বিন্নি ধানের খই পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
334

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৩
#মিদহাদ_আহমদ

মদ খেয়ে মাতাল হয়ে উঠা যে স্বামীকে নিয়ে আমি আমার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি নতুন করে, সেই স্বামী যখন আরেকটা মেয়ের স্কেচ দেখিয়ে বললো, ‘সে আমার প্রেমিকা’ আমি তখন একেবারে থমকে গেলাম। স্থির বয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বারান্দার লাল সাদা লাইটের ভেতরে আসিফের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেমন জানি প্রফুল্লতা কাজ করছে তার মধ্যে! আমি আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করার মতো সাহস আর পেলাম না। যাকে বলে একেবারে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া! আসিফ নিজ থেকেই বললো,

‘আমি যখন ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছি জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে, তখন সেই মেয়েটার সাথে আমার পরিচয়৷ ঠিক পরিচয়টা বলতে গেলে, আমরা একসাথে বাসে আসা যাওয়া করতাম। সে ক্লাস এইটে তখন। মিষ্টি একটা মেয়ে। একটা মেয়ের মধ্যে যে বাচ্চামো স্বভাবগুলো আঁকড়ে থাকে একটা বয়স অবধি তার মধ্যে এগুলো ছিলো না। আমিও টিনেজ। নতুন করে সবকিছুতেই ভালোলাগা কাজ করা শুরু করেছে। সারাদিন স্কুলে ক্লাস শেষে যখন স্কুলের বাসে করে বাসায় ফিরতাম, তখন প্রতিদিন ওকে আমার অপজিট সাইটের সিটে বসে থাকতে দেখতাম। এই শুরু। তারপর কত কেচ্চা কত কাহিনী! আমাদের মাঝে একটা সুন্দর বন্ডিং হয়ে গেলো। আমি তাকে প্রপোজ করলাম পরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। এই দিনটাও ছিলো স্পেশাল। সে ভালো নাচ জানতো। স্কুলের অডিটোরিয়ামে তার একক নৃত্য হলো। কী তাল! কী লয়! গানের সাথে ওর নাচে যেনো এক মোহনীয় আবেশ নিয়ে এলো গোটা মহলে! আমার আগে থেকেই তার সবকিছু ভালোলাগে। সেদিনের ভালোলাগার পর আর আটকাতে পারলাম না নিজেকে। তাকে সরাসরি বলেই দিলাম নিজের ভেতরে কথাটা। দিন দুয়েক পর সাইন পেলাম, সে রাজি। আমি একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে বসলাম!’

এই বলেই আসিফ চুপ করে গেলো। আমি নিরবে তার কথা শুনে যাচ্ছিলাম। মাঝখানে কোন কথাই আমি বললাম না আর। আসিফের এই চুপ করে থাকার সিদ্ধান্তে সে অনড়। কথার মাঝখানে চুপ হয়ে থাকা শুরু হলে আর কথাই শুরু হয় না। আসিফ সিগারেট ধরালো। তারপর বললো,

‘তুমি রুমে চলে যাও। এখানে থাকলে সিগারেট তোমার ক্ষতি করবে’

দরজায় নক করলো এমন সময়ে আমার ননদ। সে ঢুকে আসিফকে বললো,

‘আর এভাবে মদ সিগারেটে কতদিন সংসার করবি তুই? কিছু তো বুঝেশুনে চল এবার! মা তামান্নার বিয়ে ঠিক করছেন৷ তুই তো এসবে কোন খেয়াল রাখিস না! ছেলের বাসা থেকে ফোন করে জানিয়েছে তারা আগামীকাল পানচিনি করে ফেলতে চায়। তাদের সময় শর্ট। অনেক আয়োজন করতে হবে। তাদের কথার উপর তো আর কথা বলা যায় না।’

বোনের কথা শুনেও আসিফ কোন রিয়েক্ট দেখালো না। আমি বললাম,

‘ আপা এতো তাড়াতাড়ি? মাত্রই না তারা কনে দেখে গেলো আর এত তাড়াতাড়ি পানচিনি বিষয়টা…’

‘কেন? তোমার অসুবিধা? তোমার বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে আমার বোনের পানচিনি করছি? তোমার সব বিষয়ে এতো নাক গলাতে হবে কেন নুপুর? নাকি এইটা একটা স্বভাবে পরিণত হয়ে উঠছে তোমার?’

‘আশ্চর্য আপা! কী বলছো তুমি এসব? সে এই বাড়ির বউ। সিদ্ধান্তে তারও মতামত থাকতে পারে। আর তার মতামতে গুরুত্ব দেয়া আমাদের দরকার অবশ্যই! সে একদম ফেলনা কেউ তো না। আর কথায় কথায় বাপের বাড়ি বাপের বাড়ি এসব কী?’

‘অহ আচ্ছা! এখন তুই তোর বউয়ের হয়ে সরদারি করবি? বোনের পানচিনির কথা বলতে এলাম তখন তো কোন কথা বের হলো না মুখ থেকে। বউয়ের বিষয়ে মুখ অন? বোনের সিদ্ধান্তে তোর অফ? বাহ বাহ! বাহ!’

ননাস আমাকে শাশুড়ির রুমে যেতে বললেন।

আমি ননাসের সাথে বের হয়ে শাশুড়ির রুমে গেলাম। শাশুড়ি বললেন,

‘আগামীকাল ইফতার শেষে তারা আসবে। রাতের খাবার দাবার হবে আরকি। তোমার বাবা মাকে বলে দিও আসতে। সময়মতো ভালো কাপড়ে যেনো আসে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাদের পুত্রবধূর শ্বশুর বাড়ির লোকেদের দেখতে চাইতে পারে। আর বাসায় আয়োজন করা সম্ভব না৷ চায়নিজে আমি কথা বলে রেখছি৷ চায়নিজে সবকিছু হবে। আমাদের ওদের সব মিলিয়ে দুইশো লোক হয়ে যাবে।’

‘এতো লোক মা?’

