ইতি নিশীথিনী পর্ব-২৫+২৬

0
698

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৫তম_পর্ব

“নিজেকে নিয়ে। আমি ধীরে ধীরে আপনাতে আসক্ত হচ্ছি। আপনার প্রয়োজনীয়তা যেনো বাড়ছে। আগে শুধু আমার ছিলো, এখন নীরাও আসক্ত হলো। কিন্তু আপনি ই বললেন যাকে ভালোবাসো তাকে মুক্ত করে দিতে হয়। যদি তোমার হয় ফিরে আসবে। আচ্ছা, আপনাকে মুক্ত করে দিলে যদি আপনি ফিরে না আসেন। কি করবো তখন? আমি যে আপনাকে ভালোবাসি, নিশীথিনী”

প্রণয়ের সরল স্বীকারোক্তির জন্য প্রস্তুত ছিলো না নিশী। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের দিকে বললে ভুল হবে। তার পলকহীন চোখের দিকে। সেই স্বচ্ছ চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে সে। এক অন্যরকম দৃষ্টি প্রণয়ের চোখজোড়ায়। সেই দৃষ্টি তার হৃদয়কে ব্যাকুল করে তুলছে। এমনটা কি হবার কথা ছিলো! মাস খানেক পূর্বেও যে মানুষটি তার নিকট ছিলো কেবল মাত্র একজন আগুন্তক। আজ তার কথা ব্যকুল করে তুলছে নিশীকে। তার ঘোরলাগা চাহনী হৃদয়ের মাঝে আলোড়ন তৈরি করছে। এমনটা কি সত্যি হবার কথা ছিলো! নিশী চোখ সরিয়ে নিলো। এই চোখজোড়া বিপদজনক। কখন তলিয়ে দিবে হিসেব নেই। প্রণয় অধীর কন্ঠে বলল,
“নিশীথিনী, আমি আপনাকে মুক্ত করলে ফিরে আসবেন? আমি খুঁজে পাবো আপনাকে? নাকি সময়ের খেলে হারিয়ে যাবেন?”

প্রণয়ের কন্ঠটা যেনো কেমন শোনালো। বিষাদের সূক্ষ্ণ আভাস পেলো নিশী। সে উত্তর দিলো না। তার কাছে যে উত্তর নেই। কি উত্তর দিবে সে! যেখানে নিজের হৃদয়ের খবর ই নেই তার কাছে। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো সে। চোখ অজান্তেই সিক্ত হয়ে উঠলো। আচ্ছা, তার জীবনটা কেনো আর পাঁচটা মেয়ের মতো কেনো নয়! কেনো সে পারে না স্বাভাবিক নারীদের মতো জীবন অতিবাহিত করতে! কেনো পারে না স্বপ্ন দেখতে। একটা সুন্দর স্বপ্ন, যে স্বপ্নে থাকবে না কোনো বিষাদ, থাকবে না ভয়! শুধু থাকবে প্রশান্তি। আচ্ছা, আজ যদি তার নামে কলঙ্কের ছিটে না পড়তো! যদি সে আগের নিশী হতো তবে কি প্রণয়ের এই আবেগ স্বীকারোক্তিতে নিজেকে আসক্ত হতে দিতো! হয়তো দিতো! অতীত ভেবে কি হবে! অতীত তো অতীত ই হয়। দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে নিলো নিশী। ধীর কন্ঠে বলে,
“আগামী ছাব্বিশ তারিখ কেসের ডেট। শুনানি হবে। যেখানে নিজের ভবিষ্যতের ঠিক নেই, কি উত্তর দিবো আমি? প্রণয় আমার কোনো ভবিষ্যত নেই। আমি জলে ভাসমান একটা খড়কুটো মাত্র। এই খড়কুটোকে জ্বালানো সম্ভব নয়! সেখানে আপনি তাকে সোনায় মুড়াতে চান। আচ্ছা, আপনি বলুন আপনার পরিবার যখন জানবে আমি জেল ফেরত আ*সামী, আমার চাচা-চাচী আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা মানবে? তাই বলি, আবেগকে দমিয়ে দেওয়াই শুভ৷ দুজনের জন্য। আপনি যদি ফিরতেও চাই, আমার ফেরার উপায় নেই প্রণয়। আপনি আমাকে ভুলে যান। ভুলে যান। প্রতিদিন একটু একটু করে আঘাত পাওয়া থেকে একেবারে আঘাত পাওয়া ভালো। এতে প্রমশন দ্রুত হয়”

