মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-২৫

0
656

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৫

ম্যাসেজের টোন বাজতেই বিদায় নিল গভীর তন্দ্রা। নিভু নিভু চোখে বালিশের পাশ থেকে ফোন তুললাম। ঘৃণায় গুলিয়ে উঠল দেহ। এতরাতে দেখা করতে হবে সেই আগন্তুকের সাথে। বারোটা ছাড়িয়ে একটা ছুঁইছুঁই। বালিশের ফাঁক থেকে ওড়না নিয়ে জড়ালাম। পাশেই ঘুমন্ত বাবুই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। আমাকে এখন যেতেই হবে, উপায়হীন। রাহাত স্যারের কথা মস্তিষ্কে হানা দিল। দ্রুত তার নাম্বারে একটা মেসেজ করলাম।
‘এই ঠিকানায় অতিদ্রুত চলে আসুন। আমি যাচ্ছি। লোকেশন অন করে রেখেছি। ঠিক পেয়ে যাবেন আমায়।’
এইটুকু মেসেজ করে ব্যাগ বের করলাম কাবার্ড থেকে। ধারালো ছু’রি রাখলাম ব্যাগে। পা টিপে টিপে সন্তর্পনে বেরিয়ে এলাম। রাস্তা ফাঁকা গাড়ি নেই। বাড়ির গাড়ি নেওয়া অসম্ভব। তাই বাবুইয়ের সাইকেলটা নিলাম।
___
“স্বাগতম মিসেস মহতাব, সুস্বাগতম। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

বলেই অন্ধকার থেকে আলোতে এসে দাঁড়ালেন একজন। বয়স পঁচিশের উর্ব্ধে। গায়ের রং ফর্সাও নয় শ্যামলাও নয়। মাঝামাঝি ধরলেন। চেনা লাগল। কোথাও একটা দেখেছি, কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে ব্যর্থ। বেশিক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে সরিয়ে নিলাম দ্রুত। তার দিকে তাকাতেও নিজের উপর ঘৃণা লাগছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম, “কে আপনি? কেন এইসব করছেন? এত নিকৃষ্ট কাজ করতে পারলেন কী করে?”

খুক খুক করে কাশি দিলেন। আমার চতুর্দিকে ঘুরে সামনাসামনি দাঁড়ালেন। বাঁকা হেসে বললেন, “এত সহজে ভুলে গেলি। সেদিন আমাদের ক্লাবে এসে আমাদের মে’রে গেলি। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি।”

অস্পষ্ট স্মৃতি স্পষ্ট হল। নটক নড়ে। এর মুখের মানুষটাকে ভুলে গেলাম কী করে? একেই তো ধ্রুব মে’রেছিল। পুরো গ্যাং জেলখানায় ছিল। বেরিয়ে এল কবে? অস্ফুট স্বরে শুধালাম,
“আপনি জেলে ছিলেন, বেরিয়ে এলেন কবে?”

“আমাকে জেলে রাখা এতই সহজ? অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করতে এসেছি।”

“তারমানে ট্রে ফেলে বাবুইয়ের পোশাক নষ্ট করাটাও আপনার প্লান ছিল? কী ক্ষতি করেছে ঐ বাচ্চা মেয়েটা, কেন করছেন এমন।”

“তোর বোনের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছাই আমাদের নেই। আজকে তোর সাথে সমস্ত হিসাব চুকিয়ে, ভিডিও ডিলেট করে দিবো। তবে ততক্ষণ তুই বাঁচতে পারবি না। তোর রুপের অহংকার গুছিয়ে এই নির্জন জায়গায় এসিডে ঝলসে দিবো মুখ। তারপরে পুঁতে দিব মাটিতে।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, “আপনি জানেন আমি মিসেস ধ্রুব। তারপরেও এইসব করছেন। আগেরবার ধ্রুব আপনার কোনো ক্ষতি করেনি, এবার জানটা নিয়ে ফেরত যেতে পারবেন?”

