশ মাখোমাখো হয়ে কথা বলছে! কেবল এক থেকে দু’ইঞ্চি ফাঁকা আছে দুজনার মধ্যে। মাহিনের হাস্যকর কথাবার্তায় পিছলে পড়ে তিথী মিটিমিটি হাসছে। আর মাহিন খানিক ঘুরে দাঁড়িয়ে তিথীর হাসোজ্জল মুখপানে চেয়ে প্রেমের ছন্দ বুনছে! মাহিনের বেপরোয়া চাহনিতে তিথী বারবার লজ্জায় কুকিয়ে উঠছে! মাথা নুইয়ে হালকা হাসছে। এসবে মাহিন একটু হলেও ধারণা করতে পারছে তিথী তার প্রেমে পিছলে পড়ছে। মনে মনে ব্যাপক খুশি সে! কখন তিথীকে লাইনে আনতে পারবে সেই চিন্তায় ছটফট করছে। হাসি ভুলে তিথী এবার আগ্রহী দৃষ্টিতে মাহিনের দিকে তাকালো। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“এরপর কী হলো?”

ছাদের রেলিংয়ে মাহিন ড্যাশ দিয়ে দাঁড়ালো। ঈষৎ হেসে বলল,,

“এরপর আর কী হবে? দুজনে একসাথে বসে চা, কফি খেলাম। মেয়েটাকে কিছুক্ষণ বুঝালাম। শান্ত গলায় বললাম, আরে যা হইছে বাদ দাও। আমি হয়তো তোমার ভাগ্যে ছিলাম না। না হয় আমাকে প্রপোজ করার আগের দিনই কেন হুট করে তোমার বিয়ে-শাদি ঠিক হয়ে যাবে বলো? এখন আর আফসোস কী লাভ? বরং বিয়ে শাদি করো। আমাকে দাওয়াত টাওয়াত করো। খেয়ে দেয়ে তোমাদের জন্য দোয়া করে আসি।”

“আহারে। মেয়েটা খুব কষ্ট পেয়েছে তাইনা?”

“পাইলে আমার কী? আমি তো আর তাকে বলিনি আমার জন্য কষ্ট পাও। এমন কতো মেয়েই তো আছে যারা আমার জন্য কষ্ট পায়! অনেকে তো বলে তোমাকে না পেলে আমি বাঁ’চ’ব না মাহিন। ডিরেক্ট সু’ই’সা’ই’ড করব! ছাদ থেকে ঝা’প দিয়ে পড়ব। তো এসবে কি আমি পাত্তা দিই বলো? এসব তো হলো সাময়িক আবেগ।”

বেশ ভাব নিয়ে মাহিন কলার ঝাড়ল! এমন একটা ভাব নিলো যেনো সে যা বলছে সব সত্যি সত্যি বলছে! মেয়েরা সত্যিই তার পেছনে আদাজল খেয়ে পড়ে। কোথাও কোনো মিথ্যের অবকাশ নেই। মাহিনের এই দুর্দান্ত এটিটিউট দেখে তিথী চোখ বুজে সব বিশ্বাস করে নিলো! নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“সত্যি? আপনার জন্য এতো মেয়ে পাগল ছিল?”

“তা বৈ কী? পুরো বিদেশ কাঁপিয়ে এসেছি আমি! আমাকে দেখে কী মনে হয় তোমার হ্যাঁ? এই নীল নীল চোখ দুটো দেখছ না? সবাই এই নীল চোখের দিকে তাকালেই আমার প্রেমে ডুবে যায়! আফসোস! শুধু তুমিই ডুবলা না!”

মাহিনের করা শেষোক্তিটা শুনে তিথী ভ্রু কুঁচকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“মানে?”

মাহিন থতমত খেলো৷ প্রসঙ্গ পাল্টাতে মরিয়া হয়ে উঠল। শার্টের কলারটা উঁচিয়ে বলল,,

“মানে কিছুনা৷ তবে এই সাদা জামাটায় তোমাকে কিন্তু জোস লাগছে! চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো সুন্দর লাগছে।”

তিথী ভীষণ লজ্জা পেল! লজ্জাবতী হয়ে মাথাটা নুইয়ে নিলো। উড়তে থাকা খোলা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে নিলো। মিষ্টি হাসিতে আচ্ছাদিত হয়ে উঠল। তিথীর চোখ ধাঁধানো হাসি দেখে মাহিন গলা ঝাড়ল। বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলল,,

“হাছি তো ফাছি!”

_________________________________

আয়মন প্রায় অনেকক্ষণ যাবত হন্ন হয়ে তাশফিয়াকে খুঁজে চলছে। ধারণা করছে তাশফিয়া এবং জায়মা একসাথেই বাড়ির কোথাও একটা আছে। একটু মন দিয়ে খুঁজলেই হয়তো পেয়ে যাবে। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হতে চলছে আর এক্ষণি তাদের শপিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। সোহানীও ঐদিক থেকে বেশ তাড়া দিচ্ছে। মেয়েদের বিয়ের সময়টাতে নাকি একটু বেছে চিন্তে চলতে হয়। মুরুব্বিদের বলা কথা এসব। নিশ্চয়ই তারা বুঝে শুনেই কথাগুলো বলেন। পুরো বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আয়মন অবশেষে তাশফিয়া এবং জায়মাকে হলরুমের পেছনের এরিয়ায় খুঁজে পেল! দুজনই হৈ-হুল্লোড় করে বেলিফুল কুড়ুচ্ছে! খুশিতে যেন হৈ হৈ করছে। হলরুমের পেছনের দিকে যে এত বিশাল বড়ো এক বেলিফুল গাছ আছে আগে তা কেউই জানত না! মূলত জায়গাটা প্রচুর ঝোঁপঝাড়ে আবিষ্ট বলে কেউ এখানে আসতে চায়না। তবে আজ জায়মা এবং তাশফিয়া হাঁটতে হাঁটতে এই জায়গাটায় এলো। এসেই দেখতে পেল বেলিফুল অকাতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মাটিতে। মাতাল করা সুঘ্রাণে জায়গাটা ম ম করছে। সেই লোভ তারা সামলাতে পারলনা। প্রতিযোগীতা করে নেমে পড়ল বেলিফুল কুড়োতে।

