মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-২১

0
707

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২১

“আপু আমাদের বাঁচা। কলা আমাদের লড়াচ্ছে থুক্কু কলাওয়ালা, না না বাগানের মালিক আমাদের লড়াচ্ছে।”

উত্তরের দিকে থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো হাওয়ায়। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। যেন দ্রুত বেগে ছুটে আসছে আমার নিকট। আমি শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে দৃষ্টি দিতেই ভরকে গেলাম। বিয়ের বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে আঁখিও আছে। দুপুরের খাওয়ার সময় দেখা যায়নি তাদের। তাদের খুঁজতে এদিকে আসা। নতুবা এদিকে আসার প্রশ্নই ছিলনা। আমি সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। তাদের কাছে পিঠে আসতেই বাবুই নিজেকে আড়াল করে নিল আমার পেছনে। তড়িগড়ি করে বললাম, “পাগলা কুকুরে কামড়েছে তোদের? এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন? নিজেদের বয়স দেখেছিস? ধীঙ্গি হচ্ছিস দিনকে দিন। কিন্তু বুদ্ধি হলনা।”

হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা আঁখির। তবুও নিজের সাথে যুদ্ধ করে একপ্রকার বলল, “আর বলিস্ না, শা’লায় দেখে ফেলছে। মোটা একটা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে। বুড়া হইছে আবার বলে চোখে দেখতে পারেনা আগের মত। কই আমগো তো ঠিকই দেখল। বিম্রতি। ”

“ঐ ছেমড়ি, তোর কাছে আমার বইন বিয়া দিছে নি? তুই কথায় কথায় আমারে শা’লা কস। একেই তো চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ছিস। এখন আবার শা’লা কস।”

পেছনে পঞ্চাশ উর্ধ্বে একজন বয়স্ক লোক। হাতে তার মোটা লাঠি। হাঁটতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ছে। নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে লাঠির সাহায্য নিচ্ছে। চোখের ভ্রু সাদা হয়েছে বয়স বাড়ার কারণে। চামড়া কুঁচকে গেছে অনেকটা। চুল পেকেছে। লোকটাকে চিনি চিনি ঠেকছে। তিনি তো মুজিবুর। ছোটবেলায় কত তার বানানে চু’রি করেছি। আগের মতই লাঠি নিয়ে তারা করছেন। সরল কণ্ঠে বললাম, “দাদু কী হয়েছে, এভাবে আসছ কেন? একটু কলাই তো খেতে চেয়েছিল।”

“ওগো জ্বালায় কোনো ফল শান্তিতে রাখতে পারে?”

“এখনও যদি বলো, শান্তিতে রাখতে পারোনা, তাহলে আগে কী রাখতে পারতে? তোমার বাগান ফাঁকা করে ফেলতাম।”

তিনি বৃদ্ধ চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। একটু বয়স বেড়ে গেলেও আহামরি কিছু বাড়েনি। চেনা অসম্ভব কিছু নয়। তবে তাকে চেনা বরং দুস্কর। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সন্দিহান স্বরে বললেন,
“তুই শ্রেয়া মা না-কি? মুখটা তো ওর মতোই ঠেকছে।”

“এতক্ষণে চেনা হলো বুঝি?” অভিমানী সুরে।

প্রসারিত হলো ওষ্ঠদ্বয় তার। হাসলেন মৃদু‌। তৃপ্তিদায়ক হাসি। তার বাগানের ফল ফাঁকা করে দেওয়ার পরেও হাসছেন, ভারী আশ্চর্য। ভীত হলেন না। আবদারের সুরে বললাম, “আবার মামাতো বোন বাবুই। কখনো গ্ৰামে আসেনি। আঁখির মুখে বিচি কলার ভর্তা শুনে খেতে ইচ্ছে করছে ওর। তুমি কি তোমার বানান থেকে দুটো কলার দিবে।”

“তোরে বাঁধা দেওয়ায় সাধ্য আছে আমার? আগে কত দিয়েছিলাম, লাভ হয়নি। তুই কি শুনবি আমার বারণ? এখন চোখে ঠাওর করতে পারিনা। তুই নিয়ে যা।”

