বিন্নি ধানের খই পর্ব-৫৩+৫৪+৫৫

0
326

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫৩
#মিদহাদ_আহমদ

মা গল্পের হাতে ধরলেন। তারপর গল্পকে বললেন,

‘জানো আজ কে এসেছে নানুভাই?’

‘কে?’

‘ওইযে একটা ছবি দেখে তুমি বলতে না ওই সুন্দর মেয়েটা তোমার কে হয়? আমি কী বলতাম তখন?’

‘ওই মেয়েটা? ওইযে যার লম্বা লম্বা চুল, ইয়া মোটা মোটা চোখ ওই মেয়েটা?’

‘হ্যাঁ নানুভাই। ওই মেয়েটাই।’

‘ওই মেয়েটা কি আমার আম্মু হয়?’

এবার শাশুড়ি এগিয়ে গেলেন। গল্পকে বললেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওই মেয়েটাই তোমার আম্মু হয়।’

গল্প এবার ননাসের দিকে ফিরে তাকালো৷ ননাসের চোখে চোখ রেখে কী যেনো সে অনুধাবন করলো। তারপর ননাসের আঙুল ধরে আমার গল্প বলতে লাগলো,

‘এইতো আমার আম্মু৷ এইতো আমার আম্মু৷ নানুভাই তুমি কি আমার জন্য মিত্তি মিত্তি পায়েস রান্না করেছো? আমি পায়েস খাবো। আমি পায়েস খেয়েই ছবি আঁকতে বসে যাবো৷ আজ আমার অনেক ছবি আঁকতে হবে। তুমি আমাকে হেল্প করবে মা?’

ননাস জড়িয়ে ধরে গল্পকে বললো,

‘হ্যাঁ মামুণি৷ মা তোমাকে পুরো রাত জেগে থেকে হেল্প করবে। এক্সিবিশনে আমার মামণিকেই ফার্স্ট হতে হবে। তাইনা?’

‘ইয়েস মামুণি।’

‘আচ্ছা মামুণি, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেয়ার আছে।’

‘কী সারপ্রাইজ মামুণি?’

‘ওইযে আমি তোমাকে গল্প বলি না? রাজকন্যার গল্প? রাজার মেয়ের গল্প?’

‘ওই গল্প না, যে গল্পে সব সময় ছোট্ট রাজকন্যা বিপদে পড়ে?’

‘হ্যাঁ মামুণি। ওই গল্পই। তারপর ওই গল্পে একজন আম্মু এসে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে দেয় না সব সময়? কিন্তু কখনো সামনে আসে না?’

এবার গল্প কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলো। তাকালো এদিক ওদিক। উপরের দিকে তাকাতেই আমাকে আর আসিফকে দেখতে পেলো গল্প। ননাস গল্পকে বললো,

‘ওই গল্পে রাজকন্যাকে এসে যে আম্মু বাঁচিয়ে নিতো সব সময়, সেই আম্মুকে তুমি দেখতে চাও?’

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো গল্প। তারপর আস্তে আস্তে তানিয়ার কাছে গিয়ে বললো,

‘সেই আম্মু কোথায়? আর ওইযে আমার আব্বু না? যাকে ছবিতে আর ভিডিও কলে দেখতাম?’

তানিয়া এবার গল্পের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। গল্পকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে আমার দিকে তাক করে বললো

‘এই হচ্ছে তোমার আম্মু। গল্পে যে আম্মু এসে তার রাজকন্যাকে বাঁচিয়ে নিতো সব সময়, সেই আম্মুই আজ তোমার সামনে চলে এসেছে।’

আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার চোখ ভিজে জল টলমল করছে। আসিফও আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে হাতে। ননাসকে গল্প বললো,

‘উনি তো আমার আন্টি। তাইনা মামনি? উনি রোজরোজ আমাকে কল করতেন তাইনা? ভিডিও কল দিতেন। আন্টি আন্টি, তুমি বলেছিলে আসার সময় আমার জন্য কালার পেন্সিল আর চকোলেট আনবে। এনেছো তো? জানো আন্টি, মামুনি আমাকে অনেক অনেক কালার পেন্সিল কিনে দেয়৷ কিন্ডারজয় কিনে দেয়। আমার পছন্দের পিৎজা খাওয়ায় সব সময়। আর নানুভাই আমাকে মিত্তি মিত্তি পায়েস করে খাওয়ায়।’

আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। জড়িয়ে ধরলাম গল্পকে। গল্পও কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর গল্পকে তার বাবা এসে ধরতেই গল্প নিজ থেকে তার বাবাকে আকড়ে ধরলো। আর বলে উঠলো,

‘বাবা বাবা। আমি অনেক মিস করেছি তোমাকে। অনেক।’

