শালুক ফুলের লাজ নাই পর্ব-৩১+৩২

0
649

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (৩১)
শালুক ধ্রুবর এক বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে। সারা শরীর কাঁপছে তার। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা করছে।
কিছুতেই বুঝতে পারছে না শালুক ধ্রুব কেনো এলো আদনানের কাছে তাকে নিয়ে।
কষ্টে তার দুই চোখ টলমল করতে লাগলো। এই মানুষটাকে শালুক দ্বিতীয় বার দেখতে চায় নি আর। ধ্রুব তো জানতো,তবুও কেনো নিয়ে এলো!

মাথার উপর নানা রঙের আলো।এসি চলছে না,ফ্যান ও বন্ধ।শালুক টের পেলো সে যেনো ঘামছে।

আদনান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনে বসা দম্পতির দিকে।তারপর হেসে ধ্রুবকে বললো, “, কেমন আছিস তোরা?”

ধ্রুব বললো, “ভালো আছি।”

আদনান এর পর কি বলবে খুঁজে পেলো না।শালুকের দিকে লজ্জায়, ভয়ে তাকাতে পারছে না সে।কেমন গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার হঠাৎ করেই। টেবিলের উপর থেকে একটা পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে আদনান পানি পান করলো।
শার্টের হাতায় মুখ মুছে বললো, “হঠাৎ করে নার্ভাস লাগছে কেনো জানি। ”

ধ্রুব হাসলো। ধ্রুবর সেই হাসি আদনানের কলিজায় গিয়ে লাগলো। কেমন তাচ্ছিল্যের হাসি ধ্রুবর।যেনো ধ্রুবর হাসি তাকে বলছে,”তোমার মতো নির্লজ্জ মানুষ আবার নার্ভাস হয় না-কি! ”

নিজেকে ধাতস্থ করে আদনান বললো, “শালুককে আমার ছোট বেলা থেকেই ভালো লাগতো। তবে তা শুধু ভালো লাগাই ছিলো। কেননা তখন নয়নার সাথে আমার প্রেম ছিলো। নয়নার সাথে প্রেম আমি কখনো সিরিয়াস ভাবে নিই নি।এমনি কথা বলতাম যাতে সময় কেটে যায়। এরই মধ্যে বাসায় বড়রা অনেকেই টের পেয়ে গেলো ব্যাপারটা।
কারো কোনো আপত্তি দেখলাম না।আমি ও নিশ্চিন্তে নয়নার সাথে প্রেম করতে লাগলাম।
কিন্তু নয়নাকে সত্যি বিয়ে করে সংসার করবো এই মনোভাব আমার ক্ষণিকের জন্য মনে এলেও তা আমি এতো গভীরভাবে পাত্তা দিই নি। মা মাঝেমাঝে বলতেম আমি বিরক্ত হতাম শুনে।
এরপর সুযোগ এলো আমেরিকা যাওয়ার। আমার তখন দুচোখ ভর্তি নতুন স্বপ্ন। আমেরিকা! স্বপ্নের দেশ আমার।

ওখানে যাওয়ার পর আশার সাথে সম্পর্ক হবার পর আমার কেনো জানি মনে হতে লাগলো আশা আমার জন্য পারফেক্ট না।কিন্তু আশাকে বিয়ে করতে পারলে আমি রাজত্ব, রাজকন্যা দুটোই পাবো।আমার খালা ও আমাকে খাতির করতে লাগলো। ও দেশের ছেলেদের চাইতে যে বাঙালি ছেলেদের চরিত্র যথেষ্ট ভালো, তা খালা বেশ বুঝতে পেরেছেন।
তাছাড়া ওখানে ডিভোর্স, লিভ টুগেদার এসব কোনো ব্যাপার না।
খালা বাঙালি মেয়ে তো,তাই চেয়েছে আশার বিয়ে আমার সাথে হোক তাতে অন্তত তার মেয়ের সংসার ভেঙে যাবে না।
কিন্তু আমার মাথায় তখন অন্য প্ল্যান। আশা অনেকের সাথেই ক্লোজ হয়েছে, হাগ,লিপ কিস এমনকি বিছানা অবদি ও গেছে। সেসব আশার নিজের স্বীকারোক্তি।

