দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব-৯+১০

0
334

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ‍্য ইয়াসমিন
পর্ব:৯

ঢাকা ইউনিভার্সিটির সামনে এক বন্ধু সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল আরাফাত সেখান থেকে ফিরে যাওয়ার পরে বাধলো আরেক বিপত্তি। হঠাৎ গেটের ভেতর থেকে অরিন দৌড়ে এসে আরাফাতের সামনে হাজির। মেয়েটাকে দেখে আরাফাত ভড়কে গেছে। প্রথমে ভেবেছিল দৌড়ে পালিয়ে যাবে কিন্তু শেষমেশ পারেনি।তারপর ভাবলো একটা বোঝাপড়া করা দরকার। অরিন হাঁপাতে হাঁপাতে ওর সামনে কোমরে হাত রেখে বলল,

> কেমন আছেন? আমাকে দেখলে আপনি এমন পালিয়ে যান নয়তো পালাই পালাই করেন কেনো? ভয় পান বুঝি?

অরিনের ওষ্ঠে হাসি দেখে আরাফাত জ্বলে উঠলো।। ভ্রু কুচকে উত্তর দিল,

> সত্যিই খুব ভয় পাচ্ছি। ভয়ে আমি লেপ গায়ে জড়িয়ে চলাফেরা করছি। শুনো মেয়ে, আমি কোনো পাবনা ফেরত রুগীর সঙ্গে কথা বলি না। একদম আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে না। ফাজিল মেয়ে।

আরাফাতের ধমক শুনে অরিনের চোখ ছলছল করে উঠলো। ছেলেটাকে ওর ভালোলাগে। কি এক অদৃশ্য অদম্য টানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা। এটাকে ভালোবাসা বলে নাকি ভালোলাগা বলে ওর ছোট্ট মস্তিষ্কে সেগুলো ধরে না। লোকটার সঙ্গ ওকে খুব করে টানে। অরিন ঢোক গিলে মুখটা করুন করে বলল,

> এভাবে কথা বলছেন কেনো?হৈমী আপনার কথা বারবার করে বলে তাই তো আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসি। এক সঙ্গে থাকি তো।

অরিন অকপটে মিথ্যা কথাটা বলে বসলো। না বললে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। অরিনের বুদ্ধি কাজে দিলো। আরাফাত চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভেবে নরম সুরে বলল,

> সরি আমার ভুল হয়েছে। আচ্ছা আসুন সামনে একটা রেস্টুরেন্টে আছে কফি খেতে খেতে কথা হবে।

অরিন মাথা নাড়িয়ে সাড়া দিলো। মনের মধ্যে রীতিমতো লাড্ডু ফুটছে। উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছে না। তবুও চুপচাপ আছে। পাছে লোকটার যদি আবার মতিগতি পরিবর্তন হয়ে যায়। আরাফাত ওক অবাক করে দিয়ে ওকে নিয়ে নিকটবর্তী একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসে কফির অর্ডার দিলো। সামনাসামনি দুজনে বসে আছে। অরিন লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হচ্ছে। আরাফাত মাঝেমধ্যে ওর মুখটা দেখছে আর ভাবছে, এই ড্রামা কুইন কি ওকে বোকা বানিয়ে নিয়ে আসলো? ও আর ভাবতে পারলো না ভ্রু কুচকে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> হৈমী কেমন আছে? ওকে কান্নাকাটি করতে মানা করবে। আমি খুব দ্রুত ওই জাহান্নাম থেকে ওকে মুক্ত করে আনবো।

অরিন অবাক হয়ে বলল,

>আমার ভাইয়ার বাড়ি জাহান্নাম কেনো হবে? হৈমী ভালো আছে একদম সুস্থ। তাছাড়া ছোট আম্মা ওকে কত আদর করে।

আরাফাত বিস্মিত হয়ে বলল,

> মিথ্যা বলছো তাইনা? কাজীরা মানুষের সঙ্গে স্বার্থ ছাড়া ভালো ব‍্যবহার করে কখনও? ওরাতো ডাকাতের বংশধর। সুস্থ মানুষকে কিভাবে অসুস্থ করতে হয় ভালো জানে।

