ইতি নিশীথিনী পর্ব-৩৫+৩৬

0
684

#ইতি_নিশীথিনী
#৩৫তম_পর্ব

নিশীর বিরক্তি বাড়লো। সে কপাল কুচকে ক্যাফের দরজার দিকে তাকালো। ঠিক তখন ই দেখতে পেলো চির পরিচিত মুখ। মুখখানা দেখে ভেতরটায় ক্ষীন ব্যাথা অনুভূত হলো। অজান্তেই চোখ টলমল করে উঠলো। নিশী নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার পূর্বেই মানুষটি তার নিকট এগিয়ে এলো। মলিন হাসি হেসে বলল,
“কেমন আছো নিশীপু?”

ঠিক কতদিন পর নিহিতাকে চোখের সম্মুখে দেখছে জানা নেই নিশীর। তবে মেয়েটির মাঝে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। মেয়েটিকে হুট করেই যেনো বড় লাগছে। মুখের আদল একই, কিন্তু চাহনীতে এসেছে বেশ পরিপক্কতা। যে মেয়েটি নিজ হাতে চুল আছড়াতে জানতো না, সেই মেয়েটি বেশ সুন্দর করে এক পাশে বেণুনী করে রেখেছে। কি সুন্দর লাগছে নিহিতাকে। উজ্জ্বল মুখখানার দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নিশী। নিশীকে অবাক করে নিহিতা তার সামনে বসলো। তারপর মৃদু কন্ঠে আবারো শুধালো,
“কেমন আছো নিশীপু?”
“ভালো”

নিশী ছোট করে উত্তর দিলো। তার শান্ত দৃষ্টি এখনো দেখে যাচ্ছে নিহিতাকে। নিহিতা তার সামনেই বসে আছে। তার দিকে চেয়ে রয়েছে। নিশী একটিবার জিজ্ঞেস করতে চাইলো, “বাড়ির সবাই কেমন আছে? তুই কন আছিস? ইমাদ তোকে এখন জ্বালায় না তো? এখন চাচার দোকানে সমস্যা হচ্ছে না তো?” কিন্তু করা হলো না। কেনো যেনো ইচ্ছে হলো না। নিশী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“এখানে বসলি যে? তুই তো কারোর সাথে দেখা করতে এসেছিলি!”
“হ্যা, এসেছি তো। আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি”

নিহিতা স্বাভাবিক কন্ঠেই কথাটা বললো। কিন্তু কথাটা হজম হলো না নিশীর। সে অবাক চোখে তাকালো। একরাশ বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
“আমার সাথে? হঠাৎ? ”
“প্রণয় সাহেব বলেন নি? আমি যে তোমার কেসের মুখ্যম সাক্ষী”

কথাটা শুনে আরেকদফা অবাক হলো নিশী। এখানে প্রণয় ই তাকে আসতে বলেছিলো। এটাও বলেছিলো তার কেসের ব্যাপারেই কথা আছে। কিন্তু সেই কথাগুলো যে এগুলো সেটা কল্পনাতীত তার জন্য। নিহিতার কথা শুনে খুশি হবার কথা নিশীর। খুশিতে আত্মহারা হবার কথা। তার আপনজনেরা তাকে ভুলে নি। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই খুশিটা কিছু তীক্ত স্মৃতির জন্য কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো। উলটো মন জুড়ে বিস্তার করলো কিছু অভিমান। ফলে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমি তো তোর সাহায্য চাই নি”
“এভাবে বলছো কেনো নিশীপু?”
“খুব কঠিন করে বলে ফেললাম?”
“আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো? তাই তো সেদিনের পর থেকে আর যোগাযোগ করো নি। জানো নিশীপু, ওরা না আমাদের আর জ্বালায় নি। ইমাদ আমাকে ফলো ঠিক ই করেছে কিন্তু আমাকে আর ডিসটার্ব করে নি। বাবার দোকান ও চলছে ভালো মতো। আমরা তো প্রথমে ভেবেই নিয়েছিলাম তুমি বুঝি কেস তুলে নিয়েছো। পরে জেনেছি তুমি তুলো নি, বরং ওদের শাসিয়েছো! তোমার দ্বারাই সম্ভব এগুলো। মাঝে মাঝে মনে৷ হয় তোমার মতো হতে পারলে কি দারুন হতো! কিন্তু আফসোস আমি বরাবর ই ভীতু। তাই একটু একটু করে সাহস করছি। ওরা তোমার সব সাক্ষীকে হু*মকি ধ*মকি দিচ্ছে। দুজন এখনো টিকে আছে। তাই প্রণয় সাহেব আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। পরিবারের চেয়ে ভালো সাক্ষী আর কি হতে পারে?”
“চাচী জানেন তো?”
“নাহ, মা জানে না। তবে আমি চাই না মা কেসের দিনের আগে জানুক”
“কেনো?”
“কেনো প্রণয় সাহেব জানান নি?”