‘এই এক জায়গায় ছোটলোকের মেয়ের সমস্যা। এতো লোক আসবে তো তোর সমস্যা কোথায়?’

আমি যেনো ভেতরে লজ্জায় লাল হয়ে যেতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম বারবার তাদের এসব কথায় নিজের কথা বলে উঠাটা কেমন মানাচ্ছে না আর। হয়তো নিজে ছোট ঘর থেকে এসেছি এজন্য অথবা আমার কাছে এসব লোক দেখানো খরচাকে অপচয় মনে হয়। এজন্যই নাকি! ভেতরে ভেতরে জাগা প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি যেনো খুঁজে পাচ্ছিনা এই মুহূর্তে!

এদিকে ভেতরে ভেতরে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে আসিফের কথাগুলো! মেয়েটা তার প্রেমিকা! এর কোন সুরাহা তো আমি করতে পারলাম না। তড়িঘড়ি করে রুমে গেলাম। দেখি আসিফ নেই। খাটে গিয়ে বসলাম। ভীষণ মন খারাপের মাঝে মাকে কল করলাম। বললাম, আগামীকাল আমার ননদের পানচিনি হবে চায়নিজে। মা জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন আছিস রে?’

মায়ের এই কেমন আছিসের উত্তর আমি আজকাল আর দিতে পারি না। ভেতরে চাপা কষ্ট নিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারর না। মাকে বললাম,

‘ভালো ঘর, ভালো বিছানা, তিনবেলা খাবার, নাকে হীরার নাকফুল, হাতে স্বর্ণের চুড়ি। এইতো আছি। তোমার স্বপ্নের মতোই সুখে আছি মা।’

‘মায়ের উপর এখনও রাগ কাটেনি রে মা? আগামীকাল আসার সময়ে ঈদের কাপড়চোপড় নিয়ে আসবো। তোর বাবা আবারও চড়া শোধে ঋণ এনেছে। সবকিছু তোর শাশুড়িও চাহিদামতো হবে। গতদিন তোর ছোটভাই তোর বাবার সাথে গিয়েছিলো না তোদের বাসায় ইফতার নিয়ে? তখন সে শুনে ফেলেছে তোর শাশুড়ির চাহিদাগুলো। আমিও তোর বাবা কে বুঝিয়েছি। দেখিস মা, তোর মুখ যাতে উঁচু থাকে এর সব ব্যবস্থা আমরা করবো। ‘

আমার মাথা আর জায়গায় রইলো না। আমি মাকে আচ্ছামত কথা শুনিয়ে দিলাম কতক্ষণ। কথাগুলোর সারমর্ম ছিলো এমন যে,

‘আমার বয়স্ক অসুস্থ বাবার ঘাড়ে যে এই ঋণের বোঝা চাপাচ্ছো, এগুলোর খেসারত তো তাকেই দিতে হবে তাইনা? নাকি এগুলো তুমি দিয়ে দিবা? তোমার ভাই দিয়ে দিবে? বড়লোক ঘরে মেয়ে বিয়ে দিয়েছো এটাই তো অনেক তাইনা? এখন বারেবারে এই সেই এইটা সেইটা দিতে দিতে নিজে মরে যাবা নাকি?’

আমি শেষমেশ সোজা না করলাম যে ঈদের আগে যেনো কোন কাপড়চোপড় না দেয়। আমার কথাগুলো কখন যে আমার ননাস এসে শুনছিলো দরজায় দাঁড়িয়ে আমি আর সেদিকে খেয়াল করিনি। রুমে ঢুকে বললো,

‘তোমার বাবা মা যখন দিতে চাইছেন, দিতে পারছেন তখন কেন তাদের না করলা? এসব নিয়ম সব বাবারাই পালন করে। এগুলো নতুন কোন নিয়ম না।’

আমি বললাম,

‘আমার অসুস্থ বাবাকে আমি আর অসহায় দেখতে চাই না। এই নিয়মের মধ্যে আমি থাকতে পারবো না।’

আমার এই মুখের উপরে বলা কথা শুনে আরও কিছু কথা শুনিয়ে আমাকে রুম থেকে ননাস চলে গেলো। আমি বিছানায় আড়মোড়া দিয়ে শুয়ে রইলাম। মাথায় ঝিম ধরে বসেছে যেনো চিন্তার পাহাড়। অবসন্ন শরীর যেনো নিস্তেজ করে দিচ্ছে আমার মন মানস। আমি যেনো আর কাজ করার শক্তি পাচ্ছি না। বারবার মাথায় ঘুরতে, কে সে মেয়ে! আমাকে জানতেই হবে।

রাতে কখন আসিফ রুমে এসেছে আমার আর খেয়ালে ছিলো না। এখন বাজছে সকাল দশটা। আসিফ বেহুশের মতো শুয়ে আছে। বিছানার উপর মদের খালি বোতল, সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার, ইয়ারফোন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। গিটারটা মাটিতে পড়ে আছে। গিটার তো এখানে থাকার কথা না। রিডিং রুম থেকে নিশ্চয়ই আসিফ গিটার নিয়ে এসেছে! তাহলে রাত্রে ঠিকই গান করেছে সে। আমি কি এতোই গভীর ঘুমে ছিলাম যে গিটার দিয়ে বাজানো গানটাও শুনতে পারিনাই! গিটারটা তুলে এক পাশে রাখলাম। আসিফ খালি গায়ে শুধু হাফ প্যান্ট পরে শুয়ে আছি। তার উপর একটা কাঁথা টেনে দিলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসতেই দেখি বাড়িভর্তি মেহমান। সব আসিফের মামার বাড়ির লোকজন! আসিফের মামি আমাকে দেখে বললেন,

‘কী নুপুর? শ্বশুরবাড়িতে কখন ঘুম থেকে উঠা লাগে এর তামিজ জানো না? রমজান মাস তো কী হয়েছে? এখন বাজে কয়টা? আমরা মেহমানরা এসে বসে আছি সকাল আটটা থেকে। আজ তোমার ছোট একমাত্র ননদের পানচিনি। বাসা ভর্তি লোকজন থাকবে কাজ থাকবে। এসব দেখতে হবে না নাকি?’

