ইতি নিশীথিনী পর্ব-২১+২২

0
680

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২১তম_পর্ব

লোকটির কথাটা শুনতেই বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকলো প্রণয়। কথাটা মস্তিষ্কে ধারন করতে যেনো সময় লাগলো। ঠিক তখন ই ফোন বেজে উঠলো তার, স্ক্রিনে ভেসে উঠলো পরিচিত নাম “নিশীথিনী”। নামটি দেখতেই বুক চিরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস বের হলো প্রণয়ের। সময় অবিবাহিত না করেই ফোনটি রিসিভ করলো। ব্যস্ত গলায় বললো,
“কোথায় আছেন আপনি?”

প্রণয়ের এমন প্রশ্নে কিঞ্চিত থতমত খেয়ে গেলো নিশী। এখন ঘড়িতে সময় সকাল ছ’টা ত্রিশ। এই সময় যেকোনো বেকার কাজকর্ম বিহীন মানুষ তার বাসায় ই থাকবে। তাও বিছানার উপর, গড়াগড়ি খাওয়া অবস্থায়। নিশীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। যে নামায শেষে নাস্তা বানাচ্ছিলো। তাকে সাড়ে আটটার ক্লাস ধরতে হবে। বর্তমানে তার যেখানে আশ্রয় সেখান থেকে কলেজ কম হলেও একঘন্টার দূরত্ব। সুতরাং তাকে সাড়ে সাতটার ভেতরেই বের হতে হবে। সেকারণেই নামাযের পর আর বিছানায় গড়ায় নি নিশী। সুহা এখনো ঘুমে বিভোর। গতকাল কম ধকল যায় নি তাদের উপর। অবশেষে আশ্রয়হীন হওয়া থেকে দীপালি দিদি ই সাহায্য করলেন। শিরোমনির এখানে তার এক বান্ধবীর একটি বাসা আছে। বাসাটি বেশ ছোট। এক রুমকে পার্টেক্স এর হার্ডবোর্ড দিয়ে দু ভাগ করা। একটি বাথরুম এবং একটি ছোট রান্নাঘর। ঘরের সাথে একটা লাগোয়া বারান্দা আছে। তবে সেটা থাকা না থাকায় খুব একটা যায় আসে না। বাসার এই ধরনের স্ট্রাকচারের জন্য ভাড়া হয় না। উপরন্তু ভাড়াটাও সে তুলনায় বেশ বেশি৷ দিপালী দিদি বললো,
“দেখ আমি এতোটুকুই সহায়তা করতে পারবো। আপাতত না হয় কিছুদিন থাক। তারপর ভালো বাসা দেখে উঠে যাস। তবে হ্যা, এডভান্স পাঁচ হাজার লাগবে”
“তুমি বাঁচালে। নয়তো পথে থাকল্মতে হতো”

নিশীকে জানাতেই সেও অমত করে নি।যা নসিবে আছে সেটাকে প্রত্যাখান করা বোকামি। ফলে রাতের মধ্যে তারা সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। সকাল দশটা নাগাদ বাড়িওয়ালিকে ঘরের চাবি দেয়। তখন অবশ্য বাড়িওয়ালির সাথে এডভান্সের টাকা নিয়ে সুহার সাথে একচোট তর্কযু*দ্ধ হয়। বাড়িওয়ালি হিনহিনে স্বরে বলে,
“জেল ফেরত আসামীকে যে আশ্রয় দিয়েছি এই অনেক। আবার এডভান্স দিবো! লজ্জা করে না?”
“আন্টি আপনি কিন্তু আমাদের টাকা মে*রে দিচ্ছেন, এটা অন্যায়। চুক্তিতে এ কথা ছিলো না”
“ও সব চুক্তি ভুলে যাও। ভালোয় ভালোয় নামো নয়তো পুলিশে ফোন দিবো”
“দিন, আমিও টাকা না নিয়ে যাবো না”

