ইতি নিশীথিনী পর্ব-১৩+১৪

0
741

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৩তম_পর্ব

এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো নিশীর। নাম্বারটি অপরিচিত, নিশী সাতপাঁচ ভেবে ফোনটা ধরলো। তখন অপরপাশ থেকে একটা আর্তনাদ শোনা গেলো। কন্ঠটি পরিচিত, নিশীর চোখ বিস্ফারিত হলো, মুখশ্রী পাংশুটে। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“নিহিতা”

নিহিতার চাপা আর্তনাদ অস্থির করে তুললো নিশীকে। অন্যদিকে আর্তনাদ ক্ষীণ হলো, শুধু চাপা কান্নাটুকুই শোনা যাচ্ছে। নিশী ব্যগ্র হয়ে শুধাতে থাকলো,
“নিহিতা, কি হয়েছে? নিহিতা কথা বল। কি হয়ছে তোর? কাঁদছিস কেনো বোন?”

কান্নার বেগ বাড়লো। দলা পাকানো স্বরে বললো,
“নিশীপু, তুই মাহাদী ভাইয়ের বিরুদ্ধে কেস টা তুলে নে। নয়তো ওরা আমাদের শান্তি দিবে না”

নিহিতার কথাটা কর্ণপাত হতেই থমকে গেলো নিশী। মস্তিষ্ক যেনো অকেজো লাগছে। হৃদয়টা কেঁপে উঠলো। না পাত্তা দেওয়া নিকষকালো ভয়টা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। একটু সময় লাগলো নিশীর স্বাভাবিক হতে। কাঁপা স্বরে বললো,
“কি হয়েছে?”
“তুমি যখন থেকে তার উপর ধ*র্ষণের চেষ্টার মামলা দিয়েছো তখন থেকেই আমাদের সাথে বিরুপ আচারণ করছে তারা। ওয়ার্ড কমিশনার হবার জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন ঝামেলা। সেদিন রাতে হুট করেই বাবার দোকানের লাইট কেটে গেলো। দোকানের সামনে রাস্তা হুট করেই ভেঙ্গে দিলো। আজ কলেজ যাবার সময় ইমাদ হুট করে হাজির হলো। আমার সামনে বাইক থামালো। তোমাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলছিলো। আমি কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি। এখন আমাদের বাসার লাইন কেটে দিয়েছে। পানি আসছে না, কারেণ্ট নেই। বাবার এসব ভেবে ভেবেই অস্থিরতা বাড়ছে। নিশীপু, আমাদের বাঁচাও প্লিজ৷ তুমি কেসটা তুলে নাও। সোলাইমান সাহেব বলেছে কেস তুলে নিলে তারাও কেস তুলে নিবে। জানি অন্যায় আবদার কিন্তু নিশীপু প্লিজ তুমি আমাদের বাঁচাও।”

নিহিতা ডুকরে কেঁদে উঠলো। কান্নার দমকে শেষ কথাগুলো অস্পষ্ট ঠেকলো। নিশী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর শান্ত স্বরে বললো,
“আমি তো আর ও বাড়ি থাকি না নিহিতা। আমি তো সব সম্পর্কের পাঠ চুকিয়ে এসেছি, যার মুল্য ও পেয়েছি। তাহলে আমার থেকে কেনো সহায়তা আশা করছিস”
“নিশীপু এভাবে বলো না। আমাদের জীবটা জাহা*ন্নাম বানিয়ে দিয়েছে ওরা। তোমার উপরের সব ক্ষোভ আমাদের উপর দিয়ে মেটাচ্ছে। আমার খুব ভয় করছে নিশীপু। তুমি একটু দয়া করো আমাদের উপর”

নিহিতার কথাগুলো শুনতে ভালো লাগছে না নিশীর। মেয়েটিকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কখনো তার সাথে আপন পর ব্যাপারটি সে খাটায় নি। একটা কথা আছে, সম্পর্ক কখনো মুখের কথায় ভাঙ্গে না। একটা সুতো থেকেই যায়। তবে এই মামলা তুলে নিলে নিজের কাছেই হেরে যাবে নিশী। এই লড়াইটি তো তার অস্তিত্বের লড়াই। এই লড়াই এ হা*তি*য়া*র নামিয়ে দিলে বাঁচার স্পৃহাটুকুই হারিয়ে ফেলবে নিশী। কিন্তু ছোট বোনটিকেও তো ফেলে দিতে পারছে না সে। যতই হোক, চাচা-চাচীর মতো নিষ্ঠুর যে হতে পারছে না নিশী। যে বোনকে বুকে আগলে ঘুমিয়েছে তার আর্তনাদ যে ভেতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখলো নিশী। একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে ধীর স্বরে বললো,
“আমি দেখছি কি করা যায়, রাখলাম”

