#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৯
অষ্ট্রেলিয়া আগমনের চতুর্থ দিন হৈমন্তীর মন মেজাজ নিজের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ঝামেলা মুক্ত লাগছে।সারারাত ভালো ঘুম হয়েছে।তাই ভোরবেলা বাইরে বের হয়েছে সম্পূর্ণ একা।অযথা টেনশন নেই। আরেকটা সুবিধা হয়েছে একাকিত্ব ওকে ঘিরে ধরছে না বললেই চলে।তবে একা না থাকলে হৃদয়ের অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় ঘটেনা। জুলি আর নায়রা ওকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে বিষয়টা মন্দ না তবে হৈমন্তীর কাছে মাঝেমধ্যে বিরক্তিকর লেগেছে। এখানে এসে জীবনে প্রথমবার মুক্তির স্বাদ নিতে পেরেছে বলা যায়। বাংলাদেশ থাকতে কখনও এভাবে ঘোরাঘুরি বা বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়নি। শপিং বা স্কুল কলেজ সব সময় পাশে পরিবারের লোকজন গার্ডের মতো থেকেছে। কিন্তু এখানে ওরকম কেউ নেই। জুলির বিস্তর বন্ধু আছে যারা ভ্রমণপিপাসু। হৈমন্তীর সঙ্গে সকলের পরিচয় হয়েছে। ওরা কথা দিয়েছে হৈমন্তীকে পুরো ক্যানবেরি ঘুরে দেখাবে। দরকার হলে সিডনিতেও যাবে। অষ্ট্রেলিয়ার চমৎকার চমৎকার ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোতে ওকে নিয়ে যাবে। হৈমন্তী বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানা পযর্ন্ত না দেখা মেয়ে। যার গণ্ডি ঘর আর বিদ্যালয় পযর্ন্ত সীমাবদ্ধ ছিল হঠাৎ এখানে এসে সত্যিই ওর চোখমুখের রঙ পাল্টে গেছে। সমুদ্র আর চুনাপাথর নদী ওকে টানছে। এতোটা আনন্দের পেছনে আরও একটা কারণ আছে। দীর্ঘ টেনশনে পরে একটা নিউজ শুনে ও কিছুটা রিলিফ পেয়েছে। আবির জেলের বাইরে কথাটা শুনেই মন শান্ত। কোথায় আছে এটা জানে না তবে বাইরে আছে মোটামুটি সুস্থ এর থেকে ভালো খবর ওর কাছে আপাতত নেই। লোকটাকে ঘিরে ওর সকল ভালোলাগা ভালোবাসা। অনুভূতিটা কাউকে বোঝাতে পারবে না। হৈমন্তীর ধ্যান ভাঙলো জুলির ডাক শুনে। হৈমন্তীর বিরক্ত লাগলো তবুও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। চেয়েছিল একা নির্জনে একটু হাটতে। গতকাল সারাদিন জুলি আর নায়রার সঙ্গে শপিংমলে ঘুরতে হয়েছে। রাতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে গেছে আবিরকে নিয়ে ভাবা হয়নি। লোকটাকে নিয়ে ভাবতে ওর ভালো লাগে। মনে হয় আশেপাশে আছে ওকে ছুয়ে দিচ্ছে। তাই ভোরবেলা কাউকে কিছু না বলে বের হয়েছে। ঢাকা শহরের মতো এই শহরের জনসংখ্যা ওরকম গিজগিজে নয়। এটাই হৈমন্তীর কাছে সবথেকে শান্তির। জুলি দৌড়ে এসে হৈমন্তীর সামনে দাঁড়িয়ে হাপাতে হাপাতে বলল,
> পিচ্চি কোথায় যাচ্ছো? একা হারিয়ে যাবে।
হৈমন্তীর জোর করে হেসে বলল,
> কোথাও যাচ্ছি না আপু। হাটতে ইচ্ছা করছিল তাই এসেছি।
> একদম ঠিক করোনি। আমাদের ছোট একটা বাগান আছে তুমি যাবে সেখানে? আমি ফুল পছন্দ করি। টিউলিপ ফুলে বাগান ভর্তি।
হৈমন্তী আগ্রহ নিয়ে বলল,
> নিশ্চয়ই যাবো।
> তাহলে ফিরে এসো।
হৈমন্তী বাধ্য হয়ে ফিরে আসলো। জুলির সঙ্গে বাগানে এসে সত্যিই ওর মন আরও ভালো হয়ে গেলো। চারদিকে অসংখ্য ফুল ফুটে আছে। নানা রঙের ফুল। হৈমন্তী ঘুরে ঘুরে দেখলো। ফোনটা আনলে হয়তো দুটো ছবি নেওয়া যেতো। বাড়ির পেছনে এতো সুন্দর একটা বাগান হৈমন্তীর চোখে আগে কেনো পড়েনি বুঝতে পারলো না। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে সকাল সন্ধ্যায় বসে থাকবে। গাছগুলো জুলি নিজেই যত্ন করে। আবেদা মির্জাও ওকে সাহায্য করে। নায়রা অলস প্রকৃতির মেয়ে। ওর ঘুম থেকে উঠে অনেক লেট হয়। আর রোহান বাড়িতে কখন আসে কখন যায় কেউ বলতে পারে না। হৈমন্তীর কাছে এটা ভালো খবর। ছেলেটা ওকে খোচা দিয়ে অপমান করার চেষ্টা করে। হৈমন্তী ওর চক্ষুশূল বলা যায়। জুলি ওকে ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। হঠাৎ সেখানে রোহানের আগমন। ছেলেটা দৌড়ে এসে হুটকরে হৈমন্তীর নাক ধরে টেনে দিয়ে বলল,
> সব সময় ভ্রু কুচকে থাকো কেনো মেয়ে? পৃথিবীর সবাইকে বিরক্ত লাগে?
