#ইতি_নিশীথিনী
#২৭তম_পর্ব
নিশীকে দেখে অবাক চাহনীতে তাকিয়ে রইলো সে। তারপর মৃদু স্বরে বললো,
“কাকে চাই?”
“আমি নীরার শিক্ষক। আপনি কে?”
বেশ জড়তা নিয়ে উত্তর দিলো নিশী। তারপর কি ভেবে প্রশ্নটা ও করলো। নিশীর প্রশ্নে হাসলো মেয়েটি। স্নিগ্ধ হাসি। তারপর বললো,
“ধরুন, এ বাড়ির ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ”
কথাটা বলতেই মেয়েটির হাসি প্রসস্থ হলো। নিশী ঠিক বুঝলো না কেমন প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিত। সে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো। এর মাঝেই মধ্যবয়স্ক কারোর কন্ঠ কানে ভেসে এলো,
“মায়া, কে এসেছে?”
“নীরার টিচার আন্টি”
মায়া নামক মেয়েটি স্বর বাড়িয়ে কথাটা বললো। মহিলা এগিয়ে এলেন। পরণে সাদা কালো একটি সুতির শাড়ি, মুখশ্রীতে বয়সের ছাপ, চোখে সোনালী বর্ডারের একটি চশমা। কাঁচাপাকা চুলগুলো খোঁপায় আটকে রেখেছেন তিনি। নিশী ইতস্তত ভাবেই সালাম দিলো। তিনি বেশ ভারী কন্ঠে সালামের উত্তর দিলেন। তারপর ভ্রু কুঞ্চিত করে থমথমে কন্ঠেই শুধান,
“কি পড়ান আপনি নীরাকে?”
“জ্বী?”
“বললাম মেয়েটিকে কি পড়ান?”
মহিলার প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো নিশী। সে সত্যি ই নীরাকে কিছুই পড়ায় না। শুধু নীরার সাথে কথা বলে, খেলাধুলা করে, তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে, তার অব্যক্ত অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করে। নিশী একটু সময় নিলো কথা গোছানোর জন্য। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“আমি ওকে ঠিক পড়াই না, শেখাই। কারোর কাছে কিভাবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে হয়”
“একটা এব*নর*মাল*কে শিখিয়ে কি হবে? যা তাই, শুধু শুধু কাড়ি কাড়ি পয়সার অপব্যাবহার”
মহিলা কথাটি হাসিমুখে বল্লেও সেই হাসির ফাঁকে ছিলো একদলা তাচ্ছিল্য। তার কথাটা শুনতেই তাজ্জব বনে গেলো নিশী। অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। খানিকটা বিরক্ত ও হলো সে। বিরক্তি দমিয়ে ধীর গলায় বললো,
“নীরা সাধারণ নয়, আলাদা। আসলে ও এই সমাজের স্বাভাবিক মানুষদের মতো হৃদয়ে বি*ষ ধারণ করে রাখতে পারে না। তার মনের ভেতর সাদাকালো প্যাঁচ নেই। নিজের জগতেই থাকে। ওর এই স্বভাবকে এব*নর*মা*লিটি না বলে স্পেশালিটি বললেই খুশি হতাম”
নিশীর কথাটা শুনতেই মুখের হাসির মিয়ে গেলো মহিলার। তার কপালে পরলো তীক্ষ্ণ ভাঁজ। বিরস কন্ঠে বললেন,
“কথাতো বেশ ভালোই বলতে পারো!”
“ধন্যবাদ, নীরা কোথায়?”