পরিবেশ যখন গমগমে তখন নিশী সুহাকে শান্ত করতে বললো,
“উনার না হয় শিক্ষার অভাব, তুই ও কেনো কোমড় বেঁধে ঝগড়া করছিস?”
“এই মেয়ে কি বললে কি বললে?”
“যা শুনেছেন তাই বললাম। আপনার শিক্ষার অভাব, আপনার কথাবার্তায় সেটা বোঝা যায়। যাক টাকাটা দেওয়া লাগবে না। ওইটাকা আপনার কাছেই রাখুন। সামান্য টাকায় তো আর কেউ বড়লোক হতে পারে না। ওই টাকাটা রেখে দিন বরং। চল সুহা”

নিশীর শীতল কন্ঠে বলা কথায় সুহা ফিক করে হেসে দেয়। অপরদিকে বাড়িওয়ালি রাগে গজগজ করতে থাকেন। রাগের বশে নানা অকথ্য কথাও বলতে থাকেন কিন্তু নিশী বা সুহা তার কথাগুলো কালে তুলে না। জিনিসপত্র নিয়ে সোজা বেরিয়ে যায়। সব জিনিস পিকাপে তুলে কিশী এবং সুহা পাড়ি দেয় নতুন আশ্রয়ের ঠিকানায়। এই সবের মাঝে নিশীর ফোনটি কখনো বন্ধ হয়ে এক কোনায় পড়ে থাকে সেই খেয়াল ই ছিলো না তার। আজ সকালে ফোনটি চার্জ দিয়ে চালু করে। তখন ই প্রণয়ের কলের ম্যাসেজ গুলো আসে। মোট তেইশটা ম্যাসেজ। অর্থাৎ সে তাকে তেইশ বার ফোন করেছে। এমন কি কিছুক্ষণ পূর্বের ও একবার ফোন করেছে সে। এতোবার ফোন করার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তাই দেরি না করে নিশী নিজ থেকে ফোন ব্যাক করে। ফোন রিসিভ করতেই লোকটি এমন খটখটে প্রশ্ন করে বসলো। নিশী একটু দম নিয়ে বললো,
“বাসায়?”
“আমি আপনার বাসার নিচেই দাঁড়ানো। দারোয়ানের সাথে রীতিমতো তর্ক করছি”
“ওহ, ওই বাসা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর ওদিকে থাকি না”
“সেটা কি একটি বার জানানো যেতো না? নিজ থেকে ফোন না করতেই পারেন। আপনার ইচ্ছে। কিন্তু আমি যখন ফোন করেছি তখনও ফোন বন্ধ পাচ্ছি। গতকাল নীরাকেও পড়াতে আসেন নি। এদিকে ফোন বন্ধ। মানে যাচ্ছে তাই। এখন কি এড্রেস টা বলা যায়? কোথায় আছেন আপনি?

প্রণয়ের কন্ঠ বেশ কঠিন শোনালো৷ জ্বলন্ত লাভা যেনো গলে পড়ছে তার বাক্য থেকে। নিশী হতভম্বের মতো ফোন হাতে কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকলো। লোকটি কি কোনোভাবে মাথায় চোট পেয়েছে? তার স্ক্রু গুলো এমন বিক্ষিপ্ত কেনো? কিন্তু এটা তো এখন বলা যাবে না। রাগী মানুষদের রাগানো মানে নিজের পায়ে কু*ড়াল দেওয়া। নিশী শান্ত কন্ঠে বললো,
“বাড়ি বদলিয়েছি, ব্যাস্ত ছিলাম। তাই পড়াতে আসতে পারি নি। ফোনটা কোন প্যাকেটে রেখেছিলাম মনে ছিলো না। আর এমনেও আমার ফোনে কারোর ফোন আসে না। তাই সেটার প্রতি আগ্রহ আমার বরাবর ই কম। আর এখন দেখা করা সম্ভব নয়। আমার ক্লাস আছে। বিকালে বাসায় গেলেই না হয় দেখা হবে!”
“সমস্যা নেই। আমি ড্রপ করে দিবো আপনাকে। বুঝতে চাইছেন না কেনো! আপনাকে একনজর দেখাটা যে খুব ই জরুরি”
“আপনি এমন আচারণ করলে আমি ফোন রেখে দিবো!”
“কেমন আচারণ?”
“আজাইরা মানুষের মতো আচারণ”
“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন”
“কিছুই করার নেই আমার, যেমনটা আপনি আচারণ করবেন সেই আখ্যাই পাবেন”