শাশুড়ি তার ভাইর বউকে বললেন,

‘তা আর বলো না ভাবি। কী এক বউ এনেছি কোন কাজের না। ‘

ননদ এসে ডাক দিলো আমাকে। রুমে নিয়ে বললো,

‘কুসুম গরম পানি এনে আমার পা একটু ধুয়ে মাসাজ করে দাও ভাবি। কুসুম গরম পানি দিয়ে পা পরিস্কার করে মেহেদি দিব।’

আমি বললাম,

‘এই কাজটা তো তুমি নিজেও করে ফেলতে পারো তাইনা?’

‘তুমি করে দিলে সমস্যা?’

‘সমস্যা তো আমি বলিনি।’

আমার ননাস এসে হাজির হয়ে গেলো সেই সময়েই। বললো,

‘এই সামান্য কাজটা করে দিতে তোমার প্রবলেম নাকি নুপুর? আশ্চর্য! ‘

আমি আর না করলাম না। কুসুম গরম পানি দিয়ে আমার ননাসের পা ধুয়ে দিলাম। এমন সময়ে রুম থেকে শুনতে পেলাম আমার শাশুড়ি কাকে যেনো বলছেন,

‘এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন আপনারা? আপনাদের তো দাওয়াত দিয়েছি ইফতারের পরে, রাত্রের৷ এখন ইফতারের আগে দিন দুপুরে চলে এলেন যে!’

‘না আসলে চলে এসেছি নুপুর বলেছে যে তাড়াতাড়ি আসতে তাই!’

আমার মায়ের গলা শুনে আমি বেরিয়ে আসলাম ননদের রুম থেকে। চোখ ভরে কান্না চলে এলো আমার। বাড়িভর্তি লোকের সামনে আমার শাশুড়ি আমার মাকে এভাবে অপমান করছেন! মেয়ে হয়ে এ যেনো আমার বাধ ভাঙ্গার বেলা চলে এসেছে!

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৪
#মিদহাদ_আহমদ

নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না৷ শাশুড়িকে বললাম,

‘আপনার মেয়ের বাড়িতে আপনি যেকোন সময়ে যাওয়ার অধিকার রাখনে না মা?’

আমার কথা শুনেই আমার মামি শাশুড়ি হায় হুতাশ করা শুরু করে দিলেন৷ ঝরঝরে কথায় বলতে লাগলেন,

‘আরে আরে আরে! ঘরভর্তি মানুষের সামনে মেয়ের মুখের কথা দেখো! একী আদব কায়দা! আমরা আমাদের শাশুড়ির সামনে মাথার কাপড় নামাইনি আর এই মেয়ে দেখছি শাশুড়ির পায়ের তলার মাটি খুঁড়ছে এসে! দুনিয়া কই গেলো। গেলো রে গেলো। এগুলা কেয়ামতের আলামত। তা আপনি কি আপনার মেয়েকে সামান্য ভদ্রতাটুকু শেখাননি? মেয়ে এমনিই সিংলার ডালের মতো তড়তড় করে বেড়ে উঠেছে?’

শেষের কথাগুলো আমার মাকে বললেন মামি শাশুড়ি। আমার মা একেবারে নিশ্চুপ। তার চোখদুটো টলমল করছে একেবারে। আমি মামি শাশুড়িকে বললাম,

‘এই একই প্রশ্ন আপনার জন্যও মামি। আপনি কি আপনার মেয়ের বাড়িতে তিথি নক্ষত্রে মেনে যাবেন? আপনাদের কারো লজ্জা শরম নাই? আর আদব শেখানোর কথা আমাকে বলছেন? এই একই কথা যদি আপনাকে বলি? যদি বলি আপনাকে আপনার বাবা মা আদব শেখায়নি?’

‘চুপ করো নুপুর। তুমি কীভাবে কথা বলছো আমার মামির সাথে। মেহমানদের ভদ্রতার সাথে ট্রিট করতে হয় এইটা জানো না? নাকি এই জানাটুকুর মাঝেও কোন অজানা কাজ করছে?’

ননাসের কথা শুনে সামনে গিয়ে বললাম,

‘আপা তোমার কথাতেই তাহলে বলি। মেহমানদের সাথে কীভাবে ট্রিট করা লাগে এইটা এই ঘরের লোকজন কেউ জানে না? নাকি জানিয়ে দেয়া লাগবে? কোনটা? নাকি শিখিয়ে নিতে হবে আমাকে?’

আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন,

‘আমি চলে যাচ্ছি রে মা। তুই আর কোন কথা বাড়াস না এখন।’

আমি আরও ভারসাম্য হারিয়ে বসলাম। বললাম,

‘কেন? কেন চলে যাবে তুমি? এইটা তোমার মেয়ের বাড়ি। এই বাড়িতে এসে তোমার সম্মান আর অসম্মান আমার সম্মানের সাথে জড়িত। এখানে তোমার মেয়ের যে সম্মান, সেই সম্মান তোমাকেও পেতে হবে।’

শ্বশুর হাক ছাড়লেন এবার। এসে বললেন,

‘এই গরমের দিন, তার উপর রমজান মাস। বাসায় মেহমান এসেছে। তোমরা কী শুরু করলে এসব? বেয়ান আপনি আসুন। ভেতরের রুমে গিয়ে বসুন। ‘

শ্বশুর আমার মাকে ভেতরের রুমে বসতে বললেন।আমিও আর কথাগুলো চেপে গেলাম। ঘরভর্তি মানুষের সামনে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করলো না। আমার মা রুমে গেলেন। শাশুড়ি শুধু ফিসফিস গলায় বললেন,

‘এই পানচিনি হয়ে যাক ভালোয় ভালোয়। তারপর দেখবো কার বাড়ন্ত এই ঘরে কীভাবে থাকে।’

সব কাজকাম শেষে বিকালে আমি আমার রুমে যাবার অবকাশ পেলাম। আসিফ পেপার পড়ছে। আমাকে আসিফ জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছিলো দুপুরে?’

