ইতি নিশীথিনী পর্ব-২৯+৩০

0
730

#ইতি_নিশীথিনী
#২৯তম_পর্ব

কথা সাজিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাদের অবাক করে দিয়ে হেসে উঠলো নীরা। আজ প্রথমবার হাসতে দেখলো তাকে প্রণয়। সুন্দর হাসি নয়, কেমন যেনো ঘোড়ার ডাকের মতো আওয়াজটি। মুখ খুলে শুধু শব্দ করছে যেনো সে। কিন্তু তবুও যেনো নিশীর মনে হলো এর চেয়ে মধুর কিছু হতে পারে না। নীরা হাসছে, আর প্রণয় দু চোখ ভরে দেখছে। নুশরাতের মৃত্যুর পর কখনো নীরাকে হাসতে কিংবা কাঁদতে কিংবা জিদ করতে দেখে নি সে। বরাবর ই যেনো নির্বিকার সে। অনুভূতিগুলো জড়ো পাথরের মতো ছিলো। প্রণয়ের মনে হতো সে র*ক্ত মাংসের একটা পুতুলমাত্র। কিন্তু আজ তার সকল ধারণাকে ভুল প্রমান করলো নীরা। সেও মানুষ, তারও অনুভূতি রয়েছে। ভালো লাগা, মন্দ লাগা আছে। সেও হাসে, সেও কাঁদে। নিশী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। তার চোখ ছলছল করছে। কিন্তু ঠোঁটের কোনায় অমলিন হাসি অক্ষত। চোখজোড়ায় এক সমুদ্র প্রত্যাশা। অপলক চাহনী দেখছে নীরার হাসি। অজান্তেই নিশীর ঠোঁটে উঁকি দিলো এক চিলতে হাসি। কিছু ঝগড়ার ফলাফল যদি ভালো হয় তবে ঝগড়া করতে দোষ কি! আযানের সূক্ষ্ণ ধ্বনি কানে আসছে। সূর্যের লাল রঙ্গ ফিকে হচ্ছে৷ ব্যস্ত দিবার অবসান ঘটিয়ে ধীর পায়ে আঁধার হচ্ছে। মাথা ওড়না টেনে দিলো নিশী। শক্ত করে ধরলো নীরার হাত। কোমল কন্ঠে বললো,
“বাড়ি যাই?”

নীরা মাথা দোলালো মৃদুভাবে। প্রণয় সকলের অগোচরে চোখ মুছে নিলো৷ এখন সত্যি বাড়ি ফেরার পালা_____

******

ডা. সাদাত আহমেদ ঠিক পাঁচটা নাগাত চেম্বারে বসেন। তাও শনি আর বুধবার। জেলার খুব নামকরা মস্তিষ্কের ডাক্তার তিনি। সেদিন রোগীর ভিড় উপছে পড়ে। দূর দূরান্ত থেকে রোগী আসেন চিকিৎসার জন্য। এই দুদিন রাত বারোটা অবধি তার চেম্বার খোলা থাকে। তাও রোগী দেখে শেষ করা যায় না। কিছু কিছু রোগী তো সাতক্ষীরা, বাগেরহাট থেকেও আসে। তাদের সিরিয়াল দেরিতে থাকলেও তিনি আগে আগে দেখে দেন। ডাক্তার হলেও ক*ষা*ই নন তিনি। আজ বুধবার। তাই ঠিক পাঁচটায় সাদাত চলে এসেছেন। হাত স্যানিটাইজ করে বসতেই তার কম্পাউডার কামাল এসে হাজির। সাদাত মৃদু হেসে বললো,
“আজ রোগী কেমন কামাল?”
“আগের দিনের থেকে কম। রাত বাজবে না”
“ভালো”
“স্যার, একজন রোগী এসেছেন কুষ্টিয়া থেকে। মানে রোগী নয়, রোগীর ভাই। উনাকে কি ভেতরে পাঠিয়ে দিবো?”
“দিবে? আচ্ছা দাও। উনার কাছে রিপোর্ট আছে তো?”
“হ্যা এই যে”

বলেই কিছু রিপোর্ট এগিয়ে দিলো কামাল। সাদাত চোখের চশমা ঠিক করে এমআরআই রিপোর্ট গুলো দেখতে থাকলো। কামাল বেরিয়ে যাবার মিনিট তিনেকের মাঝেই প্রবেশ করলো প্রণয়। মৃদু কন্ঠে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, আমি মাহতাব হোসেন। আমার ভাই অসুস্থ। ওর চিকিৎসার জন্য ই এসেছিলাম। কিন্তু ও এমন পর্যায়ে নেই যে এখানে আসতে পারবে। তাই আমি ই এসেছি”