প্রণয় এবার কিছুটা দমলো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সে। নিশীও ফোন কাটলো না। নীরবে ফোন কানে কিছুসময় দাঁড়িয়ে রইলো। শান্ত সকাল, রান্নাঘরের জানালায় লেপ্টে আছে গতরাতের বৃষ্টির প্রমান। ক্ষীন আলো এসে পড়ছে জানালার কাচে। তাপ এখনো মৃদু। নিশী অপাশের কন্ঠ শুনতে না পেলেও প্রণয়ের গাঢ় নিঃশ্বাস তার কানে আসছে। লোকটা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে, হয়তো কথা সাজানোর চেষ্টা করছে। নিশীর কেনো যেনো মন্দ লাগছে না। লোকটির পরিবর্তনটা কেনো যেনো চক্ষুশুল হচ্ছে না। বরং এক অন্যরকম ভালোলাগায় মিশ্রিত। তার দেওয়া লাল শাপলাগুলোর একটি অবশ্য নিজের কাছেই রেখেছে নিশী। সময়ের সাথে সাথে মূর্ছা গেছে ফুলটি। রঙ্গ ফিকে হয়ে গেছে খানিকটা। তবুও ফেলে দিতে অচ্ছে হয় নি। বরং পাঁপড়িগুলো একটা বই এর ভেতর সযত্নে রেখে দিয়েছে। বইটির নাম ও “নিশীথিনী” নীরবতা চললো বেশ কিছু সময়। এই গাঢ় নীরবতা ভাঙ্গলো প্রণয়। শান্ত কন্ঠে বললো,
“আবেগগুলো মস্তিষ্ক অকেজো করে দিচ্ছে আর হৃদয়কে ব্যাকুল। নয়তো আমার মতো মানুষ কি না রাত জেগে আলো ফুটতেও ছুটে আসে আর আপনার কাছে আজাইরা খেতাব পায়। তবুও আক্ষেপ নেই, এমন আজাইরা হতে খারাপ লাগছে না”
“আমি রাখছি”

নিশী ফোন রেখে দিলো। প্রণয় বাঁধা দিলো না। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো বেশ কিছুসময়। মৃদুমন্দা বাতাসে এলোমেলো চুলগুলো কিঞ্চিত উড়ছে, তেজহীন সূর্যের কুসুমপ্রভা মুখশ্রীতে আছড়ে পড়ছে। সেই সাথে প্রণয়ের ঠোঁটের কোনায় ও ঠায় নিলো এক চিলতে হাসি। স্নিগ্ধ, প্রশান্তিময় হাসি______

*******

নিশীকে দেখতেই নীরার চোখজোড়া চকচক করছে। নিশী তার রুমে ঢুকতেই একপ্রকার ছুটে আসে সে। নিশীর ওড়নাটা হাতে নিয়ে দু হাতে তা ঘষতে থাকে। নীরার আবেগ প্রকাশের ধরণ যে বরাবর ই আলাদা। নিশী মৃদু হাসে, তারপর তার সামলে হাটুগেড়ে বসে আলতো কন্ঠে বললো,
“কাল আসিনি তাই রাগ করেছিলে?”