হৈমন্তীর নাক বেশ ব্যাথা করছে । লোকটার কোনো আক্কেল নেই। একটা মেয়ের অনুমতি ছাড়া তাকে স্পর্শ করে আবার দাঁত বের করে হাসছে। হৈমন্তীর সহ্য হলো না। বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,
> আপনি কেনো আমাকে বিরক্ত করছেন?
হৈমন্তীর কঠিন করে রাখা মুখের দিকে তাঁকিয়ে ছেলেটা থতমত খেয়ে গেলো। ও যে রেগে গেছে বুঝতে পেরে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
> বাহ পিচ্চি দেখি আবার রাগতেও পারে। পেত্নীর মতো ভয়ংকর লাগছে ।মাম্মাকে বলবো তোমাকে ঘরে আটকে রাখতে।
হৈমন্তীর বুঝতে পারলো না ওকে ঘরে আটকে রাখার মতো কি হয়েছে। তাই কৌতুহলবশত প্রশ্ন করল,
> আমি কি চিড়িয়াখানার জীবজন্তু যে ঘরে আটকে রাখবে? আপনাকে আটকানো ফরজ। আপনি প্রচণ্ড খারাপ মানুষ।
হৈমন্তী রাগ দেখিয়ে চলে আসলো। জুলি দৌড়ে ওর পিছু নিলো। রোহান সেদিকে তাঁকিয়ে মলিন হাসলো। মেয়েটাকে ওর মনে ধরেছে। আগে জানলে বাংলাদেশ সফর আগেই করে ফেলতো। কেনো যে বাবা মা কে বাংলাদেশে যাওয়া থেকে আটকে রেখেছিল এখন আফসোস হচ্ছে।
☆☆☆☆☆
পায়ের উপরে পা তুলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আরাফাত। অরিন ওর পায়ের কাছে বসে আছে । আরাফাত সত্যি সত্যিই ওকে দিয়ে পা টিপিয়ে নিয়েছে। দজ্জাল শাশুড়িদের থেকেও সাইকো বর বেশি বিপদ্দজনক। অরিন মুখ ভার করে চুপচাপ পা টিপে দিচ্ছে। এখন ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। আরাফাতের চোখে ঘুম নেই। ও ঘুমের ভান ধরে আছে। মাঝেমাঝে এক চোখ খুঁলে দেখছে। মেয়েটাকে বিরক্ত করতে ওর ভালো লাগে। ভয়ভয় মুখ নিয়ে যখন তাকিয়ে থাকে আরাফাত তখন মুগ্ধ হয়ে দেখে। এখানেও আলাদা সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। ও শুধু অনুভব করে। আরাফাতের ধ্যান ভাঙলো অরিনের থেমে যাওয়া দেখে। মেয়েটা ঝিমিয়ে ওর পায়ের উপরে মাথা রেখেছে। আরাফাত দ্রুত উঠে বসে অরিনকে সোজা করে দিলো। মেয়েটা চমকে উঠে ডিড়ডিড় করে বলল,
> সরি প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে।
> শুয়ে পড়ো জেগে আছো কেনো?
অরিনের প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হলো কিন্তু কিছুই বলা হলো না। রুমে সিঙ্গেল সোফা আছে সেখানে ঘুমানো যাবে না। নিচে বিছানা করতে ওর ইচ্ছে করছে না। এতদিন দুজন এক রুমে থাকলেও আরাফাত ওকে নিজের সঙ্গে ঘুমাতে দেয়না। দুজন আলাদা বিছানাতে ঘুমাই। মির্জা বাড়িতে থাকলে আরাফাত সোফায় গিয়ে ঘুমিয়ে যায়। তাছাড়া ও প্রায় রাতে বাড়িতে থাকে না। অরিন এসব নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি। একটার পর একটা ঘটনা সবার উপরেই প্রভাব ফেলেছে। আরাফাত ওর বোনকে ভালোবাসে ওকে তো না। প্রথমে মন খারাপ হলেও এখন আর হয় না।কথাগুলো ভেবে ও বিছানা থেকে নামতে যেতেই আরাফাত ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,
> কোথায় যাচ্ছো?
