দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব-১৮+১৯

0
353

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৮

হতভম্ব হয়ে সোফায় পা তুলে বসে আছে হৈমন্তী। গতকাল আবির ওর জন্য টকটকে লাল রঙের একটা জামদানি শাড়ি কিনে দিয়েছে। শাড়ির রঙটা একটু বেশিই কটকটে টাইপের। ভেবেছিল ভাইয়ের বিয়ের দিন পরবে কিন্তু রঙ দেখে আর ইচ্ছে করছে না। আমেনা বেগম বোনকে নিয়ে কাজকর্ম করছেন। ছোঁয়া মুখটা মলিন করে হৈমন্তীর থেকে একটু দূরে বসে আছে। মেয়েটার মন খারাপ। হৈমন্তী বুঝতে পারে কিন্তু কিছু করার নেই।তবুও কিছু একটা ভেবে হৈমী ছোঁয়ার পাশে গিয়ে বসতে বসতে বলল,

> আপু তোমার জীবনেও কেউ আসবে দেখো।তোমাকে আগলে নিবে মন খারাপ করোনা। উপর থেকে সব ঠিক করা এখানে তুমি আমি কি করতে পারি বলো? ভাইয়াকে ভূলে যাও। বিয়েটা উপভোগ করো ভালো লাগবে।

ছোঁয়া ভ্রু কুচকে তাঁকালো হৈমন্তীর দিকে। কিছু মানুষের ভাগ্য দেখলে হিংসা এমনি এমনিই হয় হৈমন্তীও তেমনি একজন মানুষ। সব কিছু কিভাবে জানি না চাইতেই পেয়ে যায়। ছোঁয়ার ভালো লাগে না। ভয়ানক খারাপ লাগে হৈমন্তীকে দেখলে। ভেতর থেকে রাগ হয়। ছোঁয়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তবুও মুঠো শক্ত করে বলল,

> তোকে কেউ কখনও প্রপোজ করেছে? তুই কাউকে পছন্দ করেছিস জীবনে?

হৈমন্তী অবাক হয়ে কিছু একটা ভাবলো। আসলেই ওকে কেউ কখনও প্রপোজ করেনি। ওতো দেখতে খারাপ না। মোটামুটি ভালো সুন্দরী বলা যায় তবুও কেউ ওকে কখনও ভালোবাসেনি কেনো? হৈমন্তীকে ভাবতে দেখে ছোঁয়া বলল,

> করেনি তো? অথচ আমার পেছনে ছেলেদের লাইন লেগে থাকে। আমি কাউকে পাত্তা দিই না। তোঁর ভাইকে চেয়েছিলাম ও আমার মর্ম বুঝতে পারেনি। এটা ওর ব‍্যর্থতা আমার না।

ছোঁয়া খুব গর্ব করে কথা গুলো বলে থামলো। হৈমন্তীর গায়ে লেগেছে কথাটা। ওকে কেউ পছন্দ করে না বিষয়টা কেমন জানি লাগলো। হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> ভালোবাসা বুঝি এমন? চেহারা দেখে যদি ভালোবাসা হতো তাহলে এতদিনে তুমি আমার ভাবি হতে।

> তোর ভাই আমার উপযুক্ত না। যে যেমন তাঁর জীবনসঙ্গী তেমনই হবে। আমার জন্য তোর ভাইয়ের থেকেও বেটার কেউ অপেক্ষা করছে।

হৈমন্তী মলিন হেসে বলল,

> নিশ্চয়ই কেনো না? তবে আমার এই মূহুর্তে একটা কথা বলতে খুব মন চাইছে। কথায় বলে,আঙুর ফল টক। আসছি আমি।