নীরা উত্তর দেয় না। শুধু মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিশী তখন জিজ্ঞেস করে,
“তোমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না নীরা? একটু কথা বলতেই পারো”

নীরা এবারো চুপ করে থাকে। শুধু নিশীর ওড়নাটা আরোও শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে। নরম হাতজোড়া যেনো ছাড়তেই চাচ্ছে না নিশীকে। নিশী আবারোও হাসলো। ধীর স্বরে বসলো,
“আজ নতুন একটা খেলা খেলবো। খেলবে?”

নীরা কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো নিশীর দিকে। তারপর আস্তে করে মাথা দোলালো। সে খেলবে____

******

নিজের স্টাডি রুমে বসে আছে প্রণয়। তার চাহনী তীক্ষ্ণ। সামনে এলোমেলো হয়ে আছে কিছু কাগজ। আগামীকাল একটি কেসের শুনানি আছে। গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে অত্যাচারের মামলা। মদ খেয়ে মাতাল স্বামী আকন্দ ক্রোধের বশে স্ত্রী রমাকে ইচ্ছে মতো প্র*হার করেছে। প্রহা*রের এক পর্যায়ে রমা দাসের গর্ভপাত হয়। অবস্থা খুব করুন ছিলো। রমাকেও বাঁচানো হয়েছে অনেক কষ্টে। ফলে রমার বাবা আকন্দ দাসের উপর মামলা করেছে। আগামীকাল তার ই শুনানী। গতরাতে নির্ঘুম কাটায় সকাল থেকে তেমন কাজ করা হয় নি। তাই এখন ই কালকের সব কিছু সাজিয়ে রাখছে প্রণয়। এমন সময় দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। প্রণয় কিছুটা অসন্তোষ নিয়েই উত্তর দিলো,
“পৃথা এখন না”
“ব্যস্ত থাকলে আগামীকাল ই কথা হবে”

নিশীর কন্ঠ কানে যেতেই মাথা তুলে তাকালো প্রণয়। ক্লান্ত চোখে চাইলো নিশীর দিকে। তেজী মুখশ্রী দুদিন বাদে দেখছে সে। হাতের কাগজটি টেবিলে রেখে বললো,
“আসুন”
“আপনি তো ব্যস্ত”
“আধ ঘন্টা না হয় কম ঘুমাবো”

নিশী একটু সংকোচবোধ করলো। কিন্তু কথাটা বলাটা জরুরি তাই আসা। নিশী সামনে বসলেই প্রণয় বললো,
“এই অগোছালো টেবিলেই আজ বসতে হবে। কাগজের ভিড় আজ আর সরবে না”
“তাতে আমার সমস্যা নেই, আসলে কিছু কথা ছিলো। কথাগুলো নীরা সংক্রান্ত”

প্রণয়ের ভ্রু ঈষৎ কুঞ্চিত হলো। কন্ঠে গাম্ভীর্য এলো। সন্দিহান স্বরে শুধালো,
“নীরা সংক্রান্ত কি কথা?”

নিশী কিছুটা সময় নিলো। তারপর রয়ে সয়ে শুধালো,
“আচ্ছা, নীরা কোনো প্রিয়জনকে কি কেউ গলা চে*পে হ*ত্যা করেছে? এবং নীরা কি সেটা নিজের চোখে দেখেছে?”

নিশীর প্রশ্নে প্রণয়ের মুখশ্রী পাংশুবর্ণ ধারণ করলো। চোয়াল হয়ে উঠলো কঠিন। শান্ত চোখজোড়া ধপ করে জ্বলে উঠলো। চাহনী হলো তীক্ষ্ণ। শীতল স্বরে বললো,
“এটা মনে হবার কারণ?”

নিশী একটি দলা মোচড়ানো কাগজ এগিয়ে দিলো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় সেট খুলতেই তার চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো। কাগজটি আর কিছুই নয় বরং সেদিনের নীরার কচি হাতের আঁকা সেই ভয়ংকর তৈলচিত্র। প্রণয় কম্পিত কন্ঠে শুধালো,
“এ কার আঁকা?”
“নীরার”……….