প্রণয় শান্ত হয়ে কথাগুলো শুনলো। নিশীর ভেতরটা তোলপাড় করছে। কেনো যেনো খুব কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। প্রণয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। নিজের মতের বিরুদ্ধে তো কিছুই বলে নি সে। তবুও কেনো এতো অশান্তি লাগছে। কেনো মনে হচ্ছে নিজ হাতে খুব অমূল্য কিছু প্রত্যাখ্যান করছে। নিশী পা বাড়াতেই বলিষ্ঠ, রুক্ষ্ণ হাতটা শক্ত করে ধরে বসলো তার কবজি। নিশী অবাক চোখে তাকাতেই প্রণয় শীতল, ঝাঁঝমাখা কন্ঠে বললো,
“আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ নাই করলেন নিশীথিনী, তবে সেটাকে অপমান করার অধিকার আপনাকে দেই নি। এতোটা ঠুঙ্কো নয় সেটা। অনুভূতি কি গাওছিয়ায় পাওয়া জিনিস নাকি! আজ এর উপর চলে এলো, কাল ওর উপর চলে এলো! এই জীবনে একজন নিশীথিনীর কাছেই নিজেকে সপে দেবার অঙ্গিকার নিয়েছি। তা বদলাবার নয়”
“আমি যে কলঙ্কিত সমাজের চোখে”
“চাঁদেও দাগ থাকে, তাই বলে কি জ্যোৎস্নাকে অস্বীকার করে কেউ?”
“হাসালেন, আমি আর চাঁদ এক?”
“আমার জন্য আপনি সেই শুভ্র জ্যোৎস্না যাতে সিক্ত হতে ব্যাকুল থাকি আমি। আপনি বুঝবেন না নিশীথিনী। বুঝবেন না”

প্রণয়ের কন্ঠ নরম হলো। পূর্বের ন্যায় রুক্ষ্ণতা নেই। বরং হতাশা যেনো তাকে ঘিরে ধরেছে। নিশীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বিষাদমাখা কন্ঠে বললো,
“আপনাকে মুক্তি দিলাম নিশীথিনী। মুক্তি দিলাম এই উটকো আবেগের শিকল থেকে”

প্রণয়ের কথায় অভিমানের প্রকাশ পেলো। কথাগুলো তীরের মতো বিঁধছে যেনো নিশীর হৃদয়ে। কিন্তু এটাই তো চেয়েছিলো। তবে কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে। কেনো ভারী লাগছে ভেতরটা। কেনো মনে হচ্ছে সে আবারোও হারিয়ে ফেলেছে সব। নিশী আর দাঁড়াবে না। অসার পা জোড়া দিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো সে বাড়ি থেকে। প্রণয় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। মুখশ্রী কঠিন। বুকে চিনচিনে ব্যাথা। অব্যক্ত অনুভূতিগুলো বি*ষের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও বেপরোয়া চোখ জোড়া দেখে যাচ্ছে নিষ্ঠুর মানবীর প্রস্থান।