“ঘরে”
“আচ্ছা”
নিশীর সরাসরি নীরার ঘরের দিকে প্রস্থান করলো। মায়া একটু হেসে বললো,
“এবার বুঝলে কেনো তোমার ছেলে এতে মত্ত হয়েছে! আলাদাই একটা ভাব”
“সেটাই দেখছি”
মহিলা বিড়বিড়িয়ে বললেন। মহিলাটি আর কেউ নয়, প্রণয়ের মা শেফালী বেগম। আজ সকালেই এসেছেন তিনি। পৃথা বহুপূর্বেই নিশীর কথা জানিয়ে দিয়েছিলো শেফালী বেগমকে। তাই তো মেয়েটিকে নিজ চোখে পরখ করতেই তার এখানে আসা। প্রথম নজরেই মেয়েটির কথা তার পছন্দ হয় নি। সে তার ছেলের জন্য পুতুলের মতো একটি বউ চায়, সে হবে সরল, সোজা, নরম, স্নিগ্ধ অনেকটা জলেফোঁটা পদ্মের মতো। কিন্তু মেয়েটির বচনভঙ্গীতে সে অবগত, মেয়েটি কোনো কোমল পদ্ম নয় বরং বিষাক্ত ক্যাকটাস। শেফালী বেগম কথা বাড়ালেন না, চলে গেলেন নিজ ঘরে। মায়া দরজা আটকে দিলো। তার বেশ কৌতুহল। কৌতুহল নিশী নামক মেয়েটিকে নিয়ে। মেয়েটির মাঝে কিছু একটা আছে, নয়তো মাহতাব হোসেনের মতো মানুষের মনে জায়গা করা কি এতোই সহজ। কই অনেকেই তো চেষ্টা করেছে, সফল একজন ও হয় নি। মায়ার মনে হতো প্রণয় ব্যাক্তিটির হৃদয়ের পথ একটি দুর্গম উপাত্যাকা, যা পাড়ি দেওয়া সময়নষ্ট। অথচ নিশী নামক মেয়েটি বিনা প্রচেষ্টাতেই সেই পথ অতিক্রম করে ফেললো। তাই কৌতুহল হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়___________
জানালার গ্লাসে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে নীরা। অবসন্ন চোখজোড়া তাকিয়ে আছে ভাসমান ধুসর মেঘের দিকে। আজ সূর্যের আলোতে তেজ নেই। বরং বৃষ্টি হবার তাল যেনো বেশি। মৃদু শীতল বাতাস বইছে। কিন্তু থাই গ্লাস ভেদ করে সেই বাতাসের আসার সামর্থ্য নেই। নিশী চটের ব্যাগটা রাখলো বিছানার উপর। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে হাটু গেড়ে বসলো, তারপর ধীর কন্ঠে শুধালো,
“কি দেখো?”
নীরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো নিশীর দিকে। নিশীকে দেখে তার চোখজোঁড়া চকচক করে উঠলো। হুট করেই নিশীর বুকে মুখ লুকালো। নীরার এমন কাজে বেশ অবাক হলো সে। নীরা এর পুর্বে কখনোই নিশীকে জড়িয়ে ধরে নি। এই অনুভূতিটি নিশীর জন্য খুব নতুন। সে হতবিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীরা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। তার ছোট ছোট হাত শক্ত করে আকড়ে আছে নিশী জামা। কিঞ্চিত বিস্মিত কন্ঠে নিশী বললো,
“কি হয়েছে নীরা?”
বরাবরের মতো এবারো উত্তর দিলো না সে। শুধু নিশীকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। নিশীও আর শুধালো না কিছু। নীরার মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে ধীর স্বরে বললো,
“সব ঠিক হয়ে যাবে। কালো মেঘ সরে যাবে”
কুসুম আলোর কিরন প্রবেশ করলো থাই গ্লাস ভেদ করে। কাঁচা সোনার মতো আলো। নীরা এখনো জড়িইয়ে ধরে আছে নিশীকে। নিশীর মন্দ লাগছে না। নীরার মাঝে কোথাও না কোথাও নিহিতাকে খুঁজে পায় নিশী। তাই তো অজান্তেই মেয়েটিকে খুব স্নেহ করে। শেফালী বেগম যখন তাকে কটুক্তিতে সম্বোধন করেছেন তখন সে চুপ করে থাকতে পারে নি। নিশী নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বললো,
“ছাঁদে যাবে?”
