#ইতি_নিশীথিনী
#৩১তম_পর্ব
নিশীকে বেশ অপ্রকৃতস্থ ঠেকলো। সে কথাটা আওড়াচ্ছে। প্রণয় বুঝলো সুহার এই অবস্থায় তার মস্তিষ্ক স্বাভাবিক নেই। কিন্তু নিশীকে বুঝতে হবে, সে কোথাও ভুল করছে। প্রণয় শান্ত কন্ঠে বললো,
“মাহাদীর পক্ষে আক্রমণ করা সম্ভব নয়”
“কি বলছেন আপনি? কেনো সম্ভব নয়?”
“কারণ মাহাদী সত্যি ই প্যারালাইজড”
প্রণয়ের কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না নিশী। তার বিশ্বাস দৃঢ়। চোখে মুখে এক অব্যক্ত ঘৃণার ছাপ। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
“এই সব ভং, নাটক করছে সে। আপনিও দেখছি ওর নাটকে ধরা খেয়ে গেলেন। ও যেহেতু একবার আমাকে আক্রমণ করেছে দ্বিতীয়বার করতে তো সমস্যা নেই। আমি জানি মাহাদী ই এমন টা করেছে। আর প্রমাণ আপনার সামনে”
নিশী তার কথাগুলোই বলছে। প্রণয় তাকে দু-তিনবার বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ব্যর্থ হলো। নিশী এখন কিছু বুঝার পরিস্থিতিতেই নেই। কিন্তু প্রণয় প্রমাণ ছাড়া কথা বলার মানুষ নয়। সাদাত হোসেন থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট মোট দুজন নিউরোলজিস্টকে দেখিয়েছে। দুজনের ভাষ্য, “রোগীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। ফলে স্নায়ুকোষের ক্ষতি হয়েছে। যে কারণেই প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে” সাদাত হোআশঙ্কাসেন মিথ্যে বললেও বাকি দুজন ডাক্তারের মিথ্যা বলাটা অযৌক্তিক। তবুও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। যেমন এদের একজন বলেছেন রোগীর প্যারালাইসিস চিরকাল থাকবে না। চিকিৎসা করলেই ঠিক হয়ে যাবে। তাই যদি ইতিমধ্যে মাহাদী সুস্থ হয়ে যায় তবে নিশীর ভুল হবে না। দ্বিতীয়ত, এই রিপোর্টটি ই ভুল হতে পারে। প্যাথলজি থেকে টাকার বিনিময়ে ভুল রিপোর্ট করা খুন কঠিন কিছু নয়। তাই নিশীকে একেবারে ভুল বলাটা ঠিক নয়। আবার নিশীর কথাকে ধরে আগানোটাও বোকামি। একটা কাগজ কখনো প্রমাণ হতে পারে না। আর মাহাদী শেখ যদি ভং করেও থাকে সে কখনোই এমন একটি কাজ করবে না, যা তাকে হাতে নাত্র ধরিয়ে দিবে। উপরন্তু এই আ*ক্রমণের সময় নিশীর উপস্থিতি সেখানে ছিলো না। সুতরাং আন্দাজে কোনো সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রণয় বুড়ো আঙ্গুলটা দিয়ে কিছুসময় কপাল ঘষলো তারপর নরম কন্ঠে বললো,
“বেশ, আমরা নাহয় পুলিশেই খবর দিবো। তারাই কাল*প্রিটকে খুঁজে বের করবে”
প্রণয়ের কথাটা নিশীর মনে ধরেছে। সে খানিকটা শান্ত হলো। নিশীকে এতোটা অস্থির এই প্রথম দেখছে প্রণয়। মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। প্রণয়ের মনে হলো সে অন্য নিশীকে দেখছে। আজও মনে আছে সেই নিগূঢ় আঁধারের কথা যখন প্রাণ বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিলো মেয়েটি। প্রাণ, সম্মান উভয় সংকটে থাকার পরও সেদিন তাকে এতোটা ভীতু দেখায় নি। অথচ আজ মনে হচ্ছে নিকষকালো ভয়ের ঝাল তাকে একটু একটু করে গ্রাস করছে। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। প্রিয় মানুষটিকে হারাবার বিশ্রী ভয় তার মস্তিষ্ককে অপ্রকৃতস্থ করে তুলছে। প্রণয় গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে কথাগুলো সাজালো। তারপর হাটু গেড়ে বসলো নিশীর মুখোমুখি। তারপর মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“আমি যে নিশীথিনীকে চিনি সে এতো দূর্বল নয়, তাহলে আজ কেনো এতোটা অসহায় লাগছে! কেনো আমার নিশীথিনীকে অচেনা লাগছে! নিশীথিনীর পথ তো সরল নয়, পথ চলতে গেলে ইট কংকর পায়ে বিধবে, র*ক্তক্ষরণ হবে। তা বলে কি এভাবে ভেঙ্গে পড়তে হবে? আজ আপনি ভেঙ্গে পড়লে সুহাকে কে দেখবে! আপনার যেমন ও ছাড়া নেই, এখানে ওর তো আপনি ছাড়া কেউ নেই। আর কান্নাকাটি করলে যদি সুহা সুস্থ হয়ে যায় তবে কাঁদুন, আমার আপত্তি নেই”
নিশী ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ প্রণয়ের চোখের দিকে। এতোসময়ে দলাপাকিয়ে থাকা বিশ্রী ভয়গুলো যেনো ধীরে ধীরে উবতে লাগলো। হৃদয়ে জমা কালো মেঘের পরদ গুলো ধীরে ধীরে সরতে লাগলো। কাতর স্বরে বললো,
“আমার কেউ নেই প্রণয় সাহেব, কেউ নেই। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা থাকাটা খুব কঠিন জানেন তো! এই একাকীত্বের জীবনে সুহা আমার জন্য সেই ছাউনি যেখানে আমি কাঁদতে পারি, হাসতে পারি। বাবার মতো ও যদি হারিয়ে যায়, আমি কি করবো তখন! আবার একা হয়ে যেতে হবে! আমি এতো সবল নই প্রণয় সাহেব যতটা ভাবছেন, আমারো ভয় লাগে। একা হবার ভয়, বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। ভয়টা খুব বাজে, তিতকুটে, কালো, বিশ্রী”
প্রণয় অনুভব করলো তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তাই উঠে দাঁড়ালো সে। নিপুনভাবে চোখ মুছে নিলো। কিছু না বলেই রিসিপশনের কাছে চলে গেলো সে। নিশী ঠায় বসে রইলো। টলমলে চোখে দেখতে লাগলো সেই ময়লা মেঝেটা। কেনো তার দিনগুলো সরল নয়, কেনো তাকে ভোগ করতে হচ্ছে এই অসহনীয় যন্ত্রণা। হাপিয়ে উঠেছে সে, এই নিষ্ঠুরতার সাথে লড়তে লড়তে। একটু জিরিয়ে নিতে চায়, একটু বিশ্রাম চায়। হতে চায় না সে নিশীথিনী, সাধারণ নিশীটুকু হলে কি ক্ষতি!