আমি জবাব দিলাম না। সে আবার জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছিলো দুপুরে?’

এবার বললাম,

‘কিছু না।’

‘কিছু না মানে?’

‘কিছু না মানে কিছু না।’

‘আশ্চর্য! আমি যে শুনলাম…’

‘শুনলে তো ঠিকই আছে। যা শুনেছো তাই। আমি সব অপমান, সব ঘৃণা সহ্য করে আছি। এর কারণ, আমি মেয়ে। আমাকে স্বপ্ন দেখতে নেই, আমাকে বাঁচতে নেই। আমাকে বড় হতে নেই। আমাকে আল্লাহ রূপ দিয়েছেন, সুন্দর করে বানিয়েছেন। এই সুন্দরের দামে আমার বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। আমার তো এটুকুই অনেক। এরচেয়ে বেশি আশা করাই তো ঠিক না আমার। আমি স্বামী, সংসার, ঘর এসব নিয়ে সব অপমানের সাথে ঘর করতে রাজি হয়েছি। এইতো আমার জীবন।’

এক নাগাড়ে বললাম কথাগুলো। কয়েক মিনিট আসিফ নীরব হয়ে গেলো। তার এই অদ্ভুত কাজগুলো আমাকে ভাবায়। আমাকে প্রফুল্লচিত্তে বিস্ময়ের জন্ম নিতে বাধ্য করে। মানুষটা তার ভেতরে কী চেপে রাখে সে নিজেও হয়তো জানে না। তারপর আবার বললো হুট করে,

‘আমার স্বপ্নগুলো আমি সেই মেয়েটার সাথে শেয়ার করতাম। তাকে ভালোবাসতাম যে ভীষণ! আমাদের দুজনের মিল ছিলো অনেক। তার ইচ্ছা ছিলো নাট্যকলা নিয়ে পড়বে। অন্যদিকে আমার চারুকলা। দুজনের মধ্যে এই সংস্কৃতির বিচরণের জন্য একে অপরের প্রতি আগ্রহ আমাদের সমান তালে ছিলো। মাঝেমধ্যে পড়াশোনার ফাকে যখন টুকটাক ফিগার ড্রইং, স্কেচ বানাতাম তখন সেই মেয়েটা হা হয়ে দেখতো। প্রতিবার তারিফ করতো আমার। বাসার অবস্থা যখন তাকে বলতাম, যখন তাকে জানাতাম যে বাসায় চায় আমি ইঞ্জিনিয়ার হই, তখন সেও আমাকে না করতো। আমাকে বললো, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেনো আমি কিছুই না করি। তার এই সাপোর্টিভ মনোভাবের জন্য আমার ভেতরে পুষে রাখা আগ্রহটা একেবারে প্রস্ফুটিত হতে লাগলো যেনো! স্কুলে আর্ট এক্সিবিশনে আমার আর্ট সেরা ঘোষণা হয় সেইবার। অন্যদিকে কালচারাল এওয়ার্ড এ স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয় নুপুর।’

এবার আমার কথা যেনো শুরু হলো।

‘ নুপুর?’

‘হ্যাঁ। আশ্চর্য না?’

‘কী আশ্চর্য! আমি তো কোনকিছু বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলছো এসব?’

আসিফ শুরু করবে করবে এর আগেই শাশুড়ি ডাক দিয়ে নিয়ে গেলেন আমাকে। ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে ইফতার রেডি করতে হবে।

বাসায় আসা আসিফের মামার বাড়ির সব লোকজন বসে আছে ড্রইংরুম ও ডায়নিং রুমে। আমি ইফতার রেডি করছি। খেয়াল করছিলাম আমার মা, ভাইকে কেউ ডাক দেয় কিনা। কিন্তু না। ইফতারের সময় প্রায় হয়ে আসলো। আমার ননাস একে একে সবাইকে নিয়ে এনে বসালো টেবিলে। আমার মাকে আর ভাইদেরকে কেউ ডেকে আনলো না। আমিই অগ্যতা রুমে গিয়ে তাদের ডেকে আনলাম। আমার ভাইদেরকে শাশুড়ি ড্রইংরুমে যেতে বললেন। তারা সেখানে চলে গেলো। বিশ সিটের ডায়নিং টেবিলের যে কোণায় আমার মা বসেছিলেন, সেই সাইডে শাশুড়ি এসে আমার মাকে তুলে কাঠের চেয়ার সরিয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন,

‘বেয়ান সমস্যা হবে না নিশ্চয়ই? ওই আমার মেয়ের শাশুড়ি এসেছেন তো। ওদিকটায় একটা চেয়ার শর্ট৷ তাই এইটা নিয়ে নিচ্ছি।’

পুরো ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে ঘটছে। আমার মা মুখে হাসি এনে বললেন,

‘আরে না। কোন সমস্যা নাই। ঠিক আছে বেয়ান ‘

আমার ননাসের শাশুড়ি ইফতারের বসার আগেই আমার শাশুড়িকে বললেন,

‘আপনার সাথে কিছু কথা আছে বেয়ান। ইফতার করতে আসিনি আসলে।’

আমার শাশুড়ি বললেন,

‘আরে ইফতার করতে আসেননি মানে? আপনারাই তো আমাদের চিফ গেস্ট। এখন আজান হয়ে যাবে। আপনার জরুরী কথা আমি পরে শুনবো। নুপুর তুমি আমার সাথে রান্নাঘরে চলো৷ মাল্টা কাটা হয়নি এখনও।’