নীরা মাথা নাড়ালো। সে যাবে না। সে ঘর থেকে বের হবে না। সে এখানেই থাকবে। নিশী তখন বললো,
“বেশ, চলো আমরা আজ পাখি বানাই। তারপর সেটা উড়াবো”
নীরা কিছু বললো না। নিশীকে ছেড়ে নিজের টেবিলের কাছে চলে গেলো। রঙ্গিন কাগজগুলো নিয়ে আসলো। অর্থাৎ সে পাখি বানাবে। বিকেল গড়ালো, কিছু রঙ্গিন কাগজের ভাঁজে উড়লো কিছু স্বপ্ন। ছোট ছোট হাতের এবড়োখেবড়ো স্বপ্ন________
****
রফিক মুখখানা কালো করে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়ের সামনে। আগামী ছাব্বিশ তারিখ শুনানী, সে্টার প্রস্তুতি চলছে। প্রণয় ভ্রু কুঞ্চিত করে স্থির চাহনীতে তার সকল সাক্ষীতের নাম, এবং রিপোর্ট পর্যাবেক্ষণ করছে। পুলিশি তদন্তের ব্যাপারটাও বেশ ঘোলাটে। মাহাদী এখনো প্যারালাইসড। তার শারিরীক উন্নতি হয় নি। ব্যাপারটি ক্ষতিকর, ক্ষতিকর নিশীর জন্য। প্রতিরক্ষার জন্য কাউকে আ*ঘাত করাটা ক্রাইম না হলেও কাউকে আঘাত করে শারিরীকভাবে পঙ্গু করে দেওয়াটা ক্রাইম। আর সোলাইমান শেখের ক্ষমতা, বিত্তের কিছুর অভাব নেই। সে চাইলে কেসটি খুব সহজেই দফা রফা করে দিতে পারেন। যদিও প্রণয় প্রস্তুত দ্বিতীয়বার আপিলের জন্য। তবে এতে নিশীকে জেলে যেতে হবে পারে। প্রণয়ের মুখশ্রী কঠিন হলো। নিশীর যত সহপাঠী আছে তারা প্রথমে সাক্ষী দিতে রাজী হলেও পরমূহুর্তেই তারা নাকোচ করে দিচ্ছে। হয়তো সোলাইমান শেখের ক্ষমতার জন্যই এমন হচ্ছে। তারা ভয় পাচ্ছে পাছে নিজেদের জীবনে ঝামেলা না বয়ে আনে। মাত্র দুজন এখনো কথার নড়বড় করে নি। প্রণয় বা হাতে কপাল টেনে বললো,
“এরা নড়বে না তো?”
“জানি না স্যার, ইমাদ হুমকি দিচ্ছে। একজনকে তো মেরেছেও”
“পুলিশে জানিয়েছো?”
“রিপোর্ট লেখে নি। অসি দীপঙ্কর হালদার তো বলেই দিয়েছেন এসব টুকটাক ব্যাপারে তারা সাহায্য করবে না”
“মানে কি? কোর্ট থেকে প্রটেকশনের ওর্ডার আছে”
“কিন্তু যাকে প্রটেকশন দিবেন সেই তো বলছে আমার প্রটেকশন লাগবে না। স্বীকার করছে না ইমাদ তাকে মেরেছে”
রফিকের কথায় বিরক্তি বাড়লো প্রণয়ের। ডানহাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে হাতলে আঘাত করলো সে বিরক্তি দমাতে। তবুও মুখভঙ্গির বদল হলো না। আইনের মানুষ ই যদি টাকার বিনিময়ে নিজেকে বিকিয়ে দেয় সেখানে মানুষ কোথায় সুরক্ষিত! রফিক একটু রয়ে সয়ে বললো,
“এখন যদি এটা প্রমাণ করা যেতো মাহাদী অসুস্থতার ভান করছে তাহলে কেস আমাদের পক্ষে হতো”
কথাটা শুনতেই প্রণয় তার দিকে তাকালো। আগ্রহ নিয়ে বলল,
“কি বললে?”
“মাহাদী অসুস্থতার ভান করছে”
“বিংগো, আচ্ছা, ওর ডাক্তার কে”
“ডা. সাদাত আহমেদ, নিউরোলজিস্ট”
“উনার একটা এপোয়েন্টমেন্ট নাও। কিন্তু ছদ্দনামে, কেউ যেনো না জানে আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই”
“লাভ কি তাতে?”
বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো রফিক। প্রণয় ঠোঁট প্রসস্থ করে হাসলো। এই হাসির অর্থ দুর্বোধ্য ঠেকলো রফিকের কাছে। হাসি অক্ষত রেখেই বললো,
“সময় আসলেই জানবে। তুমি যেতে পারো”
রফিক মাথা দোলালো। প্রণয়ের অনেক কাজ ই সে বুঝে না। মাঝে মাঝে বুঝতেও চায় না। সে যেতে ধরলেই প্রণয় পিছু ডাকে তাকে।
“শোনো”
“জ্বী স্যার”
“মির্জা শাহরিয়ারের ছোট ছেলের কি খবর? পেয়েছো কোনো তথ্য?”