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২২তম_পর্ব

নিশী একটি দলা মোচড়ানো কাগজ এগিয়ে দিলো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় সেট খুলতেই তার চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো। কাগজটি আর কিছুই নয় বরং সেদিনের নীরার কচি হাতের আঁকা সেই ভয়ংকর তৈলচিত্র। প্রণয় কম্পিত কন্ঠে শুধালো,
“এ কার আঁকা?”
“নীরার”

নিশীর কথাটা যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না প্রণয়। এক রাশ অবিশ্বাস এবং সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে,
“কি বলছেন আপনি? এতো ছোট বাচ্চা এমন ছবি আঁকতে পারে না কি?”
“প্রশ্নটা আমারো সেখানে, দেখুন বাচ্চাদের পক্ষে এতোটা ভয়ংকর জিনিস কল্পনা করা সম্ভব ই না। আর যদি সেটা সে কল্পনা করেও থাকে তবে আমি বলবো ও এমন কিছু একটা দৃশ্য দেখেছে। যার থেকেই এমন কল্পনা এসেছে। নয়তো একটা দশ বছরের বাচ্চার পক্ষে সম্ভব ই না এমন কিছু কল্পনা করা। আরেকটা কথা, এই ছবির ডিটেইলিং দেখুন, কল্পনাতে কি এতোটা নিঁখুত ডিটেইলিং করা যায়! এই ছবিটা ও সপ্তাহ খানেক পূর্বে একেছে। আমি প্রশ্ন করতেই ও গুটিয়ে গেছে। শুধু যে এই ড্র‍য়িং কিন্তু নয়। ওর পুরো স্কেচবুক জুড়ে এমন আঁকাউঁকি”

নিশী কথাটা বলেই নীরার স্কেচবুক এগিয়ে দিলো প্রণয়ের দিকে। আজ নীরার সাথে কানামাছি খেলার ছলে স্কেচবুক এবং কাগজটি সে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। এ ব্যাপারটি নিয়ে বহুদিন যাবৎ ই প্রণয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টায় ছিলো। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কথাটা বলা হয় নি। প্রণয় বিস্ফারিত নজরে তাকিয়ে রইলো স্কেচবুকের তৈলচিত্রগুলোর দিকে। প্রায় দু তিন পৃষ্ঠা পর পর ই কালো হাতের চিত্র। নারীর মুখ থেকে গলগল করে র*ক্ত ঝড়ছে। দৃশ্যটি যতটা হৃদয়বিদারক ততটাই ভয়ংকর৷ একটা ছোট বাচ্চার মস্তিষ্কের এমন কল্পনার বাস ও ভয়ংকর। প্রণয় অনেকক্ষন যাবৎ তাকিয়ে থাকলো ছবিটির দিকে। ধুলো পড়া স্মৃতিগুলো যেনো ধীরে ধীরে জীবন্ত হচ্ছে। সেই বিষাক্ত অনুভূতিগুলো আজও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে। নুশরাতের মৃ*ত্যুটা এখনো যেনো হৃদয়কে কাঁদায়। আজ ও মনে আছে মেয়েটার সেই কান্না জর্জরিত কন্ঠ। নিজের সন্তানকে বাঁচানোর আহাজারি। সেই আর্তনাদগুলো এখনো কানে বাজে। প্রণয়ের চোখজোড়া ঝাপসা হতে লাগলো, সেই সাথে ভেসে উঠলো সেদিনের স্মৃতিগুলো।

