ইট পাটকেল পর্ব-৩০+৩১

0
963

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৩০

মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর স্ত্রী কে কিডন্যাপ করা হয়েছে। আজ সকালে অফিসে আসার সময় তার গাড়ি থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে মিনিস্টার আশমিন জায়িন চৌধুরীর স্ত্রী সনামধন্য সিঙ্গার তেহজিব নূর কে জোর করে কিছু লোক গাড়ি থেকে বের করে তাদের গাড়ি তে তুলে নিয়ে গেছে।তেহজিব নূরের সাথে তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট লুবানা জান্নাত ও ছিল।বাধা দেওয়ায় তাকে আঘাত করে আততায়ীরা।

সানভি অস্থির হয়ে পায়চারি করে সব জায়গায় কল করে যাচ্ছে। ভয়ে তার আত্মা লাফিয়ে বাইরে আসার অবস্থা। কয়েকদিন যাবত আশমিনের কাছে হুমকির কল আসছিলো। নারী পাচারকারীরা হুমকি দিচ্ছিলো তাকে আশমিন কে।আশমিন খুব শান্ত গলায় তাদের বলেছিল,

— বাচ্চাদের এতো দুষ্টুমি করতে হয় না। আংকেল রাগলে কিন্তু কান মলা দিবো। ভালো বাচ্চারা এসব করে? কালকে গিয়ে শিশু ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাবে।বাচ্চা কাচ্চা হুমকি দিচ্ছে। দেশটা রসাতলে গেলো।

আশমিন ফোন কেটে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছে।সানভি এখন বুঝতে পারছে তার স্যার মস্তো বড় ভুল করেছে।
সানভি অস্থির হয়ে আশমিনের দিকে তাকালো। সে এখন ফোনে এঞ্জেলো গেম খেলতে ব্যস্ত।দুই দিন আগে আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে জেনেছে তার দুই টা রাজকুমারী হবে।উত্তেজনায় ডাক্তার কে জরিয়ে ধরেছিলো সে।হুস ফিরতেই তাকে ছেড়ে দিতে মিনমিন করে নূরের দিকে তাকাতেই দেখে নূর তার দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছে। কারন ডাক্তার ছিল একজন ইয়াং মেয়ে। আশমিন নূরের ভয়ংকর দৃষ্টি দেখে কাচুমাচু করে বললো,

— স্লিপ অফ জরাজরি বউ।আমি তো তোমাকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম।মাঝখানে এ চলে এসেছে।আমার ছোট বোনের মতো। আজ থেকে এ তোমার ননদ। ননদের সাথে ভাব করো। আমি বাইরে আছি।

কথাগুলো বলেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল আশমিন।সেদিন থেকেই সে এঞ্জেলা খেলা শুরু করেছে। তাদের খাওয়া, গোসল, সাজগোছ সব শিখে ফেলছে।আশমিন একশ পার্সেন্ট শিউর নূর তাকে দিয়েই বাচ্চাদের ডায়পার চেঞ্জ করাবে।

সানভি করুন গলায় বলল,

— স্যার,, পুলিশের আশায় বসে না থেকে আমরা নিজেরাই খুজলে ভালো হবে।এভাবে বসে থাকলে ওরা যদি ম্যামের কোন ক্ষতি করে ফেলে।

সানভির ভয়ার্ত গলা শুনে মুখ কুচকে ফেললো আশমিন। মনে হলো কেউ তাকে এক গ্লাস নিম পাতার রস খায়িয়ে দিয়েছে।

— তুমি একপাক্ষিক কথা বলছো সান।তোমার ম্যামের জন্য চিন্তা না করে ওই অসহায় ভোলা ভালা সন্ত্রাসী গুলোর কথা চিন্তা করো।তার জন্যই আজকে তাদের প্রাণ যাবে।এমন চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে আমি ভোট পাবো? বউয়ের জন্য কতগুলো ভোট হারালাম। সন্ত্রাসীদের ও একটা করে এন আই ডি কার্ড আছে। তারা দেশের জনগণ। এমন করলে জনগণ আমাদের পাশে থাকবে?