আমি রান্নাঘরে গেলাম। সাথে সাথে আমার ননাস ও শাশুড়িও এলেন। ননাস শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী বলেছে ওই কুটনা বুড়িটা? সারাদিন পা খেয়ে খেয়ে জর্দা নিচে ফেলে আর আমাকে ক্লিন করতে হয় বুঝছো! ওই কুটনা বুড়িটা মরলে তবে শান্তি পাবো।’

‘আরে আরে আরে! আস্তে কথা বল। যদি কেউ শুনতে পায় তাহলে…’

‘শুনলে শুনুক। আমি আগেই বলেছিলাম তোমাকে এমন ঘরে দাও যেখানে কেউ নাই। একা একা। কিন্তু না। কী করলা? দিলা যেখানে লোকভর্তি পরিবার৷ অন্যরা তো ঠিক আছে কিন্তু কুটনা বুড়িটাকে আমার অসহ্য হয়ে যায়।’

শাশুড়ি তার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন এবার,

‘কুটনা বুড়িটা এলো কেন তাহলে আজ? এমনি এমনি তো তাকে দাওয়াত কেন, গাড়ি পাঠিয়েও নিয়ে আসা যায় না। আজ চলে আসলো তাকে ইফতারের দাওয়াত না দিতেই!’

আমার মুখ আর আটকালো না এবার। বলেই ফেললাম মনের কথাটা। বললাম,

‘আমার মা আর আপার শাশুড়ি দুজনেই তো সম্পর্কে আপনার এক সমান কুটুম। কিন্তু আমার মা চলে আসলে অপমান করতে হয়, প্লাস্টিকের চেয়ারে আমার মাকে বসিয়ে আপার শাশুড়িকে কাঠের চেয়ারে বসাতে হয়, এই দুই নীতির মানুষ যে এখনও আছে সেইটা আমার জানা ছিলো না।’

আমার কথায় শাশুড়ি আর ননাস চুপ মেরে গেলেন। শাশুড়ি এবারও বললেন মিনমিন করে,

‘যখন খেল দেখাবো তখন বুঝবা এই বাড়ন্ত মুখের খেসারত কীভাবে দেয়া লাগে।’

আজান হয়ে গেলো। ইফতার শেষ হলো। ইফতার শেষ হতে না হতেই আমার ননাস আমার ননদকে সাথে করে বের হয়ে গেলো পার্লারের উদ্দেশ্যে। আমি রুমে চলে এলাম। আসিফ জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি পার্লারে যাও নাই?’

‘না।’

‘কেন?’

‘কেউ আমাকে বলেনি তাই।’

আসিফ তখনই রুম থেকে বের হয়ে তার মায়ের রুমে গেলো। আমি পেছনে পেছনে গেলাম৷ বাড়িভর্তি লোকের সামনে সে নতুন কোন কান্ড করে না বসে। আসিফ মায়ের রুমে গিয়েই জিজ্ঞেস করলো,

‘ওকে নিয়ে পার্লারে গেলে কী সমস্যা ছিলো?’

শাশুড়িও তেড়ে এলেন। বললেন,

‘তোর বউয়ের ভাত দিচ্ছি, কাপড় দিচ্ছি, তোর মদের টাকাও নিচ্ছিস আমাদের ফ্যামিলি বিজনেস থেকে, দুই টাকা রোজগার করার মুরোদ আছে তোর? বউকে আবার পার্লারে পাঠাবি? এত শখ হলে নিজের টাকায় বউকে পার্লারে নিয়ে যা। আর নাহলে ঘরে চুপটি মেরে বসে থাক!’

শাশুড়ির এই কথাটা শুনে আসিফ তার রুমে চলে এলো। পেছনে পেছনে আমিও এলাম। শাশুড়িকে শুধু বলে এলাম,

‘আপনি তো জানেন ই আপনাদ ছেলে কেমন। এখন এই কথাগুলোর কোন নেগেটিভ ইফেক্ট যদি তার উপর…’

‘এই ছেলের না আছে বোধশক্তি, না আছে কিছু করার মুরোদ। হাতে গিটার আর আঙুলে রঙ তুলে দাও। গলা বাজবে। আর কোন কাজের না।’

আমি বলে এলাম,

‘এটাই ওর কাজের হয়ে উঠবে মা। আজ যা বলছেন শুধু শুধু কোন কাজের না, আগামীতে তাই হয়ে উঠবে ওর সবচেয়ে বড় শক্তি, সবচেয়ে বড় কাজ। দেখে নিয়েন মা। দেখে নিয়েন।’

আসিফের পেছনে পেছনে রুমে এলাম। আসিফ যখন প্রচন্ড রাগে থাকে তখন সে কেমন জানি চুপসে যায়! একেবারে নীরব হয়ে উঠে। এবারও তাই হলো। বারান্দায় যেতে যেতে বললো,

‘ওইযে গোলাপি শাড়িটা পরেছিলা না একদিন, ওই শাড়িটার সাথে খোপায় গাজরা দিও। কপালে একটা ছোট কালো টিপ দিও। তোমাকে সুন্দর লাগবে।’

আমার মাথায় বুদ্ধি কাজ করলো একটা। আসিফ এই প্রচন্ড মন খারাপ আর রাগের মাথায় নিশ্চিত সিগারেট খাবে। মদ খাবে। আমি আসিফকে বললাম,

‘আমাকে একটা জিনিস এনে দিবে?’

‘শুনেছো না মা কি বলেছে? বলেছে নিজের টাকায় এনে দিতে! নিজের টাকায়! আমার টাকা আছে? আছে আমার টাক? নাই!’

‘আছে।’

‘কোথায়?’