এক হাতে গল্প তার বাবাকে আর আরেক হাতে ননাসকে ধরলো। তারপর গল্পের মুখে সে কী খুশি! সদ্য দুধদাঁত হারানো চোয়াল খালি চেয়ারায় অদ্ভুত মায়াবি লাগছে মেয়েটাকে। ননাস তার হাত ছাড়িয়ে গল্পের হাত আমার হাতে তুলে দিলো৷ গল্প আমাকে আর তার বাবাকে ছেড়ে দিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ননাসকে। ননাস গল্পকে রেখেই তার রুমে চলে গেলো। শাশুড়ি উপরে উঠে এসে গল্পের হাত ধরে বললেন,

‘দেখি দেখি তোমরা কী এনেছো আমার গল্পের জন্য? দেখি তো৷ দেখাও।’

আমি, আসিফ, গল্প, শাশুড়ি মা আমাদের রুমে ঢুকলাম। গল্পকে তার বাবা খাটে বসালেন৷ গল্প তার বাবাকে বললো,

‘তুমি আমার বাবা না? আমি কতো মিস করেছি তোমাকে। জানো মা বলেছে যে তুমি একদিন ঠিকই আসবে।’

তারপর গল্প তার দাদির দিকে চেয়ে বললো,

‘তাইনা দাদুভাই?’

‘হ্যাঁ দাদুভাই৷ তোমার আব্বু আম্মু সব এসেছে ‘

আমি ব্যাগ খুকে চকোলেটের বেশ কয়েকটা বড় বড় প্যাকেট বিছানার উপর ঢেলে দিলাম৷ বড় টেডি বিয়ারটা বিছানার নিচে রাখলাম। গল্প আমতা আমতা করে বললো,

‘এত্ত চকোলেট! এগুলো সব আমার জন্য?’

‘হ্যাঁ মা সব তোমার জন্য।’

‘আর ওই টেডিটা? ওইটাও কি আমার?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। টেডিটাও তোমার মা।’

‘আর পেন্সিল এনেছো? রেড, ইয়েলো, ভায়োলেট,গ্রিণ কালারের?’

আমি এক ব্যাগ রঙ পেন্সিল, ওয়াটার কালার, পোস্টাল কালার তুলে দিলাম গল্পের হাতে৷ গল্পের চোখেমুখে আনন্দ হাসি। গল্প দুই হাতের মুঠোয় কালার পেন্সিল ধরতে ধরতে যে কয়টা ধরতে পারলো, ধরেই এক দৌঁড় দিলো রুম থেকে। আমরা পিছুপিছু গেলাম। দেখলাম গল্প ননাসের রুমের দিকেই ছুটছে। দরজা লাগানো ভেতর থেকে। সে দরজার বাইরে থেকে ডাকতে লাগলো,

‘মামুণি, মামুণি দেখো এতো এতো কালার পেন্সিল পেয়েছি আমি৷ ওই আন্টি আমাকে দিয়েছে৷ দলজা খুলো তুমি। দেখো।’

ননাস দরজা খুললো। হাত উঁচুতে ধরিয়ে গল্প দেখালো কালার পেন্সিল গুলো। ননাস গল্পকে তার কোলে তুলে নিলো। শাশুড়ি আমাকে নিয়ে রুমে এলেন। মাও রুমে চলে এলো। শাশুড়ি মা আমাকে খাটে বসিয়ে বললেন,

‘জানো নুপুর, এই কয়টা বছর আমাদের কীভাবে কেটেছে? যদি গল্প না থাকতো, তাহলে হয়তো তানিয়া আর তানিয়া থাকতো না। মেয়েটা কেমন জানি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো প্রথমে! তারপর যেনো শক্ত হাতে হাল ধরলো গল্পকে নিয়ে। সারাদিন তার ধ্যান জ্ঞান সব গল্প। খাওয়া দাওয়া সব গল্প। পড়া, গান, খেলা, আঁকা সব যেনো গল্পকে ঘিরেই৷ গল্পই যেনো তার বেঁচে থাকার নতুন অনুষঙ্গ। আর মারে, দোষ আমার। আর কারো না৷ আমিই চেয়েছি গল্পকে তোর থেকে আড়াল করতে। গল্প যেনো আমার মেয়ের সাহারা বনে, আমার মেয়ের জীবন হয়ে উঠে, এইটাই চাইতাম বারেবারে। ‘

এবার আমার মা আমার হাতে নিজের হাত ধরে বললেন,

‘গল্পের বেড়ে উঠায়, তানিয়ার যেমন হাত, সেই হাত হয়তো তুই নিজেও পারতি না রে মা। তানিয়া গল্পের মা হয়ে উঠেছে তোর মা হয়ে উঠার আগেই।’

এমন সময় তানিয়া আপা রুমে এসে ঢুকলো। আমার পাশে বসে তানিয়া আপা বললো,

‘নুপুর বোন আমার, এই জীবনে আমি অনেককিছু হারিয়েছি৷ আমাকে আর কোনকিছু হারাতে দিস না। আমি গল্পকে ছাড়া বাঁচবো না। আমি কথা দিচ্ছি, আমি গল্পকে কাছে টেনে না, দূরে থেকেই দেখে যাবো। তবুও আমার গল্পকে আমার থেকে দূরে নিস না।’