অপারেশন চলছে। বাহিরের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে রয়েছে নিশী এবং প্রণয়। প্রণয়ের ক্ষণে ক্ষণে ঘড়ি দেখছে। প্রায় দেড় ঘন্টা হতে চললো এখনো ডাক্তারদের থেকে তথ্য মেলে নি। চিন্তা তার ও হচ্ছে। নিশী এখনো অবসন্ন চোখেই তাকিয়ে আছে। মনে মনে পরম করুনাময়কে ডাকছে অক্লান্তভাবে। প্রণয় চিন্তা কমাতে থাইগ্লাসের সামনে দাঁড়ালো। শরতের ঝিমুনি বৃষ্টি তার ক্লান্তি মিটিয়ে আবারো পুরোউদ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছে। অক্লান্ত বর্ষণে হাপিয়ে উঠেছে ব্যস্ত শহর।
“প্রণয় সাহেব?”
পুরুষালি কন্ঠে ঘোর কাটলো প্রণয়ের। পেছনে তাকাতেই নেভি রঙ্গের ইউনিফর্ম পরিহিত দুজন যুবককে নজরে পড়লো। প্রণয় এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। গম্ভীর স্বরে বললো,
“জ্বী, আমি ই ফোন করেছিলাম”
“ঘটনা ঘটেছে কিভাবে একটু বিস্তারিত বললে ভালো হতো”
প্রণয় একবার তাকালো নিশীর দিকে। তার শুষ্ক মুখখানা দেখে তাকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলো না। প্রণয় নিজের মতোই বললো এবং সাথে সেই কালো কাগজটি এগিয়ে দিলো। সব শুনে এবং কাগজটি পেয়ে দুজনের একজন থমথমে গলায় বললো,
“কারোর সাথে শত্রুতা ছিলো কি? মানে কেউ বিরক্ত করছিলো?”
“দেখুন শত্রুতা সুহার সাথে কারোর আছে কি না সেটা আমি বা নিশী বলতে পারছি না। তবে যেহেতু চিঠিটা নিশীকে উদ্দেশ্য করে। তাহলে বলাই যায় সে নিশীকেই টার্গেট করেছে। আর ঘটনাস্থলে আমরা দুজনের কেউ ছিলাম না৷ নিশী স্পেয়ার কি দিয়ে দরজা খুলেই এই দৃশ্য দেখেছে”
“মানে দরজা লাগানো ছিলো?”
“জ্বী, দেখুন স্পেয়ার কি দিয়ে খোলা হয়েছে মানে এখানে ছিটকিনির সমস্যা নেই। আক্রমণকারী ভেতর থেকে লক চেপে বাহির থেকে দরজা দিলেই সেটা অটো আটকে যাবে”
“কিন্তু আমার কথা হচ্ছে সে বা তারা ঘরে ঢুকলো কিভাবে? আপনাদের বাসায় একবার যাওয়া গেলে ভালো হতো!”
“এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে, কাল আসুন না হয়”
“আচ্ছা, কাউকে সন্দেহ হচ্ছে কি?”
প্রণয় একটু সময় নিলো। তারপর বেশ ভেবেচিন্তে বললো,
“দেখুন যাকে সন্দেহ হচ্ছে তার পক্ষে এই কাজ করাটা অসম্ভব। হ্যা, তার পক্ষ হয়ে কেউ করে থাকলে হিসেব ভিন্ন”
“বুঝলাম, আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আর সুহার জ্ঞান ফিরলে জানাবেন অবশ্যই”
প্রণয় মাথা দোলালো। পুলিশেরা প্রস্থান করতে না করতেই সেখানে উপস্থিত হলো ঈশান এবং জসীম স্যারের আগমণ ঘটলো। সাথে আর দুজন ছেলেও আছে। প্রণয় তাদের দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো। ঈশান ছেলেটিকে সে চিনে। এই ঈশান ছেলেটিকে এর আগেও সে দেখেছে নিশীর আশেপাশে। নিশীকে বদনাম করার সময় ও তার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। ঈশান নিশীকে দেখতেই তার নিকট ছুটলো। বেশ অধীর হয়েই শুধালো,
“তুমি ঠিক আছো তো?”
ঈশানের আগমণটা অবাক করলো নিশীকে। অবাক গলায় বললো,
“আপনারা?”
“শুনেছি তোমাদের উপর কেউ হামলা করেছে, তাই তো খোঁজ নিয়ে এখানে ছুটে আসা। তুমি চিন্তা করো না, সুহার কিছু হবে না। তুমি কি তখন উপস্থিত ছিলে? তোমার উদ্দেশ্যে এসেছিলো কি?”