বৃদ্ধা দাদুর কথায় সবাই আনন্দে গদগদ হল। সারিবদ্ধভাবে তার বাগানের দিকে আগ্ৰসর হল। তিনিও হাঁটা ধরলেন। এগোলাম আমি।

সবুজের সমারোহ প্রকৃতি বহুদিন পর যেন স্বাগত জানাচ্ছে। হিম হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে লোমকূপ। উড়িয়ে হাওয়াতে ভাসিয়ে দিচ্ছে ওড়না। চুলগুলো এলোমেলো। নীলাভ আকাশ মেঘের ভেলা সাজালো। খণ্ড খণ্ড মেঘ। গর্জন করছে মেঘেরা। বৃষ্টি আসার পূর্ব লক্ষণ। ঠুক ঠুক শব্দ হচ্ছে লাঠিতে। যেন ঘোড়ার হাঁটা। মাঠে কাজ করছে গ্ৰামবাসীরা। অবশেষে পৌঁছে গেলাম দাদুর বাড়িতে। পথে দাদুর সাথে কথা হলো প্রচুর। তার বাড়ির সামনেই বাগান। টিন আর বাশ দিয়ে ঘেরা। এই বাগানের টাকা দিয়ে বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাকে বছর চলতে হয়। ছেলে বিদেশে থাকে। তিনি তালা তুলে ভেতরে ঢুকতে অনুমতি দিলেন। আমি ভেতরে ঢুকলাম। কলা বাগান মানে শুধু কল নয়, বিভিন্ন ধরনের গাছ। এত গাছের নামটাও জানা নেই। তার ভেতরে কলা গাছ বেশি।

মেহগুনি গাছের হেলান দেওয়া কলাগাছ। লগি নেই। গাছে উঠে কলা পাড়তে হবে। আগে গাছে উঠার ক্ষমতা ছিল, এখন নেই বললেই চলে। তবুও গাছে আমাকেই উঠতে হল ওদের জোরাজুরিতে। আমি গাছে উঠলাম ওড়না কোমরে বেঁধে। কলা পেড়ে বসে রইলাম গাছে। নামতে ইচ্ছে করছে না। বহুদিন পর উঠা। কিন্তু মহাশয় হাজির সেখানে। আমার এখানে আসার কথাটা তিনি জানলেন কীভাবে জানা নেই। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের মত ধমকে উঠলেন এসে। রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,

“সমস্যা কী তোমার? গাছে উঠেছ কেন?”

আমি তৎক্ষণাৎ নিচে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ধ্রুব এবং রাহাত স্যার একসাথে দাঁড়িয়ে আছেন। ধ্রুব স্যারের হাতে একটা প্যাকেট। বিকেলে ঘুম দিয়ে উঠে দেখতে পাইনি তাকে। রমিলা আন্টি বলেছেন ধ্রুব বাড়িতে নেই। রাহাত স্যারকে নিয়ে কোথাও একটা গেছে। তবে এখানে কী করছেন? আমাকে ফলো করে ঠিক চলে এসেছে।

তার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লাম, “আপনি এখানে কী করছেন?”

“তোমাকে দেখতে এসেছি ইডিয়েট।”

“আমাকে কেন দেখতে আসবেন? আমার কি বিয়ে?”

তেজ নিয়ে বললেন, “বিয়ে করার খুব শখ দেখছি তোমার। বাড়িতে যাই তারপরে বিয়ে করাবো, এবার নেমে আসো। তোমার জন্য এটা এনেছি।”
হাতটা ঈষৎ উঁচুতে তুলেন প্যাকেট দেখালেন। ভেতরের জিনিসগুলো দেখা গেল না।

“না, আমি এখন যাবো না। আপনি বরং যান। আমার সাথে সেদিন বা’জে ব্যবহার করে গিফ্ট নিয়ে এসেছেন। যাবো না, বলছি তো!” উল্টোমুখী জবাব।

“চড়ুই নেমে এসো।” শান্ত কণ্ঠে বললেন রাহাত স্যার।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ভীত হলেও প্রকাশ করলাম না বাইরে। ভয় পেলেই ঝোঁকে বসবেন। আমার ভাবাবেগ না পেয়ে টেনে টেনে বললেন, “বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে, একটা দামড়া মেয়ে গাছে উঠেছে। দৃশ্যটা কেমন লাগছে ভাবতে পারছ?
আমি কি জানতাম না-কি তুমি এখানে? বাইরে থেকে দেখে এসেছি।”

“আপনি আমাকে দামড়া বলছেন? আপনি কী হ্যাঁ? চারপাশে তো টিন..