তানিয়া আপা তারপর তার ভাইয়ের হাত ধরে বললো,

‘কীরে আসিফ? আমরা একসাথে যখন লুডু খেলতাম, আর আমাকে তামান্না খেয়ে দিতে আসলে তুই আমার গুটি একঘর এগিয়ে নাহয় পিছিয়ে দিতি মনে আছে রে ভাই? তোর বোনকে আগে যেমন জিতিয়ে দিতি, এবারও নাহয় জিতিয়ে দে। তোর বোনটা তার জীবন যুদ্ধে হেরে, তোরই বাচ্চাটাকে নিয়ে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখেছে। তোর বোনটাকে আবার জিতিয়ে দে।’

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ননাস। আমি কোনকিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। এক স্তব্ধতা ভর করেছে যেনো আমাকে। আসিফ আমার দিকে তাকালো। তার এই তাকানোর মানে হয়তোবা আমার মেয়েকে তার বোনের হাতে তুলে দেওয়া! আমার চোখে আর কানে বারবার ভাসতে লাগলো, এই কয়েক বছরে আমি যতোবারই কল দিতাম দেশে, শাশুড়ি আর ননাস মিলে শুধু আমাকে আমার মেয়ের সাথে দেখা করাতেন। কথা না! দূর থেকেই দেখতাম আমার মেয়ে গাইছে, খেলছে, আঁকছে, খুশি করছে। আমি এতেই যেনো খুশি ছিলাম! আমার মাও তো এখানে আসা যাওয়া করতেন। তিনিও আমাকে কিছু বললেন না! একটাবারের জন্যও না? সবাই কি তাহলে আমার নিজের পেটের সন্তানের সাথে নিজেদের সমঝোতা করলো? শেষ পর্যন্ত আসিফও? মেয়েটা আমার তার বাবাকে চিনতে পেরেছে কিন্তু যেই আমি নয়মাস পেটে রেখে তাকে জন্ম দিয়েছি, সেই আমাকে চিনতে পারলো না? এই তাহলে আমার মাতৃত্বের জোর?

আসিফ আমার হাতের উপর তার হাত শক্ত করে ধরলো। এই ধরার মানে আমি বুঝি। আমি কি আবার চুপ করে যাবো? ভেতর থেকে আমার মাতৃশক্তি যেনো জেগে উঠলো। আমি বললাম,

‘না। কখনো এমন হবে না। আমার মেয়েকে আমি অন্যকারো হাতে তুলে দিবো না।’

শাশুড়ির রুম থেকে বিকট একটা শব্দে কেঁপে উঠলো আমাদের দ্বিতল ভবন। জীবন এক বিশাল মোড়ে যেনো ঘুরে গেলো মুহূর্তেই।

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫৪
#মিদহাদ_আহমদ

শ্বশুরের রুমে ছুটে গেলাম আমরা সবাই। গিয়ে দেখি তিনি বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে গিয়েছেন। আসিফ আর শ্বাশুড়ি গিয়ে তাকে ধরে বিছানায় তুললো৷ পায়ে বাজেভাবে আঘাত হয়েছে। তানিয়া আপা আর শাশুড়ি গাড়িতে করে শ্বশুরকে হসপিটালে নিয়ে গেলো সাথেসাথে। আসিফ যেতে চাইলে শাশুড়ি না করলেন। বাসায় মাত্র এসেছে৷ শাশুড়ি তাকে রেস্ট নিতে বললেন।

আসিফ সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেলো। সিগারেটের প্যাকেটটা সাথে নিলো। আমি রুমে ঢুকে বিষন্ন হয়ে বসা রইলাম খাটের উপরে৷ মা এসে ঢুকলেন৷ আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। মাকে রাগান্বিত গলায় বললাম

‘মা তুমি কি তোমার পেটের মেয়েকে অন্যকারো হতে দিবা? দেখতে পারবা যে অন্যকারো হাতে তোমার মেয়ে বড় হচ্ছে? আমি কি এসব মেনে নিবো এবার?’

মা বললেন,

‘মারে, তোকে আজ না, এখন না, আজ থেকে কত বছর আগে বলেছিলাম যে ঘরকর্ম কর। সংসার কর। এসবে মন দে। কিন্তু কী করলি তুই? নিজের ঘর, সংসার, সাজানো সবকিছু ছেড়ে চলে গেলি দেশের বাইরে? একমাত্র পেটের সন্তানকে ছেড়ে? আমি আর কী বলবো রে মা। দুনিয়া বড়োই নিষ্ঠুর।’

‘তাই বলে মা আমি এখন আমার নিজের মেয়েকে অন্যের হাতে…’

‘না। অন্যের হাতে কেন হবে? যা নিজের হাতে নেই, তা নিজের হাতে আনতে হবে। এইটাও তো ভুল না গল্প তোর ননাসের কাছে মায়ের আদর পেয়েছে। মিথ্যা বলবো না। আমি তো দেখেছি নুপুর, তোর মেয়েকে তোর ননাস কেমন করে আগলে রেখেছিলো? কারো স্নেহ তো আর ভুল হয় না রে মা। পেটের সন্তান না, যে কোন সন্তান বলেই যদি কোন মহিলা কাওকে আগলে নেয় নিজের কাছে, সেই হয়ে উঠে মা। মা হওয়ার জন্য মাতৃত্ব শুধু থাকা লাগে না। মা হওয়ার জন্য একটা মন লাগে, একটা প্রেম লাগে, একটা নিষ্ঠা লাগে। মায়েরা করকিছু ছাড় দেয় জীবনে! জীবনের ছাড় ছাড়া কি আর মা হওয়া যায় রে মা?’

