বিন্নি ধানের খই পর্ব-১৯+২০+২১

0
337

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_১৯
#মিদহাদ_আহমদ

‘আপনার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবে না।’

ডাক্তার কথাটা বললেন তানিয়া আর তানিয়ার স্বামীকে। তানিয়া তার স্বামীর হাত শক্ত করে ধরলো। ডাক্তারকে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘আর কি কোন চান্স নেই?’

ডাক্তার এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন তানিয়ার দিকে। বললেন

‘জানি এই পরিস্থিতি এক নারী জীবনে সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি করে। একজন নারী মা হয়েই পূর্ণতা লাভ করে এটা আমাদের ধারণা। আর যদি ডাক্তারের ফিলোসোফি থেকে বেরিয়ে এসে আমি বলি, তাহলে এটা আমারও ধারণা। তবে ডাক্তারের অবস্থান থেকে বলবো, এটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিন। আপনি মা হতে পারবেন না এটা আপনার দোষের কিচ্ছু না৷ উপরওয়ালা যা নির্ধারণ করেছেন আমাদের জন্য, তাই তো হবে।’

তানিয়ার স্বামী ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,

‘সমস্যাটা কোন জায়গায় তাহলে?’

‘mixed Turner syndrome। এগুলোর fertility এর treatment আমাদের দেশে নাই। অন্য দেশেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফেইলর হয়। তবুও আশা থাকে। আশায় মানুষ বাঁচে। এরচেয়ে বড় বাঁচা আর হতে পারে না জীবনে৷ তারপর এই বাঁচাকেই অবলম্বন করে মানুষ গড়ে তুলে তার স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্খা সবকিছু। এছাড়া থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে বা Prolectine হরমোন বেড়ে গেলে ডিম্বাণু পরিস্ফুটন নাও হতে পারে বা বড় নাও হতে পারে। আপনাদের ক্ষেত্রে এই শেষের সমস্যাই প্রকট হয়ে উঠেছে৷ এই সমস্যার কারণেই আপনার মিসেস আর কখনো মা হতে পারবেন না। আই এম সরি।’

তানিয়া তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরলো।

ননাস আর ননাসের স্বামী বাসায় আসতেই আমার শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী বলেছে ডাক্তার? কী বলেছে?’

আমি দেখলাম আমার ননাস জমে শক্ত হয়ে আছে। কোন ফিল তার মাঝে নাই যেনো। সে আর কথা বলছে না।

ননাসের স্বামী আমার শাশুড়িকে বললেন,

‘তানিয়া আর মা হতে পারবে না কখনো’

শাশুড়ি মাটিতে বসে শুরু করে দিলেন মরাকান্না। মাটিতে বসা অবস্থাতেই চেয়ার পা দিয়ে ঠেলে আমার দিকে ফেলে দিলেন৷ আমি চেয়ার ধরলাম। আমার উপর পরলো না। শাশুড়ি বললেন,

‘এই অলক্ষ্মী অপয়া মেয়ের জন্য সব হচ্ছে। সবকিছু এই মেয়েটার জন্য। আমি ঘরে এক ডায়নি এনেছি৷ কাল নাগিনী এনেছি৷ এই মেয়েটা আসার পর থেকে এক এক করে এসব অনাচার হচ্ছে।’

ননাস চোখের সামনে তার রুমে চলে গেলো। ননদ এসে মায়ের সাথে আমাকে যা তা বলতে শুরু করলো। আমি নাকি একটা কালো গ্রহের ছাপ নিয়ে এসেছি, আমার ভাগ্যে নাকি তাদের ফ্যামিলির সাথে এত বিড়ম্বনা হচ্ছে। তারা কষ্টে পড়ছে, তাদের সম্মানহানি হচ্ছে। ননদ বললো,

‘মাতাল ভাইকে ঠিক করার জন্য এনেছিলো মা তোমার মতো গরীব ঘরের মেয়ে। আর তুমি কী করছো? এসব?’

ভেতর থেকে আসিফ উঠে এলো। আমি আসিফকে কথা বলতে আটকালাম। আমার মনেমনে ভাবনা, তারা যা ইচ্ছা বলুক৷ এই অবস্থায় তাদের মনের ঘরটা ভালো নেই, একজন মা কখনো নিজের সন্তানের খারাপ দেখে ভালো থাকতে পারে না।

আসিফ আমার হাত তার বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিলো। তেড়ে গিয়ে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তামান্নাকে। উঠে দাঁড়ালেন আমার শাশুড়ি। গড়গড় করে বললেন,

‘বাহ বাহ! আজ এই দিন আমার দেখতে হলো? এই মেয়েটা তোকে এতোই জাদু করেছে যে আজ তোর নিজের বোন, আপন বোন, ছোট বোনের গায়ে হাত তুলতে বাধলো না তোর?’

তামান্না বললো,

‘বাহ ভাইয়া! ক্লেপ ক্লেপ! দারুণ! আজ আমাকে তুমি মারতে পারলা? এই মেয়েটার জন্য আজ এতকিছু? ‘

আসিফ বললো

‘তোমরা সবাই কখন থেকে শুধু নুপুর নুপুর নুপুর করে চলছো। কোনকিছু হলে, কোন অঘটন হলে সব নুপুর করছে? আরে সেদিনও আপা যখন নুপুরের উপর দুলাভাই নিয়ে আঙুল তুললো, সেদিনও তো সে আমাদের সবার অগোচরে কার জন্য করলো? কার জন্য? আপার জন্যই তো তাইনা? বিনিময়ে কী শুনতে হলো? আপার কথাবার্তা, গঞ্জনা, অপমান? একটা মেয়ে আর কত সহ্য করবে এসব?’