রাগে গজগজ করে আয়মন দুজনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। এই ভর সন্ধ্যায় ঝোপঝাড়ে তাদের দেখে তার মাথাটা যেনো গরম হয়ে গেলো। কিছুতেই যেন তার রাগ সংবরণ হচ্ছিলনা। তারা দুজনই এখনো উবুড় হয়ে বেলিফুল কুড়াতে ব্যস্ত৷ তাই আয়মনের উপস্থিতি তারা তেমন টের পেলনা। আয়মনের দু’পায়ের মধ্যখানে পড়ে থাকা বড়ো রকমের বেলিফুলটা দেখে মাত্রই তাশফিয়া দেঁতো হাসল। উচ্ছ্বাসিত হয়ে বেলিফুলটা তুলতে গেলেই হঠাৎ তাশফিয়ার নজর পড়ল উপরের দিকে। চোখ উঠিয়ে দেখল আয়মন অগ্নিশর্মা হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সঙ্গে সঙ্গেই শুকনো ঢোঁক গিলল তাশফিয়া। চট করে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ওড়না ঠিক করে মাথাটা নুইয়ে নিলো। অন্যদিকে জায়মা এদিক ওদিক না তাকিয়ে ওড়না ভর্তি বেলিফুল নিয়ে দিলো এক ছুট! যেতে যেতে তাশফিয়াকে ভয় দেখিয়ে বলল,,

“আরে এই তাশফিয়া চলে আয়। আয়মন ভাইয়া বকবে তোকে এখন। দেখছিস না কেমন রেগে আছে?”

হাতে থাকা অবশিষ্ট বেলিফুল গুলো মাটিতে ছুড়ে ফেলেই তাশফিয়া জান নিয়ে পালানোর চেষ্টা করল। আয়মনের ভয়ে সে কাবু হয়ে উঠল। অমনি আয়মন পেছন থেকে তাশফিয়ার বাঁ হাতটা খপ করে ধরে ফেলল! তাশফিয়া ভয়ে কান্না জুড়ে দিলো! ভরাট গলায় বলল,,

“সরি আয়মন ভাইয়া। আমি আর কখনো এখানে আসবনা। এবারের মতো আমাকে যেতে দিন প্লিজ।”

তাশফিয়ার আহাজারি শুনলনা আয়মন। হেঁচকা টানে তাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো! একজন আরেকজনের গাঁয়ের সাথে যতখানি সম্ভব ঠেসে দাঁড়ালো। কোথাও একরত্তি ফাঁকফোকরও অবিশিষ্ট রইল না। বুক দুড়ুদুড়ু করে কাঁপতে লাগল তাশফিয়ার। চোখ জোড়া জ্বালা পোড়া করে উঠল। তাশফিয়ার ভয়াল দু’চোখে এক ঝলক তাকালো আয়মন। রাগ ভুলে তার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সহজ গলায় শুধালো,,

“আমাকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে হ্যাঁ? আমি বাঘ না ভালুক?”

তাশফিয়া ছটফট করে উঠল আয়মনের কবল থেকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য। হাত দু’খানা মোচড়াতে লাগল সে। জড় গলায় অসহায়তা নিয়ে বলল,,

“প্লিজ আমাকে যেতে দিন।”

“আগে বলো আমাকে এত ভয় পাও কেন? ভয় পাওয়ার মতো এমন কী আছে আমার মধ্যে?”

“কারণ, আপনি যখণ তখন আমার গাঁয়ে হাত তুলতে পারেন। আমি আপনার গাঁয়ে একবার হাত তুলেছিলাম তাই!”

“ধ্যাত বোকা মেয়ে। মেয়েরা হলো আদর করার জিনিস। মা’র’ধ’র করার জিনিস নাকি?”

তাশফিয়া ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। ক্ষণিকের মধ্যেই তাশফিয়াকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে আয়মন টুপ করে তাশফিয়ার কপালে চুমু এঁকে দিলো! দ্রুত বেগে তাশফিয়ার হাতটা ছেড়ে সে পেছনের দিকে মোড় নিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাশফিয়ার দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র হাসল। রসাত্মক গলায় বলল,,

“ভয়কে এবার জয় করে নিলাম! আমাকে দেখলে এবার শুধু লজ্জা পাবে। ভয় আর পাবেনা!”

ঘটনার আকস্মিকতায় তাশফিয়া বরফের মতো জমে গেল! ম’র’ণটা বোধ হয় তার ঘনিয়ে এলো।

,
,

খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে নূরের মাথার পাশে ঠায় বসে আছে চাঁদ! নূর কোল বালিশ আঁকড়ে ধরে নাক টেনে বেশ আরামচে ঘুমুচ্ছে! খাবার নিয়ে আসতে আসতে এতটুকু সময়ের মধ্যে যে নূর এতোটা গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়বে আন্দাজ করতে পারেনি চাঁদ। নূরকে এই সময় ডেকে তোলাটাও তার বিবেকে বাঁধছে। অসুস্থ শরীরে যত ঘুমোনো যায় ততোই ভালো। এতে শরীর মন চাঙা থাকে। নূরের দিকটা বিবেচনা করেই চাঁদ নূরের ঘুম ফুরিয়ে জেগে ওঠার অপেক্ষা করছে। এইদিকে মাহিন, আয়মন, সোহানী, জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া চাঁদকে ফেলেই শপিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে! আর কতক্ষণ তারা চাঁদের জন্য এভাবে অপেক্ষা করবে? এদিকে যে রাত হতে চলল।