*****

বেপোরয়া শ্রাবণবর্ষণে যাত্রী ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে নিশী। শীতল বর্ষণ হাওয়ার প্রকোপে ছিটকে পড়ছে তার মুখশ্রীতে। জামার একাংশ ভিজে গেছে এভাবেই। কোনো মহেন্দ্র নেই। যাবার উপায় ও নেই। তাই নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে ছাউনিতে। মেঘের তুমুল গর্জন কানে আসছে। তবে সে তা অচিরেই উপেক্ষা করছে। তার কানে এখনো প্রণয়ের কথাগুলো বাজছে। এক অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে নিশীর। চোখজোড়া কেনো যেনো জ্বলছে! ভেতরে এক শূন্যতার আবির্ভাব হয়েছে। যা তাকে ক্রমশ খুব*লে খাচ্ছে। পাজোড়া নিস্তেজ লাগছে। বাড়ি যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না কেনো যেনো। মেঘমেদুরের আস্তরণের নীলাম্বরের দিকে চেয়ে আনমনেই আওড়ালো,
“আজ এতো নিঃস্ব লাগছে কেনো! কেনো মনে হচ্ছে আমি পরাজিত!”

এমন সময় এক মহেন্দ্র ওয়ালা তার সামনেই গাড়ি থামালো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“যাইবেন?”

নিশী মাথা দোলালো। সন্তপর্ণে গোপন করে দিলো তপ্ত নিঃশ্বাস। মহেন্দ্র চলছে পিচের রাস্তা চিরে। বৃষ্টিস্নাত হাওয়ায় উড়ছে নিশীর খোলা চুল। উদাস নয়ন দেখছে ভেসে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে________

*****

প্রণয় স্টাডিতে বসে রয়েছে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। কাজে মন বসছে না। কাগজগুলো ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সাধারণত প্রণয়ের রাগ খুব কম। যখন তখন রেগে ভাঙ্গচুর করার স্বভাব তার রক্তে নেই। সে খুব স্থির মস্তিষ্কের মানুষ। খুব রাগ হলে সে শীতল চাহনী নিক্ষেপ করে। তবে আজ যেনো সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ক্রোধ সংযত রাখার ক্ষমতা হারিয়েছে সে। ভঙ্গুর হৃদয়ের যন্ত্রণা কম ছিলো না এখন শুনছে মা আসবে আগামী পরশু। মা এর সাথে বিগত একটি বছর কথা হয় নি প্রণয়ের। নিজ থেকেই করে নি সে। কারণটি হলো নীরা। নীরাকে চক্ষুশুল লাগে শেফালী বেগমের। হবে নাই বা কেনো! এই মেয়ের জন্য প্রণয়ের বিয়ে হয় নি। ভালো ভালো মেয়ের সম্বন্ধ প্রণয় নাকোচ করেছে। শুধু এই মেয়ের জন্য। যখন ই বিয়ের প্রসঙ্গ উঠে তখন ই নীরার প্রসঙ্গ উঠে। এবং মায়ের কটুক্তির স্বীকার হয় অসহায় অনাথ মেয়েটি। সেকারণেই প্রণয় যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ মা বলা নেই কওয়া নেই আসবেন। একটু আগেই পৃথা জানালো,
“মা আসছে”

কথাটা শুনতেই কপালে ভাঁজ পড়লো প্রণয়ের। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“কেনো?”
“বাহ রে! ছেলে এখানে একটা চালচুলোহীন মেয়েতে মত্ত হয়েছে মা আসবে না?”
“পৃথা, মুখ সামলিয়ে কথা বলো”
“আমাকে সামলে নিবে! মাকে পারবে?”

প্রণয় কিছু বলে না। শুধু রক্তিম চাহনীতে তাকিয়ে থাকে পৃথার দিকে। পৃথা আজ ভয় পায় না। সে তার চাহনী উপেক্ষা করে বলে,
“তোমাকে জানাচ্ছি, যা করবে বুঝে করো”

বলেই সে হাটা দিলো নিজ ঘরে। তারপর থেকেই গা কাঁপছে তার রাগে। কিন্তু রাগ হবার তো কারণ নেই। নিশীথিনী তো তাকে ঠাঁয় দেয় নি। নিষ্ঠুর মানবী নিজের মত পরিবর্তন করে নি। সেই বেহায়ার ন্যায় প্রতীক্ষায় রয়েছে। প্রতীক্ষা নিশীথিনীর ফেরার। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠলো প্রণয়ের। বিরক্তি বাড়লো। না চাইতেও ফোনটি হাতে নিলো সে। স্ক্রিনে রফিকের নাম ভাসছে। ফোঁশ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। গম্ভীর স্বরে বললো,
“কি খোঁজ পেলে?”
“স্যার, একটা ক্লু পাইছি নুশরাত আপার খু*নের”
“কি ক্লু?”