প্রণয় ছদ্মবেশে এসেছে সাদাত আহমেদের কাছে। উদ্দেশ্য মাহাদীর বিষয়ে তদন্ত। সাদাত রিপোর্ট দেখতে ব্যস্ত। মাথা না উঠিয়েই বললো,
“বসুন, কি সমস্যা রোগীর”
“প্যারালাইজড”
“কতদিন”
“দু মাস হবে”
“মাথায় কি চোট পেয়েছে?”
“হু ইট দিয়ে প্র*হার করা হয়েছে। তার পর থেকেই এ অবস্থা”
“ওহ, ডাক্তার দেখাচ্ছেন না?”
“দেখাচ্ছি লাভ হচ্ছে না। আপনি যদি একটু সাহায্য করতেন!”

সাদাত এবার মাথা তুললো। একটু নড়ে চড়ে চেয়ারে হেলান দিলো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“এখানেই কি সব রিপোর্ট?”
“জ্বী স্যার, এখানেই সব রিপোর্ট”
“আমি একটু কনফিউজড জানেন তো! রিপোর্ট গুলোতে তার মাথার পেছনের হাড় ভাঙ্গার প্রমাণ আছে। আঘাত ও পেয়েছে তবে এই আঘাতে প্যারালাইজড হয়ে যাবে এই ব্যাপারটা আমাকে ভাবাচ্ছে। এমন হতেই পারে প্রথম MRI এ তেমন ক্লিয়ার আসে নি। আচ্ছা আবার কি রিপোর্ট করিয়েছিলেন?”
“নাহ, তবে আপনার মনে হয় এই CT scan আর MRI দেখে মনে হয় সে সুস্থ!”
“সুস্থ আমি বলবো না। তবে প্যারালাইজড হবার লক্ষণ দেখছি না। মাথায় রক্তক্ষরণ ও তেমন হয় নি”

সাদাত বেশ চিন্তিত কন্ঠে কথাটা বললো। প্রণয় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো সাদাতের দিকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তাহলে বলছেন মাহাদী শেখের প্যারালাইজড হবার লক্ষণ নেই। তবুও সে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায়। এর থেকে একটা বিষয় ক্লিয়ার সে প্যারালাইজড নয়, ভান করছে। আর ডাক্তার হিসেবে কোর্টে ভুল রিপোর্ট পেস করা কতোটা বড় ক্রাইম জানেন তো! ধরা পড়লে আপনার লাইসেন্স থাকবে! এই যে চেম্বার খুলে রোগী দেখছেন এইটা আর হবে?”

প্রণয়ের কথা শুনতেই কপালে ভাঁজ পড়লো সাদাতের। দৃষ্টি তীর্যক হলো। তার চোখে কৌতুহল দেখা গেলো। রিপোর্ট গুলো হাত থেকে রেখে দিলো। সে ঈষৎ চমকালেও বিচলিত নয়। বরং শীতল কন্ঠে শুধালো,
“কে আপনি?”
“আমি তো আমার নাম বলেছি”
“নাম নয়, পরিচয় জানতে চাচ্ছি”
“আপনার ভন্ড রোগীর প্রতিপক্ষ। এডভোকেট মাহতাব হোসেন”
“এখানে আমি রোগী দেখতে আসি, ফাজলামি করতে নয়। আপনি অহেতুক আমার সময় নষ্ট করছেন। অনুগ্রহপূর্বক বেরিয়ে যান। নয়তো পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো”

প্রণয় মৃদু হাসলো। তারপর পকেট থেকে একটা কলম বের করে বললো,
“এই কলমে একটা ফুটেজ রয়েছে যা কোর্টে পেশ করলে আপনার লাইসেন্স থাকবে না। এখন আপনার ইচ্ছে পুলিশ ডাকতে চাইলে ডাকুন”