খাবারের থালাটা সেন্টার টেবিলের উপর রাখল চাঁদ। একধ্যানে নূরের ঘুমন্ত, মায়াময়, নিষ্কুলষিত মুখমণ্ডলে তাকিয়ে রইল। ভালোলাগা, ভালোবাসা নেশালো ভাবে ছুঁতে লাগল তাকে। অজানা কিছু শিহরণ বার বার জানান দিয়ে বলছিল এই বুঝি তার বাম পাজরের হাড় ঘুমিয়ে রয়েছে। নূরের দিকে ওভাবে অপলক তাকিয়ে থেকেই সে যেনো নিমিষেই আজীবন পাড় করে দিতে পারবে। এই যামানা ধ্বংস হয়ে গেলেও নূরকে দেখার তৃষ্ণা তার একচুলও কমবেনা। বরং আরও পিপাসু হয়ে উঠবে তার প্রেমপিপাসু হৃদয়। নূরের মধ্যেই বার বার পূর্ণজ্জীবিত হয়ে উঠবে।

নূরকে আরও কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারলনা চাঁদ। তাই আস্তে ধীরে সে নূরের মাথাটা তার হাঁটুর উপরের অংশে রাখল! মিটিমিটি হেসে নূরের দিকে ঝুঁকে তাকালো। আলতো করে নূরের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। কপালে একটু একটু করে হাত বুলাতে লাগল। পরম আরামের খনি যেনো খুঁজে পেল নূর। নড়েচড়ে সে জমপেশ ঘুম দিলো। সেই ঘুম ভাঙল তার আরও ঘণ্টা খানিক পর! তখন ধরণীতে সন্ধ্যা সাতটা প্রায়। হাঁটু গলিয়ে চাঁদ আকাশকে রাঙিয়ে তুলছে। অদ্ভুত সৌন্দর্য্যে মেতে আছে গোটা ধরণী। জানালা দিয়ে সুন্দর চাঁদ দেখা যাচ্ছে। এদিকে চাঁদের হাঁটু প্রায় অবশ হয়ে আসার পথে। তবুও সে তার কষ্টকে নূরের আরামের তুলনায় বেশি প্রাধান্য দিলোনা।

ঘুম ফুরিয়ে আসতেই নূর পিটপিটে চোখে এদিক ওদিক তাকালো। উঁচুতে তাকাতেই চাঁদের ঝুকে থাকা হাসোজ্জল মুখটা সে মিটমিটে চোখে দেখতে পেল! ধড়ফড়িয়ে সে শোয়া থেকে ওঠে বসল৷ চাঁদের দিকে আগ্রাসিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভ্রু যুগল কুঁচকে বলল,,

“এই তুমি এখানে কী করো? শপিংয়ে যাও নাই?”

চাঁদ মুখটা কুঁচকে নিলো। গম্ভীর গলায় বলল,,

“আপনাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কীভাবে শপিংয়ে যাই হ্যাঁ?”

“আশ্চর্য! কী অবস্থা আমার? আমি তো টোটালি ফিট এন্ড ফাইন।”

“ফিট এন্ড ফাইন না? খাবার দাবার খেয়েছেন কিছু? আমি যে একটুর জন্য খাবার আনতে গেলাম এসে তো দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছেন। খাওয়ানোর সুযোগটা দিয়েছেন একটু?”

তাড়াহুড়ো করে নূর বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তার মাথাটা হঠাৎ ঘুরে এলো! তাল গোল পাকিয়ে গেল সব। এক পর্যায়ে সে হেলেদুলে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। চাঁদ বসা থেকে ওঠে রেগে মেগে নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। কোমড়ে দুু’হাত গুজে চোয়াল শক্ত করল। উড়নচণ্ডী ভাব নিয়ে বলল,,

“এই আপনার ফিট এন্ড ফাইন, না? এখনি তো মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন।”

অস্থির হয়ে নূর চোখজোড়া বুজে কপালটা খানিক ঘঁষল। অস্থির গলায় বলল,,

“বাইরে চলো।”

“বাইরে চলো মানে? খাবেন না এখন?”

“বাইরে গিয়েই খাব।”

“মানে? এখানে খেলে কী হবে?”

“সবাই খারাপ ভাববে।”

“আশ্চর্য। খারাপ ভাবার কী আছে এখানে?”

“তুমি আর আমি একা একটা রুমে! খারাপ ভাববে না সবাই?”

“এসবের তোয়াক্কা করেন নাকি আপনি?”

“আগে করতাম না। তবে এখন করি। কারণ, আমি আমার ভালোবাসা নিয়ে কারো কোনো কটুক্তি শুনতে পারবনা। কেউ আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করুক ঘুনাক্ষরেও মানতে পারবনা।”

“এদিকে যে আমি আম্মুকে বড়ো গলায় বলে এলাম আম্মুর ছোটো মেয়ের জামাই আপনি হতে চলেছেন এখন তার কী হবে?”

#চলবে…?

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৫৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এদিকে যে আমি আম্মুকে বড়ো গলায় বলে এলাম আম্মুর ছোটো মেয়ের জামাই আপনি হতে চলেছেন এখন তার কী হবে?”

নূর যেনো তাজ্জব বনে গেল! ঢুলুঢুলু নয়ন তার আগ্রাসী হয়ে উঠল। হঠকারিতায় মাথা চুলকাতে বাধ্য হলো। চাঁদের লাগামহীন কথাবার্তায় তার পিলা চমকে গেল। কীভাবে সম্ভব বড়ো গলায় তার খালামনির কাছে বলা যে সে উনার ছোটো মেয়ের জামাই হতে চলেছে? যেখানে নূরেরই এই প্রস্তাবটা তার খালামনির কাছে রাখার কথা ছিল। সেখানে চাঁদ তার পূর্বেই প্রস্তাবটা রেখে দিলো? ভালোবাসা দেখো এই মেয়ের! কিঞ্চিৎ মুহূর্তের জন্য নিজেকে ধাতস্থ করল নূর। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কী বললা তুমি?”

চাঁদ ভ্রু যুগল কুঁচকালো। দৃষ্টি জোড়ায় তীক্ষ্ণতা নিয়ে নূরের বোকা সোকা নির্বিকার মুখমণ্ডলের দিকে তাকালো। কোমরে দু’হাত গুজে সে রাগী ভাব নিয়ে এক কদম সামনে বাড়ল। যতটা সম্ভব নূরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন? ভয় পাচ্ছেন আপনি? বিয়ে করবেন না আমাকে?”

