যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব-১৫

0
313

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ
~মিহি

১৫.
নয়নের দাফনকার্য শেষে কাউকেই বাড়িতে থাকতে দিলেন না রামিলা পারভীন। এমনকি নিজের ভাবীকেও না। সন্ধি বড়সড় বিপদের আভাস পাচ্ছিল। রামিলা এত সহজে তাকে ছেড়ে দেবেন না তা সে বুঝে গেছে কিন্তু এখনো তার মতলব স্পষ্ট বুঝতে পারছে না সন্ধি। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হলো। রামিলা তাকে কিছুই বলতে আসলেন না। বিপদমুক্তির নিশ্চয়তা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নয়নের কণ্ঠ কানে বাজতে লাগল সন্ধির। ভয়ে ঘামতে লাগল সে। সকালেও এ ঘরটাতে নয়নের অস্তিত্ব ছিল অথচ এখন কিনা তাকে অন্ধকার কবরে রেখে আসা হয়েছে। মৃত্যু কখন আসবে তা কেউ জানেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সন্ধি। এরই মধ্যে রামিলা পারভীন হুড়মুড়িয়ে তার ঘরে ঢুকলো। আচমকা এমন উপস্থিতি সন্ধিকে ঘাবড়ে তুলল।

– ‘খালা, হঠাৎ এখানে? এত রাতে?’

– ‘তুই মেরেছিস আমার ছেলেকে। অলক্ষ্মী, অপয়া, ডাইনী কোথাকার। তুই কি ভেবেছিস তোকে আমি ছেড়ে দেব? নাহ! আজকের রাতটা শান্তিতে থেকে নে।’

– ‘খালা, কী বলছেন আপনি? মানে কী এসবের?’

– ‘অত বুঝতে হবে না রে ভাগ্নী। আমার ছেলেকে ভালো লাগেনি না তোর? এখন ভালো লাগবে যখন একেক দিন একেক ছেলে এসে তোর স্বাদ নেবে।

– ‘ছিঃ খালা! এত নোংরা কথা বলতে পারেন কিভাবে আপনি?’

– ‘তোকে বিয়ে করিয়ে এনেছিলাম জমির টাকার জন্য যাতে আমার নয়ন দেশেই ব্যবসা করতে পারে অথচ আমার ছেলেটাই আর নেই কিন্তু টাকাটা তো আছে। তোকে আমি আর এ বাড়িতে রাখবো তুই ভাবলি কী করে?’