রফিক একটু চুপ করে রইলো। তারপর রয়ে সয়ে বললো,
“তিনটে আংটির একটা আংটি বিক্রি করা হইছে মির্জা শাহরিয়ারের কাছে”

কথাটা শুনতেই চোখ বিস্ফারিত হয় প্রণয়ের, এ কি করে অসম্ভব। জেলে বসা মানুষ কি খু*ন করতে পারে……..

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২৬তম_পর্ব

রফিক একটু চুপ করে রইলো। তারপর রয়ে সয়ে বললো,
“তিনটে আংটির একটা আংটি বিক্রি করা হইছে মির্জা শাহরিয়ারের কাছে”

কথাটা শুনতেই চোখ বিস্ফারিত হয় প্রণয়ের, এ কি করে অসম্ভব। জেলে বসা মানুষ কি খু*ন করতে পারে! প্রণয়ের মস্তিষ্ক ঝিম ধরে আছে। কোনোভাবেই যেনো সে মিলাতে পারছে না সে। যখন নুশরাতের খুন হয় তখন মির্জা শাহরিয়ার অবস্থান জেলে ছিলো। তার সেই সময় ফা*সির আদেশ পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। এতো কড়া পুলিশি নিগরানির ভেতর থেকে কখনোই তার পালানো সম্ভব নয়। আর যদি পালিয়েও থাকে। তাহলে সে ফিরে এসে ফা*সির দড়িতে ঝু*লবে কেনো? কিছুতেই যেনো মেলাতে পারছে না। এর মাঝেই রফিকের ব্যগ্র কন্ঠ কানে আসলো,
“স্যার, শুনছেন? স্যার?”
“হ্যা, শুনছি। তুমি শিওর একটি আংটি মির্জা শাহরিয়ার ই কিনেছে?”
“জ্বী, স্যার”
“কেনার সময়?”
“দু বছর আগে, অর্থাৎ তৌহিদ স্যারের মৃত্যুর অনেক আগে। আর অবাককর ব্যাপার, আংটিটির মাপ হিসেবে তিনি নিজের আঙ্গুলের মাপ দিয়েছিলেন”

প্রণয় যেন রফিকের শেষ কথায় আরোও বেশি ঘেটে গেলো। আংটি নিজের মাপে দিয়েছে তার দুটো মানে হয়, প্রথম সে আংটিটি নিজের জন্য কিনেছে। দ্বিতীয় সে আংটিটি এমন কারোর জন্য কিনছে যার আঙ্গুলের মাপ তার মাপের সমান। না আর ভাবতে পারছে না৷ গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তারপর কৃথার্থ কন্ঠে বললো,
“ধন্যবাদ রফিক, তোমাকে অহেতুক কাজ দেই তবুও করে দাও। তুমি ছাড়া যে কি হতো আমার”
“এভাবে বলবে না স্যার। আপনার থেকে কতকিছু শিখেছি। আমার কাজে যদি আপনার সাহায্য হয় এই অনেক। রাখছি স্যার”
“আচ্ছা”