সেই মুহুর্তে আমার মনে হলো, এরকম একটা মেয়ের সাথে আমি আজীবন থাকতে পারবো না। আবার তাকে ফিরিয়ে দিলে সোনার ডিম পাড়া হাঁস সে,অনেক কিছুই হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আমার কুটিল মন,লোভী মন,স্বার্থপর মন তো।
নিজেরটাই খুঁজে গেছে সে তাই।নিজের সুবিধা, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে লাগলো সে তাই।
বারবার মনে হতো বউ হিসেবে দরকার আমার শালুকের মতো দুষ্ট, মিষ্টি একটা মেয়ে।এর পর থেকেই মনের পর্দায় শালুকের আনাগোনা বাড়তে লাগলো।
সিদ্ধান্ত নিলাম আশাকে বিয়ে করে একেবারে আমেরিকায় সেটেল্ড হবার পর তাকে ছেড়ে দিবো।এরপর শালুককে বিয়ে করবো এতে আমার সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙ্গবে না।
আশাকে ছাড়ার জন্য উপযুক্ত কারণের অভাব হতো না আমার। দুজনের দেশ,কালচার যেহেতু আলাদা, আশা আমার সাথে এডজাস্ট করতে পারতো না আমি জানতাম।

আশার কাছে ভালো হবার জন্য আমি আশার হ্যাঁ তে হ্যাঁ, আশার না তে না মেলাতে থাকি।
আমি বোকা ছিলাম।আশা যে ভীষণ চালাক মেয়ে তা আমি ধরতে পারি নি। আশা আমাকে নিয়ে খেলছিলো। তার এই খেলা শেষ হবার আগ পর্যন্ত আমি কিছুতেই বুঝতে পারি নি।

ফোনে শালুকের সাথে মাঝেমাঝে কথা বলতাম।শালুকের বয়স কম,আমার কথা শুনে শালুক হয়তো আমাকে নিয়ে ভাবতো কখনো। আমি সেটা জানি না।শালুক কখনো আমাকে ফিডব্যাক দেয় নি। আমি বলতাম ও চুপ করে শুনতো।

এরপর আশা গোঁ ধরে বাংলাদেশে আসবে বলে। ওর আসা হয় নি এই দেশে।
আমি ভাবলাম এই সুযোগ। দেশে গেলে মা’কে বলে বিয়ের ব্যবস্থা করে নিবো।

সব ঠিক ছিলো, আশা যাতে শালুকের প্রতি আমার দুর্বলতা টের না পায় তাই আশার সামনে সবসময় শালুককে ছোট করে কথা বলতাম,হাসাহাসি করতাম শালুককে নিয়ে। কিন্তু মনে মনে শালুককে সরি বলতাম।মাঝেমাঝে ইচ্ছে হতো শালুককে বলে দিই এসব ভান শালুক,অভিনয়। শুধু তোর আর আমার ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য।

এরই মধ্যে তুই ও বাড়িতে গেলি।কিছুদিন পর টের পেলাম আশা তোর প্রতি ইন্টারেস্টেড হয়ে পড়েছে। আমার মনে হতে লাগলো এতো বছর ধরে যে মাছ আমি খেলিয়ে খেলিয়ে বঁড়শিতে গাঁথার চেষ্টা করছি সেই মাছ কিনা তুই খালি হাতেই শিকার করতে যাচ্ছিস!
তুই বল আমার কষ্ট হবে না?