“আসলে স্যার, তার খোঁজ করা বৃথা…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#ইতি_নিশীথিনী
#২৮তম_পর্ব
রফিক যেতে ধরলেই প্রণয় পিছু ডাকে তাকে,
“শোনো”
“জ্বী স্যার”
“মির্জা শাহরিয়ারের ছোট ছেলের কি খবর? পেয়েছো কোনো তথ্য?”
“আসলে স্যার, তার খোঁজ করা বৃথা”
রফিকের হতাশ কন্ঠে কথাখানা বললো। তার কথাটা শুনতেই ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত হয়ে এলো প্রণয়ের। বিস্ময় নিয়ে বললো,
“কেনো? বৃথা কেনো?”
“কারণ সেই মানুষটি বিগত দশ বছর ধরেই দেশের বাহিরে। ওর যা ডকুমেন্ট খুঁজে পেয়েছি তাতে খুব একটা লাভ হবে না”
“একবারও দেশে ফিরে নি সে?”
“না স্যার, আমি যা যা জানতে পেরেছি তা হলো ছোট ছেলের নাম মির্জা হাফিজ। সে ও লেভেল পর্যন্ত সাউথ ব্রিজে পড়াশোনা করে। তারপর তাকে দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ায়। তারপর আর দেশে আসে নি সে। কেউ তাকে দেখে নি। বয়স হিসেব করলে এখন পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। এই যে কিছু ছবি, যা ছোট বেলার। মির্জা শাহরিয়ারের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তোলা। এছাড়া আর কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি”
বলেই মোবাইল এগিয়ে দিলো রফিক। বেশ কিছু ছবি সে যোগাড় করেছে। কিন্তু প্রতিটি ছোটবেলার ছবি। মির্জা শাহরিয়ারের সাথে বিভিন্ন পার্টি, অনুষ্ঠানে তোলা। আট-দশ বছরের বাচ্চার ছবি দেখে কখনোই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মানুষের চেহারা কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু একটা ব্যাপার কিছুতেই তার মস্তিষ্কে ঢুকছে না একজন ছেলে তার বাবার মৃ*ত্যুতেও দেশে ফিরে নি! ব্যাপারটি অবাককর নয়! কিছুতেই যেনো হিসেব মিলছে না। কিছু একটা ভেবে বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
“শাহরিয়ারের মৃ*ত্যুতেও সে অনুপস্থিত ছিলো?”
“জ্বী স্যার, তাই তো জানলাম”
“তাদের সম্পর্ক কেমন ছিলো? না মানে এক ছেলে বাবার সব ব্যবসায় জড়িত ছিলো, মেয়ে জামাইকেও ছাড়ে নি শাহরিয়ার। তাহলে ছোট ছেলের বেলায় নিয়ম ভিন্ন কেনো? এতো ছোট বেলায় তাকে বাহিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে!”
প্রণয়ের প্রশ্নে রফিক একটু নড়েচড়ে উঠলো। কিছু একটা ভেবে বললো,
“এভাবে তো ভাবি নি স্যার”
“ভাবো নি ভাবো! আর শোনো কি স্কুলের নাম বললে?”
“সাউথ ব্রিজ”
“খোঁজ নাও। তার স্কুল জীবন কেমন ছিলো? মানে বড়লোকের ছেলে, কোনো হিস্টোরি আছে কিনা?”