হৈমন্তী এক মূহুর্তেও অপেক্ষা করলো না। দ্রুতগতিতে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করলো। ছোঁয়া রাগে ফুলছে। হৈমন্তী রুমে এসে কানে হাত দিয়ে বিড়বিড় করলো জীবনে আর এই মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে যাবে না। অহংকারী মেয়ে একটা। কিছুতেই ছোট হবে না। এই মেয়েটা যদি ভাবি হয়ে আসতো হৈমন্তী গৃহত‍্যাগ করতো। কথাটা ভেবে ও ঠাস করে বিছানায় বসে পড়লো।
☆☆
চুপচাপ জানালায় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে অরিন। আরাফাতের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা একদম ঠিক নেই।। ছেলেটা ওর ভয়ে বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছে। সারাদিন কাজকর্ম করছে।অনেক রাতে এসে চুপচাপ ঘুমিয়ে যায়। অরিন কষ্ট পাচ্ছে। লোকটাকে পেয়েছে না পাওয়ায়। এমন পাওয়ার খুব কি দরকার ছিল? অরিন ফুপিয়ে উঠলো। হৈমন্তী ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়টা খেয়াল করেনি। ওর শরীর মৃদু মৃদু কাপছে। হৈমন্তী গিয়ে অরিনের কাঁধে হাত দিতেই মেয়েটা চমকে উঠে পিছিয়ে গেলো। হৈমন্তী ব‍্যস্ত হয়ে বলল,

> ভাবি আমি। তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো?

অরিন পেছন তাকিয়ে হৈমন্তীকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো পা। শব্দ করে কেঁদে উঠে বলল,

> তোমার ভাইয়ের জীবনে আমি অযাচিতভাবে চলে এসেছি। ও আমাকে ভালোবাসে না হৈমী। আমি কষ্ট পাচ্ছি। ভাইয়াকে বলবে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।

হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> বিনা যুদ্ধে হারমানবে? আমার কথামতো চলবে দেখবে ভাই তোমাকে চোখে হারাচ্ছে। শুনবে আমার কথা?

অরিন আশার আলো দেখতে পেলো। চোখ মুছে ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

> তুমি আমাকে সাহায্য করবে?

> নিশ্চয়ই করবো। তোমার ভাবি আমি। তোমাদের বাড়িতে দুদিন পরে সংসার করতে যাবো। ছোট হতে পারি দায়িত্বটা কি ছোট নাকি?

অরিন ওষ্ঠে হাসি নিয়ে বলল,

> বলো তোমার বুদ্ধি।

অরিন ফিসফিস করে ওর কানে কানে কয়েকটা কথা বলে দিলো। অরিন মুখটা কালো করে ফেলল। এসব ওকে দিয়ে হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও চেষ্টা করতে হবে। বরকে নিজের আচলে বাঁধতে স্ত্রীরা সব করতে পারে। তাঁর কাছে এটাতো সামান্য। হৈমন্তী ওর সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে বেরিয়ে আসলো।
☆☆☆
কাজীদের বাড়িতে ভয়ানক ‍এক কাণ্ড ঘটে গেছে। মহিত নিখোঁজ। রাসেলকে আনতে থানায় গিয়েছিল তারপর থেকে নিখোঁজ হয়েছে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দেলোয়ার কাজী রফিকের থেকে সবটা শুনেছে তারপর আর থানায় যাওয়ার সাহস পাইনি। মেয়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠেছিলেন সেটা নতুন করে আবারও আঘাত করেছে। গোলনাহার বানু নাতনিকে খুব ভালোবাসতেন। ওর মৃত্যু উনি মেনে নিতে পারেননি তাই হৈমন্তীকে মারার জন্য উনি মুখিয়ে ছিলেন। এখন সবটা জানার পরে উনি চুপচাপ বসে আছেন। মেয়েকে উনার কালসাপ মনে হচ্ছে। সারাজীবন উনার কানে বিষ ঢেলে গেছে। বিনিময়ে উনি লক্ষ লক্ষ টাকা মেয়ের পেছন খরচ করেছেন। সেই মেয়ের ছেলের দ্বারা নিজের নাতনির অসম্মান হয়েছে বিষয়টা কতটা জঘণ্য উনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা অনুভব হচ্ছে। মেয়েটা কতটা কষ্ট পেয়েছিল সে আল্লাহ্ ভালো জানে। উনারা আশেপাশে ছিলেন তবুও কিছু করতে পারেননি। মনে হলেই রাসেলকে খুন করতে মন চাইছে। উনি থম মেরে বসে আছেন। জুলেখা কাজী মায়ের হাতটা ধরে ছলছল চোখে বললেন,

> মা তুমি বিশ্বাস করো রাসেল এমন জঘন্য কাজটা করতে পারে? ওরা মিথ্যা বলছে। আমার ছেলে এমন কাজ করতেই পারে না।

গোলনাহার বানু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

> মিথ্যা হলে আমার চাইতে খুশি কেউ হতো না। তুই এবার বাড়িতে ফিরে যা। শশুর বাড়িতে গিয়ে ভালো করে সংসার কর। ভাইদের কাছে অনেক তো থাকলি। বিনিময়ে ভাইদের কলিজা ধরে টান দিয়েছিস। সবটা জানতি তুই তাইনা?