সাদাতের মুখের বিরক্তি বাড়লো বই কমলো না। চোখমুখ খিঁচিয়ে সে প্রশ্ন করলো,
“কি চান আপনি?”
“মাহাদী শেখের হেলদ নিউজ। সে কি আসলেই প্যারালাইজড নাকি ভান করছে। আপনার হাতের রিপোর্টগুলো কোর্টে প্রথমদিন জমা দেওয়া হয়েছিলো। মাহাদীর তখন সদ্য জ্ঞান ফিরেছিলো। আপনি নিজেই বললেন রিপোর্ট দেখে প্যারালাইজড হবার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আপনি ই তাকে প্যারালাইজড ঘোষণা করেছেন। বিগত দু মাস যাবৎ সে বিছানায়। এবার আপনি ই আমাকে বলুন, মাহাদী সত্যি প্যারালাইজড নাকি শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য এমন টা করছে”

প্রণয়ের শান্ত দৃষ্টি সাদাতের উপর৷ সাদাতকে বিচলিত লাগছে না। তার মুখভাব স্বাভাবিক। সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বিরক্তিসমেত একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আপনি উকিল তাই তো?”
“সন্দেহ আছে?”
“তাহলে এতো ভুল কিভাবে করলেন?”
“কি ভুল?”
“দেখুন এই সব রিপোর্ট আমি বানাই না। এসব রিপোর্ট প্যাথলজি থেকে। সিটি স্ক্যান, এমআরআই করার আলাদা লোক থাকে। তারাই করে। আমি শুধু রিপোর্ট দেখে চিকিৎসা করি। এখন আমার কাছে যে রিপোর্ট আসবে সেটাই আমি ব্যখ্যা করবো। এই রিপোর্টটা মাহাদীর প্রথম স্টেজের। তখন তার মস্তিষ্কে তেমন রক্তক্ষরণ দেখা যায় নি। দাঁড়ান”

বলেই কামাল ডেকে নিলেন সাদাত। কামাল এলে তাকে বললেন,
“মাহাদী শেখের রিপোর্টের ফাইলটা দাও তো”

কামাল তার আদেশ মতো রিপোর্টের ফাইল এগিয়ে দিলো। সাদাত নির্ভীক কন্ঠে বললো,
“এই দেখুন, সপ্তাহ খানেক আগের সিটি স্ক্যান রিপোর্ট। আপনার আমাকে বিশ্বাস না হলে যেকোনো কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি তো একা ডাক্তার নই। অনেকেই আছেন শহরে। তাদের জিজ্ঞেস করবেন। তারা যদি বলে মাহাদী শেখ ভান করছেন আমি নিজেই এই পেশা ছেড়ে দিবো”

সাদাতের কন্ঠ স্পষ্ট, কোনো জড়তা নেই তাতে। তার চোখের চাহনীতে বিচলতা এখনো নেই। যা প্রণয়কে বড্ড বিরক্ত করছে। সাধারণত মানুষ কিছু লুকালে তার কন্ঠ কাঁপে, দৃষ্টি হয় বিচলিত। বেশ ছটফটানি লক্ষ্য করা যায়। যেমন হাত ঘষা, ঘনঘন ঘামতে থাকা। কিন্তু সাদাতের মাঝে এমন কোনো লক্ষণ নেই। সে খানিকটা বিরক্ত বটে কিন্তু অস্বাভাবিকতা তার মাঝে নেই। এর দুটো বিশ্লেষণ হতে পারে। হয় সে চরম মাত্রার ধুর*ন্দর আর নাহয় সে সত্য বলছে। প্রণয় হাসলো। হাসিতে কিছু তাচ্ছিল্যের আভাস। এই হাসি বুঝতে সময় লাগলো না। সাদাত ও হাসলো তাই। তারপর বললো,
“আপনি রিপোর্টগুলো নিয়ে যান। আমি যদি আইনের সাথে প্রতারণা করি তবে তো ধরা খাবোই”

প্রণয় আর বসলো না। রিপোর্টগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলো। কামাল তখন অবাক কন্ঠে শুধালো,
“স্যার, লোকটা কি পুলিশের?”
“নাহ, পুলিশের ভাইরা ভাই”

কথাটা বলতেই সাদাতের ঠোঁটের হাসি প্রসস্থ হলো। কামাল কি বুঝলো জানা নেই, তবে সে সাদাতের হাসির সাথে তাল মিলাতে ভুললো না।