ঈশান একের পর এক প্রশ্ন করছে। কিন্তু নিশী স্তব্ধ। ঈশানের প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে ঠিক ধারণ করতে পারছে না। সে তো কাউকে জানায় নি প্রণয় ব্যাতীত। তবে ঈশানের আগমণের কারণ কি! এর মাঝেই প্রণয় বলে উঠলো,
“নিশী তখন আমার সাথে ছিলো, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আপনি এই আক্র*মণের ঘটনা জানলেন কিভাবে?”
প্রণয়ের তীর্যক প্রশ্নে খানিকটা হলেও চমকালো ঈশান, তবে ভড়কালো না। বেশ গুছিয়ে বললো,
“আমি নিশীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম তখন জানতে পারি!”
“এতোরাতে? এতোরাতে একটা মেয়ের বাসায় যাবেন! দেখায় কেমন? আর কারণ টা জানতে পারি? আমি যতদূর জানি আপনি নিশীর কেউ হন না”
“সেই উত্তর আমি আপনাকে দিবো না। আপনিও কেউ হন না”
প্রণয়ের মুখশ্রী শক্ত হয়ে গেলো মুহূর্তেই। ঈশান মাহমুদের কথার যুক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রণয় ও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, তাই বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“আমি তার উকিল, কথাটা ভুলে গেছে হয়তো। আমার মক্কেলকে যার সাথে জড়ানো হয়েছে সেই মানুষটি রাত বিরাতে তার বাড়ি যাবে, ব্যাপারটা আমার অবগত হওয়াটা কি ভালো নয়!”
ঈশান কিছু বলার পূর্বেই জসীম স্যার বলে উঠলেন,
“আমি জসীম আহমেদ, আপনি মাহতাব হোসেন তাই না? আপনার অনেক নাম শুনেছি। বড় উকিল আপনি। আমি নিশীর কলেজের টিচার। আসলে নিশী তো দু-চারদিন কলেজ আসে না তাই ওর খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। জানি একটু রাত করেই গিয়েছি। কিন্তু খুব রাত তখন ছিলো না। সন্ধ্যে সন্ধ্যে ছিলো। বুঝেন ই কলেজ শেষ করে যেতে হয়। আর আমার বাসা কিন্তু এদিকে নয়। তাই দিনে দিনে বের হলেও দেরি হয়েই যায়। সুহার খবর শুনে, এখানে আসতেই আরোও দেরি হয়েছে। ঈশান আর ভাতিজা, তাই ওকে নিয়েই গিয়েছিলাম। আশাকরি আর জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না”
জসীমের কথায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ঈশান। যে চায় না নিশীর সামনে ধরা খেতে। নিশী যদি জানে এই ঘটনা সে দারোয়ান থেকে জেনেছে তবে বাসা ছাড়ার একটা ভুত মাথায় চড়ে উঠবে তার। নিশী বআয়া গলায় বললো,
“সুহা সুস্থ হলে আমি আবার কলেজে যাবো। আপনারা এখন যেতে পারেন”
“হাসপাতালে থাকতে আমার তো সমস্যা নেই নিশী”
ঈশানের কথায় আবেগ স্পষ্ট, সে নিশীর প্রতি চিন্তিত। নিশীর তর্ক করতে ইচ্ছে হলো না। এদিকে প্রণয়ের দৃষ্টি জসীমের দিকে। তার কথাগুলো স্পষ্ট, গোছানো। কোথাও কোনো জড়তা নেই, ফাঁক ফোকড় নেই। তার মুখভঙ্গী, কথা বলার ধরণ ও বেশ আলাদা। প্রণয় কিছুটা দ্বিধায় পড়লো, লোকটি কি আসলেই সত্যি বলছে নাকি সে মারাত্মক ধূর্তের মতো গুছিয়ে মিথ্যে বলছে। জসীম এবার হাসলো, ঠোঁট চেপে বিচিত্রভাবে হাসলো সে। যেনো কোনো বিষয় তাকে বেশ মজা দিচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতির জন্য সেই অনুভূতি চাপিয়ে রাখছে। প্রণয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মুখোমুখি হতেই সে বললো,
“কিছু মনে করবেন না, তবে আপনার তাকানো দেখে হাসি পাচ্ছে৷ আসলে যেভাবে তাকাচ্ছেন মনে হচ্ছে এখনই লাই ডিটেকটর মেশিনের সামনে বসাবেন”
প্রণয় কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই একজন নার্স ছুটে এলেন,
“আপনাদের মধ্যে কি কারোর ব্লাড গ্রুপ ও পজেটিভ? রোগীর দরকার। খুব ইমার্জেন্সি। আমাদের এখানে যা ছিলো তা ব্যাবহার করা হয়ে গেছে। প্লিজ যোগাড় করুন।”
নিশীর রক্তের গ্রুপ ও পজেটিভ নয়। নার্সের কথায় বেশ চিন্তায় পড়লো সে। তার পরিচিত তেমন মানুষ ও নেই। নিশী অস্থির হয়ে পড়লো৷ তড়িঘড়ি করে ব্লাডব্যাংকে ফোন করার চেষ্টা করলো। কিন্তু সেখান থেকেও আশাহত হতে হলো। ও পজেটিভ রক্ত তাদের কাছে এই মূহুর্তে নেই। নিশী অসহায়ের মতো চাইলো প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের ও ব্লাড গ্রুপ ভিন্ন। সে মাথা দোলালো। এতো কম সময়ে রক্ত জোগাড় করাটা দুষ্কর ব্যাপার। রফিককে ফোন করলে যদি সমাধান হয়। ঠিক তখন ই ঈশান বললো,
“মানুষ আছে, কত ব্যাগ লাগবে?”