আশা তোর সবকিছুতে মুগ্ধ হয়,তোর সাথে সবসময় আমাকে তুলনা শুনতে হয়।
আমার সারা শরীর জ্বলে যেতো এসব শুনে।ভীষণ রাগ হতো তোর উপর।কেনো বাড়তে এলি তুই এই ক্ষোভে তোকে মাঝেমাঝে কি যে করতে ইচ্ছে করতো বলে বুঝাতে পারবো না ।

এরপর যখন দেখলাম আশা তোর সাথে ঘুরে বেড়ায়,হাসাহাসি করে তখন আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো। আমার তখন মনে হলো কিছু একটা করতেই হবে এবার।
আমি তখন প্ল্যান করলাম।আফিফার বিয়ের আগের রাতে ঠিক করলাম তোকে ভীষণ বদনাম করে দিবো যাতে আশার মোহ কেটে যায়।
এবার ও আমার ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। শালুককে নিয়ে আমি এই প্ল্যান করি নি। আমি পাঠিয়েছিলাম শাপলাকে।কিন্তু কেনো জানি শাপলার বদলে শালুক চলে গেলো তোর রুমে।
এরপর আমি নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলাম।
আমার মুখে রা ছিলো না শাপলার জায়গায় শালুককে দেখার পর। সেই মুহুর্তে আমার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছিলো তা আমি কাউকে বুঝাতে পারি নি।

এরপর আশা ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। তখন আমার হতাশা আরো বেড়ে গেলো। আশা যদি যাবারই ছিলো তবে কেনো এতো দেরিতে গেলো?
তাহলে তো আমি শালুককে হারাতাম না।এরপর শালুক যখন বাড়ি গেলো আমার মনে হলো শালুককে সব খুলে বলতে হবে।আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু শালুক আমার সাথে কথা বলে নি। তখন আমি রাতে আবারও শালুকের রুমে গেলাম।শালুকের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার ও কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আমি শুধু এই কথাগুলো শালুককে বলতে চেয়েছি।
সেদিন ও আমি পারি নি।আজ তাই ভাবলাম আজ যদি না বলে যেতে পারি তবে সারাজীবনের জন্য আমাকে অনুতপ্ত হয়ে থাকতে হবে। আমার সব কথা বলা শেষ। এবার আমার শান্তি।”

ধ্রুব শালুক দুজনেই চুপ করে রইলো। তারপর কফি খেয়ে ধ্রুব শালুককে নিয়ে বের হয়ে এলো।আদনান চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে ।
বাড়িতে এসে আদনান শেষ বারের মতো ধ্রুবকে একটা মেসেজ পাঠালো একটা কবিতা থেকে।

“আমি কেবল একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চেখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম, ওদের ভালো হোক।

ভালো থাকিস তোরা দু’জনে। ”

সব কিছু আবারও সুন্দর করে চলছে।জীবন কেটে যাচ্ছে আপন গতিতে।শালুকের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। শালুক তখন বাড়িতে গিয়ে নির্ভয়ে থাকতে পারলো আদনান দেশে না থাকায়।

ধ্রুবর চাকরি হলো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে।

শালুকের রেজাল্ট হলো। এসএসসি পরীক্ষায় শালুক জিপিএ ৪.৮৯ পেলো।শালুকের এই সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো ধ্রুব।
অফিসের কাছাকাছি একটা কলেজে শালুককে ভর্তি করিয়ে দিলো।নতুন কলেজে,নতুন নতুন বন্ধু হলো শালুকের। পড়ালেখা, বন্ধুবান্ধব, আড্ডাবাজি,সংসার সবকিছু শালুক সুন্দর করে সামলাতে লাগলো।

কিন্তু সুখ সবসময় মানুষের কপালে থাকে না।উত্থান পতন নিয়েই জীবন। তেমনি এক বিকেলে শালুক বইয়ের ভাঁজে একটা চিঠি পেলো।কোনো একজন একটা চিঠি পাঠিয়েছে শালুককে। ভালোবাসার চিঠি।
সেই চিঠি পড়ে শালুক থরথর করে কেঁপে উঠলো। ধ্রুবকে জানাবে জানাবে করে ভয়ে জানালো না যদি ধ্রুব তাকে ভুল বুঝে এই ভেবে।তাছাড়া অফিসের কাজে ধ্রুবকে ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়।
রাতে শালুককে পড়াতে বসে ধ্রুব নিজের ফাইলপত্র নিয়ে বসে।কাজের ব্যাপারে ধ্রুব ভীষণ সিরিয়াস।
শালুককে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়ার জন্য ধ্রুব তখন মরিয়া।