আরাফাতের চোখেমুখে আগুন।অরিন কিছুটা নিভে গেলো নিজের বংশের উপরে আনা এতবড় অপবাদ শুনে। বাপ চাচা চৌদ্দ গোষ্ঠীর কাউকে আজ অবধি ডাকাতি করতে দেখেনি তবুও কিভাবে ডাকাত হলো কে জানে। অরিনকে এভাবে চুপচাপ দেখে আরাফাত গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> হৈমীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে পারবে, ফোন আছে তোমার?

অরিন ঢোক গিলল ভয়ে। আবির আগেই ওর ফোনটা জব্দ করেছে। বাড়িতে একটামাত্র ফোন, তাও আবার হাতি বাহিনীর প্রধান সেটা আগলে নিয়ে বসে থাকে। আবিরের আছে ফোন আছে কিন্তু সেটা ওর নিজস্ব। বাড়ির লোকজন কেমন শেয়ালের মতো চালাক। অরিন জোর করে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,

> আসলে আমার কাছে কোনো ফোন নেই। ভাইয়া বলেছে সব মিটে গেলে ফোন পেয়ে যাবো। খুব সরি।

আরাফাত ক্ষুব্ধ হলো অরিনের উত্তর শুনে। এই মেয়েটা ওকে কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারবে না এটা ওর আগেই মনে হয়েছিল তবুও একটা আশা ছিল। সেটাও গুড়ে বালি। এলাকায় রফিকের লোকজন দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছে। রাজীব ফোন করে বলেছে। হৈমীকে নিয়ে যত চিন্তা ওদের। মেয়েটাকে হাতে রেখে কোনো অন‍্যায় আবদার না করে বসে। আরাফাতের ধ‍্যান ভাঙলো অরিনের কথা শুনে। মেয়েটা বোকাবোকা মুখ নিয়ে বলল,

> শুনেন,যদি আপনি আমাকে বিয়ে করেন তাহলে কিন্তু আপনার লাভ হবে। এই ধরুন..

অরিন আর বলতে পারলো না।আরাফাত ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো। এত বড় একটা মেয়ের এমন গোলমেলে বুদ্ধি কেনো আরাফাতের মাথায় ধরে না। কাজীদের মাথায় যে গোবর আছে সন্দেহ নেই। আরাফাতের ধমক খেয়ে অরিনের কিছুই অনুভব হলো না। বরং সে চনচল হয়ে বলল,

> আরে বাবা শুনবেন তো আমার বুদ্ধি। তারপর না হয় বকাবকি করবেন। যদি আপনার কাছে আমি চলে যায় তাহলে আমাদের বাড়ির লোকজন বাধ্য হয়ে হৈমীকে আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে চাইবে। তখন আপনার লাভে লাভ। বুদ্ধিটা কেমন?

আরাফাত কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলো,

> তাই বলে বিয়ে? তোমার মতো বুদ্ধিটাও একেবারে পচা।

> ভেবে দেখুন একবার। আমি তো শুধু আপনাকে সাহায্য করতে চেয়েছি যদি পছন্দ না হয় তবে যাচ্ছি। যেচে লোকের ভালো করতে নেই।

অরিন উঠতে গেলো কিন্তু আরাফাত ওকে আটকে দিয়ে বলল,

> আমি রাজি। দ্রুত আমরা বিয়ে করছি। পরের বার দরকারি কাগজপত্র সঙ্গে রাখবে। বাড়িতে ফিরবো।