আমি আসিফকে বললাম,

‘তুমি রুমে এসো প্লিজ। কথা বাড়িও না আর।’

আসিফ আমার দিকে তেড়ে এলো এবার৷ বললো,

‘কেন বলবো না? কেন? সব সময় এসব সহ্য করা? অন্যায়ের সাথে চলে এসব সহ্য করবো আমিও? না নুপুর এমন হবে না৷ এমন হবে না।’

শাশুড়ি নাকি গলায় বললেন,

‘ছেলেকে তাবিজ করে ফেললি তুই৷ তাবিজ করে ফেললি। আমার আর কিছু রইলো না। আমার আর কিছু রইলো না।’

আসিফ তার মাকে বললো,

‘তোমাদের সমস্যা কোথায়? এই মেয়েটা তোমাদের কী ক্ষতি করেছে? আমার জীবনের সাথে জুড়ে দিয়ে প্রথমেই তোমরা তার জীবন শেষ করে দিয়েছো৷ শেষ করে দিয়েছো সব।’

‘এত বড় বড় কথা? খাচ্ছিস তো আমাদের ঘাড়ে। ঘর ভর্তি মদ আর সিগারেট এর টাকা রুজি করার মুরোদ আছে তোর? বউ সোহাগী হওয়ার আগে নিজে কিছু করে দেখা আহাম্মক। নালায়েক। তারপর অধিকার দেখাতে আসবি।’

শাশুড়ির এই কথাটা কেমন জানি গভীর হয়ে লাগলো আসিফের এমন মনে হলো। আসির আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সেখানে। রুমে চলে এলো। বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো৷ কয়েক টান দেয়ার পর সিগারেট ফেলে দিলো। কেমন মুচড়ে ফেলে দিলো সে। তারপর আমাকে বললো,

‘চলো।’

‘চলো মানে?’

‘এই ঘর থেকে চলো। এই ঘরে আর এক মুহূর্তও না।’

আমি আসিফের গরম মাথা বুঝতে পারলাম। তার হাত ধরে বললাম,

‘মাথা ঠান্ডা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘না। কোন ঠিক হওয়ার কিছু নাই এখানে। চলো।’

আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না। এমন উদ্ভূত পরিস্থিতি আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়৷ ভেতরের সাহস একেবারে শেষ করে দেয়। কম্পিত করে রাখে নিজের মন প্রাণ সব।

মিনিট পাঁচেকের মাথায় ব্যাগে কিছু ব্যবহার করা কাপড় নিয়ে আসিফ আমার হাত ধরে নিচে নেমে এলো। শাশুড়ি সামনেই বসা ছিলেন৷ পাশে আমার ননদ। শাশুড়ি আসিফকে বললেন,

‘অহ! বউয়ের হাত ধরে বাড়ি ছাড়বা এখন? দুইদিন পরে তো আবার এই ঘরে আসবি। এই ঘর ছাড়া তোর মদের পয়সা আসবে কোথা থেকে?’

আসিফ তার মায়ের কথার জবাব দিলো না। আমার হাত ধরে শাশুড়িকে অতিক্রম করার সময় শাশুড়ি আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন,

‘যে মেয়ে ঘর ভাঙ্গিয়েছে আমার, সেই মেয়ের ঘর আল্লাহ কখনো করতে দিবেন না। ছোটলোকের ঘরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসে আমি নিজেই নিজের ঘর ভাঙ্গলাম।’

আমরা দুজন বাড়ির সদর দরজা ক্রস করার সময়ে পেছন থেকে আমার ননাস আসিফকে ডাক দিয়ে বললেন,

‘দাঁড়া আসিফ! এইটা তোর ঘর৷ তুই কেন যাবি এখান থেকে?’

শাশুড়ি উঠে গিয়ে ননাসকে বললেন

‘কেন? এখন তুই ও নতুন হয়ে আসলি নাকি এখানে?’

‘মা! আমি মা হতে পারবো না। আমার শাশুড়ি সব কথা বলে দিয়েছে তামান্নাত হবু শ্বশুরবাড়ি। এখানে আমার দোষ, আমাদের দোষ। আল্লাহ আমাকে মা হওয়ার ক্ষমতা দেন নাই। এই দোষ এখন কেন আরেকটা মেয়ের ঘাড়ে পড়বে? সে কী অপরাধ করেছে?’

আমার ননদ আমার ননাসকে বললো এবার,

‘অহ! তারমানে এখন তোমাকেও সে হাত করে নিয়েছে? নিজে মা হতে পারবে না দেখে এখন ভাইর বউয়ের চামচামি করে জীবন কাটানোর পায়তারা করতে বসেছো?’

‘বল। তোর যা ইচ্ছা বল। আমি আর কোন কথা বলবো না। কোন কথাই না।’

ননাস আমার হাত ধরে বললো

‘তুমি অন্তত বুঝার চেষ্টা করো নুপুর। একটা ঘর মানুষ শূন্য হওয়া আর কবর হওয়ার মাঝে কোন তফাত নেই। আসিফ আমার একমাত্র ভাই। আমাদের পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য৷ আমাদের মাথার উপরে ছাতা। এই ভাইকে আমাদের থেকে দূরে নিয়ে যেও না। তুমি বুঝাও আসিফকে।’

আসিফ আমার ননাসের থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিলো। কোন কথা না বাড়িয়ে পা আগালো বাইরের দিকে। পেছন থেকে আমার শাশুড়ি বলতে লাগলেন,

‘আর কোনদিন যেনো এই মেয়েকে নিয়ে আমার ঘরের চৌকাট পার করতে না আসতে হয়।’

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২০
#মিদহাদ_আহমদ

আসিফ আমার হাত ধরে আলিশান থেকে বের হয়ে এলো। বাসার গেইটে আসতেই দারোয়ান জিজ্ঞেস করলো,

‘স্যার গাড়ি কোনটা বের করবো? কালোটা না নতুন এইটা আনছেন পর্শুদিন ইনপোর্ট করে ওইটা?’

আসিফ কোন জবাব দিলো না। আমি বললাম,

‘গাড়ি লাগবে না চাচা’

‘ওমা! একী কথা! স্যার কোনদিন গাড়ি ছাড়া তো বাড়ি থেকে বের হয়নাই। ও বুঝছি, বাইক নিয়ে যাবেন? ম্যাডামরে নিয়া রাইতে বাইক দিয়া ঘুরবেন শহর বুঝতে পারছি!’

‘যাস্ট গো! আমি বলেছি আমার গাড়ি লাগবে? কী সব আবোল তাবোল বকছো তুমি!’

