#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৩৫
নিভু নিভু চোখে অবলোকন করতেই ধ্রুবের ক্লান্তিমাখা মুখ নজরে এলো। ঘুমের রেশ ভেবে নড়েচড়ে উঠলাম। আরেকটু তলিয়ে গেলাম ঘুমে। এখানে ধ্রুবের উপস্থিতি হাস্যকর ব্যাপার। মাথায় স্পর্শ পেলাম। এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। ব্যাঘাত ঘটল ঘুমের। তড়িগড়ি করে উঠে বসলাম। ধ্রুব গালে হাত রেখে সামনের টেবিলের উপর বসে আছে। দ্রুত দৃষ্টি আশেপাশে নিবদ্ধ করলাম। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। বাইরে থেকে চাঁদের ঝাঁপসা আলো ভেতরে প্রবেশ করছে। মিটিমিটি তারা জ্বলছে। আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। দেয়ালে কোনো ঘড়ি দেখতে পেলাম না। ফোন খুঁজতে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলাম। জায়গা থেকে উঠার পূর্বেই ধ্রুবের ফোনের স্ক্রিন চোখের সামনে ভেসে উঠল। হঠাৎ তীব্র আলোতে সংকুচিত হল চোখ। আমার ঘুমন্ত ছবি ওয়ালপেপারে সেভ করা। এলোমেলো চুলগুলো, জায়গা এটাই। নিশ্চয় কিছুক্ষণ পূর্বে তুলেছেন। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ৩:২২ এ.এম। আচ্ছা কতক্ষণ হয়েছে তিনি এসেছেন। সত্যি এসেছেন তিনি। কোথায় ছিলেন এতগুলো দিন।
নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ভারসাম্য হারিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার বুকের মধ্যিখানে। গলা জড়িয়ে রাখলাম। অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, “এতক্ষণে এসেছেন আপনি, কোথায় গিয়েছিলেন? কত ভয় পেয়েছিলাম আমি?”
অকস্মাৎ আক্রমণে ভরকে গেলেন তিনি। এলোমেলো হয়ে টেবিলের উপর শুয়ে পড়লেন। হুট করে একহাত পিঠে রাখলেন। আশ্বাসের ভঙ্গিতে বললেন, “কুল, কুল শ্রেয়াপাখি। শান্ত হও। কাঁদে না। এইতো এসেছি আমি। কান্না থামাও। কান্না না থামালে আমি কিন্তু চলে যাবো।”
ক্ষান্ত হওয়ার বিপরীতে বেড়ে গেল কান্নার গতি। শার্ট আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছি। ধ্রুব নিরাশ হলেন। উপায় খুঁজলেন না। অন্য উপায় অবলম্বন করলেন।কপালের চুলগুলো সরিয়ে চুমু দিলেন স্বযত্নে। ঘোর লাগা কণ্ঠে বললেন, “আমাকে দেখার স্বাদ, এই জীবনে মিটবে না।”
আমি লজ্জানত হলাম। তার দেওয়া কথায় লজ্জা মিশ্রিত হয়ে তার বুকেই মুখ গুঁজলাম। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক নেই, বেড়ে চলেছে। ডিপডিপ, ডিপডিপ, ডিপডিপ করছে। পরম শান্তি অনুভব করলাম। আকাশের চাঁদকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলাম। কোনো আলো যাতে স্পর্শ করতে না পারে আমাদের।
ধ্রুব হাত পা ছড়িয়ে টেবিলের উপর শুয়ে পড়েন। তার সাথে মিশে থাকার ফলে আমাকেও থাকতে হল টেবিলে। মাঝামাঝি সাইজের টেবিল। হাঁটুর পরের অংশ টেবিলের বাইরে ঝুঁলে আছে। কাত হয়ে শুয়েছি বলে টেবিলের ভেতরেই আছি।
ধ্রুব একটু নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললেন, “রাঙামাটি গিয়েছিলাম। শুধু মা জানত। তোমাকে জানালে চিন্তা করতে, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করতে না। তাই বারণ করেছি। রাহাতকেও বলিনি। ঐ শা’লার ঠোঁট পাতলা। তোমাকে বলবে না, কিন্তু বাবুইকে বললে। বাবুই আবার তোমার কাছে লিক করবে।”
অস্ফুট স্বরে বললাম, “যাওয়াটা কি খুব জরুরি ছিল?”