“এক ব্যাগ হলে হবে”
“হ্যা, আমার বন্ধুর রক্তের গ্রুপ একই। ও দিতে পারবে”
“আমার সাথে আসুন তাহলে। ম্যাচিং এর ব্যাপার আছে।”
বলেই নার্স হাটা দিলো। সাথে আসা দুজনের একজন নার্সের পিছু নিলো। নিশী বেশ কৃতজ্ঞতার সাথে তাকালো ঈশানের দিকে। ঈশান শান্ত চাহনীতে ইশারা করলো তাকে। বোঝালো,
“চিন্তা নেই”
এদিকে প্রণয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখছে ঈশানকে। ব্যাপারটি কি সত্যি কাকতালীয় নাকি সাজানো। ঠান্ডা মাথায় সাজানো। কেনো যেনো ঈশান নামক ব্যাক্তিটিকে মোটেই সন্দেহের তালিকা থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না।
সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। রাত ঘন হলো। ঈশানের বন্ধুর রক্তের সাথে ক্রস মেচিং করে সেটাই দেওয়া হয়েছে সুহাকে। এখন অপেক্ষা অপারেশন শেষ হবার। অপারেশন শেষ হতেই ডাক্তার বের হলেন। ডাক্তারকে দেখতেই নিশীর চোখ চকচক করে উঠলো। সে ছুটলো ডাক্তারের কাছে। কাতর গলায় বললো,
“রোগীর কি অবস্থা?”
“পোস্ট অপারেটিভ রুমে আছে। আশাকরছি পাঁচ-ছ ঘন্টায় এনেস্থিসিয়া কেটে যাবে। জ্ঞান ফিরবে। চোটটা বেশি গভীর ছিলো না। কিন্তু র*ক্তপাত হওয়ায় ভয়ে ছিলাম। ভয় এখন নেই। অপারেশন সাক্সেসফুল। আশাকরছি আপনাদের রোগীকে নিয়ে আর কোনো কম্পলিকেশন হবে না”
ডাক্তারের কথা শুনতেই বুক চিরে এতো সময়ের দলাপাকানো ভয়গুলো দীর্ঘশ্বাস রুপে বের হলো। নিশী কৃতজ্ঞতার সাথে বললো,
“কি বলে ধন্যবাদ জানাই!”
“উপরওয়ালাকে জানান, উনি সব কিছুর মালিক”
ডাক্তার চলে গেলো। তখন জসীম বললো,
“যাক, সুহা সুস্থতার দিকে পা বাড়িয়েছে। এবার আমাদের যাবার পালা”
ঈশান না চাইতেও সম্মতি দিলো। নিশীকে ধীর স্বরে বললো,
“কোনো ঝামেলা হলে জানিও। মনে রেখো আমি আছি সবসময়”
নিশী কিছু বললো না। জসীম প্রণয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
“আসি তাহলে উকিল সাহেব?”
প্রণয় কিছু বলার পূর্বেই তার চোখ আটকে গেলো জসীমের বা হাতের দিকে। সাথে সাথেই বেশ চমকে গেলো সে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করেই সে শুধালো,
“আংটিটা বেশ ভালো মানিয়েছে”
জসীম স্যার প্রণয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো নিজ হাতের দিকে। তারপর স্মিত হেসে বললো,
“ধন্যবাদ, অনেক রেয়ার জিনিস। রেয়ার জিনিসগুলো সুন্দর হয়। আর যদি সেই জিনিসের সাথে রহস্য মেশানো থাকে তাহলে তো কথাই নেই”……..
চলবে
#ইতি_নিশীথিনী
#৩২তম_পর্ব
জসীম স্যার প্রণয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো নিজ হাতের দিকে। তারপর স্মিত হেসে বললো,
“ধন্যবাদ, অনেক রেয়ার জিনিস। রেয়ার জিনিসগুলো সুন্দর হয়। আর যদি সেই জিনিসের সাথে রহস্য মেশানো থাকে তাহলে তো কথাই নেই”
জসীমের কথাগুলো বেশ আজগুবি। প্রণয়ের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা বাড়লো। তার দৃষ্টি অবগত হতেই জসীম আবার হাসলো। তারপর বললো,
“আপনি এতো সিরিয়াস হয়ে যান কেনো? মশকরা করছিলাম। আসলে নিশীর ও আমার আংটিতে বেশ কৌতুহল ছিলো। আর আপনাদের দুজনের মুখভঙ্গি ই আংটির দিকে তাকাতেই বেশ বদলে যাচ্ছে। একটা জিনিস আগ্রহের সাথে দেখা আর চমকে দেখার পার্থক্য আমি জানি। এই জ্ঞান বেঁচে তো আমাকে চলতে হয়। তাই আমার ধারণা এই আংটির পেছনে জটিল রহস্য রয়েছে। তাই বললাম”
“আপনি অনেক বুদ্ধিমান”
“সবাই বলে”
প্রণয় হাসলো। সে আর কথা বাড়ালো না। তবে সন্দেহের তালিকায় জসীমকে ফেলতেও ভুল হলো না তার। লোকটি হয়তো অনেক ধূর্ত নয়তো ধূর্ত হবার ভান ধরতে তার ভালোলাগে। কিছু কিছু মানুষের স্বভাব বিচিত্র হয়। তারা নিজেকে জাহির করতেই ভালোবাসে। জসীম স্যারের মাঝে এই স্বভাবের প্রবণতা লক্ষ্য করলো প্রণয়। তার আচারণ গুলো অদ্ভুত, ভীষণ ভাবে অদ্ভুত। জসীম এবং ঈশানেরা বেরিয়ে পড়তেই ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিলো প্রণয়। সাড়ে এগারোটা বাজে। সুহাকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে রাখা হয়েছে। সাধারণত যেখানে সাধারণ মানুষের আনাগোনা নিষিদ্ধ। সুতরাং নিশীকে এই করিডোরেই রাত পার করতে হবে। হাসপাতালে রুম ভাড়া নেবার উপায় ও নেই। প্রণয় বেশ চিন্তায় পড়লো। মেয়েটিকে একা একা এই রাতে হাসপাতালে ছেড়ে যাওয়াটা অমানবিক। উপরন্তু তার মন ও সায় দিচ্ছে না। উপরন্তু এতো রাতে নিশীর বাসাতেও তাকে পাঠাতে মন সায় দিচ্ছে না। বলা তো যায় না, আ*ক্রমণকারী যদি আবার আ*ক্রমণ করে। তাই ভেবে চিন্তে বেশ কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো সে। নিজ বাসায় আজ নিশীকে রাখবে সে৷ যদিও মা এবং মায়া এখনো প্রস্থান করে নি। এই ঘটনা নিয়ে তারা হুক্কাহুয়া করলেও করতে পারে। তবুও নিশীকে সে আজ রাত তার বাড়িতেই রাখবে।
