বিন্নি ধানের খই পর্ব-৩৩+৩৫+৩৬

0
326

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩৪
#মিদহাদ_আহমদ

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো আসিফের ডাকে। মাথার কাছে এসে ডাক দিয়ে তুললো। বললো,

‘রেডি হও। আমার সাথে যাবা।’

আমি উঠে বসলাম। কেমন জানি করলো নিজের মনের মধ্যে। কয়েক মিনিট বিছানায় বসা রইলাম। এর মাঝে আসিফ বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চলে এসেছে৷ এসে বিছানায় বসা দেখে বললো,

‘অদ্ভুত! এখনও বসে আছো? রেডি হও। আমার সাথে যাবা।’

আমি কোন উত্তর দিলাম না। চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু৷ ননাস এসে ডাক দিয়ে ভাইকে নাস্তা খাওয়ার জন্য নিচে নামতে বললেন। অথচ এর আগে কোনদিনও এমন হয়নি। আসিফকে রোজ সকালে আমি আর নাহয় শাশুড়ি মা নাস্তা খাইয়ে দেন। আমার হাতের চা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যেনো! আসিফ আমাকে কথাগুলো বলেই সে নিচে নেমে গেলো। আমি পিছুপিছু গিয়ে দুতলার সিঁড়ি থেকে দেখলাম, ডাইনিং টেবিলে নানান পদের খাবার সাজিয়ে ননাস বসে আছেন ভাইকে খাওয়াবেন বলে। আমি রুমে চলে এলাম। কেন জানি না শাড়ি পরতে ইচ্ছে হলো। এদিকে আসিফ আমার উপর রেগে আছে। রাগবেই না কেন! আমি হয়তো মিছেমিছি তাকে সন্দেহ করছিলাম! নিজের উপর নিজের কেমন রাগ হলো। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, এমন কেউ করে নাকি নিজের মানুষের সাথে! আর এসব তো আমার আন্দাজ। সত্য তো নাও হতে পারে। মাথায় এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আর আমি আলমারি খুলছি। আলমারির প্রথম তাকে রাখা ফিরোজা রঙের জামদানি শাড়ির দিকে আমার নজর গেলো। ইচ্ছা হলো শাড়িটা পরে নেই। হয়তো আসিফের রাগ কমে যাবে!

এদিকে নিচে আসিফ খাবার খেতে গেলে পাশে বসে থাকা বোন আসিফকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,

‘জানিস কী হয়েছে? আমার ছোট ননাস আর স্বামীর কথা বলছি। ওইযে ছোটটা যে? চিনেছিস? মুনা না।’

‘হুম’

‘তার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।’

আসিফ কোন ইন্টারেস্ট দেখালো না বোনের কথায়। তানিয়া আবার নিজ থেকে আসিফের প্লেইটে বিন্নি চালের পোলাও তুলে দিতে দিতে বললো,

‘কেন হয়েছে ভাই জানিস?’

‘তুমি না জানালে জানবো কীভাবে আপু?’

‘এইযে সন্দেহ। তার স্বামীর উপর তার সন্দেহ হচ্ছিলো৷ যদিও কোনকিছু ক্লিয়ার হয়নি। তার পরও সন্দেহ থেকে সে আর সংসার করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়৷ সন্দেহে কবার ঢুকে গেলে ডিভোর্স না দেয়ার আগ পর্যন্ত কোনভাবেই শান্তি পাওয়া যায় না রে ভাই।’

তামান্না এসে বললো,

‘ভাইয়া শুনো, আমাকে আরেকটা জিনিস দিতে হবে তোমার।’

‘কী?’

‘আগে বলো দিবা?’

‘হ্যাঁ দিবো।’

‘আমাকে এন্টলিক পেইজ থেকে মেইকআপ কিট পুরো সেট দিতে হবে। দাম কিন্তু পনেরো হাজার টাকা।’

‘আচ্ছা বিকালে দিবো। অর্ডার দিয়ে দিস।’

আমি রেডি হয়ে নিচে নেমে এলাম। নিচে নামতে নামতে শুনলাম আসিফ তার বোনকে বলছে বিকালে পনেরো হাজার দিয়ে দিবে। এদিকে ননাস আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘আরে আরে আরে! এত সকাল সেজেগুজে? কোথাও যাচ্ছো নাকি নুপুর?’