দিনটি ছিলো রবিবার। জুলাই মাস। শ্রাবণের ক্রন্দন চলছে তার গতিতে। কিন্তু এই বর্ষণেও বিচারকের রায় বদলায় নি। না বদলেছে নুশরাতের দৃঢ় প্রতীজ্ঞা। তার দৃঢ় পণ ছিলো, ছিলো নিজের স্বামী তৌহিদুর রহমানের হ*ত্যার সঠিক বিচার সে চাইবে। মির্জা শাহরিয়ারকে ফা*সিতে ঝু*লিয়ে দম নিবে। হয়েছিলো সেটাই। প্রমাণের ভিত্তিতে বিগত ছয় মাস যাবৎ চলমান কেসটির বিচার ঘোষণা করা হয়েছিলো। মির্জা শাহরিয়ারের ফাঁ*সির আদেশ ও দেন বিচারক। সেদিনটি ছিলো নুশরাতের জীবনের সবথেকে প্রশান্তির মূহুর্ত। প্রণয় বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ছিলো তার পাশে। যখন বিচার ঘোষণা করা হয় তখন প্রণয় তাকে বলে,
“এবার নিশ্চয়ই ঘুমাতে পারবি?”
“হ্যা, রে। এখন সত্যি ঘুমাতে পারবো। কত দিন ঘুমাই না বল!”
“তৌহিদ আজ হয়তো অনেক আনন্দিত। তোর উপর গর্ববোধ করছে। যোগ্য শাস্তি দেওয়ালি পিশাচগুলোকে”

প্রণয়ের কথায় শুধু ম্লান হাসি হাসে নুশরাত। চোখ তুলে তাকায় নীলাম্বরের দিকে। বৃষ্টি এখনো থামে নি। কালোমেঘ এখনো সরে নি। সূর্য এখনো গা লুকিয়ে রেখেছে। এমন ই এক বৃষ্টিস্নাত দিনে তাদের গল্পের সূত্রপাত হয়েছিলো। আজ ও বৃষ্টিস্নাতক্ষণ, শুধু মানুষটি নেই। আছে কিছু মূহুর্ত, কিছু স্মৃতি। যা আগলে ধরেই সামনে এগোতে হবে নুশরাতকে। নিজের জন্য নয়। নিজের মেয়েটির জন্য, নীরা। তাদের সারাজীবনের পুঁজি। নীরাকে স্বাভাবিক জীবন হয়তো দেওয়া সম্ভব নয়, তবে সুন্দর একটা তো দেওয়া যেতেই পারে। নুশরাত প্রণয়ের অগোচরে চোখ মুছে নেয়। ধীর কন্ঠে বলি,
“থাক, আমি আসছি। নীরা বাসায় একা”
“যা”

নুশরাত ছাতিটা খুলে পা বাড়ালো যাবার জন্য। প্রণয় অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো নুশরাতের যাবার দিকে। একটি মেয়ে এতোটা শক্ত হতে পারে! হয়তো পারে! প্রণয়ের ঠোঁটে আনমনে ঠাঁয় নিলো রোদেলা হাসি। কে জানতো এটাই শেষ সাক্ষাৎ হবে এই নারীর সাথ।

রাত তখন ১০ টা, প্রণয় তখন নিজ কাজে ব্যাস্ত। কাগজ পত্রে চোখ ঠেকিয়ে রেখেছে সে। মাথায় ক্ষীণ ব্যাথা। বৃষ্টিতে ভেজাটা বোকামি ছিলো। রহিম কাকাকে ফোন দিলেই গাড়ি দিয়ে আসতেন। কিন্তু সে বেশ পাঁকনামি করেই গাড়ি আনায় নি। বৃষ্টিতে ভেজার ভুত উঠেছিলো। ফলাফল তীক্ষ্ণ অসহ্য মাথা ব্যাথা। হয়তো জ্বর ও আসবে। ঔষধে আজকাল কাজ হচ্ছে না। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। মাথা ব্যাথা তখন ধীর গতিতে তীব্র হচ্ছে তখন ই অসহনীয় আওয়াজে মোবাইলটা বেজে উঠে। প্রথমে বিরক্তি নিয়েই সে ধরে নি। কিন্তু অপর মানুষটির যেনো জীবন মরন ব্যাপার। সে অক্লান্তভাবেই ফোন করছেই। বাধ্য হয়ে প্রণয় ফোনটি হাতে নেয়। ‘নুশরাত’ নামটি দেখেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। নুশরাতের এতো রাতে ফোন করাটা বেশ বিস্মিত করলো তাকে। সময় নষ্ট না করেই সে ফোনটি ধরে। ফোন ধরতেই নুশরাতের আতংকিত, কম্পিত কন্ঠ ভেসে আসে,
“প্রণয়, তুই কি একটু আমার বাসায় আসতে পারবি। ওরা বাসায় এসে পড়েছে, ওরা বোধ হয় আমাদের মে*রে ফেলবে”
“নুশরাত শান্ত হ, কি হয়েছে একটু খোলসা করে বল”
“আমার কাছে সময় নেই। পুলিশে খবর দিয়েছি। কিন্তু ওরা কতক্ষণে আসবে জানি না। আমার মনে হয় আমার সময় শেষ”