অরিনের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। শেষমেশ লোকটাকে নিজের করে পাওয়ার একটা সুযোগ পেলো। পরের কথা পরে ভাবা যাবে। তাছাড়া কাজীরা কখনও চাইবে না ওদের মেয়ের সংসার ভাঙুক। বরং সব ঠিকঠাক হওয়ার একটা সুযোগ পাবে। সেদিন কথা শেষ করে আরাফাত বাড়িতে ফিরে আসল। ওদের টেবিল থেকে দূরে একজন বসে ফুলছিল আরাফাত সেটা বুঝতেই পারলো না।
______________________
আবির রাগরাগি করে হাসপাতালে চলে গেছে আর ফিরে আসেনি। তবে হৈমন্তীর মনটা বেশ ফুরফুরে। শাশুড়ির সঙ্গে মিলে আবিরকে টাইট দেওয়ার ভিন্ন ভিন্ন টিপস আবিস্কার করেছে। কান্নার পরেই সুখ আসে কথাটা হাড়ে হাড়ে সত্যি বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধি গুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে সোনার সোহাগা। লোকটা এতোদিন খুব জ্বালাতন করেছে হৈমন্তী এবার প্রতিশোধ নিবে। বিষয়টা ভাবতেই ওর পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। সারাদিন বেশ ভালো কেটেছে।হৈমন্তির কলেজে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি। আবির একগাদা বই পাঠিয়েছে। পরীক্ষা পযর্ন্ত বাড়িতেই পড়তে হবে। আনোয়ার কাজী খুব হম্বিতম্বি করেছে সেই ভয়ে এই ব‍্যবস্থা নেওয়া। আপাতত হৈমন্তীর এসবে কোনো ভাবনা নেই। পড়তে ওর তেমন ভালোলাগেও না। আমেনা বেগমের চক্করে পড়াশোনা করা। সারাদিনের কর্মব্যস্তা শেষে বাড়িতে ফিরলো আবির। হৈমন্তী ডাইনিং রুমে সোফায় পা তুলে টিভি দেখছিল। আবির ওর দিকে একবার তাঁকিয়েও দেখলো না। হৈমন্তী কয়েকবার উঁকিঝুকি কেটে চুপচাপ টিভিতে মনোযোগ দিলো। মহিত ঝগড়ার পর থেকে হৈমন্তীর থেকে দূরে দূরে আছে। আসমা বেগম ওকে হৈমন্তীর কাছে আসার সুযোগ দিচ্ছেন না। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে উনি মেয়েটাকে শান্ত করেছেন। বয়সের স্বল্পতা সেক্ষেত্রে ভুল করা অস্বাভাবিক কিছু না। মানুষের প্ররোচনায় কখন কি করবে তখন সংসারে অশান্তি হবে। আসমা বেগম দক্ষ হাতে সামলে নিয়েছেন। আবির ফ্রেস হয়ে টেবিলে গিয়ে বসে পড়লো খাওয়ার জন্য। আসমা বেগম হৈমন্তী আর অরিনকে ডেকে নিলেন। বাকীরা খেয়ে নিয়েছে। আবিরের আজ বেশ মন খারাপ। কারো সঙ্গেই দরকার ছাড়া কথা বলছে না। হৈমন্তী উশখুশ করে আমেনা বেগমের দিকে তাকালো। আমেনা বেগম চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। হৈমন্তী চুপচাপ খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে ঢুকলো। আবির এখনো রুমে আসেনি। হৈমন্তী অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষমেশ বুকশেলফ থেকে বই ঘাটাঘাটি করতে লাগলো। এক পাশে হুমায়ূন স‍্যারের বেশ কিছু বই রাখা। হৈমন্তী বইগুলো নামাতেই একটা ফাইল উপর থেকে পড়ে গেলো। হৈমন্তী মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় ফাইলটা চোখের সামনে তুলে ধরলো। ফাইলের উপরে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা “অরুনি “। হৈমন্তী ভ্রু কুচকে ফেলল। অরুনির কিসের ফাইল দেখার জন্য পরের পৃষ্ঠা খুলতেই বুঝে গেলো এটা ওর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। চাপা উত্তেজনাই ওর শরীর কাপছে। দ্রুত বিস্তারিত পড়তে গেল তার আগেই ফাইল টা কেউ টেনে কেড়ে নিলো। হৈমন্তী বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরে দেখলো আবির চোখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। ফাইলটা ওই কেড়ে নিয়েছে কিন্তু কেনো? হৈমন্তী ফিসফিস করে বলল,

> নিলেন কেনো? দিন আমি দেখবো।

আবির দ্রুত ফাইলটা আলমারিতে লক করতে করতে বলল,

> বুঝবে না শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে। এসব তোমার কর্ম নয়।

হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> আমি দেখতে চাই। লুকিয়ে কেনো রাখছেন?