বলেই ফোনটা রেখে দিলো প্রণয়। ফোন কাটতেই মুখখানা গম্ভীর হয়ে গেলো তার। চোখ বুজে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। অসার মস্তিষ্ককে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ জোড়া খুললো সে। বসার ঘরের এক কোনায় পড়ে থাকা হোয়াইট বোর্ডটা আটকালো দেয়ালের পেরেকে। একটা মার্কার নিলো হাতে। তারপর একটা ট্রি আঁকলো। মির্জা শাহরিয়ারের পারিবারিক ট্রি। মির্জা শাহরিয়ার ছিলেন ঢাকার স্বনামধন্য ব্যাবসায়ীদের একজন। ভদ্র সমাজে তার ব্যবসা ছিলো মাছের। মাছ বিদেশে রপ্তানি করতো সে। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় এই রপ্তানি সম্পূর্ণ ভাওতাবাজি। এগুলো সরকার এবং আইনকে ধোঁকা দেবার ফন্দি। এগুলোর অগোচরে সে ড্রা*গ এবং মা*দ*ক*দ্রব্য পাঁচার করে। তাদের টার্গেট ছোট ছোট কলেজ পরুয়া ছাত্র, ছাত্রী। বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে একটা র‍্যা*কেট হিসেবে কাজ করে তারা। এই র‍্যা*কেট ধরার দায়িত্বে ছিলো এসপি তৌহিদুর রহমান। যখন র‍্যা*কেটের মাথা মির্জা শাহরিয়ারকে সম্পূর্ণ হাতে নাতে ধরার প্রমাণ ছিলো তৌহিদের কাছে। কিন্তু ভাগ্যের ফের। ডিপার্টমেন্টের একজন ই তার সাথে বে*ই*মানি করলো। ফলে মিশনের দিন মাকড়সার জালের মতো পেঁচিয়ে ধরে তারা তৌহিদকে তার ই দৃষ্টির অগোচরে এবং নৃ*শংসভাবে হত্যা করা হয় তাকে। অবশ্য নুশরাতের মনের জোর এবং সাহসের জন্যই মির্জা শাহরিয়ারকে ফাঁ*সি অবধি টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু লাভটা কি হলো! শেষে তাকেও চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে ফেললো।

প্রণয়ের আঁকা শেষ হলো। মির্জা শাহরিয়ারের দু ছেলে এবং এক মেয়ে। বড় ছেলে এবং মেয়ে জামাই উভয় ই তার সাথে এই নোংরা কাজে জড়িত ছিলো। শাস্তি স্বরুপ দুজনের একজনকে যাবজ্জীবন কা*রাদ*ণ্ড এবং একজনকে চৌদ্দ বছরের কা*রাদ*ণ্ড দেওয়া হয়। ছোট ছেলেটি দেশের বাহিরে থাকার দরুন তার সম্পর্কে কোনো তথ্য পুলিশের কাছে নেই। যদিও ঘটনাটি বহু পূর্বের তবুও কিছু জিনিস এখনো মস্তিষ্ক থেকে যায় নি। সেটা হলো মির্জা শাহরিয়ার ছিলেন বা হাতী। বাহাতী মানুষেরা বা হাতে আংটি পড়ে না। সে পড়বে ডানহাতে। কিন্তু নীরার ছবিটিতে লোকটির আংটিটি ছিলো বা হাতে। খু*নী আর সেই হোক মির্জা শাহরিয়ার নয়। সম্ভব ই না। প্রণয় আবারো ফোনটি হাতে নিলো। রফিককে ফোন লাগালো। দুবারের বেলায় রফিক ফোনটি ধরলো,
“জ্বী, স্যার বলুন”
“আরেকটু সাহায্য লাগবে রফিক”
“বলুন স্যার”
“মির্জা শাহরিয়ারের ছোট ছেলেটার তথ্য বের করো। নাম, ঠিকানা সব”
“কেনো স্যার?”
“আমার একটা ধারণা বুঝলে আংটিটি শাহরিয়ার নিজের জন্য কিনে নি। কিনেছে ছোট ছেলের জন্য”
“কিভাবে বুঝলেন স্যার?”

