শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব-২৯+৩০

0
648

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (২৯)

দেখতে দেখতে ২ মাস কেটে গেলো। শীতের তীব্রতা বাড়তে লাগলো। এরই মধ্যে ধ্রুবর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো। বন্ধুদের থেকে বেশ কিছু টাকা পয়সা ধার করতে হলো ধ্রুবকে যেই সময় শালুকের টাইফয়েড হলো।

ধ্রুবর তখন দিশেহারা অবস্থা। শালুক একা বাসায় থাকে,এদিকে নিজের পরীক্ষা, চাকরি,টিউশন।
কি করবে ধ্রুব ভেবে উঠতে পারলো না।
শেষে ঠিক করলো শালুকের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত একজন মহিলা রাখবে বাসায়।ধ্রুবর অনুপস্থিতিতে সে যাতে শালুককে দেখে রাখতে পারে।
কিন্তু বললেই তো হয়ে যায় না কোনো কাজ।কাকে রাখবে,যাকে রাখবে সে কতোটুকু বিশ্বস্ত তা ও তো জানতে হবে।

শেষে ধ্রুব বাড়িওয়ালার কাছে গেলো। তাকে নিজের সমস্যা খুলে বলতেই তিনি তার বাসায় কাজ করে এরকম একজন মহিলাকে পাঠালেন।
তার কাজ হচ্ছে শালুককে সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো। শালুকের কিছু লাগলে এগিয়ে দেওয়া।এটুকুই কাজ তার।

প্রায় ১২ দিনের জ্বরে শালুকের চেহারা মলিন হয়ে গেছে, মাথার চুল সব ঝরে পড়ছে, ভীষণ শুকিয়ে গেছে শালুক।
ধ্রুবর ভীষণ কষ্ট হয় শালুকের দিকে তাকালে।

এক দিকে হাতে টাকা পয়সার টানাটানি, আবার অন্যদিকে শালুকের চিকিৎসা, বাসায় একজন মহিলা রাখায় তার মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতন।
ধ্রুব তবুও নিজেকে সামলে নিলো। কিছুতেই ভেঙে পড়বে না বলে বারবার নিজেকে নিজে বুঝাতে লাগলো।
বিপদ যিনি দেয়,তিনিই আবার বিপদ মুক্ত করেন।

রোজ বাসায় যাবার সময় ধ্রুব ফল নিয়ে যায়,নিজের হাতে কেটে শালুককে খাওয়ায়।দিনে নিজে থাকতে পারে না যখন ঘন্টায় ঘন্টায় কল দিয়ে জিজ্ঞেস করে শালুক কি খেলো না খেলো।

অভাব অনটন, প্রেম ভালোবাসা সব কিছু নিয়ে দুজনের দিন কেটে যাচ্ছিলো।
কিন্তু এরই মধ্যে সমস্যা দেখা দিলো অন্য জায়গায়। বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া আরো দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে দিলো।

সেই মুহুর্তে ধ্রুবর মনে হলো পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে তার।
এমনতেই প্রায় ২২-২৩ হাজার টাকার মতো ধার করতে হয়েছে। কিন্তু বাড়ি ভাড়া আরো বাড়ানোর জন্য সংসার খরচ চার হাজার থেকে নামিয়ে দুই হাজারে আনতে হলো।
শালুকের এই মুহূর্তে পুষ্টিকর খাবার দরকার একদিকে।
ধ্রুব টিউশনি শেষ করে রাস্তার পাশে বসে রইলো।
এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে তার চাইতে অসহায় এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার পরেও তাকে ভালো রাখতে পারছে না সে।
হতাশায় নিমজ্জিত হলো ধ্রুব।বাসায় যাওয়ার মতো অবশিষ্ট শক্তি ও যেনো তার দেহে নেই।
অনেকক্ষণ পথে বসে থাকার পর ক্লান্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে গেলো কোনোমতে।