“যাওয়াটা জরুরি ছিল কি-না জানিনা। কিন্তু তোমাকে স্পেস দেওয়াটা জরুরি ছিল।”
আমি অবুঝের মত মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেলাম। অতিবাহিত হল কিছু প্রিয় মুহুর্ত। হঠাৎ ধ্রুব বললেন,
“এবার আমাকে খুলে বলো সবকিছু।”
অবুঝ স্বরে বললাম, “কোন সবকিছু?”
“তুমি এখানে কী করছ?”
স্নিগ্ধ গলায় বললাম, “আমি দু’দিন ধরে এখানে কাজ করছি। আমি আপনার আর মামার গণ্ডি পেরিয়ে রোজগার করতে চাই।”
“ভালো কথা। রোজগার করা দোষের কিছু নয়। কিন্তু আমি অন্য কথা জিজ্ঞেস করছি।”
বুঝতে পারলাম তার কথার ধরন। কিন্তু তোয়াক্কা করলাম না, প্রসঙ্গ পাল্টে নিলাম।
ধ্রুবের বাক্য থামতেই বলতে শুরু করলাম, “বিকেলের দিকে শরীরটা ভালো লাগছিল না, একটু বসেছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানিনা না। কেউ ডেকেও দেয়নি।”
বিরক্ত হলেন অতিশয়। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “আমি এটার কথা জিজ্ঞেস করিনি, ভার্সিটিতে কী হয়েছে সেটা জানতে চাইছি।”
অবিলম্বে যাতনার সূচনা হল। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম। চুপসে গেলাম আমি। ধ্রুবকে সন্নিকটে পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম কথাটা। নতজানু হয়ে রইলাম। প্রত্যুত্তর না পেয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলেন ধ্রুব, “কিছু জিজ্ঞাসা করছি কিন্তু..
প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, “ক-কই, কিছু হয়নি তো..
আমার কথা থামার পূর্বেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন ধ্রুব, “আগেরবার মিথ্যা বলার কারণে চড় দিয়েছিলাম, এবার একই ভুল করবে না নিশ্চয়ই, করলেও পরিনতি ভালো হবে না।
তাছাড়া আমি সবটাই জানি, তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছুক।”
অস্পষ্ট স্বরে বলি, “জানেনই যখন, আবার প্রশ্ন করেছেন কেন? আচ্ছা আপনাকে কে বলেছে?”
ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কেন তাকে নোবেল দিবে?”
“না, ধন্যবাদ দিতাম।”
“লাইব্রেরীয়ান বলেছে। তিনি পুরোটা সময় ছিলেন না, পরে এসেছেন। তার ভাষায় শুনেছি, এবার তুমি বলো।”
“এবার তুমি বলো” শেষের উক্তিটা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন ধ্রুব। কেঁপে উঠলাম মুহূর্তে। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করলাম, “ওরা আমাকে ভেঙে দিয়ে ধ্রুব। ভেঙে দিয়েছে। কত ছাত্র-ছাত্রী ছিল। সবার সামনে আপনার আর আমার সম্পর্কটাকে বাজেভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘পতিতা’ শব্দটা মানানসই বললেও কম হয়ে যাবে। আমাদের পবিত্র সম্পর্কটা কি এই তকমা পাওয়ার যোগ্য? আপনার দোষ আর দিবো না, সব আমার দোষ। সবকিছু জন্য আমি দায়ী।”
ধীরে ধীরে কালকে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা বলতে শুরু করলাম।
ধ্রুব বুকে জড়িয়ে নিলাম আমায়। শান্তনা দিয়ে বললেন, “নিজেকে দোষারোপ করোনা। সব ঠিক করে দিবো আমি। আর কাঁদতে দিবো না। সকাল হতে দাও।”
___
গাড়ি থামল ভার্সিটির মেইন গেটের থেকে কিছুটা দূরত্বে। এখনও সময় হয়নি ক্লাসের। তবে ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচল। আশেপাশে সন্দিহান চোখে চেয়ে নামলেন গাড়ি থেকে। কাঁচ লাগানোর ফলে বাইরে থেকে ভেতরের অংশ দেখা যাচ্ছে না।