প্রণয়ের ইঙ্গিত বুঝতে বাকি রইলো না রফিকের। কিন্তু প্রত্যুত্তরে ইতস্ততভাবে বললো,
“ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল স্যার, ওরা কি বলতে চাবে? ওরা তো নিজেদের রেপুটেশন রক্ষা করতেই ব্যাস্ত। উপরন্তু দশবছর আগের ব্যাপার, মির্জা সাহেব যেমন বিত্তবান যদি কিছু ঘটেও থাকে ধামাচাপা দেওয়া খুব কঠিন নয়”
রফিকের কথার যুক্তি আছে। দশ বছর পূর্বের ঘটনা খুঁজে বের করা সহজ নয়। সহজ বললে ভুল হবে রীতিমতো অসম্ভব৷ কিন্তু তবুও যেনো কিছুতেই ঘটনাটিকে এড়িয়ে যেতে পারছে না। কিছু তো একটা আছে যা চোখের সামনেই আছে, তবুও দেখতে পারছে না। অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“তুমি চেষ্টা তো করে দেখো। তারপর না হয় অসম্ভব, সম্ভবের কথা ভাবা যাবে”
রফিক মাথা নাড়ালো। যার অর্থ সে খোঁজ নিবে। সে মাথা দোলালেও মন থেকে আশ্বস্ত হতে পারছে না। অহেতুক একটি বিষয় নিয়ে কেনো এতোটা বেশি বাড়াবাড়ি করছে প্রণয় ব্যাপারটা মস্তিষ্কে ঢুকছে না। সব কেসের যে সমাধান থাকবে এমনটা নয়। কিছু কিছু কেস আনসলভড থাকে। কতো এমন কেস আছে যার কোনো সমাধান আসে নি। হয়তো নুশরাতের কেসটিও তেমন। কোনো সমাধান নেই। রফিকের মুখভাবে চিন্তা স্পষ্ট যা নজর এড়ালো না প্রণয়ের। সে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো,
“কিছু বলবে?”
“কিছু মনে করবেন না স্যার, তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি মরীচিকার পেছনে ছুটছেন। যদি কেসটা সলভ ই হবার হতো এক বছর আগেই তো হতো। আংটি, স্কুল এসব সব ই কেনো যেনো বৃথা মনে হচ্ছে। হয়তো আপনি বেশ আশা নিয়ে আছেন। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই শূন্যহাতেই ফিরতে হবে”
কিঞ্চিত ভীত কন্ঠেই কথাটা বললো রফিক। তার কথা শুনে হাসলো প্রণয়। তারপর বললো,
“তোমার মনে হচ্ছে আমার মাথা নষ্ট?”
“ঠিক তা নয়, কিন্তু এই আংটি টা কিভাবে খু*নের ক্লু এটাই মাথায় ঢুকছে না। আপনি এতোটা নিশ্চিত ভাবে বলছেন এই আংটির মালিক খুনী, নিশ্চয়ই তার পেছনে কারণ রয়েছে। আমি সেই কারণটি জানতে চাচ্ছিলাম”
রফিক কথাটি বলেই মাথা নামিয়ে নিলো। প্রণয় কিছুসময় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। ছেলেটি তাকে যতটা ভয় পায় তার চেয়ে বেশি সম্মান করে। তাই তো সে প্রণয়ের কোনো কাজ সে ফেলতে পারে না। শত সন্দেহ থাকা স্বত্তেও কাজটি করে। যে কাজ তাকে খুব বেশি দ্বিধায় ফেলে তখন ই সে প্রণয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেমনটা নিশীর কেস নেবার সময় করেছিলো। যেমনটি আজ করছে। প্রণয় মাঝে মাঝে সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়, মাঝে মাঝে দেয় না। এমনটি নয় প্রণয় তাকে ভরসা করে না। ভরসা করে। রফিককেই একমাত্র চোখ বন্ধ করে সে ভরসা করে। কারণ খুলনায় আসার পর থেকেই প্রণয়ের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত হয় রফিক। তখন সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছিলো সে। প্রণয়ের আন্ডারে এখন প্রাক্টিস করছে। এই একটি বছরে প্রণয়ের প্রতিটি কেসে সে ছিলো একজন তার সহযোগী। খুব কঠিন এবং ভয়ংকর কেসেও সে নির্ভীক ভাবে প্রণয়ের সাথে ছিলো। সুতরাং তাকে অবিশ্বাস করার প্রশ্ন উঠে না। প্রণয় একটু সময় নিলো। তারপর গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আমি এতোটা নিশ্চিত কেনো এটাই তো তোমার প্রশ্ন?”
“জ্বী স্যার, আসলে নুশরাত ম্যাডামের খু*নের তো কোনো এলিবাই নেই”
“যদি বলি আছে। উইটনেস আছে। তাহলে?”
“কে?”