নিশীর মুখখানা শুকনো, চোখজোড়া খানিকটা ফুলে গেছে। চোখের পাতায় এখনো বিন্দু বিন্দু নোনাজলের রেশ। তার ঠোঁটজোড়া শুষ্ক। চাহনীতে ক্লান্তির আভাস। প্রণয় ধীর স্বরে বললো,
“বাসায় চলুন”
নিশী মাথা তুলে চাইলো। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো কথাটা যেনো একরাশ আবেগের সমষ্টি। পরক্ষণেই একটু নড়ে চড়ে উঠলো সে। ধীর কন্ঠে বললো,
“আজ এখানেই থাকি”
“লাভ নেই, আপনাকে ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। আর এখন সুহাও ভালো আছে। কম ধকল তো যায় নি। একটু ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুম দিবেন। কাল এগারোটায় ভিজিটিং হাওয়ার। তখন আসবেন। আর আপনি কিন্তু আমার বাড়ি যাচ্ছেন, একা একা ওই বাড়িতে থাকা রিস্কি”
“আর কি রিস্ক হতে পারে বলুন? সর্বোচ্চ আমাকে মে*রে ফেলবে”
বিষন্ন কন্ঠে নিশী বললো। তার দৃষ্টি শান্ত। প্রণয় কিছুসময় চুপ থাকলো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“আপনার প্রা*ণের মায়া নাই থাকতে পারে। তবে আমার কাছে আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকটা যক্ষের ধন। তাই রিস্ক নেবার বোকামি আমি করছি না। উঠুন এবার। ক্লান্ত আমি, তর্ক করতে ভালো লাগছে না”
প্রণয়ের কথায় এই প্রথম প্রবল রাগের রেশ পেলো নিশী। সে রেগে আছে, তার চোখের শানিত দৃষ্টি সেটাই বারবার প্রমাণ দিচ্ছে। নিশী জেদ করলো না। ইচ্ছে হলো না। সবসময় জেদ করাটা ঠিক নয়। তাই উঠে দাঁড়ালো সে। প্রণয়ের লম্বা লম্বা পায়ের সাথে তাল মিলিয়েই সেও প্রস্থান করলো।
*****
শেফালী বেগমের মুখভার। তার দৃষ্টি শান্ত। মুখে রা নেই। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিশীর দিকে। তার জামায় র*ক্তের কালচে দাগ। ভেজা শুকনো অবিন্যস্ত চুল। পায়জামার নিচে কাদার প্রলেপ। মেয়েটিকে দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না তার। কিন্তু ছেলের সাথে কথা বলতে পারছেন না। ছেলে বেশ স্পষ্ট কন্ঠে জানিয়েছে,
“নিশী আজ এখানে থাকছেন”
কথাটা বলেই সে ভেতরে চলে গেছে। পৃথা নিশীকে তার ঘর দেখিয়ে দিয়েছে। নিশী ছোট করে “ধন্যবাদ” দিতেই সে নিজ কাজে চলে গেলো। নিশীও খুব একটা মনে নেয় নি। রাত বিরাতে উড়ে আসলে এমন আচারণ হওয়াটাই যৌক্তিক। এদিকে শেফালী বেগমের পাশে মায়া বসলো। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
“তুমি তার জামাটা দেখেছো? র*ক্ত লাগা তাই না?”
শেফালী বেগম এখনো শান্ত হয়ে বসে আছেন। মায়া আবার বললো,
“মেয়েটা কি করে এসেছে বলো তো, এই রাত বিরাতে তোমার ছেলে তাকে বাড়ি নিয়ে এলো। আচ্ছা, তোমার ছেলে কি একে বিয়ে করার ধান্দায় আছে নাকি?”
“বিরক্ত করিস না, ভালো লাগছে না আমার”
বেশ কড়া করেই শেফালী বেগম বললেন কথাটা। মায়া মুখে ভেংচে বললো,
“বিরক্ত কই করলাম, হাবভাবে যা মনে হলো বললাম। মিলিয়ে নিও। আন্দাজে কথা বলার স্বভাব নেই আমার। অবশ্য মেয়েটা কিন্তু যে সে মেয়ে নয়। শহরে আত্নীয়বিহীন থাকে। তুমি বরং একটু স্মার্ট হও আন্টি। তুমি যে সেকেলে, বউ মার সাথে বনিবনা হবে কি না সেটা দেখো”
শেফালী বেগম গজগজ করতে করতে চলে গেলেন। মায়া তার রাগী মুখটা দেখে বেশ মজা পেলো। ফুপী মানুষটা বেশ কড়া, তার পছন্দের বাহিরে কিছু তিনি মানতে পারেন না। অথচ তার প্রিয় ছেলেই এমন মেয়ের কাছে মন হারালো যাকে তিনি ইহজীবনে মানবেন না। মা ছেলের এই শীতল যু*দ্ধ দেখাটা বেশ উপভোগ্য হবে বলেই মায়ার ধারণা।
মধ্যরাত পার হয়েছে অথচ এখন খেতে বসলো প্রণয় এবং নিশী। মায়া খাবার গরম করে দিলো। শেফালী বেগম ও তার লেবুপানির গ্লাস নিয়ে নিশীর সম্মুখে বসলেন। নিশীর খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার দেখলেই যেনো গা গুলিয়ে যাচ্ছে। তবুও ইচ্ছের বিরুদ্ধে খেতে হচ্ছে। ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই শেফালী বেগম শান্ত প্রশ্ন নিক্ষেপ করলেন,
“আচ্ছা, তোমার গায়ে র*ক্তের দাগ দেখলাম! ব্যাথা ট্যাথা পেয়েছো নাকি?”