মায়ের কথা শুনে জুলেখা কাজি কেঁপে উঠলেন। সত্যিই উনি জানতেন তবে আগে না। ঘটনার পরে সবটা জেনেছেন তখন হাতের বাইরে সব। কিভাবে সবাইকে বলতেন উনার ছেলের দ্বারা উনার ভাইজির সম্ভ্রমহানি হয়েছে। লজ্জা সেই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধবোধে উনি জর্জরিত। না উনি পারতেন না। উনাকে চুপচাপ দেখে গোলনাহার বানু ফিসফিস করে বললেন,

> গতকাল রাতেও মেয়েটাকে স্বপ্নে দেখলাম। কি পবিত্র ওর মুখটা। তোরা অপবিত্র করে দিলি? আমার সব টাকা পয়সা জমিগুলো নিয়েও যদি ওকে ছেড়ে দিতি। কেনো করলি এমন? এইটুকু ছিল,আমি এই দুহাতে মানুষ করেছিলাম। বড় হয়েও আমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতো না। দাদিজানের হাতে খেতে ভালোবাসতো। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার হাতে খাওয়া বন্ধ করে দিলো। আমি তো বুঝতে পারিনি। যেই মেয়ে আমাকে জড়িয়ে ছাড়া ঘুমাতে পারতো না সেই হঠাৎ আমার ছোঁয়া সহ‍্য করতে পারছিল না। ভয় পেতো বলতো ওকে না ধরতে। দূরে দূরে থাকতো। আমি ভাবলাম খারাপ জ্বীনের দৃষ্টি পড়েছে তাই এমন করছে। সত্যিই নজর পড়েছিল। কেনো করল তোর ছেলে এমন? ফিরিয়ে দে আমার মেয়েটাকে।