****

ব্যস্ত দিনের অবসান ঘটলো নিশীর। এবার বাড়ি ফেরার পালা। নীরাকে আজকের মতো পড়ানো শেষ। পড়ানো বললে ভুল দেখভাল করা। ও বাড়িতে মানুষের অভাব নেই। তবে নীরার দেখার মতো মানুষের যেনো বড্ড বেশি অভাব। বিগত তিনদিন যাবৎ জ্বরে ভুগছে মেয়েটি। অবশেষে মেয়েটির জ্বর আজ নেই। নিশী প্রতি বিকালে যায় আর রাত করে ফেরে। নীরাকে ঘুম পাড়িয়ে তবেই যেনো কাজ শেষ হয়। শেফালী বেগমের ব্যাপারটি ভালো লাগে না তা খুব ভালো করেই জানা নিশীর। কিন্তু প্রণয়ের জন্য তিনি কোনো কথা বলেন না। চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেন নিশীকে। অপরদিকে মায়া তার সাথে বন্ধুত্ব করার তালে আছে। কারণটা বুঝতে পারছে না নিশী। তার এই গায়ে পড়া ভাবটি প্রচন্ড বিরক্ত করছে তাকে। কিন্তু কিছু বলছে না। পাছে হিতে বিপরীত হয়। নীরাকে পড়ানোটা যেনো খুবই ক্লান্তকর হয়ে যাচ্ছে নিশীর জন্য। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটি নিয়ে দাঁড়ালো ঘরের সামনে। কলিংবেল বাজালো। কিন্তু সাড়া পেলো না। নিশী আবারো বেল বাজালো। কিন্তু সাড়া নেই। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে তার ভেতরটা অস্থির হতে লাগলো। নিকষকালো ভয় জড়ো হতে লাগলো অচিরেই। সুহার এখন বাসায় থাকার কথা। সে এই সময় ঘুমায় না। কারণ সে জানে নিশী ফিরবে। অথচ এখন মিনিট পনেরো হলো সে দরজা খুলছে না। হতেই পারে সে বাথরুমে, অথবা ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু তাই বলে তার ঘুম এতোও গাঢ় নয়। নিশী অস্থির হয়ে কলিংবেল বাজাতে লাগলো। কিন্তু তাকে আশাহত হতে হলো সাড়া না পেয়ে। নিশীর কাছে একটি স্পেয়ার কি থাকে। তাই দেরি না করে সে সেটা দিয়েই দরজাটা খুললো সে। ভেতরে ঢুকেই লাইটটা জ্বালালো। লাইট জ্বালাতেই চোখ বিস্ফারিত হলো নিশীর। ক্রমশ ঘামতে লাগলো সে। ভেতরটা ভয়ে ধক করে উঠলো। হাত পায়ে হিম ধরলো। চাপা আর্তনাদ করে উঠলো সে,
“সুহা”……..

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী
#৩০তম_পর্ব

নিস্তব্ধতায় ঘেরা অন্ধকার ঘর। যা প্রচন্ড অস্বাভাবিক। ভেতরে ঢুকেই লাইটটা জ্বালালো নিশী। লাইট জ্বালাতেই চোখ বিস্ফারিত হলো তার। ক্রমশ ঘামতে লাগলো সে। ভেতরটা ভয়ে ধক করে উঠলো। হাত পায়ে হিম ধরলো। চাপা আর্তনাদ করে উঠলো সে,
“সুহা”

শীতল মেঝেতে লুটিয়ে রয়েছে সুহা। মাথার পেছন থেকে তরল র*ক্তের ধারা বইছে। জ্ঞানহীন নিথর দেহটি সেই র*ক্তে মাখামাখি অবস্থা। এমন দৃশ্য কল্পনাও করে নি নিশী। তার পা অবশ হয়ে যাচ্ছে যেনো। মনে হচ্ছে মাটি যেনো পাজোড়াকে কা*ম*ড়ে আছে। এগোতে দিচ্ছে না। তবুও কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলো সে। ধপ করে বসলো সুহার দেহের সম্মুখে। জড়ানো গলায় ডাকতে থাকলো,
“এই সুহা, এই সুহা। সুহা উঠ না! সুহা”