নিহিতা বিপরীতে কিছু বলতে যেয়েও বললো না। নিশীকে এতোটা কঠিনরুপে পাবে আশা করে নি। যে নিশীপু তার মায়ের শত কটুক্তি, তাচ্ছিল্য, অবহেলার পরও ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি তাকে বুকে আগলে নিতো। আজ সেই নিশী আপুর কন্ঠে শুধু খুঁজে পেলো কাঠিন্য, উদাসীনতা এবং শূন্যতা। সত্যি কেসটা তুলে নিবে তো নিশীপু!

ফোন রেখে চেয়ারে বসে রইলো নিশী। দোটানা জিনিসটি খুব বাজে। দ্বিধাদ্বন্দে মানুষের চিন্তাশক্তি ক্ষীন হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের উপর ভারী হয়ে যায় আবেগ। হৃদয় টলমলে হয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত হয়ে যায় এলোমেলো। নিশীর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। বক্ষস্থলে দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। মস্তিষ্ক নিরেট হয়ে আছে। এক পাশে বোনের প্রতি মাত্রাহীন ভালোবাসা তো অন্যদিকে নিজের আত্মমর্যাদা। সব ছেড়ে ছুড়ে কোথাও পাকিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার। একবিন্দু শান্তি কি জীবন তাকে দিবে না। এতোটা নির্মম কেনো ভাগ্য! এর মাঝেই কাঁধেই শীতল স্পর্শ পেলো সে৷ সাথে সাথেই কেঁপে উঠলো নিশী। সুহা চমকে উঠলো নিশীর আচারণে। তাকে সামলে নিতে বললো,
“আমি তো, ভয় পেলি নাকি?”

নিশীর ঠোঁট কাঁপছে ঈষৎ। ধরা গলায় বললো,
“নাহ”
“কাঁদছিলি?”

নিশী উত্তর দিলো না। সে অনুভব করলো তার তার ভেজা। অজান্তেই মনআকাশে বর্ষণ হয়েছে৷ টেরটিও পায় নি সে। সুহা তার পাশে বসলো। তারপর নরম গলায় বললো,
“ঘেটে আছিস?”
“একদম, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না”
“শান্ত হ। মানুষ বিপাকে পড়লেই ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। এটা উপর ওয়ালার কঠিন পরীক্ষাও বলতে পারিস। আমরা নিজেদের মাঝেই এলোমেলো হয়ে যাই। আবেগী হয়ে ভুল দিকে পা বাড়াই। একটু শান্ত হ, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে”

নিশী হাসলো। মৃদু, মলিন হাসি। মাঝে মাঝে কথা বলার মানুষের প্রয়োজনটাই বেশি থাকে। ভেতরে কুঁড়ে কুঁড়ে মরার চেয়ে কাউকে মনের ভেতর জমাট কষ্ট গুলো উজার করে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু নিশী চাইলেও তা পারছে না। সে ভয় পায়, ভয় পায় প্রত্যুষীর মতো সুহাও না পিঠ দেখিয়ে হাটা দেয়। নিশী মৃদু স্বরে বললো,
“চল, ক্ষুধা লেখেছে”