হৈমন্তী দ্রুত আলমারির কাছে গিয়ে খুলতে গেলো কিন্তু পারলো না। আবির ওকে দুহাতে আগলে নিয়ে বলল,

> জিদ করোনা। যা হয়ে গেছে তা ঘাটাঘাটি করা ঠিক হবে না। তাছাড়া তুমি দেখে কি করবে? বর রেগে আছে তার রাগ না ভাঙিয়ে ফালতু কাজকর্ম করছো?

কিছু একটা ভেবে হৈমন্তী এবার জোরাজুরি করলো না। চুপচাপ আবিরের দিকে ঘুরে পড়লো। আবিরের দুহাত হৈমন্তীর কোমরে আবদ্ধ ছিল। হৈমন্তী নিজের হাত দুটো দিয়ে আবিরে গলা জড়িয়ে ধরে ওর চোখে চোখ রেখে বলল,

> তাহলে আগে বরের রাগ ভাঙাই কি বলেন?

আবির বুঝতে পারলো না হৈমন্তীর মাথায় কি চলছে। ওর চোখেমুখে বিস্ময়। যে মেয়েটা ওর ধারেকাছে আসতে চাইতো না সেই মেয়েটা আজ নিজে থেকে ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে হজম হলো না। ও ভ্রু কুচকে বলল,

>তুমি ঠিক আছো? জ্বর টর আসেনি তো?

হৈমন্তী পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলল,

> কিছু ঠিক নেই ডাক্তার আমি অসুস্থ। আমার ভীষণ প্রেম প্রেম পাচ্ছে।

কথাটা বলে হৈমন্তী ক্রমশ আবিরের ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যেতেই আবির ঝট করে নিজের থেকে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

> এসব কি হৈমী? তুমি তো ভাবি দুষ্ট হয়ে গেছো। শুনো এসব ভালো লক্ষণ না। পড়াশোনা ফেলে তুমি এসব শিখছো? আজ থেকে আর টেলিভিশন দেখবে না।

হৈমন্তী হাসিটা আরও কিছুটা প্রশস্ত করে বলল,

> আমার কি দোষ বলুন?প্রেম রোগে ধরেছে আপনি তো ডাক্তার ঠিক করে দিন না। প্লিজ।

কথাটা বলে হৈমন্তী আবিরের দিকে এগিয়ে গেলো। ছেলেটা বারবার ঢোক গিলছে। শেষমেশ রুমে টিকতে না পেরে দ্রুতগতিতে পাশের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। হৈমন্তী ওকে এভাবে ভয় পেতে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। লোকটা ভীষণ চালাক। সব সময় ওকে মানিয়ে নিয়েছে ভাব ধরে থাকে। এই হচ্ছে ওর মানিয়ে নেওয়ার ধরণ। বুদ্ধিটা আসমা বেগমের ছিল। উনি ছেলের মতিগতি বুঝেন। মনের মধ্যে একজনকে রেখে হঠাৎ অন‍্য একজনকে হুটকরে মানিয়ে নেওয়া খুব একটা সহজ না।