নিহিতার কথাটায় একটু খটকা লাগলো নিশীর। প্রণয় তাকে কিছুই বলে নি। কেস বিষয়ক তেমন কথা প্রণয়ের সাথে তার হয় না। সে নিজ থেকে শুধালে প্রণয় বলে “চিন্তা নেই, আমি আছি”

ইতোমধ্যে প্রণয়ের আগমণ ঘটলো। নিশী এবং নিহিতাকে সে তাদের কাছে এগিয়ে গেলো। নিশীর কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই প্রণয় তার পাশে মৃদু কন্ঠে বললো,
“যাক ভালোই হলো, ভারতমিলাপ হয়ে গেছে। তাহলে তো মুল আলোচনায় যাওয়াই যায়”

প্রণয়ের কন্ঠ শুনতেই কিছুটা চমকে উঠলো নিশী। সে এতোটাই ঘোরে ছিল যে প্রণয়ের আগমণ টের পায় নি। খানিকটা অবাক কন্ঠে শুধালো,
“আপনি কখন এলেন?”
“যখন আপনি চিন্তায় বিভোর ছিলেন”

নিশী নিজেকে সামলে নিলো। প্রণয়কে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, ‘কেনো ওদের কাছে সাহায্য চেয়েছেন?’ কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো না। সে ছোট করে বললো,
“খেয়াল করি নি”
“জানি তো, বোনকে পেয়েই আমাকে ভুলে গেছেন”

প্রণয় কথাটা হেসে বললেও নিশীর প্রতিক্রিয়া হলো না। সে নির্বিকার মুখশ্রীতেই বসে রইলো। প্রণয় নিহিতাকে শুধালো,
“জামশেদ সাহেব আসলেন না?”
“বাবা চিটাগং গেছেন। কাল আসবেন। আপনাকে বলেছিলেন”
“অহ, হ্যা। মনে নেই। ভুলোমনা মানুষ তো। যাক গে, মুল কথায় আসি”

বলেই একটা খাতা বের করলো সে। সেখানে কিছু নাম লেখা। যার মাঝে একটি নাম বেশ বক্স করে লেখা। নিশীর দৃষ্টি সেই বক্সকৃত নামের উপর ই আটকে গেলো। নামটি আর কেউ নয়, “ঈশান মাহমুদ”। প্রণয় ঠিক কি চিন্তা করছে বুঝে উঠতে পারছে না নিশী। তবে তার প্রণয়ের আচারণে কৌতুহল জাগছে। সে তার কৌতুহলকে ক্ষণিকের জন্য দমিয়ে রাখলো। প্রণয় তখন নিহিতার উদ্দেশ্যে বললো,
“যেহেতু তুমি এখনো আঠারো হও নি, তাই তোমাকে নানাভাবে ভীত করার চেষ্টা করা হবে। তোমাকে এমন এমন অনেক প্রশ্ন করা হবে যা অপ্রীতিকর। অপর পক্ষের উকিলকে তো আমি চিনি। উনি নিশীকে যেভাবে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলো। তোমাকেও সেই কাজটি ই করবে। তাই বলছি, তুমি শিওর তুমি সাক্ষী দিবে?”
“জ্বী, নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি সাক্ষী দিবো। নিশীপুর জন্য কখনো কিছু করার সৌভাগ্য হয় নি। এবার না হয় বোন হবার দায়িত্বটুকু পালন করি”
“তুমি যে এটুকু সহায়তা করছো এটাই অনেক। তোমার নিশীপু কেমন সেটা তুমি ই ভালো করে বলতে পারবে। ওখানে তোমাকে বারবার নিশীর চরিত্র সম্পর্কিত কথা গুলোও উঠবে। সুতরাং সত্যটাই বলবে”