আসিফ বললো,

‘হ্যাঁ আমার সাথে সে যাবে আপা।’

‘কেন? তোর সাথে কেন?’

তারপর আবার ননাস বললো,

‘অহ ও! স্বামীর উপর নজরদারি করা হচ্ছে বুঝি? ঘর সংসারে মন দাও নুপুর। এসব নজরদারি করে করে জীবন সংসারে আগুন ধরাবা।’

বুঝতে পারলাম না আমার ননাস এসব আমাকে কেন বলছেন। আসিফ তো এসব কোনকিছু তার বোনকে বলবে বলে মনে হচ্ছে না। আর যদি আসিফ এসব তার বোনকে বলে, তাহলে আসিফের উপর আমার এত দিনের জমে উঠা অনুরাগ, স্নেহ সব একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে৷ সব।

আমি কোন কথারই জবাব দিলাম না৷ আসিফ খাওয়া শেষ করলো। গাড়ি বের করে রাখা ছিলো বাসার সামনেই। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। মিনিট দুয়েক হয়ে গেলেও আসিফ কোন কথা বললো না আমার সাথে। আমিও নীরব ছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম আসিফ কিছু বলে কিনা না৷ লুকিং গ্লাসে নজর যেতেই দেখলাম আসিফ তার চোখ সরিয়ে নিলো। সে লুকিং গ্লাসে আমাকেই দেখছিলো। আমিই এবার বললাম,

‘কেমন লাগছে আমাকে? কপালে কালো টিপ দিয়েছি!’

কয়েক সেকেন্ড নীরব থাকার পর আসিফ বললো,

‘হুম ভালো।’

‘জানো আসিফ কোক স্টুডিওর নতুন গান কাল রিলিজ হয়েছে। আমি অনেকবার শুনেছি। তুমি শুনেছো কি? তাদের এবারের কম্পোজিশন দারুণ হয়েছে। তাইনা?’

আসিফ এবারও জবাব দিলো না আমার কথার৷ আসিফ আর কোনকিছু বললোও না পুরো সময় জুড়ে সকাল সকাল স্কুলের জ্যাম। মিরাবাজার পয়েন্ট থেকে জ্যাম শুরু হয়েছে। মিরবাজার ক্রস করে বন্দর পর্যন্ত যেতে যেতেই আমাদের ত্রিশ মিনিটের মতো লেগে গেলো৷ অথচ পথ মাত্র পাঁচ/সাত মিনিটের। আসিফ গাড়ি সাইড করে আমাকে নামতে বললো। আশেপাশে সব দোকানপাট, লোকজন, হাট বাজার। লালদিঘির পারের একদম এক কোণার দিকের পাঁচতলা পুরানো বিল্ডিং এর পাশে গাড়ি পার্কিং করলো আসিফ৷ আমি নেমে দাঁড়ালাম। গাড়ি থেকে নামতেই কেউ একজন আমাকে সালাম দিলো। আসিফ আসতে আসিফকেও সালাম দিলো। আসিফ আমাকে বললো,

‘দেখবে বলেছিলে না? সব দেখবে৷ চলো৷ আমার সাথে চলো উপরে। আজ সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে৷ কোন রাখঢাক থাকবে না আর।’

আমি ফ্যালফ্যাল চোখ আসিফের দিকে চেয়ে রইলাম। আসিফের এমন ব্যবহার আমি এর আগে কখনো দেখিনি। বিল্ডিংটা প্রকান্ড হলেও একদম সরু এর সিঁড়িগুলো। কেমন যেনো ভয় ভয় করছে আমার। চারদিকে কাগজ ছড়ানো ছিটানো। সোজা তিন তলায় উঠলাম। গিয়ে দেখি কয়েকটা ভাগে মানুষ এক ত্রিশ জন হবে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। আসিফ তাদেরকে ক্রস করে যাচ্ছে আর এক এক করে সবাই তাকে সালাম দিচ্ছে৷ আমাকেও দিচ্ছে। আমি কোনকিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না যেনো!