সানভি চোয়াল ঝুলিয়ে না বোধক মাথা নাড়লো। আশমিন নিজের চেয়ার ছেড়ে ওঠে পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রাখতে রাখতে বললো,

— চলো বউ খুজতে যাই। না জানি বেচারা সন্ত্রাসীরা কোন হালে আছে।(দুঃখী গলায়)

সানভি আহত চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। এই চাকরি ই একদিন তার প্রাণ নিবে।এতো অনাচার চোখে দেখা যায় না।

আশমিন কে বের হতে দেখে রিসিপশন থেকে ছুটে এলো লুবানা।মাথায় ব্যন্ডেজ করা হয়েছে। আশমিন কে অনুরোধ করে বললো,

— আমাকে ও সাথে নিয়ে চলুন স্যার।এভাবে বসে থেকে চিন্তা করতে করতে আমি বোধহয় পঙ্গু হয়ে যাবো।

সানভির কপাল কুচকে গেলো। সে বিরক্ত গলায় বলল,

— চিন্তা করতে করতে কেউ পঙ্গু হয় না সাবানা।ঝামেলা না করে চুপচাপ এখানে বসে থাকো।আমরা দরকারী কাজে যাচ্ছি। পিকনিকে যাচ্ছি না যে তোমাকে নিয়ে নাগরদোলায় চড়াবো।

লুবানা তেতে গেলো। তাকে আবারো সাবানা বলেছে এই লোক।তার কি সাবানার মতো সেলাই মেশিন আছে? নাকি সে সারাদিন কান্নাকাটি করে? আজব!

আশমিন এই ফাকে আরেক রাউন্ড এঞ্জেলা খেলায় মন দিলো। হাতে আরো কিছু সময় আছে।এই ফাকে গোসল করানো টা শিখে ফেলা যাবে।

— জরুরি কাজে আপনাকে কি দরকার মি.সরকারি হাসপাতালের মর্গে সুয়ে থাকা অর্ধেক পচা লাশ।মুখ বন্ধ রাখুন।নইলে আপনার কংকাল মেডিক্যাল এ দান করে দিবো। তখন ঝুলে থাইকেন আজীবন।

ওদের তর্কের মাঝেই মেসেজ পেয়ে বেরিয়ে গেছে আশমিন। তার লোকের নূর কে ট্রেস করে ফেলেছে। পুরো জায়গা ঘেরাও করে আশমিনের জন্য অপেক্ষা করছে।
সানভি ও ছুটছে আশমিনের পিছনে। হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠতেই লুবানা ও তার সাথে এসে উঠলো। সানভি কিছু বলবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

— একদম জ্ঞান দিতে আসবেন না।ম্যাম কি হালে আছে কে জানে।আমি গেলে তাকে সামলে নিতে পারবো।চুপচাপ গাড়ি চালান।

আশমিন কড়া চোখে তাকাতেই সানভি গাড়ি স্টার্ট দিলো।তাদের গন্তব্য এখান থেকে দুই ঘন্টার পথ।অমি ওখানেই আছে।

এতক্ষণ নির্লিপ্ত থাকা আশমিনের কপালে ঘাম দেখে অবাক হলো লুবানা।তবে আশমিনের চেহারা শান্ত।চোখে ও কোন অস্থিরতার ছাপ নেই। হাত শক্ত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে। সমান সর্বচ্চো স্পিডে গাড়ী চালাচ্ছে।

এতো এতো ঝামেলা আর ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে হিমালয়ের গুহায় গিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়।নেহাৎ ই তার টনসিল ফুলে যায় বলে যেতে পারছে না। আজকের ঝামেলা শেষ হলেই সে কুকুর খুজতে বের হবে। কোন পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে এই চাকরি তে এসেছিল তাকে খুজে বের করা দরকার। তার কাছে জবাব চাইতে হবে, সে তার কি ক্ষতি করেছিলো? এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়ার দরকার।

সানভির ভাবনায় ছেদ পরল আশমিনের ডাকে।

— এখানেই গাড়ি থামাও সান।

গাড়ি থামতেই আশমিন নেমে গেলো। পাঞ্জাবি খুলে একটা সাদা শার্ট পরে তার জন্য রাখা বাইক নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেলো। সানভি আর লুবানা হা করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এতো এতো ঝগড়া বৃথা করে আশমিন তাদের না নিয়েই চলে গেছে। সানভির চোখ ফেটে কান্না এলো। আশমিন তাকে ছাড়া চলে গেছে ভাবতেই বউ মরে যাওয়ার ফিলিং হলো।

— দেখলে সাবানা!স্যার আমাকে না নিয়েই চলে গেলো। এখন আমি কি করবো?