চলবে

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১০

অমোঘ এক সত্য হৈমন্তীর সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে। মাথায় নানারকম চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশি ভড়কে গেছে অরুণির ছবি দেখে।মেয়েটা দেখতে একদম অরিনের ফটোকপি। মনে হয় ওরা জমজ। হৈমন্তী শুধু মেয়েটার নাম শুনেছিল কখনও স্বচক্ষে দেখা হয়নি। ফাইলের মধ্যে থাকা তৈলচিত্রে প্রাণবন্ত কিশোরীর ওষ্ঠে অমায়িক হাসি। যেই মেয়েটার অস্তিত্ব আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায়। নিঃশব্দে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে নাকি কেউ ষড়যন্ত্র করে ওকে সরিয়ে দিয়েছে ভাবার বিষয়। আচার্যের বিষয় মৃত্যু কালে মেয়েটা প্রেগনেন্ট ছিল কিন্তু কিভাবে সম্ভব?। আরাফাতের সঙ্গে মেয়েটার গভীর সম্পর্ক ছিল। অরিন একবার বললে আরাফাত ওকে নিয়ে চোখের পলকে উধাও হয়ে যেতো।সেখানে মেয়েটা কি এমন দরকারে কিটনাশক খেয়ে মারা যেতে পারে?মেয়েটার এই অবস্থা জন্য কি কোনো রকমে আরাফাত দোষী? ওদের মধ্যে যেহেতু সম্পর্ক ছিল যেহেতু এরকম কিছু হওয়া অসাভাবিক কিছু না। রক্তে মাংসে গড়া মানুষের মধ্যে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে কিন্তু কাজীরা কেমন করে বিষয়টাকে ধামাচাপা দিয়ে দিলো? ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পযর্ন্ত ঘুষ দিয়ে আটকে দিয়েছে। তিল থেকে তাল বানানো কাজীরা এতবড় একটা সুযোগ পেয়েও মির্জাদের বাড়িতে কোনো হামলা করেনি। বরং চুপচাপ মেয়েকে দাফন করেছে। লোকজনকে বলেছে বিয়ে করবে না বল‍ে সুইসাইড করেছে। হৈমন্তীর মাথা ঘুরছে। কাকে বিশ্বাস করবে বুঝতে পারছে না। আরাফাতকে অবিশ্বাস করলে নিজেকে অবিশ্বাস করা হবে। ওকে বিশ্বাস করলে তাহলে আবার আরেক ঝামেলা হবে তা হচ্ছে সামনে থাকা প্রমাণ পত্রটাকে অবিশ্বাস করা হবে। অরুনির মৃত্যু রহস্যের জটিলতায় হৈমন্তী আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। আবির হাসপাতালে যাওয়ার পরে হৈমন্তী কৌশলে ড্রয়ার খুলে রিপোর্ট বের করেছে। চোখের সামনে মেয়েটার মৃত্যুর কারণগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। হৈমন্তী গভীরভাবে ধ‍্যান মগ্ন। নিজের ভাইয়ের নামে বাজে কথা হৈমন্তী কিছুতেই ভাবতে পারছে না। এর পেছনে অন‍্য কোনো রহস্য আছে। কি রহস্য থাকতে পারে বুঝলো না। তবে আবির হয়তো কিছুটা জানতে পারে। হৈমন্তী মনে হাজারো প্রশ্ন। শাশুড়ির কাছে জিঞ্জাসা করা ঠিক হবে কি না চিন্তা করে হৈমন্তী দ্রুত ফাইলটা ড্রয়ারে রেখে বেরিয়ে আসলো। আসমা বেগম যত্ন নিয়ে অরিনের চুলে তেল দিয়ে দিতেছিলেন হঠাৎ হৈমন্তীকে দেখে উনি হেসে বললেন,

> পাশে বস, চুলে আজ সব গুলোরে তেল দিয়ে বেধে দিব। উল্লুখ হয়ে সামনে সামনে ঘুরছিস।

আসমা বেগমের কথা শুনে হৈমন্তী বিনিময়ে হেসে সোফায় বসতে বসতে বলল,

> তেল দিতে হবে না। তুমি আগে বলোতো অরিন আপুর মতো দেখতে কেনো অরুনি আপুকে?