এরই মধ্যে বাড়ি থেকে খবর এলো ধ্রুবর দাদী ভীষণ অসুস্থ। অফিস থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছুটলো দু’জনে।
সিতারা বেগম স্ট্রোক করেছেন।এক পাশ সম্পূর্ণ অচল হয়ে গেছে তার। ধ্রুবর হাত ধরে সিতারা বেগম বললেন, “আমার একটা কথা রাখবি ভাই?”

ধ্রুব দাদীর চামড়া কুঁচকে যাওয়া হাত শক্ত করে ধরে বললো, “রাখবো দাদী,কি কথা বলো তুমি?”

সিতারা বেগম দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন,”একবার তোর মায়ের সাথে দেখা করে আয় শালুককে নিয়ে। কতোবার যে খবর পাঠিয়েছে তোকে একটা নজর দেখতে চায় বলে। যাবি?”

ধ্রুব জবাব দিতে পারলো না। কি বলবে সে?

চলবে…….

রাজিয়া রহমান

#শালুক_ফুলের_লাজ_নাই (৩২)
বাড়িতে এই প্রথম শালুক আর ধ্রুব এক সাথে থাকবে।শালুকের খুব অস্বস্তি লাগছে এখন।হঠাৎ করে কেমন লজ্জা লাগছে। অথচ যখন ঢাকায় প্রথম দুজন এক সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে তখন ও শালুকের এরকম লাগে নি। আজ কেনো এরকম লজ্জা তাকে ঝাঁকিয়ে ধরেছে?
শালুকের সারা মুখমণ্ডল লাল হয়ে গেছে।

শাপলা এসে শালুকের পাশে বসে পড়লো। তারপর হেসে বললো, “তোকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছে শালুক।বিবাহিতা মহিলার ন্যায় লাগছে।”

শালুক লজ্জা পেয়ে বললো, “শাড়ি চেঞ্জ করে ফেলি আপা?”

শাপলা বাঁধা দিয়ে বললো, “না না,চেঞ্জ করিস না।ভীষণ সুন্দর লাগছে তোকে শাড়িতে। তুই যে এতো অপরূপা আগে কখনো খেয়াল করি নি।নজর যেনো না লাগে কারো।”

লজ্জাবতী লতার ন্যায় শালুক আরো নুয়ে গেলো এ কথা শুনে।হাসনা বেগম এলেন একটা বক্স হাতে নিয়ে। তারপর বক্স থেকে সব গহনা বের করে একে একে শালুককে পরিয়ে দিতে লাগলেন।

গলার হার,সীতাহার,কানের দুল,টিকলি,হাতের দুটো রিং,নাকের ফুল।মেয়েদের জন্য গড়িয়ে রেখেছেন তিনি এসব।আজ শালুকের গহনা শালুকের গায়ে পরিয়ে দিয়ে বললেন,”মাশাল্লাহ, আমার শালুক মা’কে আজকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। আল্লাহ যে আমার ঘর আলো করে এরকম দুটো চাঁদ দিয়েছে এতোদিন তো আমি তা খেয়াল করে দেখি নি।”

শালুক মন খারাপ করে বললো, “কেনো আগে দেখলে না মা?তাহলে অন্তত লেখাপড়া করে করে আমার মাথাটা নষ্ট করতে না।”

হাসনা বেগম হেসে বললেন,”এখন তো আর মা লেখাপড়ার জন্য বকাঝকা দিই না।এখন তবে লেখাপড়া করছে কে?”