মায়ের কথা শুনে আমি কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। মনে হতে লাগলো পুরো দুনিয়াটাই আমার কাছে অন্ধকার হয়ে আসছে। আসিফ এসে ঢুকলো রুমে। আসিফ মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘মা আপনিই বুঝান এখন নুপুরকে। আর আমার বড় বোনের কোন বাচ্চা নেই। কোন সন্তান নেই। সে তো আমাদের মেয়েকে মাতৃস্নেহে আগলে নিয়েছে নিজের মাঝে। তার দাবীর কাছে তো আমরা এখন কোনকিছু বলতেও পারবো না। মেয়েতো আমাদের সামনেই আছে তাইনা?’

‘কেন বলতে পারবো না? কেন? আমি কি বলেছি তোমার বোন আমার মেয়েকে মাতৃস্নেহ দেয়নি? আমি কি বলেছি আমার মাতৃত্ব শতভাগ ছিলো? আমি কি দাবী করেছি আমার মেয়েকে তোমার বোনের থেকে আলাদা করে দিবো? না করিনি। তাহলে সেক্রিফাইজ আর হেনতেন এসব আমাকে শুনতে হবে কেন? আমাকে কেন এসব সাফার করতে হবে?’

‘নুপুর, নুপুর, নুপুর তুমি শুধু শুধু…’

‘কী শুধুশুধু? আমি শুধুশুধু? আমি বকবক করছি তাইনা? গল্প আমার মেয়ে। গল্প শুধু আমার। আমি আমার জীবন বাজিতে রাখবো তবুও কখনো গল্পকে হাতছাড়া করবো না৷ গল্পের জন্য আমার জীবনের শেষ বিন্দু রক্ত অবধি যদি দিতে হয়, তবে আমি তাই দিবো।

রুমে এমন সময় ধীরপায়ে চুপিসারে এসে ঢুকলো গল্প। গল্পকে দেখেই আমি এগিয়ে গেলাম। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে গল্পকে কোলে নিতেই গল্প আমতা আমতা করে বললো,

‘আমি কর্ণফ্লাক্স খাবো। আমাকে কর্ণফ্লাক্স দিবা?’
‘কেন না মা? আম্মু তোমাকে এক্ষুণি কর্ণফ্লাক্স করে দিচ্ছি৷ তুমি বাবার পাশে বসো একটু।’

গল্প হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। ফ্রেশ না হয়েই পরনের কাপড় পরে রান্নাঘরের দিকে চললো নুপুর। নুপুরের মা মনে মনে বললেন, মেয়েকে এসব বলার পর যদি তার ঘর সংসারে মন বসে, তাহলেই ভালো। নুপুরের মা নাতনিকে কোলে করে নুপুরের পেছন পেছন রান্নাঘরে গেলেন। নাতনিকে নুপুরের দিকে ইশারায় দেখিয়ে বললেন,

‘দেখো নানুভাই তোমার আম্মু তোমার জন্য কর্ণফ্লাক্স করতে গিয়েছে। তোমাকে তোমার আম্মু কতো আদর করে দেখেছো?’

‘কই? আম্মু তো এখানে নেই। আম্মু কই গিয়েছে নানুভাই?’

গল্পের মুখ থেকে এই কথাটা স্পষ্ট আমি শুনতে পেলাম। আমি কাজের মেয়েকে দুধ বের করতে বেলে চুপিসারে গল্পকে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম,

‘এইতো আম্মু। আম্মু এসেছি।’

গল্প কেমন জানি নীরব হয়ে গেলো। মা পাশে থেকে গল্পকে বললেন

‘আম্মু এসেছে তো নানুভাই। এই দেখো।’

ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চোখে গল্প আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘তুমি কি আমার আম্মু হও? আমাকে নিয়ে স্যারের ক্লাসে যাবা? সারগাম শেখাতে পারবা আমার মামুণির মতো?’