হৈমন্তীর কথা শুনে আসমা বেগম ছলছল চোখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন,

> ওরা জমজ ছিল। অরুনি ছোট থেকে মামার বাড়িতে থেকে মানুষ। পড়াশোনাও সেখানে করতো আর অরুনির বাড়িতে। মেয়েটা বেশ নরম মনের ছিল। সামান্য বকলেও মেয়ের সেকি কান্না। হাতের পুতুলের মতো ছিল। আমি ওকে যত্ন নিয়ে কতরকম রান্না শিখিয়েছিলাম। কি থেকে কি হয়ে গেলো।

হৈমন্তী বিস্মিত হয়ে বলল,

> কি হয়েছিল বলবে? বলো না আম্মা।

আসমা বেগম কিছু একটা ভেবে বললেন,

> মেয়েটা তোমার ভাইয়াকে ভালোবাসতো। তোমাদের বাড়ির অবস্থা খারাপ ছিল না কিন্তু আরাফাত তো বেকার ছিল। অরুনির বাবা চাচার এক কথা মেয়ে কোনো বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে না। ওরা দ্রুত ওর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। কিন্তু মেয়েটা হয়তো সেটা মেনে নিতে পারেনি। তবে তুমি বিশ্বাস করবে না আমরা কিন্তু এটা নিয়ে ওকে কখনও বকাবকি করিনি। ওকে বোঝানো হয়েছে। কি একটা ভয় ওকে জড়িয়ে রেখেছিল। সারাক্ষণ রুমে থাকতো। আরও একটা কথা আমরা জানার আগেই কিন্তু ও তোমার ভাইয়ার সঙ্গে শুনেছি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ছেলেটা পাগলামী করছিল। আমরা ওর পাগলামীর জন‍্যই জেনেছিলাম সবটা।

আসমা বেগম এই পযর্ন্ত এসে থামলো। হৈমন্তী কাছে বিষয়টা গুলিয়ে গেলো। ও ভ্রু কুচকে বলল,

> তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। তুমি বলতে চাইছো যে,অরুনী আপু ভাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল তাই ভাইয়া তোমাদেরকে বিরক্ত করছিল। আর ভাইয়া ভাবছিল তোমাদের চাপে আপু ভাইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করছে না তাই তো?

> হ‍্যাঁ এটাই। আমরা প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। অরুনীর মতো মেয়ে প্রেম করবে বিশ্বাস ছিল না। কথাটা জেনে তখন থেকেই পাত্র দেখা শুরু। অরুনি তোমার ভাইয়ার সামনে আর কখনও যায়নি। ওকে নিয়ে কিছু জিঞ্জাসা করলে চুপচাপ শুনতো। চোখের পানি ফেলতো। আমরা বুঝলাম হয়তো মেয়েটা তোমার ভাইয়ার উপরে রেগে আছে এই সুযোগে বিয়ে দিতে সুবিধা হবে। এখন বুঝি সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।

হৈমন্তী চুপচাপ গোলমেলে কথাগুলো শুনলো। ওর মনে প্রশ্ন জাগলো, আরাফাত ভাইয়া যদি অরুনীর জন্য এতোটা উথলা ছিল তাহলে নিজের বাচ্চার কথা জানলে ওকে কি ওকে ফিরিয়ে দিতো?নাকি ওদের মাঝে কোনো তৃতীয় পক্ষ চলে এসেছিল। হৈমন্তী নিজের মতো করে ঘটনাটা সাজিয়ে ফেলল।। তবুও মন মতো হলো না। রহস্যের অন্তরালের থাকা ঘটনাটা সবার সম্মুখীন হওয়াটা খুব জরুরি। হৈমন্তী সিদ্ধান্ত নিলো রহস্যের সমাধান করবে। অরিনের মন ভয়ানক খারাপ। নিজের বোনের জন্য সেই সঙ্গে আরাফাতের জন্য। ও জানতো না বোন যাকে পছন্দ করতো সেই ছেলেটা আরাফাত ছিল। আগে জানলে হয়তো এতোটা এগিয়ে যেতো না। এখন ফিরে আসা সম্ভব না। লোকটার মনে শুধু ওর বোনের জন্য ভালোবাসা বিরাজ করছে। যদিও ওরা দুবোনের আবয়বের হুবুহু মিল আছে তবুও হৃদয় তো আলাদা। ভালোবাসা চেহারা না মন দিয়ে হয়। অরিনের চোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