খাওয়া শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো নিশী। মাথার উপর ফ্যানটা মৃদু গতিতে ঘুরছে। এক দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ও ঘুম আসলো না তার। শরীরে ক্লান্তি তবুও যেনো ঘুমের সন্ধান পাচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণে হাহাকার করে উঠছে হৃদয়। ভাঙ্গা সম্পর্ক পুনরায় ভেঙ্গে যাবার বিষাদ নাকি নিজের আত্মমর্যাদাকে হারিয়ে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে যাবার ভয় জানে না নিশী। আচ্ছা, সাহসী হওয়া কি খারাপ, অন্যায়কে অন্যায় বলা কি খারাপ! আজ যদি মাহাদীর নোংরা প্রস্তাবের বিরোধ সে না করতো, মাহাদীর বিবাহ প্রস্তাবকে অস্বীকার না করতো তবুও কি জীবনটা এমন ছন্নছাড়াই হতো! হয়তো না, তবে যে নিশীর উজ্জ্বল আলোটা হৃদয়ের অন্তস্থলে দাও দাও করে জ্বলছে সেটি হয়তো থাকতো না। নিশী হয়তো হয়ে যেতো নির্জীব একটা মানুষ। বাহিরে মেঘের গর্জন শোনা হচ্ছে। নিশী উঠে দাঁড়ালো নিজের ব্যালকনিতে। তমসায় ঘেরা শহরটিতে অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু হয়েছে। শীতল হাওয়ায় উড়ছে নিশীর চুল। মুখে এসে পড়ছে শীতল পানির ছিটে। হঠাৎ মনে হলো, রাশভারি শান্ত কন্ঠে কে যেনো বলছে,
“নিশী মা, ভয় পাস না। আঁধারের পড়েই সূর্যোদয় হয়। তোর জীবনের আঁধার ও কেঁটে যাবে”

নিশী চোখ বুঝলো। মুখখানা ভিজছে, মন্দ লাগছে না এই অনুভূতি________

****
সকাল সকাল ডিসচার্জ নিয়ে দিলো প্রণয়। নীরার কন্ডিশন এখন অনেক ভালো। হাসপাতাল বরাবর ই খারাপ লাগে নীরার। তার সবথেকে অপছন্দের জায়গা হাসপাতাল। তাই তো যখন Development pediatrician এর কাছে তাকে নিজে যাওয়া হয় তখন সে হয়ে যায় গম্ভীর। তাই তো এই অবধি চার থেকে পাঁচটা ডাক্তার বদলানো হয়েছে তাকে। এই কারণেই প্রণয় তাড়াতাড়ি ডিসচার্জ নিয়েছে। সকালে যখন নীরার সাথে দেখা করেছিলো, নীরার স্যালাইন খুলে দেওয়া হয়েছিলো। তার শ্বাসকষ্ট ও কম ছিলো। জ্বর ছিলো না। তাই ডাক্তার ও জোর করে নি। এর মাঝে একবার নিশী ফোন করেছিলো নীরার অবস্থা শুনতে। নিশী মেয়েটির সাথে কাল প্রচন্ড রুক্ষ্ণ ব্যাবহার করেছিলো প্রণয়। সে এখনো অনুতপ্ত সেই ব্যাপারে। এর থেকেও বেশি ক্রোধ তার নিজের বোন পৃথার উপর। পৃথাকে জিজ্ঞাসাবাদটা এখনো করা হয় নি। নীরাকে বাসায় নিয়েই পৃথার সাথে নিরিবিলি কথা বলতে হবে। এর মাঝেই নার্স এলো। নীরার জামা বদলে দিয়েছে। তার ঔষধ ও বুঝিয়ে দিয়েছে প্রণয়কে। প্রণয় আলতো হাতে নীরার ছোট হাতটি ধরলো। তারপর মৃদু স্বরে বললো,
“যাওয়া যাক”

নীরা মাথা দোলালো শুধু, যার অর্থ হ্যা, এখন বাসায় যাবে সে।

******

নীরাকে নিজ ঘরে শুইয়ে দিয়েই পৃথার মুখোমুখি হলো প্রণয়। পৃথা তখন কলেজে যাবার জন্য প্রস্তুত। প্রণয়ের ডাকে বিস্মিত স্বরে বললো,
“কিছু বলবে ভাই?”
“বলবো তো অবশ্যই। তার আগে আমাকে একটু বল, ঘুমের মাঝে নীরা যখন ওয়াশরুমে গিয়েছিলো তুই কি সেখানে উপস্থিত ছিলি?”

কথাটা জিজ্ঞেস করতে পৃথা ঘাবড়ে গেলো। খানিকটা আমতা আমতা করে বললো,
“নীরা তো ওয়াশরুমে যায় নি কাল”
“সত্যি যায় নি?”