‘ওইযে ডায়রি, ওই ডায়রিটা আমি খুলে দেখেছি। কাল রাতেই আমি পড়েছি। আমি সব জেনেছিও। তোমার কাছে আমি নিজেই সরি বলতাম ওই ডায়রিটা লুকিয়ে পড়ার অপরাধে৷ আমি জেনেছি নুপুর কে। সে যে রোড এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে এইটাও জেনেছি৷ আর দেখো আল্লাহর কী অদ্ভুত নিয়ম যেনো! আমিও নুপুর! নুপুর তোমাকে একবার পঞ্চাশ টাকা দিয়েছিলো না তোমাকে? বাজিতে জিতেছিলে? ওই টাকাটা স্টেপলার করা আছে ডায়রিতে দেখলাম। তুমি ওই নুপুরের টাকা দিয়ে, এই নুপুরকে এক পাতা কালো রঙের টিপ এনে দিবা? আমি তোমার নুপুরের দেয়া টাকায়, তোমার কিনে আনা টিপ পরেই সাজবো!’

‘যাস্ট লিভ মাই রুম! তোমার সাহস হলো কীভাবে আমার ডায়রিটা পড়ার? আর সাহস করলে কীভাবে এই আবদারটা করার? হাউ?’

অন্যদিকে আমার ননাস তানিয়ার ননাস তার মাকে বলছে,

‘সন্ধ্যা থেকেই বসে আছো এখানে। তাদেরকে বলবা কোন সময় যে ভাইয়া আর তানিয়ার ডিভোর্সের জন্য আমরা এসেছি?

আকাশ থেকে দৈববাণীতে ভেসে এলো,

‘পীড়ন করিলে সে পীড়া এসে, পিড়িবে তোমাকেই’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৫
#মিদহাদ_আহমদ

আসিফ চিৎকার করে বললো,

‘আমার সামনে থেকে চলে যাও। এক্ষুণি চলে যাও। বিদায় হও’

আসিফের রাগান্বিত গলা শুনে আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। কেন এই জীবন আমার? যাকে নিয়ে কখনো কখনো স্বপ্ন বাধি সেই আবার দূরে ঠেলে দেয়? সে নিজেই আবার তাড়িয়ে দেয় নিজের মনকোটর থেকে? একটা মেয়ের কী জীবন মানেই এই গঞ্জনা সহ্য করা? অবহেলা অনাদরে জীবন মানিয়ে নেয়া? আমার তো জীবন এমন হওয়ার ছিলো না। এমন আমার হওয়ার কথা নয়!

শাশুড়ি বললেন,

‘আসিফের কানে কানে থাকলে এমন করেই গাল বকা খেতে হবে। নিজের অবস্থান সম্পর্কে যত আগেই ধারণা করতে পারবা, তত আগেই তোমার মঙ্গল৷ দুইবেলা খেতে পারছো, মাথার উপরে ছাদ আছে, আর এই যে দেখছো বৃষ্টির দিনেও কোন পানি টপকে ঘরে আসতে পারছে না, এতেই বা কম কিসে? নিজের বাপের ঘরে তো মেঘ বাদলার দিনে এক প্রহরও তো ঘুমাতে পারতে না। এখন পারছো! এ ও বা কম কীসে?’

শ্বাশুড়ির এহেন মতামত আমার আজকাল সব দিনই শোনা হয়ে থাকে। আজকেরটাও নতুন না৷ আজ শুধু মনে হচ্ছে, এইটা মিথ্যা হলেও পারতো! আমার এতদিনের স্বপ্ন, কল্পনা সব যেনো নিমিষেই পিষে যেতে লাগছে!

আমার ননাস তানিয়ার শাশুড়ি খোদেজা বেগম আসলেন সামনে৷ শাশুড়িকে বললেন,

‘বেয়ান একটা জরুরী কথা ছিলো আপনার সাথে। আর আজই কথা বলতে হবে।’

‘কী জরুরী কথা বেয়ান? এখন তো চায়নিজে চলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। তানিয়া তামান্নাও পার্লার থেকে সরাসরি চলে যাবে চায়নিজে। ‘

‘এর আগেই আমি আমার জরুরী কথা সেড়ে নিতে চাই বেয়ান”

শাশুড়ি বললেন,

‘আচ্ছা আপনি আমার রুমে আসুন৷ আর নুপুর, এখন আসিফের সামনে যেও না। হুদা হুদাই আজকের অনুষ্ঠান সে মাটি করে দিবে। তারপর চায়নিজে সে না আসলে আবার আরেক সমস্যা। সবাই জিজ্ঞেস করবে কনের বড় ভাই কোথায়? আমি তোর আর উত্তর দিতে পারবো না যে তার বউ তার সাথে কানাঘুষা করতে লেগেছিলো বলে আজকের আসাটাই মাটি হয়ে গিয়েছে! আমি শাড়ি এনে দিচ্ছি। তুমি আমার রুমে এসে রেডি হয়ে নিও।’

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। রান্নাঘরে গিয়ে আগামীকাল সকালের কাজ কাজের মেয়েদের গুছিয়ে দিয়ে শাশুড়ির রুমে এলাম। শাশুড়ি এর ভেতরেই শাড়ি এনে রেখেছেন তার রুমে। আমি শাড়ি পরতে ছিলাম। এমন সময়ে খোদেজা বেগম শাশুড়িকে বলতে লাগলেন,

‘বেয়ান, জানি কথাগুলো আপনি মা হিসাবে সহ্য করতে পারবেন না। তবুও আমার বলতেই হচ্ছে। কিচ্ছু করার নাই৷ আপনারা এরপর কি জানাবেন বা জানাতে আসবেনে এর কোন পরিণতি আমি জানতে চাচ্ছি না।’

শাশুড়িকে দেখলাম বেশ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে আছেন। বললেন,

‘আমার মেয়ের কি কোন ভুল হয়েছে বেয়ান?’

‘না না। ভুল তার হবে কেন? সে যে বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে না এইটা কি সে জেনেছিলো আগে নাকি আপনারা জেনেছিলেন বলেন?’