শালুক লাজুক হেসে বললো, “তুমি দাও না,তোমার বদলে অন্য জন তো আছে।”

হাসনা বেগম মেয়ের চিবুকে হাত দিয়ে বললেন,”বড় ভাগ্য করে এরকম স্বামী পেয়েছিস মা।তাকে সম্মান দিতে শিখ। তুই বড়ই ভাগ্যবতী শালুক। ধ্রুবর মতো মানুষের স্ত্রী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।”

শালুকের মাথা নিচু হয়ে গেলো মায়ের কথা শুনে। সে জানে সে যে আসলেই ভাগ্যবতী। এরকম একজন মানুষ এই সময়ে খুঁজে পাওয়া যায়?এই বিচ্ছেদের যুগে এসে সে এরকম একজন মানুষ পেয়েছে যে কি-না তাকে দু হাতে আগলে রাখে,ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেয় যার চোখের দিকে তাকালেও নেশা ধরে যায়।ভালোবাসা দিতে যে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না,এরকম মানুষ কয়জনে পায়?

ধ্রুব রুমের দিকে আসছিলো। সাহস করে ফরিদা বেগম ধ্রুবর সামনে এসে দাঁড়ালেন।ভীষণ অবাক হলো ধ্রুব ফরিদা বেগমকে দেখে। সৎ মা হয়ে আসার পর উনি প্রথম প্রথম ধ্রুবকে ভীষণ কষ্ট দিতেন।
তারপর কি হলো কে জানে।আস্তে আস্তে তিনি শুধরে গেলেন কিন্তু ধ্রুব আর তাকে আপন করে নিতে পারলো না।কিছু মানুষ মন থেকে একবার উঠে যাওয়ার পর কিছুতেই যেনো আর মনে জায়গা করে নিতে পারে না।

ফরিদা বেগম ধ্রুবর সামনে এসে বললেন,”আমি জানি ধ্রুব,আমাকে তুমি ভীষণ অপছন্দ করো।একটা সময় আমি ও তোমাকে সহ্য করতে পারতাম না।তুমি নিজেই ভেবে দেখো না।যার বউ হয়ে এলাম সে যদি দেখি সারারাত প্রাক্তন স্ত্রীর ছবি দেখে রাত কাটায়,আমাকে গালমন্দ, গায়ে হাত তোলে তখন সদ্য বিবাহিতা সেই মেয়েটির মানসিক অবস্থা কেমন হয়?
আমার মনের কষ্ট আরো বেড়ে যেতো তখন তোমাকে দেখলে।অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে,এসে সতীনের ছেলে,সতীনের স্মৃতি এসব দেখতে হচ্ছে। আমার নরম মনে কি পরিমাণ আঘাত লাগতো তা তোমার বাবা কখনো বুঝতে চাইতো না।
আমি সেজন্য তোমার উপর অত্যাচার করতাম।একটা সময় নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারি।তোমার মা হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি কিন্তু ততদিনে আমি দেরি করে ফেলেছি।
তুমি আমাকে এরপর আর সহ্য করতে পারতে না।আমার দোষ আমি মেনে নিয়েছি বাবা।আমাকে মা বলে না মানো,কিন্তু ছেলে-ছেলের বউয়ের প্রতি শাশুড়ীর যে দায়িত্ব তা অন্তত পালন করতে দাও।তুমি আমার বড় ছেলে,তোমার বাবা তোমাদের তিন ভাই বোনের বিয়ের জন্য গহনা গড়িয়ে রেখেছেন অনেক আগে।
আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেদিন তুমি আর বউমা একই সাথে বাড়িতে আসবে সেদিন তোমার বউয়ের সব গহনা তাকে পরিয়ে দিবো।তোমার শাশুড়ী গিয়ে মেয়েকে গহনা পরিয়ে দিয়েছে আমি হতভাগি পারছি না তোমার বউকে কিছু দিতে যদি তুমি রেগে যাও এই ভয়ে।
লজ্জায় তোমার বাবা তোমার সামনে আসতে পারছে না।আমি নিজেও লজ্জিত। তবুও আজ মায়ের অধিকার নিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আজকে ও কি ফিরিয়ে দিবে বাবা?”