প্রণয়ের বুকে কামড় পড়লো। বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠলো সে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি আসছি, আমি আসছি। কিচ্ছু হবে না, ট্রাস্ট মি”
“শোন, শোন। আমার কথাটা একটু শোন। আমি বুঝতে পারছি আমার কাছে সময় নেই, তোর কাছে একটাই অনুরোধ। আমার মেয়েটিকে বাঁচা, ও কে একটু দেখে রাখিস। আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। অনেক বড় কিছু চাচ্ছি। যতদিন ইশরা দেশে না ফিরছে ওকে প্রটেক্ট করিস…”

নুশরাতের কথা শেষ হবার পূর্বেই তার বিকট আত্মচিৎকার শোনা যায়। সাথে সাথে ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে যায়। প্রণয় সময় নষ্ট করে না। ছুটে গাড়িতে উঠে। মাথার যন্ত্রণায় দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মোটেই থামছে সে। বুক কাঁপছে। তর তর করে ঘামছে সে। বন্ধুকে হারাতে নারাজ সে। ঝড়ের বেগে গাড়ি ছোটায় সে। মিনিট বিশেকের মাঝে পৌছায় নুশরাতের বাসায়। কিন্তু ততসময়ে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। যখন নুশরাতের বাসায় প্রবেশ করে সে। তখন সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে আছে। ঘাতকেরা প্রস্থান করেছে। নীরবতা যেন গিলে খাচ্ছে বাসাটাকে। অসার হতে লাগলো প্রণয়ের পা। মনের বিরুদ্ধে সে এগিয়ে গেলো বেডরুমের দিকে। বেডরুমে প্রবেশ করতেই বুক কেঁপে উঠলো তার। অসার দেহটি মাটিতে লুটিয়ে আছে। মুখ থেকে রক্ত পড়ছে। মাথার পেছন থেকে রক্তের স্রোত বইছে। চোখ জোড়া বিস্ফারিত ভাবে খোলা। হাত পা এ অসংখ্য আঘাতের দাগ। শীতল শরীরটা স্পর্শ করতেই প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হলো। বন্ধুটিকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। তখন আগমণ ঘটলো পুলিশের। বরাবর ই সবার শেষেই আসলো তারা। প্রণয় আশপাশ লক্ষ্য করলো। দেহ কেবল একটি। তাহলে নীরা কোথায়! দেহটিকে যখন ময়নাতদন্তে পাঠাবে তখন এস আই রবিউল বললেন,
“উনি কি একাই থাকতেন?”
“নাহ, ওর একটা মেয়ে আছে”
“সে কোথায়?”