সন্ধির হাত পা অবশ হয়ে আসছে। রামিলা পারভীন চোখের পলকে দরজা লাগিয়ে বড়সড় একটা তালা ঝুলিয়ে দিল বাইরে থেকে। সন্ধির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল সন্ধি। কাঁদতে কাঁদতে গলা শুকিয়ে এলো তার। ‘নাহ! এভাবে কেঁদে লাভ নেই। বাঁচতে হলে পালাতে হবে সন্ধি।’ কথাটা ভাবতে ভাবতে উঠে বসলো সন্ধি। জানালা দিয়ে লাফ দিলে সর্বোচ্চ হাত পা ছিলতে পারে কিন্তু বেঁচে যাবে সন্ধি। তবে শব্দ হলে রামিলা পারভীন টের পাবে। সে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আলমারিতে তুলে রাখা টাকাগুলো ব্যাগে তুলে পিঠে ঝোলায় সে। আপাতত এ বাড়িতে এটাই তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু। আলমারি থেকে আরেকটা শাড়ি বের করে কাঠের জানালার গ্রিলগুলো খুলল সন্ধি। লোহার শক্ত খাটের পায়ার সাথে শাড়ির একাংশ বেঁধে আরেকাংশ কোমড়ে বাঁধল সন্ধি। ‘ব্যস! এবার কেবল আল্লাহর নাম নিয়ে লাফ দেওয়ার পালা।’ মনে মনে বলল সন্ধি। কথাটা ভেবে মনে মনে দোয়া পড়ে লাফ দিল। রাস্তা থেকে দু’ফিট উপরে এসেই ঝুলে পড়ল সন্ধি। অতঃপর সেখান থেকে আস্তে করে লাফ দিল। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রাস্তা ধরে সামনে ছুটতে লাগল সন্ধি। মামার কাছে যাবে কী সে? মামা বিশ্বাস করবে তাকে? সে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। তবে কি চাচার কাছে যাবে? আপাতত সেটাই ভালো। এই রাতে গাড়িও নেই। হেঁটে হেঁটে যতদূর পারলো এগোতে লাগল সন্ধি। কোনমতে সকালটা হলেই আর চিন্তা নেই। নির্জন রাস্তায় দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দও ভয় পাইয়ে দিচ্ছে সন্ধিকে। এগোতে এগোতে মূল রাস্তায় আসতেই কয়েকটা মাতাল ছেলেকে দেখে আত্মা শুকিয়ে এলো তার। ছেলেগুলোও ততক্ষণে সন্ধিকে দেখতে পেয়েছে। সন্ধির দিকে ক্রুর হাসি হেসে এগোতে লাগল লোকগুলো। অনেকক্ষণ দৌড়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল সন্ধি কিন্তু এখন থামলে চলবে না। উল্টোদিকে ক্রমাগত ছুটতে শুরু করে সন্ধি। পায়ে অসম্ভব ব্যথা করছে সন্ধির। তৃষ্ণায় গলা ধরে আসছে তবু থামার উপায় নেই। পেছনের ছেলেগুলোর হাতে ধরা পড়লে যে পরিণতি হবে তার চেয়ে শেষ চেষ্টা করা ভালো। দৌড়াতে দৌড়াতে আচমকা গাড়ির হেডলাইটের আলো এসে সন্ধির চোখে লাগে। হঠাৎ এত আলোর তেজে চোখ মেলতে পারে না সে। সরাসরি গিয়ে পড়ে গাড়ির উপর।

______________________

আজকের সকালটা অন্যরকম মাহিদের জন্য। এই প্রথম মা-বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাচ্ছে সে। সন্ধির সাথে কথা বলতেই হবে। ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে সে। মা-বাবার রাগান্বিত মুখের বিপরীতে কোন সাফাই না দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে সে। প্রথম উদ্দেশ্য গ্রামে যাওয়া। সন্ধির মা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। সন্ধির বাবার সাথে কথা বলাটা কি ঠিক হবে এই মুহূর্তে? কথা তো বলতেই হবে। ভাবতে ভাবতে বাসের সীটে হেলান দিল মাহিদ। চোখের সামনে ভাসছে সন্ধির রাগান্বিত চেহারা, কলম কামড়ানো চিন্তিত মুখ, আচমকা এসে গালে চুমু খাওয়ার সেই ভয়ানক দৃশ্যটা। অনুভূতিগুলো বড্ড পোড়াচ্ছে মাহিদকে। সন্ধির মুখোমুখি হয়ে মাহিদ প্রশ্ন করবে তাকে, ‘কেন সে এমন করলো মাহিদের সাথে? মাহিদকে যদি ভালোই না বাসত তবে অনুভূতিগুলো সব মিথ্যে ছিল? মাহিদকে নেহার সাথে দেখলে তার রাগটা কপট ছিল?’ অজস্র প্রশ্ন মনে গোছানো মাহিদের কিন্তু সন্ধিকে দেখলে আদৌ সে এসব প্রশ্ন করতে পারবে? নাকি কেবল দেখতেই থাকবে?

‘কী ভাই, নামবেন না?’ হেল্পারের ডাকে চোখ মেলল মাহিদ। সন্ধির কথা ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে এসেছিল মাহিদের। বাস ছেড়ে নামলো মাহিদ। এখন হাঁটতে হবে মিনিট বিশেক। তারপর সন্ধির বাড়ি পাওয়া যাবে। সন্ধির বাড়িতে পৌঁছানোর আগেই পথিমধ্যে তূর্ণাকে দেখতে পেল মাহিদ। মাহিদকে দেখামাত্র পালাতে চাইল তূর্ণা কিন্তু মাহিদের ডাকে থামতে হলো তার।

– ‘জ্বী জ্বী স্যার।’

– ‘ভাগ্যিস পেলাম তোমাকে। তুমি সন্ধির বেস্টফ্রেন্ড তো? কিছু প্রশ্ন আছে। একটু দাঁড়াও।’

– ‘আসলে স্যার..’