সাড়া নেই। অস্থিরতা বুকের মাঝে হানা দিচ্ছে বারবার। কাঁপা হাতটা বারবার সুহার রক্তাক্ত শরীরকে নাড়াচ্ছে। মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে। বক্ষস্থল যেনো কেউ পাথর দিয়ে চেপে ধরে আছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে নিশীর। অসহনীয় যন্ত্রণা বুকে ক্রমশ কঠিনভাবে প্র*হার করছে। চোখজোড়া ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই নিশীর চোখ যায় রক্তের পাশে পড়ে থাকা হলুদ খাদী খামের দিকে। খামটি হাতে নিতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কালো বর্ণের একটি কাগজ। র*ক্তাক্ত হাতে কাগজটি খোলে নিশী। তার ঠোঁট কাঁপছে। ভেতরে লুকায়িত ভয়টা খা*মছি মেরে উঠলো যেনো। চিৎকার করবে সেটুকু শক্তি পাচ্ছে সে। অন্তরাত্মা দোষারোপে ব্যাস্ত,
“দোষ তোর, আজ সুহার এই অবস্থার জন্য দায়ী শুধু তুই, শুধুমাত্র তুই”

******

শরতের বৃষ্টির কোনো আগাম বানী থাকে না। থেকে থেকে কৃষ্ণ মেঘেরা আন্দোলন শুরু করে। উজ্জ্বল দিবার রাতটিও হতে পারে কালো মেঘের বিরহসিক্ত। আজও তেমনটাই হচ্ছে। প্রচন্ড বৃষ্টিতে পিচের রাস্তা ডুবন্ত প্রায়। কিন্তু ক্লান্তিহীন বৃষ্টির থামার নাম নেই। নিশীর গোলাপী জামাটা ভিজে গায়ের সাথে লেগে রয়েছে। খোপার খোলা চুল গুলো থেকে চুয়ে চুয়ে পানি পড়ছে। কিন্তু তার কোনো হেলদোল হল না। বিষন্ন চাহনীতে তাকিয়ে রয়েছে ময়লা মেঝেটির দিকে। হাসপাতালের রিসেপশনের সামনে বসে আছে সে। ইমার্জেন্সিতে সুহার চিকিৎসা চলছে। নিশীকে বলা হয়েছে,
“আপনি বাহিরে দাঁড়ান”

নিশীর আসতে ইচ্ছে করছিলো না সুহাকে ছেড়ে। কিন্তু বাধ্য হয়েছে। এই বৃষ্টিস্নাত রাতে হাসপাতাল অবধি কিভাবে এসেছে সেই জানে। বৃষ্টিতে পরোয়া না করেই রাস্তায় মহেন্দ্র এর জন্য দাঁড়িয়েছিলো। কোনো মতে একটা মহেন্দ্র পেতেই সেই লোকটিকে অনুনয় করে ঘর অবধি নিয়ে আসে। সুহার অবস্থা দেখে সেও খানিকটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
“কিভাবে হলো এমন?”

নিশী উত্তর দিতে পারে না। উত্তর নেই তার কাছে। সময় যেনো খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার এই মূহুর্তে। এক সেকেন্ডেও অনেক কিছু হতে পারে। মহেন্দ্র ওয়ালা ঝড়ে গতিতে গাড়ি চালায়। অবশেষে এসে পৌছায় হাসপাতালে।
অবসন্ন শুণ্য নয়নজোড়া ভিজে যাচ্ছে বারবার অসহনীয় কষ্টে। ভেতরটা খা খা করছে। নিজেকে সর্বোনিকৃষ্ট মানুষ মনে হচ্ছে। আজ তার জন্যই সুহার এই অবস্থা। এর মাঝেই একজন নার্স এসে দাঁড়ালেন। নরম গলায় বললেন,
“আপনার তো জ্বর আসবে! এভাবে ভিজা কাপড়ে কি কেউ থাকে!”

নার্সের কথায় হেলদোল হলো না নিশীর। শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। নার্স আবারো তাকে একই কথা বললো। এবার স্বম্বিত ফিরলো নিশীর। ধরা গলায় বললো,
“সুহা কেমন আছে?”
“কে! সুহা?”
“ইমার্জেন্সিতে যে রোগী ভর্তি!”
“আমি জেনে এসে বলছি”

নিশী কাতর কন্ঠে বললো,
“প্লিজ ওকে বাঁচান, আমার ও ছাড়া কেউ নেই। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো। সত্যি নিঃস্ব হয়ে যাবো”

নার্স স্বান্তনার বানী খুঁজে পেলেন না। শুধু ম্লান হাসি দিলো। নিশীর চোখজোড়া অবশেষে বাধ ভেঙ্গে দিলো। নোনাজলের জোয়ার উঠলো। উষ্ণ জলে পুনরায় ভিজলো নরম গালজোড়া। দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদলো বেশ কিছুক্ষণ। তবুও বিষাদের অবসান হলো না।