“জ্বী না”
“তাহলে? তোমাকে এতো বিধ্বস্ত লাগছিলো কেনো? মনে হচ্ছিলো কারোর খু*ন করে এসেছো……..
চলবে
#ইতি_নিশীথিনী
#৩২তম_পর্ব (বর্ধিতাংশ)
ভাতের লোকমা মুখে তুলতেই শেফালী বেগম শান্ত প্রশ্ন নিক্ষেপ করলেন,
“আচ্ছা, তোমার গায়ে র*ক্তের দাগ দেখলাম! ব্যাথা ট্যাথা পেয়েছো নাকি?”
“জ্বী না”
“তাহলে? তোমাকে এতো বিধ্বস্ত লাগছিলো কেনো? মনে হচ্ছিলো কারোর খু*ন করে এসেছো!”
শেফালী বেগম হাসির ছলেই কথাটা বললেন। তাতে প্রকাশ পেলো একরাশ বিদ্রুপ। নিশী খাবারটা মুখে তুলতে পারলো না। কথাগুলো বিষাক্ত সুই এর ন্যায় চুবলো ভেতরে। সে দূর্বল নয়, কিন্তু আজ নিজেকে সবচেয়ে দূর্বল মনে হচ্ছে। এতোকালের সঞ্চিত সব শক্তি যেনো এক নিমিষেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে যখন সুহার র*ক্তেস্নাত অসাড় শরীরটি দেখেছিলো। শেফালী বেগমের কথার উত্তর সে দিলো না। শুধু প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলো শান্ত চোখে। এদিকে শেফালী বেগমের কথাটা মোটেই ভালো লাগলো না প্রণয়ের। শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,
“মা তোমার বয়স হয়েছে ঠিক ই কিন্তু উদাহরণ ঠিকমতো দেওয়াটা এখনো শিখে উঠতে পারো নি। খু*ন করতে যাবেন কেনো? উনার বান্ধবীর একটি এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে, বেশ ক্ষয় ক্ষতিও হয়েছে। তাই উনাকে বিধ্বস্ত লাগছিলো। এটা কি স্বাভাবিক নয়?”
প্রণয়ের কথার মাঝে কিছুটা রাগের ছাপ ছিলো। যা মোটেই শেফালী বেগমের ভালো লাগলো না। ছেলের থেকে এমন ব্যাবহার তিনি প্রত্যাশা করেন নি। তার মুখখানা আরোও লম্বাটে হলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,
“ভালো কথা, তবে এ শহরে কি শুধু তুই পরিচিত? না মানে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই? শুধু তুই?”
“এতে সমস্যা হচ্ছে কেনো মা তোমার?”
“রাত বিরাতে আমার ছেলে একটা মেয়ের সাথে সময় কাটাচ্ছে, বলা নেই কওয়া নেই তাকে বাসায় নিয়ে আসছে। সে নাকি এখানে থাকবে। আর মেয়েটি আর দত্তক কন্যার শিক্ষক। ব্যাপারটা শুনতে কেমন লাগে প্রণয়? শুধু তোমার নানা বাড়ি জানতে পারে তারা কি ভাববে? আমার গর্ব আমার নাক ডুবাচ্ছে৷ আমি কি মুখ দেখাতে পারবো? আর তোমার তো কি বিয়ে হবে না? তোমার জীবনে কেউ আসবে না। তাকে কি বুঝাবে? এই মেয়েটির পরিচয় কি? উত্তর আছে?”