আর বলতে পারলাম না। দৃষ্টি গেল বাইরের দিকে। সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাহলে আমাকেও বাইরে থেকে উদ্ভূতভাবে দেখা যাচ্ছে। সৌজন্য হাসি দিলাম। নামার প্রয়াস করলাম। নামতে পারছি না। ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছেন বিপরীত দিকে। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উল্টোপথে হাঁটা ধরলেন। আকাশ গর্জে উঠল। অবিলম্বে বৃষ্টি শুরু হল। গাছের উপর বৃষ্টি পড়তেই পিচ্ছিল হতে লাগল। হাওয়ার ঝোঁকে বেঁকে যাচ্ছে গাছ। অতিরিক্ত হাওয়া বইতে ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম। ভয়ে ভয়ে গাছের ডাল ধরে রাখলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলোনা। গাছের ডাল ভেঙে ধাড়াম শব্দে নিচে পড়লাম। মৃদু আর্তনাদ করলাম। পা একটু বেঁকে গেল। চিকচিক করে উঠল চোখজোড়া। বৃষ্টির পানিতে জবুথবু। আলাদা করা দুস্কর। ধ্রুব ছুটে এলো। ধরল হাত। পরক্ষণে ছেড়ে দিল। বুকে হাত গুজে বলেন, “শান্তি হয়েছে? হয়েছে শান্তি। আমার সামনে না পড়লে তোমার হয়না।”

অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, “আমি কি ইচ্ছে করে পড়েছি। ডাল ভেঙে গেছে কী করব?”

ধ্রুব হাত বাড়িয়ে দিলেন। উপায়হীন হয়ে খামচে ধরলাম হাত। তাকে ধরে উঠার প্রয়াস করতে পায়ের ব্যথা বেড়ে গেল। পায়ের টাকনু ভেঙে গেছে এমন অবস্থা। আমি পা ধরে বললাম, “আপনি আমাকে অভিশাপ দিয়েছেন ধ্রুব, তাই আমার পা ভেঙে গেছে। আমি আর হাঁটতে পারব না। আপনার ভালো হবেনা।”

ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন। আমি একটু নতজানু হলাম। এই প্রথম ‘ধ্রুব’ শব্দ বলেছি। ধ্রুব দ্রুত কোলে তুলে নিল আমায়। ঘোর কা’টল। কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। বিস্মিত হয়ে জড়িয়ে ধরলাম গলা। তড়িগড়ি করে বললাম, “কী করছেন টা কী? আপনি নিজেই ভাঙাচোরা মানুষ। এখন আবার মা’স্তানি করে আমাকে কোলে তুলেছেন। নামান বলছি।”

“হ্যাঁ মা’স্তান।”

“সে তো দেখতেই পাচ্ছি, ভাঙাচোরা মাস্তান।”

“আমাকে ভেঙাতে এসো না, তুমিও কিন্তু ভাঙাচোরা।”

উচ্চে পড়ল তেজ। নাক ফুললো মুহূর্তে। ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম,

“দেখতে পারছেন কত মানুষ। সবাই দেখছে, নামান দ্রুত। প্লীজ নামান।”

ধ্রুব নামালেন না। এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। বৃষ্টির ধাঁচ কমার বদলে বেড়ে চলেছে। ধ্রুবের মুখের উপরে বৃষ্টি ফোঁটা পড়ছে। বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মুখের উপর। চুলগুলো লেপ্টে আছে কপালের কোণায়। ব্যান্ডেজ খোলার কারণে কপালের পাশের কাঁটা দাগটা ভেসে আসে। কালচে হয়ে আছে জায়গাটা। একটু সাদাও হয়েছে চামড়াটা। চোখজোড়া বৃষ্টিতে ভেজা। গম্ভীর মুখশ্রী।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]