প্রণয় উত্তর দিলো না। সে তন্নতন্ন করে খুঁজলো সারা বাড়ি। অবশেষে নীরাকে পাওয়া গেলো। আলমারীর কাপড়ের নিচে অজ্ঞান অবস্থাতে। হয়তো নুশরাত ই তাকে লুকিয়েছিলো। প্রণয় নষ্ট না করে নীরাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। নীরার যখন জ্ঞান ফিরে তখন তাকে দেখা যায় শান্ত, নির্বিকার। প্রণয় তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও যেনো ব্যার্থ হয়। সে যেনো অনুভূতিশূন্য একটা কাঠের পুতুল। না কাঁদে, না হাসে। নীরা বরাবর ই অটিজমের স্বীকার ছিলো। তবে সে কথা বলতো। বিক্ষিপ্ত হলেও কথা বলতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে যেনো সে ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে। অনুভূতিশুণ্য পূর্বেই ছিলো, আরোও যেনো সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলো। প্রণয় সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটিকে সে দত্তক নিবে। যদিও এতে পরিবারের মত ছিলো না। বিশেষ করে শেফালী বেগমের। তিনি মোটেই মেনে নিন নি, তার সন্তান একটা প্রতি*বন্ধী মেয়েকে দত্তক নেন। তার ও ভবিষ্যত আছে। এসব কারণেই ঢাকা ছেড়ে খুলনা আসে প্রণয়। উপরন্তু নুশরাতের খু*নীদের ও ধরা যায় নি। তবে তারা যে মির্জা শাহরিয়ারের কেউ তা বুঝতে বাকি থাকে না। সব মিলিয়েই নীরাকে নিয়ে এই নতুন শহরে আগমণ। শেফালী বেগমের জেদে পৃথাকে ও নিয়ে আসতে হয়। প্রণয় এখানে এসেও নীরার চিকিৎসা থামায় নি। কারণ সেদিনের ঘটনার প্রতক্ষ দর্শী এই প্রতি*বন্ধী মেয়েটি ই। সেকারণে তার সাথে কথা বলাটা খুব জরুরি। আজ একটি বছর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও নীরা চুপ। তবে আজ তার ছবি গুলো প্রমান দিচ্ছে সে চুপ নয়। সেদিনের পুরো ঘটনাই সে দেখেছে। হয়তো আলমারীর ভেতরে লুকিয়ে দেখেছে। নিজের মাকে চোখের সামনে তিলে তিলে হারিয়ে যেতে দেখেছে মেয়েটি।

নিশী অনুভব করলো তার গাল ভেজা। নীরার অতীতটা এতোটা বিশ্রী এবং হৃদয়বিদারক হবে কে জানতো। প্রণয়ের অগোচরেই চোখ মুছে নিলো সে। তারপর বললো,
“ওরা কারা, জানা যায় নি, তাই না?”
“হু, প্রমাণ নেই। আর মির্জা শাহরিয়ারের ফাঁ*সি হয়ে গিয়েছে। তাই কেসটাও বন্ধ হয়ে গেছে”
“আচ্ছা ওরা কি জানে নীরা যে ওদের দেখেছে?”
“জানি না। সত্যি জানি না। তবে আফসোস হয় জানেন তো, ওই জা*নোয়া*র গুলো ঠিক ই বেঁচে আছে। শ্বাস নিচ্ছে, খাচ্ছে, দাচ্ছে। অথচ একটি নিষ্পাপের সারাটা জীবন অন্ধকার করে। নীরা হয়তো সেই অন্ধকারকে দেখলেও ঠিক অনুভব করতে পারে না। তার মস্তিষ্ক এই অনুভূতি প্রকাশ করতে জানে না। কি অদ্ভুত না!”

নিশী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। দশ বছরের মেয়েটির কথা ভেবেও তার হৃদয়ে চিনচিনে ব্যাথা করছে। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা। তবে এতে প্রণয়ের প্রতি সম্মান যেনো বেড়ে যায়। একজন মানুষ নিঃস্বার্থভাবে মেয়েটিকে আগলে রেখেছে। এমন দৃষ্টান্ত ক জন হয়! এর মাঝেই জসীম স্যারের আংটির কথাটা মনে পড়ে নিশীর। অধৈর্য্য হয়ে বলে,
“একটা কথা বলতেই ভুলে গেছি, এই যে দেখছেন এই আংটিটা, এই আংটির খোঁজ আমি পেয়েছি………..

চলবে