‘না না না। এভাবে আমার দারোয়ানের সাথে কথা বলা যাবে না। মুরোদ থাকলে টাকা দিয়ে এমন দারোয়ান পুষে রাখো এক দুইটা। তারপর এমন গলাবাজি করবা’

কথাটা পেছন থেকে এসে আমার শ্বশুর বললেন আসিফকে। শব্দহীন ভাবে আমরা দুজন মানব মানবী গেইট অতিক্রম করে বেরিয়ে এলাম। খোলা রাস্তায় মানুষজন আছে। ঈদের আগের সময়, বাজারহাট করছে লোকজন। আসিফ আমাকে বললো,

‘আমার হাত ধরে যখন বের হয়ে এসেছো, তখন থাকতে পারবা তো আমার সাথে?’

আমি কোন বাছবিচার করলাম না। আসিফকে বললাম,

‘কেন পারবো না? দেখো দুজন মিলে ঠিকই নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিবো সবকিছু।’

আমার মনে হতে লাগলো আমাদের স্কুলের বিপাশা রানী ম্যাডামের কথা। উনি সব সময় বলতেন, পুরুষদের প্রয়োজন বিশ্বস্ত হাতের। একটা শুদ্ধ মনের। একটা বিশ্বস্ত হাত যদি পুরুষেরা পেয়ে যায়, যদি তাদেরকে ভরসা যোগানোর মতো মানুষ তাদের পাশে থাকে, তাহলে পুরুষেরা জীবনে অনেক অসাধ্য করে ফেলতে পারে সাধন। আজ বারবার শুধু বিপাশা ম্যাডামের কথা মাথায় আসছে। তারা যখন বিয়ে করেছিলেন, ম্যাডাম তখন সবেমাত্র স্কুলে জয়েন করেছেন৷ তার স্বামী তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যাল থেকে সদ্য পাশ করে বেরিয়েছেন। কোন চাকরি নাই, কিচ্ছু নাই। একদিকে জীবনের টেনশন, অন্যদিকে স্ত্রী, অন্যদিকে কেরিয়ার। বিপাশা ম্যাডাম বলেছেন ক্লাসে যে তিনি তার স্বামীকে পুরোপুরি বিসিএস এর প্রিপারেশনে মনোযোগ দিতে বলেছিলেন৷ একা হাতে তুলে নিয়েছেন পুরো পরিবারের দায়িত্ব। তারপর আর কই! চার বছর! আমি ক্লাস সিক্স থেকে টেনে উঠলাম। একদিন পুরো স্কুলে মিষ্টি বিতরণ হলো। জানতে পারলাম বিপাশা ম্যাডমের স্বামী এডমিন ক্যাডার হয়েছেন। আজ আবার সেই দিনটাকে আমি অনুধাবন করতে লাগলাম। যদি বিপাশা ম্যাডাম তার নিজ হাতে তুলে নিতে পারেন পরিবারের দায়িত্ব, তাহলে আমি কেন নয়?

অন্যদিকে আমার মনকোটরে হানা দিতে লাগলো এক অজানা হয়! আমি কী করবো এখন! ইন্টার পাশ করা ছাড়া এ মেয়ে, অসহায়ের মতো মজ জোয়াড়ে ভাবণায় বদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু করতে হবে, অন্যদিকে এই করতে পারার মতো যোগ্যতাও যে আমার থাকা লাগবে! অন্যথায় হবে কীভাবে?’

আসিফ আমাকে বললো,

‘নুপুর! জানি না কী করতে পারবো। বা কিছু করতে পারবো কিনা এইটারও নিশ্চয়তা আমার কাছে নেই। আমি দিতে পারছি না। কিন্তু সব সময় একটা পজেটিভ এনার্জি আমাকে এসে বলছে, আমাকে দিয়ে হবে। আমি চেষ্টা করেই দেখিনা একবার!’

রাস্তায় একজন মধ্য বয়স্ক লোক আসিফকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘বাবা আসিফ রাতে এখানে কেন? বউমা নাকি সাথে? কোথাও যাচ্ছো নাকি?’

‘না আঙ্কেল এমনি।’

‘অহ আচ্ছা। কিছু মনে করো না। তোমাকে তো কখনো বাইক বা কার ছাড়া দেখিনি, তাই আজ দেখে কিছুটা অবাক হলাম। তা কেমন আছে বউমা? ভালো আছো তো?’

আমি সালাম দিলাম। বললাম,

‘জি আঙ্কেল। আপনি ভালো আছেন?’

‘হ্যাঁ মা ভালো আছি। ভারী মিষ্টি মেয়ে তুমি’

উনি চলে গেলেন। খেয়াল করলাম আসিফ ঘামছে। হাত দিয়ে ঘাম মুছে নিচ্ছে। আমি আসিফকে বললাম,

‘সুযোগ এসেছে। এবং এই সুযোগ আমাদের নিতে হবে৷ দেখবা, কোনদিক থেকে আমরা উপর ওয়ালার সাহায্য পাবো তার কল্পনাও করতে পারবা না। শুধু দরকার আমাদের একাগ্রচিত্ত। এছাড়া আর কিছু না।’

‘এখন কী করবো? কোথায় যাবো?’

‘বাড়িতে। আমার বাড়িতে। ‘

‘কিন্তু ওখানে…’

‘হ্যাঁ। সেখানেই যাবো আমরা। আপাতত একটা ব্যবস্থা হোক। তারপর দেখি কী করা যায় ‘

আসিফ আর আমার কথার আপত্তি জানালো না। শুধু কিছুক্ষণ ভেবে বললো,

‘ভাড়ার টাকা যে…’

‘সে তোমার চিন্তা করতে হবে না। বাড়িতে যাই। বাবা আছেন। ঠিক একটা ব্যবস্থা বাবা আমাদের জন্য করে দিবেন।’