> বিছানা করতে। এখানে সোফা নেই।
আরাফাত বিরক্তি নিয়ে বলল,
> বিছানা করতে হবে না। এখানে অনেক জায়গা আছে। আমার পাশে ঘুমিয়ে যাও।
আরাফাত পাশে চেপে গিয়ে অরিনের জন্য জায়গা করে দিলো। মেয়েটা হতবাক হয়ে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। এটা ভয় নাকি আনন্দ ওর জানা নেই। আজানা কারণে হাত পা মৃদু কাঁপছে। ওর এমন কাঁপাকাঁপি দেখে আরাফাত ঝটকরে ওকে নিজের পাশে টেকে নিয়ে বলল,
> অনেক কাঁপাকাঁপি হয়েছে। এখন ঘুমাও।
আরাফাত পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করলো। অরিনের ঘুম কেঁটে গেছে। লোকটার পাশে জায়গা পাবে কল্পণাও করেনি। আশা জাগ্রত হলো একদিন ঠিক মনে জায়গা করে নিবে। আরাফাত সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে চাইছে। মেয়েটা ওকে ভালোবাসে কিন্তু ভয় পাচ্ছে। এভাবেই সারারাত পার হলো। ভোরবেলা ফোন পেয়ে আরাফাত হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো বাইরের দিকে। গাড়ি নিয়ে সোজা থানায় গিয়ে হাজির হলো। গতকাল রাতে আবিরের ফুপাতো বোন পিউলিকে উঠিয়ে আনা হয়েছে। মেয়েটার জিঞ্জাসাবাদ চলছে। আরাফাত এক্সট্রা টাকা দিয়েছে আবির অন্যায় না করেও যেমন ধোলাই খেয়েছে এটাকেও যেনো তেমনিভাবে ধোলাই করা হয়। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে মিডিয়ার লোকজনকে পিউলির বাবা জানিয়ে দিয়েছে। ওরা থানার বাইরে সকাল সকাল ভিড় করেছে। আরাফাত পিউকে থানায় রাখতে নিষেধ করেছে তাই ওকে বাইরে রাখা হয়েছে। আপাতত যতদিন না সত্যি বের হচ্ছে ততদিন ওকে সেখানেই রাখা হবে। মৃত্যু হলে তো সব শেষ হয়েই গেলো। যন্ত্রণা কাকে বলে মেয়েটা এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে। কল রেকর্ড থেকে জানা গেছে ঘটনার দিন রাতে মেয়েটা ঘনঘন বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল। দুজনে পরিকল্পনা করে একজন মানুষকে হত্যা করে ভালো মানুষের উপরে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে পার পাবে না। সত্যি কখনও চাপা থাকে না।
___________________
বাড়িতে হৈমন্তী আর আবেদা মির্জা একা আছে। ভাইবোনেরা সব ইউনিভার্সিটিতে গেছে। প্রতিবেশির বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে ওরাও বাঙ্গালী পরিবার।ওই বাড়ির বড় বউ অনুর বেবি হবে তাই ছোটখাট বাঙালি টাইপের আয়োজন করা হয়েছে। হৈমন্তীকে ফুপির সঙ্গে অনুষ্ঠানে যেতে হলো। অনুকে দেখে হৈমন্তীর খুব পছন্দ হলো। অল্প সময়ের মধ্যে দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমে গেলো। কিন্তু হঠাৎ ওর ফুপা ফোন দিয়ে দ্রুত ওর ফুপিকে বাড়িতে ফিরতে বললেন। হৈমন্তীকে অনু কিছুতেই ফিরতে দিলো না।। শেষমেশ আবেদা মির্জা ওকে রেখেই ফিরে আসলো। গান নাচ কবিতা আবৃত্তি অনেক অনেক আনন্দ হলো। হৈমন্তীর বেশ ভালো লাগলো এদের আয়োজন দেখে। নিজেদের মধ্যে এরকমটা ও আগে কখনও দেখেনি। পুত্রবধুর আনন্দের জন্য শশুর বাড়ির লোকদের কত উৎসাহ। ওর বারবার নিজের কথা মনে হলো। ওর যদি বেবি হয় তাহলে কাজীদের বাড়িতে এরকম একটা অনুষ্ঠান হবে। ভাবতেই ভালো লাগছে সেই সঙ্গে লজ্জা পাচ্ছে। এতো সুখ কি কপালে লেখা আছে? হৈমন্তী সিদ্ধান্ত নিলো এবার একটা বেবি নিবে। বাচ্চা কাচ্চা থাকলে আবির ওকে আর ঘনঘন অস্বীকার করতে পারবে না। লোকটাকে ও উচিত শিক্ষা দিবে। অনু হৈমন্তীকে ধরে সুন্দর একটা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিয়ে দিলো। হৈমন্তীকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে অনু মিষ্টি হেসে বলল,
> হৈমী তোমাকে দারুণ লাগছে। আমার একটা ভাই থাকলে তোমার রক্ষা ছিল না। আমি আজকের মধ্যে তোমাকে ভাবি বানিয়ে নিতাম।
হৈমন্তী লজ্জা পেলো তবে প্রতিবাদ করলো না। সারাদিন বেশ আনন্দ করে পড়ন্ত বিকেলে ও বাসাই ফিরলো। অনু ওকে বাড়ির গেট পযর্ন্ত দিয়ে গেলো। শাড়ি পরে ছোটছোট পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলো। আবির ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে। ছেলেটার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ওকে ঘিরে বাড়ির বাকী সদস্যরা বসে আছে। হৈমন্তী কয়েকবার চোখ বন্ধ করলো মুছে নিলো কিন্তু দৃশ্য চেঞ্জ হলো না। হৈমন্তীকে দেখে আবেদা মির্জা বলে উঠলো,