শালুক জেগেই ছিলো ধ্রুবর অপেক্ষায়। শালুকের শরীর এখন আগের চাইতে অনেকটা ভালো।ধ্রুবর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আজ নিজেই রান্না করেছে শালুক। বেশি কিছু রান্না করতে পারে নি, ভাত,ডাল,বেগুন দিয়ে শুঁটকি আর বেগুন ভর্তা বানিয়েছে।

ধ্রুবর হঠাৎ করে মনে হলো, এখন তো রান্না করতে হবে। এতো দেরিতে রান্না করলে শালুক কখন খাবে।
নিজের উপর ভীষণ রাগ উঠলো ধ্রুবর।এতোটা বেখেয়ালি হলো কিভাবে সে এটাই ভেবে পেলো না। কেনো এতোক্ষণ বাহিরে সময় নষ্ট করলো!

পরমুহূর্তে ঠিক করলো শালুকের জন্য হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসবে।নয়তো শালুকের খাওয়ার খুব দেরি হবে।

ধ্রুব কে আবারও বের হতে দেখে শালুক আটকালো।সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছেন এখন আবার? এমনিতেই তো দেরি করে বাসায় ফিরেছেন।”

ধ্রুব মাথা চুলকে বললো, “একটু বাহিরে যাচ্ছি। রান্না করতে তো দেরি হয়ে যাবে,তোমার ও খেতে দেরি হবে তখন।তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি গিয়ে। ”

শালুক হাত চেপে ধরে বললো, “কোনো দরকার নেই।আমি রান্না করেছি আজ।আসুন খাবার খাবো।”

ধ্রুব তাকিয়ে রইলো শালুকের দিকে। তারপর বললো, “তোমার রান্না করার কি দরকার ছিলো? তোমার শরীর এখনো ঠিক হয় নি শালুক। ডিম সিদ্ধ করেছো?”

শালুক মাথা নাড়িয়ে জানালো, করে নি।
ধ্রুব কথা না বাড়িয়ে চুলায় ডিম সিদ্ধ দিলো।তারপর ঢাকনা সরিয়ে দেখলো শুঁটকি রান্না করেছে শালুক। হতভম্ব হয়ে গেলো ধ্রুব।বাহিরে এসে জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি তুমি রান্না করেছো শালুক? ”

শালুক বললো, “এতো অবাক হওয়ার কি আছে?আমি কি রান্না করতে পারি না না কি?খুব ভালো না হলেও তো,কিছুটা পারি।খাওয়া যায় আমার রান্না।আপনার মতো হয়তো সেরা রাঁধুনি না আমি। ”

ধ্রুব হতবাক হয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি তুমি রান্না করেছো?”

শালুক বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”সমস্যা কি?”

ধ্রুব মুচকি হেসে বললো, “তুমি শুঁটকি রান্না করেছ শালুক! এটাই তো আমার জন্য আশ্চর্যের ব্যাপার। ”

শালুক মাথা নিচু করে বললো, “আপনার তো অনেক প্রিয় একটা খাবার। তাই ভাবলাম একটু চেষ্টা করে দেখি।হালাল খাবারই তো এটা তাহলে কেনো এতো নাক সিঁটকাই।সেই জন্য রান্না করেছি।”

ধ্রুব হাসলো। তারপর বললো, “আমি জানি শালুক তুমি কেনো আজ শুঁটকি রান্না করতে চেষ্টা করেছ।ফ্রিজে মাছ মাংস কিছুই নেই।”

শালুক ধরা পড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। তারপর বললো, “আমার আর খেতে ইচ্ছে করে না এসব।প্রতিদিন কিভাবে মানুষ মাছ মাংস খেতে পারে আপনি বলুন?আপনি নিজেও তো পারেন না।প্রতিদিন আমাকে খাওয়ান,নিজে খান না ”

ধ্রুব চুপ হয়ে গেলো। শালুক আস্তে করে বললো, “ভাড়া বাড়িয়েছে বলেছে আপনাকে?”