— আসেন গলাগলি ধরে কাদি।(বিরক্ত হয়ে)

সানভি নিজেকে সামলে নিলো। এই মেয়ের সামনে কেদে ভাসালে তার আর ইজ্জত থাকবে না। এই মেয়ে তার ইজ্জত লুটে নিবে।

আধঘন্টার মধ্যেই আশমিন তার গন্তব্যে পৌঁছে গেলো।একটা ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়ি। কপাল কুচকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো পুরোটা। আশমিন কে দেখে অমি দৌড়ে এলো তার কাছে।

আশমিন বিরক্ত গলায় বলল,

— ভিতরে কয়জন আছে?

— বিশ জন আছে স্যার।

— আমার বউয়ের কি অবস্থা?

— চেয়ারে বেধে রেখেছে (ভয়ে ভয়ে)

— তাই! ভিতরে গিয়ে সব কটা কে বেধে ফেলো তো অমি।আমার প্রেম পাচ্ছে। বউয়ের সাথে কিছুক্ষণ সুখ দুঃখের গল্প করবো।কেউ যাতে ডিস্টার্ব না করে।

অমি বিরস মুখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। মনে মনে তার ছেড়া বলতেও ভুললো না।

অমিরা ভিতরে ঢোকার কয়েক মুহুর্ত পরেই গোলা*গু*লি শুরু হলো। আশমিন শান্ত চোখে একবার তাকিয়ে নিজের গা*ন বের করে এগিয়ে গেলো। তাকে কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না!

সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছে তাদের উপর। আটঘাট বেধেই নেমেছে তারা। আশমিনের কয়েকজন লোক খুব বাজে ভাবে আহত হয়েছে। বাহাদুরের বা হাতে গু*লি লেগেছে। তবুও সে থেমে নেই। অমি সব জায়গায় নূর কে খুজে যাচ্ছে। নূর কে না দেখে তার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছে।বোনের চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। আশমিন কয়েক পলক গো*লা*গু*লি দেখে অলস হাই তুললো। হাই তুলতে তুলতেই কয়েকজনের মাথায় শুট করে দিয়েছে সে। ব*ন্দুক পকেটে রেখে আয়েশ করে বসলো সে। তার লোকেরা পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। অমি এসে ভয়ার্ত গলায় বলল,

— ম্যাম কে কোথাও পাচ্ছি না স্যার।

আশমিন চোখ তুলে তাকালো অমির দিকে। রক্তিম চোখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলো চেয়ারের উপর। চোখ বন্ধ করেই হুংকার দিয়ে বললো,

— আমার বউ কোথায়?

আশমিনের হুংকারে সন্ত্রাসীদের সাথে সাথে অমি আর তার লোকেরা ও কেপে উঠলো। আশমিনের রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে সবার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। একজন কাপা কাপা হাতে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে একটা বস্তা দেখিয়ে দিলো।অমি এক মিনিট হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে গিয়ে বস্তা থেকে নূর কে বের করলো। তার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে।নূরের কপাল থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে রক্ত পরছে।অমির মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। নূর কে বুকের সাথে আগলে ধরে বোবার মতো তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। আশমিন সেদিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। হিংস্র বাঘের মতো সবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,

— ওকে কে আঘাত করেছে? নাম বল।নাহলে সব কয়টা কে আজ কিমা বানিয়ে ফেলবো।হাড় ও খুজে পাবে না কেউ।

সবাই ভয়ে কাপতে লাগলো। আশমিনের হিংস্র রুপ দেখে বাহাদুর নিজেও কাপছে।

সবাই তাদের লিডার কে দেখিয়ে দিলো।আশমিন সাথে সাথে নির্মম ভাবে মারতে লাগলো তাকে।একটা একটা করে সব গুলো হাড় ভেঙে আবার গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পরলো। লোকটা নড়াচড়া করছে না। আশমিন বজ্র কন্ঠে বললো,