শেফালী বেগমের শানিত বাক্যগুলো নিশীকে ছিন্নভিন্ন করতে যথেষ্ট। তার বসে থাকতে ইচ্ছে হলো না। খাবারের প্লেটটি ঠিক তেমন রেখেই উঠে পড়লো সে। একদানাও সহ্য হলো না। বেশ নমনীয় কন্ঠে বললো,
“আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। আপনাদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত”
নিশী চলে যেতে নিলেই প্রণয় তার ডান হাতটা টেনে ধরলো। শক্ত কন্ঠে বললো,
“বসুন, খাবেন তারপর ঘুমাতে যাবেন। এটা আন্টির বাসা নয়। আমার বাসা। সুতরাং এখানের সিদ্ধান্তগুলো আমি ই নিয়ে থাকি”
প্রণয়ের এমন আচারণে বেশ অবাক হলেন শেফালী বেগম। মায়া মিটিমিটি হাসছে। প্রণয়ের এই রুপ একদম অচেনা। এদিকে নিশী কিছু বলার পূর্বেই প্রণয় তার দিকে শান্ত দৃষ্টি প্রয়োগ করলো। তার হাতখানা এখনো প্রণয়ের শক্তের হাতের ভেতর। নিশীর কিঞ্চিত অস্বস্তিবোধ হলো। সে শেফালী বেগমের দিকে না তাকিয়েও তার ধারালো দৃষ্টি অনুভব করতে পারছে। নিশীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রণয় আবারো বললো,
“বসুন”
নিশী বাধ্য মেয়ের মতো বসতে বাধ্য হলো। শেফালী বেগমের ক্রোধাগ্নি যথেষ্ট তাকে ভ*স্ম করে দেবার জন্য। তিনি গজগজ করছেন ছেলের উদ্ধত আচারণের জন্য। প্রণয় এবার বেশ বেপরোয়া ভাবেই বলল,
“মা, আমি কি কখনোই কারোর চিন্তার ধার ধেরেছি? যদি তাই হতো এতো বয়স অবধি বিয়ে না করে কি থাকতাম? কিংবা নীরাকে দত্তক নেবার সাহস করতাম না। সুতরাং আমার নানা বাড়ির মানুষেরা কি ভাবলো না নিয়ে আমি ভাবছি না। আর বিয়ের পর নিজের স্ত্রীকে বোঝানোর ব্যাপার টা না হয় বিয়ে হলেই ভাববো। আর যাকে আমি আমার স্ত্রী রুপে চাই, আমার মনে হয় না তার এতে আপত্তি থাকবে। তাই অহেতুক প্রেসার খেও না মা। নিশীর এই শহরে আপনজন থাকলে সে আমার বাড়ি আসতো না। আর এতো রাতে আমি তার লাইফ রি*স্ক নিবো না। উনি আমার রেসপনসেবলিটি। তাই সেটা পালন করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরুপে আমার”
“রেসপনসিবিলিটি? কবে থেকে?”
“যবে থেকে আমি সেটা নিয়েছি”
“এমন করে দায়িত্ব নেওয়া যায় নাকি?”
“তুমি যদি মায়ার দায়িত্ব নিতে পারো আমি নিশীর দায়িত্ব কেনো নিতে পারবো না?”
“মায়া আমার ভাইয়ের মেয়ে”
“নিশীকে আমি ভালোবাসি”
প্রণয়ের নির্লিপ্ত কন্ঠের বাক্যটি বজ্রপাতের ন্যায় কাজ করলো। এতোদিনের ঢাক ঢাক গুড়গুড়ের আর সমাপ্তি ঘটলো। শেফালী বেগম বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে। শুধু শেফালী বেগম নন, উপস্থিত সকলের চোখ ই প্রণয়ের দিকে। নিশী কখনোই কল্পনা করে নি প্রণয় কথোপকথনের এক পর্যায়ে এমন করে হাটে হাড়ি ভাঙ্গবে। প্রণয় শেফালী বেগমের বিস্মিত, হয়রান মুখশ্রীকে উপেক্ষা করেই বললো,
“তুমি হুট করে ঢাকা থেকে কেনো এসেছো আমার অজানা নয় মা। যা শুনতে চাচ্ছিলে আমি বলেদিলাম। ক্লান্ত লাগছে, দয়া করে আর ব্যাপারটাকে প্যাঁচিও না। আর আপনি আমার মুখের দিকে কি দেখছেন, সন্ধ্যা থেকে কিছু খান নি। খাবারটা খান”
নিশী বুঝতে পারছে না লোকটার মাথা কি আসলেই খারাপ, এই পরিস্থিতিতে খাওয়া যায়! কোনো সুস্থ মানুষ খেতে পারবে? কিন্তু প্রণয় ঠিক খাচ্ছে, তার মাঝে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই। এদিকে শেফালী বেগম তার লেবুপানিটি এক নিঃশ্বাসে শেষ করলেন। তারপর উঠে হনহন করে মিজ ঘরে চলে গেলেন। মায়াও পিছু নিলো। নিশী এখনো ভাত নাড়াচড়া করছে। প্রণয় সেটা আড়চোখে দেখলো। সে বুঝলো নিশীর এখন খাবার ইচ্ছে নেই। তার জোর করাতে বসে রয়েছে। কিছুসময় চুপ থেকে ম্নান কন্ঠে বললো,
“আমার মার কথায় কিছু মনে করবেন না। সরি আমার বাসার এমন কুৎসিত দৃশ্য আপনার দেখতে হয়েছে। কিন্তু এগুলো নতুন নয়। নীরা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আজ আপনাকেও দেখতে হলো। আসলে বাবা মারা যাবার পর থেকে মা বেশ পালটে গেছেন। নানাবাড়িতে খুব একটা সম্মান তাকে দেওয়া হয় নি। মামাদের নিকট সে কেবল আশ্রিতা। তাই তার জেদ আমাদের এমন ভাবে মানুষ করবে যেনো মামাদের চোখে তার সম্মানটা বাড়ে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে মাঝে মাঝে ভুলে যায় আমরা মানুষ, আমাদের একটা ইচ্ছে আছে। আমাদের নিজস্ব কিছু চাহিদা আছে। অন্যের মতো করে আমরা বাঁচতে পারি না। সকলের স্বত্তাতো এক না। আর একারণেই মার সাথে আমার বাধে। পৃথা তার কথামতো চলে, তাই সে তার ভালো মেয়ে। আমি আমার মতো চলি, সেকারণে বিবাদ হয়।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো প্রণয়। তার কন্ঠে প্রবল বিষাদের তিক্ত ঢেউ উঠছে। তবুও নির্বিকার চিত্তে খাচ্ছে সে। নিশী অবাক নয়নে দেখছে প্রণয়কে। লোকটির কত রুপ, কখনো বেপরোয়া প্রেমিক, কখনো তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী উকিল, কখনো দায়িত্ববান বাবা তো কখনো বিষন্নতায় ঘেরা ছেলে। পুরুষ বুঝি এমন ই হয়। শক্ত খোলসের আবরণে লুকিয়ে রাখে নিজের সকল কষ্ট। বিষাদসিন্ধুর অতলঢেউ ও যেনো তাদের বিশাল বক্ষে আগলে রাখে তারা। তারপর বুক টান টান করে দাঁড়ায় প্রিয় মানুষটির সম্মুখে যেনো তাকে কোনো বিপদ ছুতে না পারে। কি অদ্ভুত পুরুষ! নিশী হাসলো। তারপর বিনাবাক্যে প্রণয়ের সাথেই খেয়ে নিলো। এখন আর গা গুলোচ্ছে না, এখন আর অরুচি হচ্ছে না। ফাঁকতালে একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো তার হৃদয়ে,
“একবার সাহস করবে কি?”