খানিকটা উচ্চস্বরে একদলা বিস্মিয় নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো রফিক। প্রণয় তখন ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। দূর্বোধ্য সেই হাসি। সে যেনো রফিকের কৌতুহল দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। রফিক প্রতীক্ষায় আছে প্রণয়ের উত্তরের। প্রণয় হাসি অক্ষত রেখেই বললো,
“কাজ হলে বাকিটুকু বলবো”
“দিস ইজ নট ফেয়ার। সারারাত ঘুম হবে না। প্লিজ বলুন না স্যার। আর উইটনেস থাকলে তো আরোও সুবিধা, তার কাছ থেকে স্কেচ বানাতে পারবো। কেস রিওপেন হবে”
“এতো সহজ নয় রফিক। নুশরাতের খু*নি এতো সহজে ধরা দেবার নয়। এই কেসটা একটা গোলকধাধা। আমাদের রয়ে সয়ে আগাতে হবে। উইটনেস কখনো মুখ খুলে না, আর তাকে আমি কোর্টে উঠাতেও পারবো না। নিজস্ব কারণ আছে। তাই আমাকেই খু*নীকে বের করতে হবে। আমার মনে হয় খুনী বাহিরে না। দেশেই আছে। এবং আমি সঠিক ক্লুতেই আগাচ্ছি। সিক্সসেন্স আমার এটা”
“সিক্সসেন্স হলে আমি আর কিছুই বলবো না। কারণ আপনার সিক্সসেন্স খাটে”
রফিকের মুখে প্রশংসা শুনে প্রণয়ের হাসি চওড়া হয়। রফিক কেবিন থেকে বের হতেই মোবাইলটা বের করে সে। মনটা ভালো নেই। অশান্ত হয়ে আছে যেনো। অবশ্য প্রশান্তির কিছুই হয় নি। যে কাজেই হাত দিচ্ছে ব্যর্থতাই জুটিছে। ব্যার্থতার কথা মনে আসতেই নিশীর চেহারাটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। দিন দশেক গড়িয়েছে মেয়েটির দেখা মেলে নি। নীরাকে কোন ফাঁকে পড়িয়ে চলে যায় টের পায় না প্রণয়। যাও একটু বেহায়ার মতো আগে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যেতো এখন তা করতে পারছে না। মা রয়েছে বাসায়। শুধু একা আসলে হতো মায়াকে নিয়ে এসেছে। সম্পর্কে তার মামাতো বোন হয় মায়া। কিন্তু মেয়েটিকে কখনোই সহ্য হয় না প্রণয়ের। বয়স তার থেকে কম কিন্তু স্বভাবটা ইঁচড়েপাকা টাইপ। সর্বদা সবকিছুতেই তার মূল্যবান জ্ঞান প্রদানের একটি বাজে অভ্যাস। হোক সেটা প্রণয়ের পার্সোনাল ব্যাপার। আর মা তাকে বড্ড বেশি ই স্নেহ করে। মাঝে তো মায়াকে ছেলের বউ বানাবার ভুত উঠেছিলো মাথায়। কিন্তু প্রণয়ের সামনে সেই ভুত টেকসই হয় নি। এসব যাবতীয় কারণেই প্রণয় বাসায় যায় দেরি করে। কাজ ব্যাতীত চেম্বারে বসে থাকে। রাত বারোটা বাজলেই বাসার দিকে রওনা হয় প্রণয়। তখন মা ঘুমিয়ে থাকে। এবং মায়ের ঘুম ভাঙ্গার আগেই প্রস্থান করে সে। ফলে মায়ের মুখোমুখি হতে হয় না। মাঝে মাঝে ক্লান্তিতে চোখ জোড়া হাল ছেড়ে দেয়। বিশ্রামের ঘাটতি সাক্ষী দেয় লা চোখজোড়া এবং চোখের নিচে কালি। কিন্তু নিরুপায় প্রণয়। আগে তো ক্লান্তির ঔষধ নিশীথিনীকে চোখের সামনে দেখতো। কিন্তু এখন সেটাও হয় না। অসহনীয় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাগুলো বুকে আগলেই দিন পার করে যাচ্ছে প্রণয়। তবুও আশা ছাড়ে নি। তার বিশ্বাস নিশীথিনী ফিরবেন। একদিন তার আসক্ত হৃদয়ের কাছে ধরা দিবে সে। এর মাঝেই ফোনটা বেজে উঠে বিকট শব্দে। চেয়ারে গা এলিয়ে বা হাতটা চোখের উপর দিয়েছিলো প্রণয়। কিঞ্চিত তন্দ্রা চলে এসেছিলো। কিন্তু সেই তন্দ্রায় ছেদ পড়লো বিশ্রীভাবে। নাম্বারটি না দেখেই ফোন কানে নিলো প্রণয়। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললো,
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম সালাম, আমি নিশী বলছিলাম”
চিকন মেয়েলী কন্ঠ কানে আসতেই তড়াক করে চোখ খুললো প্রণয়। খানিকটা ব্যস্ত হয়েই বললো,
“বলুন নিশীথ..”