ধ্রুবর কেমন যেনো লাগছে।এতো বছর ধরে বুকের ভেতর যেই আগুন চাপা দিয়ে রেখেছিলো সেই আগুন আজ আবারও জ্বলে উঠতে চাইছে।
ধ্রুব বড় করে নিশ্বাস নিলো।
নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করলো, “আর কতো দিন?নিশ্বাসের বিশ্বাস আছে কি?কে জানে কখন কার মরনের ডাক চলে আসে।মিথ্যা অভিমান জমিয়ে রাখলে কি আমার শৈশবের সেই ক্ষত মুছে যাবে?
আল্লাহর কাছে সব বিচারের ভার সঁপে দিলাম আমি।এরা সবাই আমার আপন। এদের সাথে আর কতোদিন দূরত্ব রেখে চলবো?”

ফরিদার হাত ধরে ধ্রুব বললো, “বাবা কোথায়?”

ফরিদার দু চোখ জলে ভিজে গেলো। এই প্রথম ছেলে তার হাত ধরে কথা বলেছে।এই পরিবারে এসে ফরিদা শিখেছে সবাই মিলে একসাথে থাকার আনন্দ।আজ সেই আনন্দ শতভাগ পূর্ণ হলো।

ধ্রুব মায়ের সাথে বাবার রুমে গেলো। অনেক দিন পর বাবাকে দেখছে ধ্রুব।
একটা শ্যাওলা রঙের শার্ট পরে বসে আছেন চেয়ারে।সামনে একটা বই খুলে রাখা। ধ্রুব গিয়ে বাবার কাঁধে হাত রাখলো।

সেলিম সাহেব পিছনে তাকিয়ে দেখেন ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। চমকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি,ধ্রুব বাবাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
বহুদিন আগে ছেলের সাথে করা সব অন্যায় চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেলিম সাহেবের। বুকটা বিষিয়ে গেলো তার গভীর বেদনায়।
হায়!কি অবিবেচক ছিলেন তিনি তখন!রাগে,ক্রোধে কেমন অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন তিনি সেই সময় যে নিজের ছেলের সাথে অমানবিক আচরণ করতে ও তার বুক কাঁপে নি।মা হারানো ছেলেটাকে যখন তার উচিত ছিলো বুকে টেনে নেওয়া তখন তিনি তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।

আজ নিজের অন্যায় কাজের জন্য নিজেই অনুতপ্ত হচ্ছেন বারবার। চোখ বেয়ে শ্রাবণের ধারা নেমেছে। কথা বলতে পারলেন না তিনি,শুধু তার ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছিলো।
বুকের ভেতর যেনো খামচে ধরে আছে কেউ তাকে।এক অজানা হাহাকার শক্ত করে চেপে ধরেছে তার হৃৎপিণ্ড।

ধ্রুব বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলছে,”কাঁদবেন না বাবা,আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।আমি এখন বুঝি নিজের স্ত্রীর প্রতি একজন মানুষের কি পরিমাণ গভীর ভালোবাসা থাকলে সে এতো পাগলামি করতে পারে। আমার আজ আফসোস হচ্ছে যে আমার মা একজন সত্যিকার ভালোবাসার মানুষ পেয়ে ও তাকে ধরে রাখতে পারে নি। আপনি কোনো ভুল করেন নি বাবা।আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে নিজেকে সামলাতে পারতো না। ”

কাঁদতে কাঁদতে সেলিম সাহেব বললেন, “আমাকে মাফ করে দিস বাবা।আমি তোর যোগ্য পিতা হতে পারি নি। আমি তোকে ভালো রাখতে পারি নি। ”

ধ্রুব বললো, “আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই বাবা।আপনি ও আমাকে ক্ষমা করবেন,আপনাকে আমি ও অনেক কষ্ট দিয়েছি।বারবার আপনার ডাক আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি লজ্জিত বাবা।”