ধ্রুব চমকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে এই কথা কে বলেছে?”

শালুক মুচকি হেসে বললো, “বাড়িওয়ালা আন্টি এসেছে বিকেলে।উনি বলেছেন।”

ধ্রুব খাবার সাজাতে সাজাতে বললো, “তোমার এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।আমি আছি তো।”

শালুক খেতে খেতে বললো, “আপনার তো একটা টিউশন ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমি আজকে বসে বসে হিসেব করেছি।আর আজকেই জীবনের বড় হিসেব মেলাতে পেরেছি।আপনার চিন্তার কারণ বের করতে পেরেছি। ”

ধ্রুব খাওয়া বন্ধ করে বললো, “কি বলছো তুমি? ”

শালুক হাসলো। জ্বরে কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখের নিচে কালি জমেছে শালুকের। চোখ বড় বড় লাগছে আগের চাইতে এখন।ধ্রুবর মনে হলো এই বুঝি বনলতা সেনের সেই পাখির বাসার মতো বড় বড় চোখ!

হেসে শালুক বললো, “আপনি আবারও নিশাকে পড়ানো শুরু করেন।”

ধ্রুব চোখ মুখ শক্ত করে বললো, “বাজে কথা বলবে না শালুক। ”

শালুক বললো, “আপনার মেইন চিন্তা তো এটাই,উপার্জন কমে গেছে,তার উপর সামনের মাস থেকে ভাড়া দিতে হবে ১৭ হাজার টাকা। আমি বুঝতে পারছি আপনার মানসিক পেরেশানি কতোটা এই মুহূর্তে। তার মধ্যে আমার ও এরকম জ্বর হলো। নিশ্চয় আপনাকে অনেক ধারদেনা করতে হয়েছে। এই সময়ে এতো খরচের মধ্যে আমার জন্য একজন বাড়তি মানুষ রাখতে হয়েছে। আমি খুব ছোট নই যে এসব বুঝবো না।”

ধ্রুব খাওয়া শেষ করে বললো, “এতটা বড় ও হয়ে যাও নি যে এতো চিন্তা তোমার করতে হবে এই সময়। আমি আছি তো।আমাকে ভাবতে দাও।”

খাওয়ার পর শালুকের ঔষধ এনে খাইয়ে দিলো ধ্রুব।বিছানায় শুয়ে তারপর বললো, “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শালুক। তোমাকে কোনো লেডিস হোস্টেলে উঠিয়ে দিই,আমি আমার হলে চলে যাবো।”

শালুক হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললো, “আপনার কাছ থেকে এক চুল দূরে ও আমি যাবো না।এসব চিন্তা বাদ দিন আপনি। ”

ধ্রুব হাসলো। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে বললো, “কাছে ও তো আসো না আমার। ”

শালুক তাকিয়ে রইলো ধ্রুবর দিকে। তারপর ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে বললো, “এই যে কাছে আছি। ”
ধ্রুব শালুকের হাত চেপে ধরে বললো, “আরো কাছে আসা যায় না?যতো কাছে আসলে দুজন মিশে একাকার হয়ে যেতে পারবো? ”

শালুক লজ্জা পেয়ে মাথা লুকালো ধ্রুবর বুকে।ফিসফিস করে বললো, “ভীষণ ঠান্ডা পড়ছে।”

ধ্রুব ও শালুকের মতো ফিসফিস করে বললো, “তাহলে আরো ঠান্ডা লাগুক তোমার শালুক। ভীষণ ভীষণ ঠান্ডা লাগুক, যাতে আমি হই তোমার উষ্ণতার চাদর।”