নিশীথিনী বলতেই যেয়েও থেমে গেলো প্রণয়। কন্ঠে কিছুটা গাম্ভীর্য এনে বলে,
“বলুন নিশী”
প্রণয়ের কাছ থেকে নিশীথিনী ডাকটি যেনো শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে নিশী। ফলে নিশী নামটি শোনার পর ও বড্ড অপরিচিত ঠেকলো নিজেকে। তবুও অনুভূতিগুলো আড়াল করে ধীর গলায় বললো,
“আপনি কি একটু বাসায় আসতে পারবেন?”
“কেনো?”
” নীরার শরীরটা ভালো নেই। গায়ে খানিকটা জ্বর, সকাল থেকে খাওয়া দাওয়া হয়েছে কি না জানি না। আমি খাইয়ে দিয়েছি। কিন্তু মুখে হয়তো স্বাদ নেই। কেমন যেনো মূর্ছানো ফুলের মতো লাগছে৷ তাই বলছিলাম, যদি একটু বাসায় আসতেন ভালো হতো। বাচ্চা মানুষ কিছুদিন আগেই শ্বাসকষ্টে ভুগেছে। তাই রিস্ক নেওয়াটা ঠিক হবে না।”
“আপনি ওর কাছেই থাকুন আমি আসছি”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো প্রণয়। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো সে। এই কয়দিন মেয়েটির খোঁজ অবধি নেওয়া হয় নি। মায়ের কাছ থেকে পিঠ বাঁচাতে নীরার প্রতি অবহেলা করে বসেছে সে। সে তো জানে মাকে কতোটা ভয় পায় নীরা। হয়তো সেজন্যই এই বিনা নোটিশ জ্বর। সময় নষ্ট না করেই ছুটলো প্রণয়।
নীরার কোলে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে নীরা। তার চোখজোড়া বসা। গতকাল ও তাকে এতোটা মূর্ছানো দেখে নি নিশী। কিন্তু আজ যেনো একটু বেশি গুটিয়ে গেছে সে। হয়তো পরিবেশের প্রভাব। যেখানে ঘরের লোক জানেই না মেয়েটি খেয়েছে কি না, সেখানে প্রত্যাশা না করাই ভালো। নিশী কিঞ্চিত বিরক্ত ও প্রণয়ের পরিবারের উপর। বিশেষ করে শেফালী বেগম। এই সাতদিন যতবার তার মুখোমুখি হয়েছে ততবার ই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সম্মুখীন হয়েছে সে। তার মুখে বিরক্তি, অপ্রসন্ন একটা ভাব সর্বদা বিরাজমান। নিশী তা উপেক্ষা করেই এই সাতদিন এ বাড়িতে এসেছে। নিশীর বা হাতে রাখা থার্মোমিটারের পারদে ১০০ তাপমাত্রা। এটা খুব বেশি নয়। কিন্তু নীরার জন্য এটা স্বাভাবিক নয়। তাই বাধ্য হয়েই প্রণয়কে ফোন করা। যতই হোক সে নীরার বাবা। বুক চিরে বের হওয়া দীর্ঘশ্বাসটি সন্তপর্ণে আড়াল করে মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলো সে নীরাকে। নীরাও চোখ বুজে বেড়ালের বাচ্চার মতো নিশীর কোলে গুটিয়ে রইলো।
********
গোধূলীর শেষ ভাগ। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। রক্তিম আভায় নীলাম্বর হয়ে উঠেছে রঙ্গিন। সাদা তুলোর মতো মেঘের বিচরণ এখনো দেখা যাচ্ছে। পাখিরা নীড়ে ফিরতে ব্যাস্ত। আযান দিতে এখনো বেশ সময় আছে। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলো নিশী, প্রণয় এবং নীরা। নিশীর ফোন পেয়ে ছুটে এসেছিলো প্রণয়। মেয়ের স্বাস্থ্যের প্রতি কোনো অবহেলা নয়। তাই তাকে নিয়ে ডাক্তারের আসার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে শেফালী বেগমের ছেলের এমন বাড়াবাড়ি সহ্য হলো না৷ বেশ তীক্ষ্ণ কন্ঠেই বললেন,