— এখনই মরবি না।আমার মারা শেষ হয় নি।আম টেকিং রেস্ট।মরে গেলে হাড়গোড় একটা ও আস্তো রাখবো না।

বাকি সন্ত্রাসীদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো,

— ওরে জাগা।নাইলে তোদের অবস্থা এর চেয়েও খারাপ করে দিবো।আমার বউ রে বস্তায় ভরা! ভাবলাম বউরে এসে বাধা দেখবো।সেই সুযোগে টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে ফেলবো। অথচ তোরা আমার বউয়ের কপাল ফাটিয়ে বস্তায় ভরে রাখিস।
বাহাদুরররর,,ডাক্তার কই।আমার বউরে তারাতাড়ি চেকআপ করতে বল।বউয়ের যদি কিছু হয়, তোদের সবাইকে কবরে পাঠিয়ে দিবো।

চলবে,,,

#ইট_পাটকেল
#সানজিদা_বিনতে_সফি
#পর্ব_৩১

হাসপাতালে গম্ভীর মুখে বসে আছে আশমিন। নূর কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে দুই ঘন্টা হতে চললো। আশমিন তখন থেকেই থম ধরে বসে আছে। আট মাসেই সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। নূরের কন্ডিশন ভালো ছিল না। একজন হলে সমস্যা হতো না। টুইনস বেবি হওয়ায় সিজার করে ফেলতে হচ্ছে। বাচ্চা উল্টে গেছে।নূর কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা।তখন পেটে আঘাত লাগায় রক্তপাত শুরু হয়।নূর কিডন্যাপ হওয়ার দুই ঘন্টা পরে আশমিন নূরের কাছে পৌঁছেছে।বেবিদের কোন ক্ষতি হয়নি।ব্লিডিং বন্ধ না হওয়ায় এখনি সিজার করতে হচ্ছে। নূরের শরীরের কন্ডিশন খুব একটা ভালো না।আশমিন অমি দের সাথেই একজন ডক্টর পাঠিয়ে ছিল।সে চেকআপ করে নূরের কন্ডিশন বলতেই আশমিন সাথে সাথে নূর কে হসপিটাল নিয়ে এসেছে।

অমি অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আশমিন কে এতো শান্ত দেখে অবাকের সাথে সাথে মেজাজ ও খারাপ হচ্ছে। নূর কে নিয়ে আশমিনের কোন মাথা ব্যথা ই নেই!সানভি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে।নূরের জন্য তার খুব খারাপ লাগছে। লুবানা পাশে দাঁড়িয়ে গুন গুন করে কেদে যাচ্ছে। সানভি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেললো। এই মেয়েকে দেখে তার মাথা ব্যথা হচ্ছে।

আশমিনের ফোন বাজতেই কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেলো। আশমিন ফোন রিসিভ করে একটু দূরে গিয়ে দাড়ালো।

— বলো বাহাদুর।

— নাফিজা ম্যামের খবর পেয়েছি ম্যাম।

— আচ্ছা। এড্রেস পাঠিয়ে দাও।

— এদের কি করবো স্যার?(আমতা আমতা করে)

— মে*রে দাও।এতো গুলো পি*স করো যে বোঝা না যায় এরা মানুষ ছিল।

আশমিনের শান্ত গলায় এমন ভয়ংকর কথা শুনে শুকনো ঢোক গিললো বাহাদুর। সে জানে আশমিন কতটা ভয়ংকর। মনে মনে একটু আফসোস হলো এদের জন্য।

— মা*রার আগে মেয়ে গুলোর খোজ নিয়ে নিবে। এদের হদিশ যেন কাক পক্ষি ও টের না পায়।

বাহাদুর সম্মতি দিয়ে ফোন কেটে দিল। আশমিন গিয়ে আবার আগের যায়গায় বসে পরলো। অপারেশন থিয়েটারের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলো। সানভি আশমিনের বসার জন্য ভিআইপি ক্যাবিন নিলেও আশমিন সেখানে যায় নি।তার ভিতরের অস্থিরতা সে কাউকে দেখাতে পারছে না।দম বন্ধ হয়ে আসছে।হুট করেই বসা থেকে দুম করে দাঁড়িয়ে গেলো আশমিন। অপারেশ থিয়েটারের দরজায় নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো। অমি এসে আগলে ধরলো আশমিন কে। আশমিনের সারা শরীর কাপছে।এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলে ও এখন আর তার সহ্য হচ্ছে না। নূর কি অবস্থায় আছে না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই তার।বুকের ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। বুকের যন্ত্রণায় তার শ্বাস আটকে আসছে। আশমিন কে অমি ধরে রাখতে পারছে না।আশমিনের শক্তির সাথে তার মতো দুইটা অমিও কিছু না। সানভি ভয়ে সামনে যাচ্ছে না। লুবানা শব্দ করে কাদছে।