‘কেন পারবো না মা? অবশ্যই পারবো।’

বাবাকে নিয়ে রাত নয়টা নাগাদ শাশুড়ি আর ননাস বাসায় চলে এলো। পায়ে বাজেভাবে আঘাত লেগেছে। প্লাস্টার করে দিয়েছে ডাক্তার। হুইল চেয়ারে করে শ্বশুর যখন বাসায় এসে ঢুকলেন, গল্প তখন এক দৌঁড়ে তার দাদার কাছে গেলো। ছোট ছোট হাত পা দিয়ে এপাশ ওপাশ করে দেখতে লাগলো তার দাদাকে। তারপর আমার ননাসের হাতে ধরে বলতে লাগলো,

‘কী হয়েছে দাদুভাইয়ের? জানো মা, আজ না ওই যে নতুন মা এসেছেন একজন, ইয়া লম্বা আর ডাগর ডাগর চোখের উনি আমাকে নিয়ে অনেক্ষণ খেলেছেন। মিউজিক স্যারের অনলাইনে ক্লাসের পুরোটা সময় আমাকে উনি হেল্প করেছেন। তোমার থেকে ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারেন উনি। আমার আঙুল ধরে ধরে আমাকে বসিয়ে দিয়েছেন। জানো আমাকে একটুও ব্যথা দেননি। বকাও দেননি। তুমি চলো রুমে। তোমার সাথে আজকের অনেক গল্প বাকি আছে। চলো আম্মু।’

গল্প চোখের সামনে আমার ননাসের হাত ধরে সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলো। এক পা, দুই পা করে উপরে চলে গেলো। ননাস তার রুমে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। শ্বশুর আমাকে ডেকে বললেন,

‘এবার নাহয় এই বুড়োটার চায়ের একটা রফাদফা হবে৷ তোর শাশুড়ি আমার চায়ের চিনিতে কার্ফিউ বসিয়ে দিয়েছে।’

মা পাশ থেকে বললেন,

‘হয়েছে বেয়াই সাহেব। আমার মেয়েকে দিয়ে চায়ে চিনি মিশিয়ে আবার আমাকে বিপদি বানাইয়েন না।’

শ্বশুর হাসলেন মুখ ভরে। হাসতে হাসতে শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললেন,

‘আপনি দেখি আমার বউয়ের মতো কথাবার্তা বলছেন। আমার মেয়ে চলে এসেছে। আমার আর কোন চিন্তা নেই।’

‘কীরে মা? কেমন আছিস?’

শ্বশুর যখন আমাকে কীরে মা বলে সম্বোধন করলেন, আমার চোখের কোণে জল চলে এলো। আমার সামনে ভাসতে লাগলো আমার বাবার মুখ। এই একইভাবে আমার বাবাও আমাকে বলতেন, ‘কীরে মা, আজ খাওয়া হলো? আজ পড়া হলো? আজ কি তোর মন খারাপ রে মা?’ এই ডাক, এই আদর, এই আবহ আজ কত বছর হলো আমি শুনি না!
চোখের কোণে জলের আবহ হয়তো শ্বশুর বুঝতে পারলেন। বললেন,

‘হয়েছে এখন জল না। জল না। আসিফের মা আর আসিফের শাশুড়ি, দুজনে মিলে দুজনের মেয়ে জামাই আর আরেকজনের ছেলের বউয়ের জন্য খাবার রেডি করো। আজ জম্পেশ খাবারদাবার হবে। আমাকে কেউ আটকাতে পারবা না।’

শাশুড়ি আমাকে বললেন,

‘নুপুর তুমি শ্বশুরকে নিয়ে রুমে দিয়ে আসো। আমি আসছি তানিয়াকে দেখে।’

আমি শ্বশুরের হুইল চেয়ারের হাতল ধরলাম। মাও আমার সাথেসাথে চললেন। আসিফও চললো সাথে। যেতে যেতে শ্বশুর বললেন,

‘মারে, আমি সব বুঝি। বুঝেও আমি বুঝি না। তোকেও কী বলবো আর নিজের মেয়েকেও কী বলবো৷ কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে কিছু উপদেশ দিবো রে মা। দেখ, মাতৃত্ব আর মা হয়ে উঠা প্রতিটা নারীজীবনের আরাধ্য। আল্লাহ যাকে খুশি মা করেন, যাকে খুশি মা করেন না। কিন্তু এই মা করা আর মা না করার পেছনে যে জিনিসটা প্রধান সেই জিনিসটা হলো মায়ের ভালোবাসা। আজ তো চোখের সামনেই দেখলাম, গল্প তোকে নতুন মা বলে ডাকছে। তোর প্রশংসা করছে তার মায়ের কাছে। বাচ্চারা হয় নাজুক, নরম, কোমল আর স্রস্টার দেয়া ফিরিশতা। ফিরিশতা শুধুমাত্র ভালোবাসা বুঝে। ভালোবাসায় পৃথিবী গড়া যায়। আমি জানি তুই এমন এক মেয়ে, যে কিনা তার ঘর সংসার বুঝবে, ক্যারিয়ার বুঝবে আবার তার মায়ের দায়িত্বও বুঝবে। আমি এইটাও বুঝি, তুই কখনো আমার মেয়ের থেকে তোর গল্পকে আলাদা করবি না৷ সত্য তো এটাই, গল্প এখন পর্যন্ত তানিয়ার ভালোবাসা আর আদর্শেই বড় হয়েছে। এই আদর্শ আর মমতাকে তো অস্বীকার করা যায় না। আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে এই অস্বীকারে। কিন্তু গল্পকে পেটে ধরা মা তুই। তোর থেকে গল্পকে আলাদা করে দেয়ার মতো গর্হিত কাজ আমার চোখের সামনে আমি হতে দিবো না। এই কাজ আমি সহ্য করতে পারবো না। শুধু দোয়া করি রে মা, আল্লাহ যেন সবকিছু ঠিক করে দেন। দুই মায়ের আদর্শেই যেনো আমার গল্প দাদুভাই বেড়ে উঠে।’