দরজা বন্ধ না করেই গম্ভীর গলায় বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমি একহাত ঘোমটা টেনে বেরিয়ে এলাম। সবাই হাঁটা থামিয়ে একবার আমাদের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ধ্রুবের তেজের কারণে সরাসরি তাকানোর সাহসে কুলাচ্ছে না। কালকের ঘটনার নিয়ে সবাই অবগত। ডানহাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের হাত গুঁজে নিলেন। গলার নিচের ঘামটুকু মুছে পা বাড়ালেন। হাতে টান পড়াতে আমার পাজোড়াও গতিশীল হল। হাত ছাড়াতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। ক্যাম্পাসের দিকে গিয়ে সবাইকে ডাকলেন। মাহি ও তার বন্ধুরা নেই। তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন মাহি ও তার বন্ধুরা আসলে যাতে ধ্রুবের সাথে দেখা করে। আঁখি আর প্রিয়াকে আমার দায়িত্ব দিলেন। অতঃপর আমাকে রেখেই চলে গেলেন ভিতরে।
আমি ক্লাসে গেলাম না। বসে দাঁত দিয়ে নক ছোট করার প্রতিযোগিতায় নামলাম। কিছুক্ষণ পর মাহি ও তার বন্ধুরা এল। ধ্রুব স্যারকে খবর পাঠানো হল। চারিদিকে ফিসফিসানি শুরু হল। ধ্রুব স্যারের আগমনে থেমে গেল সবকিছু। কথার ধরন একই রেখে স্বাভাবিক তালে বললেন, “যাওয়ার সময় টি.সি. নিয়ে যেও।”
একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাকের সুরে বলে, “কীসের টি.সি. স্যার?”
“আমার বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার বলে মনে করছি না, তবুও বলছি, ‘গতকালের জন্য।’ তোমাদের জায়গা নেই এখানে। এটা পড়াশোনার জায়গা কাউকে ছোট করার জায়গা নয়।”
মাহি নত কণ্ঠে বলে, “স্যার আমরা বুঝতে পারছি, কেন আমাদের টি.সি. দেওয়া হবে। আচ্ছা, আমরা কি কোনো মিথ্যা বলেছি? সত্যি কথা বলার কোনো অধিকার আমাদের নেই?”
ধ্রুব স্যার সৌজন্য হাসলেন। কাউকে তাচ্ছিল্য করার জন্য এই হাসিই যথেষ্ট। কপাল কুঁচকে বললেন, “সত্য বলার অধিকার সবার আছে। তুমি সত্য না-জেনেই একজনকে হেয় করছিলে। তোমার উচিত ছিলনা, আমার আর চড়ুইয়ের সম্পর্কটা আগে জেনে মন্তব্য করার?
আর পাঁচটা বৈবাহিক সম্পর্কের মত আমি আর চড়ুই স্বামী স্ত্রীর অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ।”
চমকে উঠলাম আমি। ভেবেছিলাম অন্য কোনো উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন কারণ তিনিই বিয়ের কথাটা লুকিয়েছেন।
উৎকণ্ঠিত হল পরিবেশ। সবার দৃষ্টি আমার পানে নিবদ্ধ। গমগম আওয়াজ শোনা গেল। ভার্সিটির ক্রাশ ধ্রুব স্যার বলে কথা। হুট করে বিয়ের কথাটা মেনে নিতে অসুবিধে। তড়িঘড়ি করে মাহি বলে, “স্বামী স্ত্রী? আপনারা বিবাহিত আর কেউ সেটা জানে না।”
ত্যাড়া জবাব দিলেন, “প্রথমত, এখন কেউ বিয়ে করলে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে করতে হবে না-কি? আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার পাবলিকলি আনতে চাইনি, তাই লুকিয়ে রেখেছিলাম। দ্বিতীয়ত, স্যারেদের মধ্যে অনেকেই জানে। তৃতীয়ত, সেদিন অনেক কিছু করার পরেও ছেড়ে দিয়েছিলাম। চতুর্থ, তুমি মেয়ে না হলে আমার সামনে আস্ত থাকতে না। তবে ছেড়েও দিচ্ছি না।”
ধ্রুব কড়া গলায় শাসিয়ে নিয়ে গেল ওদের।
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]