প্রায় আধঘন্টা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সিএনজি খুঁজছিলাম আমরা। আশেপাশের অনেকেই কানাঘুষা করতে লাগলো বুঝতে পারলাম৷ বিল্ডিংয়ে খেয়াল করলাম প্রায় প্রতি তলা থেকেই কেউ না কেউ পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের। হয়তো তাদের এই দেখায় মিশে আছে উৎসুক মনের নানার প্রশ্ন! আসলে এটাই স্বাভাবিক। যে ছেলেকে কখনো কেউ রাস্তায় দেখেনি আজ কয়েকটা বছর ধরে, যে ছেলে সব সময় হই বাইকে নাহলে কারে বসা ছিলো, যে ছেলের বাবা এই শহরের নামকরা শিল্পপতি সেই ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিএনজি খুঁজছে! বাসায় জোড়া জোড়া কার লাইটেস রেখে? তাও এই রাতে স্ত্রী কে নিয়ে? হাতে একটা বড় ব্যাগ! কীসের ব্যাগ এইটা? অবাক করা বিষয় অবশ্যই! মানুষের এই আশ্চর্য হওয়ার মধ্যে কোন আশ্চর্য নেই।

নিশুতি অন্ধকার অন্যদিন হলে ছেয়ে যেতো। আজ আর সেই অন্ধকার নেই। চারিদিকে আলো জ্বলছে। ঈদের বাজার। দেখতে পেলাম রিকশায় হুড নামিয়ে হাতে আইসক্রিম খেতে খেতে এক দম্পতি গল্প করতে করতে যাচ্ছে। পুরুষটার হাতে বেশ কয়েকটা ব্যাগ। নিশ্চয়ই ব্যাগভর্তি ঈদের বাজার! ঈদের আনন্দ! আর তাদের মুখে লেগে থাকা আনন্দ হাসি আমাকে বলছিলো যেনো, ‘নুপুর, তোমার জীবনে এমন আনন্দ হাসি হবে কখনো?’

আবার ভেতরে ভেতরে নিজের বিপরীত সত্বা এসে নিজেকে ধমক দিয়ে বললো,

‘কী ভাবছো নুপুর? জীবনে সবকিছু পাওয়া কি সহজ? তোমার পড়ার স্বপ্ন কী পূর্ণ হয়েছে?’ বলো হয়েছে? ‘

আমি অজান্তেই জোরে জোরে বলে উঠলাম,

‘না না। না না হয়নি।’

আসিফ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী না না? কী হয়নি?’

একটা সিএনজি এসে থামলো তখন। আসিফকে দেখে ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো,

‘স্যার আপনি এতরাতে?’

‘হুম৷ যাবা কিনা বলো?’

‘হায় হায়! কী বলেন স্যার? মনে আছে আপনার? আমি ওই যে রিকশা চালাইতাম? আমার ঘরে খাবার আছিলো না। পায়ের কোণা কাইটা ফুইলা রহছিলো। আমারে কেউ খাওন দেয়নাই। আমার সব মনে আছে স্যার। সব মনে আছে। সেদিন আপনি যে আমার হাতে বিশ হাজার টাকা আর অষুধ কিইনা দিয়া বলছিলেন কিছু করতে? তারপর দিলাম দুকান। সেই দুকান দিয়া আস্তে আস্তে পুঞ্জিপাতি বাড়াইলাম। তারপর আল্লায় দিলে আজ ছয়মাস থিকা এই সিএনজির মালিক আমি।’

আসিফ বললো,

‘নিয়ে যাবা আমাদের?’

‘আয় হায়! কী কন। বসেন বসেন। কই যাবেন স্যার?আপনারে আমার গাড়িতে কইরা নিয়া যাইতে পারলে আমি খুব বেশি খুশি হইমু। জানেন স্যার, এই গাড়িটা কেনার পর আমার গিন্নিও বইলা দিছে, আপনারে আমার গাড়িতে চড়াইয়া আপনার যেনো দোয়া লই। আপনার দোয়া যে এত তাড়াতাড়ি পাইয়া যাইমু এইটা ভাবতে পারিনাই। কী ভাগ্য আমার’

‘বড়লেখা যাবো। আমার শ্বশুরবাড়ি। নিয়ে যেতে পারবেন?’

‘আরে আরে কী কন স্যার। চলেন চলেন৷ উঠেন।’

তারপর ড্রাইভার আবার বললো,

‘অহ! লগে মনে হয় ভাবি? আস্লামালেকুম ভাবি। আপনি বড়ো ভাগ্যবান। এমন দিলখোলা মানুষ এই যুগে আর হয় না। মানুষের জন্য যে করে, যে কাঁদে সে আর যাই হোক, সাধারণ মানুষের কাতারে পড়ে না। এককালে নবী রাসূল আইছিলো। এখন তো আর ভালা মানুষও আয় না। তয় একেবারে ভালা মানুষ যে নাই, তাও না। এই দুই একজন আছে আপনার স্বামীর মতো। ভাই একেবারে গিনি সোনা। ভাইজান, ভাবিরে নিয়া উঠেন। আমি দিয়া আই।’

‘আসতে আসতে যে ফজর হয়ে যাবে তোমার। সেহরিও রাস্তায় করা লাগবে।’

‘আরে উঠেন ভাই। সে যা হবার হোক। আইজ আপনারে নিয়া গল্প করতে করতে যামু।’

আমরা সিএনজিতে উঠে বসলাম। এক দমকা বাতাস বইতে লাগলো। আজ কয়েকটা মাস পর আমি সিএনজিতে উঠেছি। এস এস সি পরীক্ষার সময়ে বাবা একটা লাইটেস ভাড়া করে দেয়। আমরা এগারো জন যেতাম। পুরো পরীক্ষা চুক্তি। জনপ্রতি ভাড়া আসছে পুরো এক্সাম সিজনে ৬০০ টাকা। তখন ভাবতাম, আমার যদি এমন গাড়ি থাকতো! আজ কয়েকটা মাস ছাড়া এমন গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি যেনো চড়াই নিষিদ্ধ। রাস্তাঘাট সিএনজি, রিক্সা দেখলে ইচ্ছা হতো, ইশ! যদি এগুলো চড়তে পারতাম এখন!

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস!

আমি মনেমনে অনুভব করতে লাগলাম, আমি এক মহাপুরুষের পাশে বসে আছি যেনো! আসিফের ভেতরে ভেতরে এসব কাজের সম্পর্কে আমি জানতাম না। হয়তো বাসায়ও কেউ জানে না। জানতোও না। একটা খারাপ অবয়বের ভেতরে যে এত নির্মল, এত সুন্দর, এত পরিস্কার, এত স্নিগ্ধ একটা মানুষ বাস করছে! পৃথিবী যেনো তার সব আশীর্বাদ দিয়ে মানুষ গড়েছে। আর সেই মানুষটাই যেনো আসিফ।

আসিফ সিএনজিতে বসে জিজ্ঞেস করলো,

‘তখন কী না না করছিলা?’