শাশুড়িকে দেখলাম একেবারে থ মেরে বসে আছেন৷ ননাসের শাশুড়ি বলা শুরু করলেন,

‘ আগামীকাল আমার ভাইয়ের মেয়ে লন্ডন থেকে আসছে। সবাই আসছে। তানিয়া চিনে সবাইকে৷ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমার ছেলের সাথে আমার ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে দিবো। আর তানিয়ার সাথে তো অনেক ভালোই চলছিলো সব। আমরা একটা নাতি চেয়েছিলাম। আর কিছু না। বিয়ের কয়েক বছর হয়ে গেলো। এখনও কোন খবর এর মুখ দেখলাম না৷ যার একবারে হয় না তার আর জীবনেও হয় না। বেয়ান সিলেটি প্রবাদ আছে জানেন তো, ‘যার সাতে হয় না তার সাতাইছেও অয় না’ ‘

শাশুড়ি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

‘বেয়ান দেখেন, এসবে কারো হাত নেই৷ আমার দুইটা মেয়ে মাত্র৷ আমি আমার জীবনে দুই মেয়ে ছাড়া আর কারো সুখের চিন্তা করি না। দেখেন এই ঘর এই বাড়ি এই সম্পত্তি সবকিছুর যদি তিন ভাগও করি, স্রেফ আমাদের এই বাড়ির জায়গাই তো আট কোটি টাকার,! এক ভাগ আপনার ছেলের হলেও তো জীবন কেটে যায়!’

ননাসের শাশুড়ি বললেন,

‘বেয়ান সব টাকা দিয়ে হয় না। আপনার আট কোটি টাকার বাড়ি আছে। গার্মেন্টস আছে, এজেন্সি আছে, ফার্ম আছে। জানি কোটি কোটি টাকার কারবার আছে। আমাদেরও কম নয় জানেন ই। আমার আরও তিন পুরুষ বসে বসে কাটাতে পারবে জীবন অনায়াসে। কিন্তু তিন পুরুষ তো লাগবে? যদি না আপনার মেয়ে এক পুরুষ না এগিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে বসে খাওয়া তো দূরে থাক, কাকদের ছিটিয়ে দিতে হবে আমাদের সব! জানি আমার কথা খারাপ লাগছে আপনার। খারাপ লাগলেও আমাদের কিছু করার নেই এখন। আমার ভাইঝি দেশে এক সপ্তাহ থাকবে। এর ভেতরেই বিয়ে দিতে হবে। আপনাকে আজ তাই জানালাম। আগামীকাল এডভোকেট ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবেন। আর তানিয়াকে বিয়েতে দেয়া এগারো ভরি স্বর্ণ ফেরত দিতে হবে না৷ কাবিনের পনেরো লাখ টাকা আগামীকাল ডিভোর্সের সাথে সাথে পাঠিয়ে দিবো।’

ননাসের শাশুড়ি কথাগুলো বলে উঠে চলে গেলেন। সাথে ননাসের ননাসও চলে গেলো। দেখলাম বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো তারা দুজন। শাশুড়ি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লেন! আমি কাছে গেলাম। শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলাম। শাশুড়ি জমে যেনো একেবারে শক্ত হয়ে আছেন!

কোন কথা বলছেন না আর।
আমি শাশুড়িকে বললাম,

‘মা আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমি সব দেখছি। আমি কোন ভাবেই আপার সংসার ভাঙ্গতে দিবো না। কোন ভাবেই না। আমি নিজে দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলবো।’

‘কোন লাভ নেই। কিচ্ছু হবে না। আমার মেয়ের সংসার আর রইলো নারে মা। আমার মেয়ের সংসার আর রইলো না।’

বলেই শাশুড়ি বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে গেলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি এই প্রথম আমার শাশুড়ির কাছে আমাকে মা বলে ডাকটা পেলাম। আমার ভেতর আত্মা কেঁপে উঠলো। শাশুড়ির এহেন নরম দিক আগে আমি দেখিনি। আমি শাশুড়িকে ধরে চোখ মুছে দিয়ে বললাম,

‘মা! এখন কান্নার সময় না। একটু পরেই সব মেহমানদের আপনাকে সামাল দিতে হবে। তামান্নার পান চিনি। আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে আর লোক জানাজানি হলে এর প্রভাব কিন্তু তামান্নার উপর এসে পড়বে। আপনি প্লিজ শান্ত হোন। প্লিজ!’

শাশুড়িকে বিছানা থেকে তুলে আমি শাড়ি পরিয়ে দিলাম৷ আমি চুলে গাজরা পড়ার জন্য রুমে গেলাম৷ দেখলাম আসিফ নেই৷ চিন্তায় পড়ে গেলাম মানুষটা গেলো কোথায়! এরকম করে সে ঠিক বারে আর নাহলে নারীতে মত্ত হয়ে উঠে! আজও কি সেখানে গেলো!

আটটা নাগাদ বাসার গাড়িতে করে আমি আর শাশুড়ি চায়নিজে চলে গেলাম। বাসার সব মেহমানও চলে এলো৷ শাশুড়ির মুখে চিন্তার ছাপ। আমি তাকে চিন্তা করতে নিষেধ করলাম। শাশুড়ির মুখে হাসি নেই তবুও!

এদিকে আমরা যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মাথায় আমার ননাস আর ননদ পার্লার থেকে চলে এলো। ননাসকে দেখেই আমার শাশুড়ি জড়িয়ে ধরলেন। তারপর সে কী কান্না! বাচ্চাদের মতো করে! আমার ননাস মাকে ছাড়িয়ে বললো,

‘কী হলো? আমাকে বিদায় করছো না। আর তামান্নাকেও তো আজ বিদায় করে দিচ্ছো না। আজ দেখি মায়ের আবার বড় মেয়ের জন্য দরদ শুরু! কান্না করছো কেন?’

শাশুড়ি আর জবাব দেয়ার অবস্থায় রইলেন না। লাল লাল চোখ। আমি চোখ মুছে দিলাম। ননদ বললো

‘তোমার এত দরদ দেখাতে হবে না ভাবি৷ এখানে লোক দেখানোর জন্য এসব করছো ঠিক ই বুঝা যাচ্ছে।’

ননাসও কথা শুনিয়ে দিলো আমাকে। একবারও সে অপেক্ষা করলো না আজকের দিনটা ভেবে!