খোলনাহার বানুর প্রতিটা কথায় জুলেখা কাজী কেঁপে কেঁপে উঠলো। কথার উত্তর দিতে ভূলে গেলেন। কিভাবে এই বাড়িতে থাকবেন বুঝতে পারছেন না। লজ্জা আর অপরাধবোধ উনাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। ছেলেকে হাতে পেলে খুন করে ফেলতেন। নিজের সঙ্গে মায়ের মুখটা পুড়িয়ে দিলো। ছেলেমেয়ে ভালো কাজ করলে বাবা মায়ের অহংকার হয়। আবার খারাপ কাজ করলে হয় লজ্জা। এই লজ্জা উনি কোথায় লুকাবেন বুঝতেই পারলেন না। জীবনে প্রথমবার মনে হচ্ছে যদি বাজা হতেন। ছেলেমেয়ে না থাকতো কতো ভালোই না হতো। গোলনাহার বানুর চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে তবুও চিৎকার করতে পারছেন না। এক সন্তানের জন্য আরেক সন্তানের দুঃখ উনি কিভাবে মানবেন বুঝতে পারছেন না। উনি বেশিক্ষণ চুপচাপ থাকতে পারলেন না। হাত পা থরথর করে কেঁপে বিছানায় লুটিয়ে পড়ছেন। মায়ের এমন অবস্থা দেখে জুলেখা কাজী চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে সবাই চলে আসলো। আবির খাবার টেবিলে বসে ছিল। ও দ্রুত গিয়ে দাদিকে কোলে তুলে নিলো। বাইরে বের করতে বেশ বেগ পেতে হলো কিন্তু ও থামলো না। একবারে গাড়িতে গিয়ে উঠালো। ফোন করে হাসপাতালে বলে দিল ওষুধ রেডি করতে। দাদিজানের হার্ট এটাক হয়েছে। বাড়ির লোকজন ছুটলো মায়ের পিছু পিছু। মির্জা বাড়িতে বিয়ের আয়োজন চলছে। আগামীকাল থেকে গায়ে হলুদ হবে। রফিক ওই বাড়িতে গিয়ে উঠেছে ফিরছে না। ছেলেটা আনন্দপ্রিয় মানুষ। গান বাজনা হৈচৈ পেয়ে বাড়ির কথা ভূলে গেছে। তাছাড়া আরাফাতের সঙ্গে ওর চমৎকার একটা সম্পর্ক হয়েছে। গলাই গলাই ভাব।
☆☆
সারারাত জমে মানুষে টানাটানির পরে শেষ রাতে গোলনাহার বানুর শরীর ঠিক হলো। সারারাত আবির দাদিজানের পাশে বসে আছে। বাইরে বাড়ির বড়রা এসেছে। সবার চোখে পানি।। এতদিন মির্জাদের উপরে দোষারোপ করে আসছে কখনও ভাবতে পারেনি ওদের মধ্যেই শয়তান লুকিয়ে আছে। পরের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেওয়া গেলেও আপনজনের দ্বারা ক্ষতি মেনে নেওয়া যায় না। দেলোয়ার কাজী বাকশূন‍্য হয়ে বসে আছে। আনোয়ার কাজী ভাইয়ের পাশে বিভিন্ন রকম কথাবার্তা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আসমা বেগম অরিনের মায়ের সঙ্গে আছেন। মোটামুটি কাউকে একা রাখা হচ্ছে না। বিপদের সময় সঙ্গ না দিলে এমন আত্মীয় থাকার চাইতে না থাকাই ভালো। হৈমন্তী অনেকবার আবিরকে ফোন করেছিল কিন্তু ছেলেটা ফোন উঠানোর সময় পেলে না। হৈমন্তী রাগ করেছে। তবুও বেশ টেনশন হচ্ছে। গতকালের ঘটনা নিয়ে এখনো চুড়ান্ত কিছু শুনতে পেলো না। ও রফিকেকে কিছু বলবে কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে। হাজার হোক এক সময় ছেলেটার সঙ্গে ওর বিয়ের কথা চলছিল। হঠাৎ গায়েব না হলে হয়তো বিয়েও হতো। তাছাড়া হৈমন্তীর কখনও বাইরের লোকজনের সঙ্গে তেমন মেলামেশা হয়নি। আমেনা বেগম মেয়েকে পুতুলের মতো গড়ে তুলেছেন। পুরুষ মানুষের আশেপাশে ঘেঁষতেও দেননি। মেয়েও মায়ের ভয়ে এসব এড়িয়ে চলেছে। ছোঁয়া যেমন বলেছিল তেমন না।হৈমন্তীকে কেউ প্রেম নিবেদনের সুযোগ পাইনি তাই করেনি। তাছাড়া মির্জা বাড়ির বড়বড় তিনটা ছেলে থাকতে তাদের বোনকে প্রেম নিবেদন করবে এমন সাহস মফস্বলে কারো ছিল না। পুতুলের মতো মেয়েটা সকলের স্নেহের। তার দিকে বাজে নজর আসবেই কিভাবে। আমেনা বেগমের বাড়াবাড়ি রকমের ভাবসাব আত্মীয়স্বজনের জানা আছে। কেউ ইচ্ছে করলেও অন্দরমহলে যেতে চাইতোও না। ফলাফল হিসেবে হৈমন্তী ঘরকুনো টাইপের হয়ে গেছে।

_______________
মির্জা বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আবির। দাদিজানের শরীর মোটামুটি ঠিক হতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। একটু ঘুমের দরকার ছিল কিন্তু বাড়িতে যেতে মন চাইছে না। হৈমন্তীকে খুব করে দেখতে মন চাইছে। ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখা যেতো কিন্তু রাখতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া মেয়েটা বেশ কয়েকবার ফোন করেছে। হয়তো রাগ করে আছে। আবির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার ফোন দিলো কিন্তু মেয়েটা ফোন তুললো না। আটবারের মাথায় ঘুমঘুম কন্ঠে হৈমী ফোন তুলল। আবির ভনিতা ছাড়াই বলে উঠলো,