প্রথমবারের মতো দুজনের মধ্যে ভীষণ ভালোবাসার লেনাদেনা হলো,প্রবল শীতের রাতে দুজনে একে অন্যকে উষ্ণ করে তুলতে লাগলো। সেই রাতে তৃপ্ত হলো দুজনের চাতক মন।

শালুক সকালে ধ্রুবকে বকতে লাগলো। ধ্রুব হাসতে লাগলো। এক অজানা সুখে ধ্রুবর দেহ মন তৃপ্ত হয়ে আছে।সোয়েটারের উপর শালুক চাদর জড়িয়ে নিলো।তবুও যেনো শীত কমছে না তার।
ধ্রুবকে সে কথা বলতেই ধ্রুব হেসে বললো, “আসো তাহলে, আবারও উষ্ণ করে দিই তোমাকে। ”

শালুক লজ্জায় লাল হয়ে বললো, “দূর,আপনি ভীষণ খারাপ। এর চাইতে ভালো আমাকে লেডিস হোস্টেলে উঠিয়ে দিন।”

ধ্রুব শালুকের পাশে বসে হেসে বললো, “এখন যে আমি কিছুতেই তোমাকে ছাড়বো না বোকা ফুল,ফুলটাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিলে রাতে তার শীত করলে আমি তো তার শীত দূর করতে পারবো না। এখন যে তোমাকে আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে ইচ্ছে করছে নিজের সাথে। ”

শালুক বললো, “একটা কথা বলি,রাগ করবেন না বলুন।”

ধ্রুব বললো, “আচ্ছা, বলো।”

শালুক বললো, “আমরা এই বাসাটা ছেড়ে দিই।এতো বড় বাসার তো আমাদের কোনো দরকার নেই তাই না?আমরা দুজন মানুষ। একটা রুম হলেও আমাদের চলে যাবে।অযথা ১৭ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকার কি দরকার তাহলে? ছোট একটা বাসা নিন আপনি, এক রুমের হলে আরো ভালো হয়।এতে করে আমাদের সব দিক থেকেই সুবিধা হবে।”

ধ্রুব অপলক তাকিয়ে থেকে বললো, “অনেক বড় হয়ে গেছিস তুই শালুক। তোর মনে আছে, ছোট বেলায় এই তুই ভীষণ জেদ করতি আমার ছাদে একটা রুম আছে তোর নেই কেনো এটা নিয়ে। তুই বলতি তোর ভীষণ বড় রুম লাগবে।জোর করে ছাদের একটা ঘর দখল করেছিস তুই।আর আজ সেই তুই কি সুন্দর করে বলছিস একটা ছোট রুম হলেই চলবে।
সময় কেমন করে খেলে মানুষকে নিয়ে, তাই না শালুক?
ছিলি কোথায় রাজ বাড়িতে, আমার জন্য তোকে এখন থাকতে হচ্ছে গাছতলায়। ”

শালুক ধ্রুবর কাঁধে মাথা রেখে বললো, “সেখানে আমি রাজকন্যা ছিলাম,অতিথি ছিলাম।সেই রাজমহল আমার আজীবনের জন্য ছিলো না। এখন আমার যা আছে তা একান্তই আমার। এখানে আমি রানী,সর্বাধিকারী এই রাজ্যের। এটাই যে আমার জন্য চিরস্থায়ী ঠিকানা। আপনি সাথে থাকলে আমি সব জায়গায়, সব পরিবেশে থাকতে পারবো। আপনি ও তো ছিলেন সেই রাজ্যের যুবরাজ। আপনার যদি মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে আমার কেনো থাকবে না।”

ধ্রুব একটা চুমু খেয়ে বললো, “কথা দিচ্ছি শালুক,একদিন একটা রাজবাড়ী করে দিবো তোমায়।”

সেদিন আর ধ্রুব শো রুমে গেলো না,বহুদিন পর দুজন বের হলো বাহিরে।একই সাথে কিছুটা ঘুরাঘুরি ও হবে,বাসা দেখা ও হবে।

এবার আর রেষ্টুরেন্ট যাওয়া হলো না,টং দোকানের চা রুটি, ফুচকা,চটপটি খেয়ে আনন্দ চিত্তে দুজন বাসা খুঁজে বের করলো।

চলবে?

