মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব-৩০

0
672

#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩০

মাঝরাতে তন্দ্রা ব্যাঘাত ঘটল। প্রত্যুষের ঢের দেরি। অপরিচিত জায়গায় ঘুম না হওয়ার দরুন জেগে আছি। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয় বৈ-কি! মাথা চুলকালাম। এই রাতে উকুনের উদয় হল না-কি! সন্নিকটে ধ্রুব বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। মাঝখানে মানুষ সমান কোল বালিশ রাখা। পাঁচিলের সমান, একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা দুস্কর। তবুও বেশ কিছুটা দূরত্ব। আমি গালে হাত রেখে কিয়ৎক্ষণ নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব কাত হয়ে শুয়েছে। চোখের পাতা অর্ধেক বুজেছে। এক ভ্রু কুঁচকে রয়েছে। তৈলাক্ত ভাবটা মুখের উপর প্রকাশ পেয়েছে। নির্দ্বিধায় ঘুমাচ্ছেন তিনি। নিষ্পাপ লাগছে তাকে। কিছুদিন পূর্বেও বিবাহিত হওয়ার সত্বেও এই ট্যাগ ব্যবহার থেকে বিরত রয়েছি। গুটিয়ে ছিলাম আর আজ এটাই আমার পরিচয়। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে বদলে গেল জীবন, এটা মেয়েদের জীবন!

ধ্রুবের মাথার নিচ থেকে বালিশটা একটু দূরে সরেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসার প্রয়াস করলাম। কারো অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ আমি। এই বলিষ্ঠ হাতের মালিক যে ধ্রুব, তা বোধগম্য হতে সেকেন্ডের প্রয়োজন হলনা। কোলবালিশের নিচে থেকে কোমর জড়িয়ে রেখেছে। সন্তর্পণে হাত সরিয়ে উঠে বসলাম। মৃদু ঝুঁলে ধ্রুবের মাথাটা শূন্যতায় উঁচু করলাম। সরে যাওয়া বালিশটা তার নির্দিষ্ট অবস্থানে রেখে মাথা রাখলাম। খোলা চুলগুলো মুখশ্রীর উপর পড়তেই ধ্রুব একটু নড়েচড়ে উঠলেন। দ্রুত সোজা হয়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করলাম। তবে বেশিক্ষণ খোঁপা হিসেবে স্থির রইল না। খুলে গেল। বা’হাতের সহায়তায় গলার নিচে জমে থাকা ঘামটুকু মুছে নিলেন তিনি। আমি উঠে ঘরের অভ্যন্তরে পদচারণ করলাম। পড়নের ওড়নাটা ধ্রুবের বালিশের নিচে চাপা পড়েছে। অন্ধকারে আবৃত ঘরে অতিশয় প্রয়োজন হলনা।

ব্যালকেনির পা রাখতেই হিম হয়ে এল শরীর। বাইরে ঝড়োহাওয়ার আর মেঝেতে জমা থাকা জলকণাগুলো পায়ের সাথে মিশে গেল। উড়ে আসা পচন ধরা গাছের পাতাগুলো পিষে গেল পায়ের তলদেশে। আমি দুহাত উজাড় করে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু জল আঁচড়ে পড়ল মুখে। ভিজিয়ে দিল আমায়। চোখজোড়া গ্ৰথণ করে ঘনঘন শ্বাস নিলাম।

চোখের পাতা উন্মোচন হল গভীর স্পর্শে। পেছনে থেকে আঁকড়ে ধরা মানুষটি কাঁধে গুঁজল মুখ। কানের ঝুমকা একটু টোকা দিল। রিনরিনে শব্দে বেজে উঠল। দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সরে এলাম। হতবাক সুরে বললাম, “আপনি! আপনি এখানে কী করছেন? ঘুমাচ্ছিলেন না?”

“হ্যাঁ। ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু মাঝরাতে বদ্ধ জানালা দিয়ে পেত্নি দেখলাম বারান্দায় বসে আছে। তাই দেখতে এলাম, হঠাৎ কোন পেত্নি উদয় হল।”

“পেত্নি? কোথায় পেত্নি?”

কপালে সরু ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, “দেখতে পারছ না? অবশ্য নিজেকে নিজে কীভাবে দেখবে, আয়না দিবো?”