নিহিতা মাথা নাড়ালো। প্রণয় আরো কিছু কথা বললো। নিশীর সেদিকে খেয়াল নেই। সে নিহিতাকে দেখছে। এই কয়েকদিনে বেশ পরিবর্তন এসেছে তার মাঝে। এখন আর সেই ছোট, ভীতু নিহিতাটি সে নেই। সাক্ষী দিবে, কোর্টে দাঁড়াবে অথচ তার মাঝে ভীতি নেই। যেখানে বুড়ো বুড়ো মানুষের ও ভয়ে হাত পা কাঁপা শুরু হয়। ভাবতেও অদ্ভুত লাগছে, নিজের ছোট্ট নিহিতা আজ সত্যি ই বড় হয়ে গেছে।

ক্যাফে থেকে বের হলো নিহিতা, নিশী এবং প্রণয়। একটি রিক্সায় নিহিতাকে তুলে দিলো তারা। নিহিতা যাবার সময় নিশীকে জড়িয়ে ধরলো। মিহি কন্ঠে বললো,
“সেদিন দিশেহারা হয়ে গেছিলাম নিশীপু, পরে বুঝেছি কি অন্যায় আবদারটাই না করেছিলাম। আমার উপর রাগ করে থেকো না গো। সম্পর্ক চুকেবুকে গেলেও তুমি আমার নিশীপুই থাকবে”
“বেশ গুছিয়ে কথা বলা শিখেছিস৷ সত্যি বড় হয়ে গেছিস”
“তোমার তালপাতার সিপাহি যে এখন সেনাপতি, বড় তো হবার ই ছিলো”

নিশী হাসলো। নিহিতার রিক্সাটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিশী অপলক নয়নে দেখছে। প্রণয় তখন শুধালো,
“বাড়ি যাবেন না?”
“আচ্ছা, আপনার মাথায় কি চলছে বলুন তো! সাক্ষ্য হিসেবে ঈশান ভাইকেও রেখেছেন দেখলাম। উপর থেকে চাচা, নিহিতা। কি ভাবছেন আপনি”
“আমার উপর মহলে যে কলকব্জার গন্ডগোল সে তো আপনার বহু আগ থেকেই জানা। এতোদিন বিশ্বাস রেখেছেন। আর কদিন রাখুন”
“পারছি না, কৌতুহল হচ্ছে”
“তবে জেনে রাখুন, আমি বি’ষে বি’ষক্ষয় করার ধান্দায় আছি”
“ধান্দাবা’জীও জানেন দেখছি”
“মানুষ চড়িয়ে খাই ম্যাডাম, একটু তো করতেই হয়। আর একজন ও সাক্ষী দিব”
“কে?”