প্রণয়ের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, কন্ঠস্বর হলো গম্ভীর। পৃথা ঠোঁট কামড়ালো। চোখের দৃষ্টি বিচলিত। প্রণয় বিঃশব্দে হাসলো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“গতরাতে নিশী নীরাকে ঘুম পাড়িয়ে তারপর গিয়েছিলো। তখন নীরার চুল ভেজা ছিলো না। তাহলে কখনো ভিজলো, সত্যি জানিস না তুই?”

নীরা চুপ করে রইলো। প্রণয় তারপর বললো,
“পৃথা, চুপ করে থাকলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। বরং আমার রাগ বাড়বে৷ আমি ভেবে নিবো শুধুমাত্র নীরাকে অপছন্দ করার জন্যই তুই ওকে কষ্ট দিয়েছিস”
“আমি ইচ্ছে করে নি, ভাইয়া। বিশ্বাস কর। আসলে ও ওয়াশরুমে পড়ে গিয়েছিলো। শব্দ পেয়ে যখন আমি চগুটে আসি দেখি ও পানির কলের নিচে বসে আছে। অন্য সময় ওর ঘরের সুইচটা টিপে, কিন্তু গতকাল সেটাও করে নি। আমি যখন পৌছাই তখন ও ভিজে গিয়েছিলো”
“তাহলে এ কথাটা কাল কেনো বলো নি?”
“কারণ তুমি আমাকে বকতে”

প্রণয় গাল ফুলিয়ে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর তর্জনী দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বললো,
“পৃথা আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, এই ভুল যেনো দ্বিতীয়বার না হয়। নয়তো মা কে ফোন দিয়ে বলতে পারো যেনো তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যায়”
“বাহিরের একটা মেয়ের জন্য তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিবে?”

করুন কন্ঠে নীরা কথাটা বললো। নীরার উক্তি কর্ণপাত হতেই প্রণয় শীতল কন্ঠে বললো,
“ভুলে যেও না, সে আমার মেয়ে”
“তোমার মেয়ে নয় সে। রাস্তা থেকে তুলে এনেছো শুধু প্রাণ বাঁচাতে। নয়তো কোথাও ম*রে পড়ে থাকতো।”

এবার আর সংযত রাখতে পারলো না প্রণয়। তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো সে,
“সীমা লঙ্ঘন করো না পৃথা। আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গলে ভুলে যাবো তুমি আমার বোন”

বলেই হনহন করে নিজ ঘরে চলে গেলো প্রণয়। পৃথা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখশ্রী অপমানে লাল বর্ণ ধারণ করেছে, একটা অনাথ মেয়ের জন্য এতো দরদের কি আছে ভেবে পায় না পৃথা______

দুপুর নাগাদ নিশীর আগমন ঘটে শুভ্রনীড়ে। প্রণয় আজ কোথাও যায় নি। রফিককে দিয়েই সব কেস সামলেছে। আজকের দিন শুধু নীরার। নিশীকে দেখেই মৃদু স্বরে বললো,
“ভাগ্যিস এসেছেন, আমি ভেবেছিলাম আমার উপর রাগ করে নীরাকে ডিচ করবেন”
“আজ আমি নীরার সাথে সময় ব্যয় করতে আসি নি। এসেছি আপনার কাছে”

নিশীর কন্ঠ খানিকটা ভাঙ্গা, থমথমে। প্রণয় অবাক হয়ে বসলো,
“কি কথা?”
“আমি মাহাদীর বিরুদ্ধের কেসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি”…….

চলবে……

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৪তম_পর্ব

“আজ আমি নীরার সাথে সময় ব্যয় করতে আসি নি। এসেছি আপনার কাছে”

নিশীর কন্ঠ খানিকটা ভাঙ্গা, থমথমে। প্রণয় অবাক হয়ে বসলো,
“কি কথা?”
“আমি মাহাদীর বিরুদ্ধের কেসের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি”

প্রণয়ের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। কিছুসময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে নিশীর দিকে। তারপর মৃদু হাসি আঁকলো ঠোঁটের কোনায়। দূর্বোধ্য এক হাসি। হাসি মুখেই শান্ত কন্ঠে বললো,
“ভেতরে আসুন। গুরুত্বপূর্ণ কথা কি সদর দরজায় দাঁড়িয়েই করবেন? সময়ের ব্যাপার। পা ব্যাথা হয়ে যাবে”