একটা রুমে গিয়ে ঢুকলো আসিফ। মাঝারি সাইজের রুম৷ দেয়ালে তিন রঙের তিন কালার। এক পাশে সাদা। এসি লাগানো। একটা টেবিল আর টেবিলের পাশে চেয়ার। অন্যদিকে সোফার মতো করে পাঁচটা চেয়ার সাজানো। টেবিলের এক দিকে ল্যাপটপ, অন্যদিকে হুইস্কির বোতল। অর্ধেক বোতল ভরা খেয়াল করলাম। দেখলাম নিচের দিকেও কয়েকটা খালি বোতল রাখা। টেবিলের আরেকপাশে একটা ফটোফ্রেম। আমার আর আসিফের শিল্পী হাসেম খানের আঁকা ছবিটার নকল ছোট করে বসানো। আসিফ আমাকে চেয়ারে বসালো। তারপর সে সামনের চেয়ারে বসলো। বসে আমাকে বললো,

‘এখন বলো কী জানতে চাও?

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩৫
#মিদহাদ_আহমদ

*গ্রুপ প্রাইভেট করে ফেলা হবে। তাই যারা গ্রুপে যুক্ত না হয়ে গল্প পড়ছেন, আপনারা আর পড়তে পারবেন না। আগে জানিয়ে রাখলাম। গল্প পড়ার আগে গ্রুপে জয়েন হয়ে নিন।*

‘জানতে চাও এসব কী? বুঝতে পারছো না এসব কি? সবকিছু ক্লিয়ার হতে চাও? ক্লিয়ার? আচ্ছা সব ক্লিয়ার হবে। সবকিছু ক্লিয়ার হবে। যাস্ট ওয়েট।’

আসিফ তার টেবিলের উপরে থাকা বেল চাপ দিলো৷ কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে একটা যুবতী মেয়ে দরজায় এসে বললো,

‘মে আই কাম ইন স্যার?’

‘হুম। তুমি পরিতোষকে ডাক দাও। বলো আসতে।’

‘অকে স্যার।’

মিনিট খানেকের ভেতর একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

‘কী মিস্টার? হুটহাট ডেকে পাঠালেন কেন? ম্যাডামকে নিয়ে এসেছেন। ঘুরেফিরে দেখান ওসব৷ কাজ কীভাবে হচ্ছে না হচ্ছে এসব দেখান।’

আসিফ ওনার কথার কোন জবাব না দিয়ে বললো,

‘আজ কয়টা এসে জমা পড়েছে আমাদের সাইটে? কয়টায় আমার টাচ করতে হবে?’

‘আজ জমা পড়েছে একশো প্লাস৷ তবে আজকের জমা পড়া কাজ তো আজ করা যাবে না। আজ লাস্ট উইকের কাজে হাত দিতে হবে। ডেলিভারি আগামীকাল দুপুরে। সবাইকে মেইল করে দিতে হবে৷ আজকে একটু বেশি। দুইশোটার মতো হবে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান।’

লোকটা চলে গেল। আমি একেবারে থ বনে বসে রইলাম৷ কোনকিছু বুঝতে পারলাম না। আসিফ উঠে দাঁড়ালো। একটা থাবা দিলো ডেবিলে। দিয়ে বলল,

‘বুঝেছো কেন রাত করে বাড়ি ফিরি? উত্তর পেয়েছো কীভাবে গাড়িতে চড়ি? বোনকে কীভাবে হীরার ফিঙ্গার রিং কিনে দেই? উত্তর পেয়েছো বাসায় বাজার কীভাবে করি? নাকি আরও কোনকিছু জানাতে হবে। আরও কিছু বলতে হবে? প্রথম যেদিন বলেছিলাম যে আমি হোটেলে কাজ পেয়েছি, আরে ওইটা ছিলো মিথ্যা। হোটেল কাজের কোন এক্সপেরিমেন্ট আমার ছিলো? সারাক্ষণ মদে ডুবে থাকা ছেলে হোটেল সামলাবে? এখন প্রশ্ন জাগতে পারে এসব কীভাবে করেছি?’