– ‘ব্যস, দু’মিনিট।’

– ‘আচ্ছা স্যার।’

– ‘সন্ধির বাবার সাথে আমার কথা ছিল। উনি কি আছেন বাড়িতে?’

– ‘চাচা মারা গেছেন কয়েক সপ্তাহ আগেই।’

– ‘কীহ? কিভাবে?’

– ‘হার্ট এটাক।’

– ‘সন্ধিদের বাড়িতে কে থাকে এখন?’

– ‘চাচী বাড়ি বেচে আরেকজনের সাথে চলে গেছে। যারা বাড়ি কিনছে তারাই থাকে।’

– ‘সন্ধি কোথায়?’

– ‘ও শ্বশুরবাড়িতে তবে…’

– ‘তবে কী?’

– ‘ওর স্বামী মারা গেছে গতকাল।’

– ‘ওর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাটা দিতে পারবে?’

– ‘জ্বী।’

ঠিকানা দিয়ে চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে এলো তূর্ণা। মাথা নিচু করি স্যরি বলেই দৌড় দিল। মাহিদ কিছু বুঝতে পারল না। হঠাৎ মেয়েটা মাফ চাইল কেন?

__________________

– ‘তোমার চাচার বাড়িতে পৌঁছে দিলেই তো হলো? এত চিন্তা করার কিছু নেই।’

– ‘খালা আমাকে খুঁজে পেলে বিক্রি করে দিবে।’

– ‘দেখো, তোমার চাচা যে তোমায় যত্নে রাখবে তা নিশ্চিত না হওয়া অবধি আমি সেখানে তোমাকে পাঠাবো না। ধৈর্য ধরো। এখানে তোমার মতো অনেক মেয়ে আছে। তোমার অসুবিধা হবে না।’

– ‘আপনাকে ধন্যবাদ ম্যাম।’

– ‘ম্যাম বলতে হবে না ডিয়ার। সবাই মামণি ডাকে। তুমিও তাই ডেকো।’

সন্ধি মাথা নাড়ে। ভাগ্যিস গতকাল এ ভদ্রমহিলার গাড়ীর সামনে পড়েছিল। নাহলে যে তার কী হত কে জানে। ভদ্রমহিলার নাম শ্রাবণী শিকদার। মধ্যবয়সী মহিলাটি একটা এন.জি.ও চালান। অনেক মেয়ের পড়াশোনা-ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। সন্ধিকেও বিপদে দেখে নিজের আশ্রমে এনেছেন। সন্ধি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ তার প্রতি। এখন কোনমতে চাচার কাছে যেতে পারলেই সে নিরাপদ। হাসিমুখে আশেপাশের সবার সাথে গল্প করতে লেগে পড়ে সন্ধি। টাকার ব্যাগটা তখনো তার কাঁধে ঝুলছে।

শ্রাবণী শিকদার বাড়িতে ঢুকেই তার লোককে পাঠিয়েছেন সন্ধির চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদি স্থানটা নিরাপদ হয় তবেই তিনি মেয়েটাকে পাঠাবেন সেখানে। সন্ধির জীবনের গল্প শুনেছেন তিনি কাল রাতে। বড্ড কষ্ট হয়েছে তার মেয়েটার জন্য। একে তো অল্প বয়সে বিয়ে তার উপর এত অল্প বয়সেই ডিভোর্স, এতটুকুন মেয়ে এত ধাক্কা কী করে সামলাতে পারে? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। সন্ধির মধ্যে নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছেন তিনি। তার জীবনটাও একসময় ওমন ছিল। পরবর্তী সময়টাতে পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে এতদূর এসে পৌঁছেছেন তিনি। এখন চেষ্টা করছেন সমাজের সব অসহায় নারীই যেন স্বাবলম্বী হয়ে নিজের যুদ্ধ নিজে লড়তে পারে।

চলবে …