— দরজা খোল,,আমি ভিতরে যাবো।

আশমিনের হুংকার শুনে একজন নার্স দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আশমিনের দিকে। সব সময় শান্ত থাকা মানুষ টা কে এভাবে ভয়ংকর রুপে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো তার।আশমিন নার্স কে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো। নূর কে অপারেশন টেবিলে দেখে তার অশান্ত চোখ গুলো আপনা আপনি শান্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার অপারেশন বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আশমিনের দিকে। আশমিন ইশারায় তার কাজ করতে বলে নূরের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নূরের ফ্যাকাসে মুখের দিকে। অক্সিজেন মাক্স লাগানো নূর কে দেখে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এলো। কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশমিন। বুকের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। বুকে কয়েক বার হাত বুলিয়ে অসহায় চোখে চারিদিকে চোখ বুলালো। সে অসুস্থ হতে চায় না এখন। নূরের পাসে থাকতে চায়।কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না। বউয়ের সিজার দেখে সে বুক ব্যথায় মরে যাচ্ছে। এমন দুর্বল মন্ত্রী দিয়ে দেশ চলবে!কি লজ্জাজনক ব্যপার।

বাচ্চার হালকা কান্নার আওয়াজে ধ্যান ফিরলো আশমিনের।বুকের ব্যথা ভুলে সেদিকে তাকিয়ে চোখ স্থির হয়ে গেলো। দুজন নার্সের কোলে দুটো রাজকন্যা। রক্তে মাখামাখি তাদের ছোট্ট শরীর পরিস্কার করে তার কাছে নিয়ে এলো বাচ্চাদের।আশমিন শুধু এক পলক দেখার সুযোগ পাবে।তার পর তাদের এনআইসিউ তে নিয়ে যাবে।ওখানেই পনের দিন রাখার পরে তাদের মায়ের কাছে দেয়া হবে। আশমিন একপলক দেখে বাচ্চাদের নিজের কোলে নিলো।নার্স কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আশমিন কে কিছু বলার ক্ষমতা নেই তাদের।একজন হ্যান্ড স্যানিটাইজার করতে বললো মিনমিন করে। আশমিন বাচ্চাদের দিয়ে নিজের হাত স্যানিটেশন করে আবার তাদের কোলে নিলো।দুজনের কানের কাছে আজান দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে তাদের আবার নার্সদের কোলে দিয়ে দিলো।

— অপারেশন হয়ে গেছে স্যার।ম্যাম কে কিছুক্ষণ পরে কেবিনে সিফট করা হবে। আপনি যদি একটু,,

শেষের কথা টা আমতা আমতা করে বলতে গিয়েও থেমে গেলো ডাক্তার।আশমিন আর কিছু বললো না। নূরের কপালে চুমু খেয়ে চুপচাপ বেরিয়ে এলো। বুকের ব্যথা টা এখন কমেছে।প্রিন্সেসদের কোলে নিয়ে অর্ধেক কমে গেছে। বউকে বুকে নিলে পুরোটা চলে যাবে নিশ্চিত। অমি সানভি আর লুবানা বাচ্চাদের দেখে এসেছে একপলক। উত্তেজনায় কখন সানভির হাত জরিয়ে ধরেছে নিজেও টের পায়নি। সানভি লুবানার বাচ্চামো দেখে হালকা হাসলো। রাগ করার ভান করে বললো,

— এই হাত ছাড়ো সাবানা।তোমাকে বিশ্বাস নেই।এখন হাত ধরছো একটু পরে গলা ধরতে আসবে। আমি কোন দুই ইঞ্চি লিলিপুট কে আমার গলা জরিয়ে ধরতে দিবো না। নারী কেলেংকারী হলেও মেনে নেয়া যাবে। কিন্তু বাচ্চা কেলেংকারি হলে আমি মুখ দেখাতে পারবো না।আল্লাহর দোহায় লাগে আমাকে ছেড়ে দাও।