> হৈমী বাংলাদেশ থেকে তোর ফুপার একটা ছাত্র এসেছে। কাজী আবির এহসান। এখানে তোর ফুপার মেডিক্যালে কয়েকবছর ছিল। এতদিন পরে ওকে দেখে তো আমি অবাক। যাইহোক ভালো হয়েছে।
হৈমন্তীর কিছু বলার আগেই ভদ্রমহিলা হড়বড় করে সবটা বলে দিলো। হৈমন্তী চোখ বড়বড় করে তাঁকিয়ে আছে। আবিরকে দেখছে। ছেলেটা মন দিয়ে খাচ্ছে। সামনে ওর ফুপা বসে আছে। এর জন্যই হয়তো তাড়াতাড়ি ফুপিকে ডেকেছে কিন্তু হৈমন্তী বুঝতে পারছে না আবির হৈমন্তীর কথা এখানে বলেনি কেনো। লোকটার মতিগতি ধরতে পারছে না। হৈমন্তীর এবার বিরক্ত লাগছে। জুলি আর নায়রা খুশী খুশী মনে ওকে আরও খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আদর যত্নের বাহার দেখে হৈমন্তী চুপচাপ আবিরের সামনে গিয়ে বলল,
> ফুপি এই ভদ্রলোকের হয়তো বিশাল ক্ষুধা পেয়েছে। যেভাবে খাচ্ছে হয়তো থালাবাসন খেয়ে নিবে। তুমি বরং ওকে আরও কিছু খাবার দাও। আমি যাচ্ছি।
হৈমন্তীর কথা শুনে আবিরের গলাই খাবার আটকে গেলো। কেশে ফেলল। জুলি ওকে পানি এগিয়ে দিতেই ও ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। কি ফাঁসা ফেসেছে এটা শুধু ওই জানে। এখানে জামাই পরিচয় দেওয়ার আগেই স্যারকে দেখে সব গুলিয়ে গেছে। একের পর এক প্রশ্ন আর আবেদা মির্জার বকবক শুনে বাকীটা আর বলা হলো না। কি একটা বিপদ। হৈমন্তী আগেই রেগে ছিল এবার বম হয়ে গেলো। ক্ষমা টামার আশা ও ছেড়ে দিলো। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। খাওয়া শেষে আবেদা মির্জা ওকে একটা রুম দেখিয়ে দিলো। উনি হৈমন্তীর বরের ছবি দেখলে আর এই অবস্থা হতো না। আবির আগেও এই বাড়িতে এসেছে। আরাফাত হৈমন্তীর ঠিকানা দিলেই ও চুপচাপ চলে এসেছে। বলেছিল না বলতে যাতে হৈমন্তীকে চমকে দিতে পারে কিন্তু এখানে এসে যে কেস খেয়ে গেলো। আবির মন খারাপ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। কতদিন শান্তিতে ঘুমানো হয়নি। থানা থেকে বের হয়ে হোটেলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে কিছু না খেয়েই ফ্লাইট ধরেছে। ও এভাবে পালিয়ে আসতে চাইনি কিন্তু আরাফাতের জন্য বাধ্য হয়েছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। অন্যদিকে হৈমন্তী ভাইকে বলে দিলো ফুপিকে আবিরের পরিচয় না দিতে। লোকটাকে ও আচ্ছা করে টাইট দিবে। হৈমন্তী ফোন রেখে চেঞ্জ করবে ভাবল তার মধ্যেই জুলি এসে হাজির। ওকে টানতে টানতে গিয়ে গিয়ে কয়েকটা সেলফি নিয়ে বলল,
> তোকে দারুণ লাগছে। আমিও একদিকে শাড়ি পরবো কিন্তু পারি না। তুই সাহায্য করিস। চল ভাইয়াকে দেখাবি কেমন লাগছে। ও তো সেদিন খূব বলল তোকে খারাপ দেখতে লাগে। আজকে দেখবে কেমন লাগে।
জুলি একদমে কথাগুলো বলে ওকে টেনে নিয়ে গেলো। হৈমন্তীর ঢোক গিলে শাড়ির আচলটা মাথায় টেনে নিয়ে ভাবলো বাড়িতে বাঘের আনাগোনা। হরিণ শাবকের এভাবে সাহস নিয়ে ঘোরাঘুরি করা ঠিক হচ্ছে না। কখন সামনে চলে আসে বলা কঠিন। হৈমন্তী অস্বস্তি নিয়েও রোহানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হলো। ছেলেটা ওর দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> ওকে এভাবে পেত্নীর মতো কে সাজিয়েছে? কি জঘন্য লাগছে। এই মেয়ে তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে?
হৈমন্তী মিনমিনে কন্ঠে বলল,
> পাশের বাসাই অনুষ্ঠান হচ্ছে সেখানে।
হৈমন্তীর বলতে দেরী হলো কিন্তু রোহানের বেরিয়ে যেতে দেরী হলো না। মাকে আচ্ছা করে বাকাবকি করলো হৈমন্তীকে পাশের বাড়িতে পাঠানোর জন্য। আবেদা বেগম ছেলের উপরে বেশ বিরক্ত। হৈমন্তীকে উনি কোথায় নিয়ে যাবে সবটা কি এই ছেলে ঠিক করে দিবে। তাছাড়া ভদ্রলোকের বাড়িতে এভাবে চিৎকার চেচামেচি সাজে না। হৈমন্তী জুলিকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে:লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৩০
প্রচণ্ড গায়ে ব্যাথা জ্বর নিয়ে আবিরের ঘুম ভাঙলো। জ্বরটা এসেছে অতিরিক্ত ব্যাথার জন্য। প্রথমদিকে থানায় নিয়ে ওকে প্রচুর মারধর করা হয়েছে। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘাঁ সত্যি প্রমাণিত। জ্বর নিয়ে শুয়ে থাকলে হৈমন্তীর সঙ্গে কথা বলা যাবে না ভেবে টুকটাক করে উঠে বসলো। সেই মুহূর্তে জুলি এসে হাজির। আবিরের লাল লাল চোখ আর উস্কোখুস্কো চুল দেখে মেয়েটা থতমত খেয়ে বলল,
> ভাইয়া তোমার চোখ এমন দেখাচ্ছে কেনো? ঠিক আছো?