ইমার্জেন্সির ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। তাকে দেখামাত্রই ছুটে গেলো নিশী। কাতর কন্ঠে বললো,
“সুহা কেমন আছে?”
“আপনি শান্ত হন প্রথমে”
“আরে আমি শান্ত ই আছি, প্লিজ বলুন ও কেমন আছে”
“দেখুন কেউ তার মাথায় আঘাত করেছে। ফলে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা ওপারেশন করতে চাইছি। আপনি কিছু টাকা ডিপোজিট করে দিন। এবং যেখানে যেখানে সাইন দেবার সাইন দিয়ে দিন। আর একটা কথা আল্লাহ ভরসা। জীবন মৃত্যু তার হাতে। আমরা মাধ্যম মাত্র। মানুষের সেই শক্তি নেই কাউকে বাঁচানোর। তাই তাকেই ডাকুন। ইনশাআল্লাহ ভালো কিছুই হবে”

নিশী ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের দিকে। রিক্তহস্তে হাসপাতালে তো চলে এসেছে কিন্তু টাকার কথাটা ঐ মূহুর্তে মাথায় ছিলো না। এমনেই মাসের শেষ, এখন তাদের আর্থিক অবস্থাও বেশ ভালো নয়। নিশী ধীর কন্ঠে শুধায়,
“ঠিক কত টাকা লাগবে?”
“রিসিপশন থেকেই জেনে যাবেন”

বলেই ডাক্তার প্রস্থান করলেন। তার মিনিট দশেকের মাঝেই সুহাকে বের করা হলো। মাথায় শুভ্র ব্যান্ডেজের প্রলেপ। মেয়েটি এখনো জ্ঞানহীন। তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ওয়ার্ডবয় সিলিন্ডার নিয়ে ছুটছে। নিশীর ইচ্ছে করলো মেয়েটিকে ছুয়ে দিতে। কিন্তু পারলো না। তার পূর্বেই তাকে ঢোকানো হলো লিফটে। অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে এখন। নিশী ঠোঁট কামড়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করলো। লাভ হলো না ঠিক। নোনাজলের ধারা আজ বেসামাল হয়ে আছে। সেই সাথে অসহনীয় যন্ত্রণায় বারবার তীক্ত হয়ে উঠছে অন্তস্থল। এই দু মাসেই জীবনের ওতোপ্রোতো অংশ হয়ে গেছে যেনো সে। তাকে ছাড়া নিশী যে শূন্য, একেবারেই শূন্য।

রিসিপশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, ওপারেশন সহ, আইসিউ খরচ পঞ্চাশ হাজার লাগবে। টাকার পরিমাণটা অনেক বিশাল। এই সময় এতোগুলো টাকা জোগাড় করা হিমালয় জয় করার মতোই দুঃসাধ্য কাজ। একেই মাসের শেষ, সামনের মাসের টাকাটাও নেই। চাচা-চাচীর কাছ থেকে পাওয়া টাকার কিছু আছে অবশ্য কিন্তু সেটা ব্যাংকে ডিপিএস করা। সকালের পূর্বে তা বের করা সম্ভব নয়। এখন এই মূহুর্তে তাকে টাকা দিয়ে সহায়তা কেবল একটি মানুষ ই করতে পারবে। ভিজে যাওয়া ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করলো নিশী। পরিচিত নাম্বারটিতে ফোন দিলো। তারপর কাতর কন্ঠে বললো,
“আমার একটু সাহায্য দরকার”