বাবা ছেলের এই মিলন দেখলো বাড়ির প্রতিটি সদস্য। ফরিদা বেগম একফাঁকে ছুটে গিয়ে সবাইকে ডেকে এনেছে। বাবা ছেলের সাথে সাথে সবাই কাঁদছে। কেনো কাঁদছে কেউ জানে না।এক গভীর বিষাদমিশ্রিত আনন্দ সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। নিজেরা না চাইতেও চোখ ভিজে যাচ্ছে।
বাবা ছেলের মিলনদৃশ্যের চাইতে সুন্দর কোনো দৃশ্য যেনো কেউ দেখে নি কখনো।

উপহারের পর উপহার পেয়ে শালুক অবাক।এতো গহনা তার!
অবাক হচ্ছে শালুক এসব দেখে।তার মায়ের চাইতে ও বেশি গহনা দিয়েছে ফরিদা বেগম। এতো গহনা শালুক কি করবে!
ধ্রুব রুমে আসতে আসতে অনেক রাত হলো। শাড়ি পরে ঘুমিয়ে থাকা শালুকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধ্রুবর মনে হলো,মনের মতো স্ত্রী পাওয়া ও আল্লাহর দেওয়া একটা রহমত যেনো। যাকে কাছে টানতে গেলে কোনো জড়তা আসে না,যার দিকে তাকালে মনের সব পেরেশানি কেটে যায়,যার হাসি অন্তরে সুখের দোলা দেয়,সারাদিনের সব ব্যস্ততা, ক্লান্তি যার মুখের দিকে তাকালে হারিয়ে যায় সেই তো স্ত্রী। সৃষ্টিকর্তার সব নিয়ম কি আশ্চর্য রকমের সুন্দর!
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো ধ্রুব।শালুকের কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া লাগতেই শালুক জেগে গেলো। লজ্জা না পেয়ে শালুক নিজে ধ্রুবকে চুমু খেলো। তারপর ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো। আমি ভয়ে এতোদিন আপনার কাছে লুকিয়েছি।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ভুল করেছি।আমার উচিত ছিলো সবার আগে আপনাকে জানানো ব্যাপারটা। আপনি আমার উপর রাগ করবেন না প্লিজ।”

ধ্রুব হেসে বললো, “তোমার সেই প্রেমপত্রের কথা বলতে চাও?”

শালুক চমকে গেলো শুনে।গলা শুকিয়ে গেলো তার।ধ্রুব পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো, “বউ আমার, আমি খেয়াল রাখবো না তা কি হয়?ছোট বেলা থেকে দেখেশুনে রেখেছি আর এখন বুঝি এমনি এমনি ছেড়ে দিবো ভাবছো?
তোমার বই খাতা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে আমি চিঠিটা পেয়েছি। পড়ে হেসেছি কিছুক্ষণ। কি পাগলের মতো কথা বলো তো,তুমি প্রেম করতে রাজি না হলে সে না-কি ঘুমের ঔষধ খাবে।
প্রেম ভালোবাসা এতো সস্তা না শালুক।তুমি যেভাবে ইগনোর করে যাচ্ছো সেভাবেই করো।দেখবে ওই ছেলে দুদিন পর নিজে থেকেই সরে যাবে পাত্তা না পেয়ে।আমার বউয়ের উপর আমার ভরসা আছে। ”

শালুক ফিসফিস করে বললো, “আপনি এতো ভালো কেনো?”

ধ্রুব ফিসফিস করে বললো, “বেশি ভালো?”

শালুক বললো, “হ্যাঁ। ”

ধ্রুব বললো, “তাহলে চলো আজ একটু খারাপ হই।আমার বোকা ফুল এতো সুন্দর করে শাড়ি পরেছে,আজ রাতে যদি একটু খারাপ না হই তবে এই পুরুষ হয়ে জন্মানো বৃথা যাবে।আজ সারারাত আমি ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকম খারাপ থাকবো শালুক। ”

লজ্জায় শালুক চোখ বন্ধ করে ফেললো, ধ্রুব রুমের বাতি বন্ধ করে দিলো।

চলবে…..
রাজিয়া রহমান