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ দৃষ্টিতে বলল,
> কিসের ঠিক? কিচ্ছু ঠিক নেই। বউ পাত্তা দিচ্ছে না সেই শোকে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। মন মেজাজ শরীর কিছুই ভালো নেই।
জুলি চোখ বড়বড় করে বলল,
> তুমি বিয়ে করেছ তো ভাবি কোথায়? কিছু একটা খিচুরি পাকিয়েছো মনে হচ্ছে। মাম্মাকে বলছি এখুনি।
জুলির কথা শুনে আবির মাথাই হাতে দিয়ে বলল,
> বলে কি হবে আমার বউ তো আর আমাকে ক্ষমা করবে না। আমাকে দেখে প্রেমের শীতল নদী না হয়ে এটোম বোম হয়ে গেছে। এখন ম্যাম জানলে আমার বউ সব উড়িয়ে দিবে। যাইহোক হৈমী কোথায় জানো?
>তুমি ওকে চিনেন?
> বউকে না চিনলে চাকরি থাকবে?
ওর ছন্নছাড়া কথাশুনে জুলি আবিরের দিকে এগিয়ে এসে চোখ বড়বড় করে বলল,
> হৈমন্তী আর তুমি ,তুমি আর হৈমী বিবাহিত? কিভাবে সম্ভব? মাথা ঘুরছে। মাম্মা জানে?
আবির মাথা নাড়িয়ে মুখ ভার করে বলল,
> হয়তো জানেনা। হৈমীকে চমকে দিতে গিয়ে আমি নিজেই চমকে গেছি। ফাজিল মেয়েটা আমার পরিচয় সবাইকে বলবে তানা করে আমাকে না চেনার ভান করে খোচা মেরে চলে গেলো। জুলি বউয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে দাও। প্রমিজ তোমাকে সাহায্য করবো। তোমার বয়ফ্রেন্ড রাফসান আছে না ওর সঙ্গে বিয়ের ব্যবাস্থা আমি নিজ দায়িত্বে করবো।
> আচ্ছা হয়েছে টা কি? হৈমী প্রথম দুদিন প্রচুর কান্নাকাটি করেছে। তোমার সঙ্গে কোনো ঝামেলা?
আবির সংক্ষেপে ওর সঙ্গে হওয়া ঘটনা গুলো বিস্তারিত বলে দিলো। জুলি ভ্রু কুচকে বলল
> আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করবো না। দরকার নেই তোমার সাহায্য নেওয়ার। তুমি আমার বোনকে কষ্ট দিয়েছ। তোমার একটা শিক্ষা হওয়া উচিৎ। ভালোবাসকে অস্বীকার করতে পারলে কিভাবে? তোমরা ছেলেরা নিষ্ঠুর। হৃদয় নেই পাষাণ। জালিমের মতো। ছিঃ লজ্জা করলো না এমন কাজ করতে?
জুলি একগাদা গালিগালাজ করে থামলো। আবির হতভম্ব হয়ে গেলো মেয়েটার ভাষা শুনে। এরা ভাইবোনেরা কেউ কারো থেকে কম না। জুলি ওর মুখের উপরে দরজা ধপাস করে বন্ধ করে চলে গেলো। আবির হতাশ। যা করার ওকেই করতে হবে। এদের সাহায্য ওর লাগবে না। শুধু শুধু কতগুলো গালি শুনতে হলো। কথাগুলো ভেবে ও ওষুধ খেয়ে বাইরে বের হলো। এখানে আসার আরও একটা কারণ আছে যেটা খুব দ্রুত শেষ করতে হবে। তিনমাসের ভিসাতে এসেছে টাইম বাড়াতে খুব একটা অসুবিধা হবে না যদি এখানকার হাসপাতালে জয়েন করতে পারে। কিন্তু ও এখানে থাকতে চাইছে না। দেশের মানুষের সেবা করার জন্য চিকিৎসক হয়েছিল সেখানে বিদেশে নিজের আখের গোছাতে পারবে না।
☆☆☆
ছেলে কোলে নিয়ে বসে আছে চয়নিকা। রাজীব মন দিয়ে ল্যাপটপে কিছু একটা করছে। চয়নিকা স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। লোকটাকে বিয়ে করার পরে বাবার বাড়ি আর শশুর বাড়ি এই দুটো জায়গা ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়নি। সংসারের গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করেছে। রাজীব ব্যস্ত মানুষ। কোথাও নিয়ে যাওয়ার সময় হয়না। তাছাড়া ওর যাওয়ার কথা উঠলে শাশুড়ি নয়তো রাজীব এটা ওটা বলে বাধা সৃষ্টি করে। এটা নিয়ে দুটোদিন প্রচুর ঝামেলা হয়। শেষপর্যন্ত চয়নিকা হাল ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ থাকে। মাসুদ নতুন বউকে নিয়ে কক্সবাজার গেছে সাত দিনের ছুটিতে। চয়নিকার অনেক ইচ্ছে কোনো এক শীতের শেষে ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। ছেলেটাকে নিয়ে চয়নিকা সমুদ্রতীরে শামুক কুড়াবে। রাজীব মুগ্ধ হয়ে স্ত্রী পুত্রকে দেখবে। খুনসুটি হবে, নোনা পানিতে পা ভিজিয়ে স্বামীর কাধে মাথা রেখে উপভোগ করবে জীবনের মানে। এমন কিছুই হয়না। সবটা শুধু কল্পনা। বিয়ের আগে বাবা মা বলতো তুমি আমার বাড়ির আমানত। এখান কোথাও যাওয়া চলবে না। যখন স্বামীর বাড়িতে যাবে তখন বরকে নিয়ে বিশ্বভ্রমনে বের হবা কেউ কিছু বলবে না। এখন স্বামীর বাড়িতে এসে সংসার সামলাতেই জীবনের অর্ধেক সময় শেষ।সারাদিনের কর্মব্যস্ততার শেষে ক্লান্ত শরীরে আর কোথাও যাওয়া কথা মাথায় আসে না। বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুম। যদিও বা যাওয়ার ইচ্ছা হয় তাহলে কত বাঁধা। বাড়ির বউ হচ্ছে বাড়ির ইজ্জত। তাকে ঘরে মানাই। এমন নীতিকথা শুনতে শুনতে চয়নিকার মুখস্ত হয়ে গেছে। তবুও হঠাৎ আজ মনের মধ্যে থাকা সুপ্ত অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে। নিজের অজান্তেই কথাটা মুখে চলে আসলো।