কিছুক্ষণের মাথায় বর পক্ষের সবাই চলে এলো। ঘরের সবাই একসাথে বসে আমার ননদের মোহরানা ঠিক করতে লাগলো৷ আমার ননাস আমার শাশুড়িকে বললো কানে কানে,

‘বড় অঙ্কের মোহর ঠিক করো মা। আজকালকার বিয়েতে এসব গ্যারান্টি নাই। মোহরানা বেশি হলে কেউ যেই সেই করে ছেড়ে দিতে পারে না। আমার পনেরো ছিলো, তামান্নার ত্রিশ ধরো।’

আমি পাশে থেকে মনে মনে বললাম, আমার ননাস জানে না তার সংসার যে ভাঙ্গতে চলেছে। তার পনেরো লাখ টাকার মোহরেও বিয়ে ঠিকছে না আর। হায়রে মানুষের গরিমা! হায়রে মানুষের চাওয়া!’

বড়দের মাঝখানে গিয়ে ননাস দাবি ছাড়লেন বিয়েতে মোহর ত্রিশ লাখ আর স্বর্ণ যার যার ইচ্ছা মাফিক নির্ধারণ করতে। বলে দিলেন স্বর্ণ সুন্দর। তারা তাদের পুত্রবধূকে যা ইচ্ছা তাই দিবেন৷ বেশি দিলে তাদের সুন্দর! আদতে তো আপনাদের ঘরেই যাবে৷ আমরা তো আর এগুলো রেখে দিবো না। যাই যাবে, আপনাদের। আমাদের বলে কিছু নেই, কিছু দাবিরও নেই। আর জানেন ই তো, মেয়েদের একটু আধটু ইচ্ছা থাকেই এসবে। সব মেয়েরাই গহনা গায়ে জড়াতে পছন্দ করে। নতুন বিয়ে হলে তো এই শখটা আরও একটু বেশি মাথা চড়া দিয়ে উঠে তাইনা?

এদিকে তামান্নার হবু ননাস বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। স্বর্ণ যা দেয়া হবে তা আবার মোহর থেকে কর্তন হবে।’

আমার ননাস বললেন,

‘না না৷ আমারও তো কর্তন হয়নি। এগুলা তো উপহার হিসাবে…’

‘না। আমাদের এখানে কর্তন হয়।’

এসব বিষয়ে বিস্তর আলাপ শেষে, মোহর সাতাশ লাখ আর স্বর্ণ উপহার হিসাবে বিয়ে ঠিক হলো। রোজা শেষ প্রায়। ঈদের এক সপ্তাহের মাথায় বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো৷ আমার ননদ তামান্নার ননাস বললো

‘বিয়ে যখন ফিক্সড তাহলে এবার রমজানে আমরা আমাদের ভাইর বউর বাড়ি থেকে ইফতারি খাচ্ছি তো?’

আমার শ্বশুর বললেন,

‘ঝিয়ারি বেটি ইতা আর কওয়া লাগবোনি খউছাইন? আমি কাইলকু হাইঞ্জাবালা আইরাম। তোমাতানোর গোষ্ঠীগাড়া হক্কলরে লইয়া খাইলিবায়নে ইফতার। (এইটা সিলেটি ভাষা। এর শুদ্ধ বাংলা হলো,’ মেয়ে এগুলো আর বলা লাগবে বলো? আমি আগামীকাল সন্ধ্যায় আসছি। তোমাদের বংশের সবাইকে নিয়ে ইফতার করে ফেলবে।)’

এসব দেয়া নেয়ায় একটা বিয়ে ঠিক হলো। অন্যদিকে আমি আমার ননাসের স্বামীর নাম্বার এনে যোগাযোগ করলাম ওনার সাথে। ওনাকে বললাম,

‘যে করেই হোক আজ রাতের মধ্যে যেনো আমার সাথে যোগাযোগ করেন। জরুরী কথা আছে।’

কলে কথা বলে ভেতরে যাবার রাস্তায় এক কোণে কয়েকটা ছেলেকে দেখতে পেলাম। আমি পেছন থেকে স্পষ্ট শুনলাম একটা ছেলে বলছে,

‘তামান্নাকে আমার না হলে আর কারোর হতে দিবো না আমি। আমি তাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি বাঁচতে পারবো না।’

কথাগুলো শুনে আমি ভিমড়ি খেয়ে গেলাম। পথ আটকিয়ে সামনে এলো আসিফ। এতক্ষণ সে কোথায় ছিলো! আসিফের পরনে মোদি কোর্ট আর প্যান্ট। গোলাপি রঙের! আমার সাথে ম্যাচিং! পায়ে নাগরা৷ হাতে ঘড়ি। চুলগুলো একপাশ থেকে অন্যপাশে গিয়ে পড়ছে যেনো! তাকে দেখতে আজ আরও সুন্দর, আরও আকর্ষণীয় লাগছে৷ আমার চোখ আটকে থাকলো আসিফের দিকে। আসিফ আঙুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে বললো,

‘কী? কী? এমন তাকাচ্ছো কেন?’

আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। আসিফ তার পকেট থেকে একটা টিপের পাতা বের করে একটা টিপ নিলো হাতে। আমার কপালে একটা টিপ পড়িয়ে দিয়ে বললো,

‘এখন তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। কালো টিপ, গোলাপি শাড়ি, সাদা গাজরা! খুব মানিয়েছে তোমাকে। আর সরি আজকের বিহেইভের জন্য৷ এই আমি কান ধরলাম’

আমার সব অনুরাগ, সব কষ্ট, সব অপ্রাপ্তি নিমিষেই যেনো গলে গেলো!

নারীরা এত সহজ কেন! যখন ইচ্ছা কঠোর হয়, কখনোবা গলে হয় জল! এই উঠানামার জীবনেই কি আসল নারী জীবনের স্বাদ?

(চলবে যদি আপনারা চালাতে চান…)