রফিকের কন্ঠে বিস্ময়। সে বুঝতে পারছে না, প্রণয় কিভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌছালো। যে ছেলে দেশেই থাকতো না, তার জন্য আংটি কেনো কিনবে? প্রণয় ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো তারপর বললো,
“এজন্য ই আমি মাহতাব হোসেন। ছাড়ো, তুমি শুধু ওর খোঁজ বের করো”
“জ্বী স্যার”

বলেই ফোনটি রেখে দিলো রফিক। প্রণয় জানে না সে কি অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছে কী না। তবে তার মনে হচ্ছে মির্জা শাহরিয়ারের ছোট ছেলেটিও এসব কাজে জড়িত। এবং সে দেশেই আছে। বাহিরে যায় নি। এখন শুধু সেই মানুষটিকে জানার অপেক্ষা_____

*****

নিশী কাথামুড়ে শুয়ে আছে। হালকা করে ঘুরছে মাথার উপরের ফ্যান। ক্যাচর ক্যাচর শব্দ হচ্ছে। এতে বিরক্তি বাড়ছে বই কমছে না নিশীর। ভালো লাগছে না নিশীর। সকাল থেকে মাথাটা খুব ব্যাথা করছে। সামান্য ব্যাথাও যেনো প্রকান্ড রুপ নিচ্ছে। তাই তো ঘরের সব পর্দা টেনে রেখেছে সে। যেনো আলো প্রবেশ না করে। তাই বোঝা মুশকিল এখন সময়টা কি! কোন প্রহর! মধ্যদুপুর নাকি গোধুলী বিকেল। সুহা দু তিনবার ডাকলো তাকে কিন্তু লাভ হলো না। হার্ডবোর্ডের দরজাটি খুললো না। শুয়েই আছে। চোখগুলো জ্বলছে। তাপ তাপ অনুভূত হচ্ছে হালকা। হয়তো জ্বর আসবে। মনের অসুখটা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তো কলেজ ও যায় নি। নীরাকেও পড়াতে যাবে না আজ৷ এতে অবশ্য একটা লাভ হলো। প্রণয়ের মুখোমুখি হতে হবে না। ভেতরটা জ্বলবে না। নিশী অবশেষে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলো। সে অজান্তেই উকিল মহাশয়ের প্রতি আসক্ত হয়েছে। আসক্তিটি গাঢ় একটা অনুভূতি। যা ধীরে ধীরে গরলের মতো ছড়াচ্ছে রক্তে। প্রণয়ের মুখোমুখি হওয়া মানে সেটা আরোও গাঢ় হওয়া। ব্যাথা দ্বিগুন হওয়া। নিশীর মাথা ব্যাথাটা বাড়লো। উঠে ঔষধ খাবার ইচ্ছে হচ্ছে না। এর মাঝেই সুহার আগমন ঘটলো। রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“এই খাবি না তুই? ঘোড়ার মতো আর কতসময় ঘুমাবি?”
“ইচ্ছে করছে না। আসছিস যখন একটা টাফনিল দে। মাথা ব্যাথা করছে”

সুহা এসে পাশে বসলো। তার হাতটা ঠেকালো নিশীর কপালে। সুহার শীতল হাতের স্পর্শ পেতেই নিশী ঝাঁঝিয়ে উঠলো,
“বরফ ঘষে আসছিস, এতো ঠান্ডা কেনো?”
“বাছা আমার হাত ঠান্ডা না তোমার গা গরম। জ্বর আসছে বিনা নিমন্ত্রণে। আরোও ভিজো বৃষ্টিতে”

কথাটা শুনতেই চুপ হয়ে গেলো নিশী। হ্যা, সে বৃষ্টিতে ভিজেছে। একবার নয় দু বার। হয়তো সেকারণেই হ্বরে আগমন। নিশী তেমন পাত্তা দিলো না। রক্তিম, ক্লান্ত চোখজোড়া মেললো। তারপর বললো,
“বাদ দে, ঔষধ দে”