লুবানা ঝামটা দিয়ে সানভির হাত ছেড়ে দিলো। কটমট করতে করতে বললো,

— এমন একটা ভাব করছেন জেন আমি আপনার ইজ্জত লুটে নিচ্ছি। ফালতু যত্তসব। আর আমার নাম লুবানা। আরেকদিন সাবানা বললে আপনাকে সাবান দিয়ে মুচড়ে মুচড়ে ধুয়ে দিবো আমি। ল্যাব পিপলস।

লুবানা গটগট করে চলে গেলো। সানভি বিরস মুখে তাকিয়ে দেখলো তার চলে যাওয়া। অমি কপাল চাপড়ে বললো,

— সমস্যা কি তোমাদের।সতিনের মতো সারাদিন একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকো কেন?আর এই ল্যাব পিপলস মানে কি?(অবাক হয়ে)

— আমার কংকাল ল্যাবে দান করা হয়েছে।তাই আমি ল্যাব পিপলস। (শ্বাস ছেড়ে)

— মানে??

— লম্বা কাহিনি। বাদ দাও।

— হুম।

আমজাদ চৌধুরী হসপিটালে এসেছে পাচ মিনিট হলো। আশমিন হাসপাতালের বিলাসবহুল কেবিনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। সারাদিনের চিন্তা ক্লান্তি চিন্তায় শরীর ভার ছেড়ে দিয়েছে।আমজাদ চৌধুরীর খারাপ লাগলো ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে।বাড়ি তে নাচতে থাকা বিপদের কথা কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।কামিনী চৌধুরীর উপর বিতিষ্ণা চলে এসেছে। তবুও সে ঘৃণা করতে পারে না তাকে।একেই বুঝি ভালবাসা বলে।

— বউ ছেড়ে আসতে মন চাইলো?তুমি তো দিন দিন বউ পাগল হয়ে যাচ্ছো।পুরুষ মানুষের এমন বউ পাগল হলে চলে!

আশমিনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো আমজাদ চৌধুরী।কে এই কথা বলছে! যে নিজেই সারাদিন বউয়ের আগে পিছে ঘুরঘুর করে।

— ক্লান্ত লাগছে আব্বু।

আমজাদ চৌধুরীর মায়া হলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বললো,

— নূরের কি অবস্থা?

— ভালো।

— আমার নাতনি রা কেমন আছে?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আব্বু।এই এটুকু হয়েছে(হাত দিয়ে ইশারা করে) আশমিন জায়িন চৌধুরীর মেয়েরা কিনা ইদুরের বাচ্চার সাইজ নিয়ে দুনিয়ায় এলো! ওদের কান্না ও ঠিক ভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম না।চোখ খুলে আমাকে দেখেনি ওরা।আমার নূরের কতো কষ্ট হয়েছে! সব কয়টা কে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো আমি।কার কলিজায় হাত দিয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।(দাতে দাত চেপে)

— ওদের তুমি এখনো বাচিয়ে রেখেছো এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছো?(ভ্রু কুচকে)

— ওরা তো চুনোপুঁটি আব্বু।রাঘববোয়ালদের ধরা এখনো বাকি।সব কয়টা কে ইঞ্চি দিয়ে মেপে মেপে সাইজ করবো।

— আচ্ছা বাদ দাও। ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।একটু রেস্ট নাও।

— দুই দুইটা মেয়ে পৃথিবীতে আনা চারটি খানি কথা! তুমি কি বুঝবা।নিজে দুই বাচ্চার বাপ হয়েও ভার্জিন বাপ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। তুমি আমার মান সম্মান ধূলিসাৎ করে দিলে। এ জীবন দিয়ে কি হবে আমার।শুধু বউ টার জন্য বেচে আছি।না হলে মসজিদের দান বক্সে দান করে দিতাম।

আমজাদ চৌধুরী হনহন করে বেরিয়ে গেল। এই ছেলের জন্য মায়া দেখানো তার জীবনের চরম ভুল।

চলবে,