******

স্টাডি রুমে একটা চেয়ারে বসে আছে নিশী। এই রুমেই সাধারণত কাজ করে প্রণয়। রুম জুড়ে দেওয়ালের সাথে আটানো বুকশেল্ফ। আর তাকে গাদা আইনের বিশাল বিশাল কালো বই। টেবিলে ডিবি হয়ে আছে পিটিশন। একের পর এক কেসের কাগজ, ডকুমেন্টস। এটুকু বোঝার বাকি রইলো না লোকটি অত্যন্ত অগোছালো এবং অপরিষ্কার৷ কতো যুগ এই টেবিল মুছে না কে জানে। তার চেম্বার অবশ্য এখানে নয়। চেম্বারটি মুজগনি। প্রণয়ের আন্ডারের ৩ জন এসিস্ট্যান্ট, একজন মুহুরি। তিনজনের সবচেয়ে কাছের রফিক। রফিক তার বিশ্বস্ত ও। বাকি দুজন প্রাকটিস করে তার আন্ডারে। নিশী অবাক নয়নে দেখলো শুধু আইনের বই গুলো। এই বই গুলো যে পড়ার বড় সাধ তার। একদিন প্রণয়ের মতোই উকিল হবে সে। জয় করবে বিশ্ব সংসার। লড়বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অথচ আজ অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতেই আসা। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো নিশী। তখন ই কফির ট্রে নিয়ে হাজির হলো প্রণয়। একটু ইতস্তত কন্ঠে বললো,
“সরি আমি একটু অগোছালো৷ আসলে কাজ করতে করতে ঘুমাই, ঘুম থেকে উঠে কোর্ট কাচেড়ী। গুছিয়ে রাখার সময় হয় না। আর কেউ যে গুছিয়ে রাখবে সেই মানুষ ও নেই। অবশ্য আমি চাই ও না আমার কাজে কেউ হাত দিক”

কথাটা বলেই কাগজের আস্তানা সরিয়ে স্বল্প একটু জায়গা করলো সে। সেখানে রাখলো ট্রে টি। এগিয়ে দিলো একটি কফির মগ। হাসি মুখে বললো,
“জানেন ই তো আমাদের বাসায় কেউ চা খায় না”

নিশী কফিটা হাতে নিলো। কফি খাওয়ার কেমন অভ্যাস নেই তার। সে চা খোর মানুষ। চা খেতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। একটু আদা, একটু লবঙ্গ, তেজপাতা অপশনাল। কড়া করে এককাপ লাল চা। সবসময় এটা যেনো নিশীর সঙ্গী। তবুও কফির মগে চুমুক দিলো সে। কফিটা ভালোই মিষ্টি। দুধ কফি, কড়া ভাব নেই। চুমুক দিতেই চোখ মুখ খিঁচলো নিশী। প্রণয় ঠোঁট চেপে হাসলো। তারপর বললো,
“আসলে মানুষ ভাবে উকিল মানেই কড়া ব্লাক কফি, আমি আবার তাদের থেকে আলাদা। দুধ দুধ, ক্রিমি, মিষ্টি কফিই আমার প্রিয়। এটা অবশ্য আমার এনার্জি ড্রিংক ও বলতে পারেন। এবার বলুন কেনো এসেছেন, কি কথা মাহাদী শেখের সম্পর্কে?”

নিশী কফির কাপটা রেখে দিলো। একটু সময় নিয়ে নিজের কথা গুলো সাজালো তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি মাহাদীর বিরুদ্ধে কেসটা তুলে নিতে চাই”
“বুঝে বলছেন কি বলছেন?”
“জ্বী বুঝেই বলছি”

প্রণয় হাসলো। বাঁকা তীক্ষ্ণ হাসি। খানিকটা তাচ্ছিল্য ও মিশে আছে সেই হাসিতে। তারপর একটু থেমে বললো,
“সেদিন যে বলেছিলেন আপনার ভয় হচ্ছে না। তাহলে আজ কেনো পিছিয়ে যাচ্ছেন? ওই দিনের এ*ট্যাকের ফল নাকি?”
“কে বলেছে আপনাকে আমি নিজের জন্য ভয় পাচ্ছি? আপনার ও একটি মেয়ে আছে। আমার অবস্থাটি বুঝতে পারছেন হয়তো”