‘স্বপ্ন’

‘কী স্বপ্ন?’

‘আমার স্বপ্ন।’

‘বলো আমাকে।’

‘আমার ডাক্তার হওয়া। আমার পড়ালেখা করা। আমার স্বপ্ন। আমার সব স্বপ্ন। এই স্বপ্নগুলো আমি বুনেছিলাম নিজের মাঝে। যেই স্বপ্নগুলোর থেকে আমি আমি হাজার ক্রোশ দূরে। যোজন যোজন দূর আমাকে আমার স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বিচ্ছিন্ন।’

পুরো রাস্তায় আমাদের আর কথা হলো না তেমন। আসিফ ড্রাইভারের থেকে চেয়ে নিয়ে একটা সিগারেট টানলো কিছুক্ষণ পর৷ ঘন্টা দুয়েকের মাথায় আমার বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থাকে। গাড়ির হর্ণেই আমার বাবা মা বাইরে বেরিয়ে আসেন। বাবা জিজ্ঞেস করেন,

‘কী হয়েছে মা? কোন সমস্যা? এতরাতে?’

আমি বাবাকে বললাম,

‘না বাবা। আপাতত আসিফকে নিয়ে রুমে যাও। কোন সমস্যা না।’

বাবা আমাদের নিয়ে রুমে ঢুকলেন। আসিফকে নিয়ে বসালেন সোফায়। আজ সন্ধ্যা থেকেই কারেন্ট নাই গ্রামে। আমাদের টিনচালা ঘর দিনের গরমে একেবারে সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো হয়ে উঠেছে এই মধ্যরাতে। আসিফকে নিয়ে কলের ধারে গেলাম আমি কল জাতা দিয়ে পানি বের করে তাকে হাতমুখ ধূয়ে নিতে বললাম। রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের সাথে সেহরির খাবার রেডি করার সময়ে মা আমাকে ফিসফিস করে বললেন,

‘ফতাকুবেলা ইতা নারিং বিরিং কিতা? হরির লগে মাইর অইছেনি? ভালায় ভালায় খাইলকু যাইবায়গিয়া। জামাই লইয়া আকতা ধরি বাফোর বাড়ি আইল্লায়। অতার লাগিয়া দিছলাম নি বড় ঘর দেখিয়া বিয়া? ডংগর একটা সময় থাখে৷ এখন ই সময় নায়৷ বিয়া দিয়া হারলে ফুড়িন কালে ভদ্রে বাফোর বাড়ি নাইওর আইন। তুমি দেখরাম নাইওর না একবারে জামাই লইয়া আইচ্ছ লাগের।’

[সেহরির সময় এসব ডং কী? শাশুড়ির সাথে মারামারি হয়েছে? ভালোয় ভালোয় আগামীকাল চলে। স্বামী নিয়ে হুট করে বাপের বাড়িতে চলে এলে। এর জন্য বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছিলাম? ডংগের একটা সময় থাকে। এখন এই সময় নয়৷ বিয়ের পর কালেভদ্রে মেয়ে বাপের বাড়িতে নাইওর কর‍তে আসে। তুমি দেখছি নাইওর না একেবারে স্বামী নিয়ে চলে এসেছো]

মায়ের মুখে কথাগুলো শুনে আমি ভেতরে চাপা কষ্ট আর চাপা রাখতে পারলাম না৷ বললাম,

‘অহ আচ্ছা! এই তাহলে আসল রূপ দেখাচ্ছো এখন? আরে আমি না তোমার মেয়ে? তুমি না আমার মা? আর একজন মা হয়ে তুমি এসব বলছো আমাকে?’

‘কেন বলবো না? সকালে যখন আশেপাশের বাড়ির লোকেরা জিজ্ঞেস করবে মেয়ে কেন এসেছে, জামাই কেন এলো? গাড়ি কই? তখন কী জবাব দিবো আমি?’

বাবা পেছন থেকে এসে বললেন,

‘নুপুরের মা কী হচ্ছে এসব? জামাই বসা। তাড়াতাড়ি ভাত দাও। এখন এসব বলার সময়? মা নুপুর তুই চল। জামাই অপেক্ষা করছে।’

আমি চলে গেলাম৷ মোমবাতির আলোতে খেতে বসলো আসিফ। আমিও পাশে বসা আছি৷ একটা পোকা উড়ে এসে পড়লো আসিফের পাতের মাছের উপর। খেয়াল করলাম আসিফ পোকাটা সরিয়ে নিলো৷ কিছু বললো না। বাসায় হলে নিশ্চিত এই সময়ে ভাতের প্লেইট ছুড়ে ফেলে দিতো!

রাতে ঘুমানোফর সময় আমি পাখা হাতে বাতাস করতে লাগলাম আসিফকে। এসি ছাড়া মানুষটা গরমে ঘামছে। কিন্তু কোন অভিযোগ করছে না। ছেড়াফাড়া মশারির ভেতরে এসে ঢুকেছে মশাও। কানের কাছে মশার গান৷ অথচ মানুষটার কোন অভিযোগ নেই।

কিছুক্ষণ পর মৌণতা ভেঙ্গে আসিফ আমাকে বললো,

‘আমরা এখানেও থাকবো না নুপুর। মাকে এভাবে উপরি কষ্ট দেয়া ঠিক না।’

আসিফ কি মায়ের কথাগুলোও তবে শুনে ফেলেছে?

এক অজানা শঙ্কা, মনের আনন্দ, অন্যদিকে মানুষটাকে নিজের মতো করে পাওয়ার সাধে আমার দেহ মন ইচ্ছা একেবারে তনুজল হয়ে গেলো। বিধাতা কি এবার সত্যি সত্যি আমার ভেতরের নুপুরকে পরিচয় দিতে এগিয়ে আসবেন?