রাজিয়া রহমান

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (৩০)
পরের মাসেই ছোট এক বেডরুম, একটা কিচেন,একটা ওয়াশরুমের একটা বাসায় উঠলো ধ্রুব আর শালুক। এখানে ভাড়া ৮ হাজার টাকা।
ধ্রুবর জন্য ব্যাপারটা স্বস্তিদায়ক। প্রায় ৯ হাজার টাকার ব্যবধান। তবে সমস্যা হচ্ছে বাসাটা একটু বেশি ভেতরের দিকে।
শালুকের সেসব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।বরং শালুক ভীষণ আনন্দিত।
কেননা এখানে এরকম অনেকগুলো ফ্ল্যাট আছে একই ফ্লোরে, সবাই তাদের মতো করে থাকছে।জীবন যুদ্ধের লড়ে যাচ্ছে সবাই।
সকাল হতেই শুরু হয় সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসে,বাচ্চাদের কান্নার শব্দ ভেসে আসে।
কর্মমুখর মানুষ সাত সকালে বের হয়ে যায় নিজের জীবিকার তাগিদে।

শালুকের পরীক্ষা সামনের মাসে শুরু হবে।শালুক সারাদিন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে, বিকেলে রাতের জন্য রান্না করে। সন্ধ্যায় শালুকের কাছে আশেপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা আসে।সবাই মিলে গল্প করে যখন শালুকের মনে হয় এরা সবাই যেনো তার কতো চেনা।
এই এক অন্য জীবন যেনো,অন্য রকম অনুভূতি।
একজন এক জেলা থেকে এসেছে, সবার কথাবার্তা আলাদা,রান্নাবান্নার নিয়ম আলাদা,চলাফেরার নিয়ম আলাদা।
একটাই মিল সবার মধ্যে, সবার একই রকম আর্থিক অবস্থা। সবাই খেয়ে পরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।কেউ বিলাসিতা করতে যায় না এখানে।
শালুক দেখলো এখানের মানুষগুলো কি নির্দ্বিধায় প্রতিদিন মাছ মাংস না খেয়ে ও স্বামী, সন্তান নিয়ে হাসিখুশি থাকছে।
এক পদ তরকারি দিয়ে,একটা ভর্তা একটা ডাল দিয়ে খেয়ে খুশিমনে একে অন্যের কাছে তা বলছে।বলতে তাদের মধ্যে কোনো জড়তা নেই।লজ্জা পায় না কেউ নিজের দৈন্যতা স্বীকার করতে। কেউ কাউকে বড় করতে চায় না।কার কি আছে সেসব নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় না।
এরা সবাই যেনো সবার ভীষণ আপন।

শালুকের মনে পড়লো আগের বাসার কথা। তার টাইফয়েড হবার পর বাড়িওয়ালার বউ প্রতিদিন বিকেলেই তাদের বাসায় আসতো গল্প করতে।
যেহেতু তার বাসায় কাজ করা মহিলাটি যার নাম দিলারা, শালুকের দেখাশোনা করছে সেই সুবাদে আসতেন তিনি।

এলেই জিজ্ঞেস করতেন,কি রান্না করেছে আজকে, কি দিয়ে খেয়েছে শালুকরা।
তারপর শুনে নাক কুঁচকে বলতেন আজ তারা বড় কাতলা মাছ এনেছেন, কোনোদিন গরুর মাংসের বিভিন্ন আইটেম,কখনো বড় ইলিশ মাছ।
আফসোস করে দিলারাকে বলতেন,”আহারে দিলারা,বাসায় থাকলে তো খেতে পারতি।আজকে আমরা এই রান্না করেছি,সেই রান্না করেছি। ”