“ওকে দেখা যাক। ঐ ধর ওকে।”

বলতেই সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো ছেলে এসে ঘিরে ধরল আমায়। হতবাক হলাম। কোথায় রাহাত স্যার। হাওয়ার বেগে ছুটলাম।

ফাঁকা রাস্তা দিয়ে প্রবল বেগে ছুটলাম। ছেলেগুলো পেছনে পেছনে আসছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ক্রমশ। দৌড়াতে দৌড়াতে ফোনটার দিকে তাকালাম একপলক। রাহাত স্যার কেন আসছে না, বাড়ির থেকে বের হওয়ার সময় তাকে জানিয়েছিলাম। তবুও কেন?
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ছুটলাম। নির্জন রাস্তাঘাট। চারিদিকে নেই মানবের ছায়া। রক্ত সঞ্চালন থেমে থেমে যাচ্ছে। হিম দিচ্ছে শরীর। তীক্ষ্ণ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। লেপ্টে গেল চোখের পাতা। দৌড়ানোর গতি হ্রাস পেল। দ্রুত চোখের সামনে হাত রেখে তীক্ষ্ণ আলো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলাম। ততক্ষণে গাড়িটা অতি নিকটে। পেছনে সাঁই সাঁই গাড়ি। ধাক্কা খেলাম গাড়ির সাথে। না! অ্যাক্সিডেন্ট হলনা। এলোমেলো চুলগুলো হুডের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ভারি শ্বাস টানলাম। নেতিয়ে পড়েছে শরীর। নিভু নিভু চোখে সামনে দৃষ্টি দিলাম। দুহাতে সরিয়ে নিলাম এলোমেলো চুলগুলো। নিমিষেই ভয় উধাও হয়ে গেল। উঠলাম না। শরীরের সবটুকু ভর হুডের উপর দিয়ে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবের পানে। কেন এসেছে ধ্রুব? এতরাতে এখানে কেন?
আমার ভাবনার মাঝপথে গাড়ি থেকে নেমে এলেন ধ্রুব। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে ঝাপটে ধরলাম ধ্রুবকে। ফুঁপিয়ে উঠলাম মুহূর্তে। ধ্রুব ধরলেন না। ততক্ষণে পেছনে গার্ডরা এসে দাঁড়িয়েছে। ধ্রুব টেনে টেনে বললেন,

“এদেরকে এখান থেকে নিও যাও দ্রুত। আমার একটা কাজ আছে, সেটা শেষ করে আসছি।”

পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল হাওয়াতে। শো শো গাড়ির শব্দ নিরব হয়ে গেল। ধ্রুব সময় নিল না, তার বুক থেকে টেনে তুলল আমায়। কিছু বলার পূর্বেই সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসালো গালে। ছলছলিয়ে উঠল চোখ। অসম্ভব রেগে আছেন ধ্রুব, সে কোনো মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারেন সবকিছু। ভয়ংকর দৈত্যের সমান। আমি বোঝানোর উপায় খুঁজে পেলাম না। পুনরায় চড় পড়ল গালে। একের পর এক চড় সহ্য করতে হল। গালে দাগ পড়েছে নিশ্চয়ই। তবুও অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম, “শুনুন আমার কাথাটা..

“একদম চুপ অস’ভ্য মেয়ে। নিজেকে কী ভাবিস তুই, সবাই তোর পেছনে কুকুরের মত পড়ে থাকবে? ভালোবাসি বলে সব সহ্য করে নিবো।
যদি জানতাম রাস্তায় এই ছেলেগুলো তোকে ধরবে, তাহলে কক্ষনো আসতাম না।আমি শুধু তোকে জবাব দিতে এসেছি। আমাকে দিয়ে হয়না তোর, আরও লাগে? কান খুলে শুনে রাখ, রাহাতের অজান্তে ফোন থেকে সিমকার্ড খুলে আমার ফোনে অন করেছি। তাই সবটা জানতে পারলাম।”

আমি হতবাক হলাম। ধ্রুব রাহাত স্যারের সিমকার্ড খুলে নিয়েছেন। পরক্ষণেই আমার হাত ধরলেন শক্ত করে। টানতে টানতে গাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ছুঁড়ে ফেললেন। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। স্পিডে চালাচ্ছেন। ভয় করছে আমার। উপায়হীন হয়ে বললাম,
“ধ্রুব প্লীজ আস্তে চালান‌। আমার ভয় করছে।”

“আস্তে কেন? নাগরের সাথে যাওয়ার সময় মনে ছিলনা।”

“প্লীজ ধ্রুব।”

“রাখ তোর প্লীজ, মুখ থেকে একটা কথা বের হলে আমার চেয়ে খারা’প কেউ হবেনা।” চ্যাঁচিয়ে বললেন।