“তোরাও তো অসুস্থ হতি, কই প্রতিদিন কি ডাক্তারের কাছে যেতাম নাকি? আবহাওয়া বদলেছে ঠিক হয়ে যাবে”
“আমরা এবং নীরা তো এক নই মা। তোমাকে সবার শারিরীক অবস্থাটা বুঝতে হবে”
ছেলের কাঠকাঠ কথায় আর কথা খুজে পেলেন না শেফালী বেগম। এপাশ ওপাশ হাতরিয়ে গাইগুই করলেন, লাভ হলো না। এদিকে প্রণয় যখন নিশীকে তাদের সাথে যাবার কথা বললো, তখন যেনো শেফালী বেগমের মুখশ্রীতে মেঘ জমলো। নিশী প্রথমে মানা করলো। কিন্তু ছোট মেয়েটির কথা শুনে দ্বিমত করলো না আর। ডাক্তারের ভাষ্য মেয়ে সুস্থ ই আছে। এই জ্বরটা ওর মনে অসুখ ও হতে পারে। তার ভাষ্য,
“জ্বর তো অসুখ না, এটা হলো অসুখের ফল। এখন ওর যা শারিরীক অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে সে কোনো কারণে ভেতরে ভেতরে ভুগছে। এরা তো মনের কথা বলতে পারে না। বাবা মা হিসেবে আপনাদের দুজনকেই বুঝতে হবে”
ডাক্তার দিব্যি নিশীকে নীরার মা বলে দিলো কিন্তু প্রণয়ের এতে ভ্রুক্ষেপ হলো না। তাই তো নিশী কিঞ্চিত রাগান্বিত। রাগটা প্রকাশ করলো না সে। কিন্তু প্রণয় যখন বললো,
“এখন কি প্লান? খেতে যাবেন কোথাও”
“না, আপনার সাথে আমি কোথাও যাবো না”
“কেনো? আমি কি কাম*ড়াই নাকি?”
“কাম*ড়াবেন কেনো? কিন্তু আমি যাবো না”
“কেনো? সেটাতো বলুন”
“আচ্ছা, ডাক্তার যে দিব্যি আমাকে নীরার মা বানিয়ে দিলো। আপনি কিছু বললেন না কেনো?”
“আমি কি বলবো?”
বেশ অবাক কন্ঠেই শুধালো প্রণয়। তার থেকেও দ্বিগুন অবাক হয়ে নিশী বললো,
“বারে, আপনি তাকে ক্লিয়ার করবেন না?”
“ওই লোকের সাথে কি আমি বিয়ে বসবো নাকি যে ক্লিয়ার করবো। যা বুঝার সে বুঝছে আমার কি! আপনি তো আর সত্যি সত্যি আমার বউ না”
“সেটাই তো? তাহলে সেই কথাটা বলেন নি কেনো?”
“বলে লাভ কি! আর আমি আমার চান্স হারাতে চাই না। আশায় মানুষ বাঁচে। এমন তো হতেই পারে, কোনো এক সময় সত্যি আপনার সাথে আমার বিয়ে হলো! খামাখা ক্লিয়ার করে কি হবে?”
প্রণয়ের কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলো নিশী। হা করে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। কথা সাজিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাদের অবাক করে দিয়ে হেসে উঠলো নীরা। আজ প্রথমবার হাসতে দেখলো তাকে প্রণয়। সুন্দর হাসি নয়, কেমন যেনো ঘোড়ার ডাকের মতো আওয়াজটি। মুখ খুলে শুধু শব্দ করছে যেনো সে। কিন্তু তবুও যেনো নিশীর মনে হলো এর চেয়ে মধুর কিছু হতে পারে না………
চলবে