দিলারা মলিন মুখে হেসে বলতো,”বড় লোকের বাসার খাওন দাওন আর এই গরীবের বাসার খাওন কি এক রকম হয় আপা?কিসের লগে আপনি কি তুলনা করেন।”
লজ্জায় তখন শালুকের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো।

নতুন শাড়ি,জুয়েলারি পরে বাড়িয়ালি এলে শালুক তখন এক মনে আল্লাহকে ডেকে যেতো।
শাড়ির দাম কতো,কোন ব্র‍্যান্ডের শাড়ি,জুয়েলারি কই থেকে নেওয়া এসবের ফিরিস্তি শুনিয়ে বলতেন,”তোমার তো এসব নেই মনে হয় শালুক।তোমার কানের এই ছোট দুল ছাড়া আর তো কিছুই দেখি নি কখনো পরতে।তোমার বরকে বলো না না-কি? তোমাকে টাকাপয়সা দেয় না সে?
আমার এসব দেখো,এগুলো আমি গত শুক্রবারে কিনে এনেছি নিজে গিয়ে। ”

শালুকের রাগ হতো ভীষণ। সে যেভাবে আছে সেভাবেই তো সে সুখী,সে তো উচ্চাশা করছে না।তবু কেনো উনি এসব কথা বলেন?
এই যে ধ্রুব বাসায় ফেরার সময় মনে করে শালুকের জন্য একটা পাঞ্চ ক্লিপ,একটা ফুলের মালা,একটা গোলাপ ফুল,এক মুঠো কাঁচের চুড়ি,এক জোড়া পায়েল এসব কিনে আনে নিজে থেকে,এসব পেয়ে শালুক যে পরিমাণ সুখ পায় তা কী ২ ভরি ওজনের কানের দুলের মধ্যে পাবে?
১৪-১৫ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনে এনে পাবে?

প্রিয় মানুষটা ভালোবেসে যা এনে দেয় তার চাইতে কি নিজের কেনা হাজার টাকা দামের জিনিসটা বড় হয় কখনো?

এই শো অফে অতিষ্ঠ হয়ে শালুক একদিন জবাব দিলো, “আন্টি,আংকেল কি নিজ থেকে আপনার জন্য কিছু কিনে আনে না?নিজে পছন্দ করে? ”

বাড়িয়ালি ইতস্তত করে বলে, “আরে,ওর সময় কোথায়?আমার ওর পছন্দ ভালো লাগে না। ও এসব কেনাকাটা করতে পারে না ভালো করে। আমি নিজেই কিনি নিজের পছন্দে।”

শালুক হেসে বলে, “আমার বর আমাকে ভালোবেসে,আমার কথা মনে করে একটা গোলাপ এনে দেয় যখন, বিশ্বাস করেন আন্টি মনে হয় এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী নারী আমি। আমাদের সংসারে হয়তো বিলাসিতা করার মতো কিছু নেই কিন্তু সুখী হওয়ার মতো অনেক কিছু আছে।
মাঝরাতে আমি আমার বরের সাথে বারান্দায় বসে চাঁদ দেখতে পারি।সেই সময় কামিনী ফুলের এতো মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসে আন্টি!
আমার ছোট্ট বাসাটাকে আমার কাছে স্বর্গ মনে হয়।

আমার বর যখন আমাকে কাঁচের চুড়ি পরিয়ে দেয় পরম যত্নে,যাতে চুড়ি ভেঙে হাত কে/টে না যায়, সেই সময় আমার ইচ্ছে করে সময়টাকে এখানেই থামিয়ে রাখি।এই মধুর সময় যেনো কিছুতেই না কাটে।
আমাদের অনেকগুলো মিষ্টি মুহূর্ত আছে যেগুলো আপনার টাকা দিয়ে কেনা যাবে না আন্টি।আপনার সুখের মাপকাঠি হতে পারে দামী শাড়ি,গহনা আমার কাছে তা ভিন্ন। আমার সুখের মাপকাঠি হচ্ছে স্বামীর ভালোবাসা ।