চাঁদের রুক্ষ মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে নূর বেশ তৎপর ভাব নিলো। বুকে যতখানি সম্ভব সাহস সঞ্চার করল। এই মুহূর্তে চাঁদের অহেতুক সন্দেহকে তিল পরিমাণ প্রশ্রয় দেওয়া যাবেনা। তাই সে দ্বিধাহীন গলায় জবাবে বলল,,

“আশ্চর্য! ভয় পাব কেন? অবশ্যই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তবে এখনি তো তা সম্ভব নয়! আমি আপাতত বেকার। পড়াশোনায় রানিং। বেকার ছেলের কাছে তোমার পরিবার তোমাকে তুলে দিবে হ্যাঁ? বিয়ের পর আমি তোমাকে কী খাওয়াব বলো?”

চাঁদ একরোঁখা ভাব নিলো। একগুঁয়ে গলায় বলল,,

“দিবেনা কেন? আলবাত দিবে। ছেলেটা এখন বেকার হলেও কিছুবছর পর তো সে চাকরী পাবে। তখন তো আর কোনো আপত্তি থাকবেনা তাইনা? তাছাড়া আমি এত খাদকও নই যে খেয়েদেয়ে আপনাকে নিঃস্ব করে দিব। প্রয়োজনে সকালে খেলে দুপুরে খাব না, দুপুরে খেলে রাতে খাব না! এভাবেই কেটে যাবে দিন। আপনাকে পেলে আর অন্যকিছুর সুখ ম্যাটার করে না!”

নূর প্রশান্তিময় দৃষ্টিতে চাঁদের প্রেমময়ী মুখমণ্ডলে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল৷ চাঁদের মহৎ চিন্তাধারায় মুগ্ধ হলো সে। মোহিত হলো চাঁদের নির্ভেজাল ভালোবাসায়। এটা ভেবেই খুব উচ্ছ্বাসিত হলো যে চাঁদও নূরকে তার মতো করেই ভালোবাসে৷ যে ভালোবাসায় কোনো ভেজাল নেই। একে-অপরকে ছেড়ে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। ভালোবাসায় কমতি থাকার সম্ভাবনা নেই। চাঁদের দিকে আরও এক পা এগিয়ে এলো নূর। আহ্লাদি হয়ে চাঁদের এক গাল টিপে দিলো! ব্রণযুক্ত মুখে উষ্ণ হাত বুলালো৷ আদুরে গলায় তৃপ্তিদায়ক হেসে বলল,,

“খুব ভালোবাসেন আমাকে না? আমার চেয়েও বেশি?”

“না! আপনার চেয়ে কম বাসতে চাই। বেশি ভালোবাসলে মানুষ হারিয়ে যায়! আমি বেশি ভালোবাসলে যদি আপনি হারিয়ে যান? তখন আমার কী হবে হ্যাঁ? এরচেয়ে বরং আপনি আমাকে বেশি ভালোবাসুন! কেননা আমি বেঁচে থাকতে আপনাকে হারাতে পারবনা।”

“তুমি হারিয়ে গেলে আমার কী হবে চাঁদপাখি?”

নূর থমথমে হয়ে গেল। মুখমণ্ডলে প্রবল অসহায়তা ফুটিয়ে তুলল। চাপা ভয় তাকে গ্রাস করতে লাগল। বিষাদ বিরাজ করতে লাগল তার নীল চোখের মণিতে। বিষণ্ণতায় ঢেকে গেল মনের অলিগলি। অন্তঃস্থলে ছোটো খাটো একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। জীবনের মতো দামী জিনিসটাকে হারিয়ে ফেলার তীব্র আশঙ্কা কাজ করল। নূরের শঙ্কা চাঁদ বুঝতে পারল। পরিস্থিতি এড়ানোর যথেষ্ট চেষ্টা করল সে। মলিন হেসে খানিক উঁচু হয়ে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। দৃৃষ্টিতে স্থিবিরতা এনে শান্ত স্বরে বলল,,

“এত ভয় পাওয়ার কী আছে হ্যাঁ? কেউ কাউকে বেশি ভালোবাসতে হবেনা। আমরা দুজনই দুজনকে সমানভাবে ভালোবাসব! তাহলে আর কেউ কাউকে হারানোর ভয় থাকবেনা।”

এতেও নূরের আগ্রাসিত ভয় কাটল না। শুকনো ঢোঁক গিলে সে চাঁদের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ভীরু গলায় বলল,,

“ভালো একটা চাকরী বাকরী পেলেই আমরা বিয়ে করে নিব চাঁদ।”

“উফফফ চাকরী পেতে হবে না তো। চাকরী পাওয়ার আগেই আমরা বিয়ে করব। একদিন না একদিন তো চাকরী হবেই তাইনা?”

“আমি তোমাকে একটা সুন্দর সংসার দিতে চাই চাঁদ। চাকরী ছাড়া তা কখনো সম্ভব হবে?”

“ঠিক আছে। চাকরী ছাড়া সম্ভব না তবে….

বাকি অংশটুকু বলার সুযোগ দেওয়া হলো না চাঁদকে। এর পূর্বেই নূর চাঁদকে থামিয়ে দিলো। চাঁদের ছেলেমানুষীকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলনা। ব্যস্ত গলায় বলল,,

“হ্যাঁ। এই তো বুঝতে পেরেছ। যখনই আমার চাকরী হবে তখনই আমরা বিয়ে করব ওকে? এখন চলো। খাওয়াদাওয়া করে আমরা বের হই।”

চাঁদ কটমট দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। বুঝতে পারল নূর প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করছে। তবে চাঁদ এক্ষেত্রে আর কোনো খামখেয়ালী করতে চায়না। শুভ কাজ সে যত দ্রুত সম্ভব সেরে ফেলতে চায়! এভাবে একটা নিরাশ সম্পর্কে ঝুলে থেকে সে তাদের ভালো সময়গুলো নষ্ট করতে চায়না। একেবারে বিয়ের পরই নূরের সাথে জমিয়ে প্রেম করবে বলে অনেক আগে থেকেই প্রবল ইচ্ছে তার। হালাল সস্পর্কে জোর বেশি থাকে। সেই হালাল সম্পর্কটাই সে চায় এখন। তাছাড়া সাদমানকে নিয়েও সে বেশ ভয়ে আছে! কখন কোন দিক থেকে সাদমান তাদের ভালোবাসার পেছনে পড়ে যায় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই যতটা সম্ভব সাবধান থাকা উচিৎ।