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২১
#মিদহাদ_আহমদ

সকাল সাতটা নাগাদ দিনের সূর্যের তাজা আলো আসিফের চোখেমুখে লাগতেই সে ঘুম থেকে জেগে উঠে। আমি পাশে বসেই তাকে বাতাস করছিলাম। আসিফ উঠেই চোখমুখ না খুলে বলে বসে,

‘উফ! এসি অফ করেছো কেন? অদ্ভুত!’

এর প্রায় সেকেন্ড তিনেকের মাথায় আসিফ বললো,

‘অহ সরি সরি সরি।’

আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানায় উঠে বসলো সে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাতের এমন ভঙ্গিমা করে বুঝাতে গিয়ে বললো,

‘একচুয়ালি অভ্যাস হয়ে উঠেছে তো! তাই আরকি। কিছু মনে করো না আবার।’

‘আচ্ছা তুমি উঠে হাতমুখ ধূয়ে নাও এখন। আমি নাস্তা এনে দিচ্ছি।’

আসিফ উঠে গেলো। যেই আসিফের ঘুম সকাল এগারোটা বারোটা ছাড়া ভাঙ্গে না, সেই আসিফ সকাল সাতটার রোদ ঝলমলানি আলোতে উঠে গেলো ঘুম থেকে! মানুষটার কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই?

আসিফ কলের ধারে গেলো। আমি তার পিছুপিছু যাওয়ার সময়ে পথ আটকিয়ে মা বললো,

‘আশেপাশের লোকজন কোনকিছু বলার আগেই যেনো এখান থেকে চলে যাস তোরা। বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছি মান সম্মান দেখে চলার জন্য। এখন তো দেখছি আমাদের মান সম্মান তুই আরও ডুবিয়ে ছাড়বি’

আসিফ এদিকে কল থেকে আমাকে ডাক দিচ্ছিলো গলা ছেড়ে। নুপুর, নুপুর, নুপুর…

আমি একটা টাওয়াল নিয়ে আসিফের গায়ে জড়িয়ে দিলাম। আসিফ বললো,

‘কী? এই গরমে টাওয়াল কেন?’

‘না আসলে এইটা গ্রাম তো তাই…’

‘অহ আচ্ছা। তুমি তাহলে কলে জাতা দাও। আমি মুখ ধূয়ে নেই।’

খালি গা আর টু কোয়ার্টার প্যান্ট পরা আসিফের গায়ে যখন সকালের ঝলমলানি রোদ এসে লাগছিলো, তখন কী এক অদ্ভুত মোহমায়ায় আমি আবিষ্টমন হয়ে যাচ্ছিলাম। এক অদ্ভুত অনুভূতি। মানুষটাকে এমন রোদের ঝলমল আলোতে এর আগে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। মুখ মুছতে মুছতে রুমে এসে বসলো আসিফ। মা সেমাই আর পরোটা দিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ মেয়ে জামাইর সাথে বসে খোশগল্প করলেন। আমি আরও অবাক হলাম, মায়ের সাথে আসিফও খোশমেজাজে গল্প করছে বসে! গল্প শেষে মা উঠে যাবার সময়ে আমার দিকে বাকা নজরে তাকালের একবার। এই নজরের ভাষা হলো আমি যেনো এখানে আর বেশিক্ষণ না থাকি। মাকে কিছু বলতেও পারছিলাম না। এই মানুষটাকে আমি নিজে ভরসা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিলাম আর এখানে? মনের ভেতর যেনো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিলো আমাত নিজের উপর ঘৃণা এবং লজ্জায়। আসিফ পরোটায় সেমাই তুলে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,

‘খাও।’

আমি কয়েক মুহূর্ত আসিফের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আসিফ চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো,

‘খাও’

আমি হা করে আসিফের দেয়া সেমাই মাখা পরোটা মুখে নিলাম। আজ প্রথমবারের মতো মানুষটা আমার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। আজকাল সবকিছু আমার জীবনে প্রথমবার হচ্ছে। এই প্রথমবার হওয়ার অনুভূতি কি আসলেই ভিন্ন হয়? নাকি আমার জীবনে এই অনুভূতি গুলো প্রাপ্য ছিলো বলেই এমন?

আমার এই ভাবনায় থাকার মাঝে আসিফ আঙুলে চুটকি বাজালো দুইটা চোখের সামনে এনে। বললো,

‘কী? বাতাস করবা না? গরম লাগছে তো।’

আমি পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম। আসিফ এক মনোযোগী হয়ে সেমাই খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে তারিফ করছে। মাকে ডেকে বলছে,

‘আপনার রান্নার হাত অনেক ভালো মা। খুব মজাদার হয়েছে৷ একেবারর পাক্কা রাধুনি। ‘

মা রান্নাঘর থেকে উঠে এসে বাটি নিয়ে বললেন,

‘আমি আরও এনে দিচ্ছি বাবা। খাও।’

আসিফও সায় দিলো। আমার শুধু মন বলছিলো তাকে বলবো যে, এই খাওয়ানোর মধ্যে মন থেকে খাওয়ানোর কোন লেশমাত্র ভালোবাসা নেই। এর মাঝে বাস করা কপটতা আমার মধ্যে ঘৃণার সঞ্চার করছিলো। বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না আসিফকে। কী বলবো? নিজের মায়ের কথাই? যে মা চাচ্ছেন না আমরা এখানে থাকি? অথচ এই মুহূর্তে আমাদের যাওয়ার জায়গাও নেই। যেনো দুনিয়া একেবারে পাষাণ হয়ে উঠেছে আমাদের জন্য। আমার মুখে চিন্তার আবেশ দেখে আসিফ বললো,

‘কী হয়েছে? কী নিয়ে চিন্তা করছো?’

এর জবাব দেয়ার আগেই দেখলাম একটা সিএনজি এসে হর্ণ দিচ্ছে আমাদের উঠানে৷ আসিফ বললো,

‘গাড়ি চলে এসেছে। তুমি বিদায় নিয়ে নাও মা বাবার থেকে।’

‘গাড়ি?’

‘হুম’

‘কেন?’

‘আমাদের জন্য। আমরা সিলেট শহরে যাচ্ছি এখন।’

‘বাসায়?’

‘না’

‘তাহলে?’