সবার দৃষ্টিভঙ্গি তো এক না।আপনার কাছে যেটা সুখী হবার কারণ আমার কাছে সেটা মনে হয় লোক দেখানো, ফুটানি করা,নিজেকে সবার সামনে অযথাই জাহির করার প্রচেষ্টা।যার অন্তঃসার আসলে শূন্য, পুরোটাই মেকি। ”

তার পরের মাসেই বাড়িয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিলো। শালুক আপনমনে হাসতে লাগলো এসব মনে করে।

আদনানের সৌদির ভিসা হলো। টিকিট ও কাটা হলো ১৫ দিন পরের। হুট করে আদনান বাড়ি থেকে উদাও হয়ে গেলো।
বাড়িতে কেউ আদনানের খোঁজ জানে না।আদনান কাউকে কিছু না জানিয়ে ঢাকায় চলে এলো শালুকের সাথে শেষ একবার দেখা করতে।

আদনান প্রথমে এলো ধ্রুবর হলে।ধ্রুবর বন্ধুদের ফেসবুক আইডি থেকে তাদের সাথে যোগাযোগ করলো। বন্ধুদের থেকে ধ্রুবর ফোন নাম্বার যোগাড় করে আদনান কল দিলো ধ্রুবকে।
আদনানের নাম্বার ধ্রুবর ফোনে সেভ করা ছিলো। আদনানের কল পেয়ে ধ্রুব ভীষণ অবাক হলো। তার ফোন নাম্বার তো আদনানের জানার কথা না।
বাড়িতে যেই নাম্বার দিয়ে ধ্রুব কথা বলে সেটা শুধু কথা বলার সময় একটিভ করে ধ্রুব। তাহলে এই নাম্বার কিভাবে পেলো সে!
ভাবনা চিন্তা করে ধ্রুব কল রিসিভ করলো। ভাঙা ভাঙা স্বরে আদনান জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছিস ধ্রুব?”

ধ্রুবর চোখ ভিজে উঠতে চাইলো,সামলে নিলো ধ্রুব নিজেকে।নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিলো, “ভালো আছি।”

আদনান বললো, “আমি ঢাকায় এসেছি, একবার শালুককে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে পারবি?ভয় নেই,তোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবো না শালুককে। আমি জানি, নিজের জিনিসের যত্ন তুই কতো ভালো করে নিতে জানিস”

ধ্রুব বললো, “আল্লাহ ছাড়া এই পৃথিবীতে এরকম কেউ নেই আমার থেকে শালুককে আলাদা করতে পারবে।এই ভয় ধ্রুব করে না। ”

আদনান বললে, “কোথায় আসতে পারবি আমাকে টেক্সট করে জানিয়ে দিস,আমি হাজির হয়ে যাবো।”

ধ্রুব কিছু বললো না।

আদনান বললো, “আমি দেশ থেকে চলে যাবো ধ্রব।১৫ দিন পরে আমার ফ্লাইট চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট হয়ে। শেষ বার তোদের সাথে দেখা করে যেতে চাই।তোদের কাছে ক্ষমা না চাইতে পারলে আজীবনের জন্য নিজের কাছে নিজে অপরাধী হয়ে থাকবো।”

রাতে শালুক ধ্রুবর সাথে একটা রেস্টুরেন্টে এলো। কেনো আসছে সেটা ধ্রুব শালুককে আগে বলে নি। চেয়ারে আদনানকে দেখে শালুক ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। খামচে ধরে রাখলো ধ্রুবর হাত।ধ্রুব শালুকের হাত আলতো করে চেপে ধরে বললো, “আমি আছি তো।ভয়ের কিছু নেই।”

চলবে..

রাজিয়া রহমান