সাথে সাথেই খেঁকিয়ে উঠলো সুহা। বললো,
“আগে দেখি জ্বর কত! তারপর খেয়ে ঔষধ খাবি”
“খেতে ইচ্ছে করছে না”
“সে বললে হবে না। বেশি বকলে আবারো পানিতে চুবানি দিবো”

নিশী আরর কিইছু বললো না। নির্বিকার চিত্তে কাঁথা টেনে ওপাশে মুখ করে শুলো। সুহা থার্মোমিটার নিয়ে এলো। পারদে তাপ উঠলো একশত চার। সুহা বললো,
“এতো জ্বর বাধালি কিভাবে? এ তো যে সে জ্বর লাগছে না! প্রেম করলে বলতাম প্রেম জ্বর। কিন্তু তোর জন্য সর্বোচ্চ ম্যালেরিয়া জ্বর হতে পারে। নয়তো ডেঙ্গু”

সুহার কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলো নিশী। একটা মানুষ জ্বরের মাঝে শুয়ে আছে, আর সুহার বচনে সমবেদনার ছিটেও নেই। উল্টো বলছে এ নায়াকি ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গু। নিশী একটু নড়ে চড়ে উঠে বসলো। চুলগুলো দু হাত দিয়ে ঠেলে পেছনে নিলো। তারপর বললো,
“তুই একটা অমানুষ”
“জানি”

বলেই উঠে দাঁড়ালো সুহা। তারপর খাবার নিয়ে আসলো। নিজ হাতে খাইয়ে দিলো নিশীকে। নিশীর চোখ অজান্তেই ঝাপসা হয়ে উঠলো। কতোদিন কেউ এভাবে খাইয়ে দেয় না। আজ হুট করেই বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। সে বিকালে বাবা মারা গেলেন, সেই দুপুরেও নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিলো নিশীকে। সেই উষ্ণতা, সেই ভালোবাসা কতো দিন পায় নি হিসেব নেই। সুহা অবাক কণ্ঠে বলল,
“কাঁদছিস নাকি?”
“না”

বলেই স্মিত হাসলো নিশী। তার হাসিতেও লুকিয়ে ছিলো তীব্র বিষাদ_________

*****

মধ্যদুপুর। নীলাম্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সফেদ মেঘ। রোদের তেজ প্রকোপ৷ বোঝা যাচ্ছে শরতের আগমন ঘটেছে। ভাদ্রের প্রথম দিন। সকালে দক্ষিণে মেঘ করলেও সেই মেঘের এখন হদিস নেই। প্রণয়ের দরজার বেল বাজালো নিশী। তিনদিন পর প্রণয়ের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়ালো নিশী। জ্ব্বালাময়ী জেদী জ্বরের অবসান ঘটেছে ঠিক কিন্তু শরীরটা দূর্বল। ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আছে শরীর। তবুও নীরাকে পড়াতে এসেছে সে। যতই হোক এটা এখন তার রুজিরুটি। আর এই সময় প্রণয় কোর্টে থাকে। তাই দেখা হবার সুযোগ নেই। মিনিট পাঁচেক কলিংবেল দেবার পর অবশেষে দরজা খুললো এক অচেনা নারী। তাকে এ বাড়িতে আগে দেখে নি নিশী। শুভ্র মুখশ্রী, টানা টানা চোখ, মাজা অবধি ঘন কালো কেশ। পরণে একটি লম্বা কামিজ আর জিন্স। নিশীকে দেখে অবাক চাহনীতে তাকিয়ে রইলো সে। তারপর মৃদু স্বরে বললো,
“কাকে চাই?”
“আমি নীরার শিক্ষক। আপনি কে?”

বেশ জড়তা নিয়ে উত্তর দিলো নিশী। তারপর কি ভেবে প্রশ্নটা ও করলো। নিশীর প্রশ্নে হাসলো মেয়েটি। স্নিগ্ধ হাসি। তারপর বললো,
“ধরুন এ বাড়ির ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ”……….

চলবে