শ্বশুরের কথাগুলো নীরবে শুনলাম শুধু। একবার তাকালাম আসিফের দিকে। এবার দেখলাম এক ভিন্ন জিনিস৷ আসিফ খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলে তার সাদা ফকফকা চেহারা লালবর্ণ ধারণ করে৷ মনে হয় যেনো টুনকা দিলেই রক্ত বের হবে। ফিনকি দিয়ে যেনো সব রাগ আর ভয়ংকর প্রলয় বের হবে। শ্বশুরের হুইল চেয়ারের হাতলে আমার হাত রাখা ছিলো। আসিফ আমার হাতের উপর তার হাত এনে শক্ত করে ধরলো। জানি না এই ধরার মানেটা কী! আমি স্থির করলাম, আমার লড়াই আমাকে একাই প্রয়োজনে লড়ে যেতে হবে। কোন বাধাই আমার জন্য বাধা হয়ে আসবে না। এই লড়াই আমার না, এই লড়াই আমার মাতৃ পরিচয়ের। শক্ত যদি হতেই হয়, তবে এবার শক্ত হবো আমি।

এদিকে তানিয়া গল্পকে রুমে নিয়ে বলতে লাগলো,

‘তুমি আর ওই ডাগর ডাগর চোখের মেয়েটার কাছে যাবে না৷ কেমন মা? আমার অনেক ভয় করে মেয়েটাকে। তোমাকে যদি সে নিয়ে গিয়ে রাক্ষসীর হাতে তুলে দেয় তখন?’

‘ও কি রাক্ষসী?’

‘হ্যাঁ মা। অনেক বড় রাক্ষসী।’

‘আমাকে খেয়ে দিবে?’

‘আস্ত করে খেয়ে দিবে।’

‘কীভাবে?’

‘অনেক অনেক অনেক ভয়ংকর। আমি বলতেই ভয় পাচ্ছি মা। তুমি ওর কাছে একদম যাবে না।’

‘তুমি না বললা ওই মেয়েটা আমার গল্প রাজকন্যাকে যে এসে বাঁচাতো সেই মেয়েটাই?’

‘আমার ভুল হয়েছে মা। ‘

‘অহ আচ্ছা। বুঝেছি।’

তানিয়ার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সব শুনতে পেলেন তানিয়ার মা। রুমে এসে মেয়েকে চোখ ইশারায় এসব বলতে নিষেধ করলেন। তানিয়াও তার মায়ের দিকে তাকালো ভয়ার্ত চোখ নিয়ে। এ যেনো চোখেচোখে কথা বলা হচ্ছে। একদিকে নিজের পেটের মেয়ে আর অন্যদিকে নিজের বংশের একমাত্র পুত্রবধূর মেয়ে, কার দিকে যাবেন তিনি! এ এক অসহায় মানব কথন। মায়েরা যুগে যুগে এতোটা অসহায় হয় কেন?

(চলবে)

#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৫৫
#মিদহাদ_আহমদ

গভীর অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে আছে আসিফ। ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে নুপুর। দুজন দুজনের পাশে থেকেও যেনো যোজন যোজন দূরে।

আসিফ আমার উপর তার ডান হাত রাখতেই আমি বিছানায় উঠে বসলাম। কোন কথা বললাম না৷ আসিফও উঠে বসলো। লাইট জ্বালালো৷ তারপর বললো,

‘আই এম সরি নুপুর। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জীবনে কখনো ভাই হয়ে বোনের উপর নিজের কর্তব্য পালন করিনি। তাই এখন ভেবেছি, হয়তো নিজের বোন এক স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে নিজের মাঝে, সেই স্বপ্নকে যেনো লালন করতে দেই৷ কিন্তু এখন রিয়েলাইজ করছি, আমি ভুল। আমার চিন্তা ভুল। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও নুপুর। আমি এই অন্যায় চিন্তার কারণে নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত।’

আসিফের এক নাগাড়ে বলা কথাগুলো আমি শুনলাম শুধু। কোন জবাব দিলাম না৷ আসিফ আমার হাতের উপর তার হাত রেখে বললো,

‘তুমিই তো আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছো নুপুর৷ তোমার উপর ভরসা করেই তো আমি আমার জীবনে ফিরে এসেছি। আর আজ যখন আমি আমার জীবনে করা কোন এক ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, তখন তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না বলো?’

‘আমার গল্প…’

আসিফ এবার আমাকে তার বাহুতে নিয়ে ধরে বললো,

‘আমার গল্প, তোমার গল্প, আমাদের গল্প। আমাদেরই আছে সে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি নুপুর, আবদার আবদারের জায়গায় রেখে দিয়েও আমি তোমাকে তোমার গল্প ফিরিয়ে দিবো। আমি আমার বোনের চিন্তাও করছি, কিন্তু একজন মায়ের বুক থেকে তার বাচ্চা কেড়ে নিয়ে অন্যের সংসারের চিন্তা নয়!’