******
সুহার জ্ঞান ফিরেছে। তাকে শিফট করা হয়েছে একটি ডাবল বেড কেবিনে। এই ডাবল বেড কেবিন টি যেনো হয়ে গেছে নিশীর অস্থায়ী বাসস্থান। সুহার শারিরীক অবস্থা দিন দিন উন্নত হচ্ছে অবশ্য এর পেছনের কৃতীত্ব নিশীর অক্লান্ত যত্ন। প্রতিটি সময় সুহার ছায়া রুপে তার উপস্থিতি। তাকে খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ধরে বাথরুম করানো অবধি। কোনো কিছুতেই বিরক্তি নেই, নেই অভিযোগ। সুহাও যেনো কৃতজ্ঞতা প্রকাশে সংকোচ করে না। এদিকে মায়ের লাগাতার ফোন। মিথ্যে বলতে হচ্ছে অনেক কিন্তু সত্যটাও যে বড় কঠিন। যশোর থেকে বৃদ্ধ বাবা-মাকে এতোটা চিন্তা দিতে নারাজ সুহা। সুহা দু চার বার অবশ্য নিশীকে জিজ্ঞেস করেছে,
“হাসপাতালে এতো খরচ কিভাবে ম্যানেজ করছিস?”
নিশী হেসে বললো,
“আম খা না, গুটি গুনিস কেনো?”
“বলবি না?”
“নাহ, তুই কি বলিস আমাকে কিছু?”
“কি বলি নি”
“এই যে সে তোর এই অবস্থা করেছে”
নিশীর কথায় চুপ মেরে গেলো সুহা। এড়িয়ে গেলো বেশ ধূর্ততার সাথে৷ কথা ঘুরিয়ে বললো,
“সুপটা মজা, কোথা থেকে কিনেছিস?”
“বানিয়েছি”
“ঢপ দিস না। তোর যা রান্না, তাতে আমি নিশ্চিত এই তোর বানানো না।”
“এড়িয়ে যাচ্ছিস যা, কিন্তু পুলিশকে সত্যটা বলিস”
“পুলিশে খবর দিলো কে?”
“তোর ক্রাস”
“নীরার আব্বা?”
“হু”
“এজন্যই বাবা বলে উকিলদের থেকে দূরে থাকতে, স্বাভাবিক বিষয়কে তারা স্বাভাবিক রাখে না”
সুহার কথাটা ভালো লাগলো না নিশীর। এই মেয়েটির প্রা*ণ যায় যায় অবস্থা তবুও সে বেপরোয়া। ফলে তার কন্ঠে কাঠিন্য এলো,
“আচ্ছা তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস কেনো?”
“বাবা পুলিশ ভয় পায়। আমি চাই না জল গড়াক”
নিশী কিছু বলার পূর্বেই দরজায় কড়া পরলো। নার্স এসেছে ড্রেসিং এর জন্য। নিশী কথা বাড়ালো না। সে বিনাবাক্যে কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেলো। কেবিন থেকে বের হতেই দেখা মিললো প্রণয়ের৷ সাথে তিনজন পুলিশ। এদের চিনে নিশী। ফুলবাড়িগেট থানার দুজন এস.আই এবং অসি। অসি মোস্তাক এগিয়ে এসে বললো,
“সুহা ম্যাডামের জবানবন্দি নিতাম”
“একটি অনুরোধ, সুহার পরিবারকে যেনো টানা না হয়। আসলে ওর পরিবার জানে না”
“কিন্তু কান টানলে তো মাথা আসবেই”
অসির কথার যুক্তি আছে। নিশী ও বুঝলো সে অহেতুক অনুরোধ করছে। নার্স বের হতেই নিশী সহ তারা কেবিনে প্রবেশ করলো। পুলিশদের দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সুহা। মোস্তাক একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে বসলো সুহার মুখোমুখি। সুহা বেশ শক্ত কন্ঠে বললো,
“আপনারা এখানে কেনো?”
মোস্তাক সেই কালো কাগজ এবং সুহাদের বাসা থেকে পাওয়া ইটের ভাঙ্গা অংশ দেখিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“দেখুন, আপনি আমাদের সাহায্য না করলে আমরা কিন্তু দোষীকে ধরতে পারবো না। আজ আপনাকে মে*রেছে কাল আপনার বান্ধবীকে মা*রবে। কারণ এই লেখাটি আপনি বা নিশী হকের নয়।ঘাতকেরা আমাদের মাঝেই আছে। তাই দয়া করে মুখটা খুলুন। আর যদি সে আপনার শত্রু হয় তবে তো কথাই নেই”
সুহা চুপ করে থাকলো অনেক সময়। তারপর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়, আর বাকি দুজন এস.আই এর দিকে। ফলে মোস্তাক তাদের বেরিয়ে যাবার অনুরোধ করলো। ঘরে থেকে গেলো নিশী এবং মোস্তাক।
আধ ঘন্টা পর কেবিন থেকে থমথমে মুখে বের হলো মোস্তাক এবং নিশী। প্রণয় বেশ আগ্রহের সাথে বললো,
“এনি প্রগ্রেস অফিসার?”
“ঘা*তক মাহাদী শেখ নন……….
চলবে