‘এতকিছু জানার প্রয়োজন আপাতত আছে বলে আমি মনে করছি না। শুধু যেটুকু বলছি ততটুকু করো।’

মানুষটাকে আমি ভয় পাই৷ কথা আর বাড়ালাম না। প্রশ্নের শেষে প্রশ্ন জুড়ে দিলাম না। শুধু একবার বললাম,

‘এখানে থেকে গেলে কি…’

প্রশ্ন শেষ হওয়াও আগেই আসিফ বললো,

‘এইটা আমার শ্বশুরবাড়ি। তোমার বাপের বাড়ি। এখানে তুমি এসে থাকতে পারো৷ যেমনটা তানিয়া আপা এসে থাকে আমাদের বাসায়। দুলাভাই এসে থাকেন কি? থাকেন না। সো, তোমাকে নিয়ে আমি এখানে থাকতে পারবো না ‘

কথাগুলো কীভাবে জানি আমার বাবা শুনে ফেললেন। এসে বললেন,

‘কী হয়েছে বাবা? আমরা গরীব মানুষ আমাদের যত্ন খাতিরে কি কোন কমতি হয়েছে বাবা?’

আসিফ মুখে একটা সুন্দর হাসি আনলো। মাথায় হাত দিয়ে চুল একপাশে নিয়ে আমার বাবাকে বললো,

‘না বাবা। কী বলেন আপনি? বাবা কখনো তার ছেলের যত্নে কম করে নাকি? আর আমি আপনার ছেলেই তো তাইনা?’

‘তাহলে বাবা এই সকাল বেলা কিছু না বলে কাওকে যে…’

‘না আসলে আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম বাবা।’

আমার মাও এসে সাথেসাথে যুক্ত করলেন,

‘বাবা কী হলো তোমার? মাত্র আসলা কাল রাতে আর আজ চলে যাচ্ছো? বিষয়টা কেমন না? লোকে কী বলবে?’

‘না মা৷ লোকে কী বলবে আবার বলেন? বরং আমি এখানে থাকলে লোকে কানাঘুষা শুরু করবে৷ আমরা চলে যাচ্ছি।’

আসিফের ভেতরের চাপা অভিমান আর বের হলো না৷ খেয়াল করলাম সে অবলীলায় মুখে মিষ্টি হাসি এনে কথাগুলো সুন্দর করে বলে চলছে। মা সাথেসাথে আমাদের একটু সময় অপেক্ষা করতে বললেন৷ আধা ঘন্টার ভেতরে এক টিফিন বক্সে মা মোরগ রান্না করে এনে দিলেন৷ আমি মাকে বললাম,

‘এগুলো লাগবে না মা।’

মা বললেন,

‘আরে তোর না লাগুক। আমি আমার জামাইকে দিচ্ছি রান্না করে৷ জামাই বাবাজি আসলো, কিছু খেলো না, আবার চলেও যাচ্ছে!’

আমি অবাক হলাম মানুষের এই পরিবর্তন দেখে। আমার নিজের মায়ের এই পরিবর্তন দেখে৷ শুধুমাত্র সম্মানের খাতিরে কোনকিছু বললাম না। সিএনজি ড্রাইভার কাল রাতের উনিই। আমরা দুজন বিদায় নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলাম। সিএনজি ছাড়ার আগেই শুনতে পেলাম মা পাশের ঘরের চাচিকে বলছেন,

‘কী যে বলবো বলেন! বড়লোক মানুষের এই বড়লোকি শখ। কাল মধ্যরাতে এসে হাজির, তাও কোটি টাকার গাড়ি রেখে ভাড়ায় সিএনজি নিয়ে। আবার আজ সকাল হতে না হতেই বিদায় নিয়ে নিচ্ছে। এসব সিএনজি একশোটা কেনার তাদের ক্ষমতা আছে। এই উদ্ভট শখ থাকলে একটা কিনে নিলেই তো হতো। আর ভাবি জানো, আজ দেখলাম নুপুরের আঙুলে ডায়মন্ড না কী জানি, ওমন সাদা চকচকে একটা আংটি। জিজ্ঞেস করার সময় ই হয়নাই। কাল রাতে যখন অন্ধকার ছিলো ঘর, মোমের আলোতে ওই আংটিটা জ্বলজ্বল করছিলো।’

সিএনজি ড্রাইভার সিএনজি স্টার্ট দিলো৷ লুকিং গ্লাসে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত দেখলাম মা ওই চাচির সাথে গল্প করছেন৷ না জানি আমার কত সুখের গল্প আওড়াচ্ছেন! আমি আমার আঙুলের দিকে তাকালাম৷ দেখলাম ডায়মন্ডের আংটি আঙুলেই আছে। আসিফকে দেখিয়ে বললাম,

‘এই আংটিটা…’

‘এইটা কে দিয়েছে?’

‘তানিয়া আপা দিয়েছিলো। ডায়মন্ডের।’

‘ফিরিয়ে দিয়ে এসো।’

গম্ভীর গলায় বললো আসিফ। তারপর ড্রাইভারের থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে, সিগারেট ধরালো। মুখটা আলতো করে জানালার দিকে নিয়ে নিলো।ধূয়া সব সাবধানে বাইরের দিকে ছাড়ছে আসিফ। আমার খেয়াল ঠিকই হলো। সে ঠিকই আমার কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছে। বাড়িতে থাকতে এক বেলাও সে সিগারেট ধরায়নি! আসিফের এহেন পরিবর্তন আমাকে আশা দেখাচ্ছে। আমাকে বাঁচতে শেখাচ্ছে যেনো!

আসিফ সিগারেট শেষ করে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,

‘বাসার ভাড়া কত বলেছে?’

‘ছয় হাজার টাকা। রুম একটা। সাথে রান্নাঘর আছে। টাইলস করা। তবে ছাদের উপর। আপনার সমস্যা হইবো কিন্তু’

‘হুম। আর কম ভাড়ায় কি বাসা নাই?’

‘আছে তয় আপনার জন্যি নাই৷ আপনি বস্তি বাড়িতে গিয়া উঠবেন ভাবি সমতে?’

আসিফ জবাব দিলো না। আমি আসিফকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কই যাচ্ছি আমরা?’