> হৈমী ভীষণ ক্লান্ত আমি। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি দ্রুত নিচে আসো। বউয়ের মুখ দেখে ফিরবো।

হৈমন্তী দ্রুত বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ও আর অপেক্ষা করলো না ফোনটা রেখে পা বাড়ালো বাইরের দিকে। ডাইনিং রুমে লাল নীল আলো জ্বলছে। কেউ জেগে নেই। ঘুমিয়ে আছে। হৈমন্তী পা টিপে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো। গেটের কাছে দারোয়ান চাচা ঘুমিয়ে আছে। হৈমন্তী সোজা আবিরের সামনে দাঁড়াতেই আবির ওকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে নিজেও গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো। হৈমন্তী চোখ বড়বড় করে বলল,

> কোথায় যাচ্ছি আমরা?
আবির ড্রাইভিং করতে করতে বলল,

> প্রেম করতে।
হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> মজা করছেন তাই না? কতবার ফোন করেছি ধরলেন না কেনো? জানেন কতটা টেনশনে ছিলাম?

> দাদিজান অসুস্থ হৈমী। সারারাত উনার সঙ্গে ছিলাম। যাবে একবার দেখতে? অরিনকে নিতে চাইছি না। হঠাৎ ওকে দেখলে আবার উত্তেজিত হয়ে পড়বে। ভয় পাচ্ছি অনেক।

হৈমন্তী আবিরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। লোকটা ডাক্তার তবুও ভয় পাচ্ছে শুনে কেমন জানি লাগলো। ধরা গলাই বলল,

> বাঁচবেন তো?
আবির গাড়ি থামিয়ে বলল,

> বুঝতে পারছি না। রিপোর্ট সকালে পাওয়া যাবে। অরুনীকে দাদিজান খুব ভালোবাসতেন হৈমী। উনি মানতে পারছেন না। চাচা চাচির মুখের দিকে তাঁকানো যাচ্ছে না। আমার ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যেতে। কারো জন্য কিছু করতে পারছি না। কি যে যন্ত্রণা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। খুব করে ঘুমানোর দরকার তবুও তোমাকে নিয়ে চলে আসছি। জানিনা কোথায় যাচ্ছি।

হৈমন্তী কিছু ভেবে নিয়ে বলল,

> গাড়ি ঘুরান আর বাড়িতে চলুন। সকালবেলায় আপনার সঙ্গে হাসপাতালে যাবো। আপনার ঘুমানোর দরকার।

আবির যেতে চাইলো না কিন্তু হৈমন্তী শুনলো না। নাছোড়বান্দা হয়ে ওকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসলো। ওকে নিজের রুমে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করে রুমে এনে ওকে খেতে দিলো। আবির চুপচাপ খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। হৈমন্তী থালাবাসন রেখে এসে দেখলো আবির ঘুমিয়ে বিভোর। তাই ওকে আর ডাকলো না। চুপচাপ শুয়ে পড়লো।

চলবে

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৯

গোলনাহার বানুর হাত ধরে বসে আছে আরাফাত। অক্সিজেন দেওয়া আছে তবুও ভদ্রমহিলা ওর হাত ছাড়ছে না। আবির আর হৈমন্তী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সকালে ভদ্রমহিলার অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। বারবার আরাফাতকে দেখতে চেয়েছিল তাই বাধ্য হয়ে আবির ওদের দুজনকে নিয়ে এসেছে। মোটামুটি ঝগড়া ঝামেলার অবসান ঘটেছে। রাজীব আসতে চেয়েছিল কিন্তু বিশেষ কাজ থাকার জন্য আসেনি। সময় করে আসবে। আরাফাত আসতে চাইছিল না হৈমন্তী বুঝিয়ে এনেছে। আসার পর থেকেই গোলনাহার বানু ওর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে কান্নাকাটি করছে। বারবার ক্ষমা চাইছে। মহিতের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার মধ্যেই আবার আরেক ঝামেলা এসে হাজির হয়েছে। জেলের মধ্যে রাসেল ভুলভাল বকছে। হয়তো মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। সারাদিন ঘুম খাওয়া বন্ধ করে অরনীর নাম জপে যাচ্ছে। ক্ষমা চাইছে।কখনও আবার নিজের চুল নিজেই ছিড়ছে। থানা থেকে পুলিশ ফোন করেছিল ওকে ডাক্তার দেখানোর জন্য আবেদন করতে। কিন্তু কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। জুলেখা কাজী দুই ছেলের শোকে পাথর তারপর আবার মায়ের এই অবস্থা সব মিলিয়ে উনি ঘর বন্দি জীবনযাপন করছেন। খাওয়া দাওয়া বন্ধ । হৈমন্তী চুপচাপ দাদি শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আবির ওর পাশেই আছে। হৈমী ফিসফিস করে আবিরকে বলল,