আসিফ এসে আমার গালে ধরলো। দুই হাত দিয়ে আমার গালে ধরে আমার চোখে চোখ রেখে অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

‘এই চোখ আমাকে বলেছিলো আমি যেনো আমার নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেই। নিজের স্বপ্নের জায়গাকে কাজে লাগাই। এই কাজটাই আমি করছি৷ এই কাজের দিকেই আমি হাঁটছি। কীভাবে কী করেছি জানতে চাচ্ছো তো? সব জানাবো। সব। এতো সকাল এতকিছু হয়ে যায়নি নুপুর। এতকিছু হওয়া সম্ভব ও না। এইযে টিভিতে দেখেছিলে না একটা নিউজ? দেখেছিলে না যে বাংলাদেশের একজন তরুণ প্রচ্ছদশিল্পী ‘রুহান মেহরা’ দেশ বিদেশে নাম ছড়িয়েছেন কিন্তু এখনও মিডিয়ায় আসেননি? তাকে কেউ দেখেনি? সেই রুহান মেহরা আমি। দেখো নুপুর তোমার সামনেই আমি বসে আছি। প্রথমে প্রকাশনীতে গিয়ে যোগাযোগ করেছি তাদের প্রচ্ছদশিল্পী লাগবে কিনা। আরে কত রাতের পর রাত জেগে কাজ করেছি। নিজের স্ট্রাগল না, এটাকে নিজের ড্রিম ভেবে কাজ করেছি। সেই কাজের ফল এত তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। বাসায় আসার পর বাবার একাউন্ট থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুললাম। বাবা টেরও পায়নি। সেই টাকা দিয়ে এডভান্স দিয়ে এখানে আমার এই প্রজেক্ট দাঁড় করালাম। জানো আমার এই প্রজেক্টের পেছনে ব্যাংক লোন কত? হয়তো শিল্পপতির সন্তান বলে ব্যাংক লোন নিতে কোন বেগ পোহাতে হয়নি। আবেদন করার সাথে সাথে পনেরো লাখ টাকার লোন ইস্যু হয়ে যায়।
যাক সেই কথা৷ এতো বিস্তারিত এখন বলার সময় নেই। এইযে এখানে দেখছো এত এত মানুষ কাজ করছে, সবাই ঢাবির চারুকলার ছাত্র। সবাই এক একটা প্রতিষ্ঠান হওয়ার যোগ্যতা রাখে। নিজে হয়তো এককালে চারুকলায় চান্স পেয়েছিলাম। সেই সুবাধে এদের সবার সাথে কানেক্টেড হওয়ার সুযোগ হয়েছে। নাহলে হয়তো তাও সম্ভব হতো না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রচ্ছদ সাপ্লাই হচ্ছে আমার এই কোম্পানি থেকে। প্রতিটা প্রচ্ছদে নাম যাচ্ছে, ‘রুহান মেহরা’। আর রোজরোজ রাত হয় কেন জানো? সব প্রচ্ছদে আমার একটা না একটা কাজ করাই লাগে৷ একাডেমি সব কাজ করে, সিগনেচার কাজটা আমার করা লাগে। আরও শুনবা কিছু? ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার নামকরা সব প্রকাশনীর প্রচ্ছদ আমার এখান থেকে সাপ্লাই হয়। বইয়ের ভেতরের ইলাস্ট্রেটর এর কাজ আমার এই একাডেমির ছেলেরাই করে। শুধু তাই? বইয়ের ভেতরের মেকাপ, গেটাপ থেকে শুরু করে আঁকিবুঁকির সবকিছুই এখান থেকে হয় ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক তো আর যেই সেই করে করা যায় না। রাতের পর রাত যায়, ছবির উপর ছবি যায়। আর তারপর আমার চোখের সামনে আমার ড্রিম সত্য হয়ে উঠে।’