> চল না ঘুরে আসি। মাসুদরা কক্সবাজার থেকে আসলে আমরাও যায়। খুব ইচ্ছে করছে।
রাজীব কি শুনলো আল্লাহ্ ভালো জানে। নজর না ঘুরিয়েই বলল,
> আম্মা আব্বাকে নিয়ে চলে যাও। আমার সময় নেই। এই মাসের শেষে চারটা মিটিং আর সংসদ আছে।
চয়নিকা মুখটা কুচকে ফেলল। রোবটকে বিয়ে করে জীবন শেষ। আক্ষেপ নিয়ে বলল,
> তোমাকে বিয়ে করাই আমার জীবনের চরম ভুল ছিল। ভাবছি ভুলটা সংশোধন করে ফেলবো। আমার বাবার বাড়িতে যে প্রতিবেশির ছেলে জাফর ছিল আজও আমার জন্য বিয়ে করেনি। ভাবছি ওরে একটা সুযোগ দিবো। কাবলার মতো যা বলবো তাই শুনবে।
চয়নিকা কথাটা বলে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত উঠে গেলো। রাজীব ধপ করে ল্যাপটপ বন্ধ করে বউয়ের পিছু নিলো। জাফররে ও ছাড়বে না। মির জাফর ওর এতো দিনের সংসার ভাঙার চেষ্টা করছে। যেতে যেতে ভাবলো দলের ছেলেদের দিয়ে ওরে ধরে এনে লাইলির মায়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিবে। চাইলির মা মফস্বলের নামকরা কবিরাজ। লম্বা লম্বা জটালো চুল। ভয়ঙ্কর দেখতে। মিরজাফরের উপযুক্ত বউ হবে। কথাটা ভেবে ওর বেশ তৃপ্তি হলো। চয়নিকা রেগে আছে। ওর রাগ ভাঙাতে দুদিন চলে যাবে। রাজীব হাল ছাড়বে না। ঘরে অশান্তি রেখে বাইরের কাজে ওর মন বসে না।
☆☆☆
আরাফাত অরিনকে নিয়ে ডিবি পুলিশের গোপন কক্ষে বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে পিউলিকে আনা হবে। অরিন জোরপূর্বক এসেছে। আরাফাত একা আসতে চেয়েছিল কিন্তু মেয়েটা শুনলো না। বায়না ধরেছে তাই বাধ্য হয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে পিউলির সঙ্গে দেখা করা। অরিন ঘেঁমে যাচ্ছে। আরাফাত ওর পাঁচ আঙ্গুলের ফাঁকে নিজের আঙ্গুল দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাঝেমাঝে ফিসফিস করে বলছে,
> ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি তো। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করো।
অরিন মুখে কিছু বলছে না। কন্ঠ কেউ চেপে রেখেছে। আশেপাশের তাঁকিয়ে দেখছে। পাশের কক্ষ থেকে চিৎকারের আওয়াজ হচ্ছে। কাকে একটা মা*রছে। বারবার আবিরের কথা ওর মনে হচ্ছে। ভাইকে এভাবে মেরেছে ভেবেই কষ্ট হচ্ছে। পুলিশের উপরে রাগ হচ্ছে সেই সঙ্গে ঘৃণা হচ্ছে। ওরা বসে আছে এই রুমের মাঝখানে একটা টেবিল আছে। টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ার আর এপাশে দুটো চেয়ার । ঘরের এককোনে সিলভারের একটা পানির ঘড়া একটা টিনের গ্লাস। তাছাড়া আর কোনো আসবাবপত্র নেই। মাথার উপরে জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। ঘরটাতে মৃদু আলো জ্বলছে। যদিও পাশে একটা এলিডি বাল্ব আছে সেটা দরকার ছাড়া অন করা হয়না হয়তো। সমস্ত রুমে আলো আধারের খেলা চলছে। যদিও বাইরের আলো হালকা ভেতরে প্রবেশ করছে। অরিন আরাফাতের মুখটা আবছা দেখছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজন মানুষ ভেতরে প্রবেশ করলো। একজন ভদ্রলোক পিউলিকে এনে অরিনের সামনে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
> মিস্টার মির্জা বাইরে আসুন। আপনার মিসেসকে একা ছেড়ে দিন। দুবোনের মধ্যে আপনি থেকে কি করবেন। হাড্ডি হয়ে কাজ নেই।
অরিন হালকা কাঁপছে। আরাফাত ওর হাতটা হালকা চাপ দিয়ে ছেড়ে দিলো। অরিন দ্রুত ওর মুখের দিকে তাকালো। লোকটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত রেখে বেরিয়ে গেলো। এখানে আসার পরে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে সেটাই ওকে ফুলফিল করতে হবে। নিজের পরিবারের জন্য এইটুকু ও করতে পারবে বলে মনে হয়েছে। আরাফাত দরজার ওপাশে যেতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। অরিনের বুকের মধ্যে ধপ করে উঠলো। নিজকে স্বাভাবিক রেখে সামনে বসা পিউলির উপরে নজর দিলো। মেয়েটার চোখেমুখে বিস্ময়। অরিনকে এখানে আসবে হয়তো আশা করেনি। আজ দুদিন ধরে ওকে এখানে ওকে বন্দী করা হয়েছে। মারধর হয়েছে। তবুও ও কিছুই স্বীকার করেনি।করবেও না। জীবন থাকতে করবে না। নিরবতা ভেঙে অরিন বলে উঠলো,
> পিউলি আপু কেমন আছো?