পিলে চমকে উঠলাম। তিনি পেত্নি বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন, তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তেজ দেখিয়ে বললাম, “জানেনই যখন পেত্নি, তবে কেন এসেছেন পেত্নির কাছে? পেত্নি ঘাড় মটকে দিবে আপনার।”

কঠোর প্রতুক্তি করলেন, “মাছ দেখিয়ে নিজের কব্জায় করে নিবো।”

না বুঝার স্বরে বলি, “পেত্নি মাছ খায়?”

“হ্যাঁ। নদীর থেকে ধরে খায়, আর আমার ঘরের পেত্নি বৃষ্টির পানি সাথে মাছ পড়েছে কি-না সেটা খায়।”

গম্ভীর গলায় বললেন। অতঃপর পা দিয়ে বারান্দার মেঝের কিনারে থাকা ছোট গর্তটা খুলে ফেলেন। হুড়মুড় করে পানি বেরিয়ে গেল। তিনি দুকদম এগোলেন বিনিময়ে দুকদম পিছিয়ে গেলাম আমি। বৃষ্টির পানির কপালে লেপ্টে থাকার ফলস্বরুপ চুলগুলো হাত বাড়িয়ে সরিয়ে দিলেন। বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, “বৃষ্টির পানিতে ভিটামিন ‘ডি’ থাকে?”

“আপনার একটু ভুল হচ্ছে, সূর্যের প্রথম রশ্মিতে ভিটামিন ‘ডি’ থাকে।”

“কারেক্ট, কিন্তু বৃষ্টির পানিতেও একটা ভিটামিন থাকে? [গুরুতর ভঙ্গিতে ভেবে]
হ্যাঁ মনে পড়েছে, ভিটামিন ‘জে’ থাকে।”

অবিলম্বে তাজ্জব বনে গেলাম। ভিটামিন ‘জে’, সেটা আবার কী? জীবনে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। স্নিগ্ধ হেসে বললাম, “সেটা আবার কী?”

গ্ৰিল বিহীন ব্যালকেনির দেয়ালে হেলান দিয়ে সোজাসাপ্টা বললেন, “জ্বর! জে ফর জ্বর। ভিটামিন জ্বর। তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? কালকে পরীক্ষা আজ এখন বৃষ্টিতে ভিজছ? হাউ ফানি! ভেতরে যাও..

আদুরে আবদারে বলি, “আরেকটু থাকি..

প্রতিক্রিয়া করলেন না। গম্ভীর গলায় বললেন, “তিন সেকেন্ড তোমার সময়। তিন সেকেন্ডের পরে আর ভেতরে যেতে পারবে না। দরজা বন্ধ করে আমি ঘুমাবো। সারারাত এখানে ভিজতে হবে। কী করবে? ইউর টাইম স্টার্ট নাও। এক, দুই, তিন।”

নিজের সিদ্ধান্তে অটল। এক পা এগোলাম না। শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমতা-আমতা করে বললাম, “আপনি কী হ্যাঁ? আমি ভিজলে আপনার জ্বর আসবে? আসবে না। আমার আসবে। আপনি আপনার মত ঘুমান না যান..

“পেত্নির জায়গা আমার ঘরে নেই।” রাগে গজগজ করে উঠলাম আমি। ঘনঘন শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ে তেজ দেখিয়ে বললাম, “কী? পেত্নি। আপনি আবার আমাকে পেত্নি বলছেন?”

“তোমাকে দেওয়া তিন সেকেন্ড অনেক আগেই শেষ হয়েছে। এবার বাইরে থাকো।”

বলেই ভেতরে প্রবেশ করলেন। দরজায় হাত রাখতেই ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার। দ্রুত বা’হাত দিয়ে দরজা ঠেকিয়ে নিলাম। এক চিৎকার করে বললাম, “নাহহহ! যাচ্ছি তো।”

দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলাম। বুকে হাত রেখে বার কয়েক ঘনঘন শ্বাস টেনে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। একটু হলে সত্যিই দরজা তুলে দিত। পায়ের কাছে এলোমেলো হয়ে গুটিয়ে থাকা কম্বলটা টেনে সম্পূর্ণ শরীরে জড়িয়ে নিলাম। মুখটাও তখন ভেতরে। বিছানার একপাশে সেঁটে বিরবির করে বললাম, “ডেন্জারাস লোক একটা! নেই! আমার ভিটামিন জে খাওয়ার স্পৃহা নেই!”
____
প্রত্যুষের আলো উদিত হতে না হতেই তন্দ্রার অবসান হল। ধ্রুবের তীব্র কণ্ঠে বাধ্য হল। আমি বেঘোরে ঘুমাচ্ছি। ঘণ্টা তিন হয়নি সময়। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলেন এবার, “চড়ুই উঠ।”
আমি নড়েচড়ে উঠলাম। শূন্য মুখে অদৃশ্য কিছু চিবিয়ে চিবিয়ে ফিসিয়ে ফেললাম। আড়শ ভঙ্গিতে বললাম, “প্লীজ একটু ঘুমাতে দিন। যান এখান থেকে। একটু আগেই তো জোর করছিলেন ঘুমাতে।”