প্রণয় এখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রয়েছে নিশীর দিকে। তার হাসি একটু দমেছে। ঘরের নিস্তব্ধতা বাড়লো। প্রণিয়ের ধারালো দৃষ্টি নিশীকে বেশ বিরক্ত করছে। লোকটি প্রায়শ এভাবেই তাকায়। তার দৃষ্টি যেনো ভেতরটাকে ও খু*বলে খায়। প্রণয় বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তারপর তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো,
“আমি আপনাকে একটু ওভারস্টিমেট করে ফেলেছিলাম। ভুলে গেছিলাম, আপনি নিশী। নিশীথিনী নন। নিশীথিনীরা তো ভয় পায় না, দমে যায় না। কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা তারা কাঠিন্যের সাথেই করে। নিশীথিনীরা আঁধারেই চলে, তারা আলোর খোঁজ করে না। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সবাই নিশীথিনী হতে পারে না। বেশ নিশী হক, যেমনটা চাইছেন তাই হবে। আমি রফিককে বলে দিবো উইথড্র করতে। তবে প্রস্তুত থাকুন আবারো কালাপানির জন্য। কারণ এখানে দুটো কেস চলছে, একটি উইথড্র হলে অপরটি জিতে যাবে। আর আমি তখন আপনার হয়ে লড়বো না”

কড়া কন্ঠেই প্রণয় কথাগুলো বললো। কন্ঠে ক্ষোভ ঝড়ছে। নিশী নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। শত কষ্টে মানানো মনটা অশান্ত হয়ে উঠলো। উচাটন শুরু হলো হৃদয়ে৷ ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
“তাহলে আমার কি করা উচিত, ওদের অন্যায় গুলো আমি সহ্য করে নিচ্ছি। কিন্তু আমার জন্য অন্য কেউ কেনো করবে তা সহ্য? জানেন ওরা কি করছে! ওরা চাচা-চাচী, নিহিতাকে টার্গেট করেছে। যতই হোক, রক্তের সম্পর্ক তো ভুলতে পারছি না। যে ঘটনা আমার সাথে হয়েছে সেটা নিহিতার সাথে হলে কিভাবে ক্ষমা করবো নিজেকে?”
“আপনি কেস উঠিয়ে নিয়ে ওরা শান্ত হয়ে যাবে? নিশী ওরা এতো সহজে আপনাকে ছাড়বে না। আপনি কেস উঠাবে ওরা পুনরায় আক্র*মন করবে। যে বোনকে বাঁচানোর আহাজারি করছে পারবেন বাঁচাতে! হয় থাকবেন জেলে নয় পঁচবেন ওদের বিষাক্ত জালে!”
“তাহলে আমি করবো”

অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো নিশী। এই প্রথম নিশীকে অসহায় রুপে দেখছে প্রণয়। যে নিশী সর্বদা চীনের প্রাচীরের মতো রুখে দাঁড়িয়ে থাকতো। আজ সে হাটু ভেঙ্গে পড়ে আছে। নিশীর অসহায়ত্ব কেনো যেনো কাঁটার মতো বিধছে প্রণয়ের কাছে। দিশ বিশেক পূর্বেও যে মেয়ে অচেনা ছিলো, তার অসহায়ত্বতে ভেতরটা দূর্বল হচ্ছে। এক অজানা প্রলয় উঠছে মনের আকাশে। প্রণয় বিসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বিশাল রুক্ষ্ণ হাতটা নিশীর মাথায় দিলো। কোমল কন্ঠে বললো,
“নিশীথিনী, আপনাকে ভঙ্গুর অবস্থায় ভালো লাগছে না আমার। আমি আপনাকে এভাবে দেখতে চাই না। আপনার অদ্রির ন্যায় দৃঢ় দেখতে চাই আমি”
“আমি কি করবো বলতে পারেন?”
“আমাকে বিশ্বাস করেন?”