________________
বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে রুগী দেখছে আবির। হৈমন্তীর ব‍্যবহারটা হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেছে মানতে পারছে না। মেয়েটার মাথায় এসব উল্টোপাল্টা বুদ্ধি কে দিয়েছে আল্লাহ্ ভালো জানে। আবির একবার ভাবলো ওকে ঘরে বন্দ করে রাখবে কিন্তু মায়ের কথা ভেবে দমে গেলো। হঠাৎ একজনের কথা শুনে ও চমকে উঠলো। সামনে ভাঙা হাত নিয়ে বসে আছে এক যুবক। আরাফাত সৌজন্যতার খাতিরে বলল,

> কেমন আছেন?নাম কি আপনার?

লোকটা লাজুক হেসে বলল,

> লিচু মিয়া।
আবির ভ্রু কুচকে বলল,
>কে রেখেছে আপনার এমন উদ্ভুত টাইপ নাম?

লোকটা আরও একটু খানি হেসে দিয়ে বলল,

> আমরা আম্মা মোছাঃ বেদানা বেগম।

আরাফাত বিরক্তি নিয়ে বলল,

> আশাকরি আপনার বাড়িতে বাকী ফুল ফুলেরা খুব যত্ন সহকারে আছে। যাহোক আপনার অসুবিধা গুলো বলেন।

ছেলেটা বিস্তার বলছিল আর আবির শুনছিল এর মধ্যেই হঠাৎ ওর কেবিনের দরজা খুলে গেলো। আবির বিরক্তি নিয়ে তাঁকিয়ে দেখলো তমালিকা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ঝড়ের গতিতে আবিরকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আবির ওক আটকে দিয়ে বলল,

> কি করছো তমা? আমাকে স্পর্শ করো না প্লিজ।

আবিরের এমন একটা কথা শুনে মেয়েটা হজম করতে পারলো না। এতদিনের সম্পর্ক, যেখানে আবির তমা বলতে পাগল ছিল সেই ছেলেটা কিভাবে ওকে এভাবে ইগনোর করতে পারলো। প্রচণ্ড রাগে ওর শরীর জ্বলে উঠলো। আবির লিচু মিয়াকে ইশারা করে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। লিচু মিয়া যেতেই তমালিকা ঝাঝালো কন্ঠে বলল,

> আমি স্পর্শ করলে তোমার শরীর পচে যাবে নাকি ক্ষয় হয়ে যাবে কোনটা? তুমি এসেছিলে আমার কাছে, আমি কিন্তু না?তাহলে আজ এমন করছো কেনো? দেশে ফিরে একবারও খোঁজ নিয়েছো?

আবির ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কি বলে এই মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিবে ভাবতে পারছে না। তবুও কিছু বলা দরকার ভেবে বলল,

> আমি বিবাহিত তমা। আমি চাইনা তুমি মরিচীকার পেছনে ছুঁটে নিজের জীবনটা এলোমেলো করে ফেলো। ভেবে নাও আমি তোমার ভাগ্যে ছিলাম না। আমার পাজড়ের হাড় দিয়ে অন‍্য নারীকে সৃষ্টিকর্তা বহু আগেই সৃষ্টি করে ফেলেছে। আল্লাল চাইলে তুমি ভালো কাউকে পাবে

আবির কথাগুলো বলতে গিয়ে জড়িয়ে ফেলল। পালিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। তমালিকা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পাত্রী না। হুমকি ধামকি দিয়ে ফিরে গেলো। ও যেতেই আবির হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মেয়েটা য‍দি বাড়িতে গিয়ে হানা দেয় তাই ফোন করে হাতি বাহিনীকে বলে দিল অনুমতি ছাড়া প্রবেশ একদম নিষেধ। তমালিকাও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে যেভাবেই হোক আবিরের বউকে স্বচক্ষে দেখে তবে ছাড়বে। কি এমন সুন্দরীকে পেয়ে আবির ওর মতো মেয়েকে ফিরিয়ে দিল।

(চলবে)