‘আমি বাসা দেখেছি৷ আমরা সেই বাসায় যাচ্ছি৷ সেখানেই থাকবো।’

‘আর ভাড়া?’

‘সময় আসুক৷ দেখা যাবে।’

আসিফ আবার এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো। তার গুনগুন করে গাওয়া গান শুনে আমি মোহিত হয়ে গেলাম যেনো। তাকে বললাম,

‘একটু শব্দ করে গাওয়া যাবে কি?’

একটা মিষ্টি হাসি দিলো আসিফ। গালের টোল পড়া হাসির ছেলে মুখ আমি এর আগে দেখিনি৷ তারপর গলা ছেড়ে গাইতে লাগলো,

‘সরল তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা
যেদিন তোমারে প্রথম নয়নে হেরি
সেদিন হতে তোমার কথা ভাবনা করি
পাগল বেশে ঘুরিফিরি বাজাই বেহালা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা
শুইলে স্বপনে সদা তোমারে দেখি
ঘুম ভাঙ্গিলে মনে হয় সকলি ফাঁকি
আমি তোমার ছবি আঁকি বসে নিরালা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা
আমার হয়ে তুমি আমার কাছে আসিলে
আদর করিয়া তোমায় লইয়া কূলে
সুভাশিত বনফুলে পরাবো মালা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা
আমি তোমারে কি আর বলিবো প্রিয়া
মনে রেখো গো তুমি আপন জানিয়া
করিমের খবর নিও থাকিতে বেলা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা
সরল তুমি শান্ত তুমি নূরের পুতুলা
সরল জানিয়া নাম রাখি সরলা।’

গানটা গেয়ে আসিফ আমার দিকে তাকালো। তার মুগ্ধতা ভরা চোখ নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন হয়েছে?’

আমি আসিফের গানের যে দরদ সেই দরদে যেনো ডুব দিয়ে আছি। বললাম,

‘অনেক ভালো হয়েছে।’

গাড়ির ড্রাইভার বলে উঠলো,

‘জানেন স্যার, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম তাঁর স্ত্রীকে অনেক ভালো বাসতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো নাইওরজান বিবি৷ আর এই গানে যে সরলা, সেই সরলা নামটা তিনি দিয়েছিলেন। বাউল সম্রাট কত গান যে লিখেছেন তার স্ত্রীকে নিয়ে!’

আসিফ বললো,

‘এককালে লোকসংগীত ছাড়া আমার মন ই বসতো না। কোথাও বসে আছি, আর সময় আছে, কিন্তু গান হয়নি এমন হয়নি।’

‘স্যার আপনে গান করা শুরু করেন৷ দেখবেন আপনার অনেক নামডাক হবে। অনেক’

‘কী যে বলো!’

আসিফ একটা হাসি দিলো। বরাবর তার হাসিতে আমি মুগ্ধতা খুঁজ করছি। এক অপার নির্ভরতা পাচ্ছি যেনো তার হাসিতে। আসিফের মাটিমাখা গানের গলা যে কাওকে মোহিত করে ফেলবে অনায়াসে।

ঘন্টা দেড়েকের মাথায় আমরা শহরে এসে পৌঁছালাম। ড্রাইভার সিলেট শহরের মিরাবাজার এলাকায় একটা বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো। তারপর কার সাথে যেনো আসিফকে কথা বলিয়ে নিয়ে এসে আমাকে করে আসিফ উপরে উঠলো৷ চার তলা বাসার ছাদের উপর এক রুম, এক কিচেন আর একটা খাবার ঘর। ছোট একটা বাথরুমও আছে। আসিফ বললো,

‘আজ থেকে আমরা এখানেই থাকবো।’

আমি এসেই আমার ফোন চার্জে লাগালাম। বাড়িতে কারেন্ট ছিলো না। এখানে কারেন্ট আছে৷ বাড়ি ওয়ালা এসে দেখে গেলো। আর বললো,

‘এডভান্স ছয় হাজার টাকা কি এখন দিয়ে দিবেন আপনারা?’

আসিফ অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

‘ব্যাংক থেকে তুলে আনতে হবে। আমি আগামীকাল দেই?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

বাড়ি ওয়ালা চলে গেলো। আসিফ আমাকে বললো,

‘বলে তো দিলাম আগামীকাল দিবো। কোথা থেকে দিবো বলো?’

আমি আসিফের হাত ধরে বললাম,

‘আল্লাহ সব ম্যানেজ করে দিবেন।’

ফোন চার্জে লাগাতেই অন হয়ে গেলো। তারপর এসে ঢুকতে শুরু করলো একের পর এক কল সবগুলাই তানিয়া আপার। আমি আসিফকে দেখালাম তানিয়া আপার নাম্বার থেকে কল এসস ঢুকেছে যে। আফিসকে দেখানোর সাথে সাথে দুলাভাইয়ের নাম্বার থেকেও কল এসে ঢুকলো। আসিফের দিকে তাকালাম আমি। আসিফ বললো,

‘কল ধরো।’

আমি কল রিসিভ করলা। ওপাশ থেকে হুলস্থুল হয়ে তানিয়া আপা জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে? কোথায় তোমরা? আসিফ কই? খেয়েছে কিছু? আমি কাল থেকে কল করে পাচ্ছি না। আসিফ কোথায়? কোথায় আমার ভাই?’

‘পাশেই আছে আপা।’

‘কিছু খেয়েছো তোমরা?’

আপার কথার জবাব দেয়ার আগেই আসিফ আমার থেকে মোবাইল কেড়ে নিলো। কানে মোবাইল নিয়ে বললো,

‘আমরা মিরাবাজার, ২৬ নাম্বার বাসায় আছি। তুমি চলে এসো। তারপর বলছি সব কথা।’

আমি মনেমনে ভাবলাম, আসিফ তাহলে কি সবকিছু মিটমাট করতে যাচ্ছে? বাসায় চলে যাওয়ার চিন্তা করছে?

বিরবির করে আসিফ বলতে লাগলো,

‘শালার কাল থেকে মদ খেতে পারিনি। লাইফটা হেল হয়ে গেলো।’

আমি বুঝতে পারলাম, নেশা পিপাসায় আসিফ কাতর হয়ে উঠেছে।

(চলবে)