******

বৃষ্টির প্রকোপ খানিকটা কমেছে। মেঘেদের অভিমান বোধহয় একটু হলেও কমেছে। কিন্তু জমে থাকা পানি নামে নি। অবশ্য কমবে কি করে? যেখানে ছিচকাঁদুনে বৃষ্টিতেই নৌকা ভাসানো যায় সেখানে আজ তো অঝোর ধারা। হাসপাতালের সামনের রাস্তাটা উঁচু করার কাজ চলছে। বালি, ইট জড়ো হয়ে আছে পাশে। পানি উঠায় কাঁদা কাঁদা হয়ে বিশ্রী অবস্থা হয়ে গেছে। তবুও কাঁদা পেরিয়ে ছুটে ভেতরে ঢুকলো প্রণয়। তার বুক কাঁপছে। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরেই বিছানায় শুয়ে পড়েছিলো প্রণয়। আজ মস্তিষ্কের রেষারেষির মাত্রা বেশি ছিলো। ফলে কাপড়টা না ছেড়ে ঘুমে ডুবতে ইচ্ছে হয়েছিলো। কিন্তু এর মাঝেই ফোনের বিশ্রী রিংটোন। পুরো ঘুম কেঁচিয়ে দিলো। ফোন হাতে নিতেই কিঞ্চিত বিস্মিত হলো সে। নিশীর ফোন অপ্রত্যাশিত ছিলো। নিশীর কাতর কন্ঠ, আর ডুকরে উঠা অনুভূত হতেই ছুট লাগালো প্রণয়। বৃষ্টিকে বুড়ো আঙ্গুল দিকে দেখিয়ে গাড়ি হাকালো। আধা ঘন্টার পথ অতিক্রম করলো দশ মিনিটে। হাসপাতালে প্রবেশ করতেই নিশীর দেখা মিললো। অর্ধ ভেজা কাপড়ে এসির মুখোমুখি বসে আছে সে। কাছে যেতেই শুকনো মুখখানা দেখতে পেলো সে। তার নিস্প্রভ দৃষ্টি, ভেজা চোখগুলো দেখতেই ছ্যাত করে উঠলো প্রণয়ের হৃদয়। সূক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভূত হলো মূহুর্তেই। সেই সাথে তুমুল অস্থিরতা। ইচ্ছা করলো তাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করবে। বুকের সাথে লেপ্টে রেখে বলবে,
“নিশীথিনী, আমি আছি। ভেঙ্গে পড়বেন না। আমি আছি। আপনাকে এমন ভঙ্গুর অবস্থায় যে মানায় না। আমার কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয়”

কিন্তু নিজেকে সংযত করে রাখলো। ইচ্ছেগুলো লুকিয়ে রাখলো দীর্ঘশ্বাসের ভাঁজে। ভরাট গলায় বললো,
“টাকা কোথায় জমা দিতে হবে”

প্রণয়ের কন্ঠ কানে যেতেই চোখ তুলে তাকালো নিশী। শুকিয়ে যাওয়া নয়নজোড়া পুনরায় আবারো হয়ে উঠলো সিক্ত। দলা পাকানো কন্ঠে বললো,
“আমার শাস্তি ওরা সুহাকে দিয়েছে প্রণয় সাহেব। আমার জন্য বেঁচারির আজ এই অবস্থা”

কথাটা শুনতেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো প্রণয়ের। হাটু গেড়ে বসলো সে নিশীর সামনে। অবাক কন্ঠে বললো,
“কারা?”
“মাহাদী”

মাহাদী নামটা শুনতেই চোখের দৃষ্টির পরিবর্তন হলো প্রণয়ের। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তুমি শিওর?”
“হ্যা”

বলেই ব্যাগ থেকে অর্ধভেজা কালো কাগজটি বের করে দিলো। যাতে উজ্জ্বল সফেদ বর্ণে লেখা,
“আমার নিশীথ পাখির জন্য ছোট্ট উপহার”

নিশী বিড়বিয়ে বললো,
“মাহাদী সুস্থ হয়ে গেছে। ও আমার সাথে শোধ তুলতেই সুহার উপর আক্রমণ করেছে”
“এখানে তো মাহাদীর নাম নেই, তুমি নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছো?”
“আমাকে নিশীথ পাখি কেবল ওই ডাকে। ও ছাড়া কেউ এই নামে ডাকে না। ওই এমনটা করেছে, ওই করেছে”

নিশীকে বেশ অপ্রকৃতস্থ ঠেকলো। সে কথাটা আওড়াচ্ছে। প্রণয় বুঝলো সুহার এই অবস্থায় তার মস্তিষ্ক স্বাভাবিক নেই। কিন্তু নিশীকে বুঝতে হবে, সে কোথাও ভুল করছে। প্রণয় শান্ত কন্ঠে বললো,
“মাহাদীর পক্ষে আক্রমণ করা সম্ভব নয়”
“কি বলছেন আপনি? কেনো সম্ভব নয়?”
“কারণ মাহাদী সত্যি ই প্যারালাইজড”………

চলবে