নূর উদ্যমি হয়ে পেছনের দিকে ঘুরে দরজার চৌকাঠে পা বাড়াতেই চাঁদ পেছন থেকে নূরের হাতটা টেনে ধরল। নূর কৌতূহলী দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকাতেই চাঁদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল,,

“আমি সাদমান ভাইয়াকে অনেক কষ্টে ফিরিয়েছি নূর ভাইয়া! আমি চাইনা উনি আবারও আমাদের মাঝখানে ফিরে আসুক। আমাদের এই সুন্দর সম্পর্কে বিঘ্ন ঘটাক৷ দেখুন আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলে উনি আমাদের আর আলাদা করতে পারবেন না। তখন আমরা একটা পবিত্র সম্পর্কে জড়িয়ে যাব। যার জোর উপর ওয়ালা অবধি। তখন উনি চাইলেও আমাদের মধ্যে কোনো ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করতে পারবে না নূর ভাইয়া।”

চাঁদের তৎপরতা দেখে নূর বেশ বুঝতে পারল চাঁদ তাদের সম্পর্কটা নিয়ে বেশ ভয়ে আছে। যা এই মুহূর্তে চাঁদকে মাত্রাতিরিক্ত দুঃশ্চিতার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। চাঁদের ভয় কাটানোর জন্য নূর ঝট করে চাঁদকে জড়িয়ে ধরল! চাঁদের মাথায় উষ্ণ ঠোঁট ছুঁইয়ে চাঁদকে সাহস যুগিয়ে বলল,,

“তুমি আমি এক থাকলে পৃথিবীর তৃতীয় কোনো শক্তি নেই আমাদের আলাদা করার! আর এতদিন আমি সাদমানকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম কারণ আমি ভাবতাম তুমি আমাকে পছন্দ করো না! এখন যখন জানতে পারলাম তুমি আমাকে শুধু পছন্দ নয়, প্রচণ্ড রকমের ভালোও বাসো। তো সেক্ষেত্রে আমি আমি জান প্রাণ লাগিয়ে দিব। সাদমানের একরত্তি প্রশ্রয় নেই সেখানে। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ চাঁদ। এসব দুঃশ্চিন্তা থেকে প্লিজ বের হয়ে এসো। এই সময়টাকে এঞ্জয় করো। ফাইনালটা ঠাণ্ডা মাথায় দিই আমি। চাকরী বাকরী পাই এরপর আমরা বিয়ে করব প্রমিস।”

চাঁদ আর কোনো কথা বাড়ালোনা। নূরের সিদ্ধান্তকেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে মেনে নিলো! দুজন দুজনকে ছেড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। চাঁদ খাবারের থালাটা হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলো। নূরকে ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে সে খেতে দিলো। নূরের পাশে চাঁদও চুপটি করে বসল। আর কী কী লাগবে নূরের থেকে জানতে চাইল। কোনো কিছুই খাচ্ছেনা নূর। শুধু ডাল দিয়ে ভাত চটকে খাচ্ছে। মুখে কোনো স্বাদই যেনো খুঁজে পাচ্ছেনা সে। গোটা একটা দিন অনাহারে থাকার দরুন কিছুই তার রুচিতে কুলুচ্ছেনা। তবুও চাঁদের মুখের দিকে চেয়ে যতটা সম্ভব জোর করে খাবারটা গিলছে। এরমধ্যেই হঠাৎ সামিয়া আহমেদ কোথা থেকে যেনো ছুটে এলেন! নূরের অন্যপাশের চেয়ারটা টেনে তিনি ধপ করে বসলেন। খাবার চিবুতে থাকা নূরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তৎপর গলায় শুধালেন,,

“এই নূর? তুই নাকি আমার ছোটো মেয়ের জামাই হতে চলেছিস?”

সঙ্গে সঙ্গেই বিষম খেলো নূর। নাকেমুখে ওঠে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গেল! চাঁদ ব্যস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। তার মায়ের দিকে খড়তড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। খরখরে গলায় শুধালো,,

“এসব কথা বলার তুমি আর সময় পেলে না মা? দেখছ না মানুষটা খাচ্ছে? এরমধ্যেই তোমার এই উদ্ভট প্রশ্নগুলো করতে হবে?”

সামিয়া আহমেদ জিভ কাটলেন। ইশারায় বললেন নূরকে পানি দিতে। গ্লাসভর্তি পানি চাঁদ নূরের দিকে এগিয়ে দিলো। উদ্বিগ্ন হয়ে চাঁদ উভয় হাত দ্বারা নূরের মাথায় হালকা হাত বুলাতে লাগল। নূরের কষ্ট ভুলাতে অস্থিরমণা হয়ে উঠল। গড়গড় করে নূর গ্লাসভর্তি পানিটা খেয়ে নিলো। বিব্রতকর দৃষ্টিতে পাশ ফিরে সামিয়া আহমেদের দিকে তাকালো। সামিয়া আহমেদ ভ্রু উঁচিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় নূরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বিষয়টা বুঝতে পেরে নূর আবারও দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। জবাবে সোজাসাপটা গলায় সামিয়া আহমেদকে বলল,,

“দেখো খালামনি আগে আমি একটা ভালো চাকরী বাকরী পাই। এরপর তোমার মেয়েকে ঘরে তুলব।”

সামিয়া আহমেদ স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। নূরের উপর খুশি হয়ে সন্তুষ্ট গলায় বললেন,,

“যাক বুঝতে পেরেছিস! এবার আমার মেয়েকে শোকেসে সাজিয়ে রাখলেও কোনো সমস্যা নেই আমার! তোর জন্যই আমানত করে রাখব!”