ক্ষিপ্র গতিতে বললেন, “একটু আগে নয়, কয়েকঘণ্টা আগে।”

“সে যাই হোক, আমি দেরি করে ঘুমিয়েছি, তাই আরও ঘুমাব।”

“দেব এক চড় ফাজিল মেয়ে। আমি দেরিতে ঘুমাতে বলেছি? জোর করেও কাজ হয়নি, তাই ধমকে ঘরে এনেছি।”

“দেখুন..

মুখের শব্দ মুখেই রয়ে গেল। বৃষ্টির চেয়ে ক্ষুদ্র কয়েক ফোঁটা পানি মুখে এসে পড়ল। নাস্তানাবুদ হলাম। তড়িগড়ি করে তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে উঠে বসলাম। ধ্রুব চুল ঝাড়ছেন। এত ভোরে গোসল, কী আশ্চর্য! চোখ পরিষ্কার করে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বললাম, “আর মাত্র দশ মিনিট। পাক্কা!”

“নো! পরীক্ষা দিয়ে এসে ঘুমিও। কালকে শুক্রবার। পরীক্ষা নেই। বাট এখন নয়। কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে পরীক্ষা, এখন ঘুমাতে চাচ্ছ? লাইক সিরিয়াসলি?”

ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে শুধালাম, “তো! মানুষ কী ঘুমায় না। আমিও ঘুমাই। এখন ঘুমাব।”

ধ্রুব দৃষ্টি সরালেন। ঝুলন্ত ফুলের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন, “তুমি তো আগে কুড়ে ছিলেনা। মানুষ মানুষের সংস্পর্শে এসে ভালো হয়, আর তুমি বাঁদর হচ্ছো।”

“হচ্ছি, তাতে আপনার কী? আজব! আপনি নিজের কাজে যান না। বিরক্তিকর!”

পরক্ষণেই ধমকে উঠলেন। আজ অবধি দেওয়ার সবচেয়ে ক্রুব্ধ এবং ভয়ংকর ছিল এটা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, “চুপ, একদম চুপ। দিন-দিন অসভ্য’তে পরিনত হচ্ছো। এক চড় দিয়ে সব বেয়াদবি ঘুচিয়ে দিব। এভাবে কথা বলে? বড়দের সম্মান করতে জানেনা। আমি শুধু তোমার রেজাল্ট দেখব আর কিছু বলব না, আজ পরীক্ষা। অথচ বইটা যদি স্পর্শ করে থাকে।
হাজবেন্ড শিক্ষক আর বউ ফেল করা ছাত্রী? টপ রেজাল্ট যদি না আসে তাহলে তুমি আর ঐ ভার্সিটিতে যাবেনা কিংবা আমি যাবো না।”

আমতা-আমতা করে বললাম, “কেউ জানে আপনি আর আমি..

“এখন জানে না, ভবিষ্য’তেও কি জানবে না? তাছাড়া তুমি ভাববে, কীভাবে পরীক্ষায় টপ হওয়ার যায়। তা-না ভেবে পরীক্ষার রেজাল্ট লুকানোর চেষ্টা করছ?”

বলেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলেন। আমি ধপ করে শুয়ে পড়লেন। অগোছালো কম্বলটা গোছানোর পরিবর্তে আরও এলোমেলো করে ফেলে দিলাম। নাকের জলে চোখের জলে মিশে গেল। শিক্ষক দেখে কী সবসময় শিক্ষকগিরি দেখাতে হবে? একটু আদর করলে, ভালোবাসা দিলে কী তোর সৌন্দর্য খসে পড়বে। শা’লা! শয়’তান!

সবসময়ই আমি টপ হই। টপ হই, টপ। প্রতিটা বই ভাজা ভাজা করা, গিলে ফেলার অপেক্ষা। এবার সাত ঘড়া পূর্ণ হয়ে গিলে ফেলাটাও সম্পূর্ণ হবে।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]