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে আসিফ আবার চেয়ারে বসে যায়। হুইস্কির বোতল থেকে হুইস্কি ঢাললো পাশে রাখা গ্লাসে। আমি উঠে গেলাম তার পাশে। গ্লাসটায় ধরলাম। আসিফ আমার হাত ছাড়িয়ে নিলো। এক ঢুকে খেয়ে নিলো পুরোটা। তারপর মাথা হেলিয়ে দিলো চেয়ারে।

কয়েক মিনিট পর সেই মেয়েটা আবার রুমে এলো৷ আসিফকে বললো,

‘স্যার নেক্সট উইকের স্লট রেখে দিয়েছি৷ আপনার ফ্যামিলি প্রোগ্রাম ই তো তাইনা? দশ জনের ইস্টিমেট দিয়ে দিয়েছি তাদের।’

‘ক্যানসেল করে দাও। লাগবে না।’

‘কিন্তু স্যার আপনি না বলেছিলেন আপনার ফ্যামিলি মেম্বারকে ওইদিন…’

‘আপনি আসতে পারেন। আর ক্যানসেল করে দিয়েন।’

আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আসিফ আমাদেরকে এতদিন জানায়নি কেন। আসিফ বললো,

‘এখন আপনি আসতে পারেন৷ আমার কাজ আছে ‘

আমি আর আসিফের অফিসে বসার মতো অবস্থায় রইলাম না। একদিকে রাগ, অন্যদিকে ক্ষোভ আর ভালোবাসার দোলনায় দোল খেতে খেতে একেবারে বিষিয়ে উঠেছি যেন।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় একজনকে কলে কথা বলতে শুনলাম কাকে যেনো বলছে,

‘হ্যাঁ আসিফ স্যারের স্ত্রীর জন্যই একজন স্যার লাগবে। সামনে মেডিকেল এডমিশন। আর তিনমাস বাকি আছে।’

কথাটা শুনে আমার কান যেনো সেখানে আরও আটকে রইলো গভীরভাবে। গাড়ির ড্রাইভার বাসার গাড়ি নিয়ে নিচে এসেছে। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো, তাহলে ওই আকাশি রঙের শার্ট পরা ছেলেটা তাহে কে? ওই শার্টটা তো আসিফের। তাহলে কি আসিফের মদের নেশার সাথে সাথে নারীর নেশা এখনও রয়ে গিয়েছে?

বাসায় আসতে আসতে একটা বেজে গেলো। ননাস জানালো, বিকালে তামান্নার শাশুড়ি বাসায় আসবেন তার বোন দুইজনকে নিয়ে। তারা লন্ডন থেকে এসেছেন। তারা দেখবেন তামান্নাকে। আমি যেনো এক্ষুণি নাস্তা রেডি করতে যাই।

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলাম। রুমে গিয়ে কাপড় চেইঞ্জ করে রান্নাঘরে গেলাম। এই কম সময়ে পিৎজা আর নারিকেল পুলি বানাবো বলে ঠিক করলাম। শাশুড়ি এসে যুক্ত হলেন আমার সাথে। ননাস রান্নাঘর পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললো,

‘আসিফের সাথে কোথায় গিয়েছিলা নুপুর?’

আমি শুনেও না শোনার বাহানা করে ময়দা মাড়লে লাগলাম। শাশুড়িও কোন সায় দিচ্ছেন না দেখলাম আমার ননাসের কথায়।

কিছুক্ষণ পর বাসার কাজের মেয়ে মরজিনা দুইটা শার্ট এনে আমার সামনে ধরলো। সামনে ধরে বললো,

‘ভাবি ভাইয়ের কোনটা আর দুলাভাইয়ের কোনটা?’

আমার চোখ চড়কগাছ। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। দুইটা একই কালারের শার্ট! ওই শার্ট যেইটা আমি দেখেছি রাস্তার সেই ছেলেটার গায়ে যে ছেলেটা কারে উঠেছিলো!