_________________________________

শপিংমলে নীড় সোহানীর জন্য শাড়ি পছন্দ করছে কম তবে সোহানীকে দেখছে বেশি! বেহায়ার মতো সে সোহানীকে কেবল সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে। পলক যেনো পড়ছেই না তার। দোকানদাররাও আড়চোখে নীড়ের বেহায়াপনা দেখছে! তারাও কেমন যেনো মিটিমিটি হাসছে সোহানীকে দেখে। সোহানী অতিষ্ট নীড়ের এহেন নির্লজ্জতায়। নীড়ের জন্যই সবার সামনে তাকে এতটা লজ্জা পেতে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নীড়কে এখনি দু’একটা কটু কথা শুনিয়ে দিতে। জোর করে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে। তবে পরিস্থিতির চাপে পড়ে সে কিছুই করতে পারছেনা। যথেষ্ট অস্বস্তি থাকার কারণে সে পছন্দসই একটা শাড়িও পছন্দ করতে পারছেনা৷ দেড় ঘণ্টা হলো শপিংমলে আসার। তবে কাজের কাজ কিছুই হলোনা! এই কারণেই মেজাজ তার প্রচণ্ড রকম বিগড়ে আছে। কেন সে ননাই করে নীড়কে তার সাথে শপিংয়ে আসতে বলল? এরজন্য এখন তার বড্ড অনুতাপ হচ্ছে!

চাঁদ, জায়মা, তাশফিয়া এবং তিথী প্রতিটি শপ ঘুরে ঘুরে তাদের হলুদের শাড়ি বাছাই করছে। তবে পছন্দসই একটাও হলুদ শাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না তারা। শাড়ি পছন্দ হলে দামে মিলছেনা। আবার দামে মিললেও শাড়ি পছন্দ হচ্ছেনা! উভয় সংকটে পড়েছে তারা। তবে বাকিদের নজর হলুদ শাড়ির দিকে থাকলেও চাঁদের একার নজর পড়ল হলুদ লেহেঙ্গার দিকে! সামনেই একটা শাড়ির দোকানে হলুদ রঙের একটিনলেহেঙ্গা হ্যাঙ্গারে ঝুলে আছে। হালকা সাদা স্টোনের কাজ আছে লেহেঙ্গাটিতে। তবে এই হালকা কাজেই লেহেঙ্গাটিকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। দূর থেকেও চোখ ধাঁধিয়ে আসছে। আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করলনা চাঁদ। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে পাশের দোকানে সোহানীর কাছে গেল। নীড়কে উপেক্ষা করে সোহানীর কাছে আবদার করল। কানে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“আপু। আমার না একটা লেহেঙ্গা পছন্দ হয়েছে!”

সোহানী ভ্রু যুগল কুঁচকে চাঁদের দিকে তাকালো। খরখরে গলায় বলল,,

“বাজেটের দিকে খেয়াল আছে তোর? নীড় খুশি হয়ে তোদের জন্য হলুদের শাড়ি কিনে দিচ্ছে। সেই জায়গায় আমি কীভাবে বলি বল? তোর লেহেঙ্গা পছন্দ? বাজেট বেশি বেড়ে গেলনা? কী ভাববে বল তো?”

চাঁদ মুখটা কালো করে নিলো! গম্ভীর গলায় বলল,,

“আচ্ছা থাক লাগবেনা।”

রাগে গটগট করে মল থেকে বের হয়ে গেল চাঁদ। পাশ থেকে নীড় উজবুক দৃষ্টিতে চাঁদের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। সন্দিহান গলায় সোহানীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো? চাঁদ রাগ করল কেন? কী বলছ তাকে?”

সোহানীর মনটাও বেশ খারাপ হয়ে গেল! নীড়ের কথায় মনোযোগ না দিয়ে সে পার্স ঘাটতে লাগল। হিসাবের বাইরেও আলাদা কোনো টাকা আছে কিনা খুঁজতে লাগল। একটা মাত্র ছোটো বোন তার। কীভাবে তার আবদার অপূর্ণ রাখে? এদিকে নীড়ের কাছে চাঁদের আবদারের কথা বলতেও তার অস্বস্তি হচ্ছে! যদিও নীড় কিছু বলবে না তবুও তার বিবেকে বাঁধছে।

শপিংমলের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে নূর দোকানের ভেতরকার সব দেখছিল। মাহিন এবং আয়মনের সাথে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলেও চাঁদের দিকে ছিল তার তীক্ষ্ণ নজর! চাঁদের গতিবিধি সব দেখছিল সে। বিষণ্ণ চাঁদকে দেখে তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারল। দ্রুত পায়ে হেঁটে সে আড্ডার মহল থেকে বের হয়ে এলো। হম্বিতম্বি হয়ে পাশের দোকান থেকে চাঁদকে টেনে এনে তাকে এক সাইডে এনে দাঁড় করালো। চাঁদের ডান হাতটা টেনে ধরে উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী লাগবে বলো? মুখ ফুলাইছ কেন?”

মাথাটা নুইয়ে নিলো চাঁদ। রাশভারী গলায় বলল,,

“আমি যা চাই। তা আপনি এখন কিনে দিতে পারবেন না নূর ভাইয়া!”

“কী চাও বলবে তো?”

“আমার একটা হলুদ লেহেঙ্গা চাই!”

ফিক করে হেসে দিলো নূর! বিদ্রুপাত্নক গলায় বলল,,

“সামান্য একটা লেহেঙ্গার জন্য আমার কাছে কোনো বাজেট থাকবেনা চাঁদ? তোমার নূরকে তোমার এতটাই হেল্পলেস মনে হয়? হ্যাঁ, হয়তো এরচেয়ে বড়ো কোনো চাওয়া এখন আমি তোমার পূরণ করতে পারবনা। তবে লেহেঙ্গা কিনে দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমার আছে। তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবেনা।”

চাঁদকে টেনে এনে নূর সামনের ঐ দোকানটিতে দাঁড় করিয়ে দিলো। সমস্ত দোকানে চোখ বুলিয়ে সে চাঁদকে বলল,,

“দেখো কোনটা পছন্দ হয়। বিল আমি পে করব।”

“কিন্তু….