আমি আর সামলাতে না পেরে ঢলে পড়লাম আসিফের বুকে। কিছুক্ষণ কান্না করলাম তাকে জড়িয়ে ধরে। বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,

‘আমার মেয়েটাকে আমি নিজ থেকেই আমার দূরে সরিয়েছি। আমার চেয়ে খারাপ মা এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই। আমার পেটের সন্তান রেখে আমি কীভাবে দেশের বাইরে এভাবে পড়ে রইলাম। কীভাবে!’

‘কোন ভুল নাই এখানে নুপুর। লাইফে সবকিছুর দরকার আছে। আর দরকার যখন আমাদের গল্পের, তখন আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমাদের গল্প আমাদের মাঝেই ফিরে আসবে। আমাদেরই থাকবে।’

‘সত্যি তো?’

‘হ্যাঁ নুপুর। সত্যি।’

পরেরদিন সকালে আমি খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠলাম। শাশুড়ি আমাকে সকাল সকাল উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী হলো? এত সকাল যে? কোথাও যাওয়া আছে নাকি?’

‘না মা। গল্পের ক্লাস না?’

‘না তো। আজ তো গল্পের ক্লাস না। আজ শনিবার না? ওর স্কুল শুক্র ও শনিবার বন্ধ থাকে। আজ সে ড্রইং ক্লাসে যাবে। এখন বাজে সাতটা। ড্রইং ক্লাস সকাল এগারোটায়।’

আমার কেমন জানি এক অসহায় অসহায় মনে হলো নিজেকে। আমার নিজের মেয়ের কখন কোন ক্লাস, কখন স্কুল আর কখন ড্রইং মা হয়ে এর কোনকিছু আমি জানি না। এরচেয়ে বড় অসহায়ত্ব আমি এর আগে কখনো অনুধাবন করতে পারিনি। শ্বশুর ডাক দিয়ে বললেন,

‘মা এক কাপ চা বানিয়ে দাও তো এনে। কতদিন আমার মেয়ের হাতের বানানো চা খাই না। ‘

আমি মুখে হাসি এনে শ্বশুরের জন্য চা বানাতে গেলাম রান্নাঘরে৷ মা রান্নাঘরেই ছিলেন আসিফের জন্য পায়েস রান্না করায়। মা আমাকে অভয় দিয়ে বললেন,

‘তোর শাশুড়ি মায়ের কথাগুলো তো এমনই। এগুলো মনে নেয়ার কী আছে? তারচেয়ে বরং দেখতে হবে কীভাবে গল্পের মা হওয়া যায়। তাইনা?’

আমি জবাব দিলাম না আর। চা বানিয়ে শ্বশুরের রুমে নিয়ে গেলাম। শাশুড়িও বসা ছিলেন বিছানায়৷ শাশুড়ি আমাকে কাছে এনে বসালেন৷ শ্বশুর চায়ের কাপ পিরিতে লাগিয়ে হালকা মৃদু শব্দ করে কেশে উঠলেন দুইবার। শাশুড়ি বললেন

‘মারে, আমি বুঝতে পারছি তোর সব কষ্ট৷ একজন মা আর যাই হোক, তার পেটের সন্তানকে অন্তত অন্যকারো কাছে দেখে শান্তি পায় না।’

‘না না মা। এ আপনি কী বলছেন? তানিয়া আপা তো…’

‘না রে মা। আমি একদিকে মেয়ে অন্যদিকে বউ, এই দুইয়ের পাতাটনে পড়ে কোনদিকে যাব কিছু বুঝতে পারছি না। একবার না, বারবার আমার মনে হয়, আমি আমার জায়গায় অপারগ। আমার শক্তি নাই। তোমরা যখন আমেরিকা চলে গেলা, তখন গল্পই আমার মেয়েকে জীবন দিয়ে দিলো। ডাক্তার জানিয়েছে তানিয়া যে মানসিক ট্রমার মাঝে আছে সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসা অসম্ভব৷ যেকোন সময়ে খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। তানিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে পারে। এবং এখনও সে মানসিক ভারসাম্যহীন। গল্পকে যদি আমি কেড়ে নেই তার থেকে, তাহলে সে যদি তার উদগ্রীব কোনকিছু থেকে গল্পের খারাপ কোনকিছু করে বসে!’

‘কী বলছো এসব আসিফের মা। যা মুখে আসবে তাই বলে দিবা? একটু তো মহল বুঝবা নাকি?’