> তোর বর আমাকে কেনো সন্দেহ করছে জানতে পারি? কি ক্ষতি করেছি ওর? নিজের মাকে খু*ন করবো এতোটা পাপি ভাবে আমাকে,কিন্তু কেনো?
> তুমি কাজটা করোনি বলছো?
> নিশ্চয়ই। তাছাড়া আম্মুকে আমি ভালোবাসতাম। মা*য়ের মৃত্যুর পরে কোথায় মামা মামি ভাইবোনেরা মিলে আমাদের পাশে থাকবে তানাকরে আমাদের পিছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছে। এতোটা জঘন্য কিভাবে হলো তোর বাবা মা বলতে পারিস? আমার সোজাসাপ্টা ভাইদুটোকে ফাঁসিয়ে মে*রে ফেলতে বিবেকে বাঁধলোনা পযর্ন্ত।
পিউলির কন্ঠে ঘৃণা ঝরে পড়ছে। অরিন বিচলিত হলো না। এখন প্রতিবাদের সময় না। চোখের পাতা নাড়িয়ে বলল,
> তুমি কি জানো আপু তোমার বাবা স্বীকার করেছে তুমি তোমার মাকে মেরেছো। উনি কিন্তু বেঁচে গেলেন। তুমি যে সম্পত্তি আর প্রতিশোধের জন্য এসব করছো তাঁতে তোমার তো কোনো লাভ হলো না। তোমার বোন আর বাবা আমাদের থেকে যে অর্থ পাবেন দুদিন পরে বিদেশে গিয়ে পায়ের উপরে পা তুলে আরামে দিন পার করবেন। তুমি এই জেলের মধ্যে আটকে থাকবে। তোমার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে আপু।
পিউলি এবার সত্যিই উত্তেজিত হলো। ওর হাতটা কাঁপছে। দুদিন ভালো খেতে দেওয়া হয়নি। পানি পযর্ন্ত পাইনি। এতবড় ধাক্কা মেনে নিতে পারছে না। অরিন আবারও বলল,
> কাদের জন্য করছো এসব? তোমার বাবার চরিত্র কেমন তুমি জানোনা? ফুঁপি বাধ্য হয়ে আমাদের বাড়িতে পড়ে থাকতো। তোমার বাবা আবারও বিয়ে করছে লুকিয়ে। সেই ঘরে দুটো ছেলেমেয়ে আছে। প্রমাণ আছে দেখতে চাইলে তোমাকে দেখাতে পারি। দেখবে?
> আমি বিশ্বাস করিনা। তুই মিথ্যা বলছিস। বাবা এমন করবেন না। উনি আমাদের দুবোনকে ভালোবাসে।
অরিন চুপচাপ নিজের ফোন থেকে একটা ভিডিও অন করে পিউলির সামনে ধরলো। সেখানে একজন মহিলার জন্মদিনের পার্টি চলছে। কেক কাটার পরে সেটা ভদ্রমহিলা পাশে থাকা পিউলির বাবার মুখে হালকা করে লাগিয়ে দিয়ে হাসছে। পাশে পুতুলের মতো সুন্দর দুটো ছেলেমেয়ে। বোঝাই যাচ্ছে একটা সুখী পরিবারের খুনসুটিপূণ মুহূর্ত। ভিডিও শেষ হওয়ার আগেই পিউলি বলে উঠলো,
> আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। অরিন আমি আম্মুকে মারিনি। বাবা এসেছিল গার্ডদের টাকা দিয়ে। সেসময় সিসি ক্যামেরা বন্ধ ছিল বলে কাউকে দেখা যাননি। তাছাড়া বাবা মহিলাদের ছদ্মবেশে এসেছি। আমি নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আম্মুকে খুন হতে দেখেছি। লোকটা জঘন্য খারাপ। আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে। উনি বলেছিল আম্মু তো দুদিন পরে মা*রা যাবেন। যদি এখানে মা*রা যায় তাহলে ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া যাবে। অনেক টাকা পয়সা পাওয়া যাবে। যেগুলো নিয়ে আমরা বিদেশে চলে যাবো।
পিউলি স্বীকারোক্তি দিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। অরিনের চোখেও পানি। নিজের মা যার সামান্য অসুস্থতার খবর শুনলে নিশ্বাস পযর্ন্ত বন্ধ হয়ে আসে তার খু*ন এই মেয়েটা নিজের চোখের সামনে দেখেছে। বিষয়টা ভেবেই ওর পিউলির উপরে ঘৃণা হচ্ছে। ফুফি নিজেও যেমন জাদরেল ছিল ছেলেমেয়ে গুলোও তেমন হয়েছে। তাছাড়া ফুপাও তেমন। এরা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করতে নারাজ। অরিনের কিছুই বলতে হলো ন। আরাফাত ভেতরে এসে অরিনের পেছনে দাঁড়িয়ে ওর দুবাহুতে হাত রাখলো। অরিন একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবারও পিউলির দিকে তাকালো। বলল,
> কাজটা তুমি ঠিক করোনি আপু। ফুপি তোমাদের নিয়ে খুব চিন্তা করতেন। উনি তোমাদের কথা ভেবে ফুপার এসব কথা তোমাদের থেকে আড়াল করেছিল। তাছাড়া তোমাদের দুইবোনের নামে উনি বেশ কিছু টাকা জমিয়েছেন। যদি এসব না করতে দাদিজান তোমাদের সব জমি দিয়ে দিতেন। উনি নিজের মেয়েকে হারিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে সবটা বাবা আর চাচার নামে লিখে দিয়েছে। যাইহোক আমরা এখন আসছি। আমি চেষ্টা করব তোমার শাস্তি কমানোর জন্য। তবে ফুপার যাতে ফাঁসি হয় এটাই কামনা করব।