“কিন্তু কী? আমার সব তো তোমারই চাঁদ। কোনো রকম হিজিটেড ফিল করবেনা। যা পছন্দ হয় তাই নিবে।”

চাঁদ অবাক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ইচ্ছের গুরুত্ব নূরের কাছে এতটা দামী ভাবতেই সে মৃদু হাসল। অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করতে লাগল মনজুড়ে। নূরের প্রতি ভালোবাসা আরও বাড়তে লাগল। চাঁদের ড্যাব ড্যাব চাহনি দেখে নূর ভ্রু কুঁচকালো। শক্ত গলায় বলল,,

“আরে আমাকে পরেও দেখতে পারবে। এখন লেহেঙ্গাটা আগে চুজ করো।”

চাঁদ দেঁতো হাসল। নূরের হাতটা ছেড়ে সে উল্লাসিত গলায় দোকানীকে বলল হলুদ লেহেঙ্গাটা দেখাতে। চাঁদের কথামতো দোকানী হলুদ লেহেঙ্গাটা চাঁদকে খুলে দেখালো। বিকাশ থেকে টাকা ক্যাশ আউট করার জন্য নূর শপিংমলের বাইরের দোকান গুলোতে গেল। মাহিন এবং আয়মন হতবিহ্বল দৃষ্টিতে নূরের কর্মকাণ্ড দেখতে লাগল। চোখদুটো তাদের কপালে যেনো ওঠে গেল! আক্ষেপভরা গলায় মাহিন বলল,,

“ধ্যাত চু’ল! আমি কেন নূরের মতো হতে পারছিনা। কেন তিথীকে এখনও পটাতে পারছিনা। যাই চু’ল আমিও ট্রিকটা এপ্লাই করে আসি!”

আয়মন কপাল চাপড়ালো। পাশ ফিরে মাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তুই না হয় এই ট্রিক এপ্লাই করলি। আমি কোন ট্রিক এপ্লাই করব ভাই?”

সন্দেহজনক দৃষ্টিতে মাহিন আগাগোড়া আয়মনকে পরখ করে দেখল। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“তুই এপ্লাই করবি মানে? এই তোর আবার কে আছে? কাকে আবার জুটিয়েছিস তুই?”

হেঁতো হেসে আয়মন মাথা চুলকালো! রহস্যময় গলায় বলল,,

“আছে একজন!”

“কে সে?”

“তাশফিয়া!”

কপালে হাত দিয়ে ফেলল মাহিন। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“মানে কী করে ভাই? তুইও কি আমার মতোই ঐ তাশফিয়ার হাতের চড় খেয়ে তার প্রেমে পড়েছিস? ঐ দুই বোনের হাতেই কী জাদু আছে রে ভাই?”

“তাশফিয়া কী হ্যাঁ? তাশফিয়া কী? ভাবি ডাকবি ভাবি!”

জায়মা পেছন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের সব গোপন কথাবার্তা শুনছিল! মুখে হাত দিয়ে সে বেকুব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী চলছে কী এই দুজনের মধ্যে? তারা দুজনই কী তবে তার দুই ফ্রেন্ডকে মন দিয়ে বসে আছে? জায়মা এই সুযোগটার সদ্ব্যবহার করল! দুজনকেই ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ের জন্য নতুন একটা ড্রেস কেনার ফন্দি আটল! ব্যগ্র হেসে পেছন থেকে সে গলা ঝাড়ল। বুকের পাঁজরে দু’হাত গুজে বেশ ভাব নিলো। দুজনকে উদ্দেশ্য করে হুমকিমূলক গলায় বলল,,

“আমি কিন্তু শুনে ফেলেছি সব। বলব তিথী আর তাশফিয়াকে সব? তোমরা যে দুজনকে লাইন মারছ?”

তাজ্জব বনে গেল দুজন। হুড়মুড় করে পিছু ঘুরে তাকালো। জায়মাকে দেখামাত্রই দুজন শুকনো ঢোঁক গিলল। একে-অপরের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জায়মা মিটিমিটি হেসে ঝেড়ে কাশলো। উগ্র গলায় বলল,,

“কী বলব তিথী আর তাশফিয়াকে সব?”

আয়মন ভীষণ ভয় পেয়ে গেল৷ ঝটপটে গলায় বলল,,

“এই না না। প্লিজ এখনি কিছু বলিস না তাশফিয়াকে। তুই ভালো করে ওকে কিছু বুঝিয়ে বলতে পারবিনা। দেখা গেল তুই উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বলে আমাকে ভুল বুঝাতে বাধ্য করলি!”

মাহিন ও আয়মনের কথায় সায় জানালো। থমথমে গলায় বলল,,

“হ্যাঁ জায়মা প্লিজ। এখনি তুমি তিথীকে কিছু বলোনা। আমি তো এখনো তাকে ভালো করে লাইনই মারতে পারলামনা! আরও কত কত লাইন মারার বাকি আছে।”

জায়মা মনে মনে বাঁকা হাসল। উদ্দেশ্য তার সফল হতে চলল। এবার সোজা পয়েন্টে আসা যাক। আটঘাট বেঁধে স্বার্থ উদ্ধারে নেমে পড়া যাক! পুনরায় গলা ঝাড়লো জায়মা। অবুঝ ভাব নিয়ে বলল,,

“ওকে ফাইন। তোমাদের সব কথা মেনে নিলাম। তবে এবার আমারও একটা শর্ত আছে!”

দুই ভুক্তভোগী এবার সতেজ হয়ে উঠল। আশার আলো যেনো খুঁজে পেল তার। নতুন করে নিষ্ক্রিয় প্রাণ উজ্জীবিত হয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় শুধালো,,

“কী শর্ত?”

জায়মা দাঁত কপাটি দেখিয়ে হাসল। ঝড়ঝড়া গলায় ফুড়ফুড়ে মেজাজে বলল,,

“আমাকে একটা সুন্দর দেখে ড্রেস কিনে দিতে হবে তোমরা দুজনে মিলে!”