আমি মরজিনাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘দুইটা এক কালারের শার্ট? দুইটা কার কার?’

‘আরে ভাবি আমার মনে আছে আফা একটা দুলাভাইরে দিছিলো আর একটা ভাইরে। আফনে বাড়িতে আছিলেন৷ এহন দুইটা ধুইতে দিছে খালাম্মা। এহন দুইডাই দেখি এক৷ কোন পার্থক্য নাই৷ একই মাপের। কোনডা কার এইডা বুঝমু কেম্নে কন দেহি?’

‘তোর এতসব বুঝতে হবে না। তুই এক কাজ কর চা বানিয়ে নিয়ে আয়। আমি বারান্দায় যাচ্ছি। এলোভেরা গাছ দুইটা টবে দিতে হবে আলাদা করে। ছানাপোনা দিয়ে একদম ভরিয়ে দিয়েছে। শার্ট দুইটা আমাকে দে। আর মা শুনো, তোমার জামাইর জন্য কাতলা মাছের মাথা রেখে দিয়েছি। তোমার হাতের মুগডাল ওর ভালো লাগে। রাতে একটু মুগডাল আর দেশি মোরগ ভূণা করে দিও। নুপুর তোমার দুলাভাইয়ের জন্য একটু ফিরনি করে দিও কেমন?’

তামান্না এসে বললো,

‘আপা দুলাভাইকে বলে দিও আইসক্রিম আনতে। খালি হাতে যেনো না আসে।’

‘খালি হাতে আসছে সে? আসছে কখনো?’

বাজখাই গলায় কথাগুলো বলে, ননাস শার্ট দুইটা মরজিনার হাত থেকে নিয়ে নিলেন। মরজিনার দিকে আবার তাকিয়ে তাড়াতাড়ি আসার আদেশ দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন তিনি। আমার অবাক চোখ, আশ্চর্য হওয়া মন, সন্দেহের তীর সব যেনো নিমিষেই বদলে গেলো!

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৩৬
#মিদহাদ_আহমদ

*গ্রুপ প্রাইভেট করে ফেলা হবে শীঘ্রই। যারা জয়েন না হয়ে গল্প পড়ছেন, আপনারা আর পড়তে পারবেন না। আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম। জয়েন হয়ে নিন**

সন্ধ্যার পর তামান্নার হবু শাশুরি আর খালা শাশুড়িরা চলে গেলেন৷ তামান্না আর ননাস মিলে মার্কেট করতে চলে গিয়েছে। শাশুড়ি তার রুমে বসে সিরিয়াল দেখছেন। শ্বশুরও শাশুড়ির পাশে বসা ছিলেন। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে আমি উঠে গেলাম। উপর থেকে দেখলাম, কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিলো। দুলাভাই এসে ঢুকলেন। আমি তড়িঘড়ি করে দুলাভাইর সামনে গেলাম। দুলাভাইকে বললাম, ওনার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে। দুলাভাই প্রথমে না করলেও শেষে বললেন কী বলার সরাসরি বলতে। ওনাকে ড্রইংরুমে বসতে বললাম। কাজের মেয়েকে চা করে আনতে বললাম। দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘সেই মেয়ে কে ছিলো?’

দুলাভাই হাঁক ছেড়ে উঠলেন। অপ্রস্তুত আর রাগ দুটোকে কন্ট্রোল করতে না পেরে তেড়ে বললেন,

‘কোন মেয়ে? কীসের মেয়ে? কার কথা বলছো?’

‘দুলাভাই আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন?’

‘তোমার এত বড় সাহস, তুমি আমার সাথে এমন করে কথা বলছো? আমি এই বাড়ির জামাই হই। মা, কোথায় আপনি? কোথায় আছেন? এদিকে আসেন। দেখে যান আপনার একমাত্র পুত্রবধূ আমার সাথে কেমন আচরণ করছে।’

চিল্লাচিল্লি করে পুরো ঘর দুলাভাই মাথায় তুলে নিলো একেবারে। উপর থেকে শ্বশুর শাশুড়ি নেমে এলেন। শ্বশুর জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হয়েছে বাবা?’