> রাসেল ভাইয়ার খোঁজ নিয়েছেন?

> প্রয়োজন নেই। যা করেছে এটাই ওর শাস্তি।

> আপনি জানতেন কিভাবে রাসেল ভাইয়া এসবের পেছনে আছে? একটু বলুন না শুনি।

>বাইরে চলো বলছি।

আবির হৈমন্তীর হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসলো। হৈমন্তী অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবটা শোনার জন্য। আবির ওকে নিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসতে বসতে বলল,
> অরুনীর মৃত্যুর দিন হঠাৎ করেই রাসেল গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। মাথায় ছিল না। আমি সন্দেহভাজন সবাইকে টেস্ট করেছি শুধুমাত্র ওকে ছাড়া। তারপর থেকে আমি বাড়ির সবাইকে প্রশ্ন করে জেনেছি ও সব সময় আমাদের বাড়িতে থাকতো। অরুনীর কাছাকাছি থাকতে দাদিজানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরী করে। প্রথমে সন্দেহ না হলেও পরে আমি সন্দেহ করি। তারপর ও যখন বাড়িতে ফিরলো টেস্ট করে জেনে গেলাম। যতটা সহজে বলছি এতটা সহজ ছিল না। অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। তাছাড়া মহিতের বিষয়ে আমি বেশ চিন্তিত। তোমাকে বলা হয়নি ওই ছেলেটার মাথার উপরেও ঝামেলা ঘুরছে। কয়েকদিন আগে একটা মেয়ের বডি পেয়েছে পুলিশ। মেয়েটাকে ওরা বন্ধুরা মিলে খুন করেছে। সেসব পুলিশের কাছে সাক্ষ্য প্রমাণ সহ জমা আছে।
হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> বিপদ জেনে ওকি পালিয়েছে? কোথায় যেতে পারে?

> আমি জানিনা কোথায় আছে। হয়তো পালিয়েছে নয়তো পুলিশের হাতে জিম্মি। যাইহোক ফুপির জন্য কষ্ট হচ্ছে। বেচারী তো বুঝতেই পারেনি নিজের ছেলের এই কর্মকাণ্ড।

> মহিত ভাইয়ার বিষয়ে কিভাবে জেনেছেন?

> রিপোর্ট তৈরী আমি করেছি। পুলিশের সঙ্গে এই বিষয়ে আমার কথাবার্তা হয়েছে। একটার পরে একটা খারাপ খবর আসছে। কিভাবে যে সবাইকে শক্ত রাখবো বুঝতে পারছি না। আর রফিক তোমাদের ওখানে বসে মজা নিচ্ছে। ছেলেটা এমন ছন্নছাড়া কিভাবে হলো কে জানে। আমাদের বংশে ওরকম মাথামোটা আর একটাও নেই। মাধ্যমিক ফেল শুধু একবার না। তিনবার পরীক্ষা দিয়েছে কোনো ফল হয়নি। এখন বখাটে ছেলেদের নিয়ে রাজনীতিতে নেমেছে। মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ভাবছি ভাইয়ার কাছে পাঠিয়ে দিব। কয়েক বছর বাইরে থাকলে যদি একটু মানুষ হয়।

আবির একদমে কথাগুলো বলে থামলো। হৈমন্তী মনোযোগ সহকারে শুনলো। লোকটা সবাইকে নিয়ে চিন্তা করে বিষয়টা ওর বেশ ভালো লাগলো। হৈমন্তীর হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই ও ভ্রু কুচকে বলল,

> আচ্ছা বিয়ের আগের দিন রাতে রফিক ভাইয়াকে কে আটকে রেখেছিল সে খবর কি পাওয়া গেছে? কে করতে পারে এমন শত্রুতা?