বিপদে ফেসে যাওয়া দুই তরুন প্রেমিকই এবার কপাল চাপড়ালো! অপারগ হয়ে জায়মার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে তারা বাধ্য হলো! চুম্বকীয় আকর্ষণে ছুটে চলল জায়মার পিছু পিছু। কোথায় তাদের প্রেয়সীদের জন্য ড্রেস কিনে দেওয়ার কথা ছিল। আর কোথায় তারা এখানে এই চুকলির ড্রেস কিনে দেওয়ার পেছনে পড়ে গেল!

বিকাশ থেকে ক্যাশ আউট করে নূর দৌঁড়ে এলো শপিংমলে। কাটায় কাটায় পাঁচহাজার টাকা ধরিয়ে দিলো দোকানীর হাতে। চাঁদ তার পছন্দসই লেহেঙ্গা কিনতে পেরে ভীষণ খুশি হলো! নূরের হাতটা সে কিছুতেই ছাড়তে চাইলনা। আহ্লাদে প্রায় আটখানা হয়ে উঠল! খুশিতে তার মনে লাড্ডু ফুটতে শুরু করল। চাঁদকে হাসি-খুশি দেখে নূরও বেশ খুশি হলো। মাথা নুইয়ে চাঁদের কর্ণতলে গহীন গুঞ্জন তুলে বলল,,

“কাল আমার হলদে পাখিটাকে দেখব! আ’ম সো এক্সাইটেড চাঁদপাখি। এখনি আমার চোখের সামনে তোমার হলদেটে রূপটা ভেসে উঠছে! আহা দেখে দেখেই মন ভরে যাচ্ছে। কল্পনায় যে এতটা সুন্দর হতে পারে বাস্তবে যে সে ঠিক কতখানি সুন্দর হবে তা ভেবে ভেবেই আমি তোমার নামের জল আরও এক গ্লাস খাচ্ছি!”

চাঁদ লজ্জা পেল! লজ্জায় একপ্রকার কুঁকিয়ে উঠল। নূরের বাহু আঁকড়ে ধরে মাথা নুয়ালো। অনুরাগ মেশানো গলায় বলল,,

“আমিও কাল আমার নূরকে হলুদ পাঞ্জাবীতে দেখব। আবারও নতুনভাবে, নতুন করে, নুতন অনুভূতি নিয়ে তার প্রেমে পড়ব। এক পুরুষের প্রেমে আমি কোটি কোটি বার পড়ব! আর এই অনুভূতিটাই আসলে অদ্ভুত সুন্দর হয় নূর।”

এরমধ্যেই নীড় এবং সোহানী দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে চাঁদ এবং নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। সোহানীর চোখে-মুখে হাসি খুশির ঝলক খেলে উঠল। ছটফটে গলায় সে চাঁদকে বলল,,

“এই চাঁদ। লেহেঙ্গাটা কোথায়? নীড় পেমেন্ট করবে বলেছে।”

নীড়ও সোহানীর কথায় কথা টেনে বলল,,

“চাঁদ তুমি কী বলো তো? তোমার কী লাগবে না লাগবে আমাকে বলবেনা একবার? আমি কি শুধুই তোমার জিজু? কাজিন নই?”

নূর ঈষৎ হেসে নীড়ের কাঁধে হাত রাখল। বিষয়টা বুঝতে পেরে সে স্থির গলায় বলল,,

“ইট’স ওকে ভাইয়া। আমি লেহেঙ্গাটা চাঁদকে গিফট করেছি। পেমেন্টও করে দিয়েছি। প্লিজ তুমি এত হাইপার হয়ো না।”

তৎক্ষনাৎ সোহানী এবং নীড় সন্দেহজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নূরের দিকে! সঙ্গে সঙ্গেই নূর দৃষ্টি জোড়া নামিয়ে নিলো। লজ্জাবোধ কাজ করতে লাগল তার। চাঁদ ভ্রু কুঁচকে নীড় এবং সোহানীর দিকে তাকালো। রুক্ষ গলায় বলল,,

“তোমরা এমন একটা ভাব করছ মনে হচ্ছে যেনো তোমরা কিছুই জানো না। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি ওকে? কিছুদিন পর আমরাও বিয়ে করব। তোমাদের চেয়েও বড়ো অনুষ্ঠান করে বিয়ে করব বুঝছ? তখন তোমরা সবাই তাক লেগে থাকবে।”

উপস্থিত তিনজন তাজ্জব দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। নূরও প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! কিছুই যেনো আটকাচ্ছেনা তার মুখে। মাইকের মতো শুধু পাবলিসিটি করেই চলছে! গোলা বারুদের ন্যায় মুখ থেকে বারুদ উড়ছে। আর কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চাঁদ হয়তো মুখটা আরও চালাবে। যা নূরকে তীব্র লজ্জার মুখোমুখি ফেলে দিবে। চাঁদের ডান হাতটা শক্ত করে ধরে নূর লেজ গুটিয়ে জায়গা থেকে পালালো। দ্রুত গলায় চাঁদকে বলল,,

“আরে চলো চলো কসমেটিকস কর্ণারে যাই! কত শপিং বাকি আছে বলো তো।”

___________________________

রাত প্রায় পৌনে দশটা বাজতে চলল ঘড়িতে। বিয়ের সমস্ত শপিং শেষ হতে হতে রাত অনেকটা বেড়ে গেল। ক্লান্তি, অবসন্নতা, ক্ষুধা সব এক সঙ্গেই তাদের দেহে গজিয়ে উঠল। তাকানো যাচ্ছেনা ঠিক কারো দিকে। একেকজন ত্যাড়া ব্যাকা হয়ে যাচ্ছে। তাই দায়িত্ব নিয়ে নীড় আশে পাশের একটি রেস্টুরেন্টে সবাইকে নিয়ে খেতে বসল। যে যার মতো অর্ডার করতে লাগল। নূর গেল ওয়াশরুমে। কাজ শেষ করে নূর ফোন হাতে নিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো। টেবিলে বসে থাকা মাহিন এবং আয়মনকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো! চোখে-মুখে ঘোর আতঙ্ক ফুটিয়ে তুলল। সামনের চুল পেছনে টেনে ধরে উত্তেজিত গলায় বলল,,

“হসপিটালে চল। সাদমান সু’ই’সা’ই’ড করতে চেয়েছিল!”

#চলবে…?