দমে গেলাম আমি। মাথা নত করে সিট চেপে ধরলাম।

গাড়ি থামতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমার হাত ধরে পুনরায় হাঁটা শুরু করলেন। তার বলিষ্ঠ পুরুষালি শক্তির কাছে আমি নিছক বাচ্চা! জোরে জোরে হাঁটার ফলে হাতে টান পড়ছে। ড্রয়িং রুমে আনতেই স্টার্ফরা ছুটে এলো। ধ্রুব চোখ রাঙাতেই পিছিয়ে গেল সব। রমিলা আন্টি আমাদের বাড়িতে। তিনি থাকলে আমাকে বাঁচাতে পারতেন।
ঘরে এনে ফেলে দিলেন। মাথানত অবস্থায় বললাম, “প্লীজ ধ্রুব, ট্রাই টু আন্ডার্সট্যান্ট!”

ধ্রুব গ্রাহ্য করলেন না। নিজের পড়নের শার্টটা খুলে ফেললেন। তার শরীর দেখার ক্ষমতা আমার নেই, ভয়ে কুপোকাত। কাঁচের গ্লাসটা টেবিলে আঘাত করে ভেঙে ফেললেন। এক খণ্ড নিয়ে পা টিপে টিপে কাছে এগিয়ে এলেন। আমি ঘামতে লাগলাম। বিছানায় ভর দিয়ে পিছিয়ে গেলাম। ঠেকে গেলাম দেয়ালে। ধ্রুব ওড়না টেনে নিলেন। বেঁধে দিলেন দুহাত। মুখের সামনে কাঁচের খণ্ড ধরলেন। মুখ গুঁজে দিলেন গলায়। এবার শব্দ করে কেঁদে দিলাম। ঝাপসা কণ্ঠে বললাম,
“আমি ভিডিওটির জন্য গিয়েছিলাম।”

ধ্রুব কাঁধ থেকে মুখ তুলে সন্দিহান স্বরে বললেন, “ভিডিও, কীসের ভিডিও।”

“বাবুইয়ের আপত্তিকর ভিডিও।”

“কী বলছ কী? মানে?”

আমি ধীরে ধীরে খুলে বললাম সবকিছু। তাজ্জব বনে গেলেন তিনি। না বোঝার স্বরে বলেন, “এতকিছু হয়ে গেল, আমাকে কেন জানাওনি?”

“আমি কাউকে জানাইনি।”

“রাহাত কী করে জানল?”

“আমার অনুমতি না নিয়ে কালকে ফোন ধরেছিলেন রাহাত স্যার। তারপরে তিনি সবটা জেনেছেন। তাই তো কালকে ঘরের ঐ অবস্থা ছিল।”

বিরতিহীন ভাবে চেয়ে রইলেন। কাঁচের টুকরো ফেলে দিলেন দূরে। চুলগুলো কপালের কাছ থেকে সরিয়ে দিলে চুমু এঁকে দিলেন। অতঃপর দুইগালে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন। হাত খুলে ওড়না জড়িয়ে দিলেন গায়ে। সরল ভাষায় বললেন, “এই সামান্য একটা ব্যাপার কেন লুকালে চড়ুই। আমি ঠিক সামলে নিতাম, একবার মুখ ফুটে বলে দেখতে।”

“আমি তখন বলতে চেয়েছিলাম!”

“তখন, যখন ধরা পড়েছ। আ’ম স্যরি চড়ুই। ভেরি ভেরি স্যরি। আ’ই ডিড নট আন্ডার্সট্যান্ট সো মাচ। ফরগিভ মি।”

মাথা নিচু করে রইলাম। প্রত্যুত্তর দিলাম না। তিনি অশান্ত গলায় বললেন, “আমি ভেবেছিলাম তুমি রাহাতের সাথে চলে যাবে কোথাও। ঐ ছেলেগুলোকে দেখে মনে হয়েছে, ওরা তোমার সাথে ..।
ভয় পেয়েছিলাম প্রচুর। তোমাকে হারাতে পারবনা চড়ুই।”

বাহুবন্ধন দৃঢ় করে নিলেন। মানুষটা বড়ই আজব। তবে অভিমানে জর্জরিত আমি। সত্যটা না যেনেই এই ব্যবহার। ছাড়িয়ে নিলাম দ্রুত। এখানে থাকব না, কিছুতেই না। তাছাড়া আজকে যা হল, ঐ ছেলেগুলো নিশ্চয়ই ভিডিও আপলোড করে দিবে। আমি ব্যাগটা বিছানা থেকে তুললাম। তখন হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়েছিল।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]