‘দেখেন বাবা আমার মুখেও আনতে লজ্জা হচ্ছে। আর নুপুর কিনা আজ সরাসরি আমার চরিত্রের উপর আঘাত করলো? সে বলল, আমাকে নাকি একটা মেয়ের সাথে দেখেছে গাড়িতে উঠতে? এই কথা কি সে বলতে পারে? আপনি বলেন?’

শাশুড়ি আমার দিকে চেয়ে বললেন,

‘কী নুপুর? কী শুনছি এসব? তুমি কেন জামাইকে এসব বললা?’

আমি জবাব দিলাম না। দুলাভাই বললেন,

‘গ্রামের মেয়েদের এই একটা স্বভাব। এরা ম্যানার জানে না। কার সাথে কেমন বিহেইভ করতে হবে এইটা জানে না। জানে না কখন কোথায় কী বলা লাগে। তার উপর এখন আমাকে ব্লেইম দিচ্ছেন! হাউ সেকুলাস!

দুলাভাইয়ের এসব কথা বলতে বলতে বাসায় এসে আমার ননাস আর ননদ ঢুকলো। ননদ ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বললো,

‘ভাবি আমার ওড়নাটা সাথে নেইনাই। ওইযে কাল যেটা আনিয়েছিলাম, ওইটার লেইস কিনবো। মেহেদিতে পরবো যেইটা। ওটা সাথে করে না নিলে লেইস মিলাবে কীভাবে বলো? তুমি একটু আমার ওয়ারড্রব থেকে এনে দাও না।’

তামান্না এই মহলের পরিস্থিতি বুঝতে পারেনাই। ননাস দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কী হয়েছে? সবাই এখানে চুপচাপ…’

‘কী আর হবে? তোমার ভাইয়ের বউ আমার উপর এফেয়ারের মামলা দায়ের করেছে। আমাকে বলছে, আমায় নাকি সে একটা মেয়ের সাথে দেখেছে৷ আমি এই ঘরে তোমার সাথে এসে থাকছি, শুধুমাত্র তামান্নার বিয়ের জন্য। আর এখানে আমাকে সর্বক্ষণ এভাবে অপমান করা হচ্ছে? মিথ্যা ব্লেইম দেয়া হচ্ছে আমার নামে?’

আমি দাঁড়িয়ে শুনলাম সবকিছু। কোন জবাব দিলাম না। ননাস তেড়ে আসলো। ছোটলোকের বাচ্চা, গরীব ঘরের মেয়ে, নিজের সংসার সামাল দেবার মুরোদ নেই সহ আরও কত কিছু! মুখে যা আসলে তাই বললেন তিনি। তামান্না এসে তার বোনকে নিয়ে গেলো রুমে। আমাকে বলে গেলো তামান্না

‘তোমারও না হয়েছে ভাবি। কী দরকার এসব দেখার? যে যাই করুক সবকিছুতে নাক গলানো স্বভাব আর যাবে না তোমার নাকি?’

শাশুড়ি আমাকে কিছু বললেন না আর। দুলাভাইর সামনে গিয়ে দুলাভাইকে সোফায় বসিয়ে বসিয়ে বললেন,

‘দামান্দ বসো। এতো তাড়াতাড়ি মাথা গরম করলে হবে বলো? আমার বড় ছেলের জায়গা দখল করে আছো তুমি। আর তুমি যদি এভাবে এসবে রেগে যাও তাহলে এই বুড়ো শ্বশুর শাশুড়িকে সামাল দিবে কে? হয়তো নুপুর তোমার মতো দেখতে কাওকে দেখেছে তাই…’

‘না মা। আমার স্বামীর মতো কাওকে দেখেছে মানে? তুমিও কি সায় দিচ্ছো এখন?’