অরিন কথা শেষ করে এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলো না। উঠে আসলো। ওর পেছনে পেছনে আরাফাতও আসলো। বাইরে এসে অরিনের মাথা ঘুরতে লাগলো। আরাফাত ওকে দ্রুত সোফায় বসিয়ে দিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। ওরা এতক্ষণ যেটা বলছিল এখান থেকে সবটা সবাই শুনেছে। শেষ মূহুর্ত্তে অরিনকে নার্ভাস দেখে আরাফাত ভেতরে ঢুকেছিল। লতিফ নামের একজন অফিসার আরাফাতকে বলল,
> দুদিন খামাখা সময় নষ্ট হলো। আপনার মিসেস এক ঘন্টায় মামলার দফারফা করে দিলো। মেয়ে মানুষ বেশি মারধর করাও যায়না। কিযে বিপদে ছিলাম। যাইহোক অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মিসেসকে।
> ধন্যবাদের কি আছে। কেসটা নিয়ে খুব চিন্তিত আছি। পরিবারের লোকজন ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া আবিরের ক্লিনিক বন্ধ আছে। মানসম্মান যাওয়ার উপক্রম। যাইহোক মুল আসামিকে ধরে একটা বড় ধরণের আয়োজন করুন। এসব উল্টোপাল্টা সাংবাদিক আর গাঞ্জাখোর দের আমি একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে চাই। সবগুলোরে এবার সাংবাদিকতা শেখাবো। ফ্রি দুটো চ্যানেল খুলে সেলিব্রিটি হওয়া বের করবো।
আরাফাত ঠান্ডা মাথায় হুমকি দিয়ে অরিনকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। মেয়েটা ফুপির জন্য কাঁদছে। দুদিন আগেও যে ওকে মারার জন্য বিষ দিয়েছিল। ভালোবাসা তো এমনি হতে হয়।
☆☆☆☆☆
দ্রুতগতিতে পাইচারি করছি হৈমন্তী। রাতে ভাইবোনেরা মিলে কোথায় একটা পার্টিতে যাচ্ছে। জুলির বন্ধু ওকে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করেছে। এক মন বলছে যাওয়া উচিত আরেক মন বলছে উচিৎ না। দোটানায় পড়ে গেছে। এর মধ্যেই নায়রা একটা ড্রেস এনে হৈমন্তীর সামনে ধরে বলল,
> তোমার জন্য এনেছিল। তুমি লম্বা লম্বা গাউন পরো এবার এটা পরবে। দারুণ লাগবে।
হৈমন্তী ড্রেসটা হাত নিয়ে দেখলো। মোটামুটি খারাপ না। গাউনের মতোই তবে ছোট। পরাই যায়। হৈমন্তী চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। জুলি এসে ওদের দুজনকেই তাড়া দিলো দ্রুত রেডি হতে। সময় আছে আধাঘন্টার মতো। জুলি মোটামুটি তৈরী। হৈমন্তী মুখ ভার করে জুরিকে বলল,
> আপু মন চাইছে না।
> চাইবে না ক্যান? চাইতে হবে। শোন মেয়েদের শক্ত হতে হয়। এভাবে নরম হলে যেকেউ তোকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে দুবার ভাববে না। ওখানে গেলে মন ভালো হয়ে যাবে। কোনো কথা হবে না।
হৈমন্তীর বোনের ধমক শুনে দ্রুত রেডি হয়ে বের হলো। কালো রঙের ড্রেসে ওকে বেশ লাগছে।তিন বোনে মিলে কালো রঙের চশমা নিয়েছে। হৈমন্তীর হাটতে অসুবিধা হচ্ছে তবুও কিছু করার নেই। আবির সোফায় বসে ছিল হঠাৎ তিনবোনকে দেখে হাঁ হয়ে গেলো। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে। বউযে হাতছাড়া হতে চলেছে। এভাবে আর বসে থাকা মানাচ্ছে না। কথাটা ভেবে ও শব্দ করে বলে উঠলো,
> আমি ঘরে একা একা থাকবো তোমাদের সঙ্গে কি যেতে পারি?
নায়রা হাসি মুখে আগ্রহ নিয়ে বলল,
> ভাইয়া তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে? কিন্তু তুমি তো অসুস্থ।
> কিসের অসুস্থ? আমি ঠিক আছি। চলো আমিও যাবো।
আবির উঠে আসলো। হৈমন্তী মুখ ঘুরিয়ে নিলো। জুলি হৈমন্তীর হাত ধরে রেখেছে। রোহান বেরিয়ে আসলো হেডফোন কানে লাগিয়ে। রোহানের তিড়িং বিড়িং থেকে গেছে হৈমন্তীকে দেখে। আবির রোহানের মুখের দিকে তাকিয়ে কি বুঝলো বোঝা গেলো না। দ্রুত হৈমন্তীর সামনে গিয়ে ওকে আড়াল করে বলল,
> রোহান যাওয়া যাক?
(চলবে)