নিশী মাথা তুলে তাকালো, প্রণয় দাঁড়িয়ে আছে। নিশীর মনে হলো একটা বিশাল বৃক্ষরাজী যেনো তাকে ঘিরে রয়েছে। অচেনা মানুষের এই ছায়াটা তাকে প্রশান্তি দিচ্ছে। হুট করে মন বললো,
“তুই একা নস”

মৃতপ্রায় সাহসেরা একটু একটু করে জড়ো হতে লাগলো। মূর্ছে যাওয়া আত্মসম্মানটা মাথা চড়া দিলো। বিশ্বাসের লহর উঠলো কন্ঠে। দৃঢ় স্বরে বলো,
“করি”

প্রণয় হাসলো। মৃদু কন্ঠে বললো,
“আমি আপনাকে হারতে দিবো না নিশীথিনী। নিশীথিনীরা আঁধারেও দূর্ঘমতাকে জয় করে”

নিশী কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। তার চোখ টলমল করছে। তার চোখে প্রণয়ের প্রতিবিম্ব। তার মনে হচ্ছে মানুষটি তার অপরিচিত নয় বরং চিরচেনা, চিরপরিচিত। নিস্তব্ধতা বাড়ছে। দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই। শুধুই নিস্তব্ধতা। তবুও যেনো এক অজানা প্রশান্তি ঘিরে আছে তাদের_______

******

নীরার রুমে একসাথে প্রবেশ করলো নিশী এবং প্রণয়। নীরা তখন আঁকাউঁকি করছিলো। নিশী নীরার পাশে বসলো। মৃদু স্বরে বললো,
“এখন কেমন আছো নীরা?”

নিশীকে দেখে মৃদু হাসলো নীরা। নিশী আবার জিজ্ঞেস করলো,
“আমার জন্য তোমার ঠান্ডা লেগেছে রাগ করো নি তো?”

নীরা মাথা দোলালো, সে রাগ করে নি। প্রণয় এখনো দাঁড়িয়ে আছে দরজার আছে। সে মুগ্ধ নয়নে দেখছে নিশী এবং নীরাকে। কেনো যেনো নিশী মেয়েটিকে দেখতে তার ভালো লাগে। এমন নয় যে মেয়েটি বেশ সুন্দরী বা আহামরি প্রতিভাবান। সাধারণ একটি মেয়ে, তবুও এক অবিচ্ছেদ্য আকর্ষণ অনুভূত হয়। আর নীরার সাথে তার কথোপকথন এতোটাই সুন্দর, যে ঘন্টার পর ঘন্টা তা দেখতে পারবে প্রণয়। এর মাঝেই নীরা তার বা হাত এগিয়ে দিলো নিশীর পানে। নিশী প্রথমে অবাক হলেও পড়ে বুঝতে পারলো নীরা তার গাল ধরতে চাইছে। ছোট ছোট হাতে মুছে দিলো সে নিশীর চোখের লেপ্টে থাকা প্রায় শুকনো অশ্রু। নিশী অবাক হলো। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। নীরা হাত সরিয়ে নিলো। তারপর মন দিলো নিজের আঁকাউকিতে। এলোমেলো করে আঁকলো কিছু। একটি বেড, একটি সুই। ফলে নিশী বুঝলো নীরা ভেবেছে সে ভিজে আছে, পানি না মুছলে ঠান্ডা লাগবে। নিশী নিঃশব্দে হাসলো। অবুঝ মেয়েটি এখনো বিষাদ কি তা বুঝতে পারছে না। এই জলে যে ঠান্ডা লাগে না, বরং ভেতরে জমে থাকা কষ্টের জোয়ার নেমে যায়________

*****

মধ্যদুপুর। আলিশান ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশী। হাতে ফুলের তোঁড়া৷ তাতে লেখা “গেট ওয়েল সুন”। ভবনের নেমপ্লেটটা একবার দেখলো সে। ” শেখভিলা”। ওয়ার্ড কমিশনারের রমরমা দেখে বিতৃষ্ণায় মন বিষিয়ে উঠলো তার। তারপর পা বাড়ালো গেটের দিকে। তখন ই বাঁধা দিলো দারোয়ান।
“কই যাবেন?”
“মাহাদী শেখের সাথে দেখা করা যাবে?”……..

চলবে……

মুশফিকা রহমান মৈথি