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো ননাস। শাশুড়ি মা আমতা আমতা করে বললেন,

‘না আসলে আমি…’

‘কোন না না মা। তোমার আদরের পুত্রবধূ এক্ষুণি আমার স্বামীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আর নাহলে আমি আর এক মুহূর্ত এই বাড়িতে থাকবো না।’

দেখলাম দুলাভাই উঠে গেলো সোফা থেকে। আপার হাতে ধরে কী কানে কানে কী যেনো বললো। আমি আর কারোর কিছু বলার অপেক্ষায় রইলাম না। দুলাভাইর সামনে গিয়ে সরি বলে উপরে চলে এলাম নিজের রুমে। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। আর যদি আমার বাবা বেঁচে থাকতো, তাহলে আর আমি এখানে থাকতাম না। বাবার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতাম। তাতে অন্তত আমার কিছুটা কষ্ট লাঘব হতো। ছোট বেলায় যখন মা, ফুফুরা আমাকে বকা দিতো, এক দৌড় দিয়ে চলতাম বাবার কাছে। জড়িয়ে ধরে কান্না কর‍তাম। আল্লাহ আমার সেই জায়গাও রাখলেন না। রাখলেন না।

রুমে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর শাশুড়ি মা রুমে এলেন। ওনার হাতে এক প্লেইট তরমুজ। রুমের এসি অন করতে করতে বললেন,

‘এই গরমে এসি অন করোনি কেন নুপুর?’

আমি জবাব দিলাম না। আমার পাশে বসে শাশুড়ি মা বললেন,

‘জানি রে মা। এই কষ্ট কেমন। আর এই অপমান সহ্য করার শক্তিও কেমন। নিচে কিছু বলিনি। তুমি তো দামান্দের কারো সাথে এফেয়ার এইটা একবারের জন্যও বলোনি। কিন্তু সে নিজ থেকেই সেইটা বললো! তুমি কি সত্যি সত্যিই তাকে দেখেছো?’

আমি এবার শাশুড়িকে বিস্তারিত খুলে বললাম। এও বললাম যে আসিফকে আমি প্রথমে সন্দেহ করেছিলাম। তারপর এই একই কালারের শার্ট দেখে সন্দেহের তীরটা দুলাভাইর উপর যায়। কিন্তু দুলাভাই যে কারো গাড়িতে উঠতেই পারে। গাড়িতে উঠা দোষের কিছু না। সে যে এফেয়ারের কথা বললো…’

শাশুড়ি মা আমার মুখ আটকে দিলেন। জড়িয়ে ধরে আমাকে কান্না করতে করতে বললেন,

‘মা রে এমন যদি কিছু হয়, তাহলে আমার মেয়েটা বাঁচতে বাঁচতে মরে যাবে। এমন কিছু যদি হয়, তাহলে তানিয়া আর সহ্য করতে পারবে না৷ জীবনে মা হওয়ার যে সাধ, সেই সাধ থেকেও আমার মেয়েটা বঞ্চিত৷ হায় আল্লাহ! আমার মেয়ের জীবনটা আর এমন করো না। বিষিয়ে তুলো না।’

অন্যদিকে রুমে গিয়ে বদরুল তানিয়াকে বললো,

‘কী যা তা বলে বসো হুট করে? যদি সে সরি না বলতো তাহলে সত্যি সত্যিই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতা?’

তানিয়া বদরুলের বুকে মাথা রেখে বললো,

‘জানো বদরুল, তোমার উপর কেউ মিথ্যা অপবাদ দিক এ আমি সইতে পারবো না। আমাকে যে যাই বলার বলুক, তোমাকে কেন বলবে? আর আমি জানি তুমি এমন করতে পারো না। আমার বিশ্বাস কখনো এমন করতে পারে না। এই বিশ্বাস আমি তোমার উপর করেছি। আমার নিজের স্বামীর উপর। আর সে ক্ষমা না চাইলে, আমার এই বাড়িতে থাকার মোহ সত্যি সত্যিই নেই। আমার জন্য তুমিই সবকিছু। তুমিই।’

আবারও জড়িয়ে ধরলো বদরুলকে তানিয়া তার ভালোবাসার ছোঁয়ায়।

(চলবে)