শ্বশুর জোর গলায় বললেন কথাগুলো। শাশুড়ি জবাব দিলেন,

‘সত্যকে আমি আর চাপা দিয়ে রাখতে চাই না আসিফের বাবা। নুপুর মা আমার, গতরাতে আমার সামনেই তানিয়া গল্পকে তোমায় ডাইনি বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তানিয়া এখন যেকোন ভাবেই চাইবে, গল্প তার হোক। পেটে না ধরলেও, পিঠে ধরে সে বড় করছে গল্পকে। গল্প ছাড়া তানিয়া কখনোই নিজের জীবন কল্পনা করতে পারবে না আর। এদিকে আমি এই অন্যায় আর দেখতে দিতে পারবো না।’

এমন সময় আসিফ রুমে এসে ঢুকলো। আসিফ শাশুড়ির পাশে গিয়ে বসে বললো,

‘মা, আমি কী করতে পারি এখন? আমি এই অন্যায় হতে দিতে পারবো না। একদিকে আমার বোন অন্যদিকে…’

আসিফ কথাগুলো শেষ করার আগেই ডাইনিং রুম থেকে চিল্লাচিল্লির শব্দ আসতে লাগলো। আমরা সবাই উঠে গেলাম। গিয়ে দেখি ননাস জোর করে দুধ খাওয়াচ্ছেন গল্পকে। গল্প খাবে না৷ সে না করছে বারবার। আমি এগিয়ে গেলাম। চেয়ার টেনে বসতেই গল্প উঠে গেলো চেয়ার থেকে। গল্প তাকালো ননাসের দিকে একবার। আমি গল্পকে টেনে কাছে আনলাম। ননাসের দিকে গল্প আবার তাকালো। বুঝতে পারলাম গল্প তার মায়ের অনুমতি নিচ্ছে। ননাস চোখের পলক ফেলে গল্পকে আমার কোলে বসিয়ে দিয়ে বললো,

‘লক্ষ্মী মেয়ের মতো এবার দুধগুলো খেয়ে ফেলো মা।’

‘তারপর আমাকে কিন্ডারজয় দিবে?’

ননাসকে জিজ্ঞেস করলো আমার মেয়েটা। ননাস বলার আগেই আমি বললাম,

‘হ্যাঁ মা। কেন দিবো না? অবশ্যই দিবো। তুমি দুধ খেয়ে নাও আগে।’

‘তুমি দিবে?’

আবারও শিশুসুলভ প্রশ্ন করলো গল্প। ননাস বললো,

‘হ্যাঁ আমি দিবো, সেও দিবে। তুমি আগে লক্ষ্মী বাচ্চার মতো খেয়ে নাও দেখি।’

গল্পের দুধ খাওয়ার পাট চুকিয়ে গল্পকে কোলে করে রুমে নিয়ে গেলো ননাস। দশটা নাগাদ সে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো গল্পকে নিয়ে। মা পাশে থেকে বললেন,

‘তানিয়া, নুপুরকে নিয়ে যা আজ তোর সাথে। সে দেখে এলো। ‘

তানিয়া আপা বললো,

‘নুপুউউর, যাবে আজ? বাইরে অনেক গরম। অন্যদিন যাবে? আজ আমি নিয়ে যাই গল্পকে? তাছাড়া তার এখন মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করা লাগবে। এক্সিবিশন আছে সামনে। আমি গেলাম।’

কোন কথা না বাড়িতেই গল্পকে নিয়ে রওনা দিলো তানিয়া। ঘরের দরজা পেরোনোর আগেই আমি ডাক দিলাম গল্পকে। আমার হাতে থাকা এক বক্স কিন্ডারজয় দেখাতেই গল্প দৌঁড় দিয়ে এগিয়ে এলো। উৎসুক চোখ নিয়ে গল্প বললো,

‘এসব আমার জন্য এনেছো?’

‘হ্যাঁ মা তোমার জন্য।’

‘সবগুলা?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ সবগুলা।’

তানিয়া আপাও এগিয়ে এলো। বক্সটা তার হাতে নিলো৷ গল্পকে আরেক হাতে ধরে বললো,

‘আমরা কারে বসে বসে খাবো। তাড়াতাড়ি চলো। লেইট হয়ে যাচ্ছে মা।’

গল্প তানিয়া আপার হাতে ধরে ধরে বাইরের দিকে রওনা হলো। বারবার পেছনে ফিরে মেয়েটা আমার হাসছিলো। তার এই হাসিটা হয়তো কৃতজ্ঞতার হাসি। মা মেয়ের আত্মিক সম্পর্ক কি আর কেউ ভেঙ্গে দিতে পারে?

শ্বশুর, শাশুড়ি, মা আর আসিফ আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। শ্বশুর বললেন,

‘দেখিস মা, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সবাই তোর পাশে আছি।’

এদিকে ড্রইং ক্লাসের ফারুক টিচার, যিনি এক্সিবিশনের জন্য গল্পকে রেডি করছিলেন, তিনি আজ ক্লাসে আসেননি। তানিয়া এক ঘন্টা বসে থেকেও টিচারকে আসতে না দেখে আর্ট স্কুলের আরেকজন টিচারকে জিজ্ঞেস করলে উনি জানালেন, ফারুক স্যারের চার বছর বয়সী মেয়ে অসুস্থ। তাই তিনি আসতে পারেননি। স্যারের স্ত্রী মারা গিয়েছেন তার মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে৷ সেই থেকেই তিনি তার মেয়েকে একা একাই দেখাশোনা করছেন।
(চলবে)