আবির এবার নড়েচড়ে বসলো। ওর কপালে দুটো ভাজ পড়েছে হৈমন্তীর কথা শুনে। মেয়েটা কখন কি বলতে হয় জানেনা। আবিরকে চুপচাপ দেখে হৈমন্তী আবারও প্রশ্ন করলো। আবির এবার ভ্রু কচকে বলল,

> আফসোস হচ্ছে রফিকের জন্য? আহারে মাধ্যমিক ফেল মাজাই হাতছাড়া হলো।

হৈমন্তী ঠোঁট গোল করে বলল,

> বললাম কি আর উত্তর ‍দিচ্ছেন কি? সব কিছু সামনে আসছে তাই ভাবলাম এটাও সামনে আসবে। আফসোস তো প্রতিনিয়ত হচ্ছে। হিটলারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কপালে এই ছিল।

আবির ক্ষুব্ধ হলো হৈমন্তীর কথা শুনে। মেয়েটা আফসোস করছে কতবড় সাহস। ও হাতের মুঠো শক্ত করে হৈমন্তীর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,

> সামনে বর বসে আছে তার দিকে মন দাও। আজেবাজে চিন্তা করলে পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো। ফাজিল মেয়ে,বরবের মাথা খারাপ করার চিন্তা করছো।

আবিরের ধমক শুনে হৈমন্তীর রাগ হলো। সাধারণ একটা কথা জিঙ্গাসা করেছে। এভাবে রিয়েক্ট করার কি আছে ও বুঝতে পারছে না। হৈমন্তী মুখ ভার করে উঠে আসতে গেলো কিন্তু পারলো না। আবির পেছনে থেকে আলগোছে ওর হাতটা ধরে নিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে টেনে নিয়ে বলল,

> সরি রে বাবা, এমন আর হবে না। কিছু বিষয় না জানলেই ভালো হয়। তবুও যখন বলছো একদিন বলবো কিন্তু এখন না প্লিজ। আর রফিকের সঙ্গে একদম কথাবার্তা বলবে না। দেবরের সঙ্গে আলাপচারিতার কোনো দরকার নেই। তুমি শুধু বরের সঙ্গে কথা বলবে। যখন দরকার হবে ফোন করবে। আমি দ্রুত তোমাকে বাড়িতে নিয়ে আসবো।
হৈমন্তী মুখ ভেঙচি দিয়ে আবিরকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,

>মনে হচ্ছে পৃথিবীতে বউ আপনার একার আছে। ঢঙ দেখলে বাঁচি না। লজ্জা শরমের মাথা আগেই খেয়ে ফেলেছেন।

> রঙ ঢঙ না করে যে উপাই নেই। একটামাত্র বউ আমার যদি পালিয়ে যায় কি হবে আমার? কাজী বাড়ির ছেলে আমি। বাবা জীবন থাকতে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিবেন না।

হৈমন্তী মলিন মুখে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

> ধাপে চাপে মানিয়ে নিয়ে সংসার করে কাজ নেই। যদি ভালোবেসে বলেন তবেই আপনার সঙ্গে থাকবো তার আগে না। এমনিতেই ছোঁয়া আপু বলেছে আমাকে কেউ কখনও প্রপোজ করেনি,ভালোবাসার কথা বলেনি। আমি কারো যোগ্য না।

হৈমন্তীর কথা শুনে আবির ভ্রু কুচকে বলল,

> তোমার খালামনির মেয়েটা আস্তো পাজি। তুমি ওর আশেপাশেও থাকবে না। আমার বউকে ভুলভাল বুঝিয়েছে। ওকি জানে আমার বউ কতটা লক্ষ্মী।

হৈমন্তী উত্তর দিতে গেলো কিন্তু পারলো না। আরাফাত ফোন দিচ্ছে এখুনি যেতে হবে। হৈমন্তী আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত আবিরের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
______________________
হালকা গোলাপি রঙের শাড়িতে নিজেকে দারুণভাবে সাজিয়ে নিয়েছে অরিন। যদিও শাড়ি পরতে চয়নিকা ওকে সাহায্য করেছে। মেয়েটা এমনিতেই সুন্দরী তারপর আবার শাড়ি পরেছে আরও সুন্দর লাগছে। আজ মাসুদের গায়েহলুদ। হৈমন্তী হলুদ রঙের গাউন পরেছে। মুখে তেমন প্রসাধনী নেই। হালকা সাজে ওকে বেশ লাগছে। অরিন চড়া করে ওষ্ঠে লিপস্টিক দিয়েছে। হৈমন্তী দেখলো আর মিষ্টি করে হাসলো। পরিচিত অপরিচিত অনেকেই এসেছে গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে। মেয়েটা ঘুরঘুর করে একাজ ও কাজ করছে। আরাফাত বাঁকা চোখে দেখছে। মেয়েটার মতিগতি ওর সুবিধার লাগছে না। কি করতে চাইছে বোঝার চেষ্টা করছে। আমেনা বেগমের একটা আত্মীর ছেলে তমাল এসেছে সেই ছেলেটা জুটেছে অরিনের সঙ্গে। আঠার মতো চিপকে থাকার চেষ্টা করছে। মেয়েটাও পাত্তা দিচ্ছে। হেঁসে হেঁসে কথাবার্তা বলছে । এটা দেখেই রাগে বোম হচ্ছে আরাফাত। ওদের বাড়ির মেয়ে বউরা বাইরের লোকদের সঙ্গে এভাবে কথাবার্তা বলে না। আরাফাত ওর আশেপাশে থাকার চেষ্টা করছে। অরিন দেখতে কিন্তু প্রতিক্রিয়া করছে না। নিজের মতোই আছে। গায়ে হলুদের মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে তমাল অরিনকে বলল,
> সেলফি তুলবেন আমার সঙ্গে?
অরিন মিষ্টি হেসে মাথা নাড়িয়ে সাড়া দিতেই ছেলেটা ফোন বের করে যেই ক‍্যামেরা অপেন করলো তখনই আরাফাত এসে হাজির। দুজনে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে অরিনর কানে ফিসফিস করে বলল,

> আম্মা দেখলে কিন্তু আস্ত রাখবে না। কি সব বাচ্চাদের মতো কাজকর্ম করছো?

অরিন সরল মুখ করে বলল;

> কি করেছি আমি? তমাল বলল একটা সেলফি উঠবে আমার সঙ্গে। আসলে আমাকে খুব সুন্দরী লাগছে কিনা।

অরিনের বোকাবোকা কথা শুনে আরাফাত ওর পা থেকে মাথা পযর্ন্ত চোখ বুলিয়ে বলল,
> কে বলেছে তোমাকে এসব আজগুবি কথাবার্তা? আয়না দেখেছো একবার? পেত্নীর মতো ভয়ংকর লাগছে। যাও চেঞ্জ করে ড্রেস পরে আসো। যতসব পাগলের কারখানা।

আরাফাত ভয়ংকর ভাবে মুখ বেঁকিয়ে কথাগুলো বলে চলে গেলো। ও যেতেই অরিনের চোখ ফেঁটে পানি এলো। এতো যত্ন নিয়ে নিজকে সাজিয়ে তুলল আর আরাফাত ওকে পেত্নী বলল অরিন মানতে পারছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। প্রিয়জনের থেকে প্রশংসা শুনতে কার না ভালোলাগে কিন্তু যদি সে প্রশংসার বদলে এমন খারাপ কথা বলে তখন তার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে। অরিন কোনো সান্ত্বনা পেলো না। ওর মনে হলো অরুণীর মতো নিজেকে শেষ করে দিতে। বেঁচে থেকে লাভের লাভ তো কিছুই হচ্ছে না। বেঁচে থাকতে কদর না কারলেও মারা যাওয়ার পরে ঠিকই কদর বাড়বে। কথাটা ভেবে ও এক দৌড়ে রুমে গিয়ে গায়ের শাড়িটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। একে একে গায়ের গহনাও ফেলে দিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

চলবে