অবাক কন্ঠে শুধালো নিশী। প্রণয় হাসলো। উত্তর দিলো না। গাড়ির দিকে যেতে যেতে বললো,
“চলুন, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি পৌছে দেই। সুহা তো একা”

সুহাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন সে বেশ সুস্থ। সেজন্যই আজ নিশীর বের হওয়া। নিশী আর কথা বাড়ালো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠলো প্রণয়ের গাড়িতে______

*****

শেখ ভিলায় পুলিশের আগমন। বসার ঘরে মোস্তাক এবং সাব ইন্সপেক্টর মোসাদ্দেক বসে রয়েছে। তাদের চা এবং বিদেশী বিস্কিট দেওয়া হয়েছে। মোসাদ্দেক বেশ তৃপ্তি নিয়েই খাচ্ছে সেটা। কিন্তু মোস্তাকের মুখশ্রী কঠিন। সে প্রখর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সোলাইমান শেখের দিকে। সোলাইমান শেখ অবশ্য পাত্তা দিলো না সেই চাহনীর। উলটো হেসে বললো,
“অসি সাহেব, খাচ্ছেন না কেনো? দুধ চা খান না? গ্রীন টি দেই?”
“আমি তো গ্রীন টি খেতে আসি নি”
“জানি কেনো এসেছেন”
“মাহাদী সাহেবের রুমটা কোথায়?”

কথাটা সোলাইমান শুনেই না শোনার ভান করলো। সে উল্টো বললো,
“আমি তো আমার, ইমাদের, বাকি ছেলেদের অবস্থান বলেছি। তদন্ত করুন দেখুন তারা কই!”
“মাহাদী শেখের সাথে দেখা কি হবে না?”

এবার খানিকটা বিরক্ত হলো সোলাইমান। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“নাহ, আমার ছেলে অসুস্থ। দেখা করা যাবে না”
“ওয়ারেন্ট বের করলেও কি অসুস্থ ই থাকবে?”
“ওয়ারেন্ট গায়েব করার মুল্য বলুন”…….

চলবে

#ইতি_নিশীথিনী
#৩৬তম_পর্ব

এবার খানিকটা বিরক্ত হলো সোলাইমান। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“নাহ, আমার ছেলে অসুস্থ। দেখা করা যাবে না”
“ওয়ারেন্ট বের করলেও কি অসুস্থ ই থাকবে?”
“ওয়ারেন্ট গায়েব করার মুল্য বলুন”

সোলাইমানের কথায় খাওয়া থামিয়ে দিলো মোসাদ্দেক। সোলাইমানের দৃষ্টি কঠিন, ঠোঁটের কোনে দুর্বোধ্য হাসি। মোসাদ্দেক শুকনো ঢোক গিলে মোস্তাকের দিকে তাকালো। মোস্তাক মানুষটি মূল্যবোধের প্রতি কতটা কড়া সেটা তার অজানা নয়। ঘুষ নামক শব্দটিকে অতীব ঘৃণা করে সে। অথচ সেই মানুষটিকেই মুখের উপর ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। মোসাদ্দেক ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিল মোস্তাকের রুদ্ররুপ দেখার জন্য। কিন্তু তাকে অবাক করে দিলো মোস্তাকের মুখশ্রী। তার মুখভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে উলটো ঠোঁটের কোনায় অদ্ভুত হাসির প্রলেপ টেনে বললো,
“সোলাইমান সাহেব তাহলে মানুষের মন ভালোই বুঝতে পারেন”
“মানুষের জন্য ই তো আমরা। এটুকু বোঝা আর এমন কি”
“তাহলে কি মাহাদী সাহেবের দর্শন হবে না?”
“নাহ। তবে মন খারাপ করবেন না, উপঢৌকনের দর্শন পাবেন। অংকটা বলুন”
“মাসে লাখ খানেক পেলেই হবে”

মোসাদ্দেক অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো মোস্তাকের দিকে। সোলাইমান শেখ শব্দ করেই হাসলেন। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে বেশ প্রসন্ন মোস্তাকের প্রস্তাবে। তিনি ইমাদকে ডাকলেন। প্রসন্ন কন্ঠে বললেন,
“যাও, চাচীকে বলো হলুদ খামটা দিতে”

ইমাদ ও প্রফুল্ল হয়ে ভেতরে গেলো। সোলাইমান শেখ তখন মোস্তাককে বললেন,
“এবার একটু চা-বিস্কিট খান, ঘরের মেহমান কিছু না খেলে দেখায় কেমন?”
“বিরিয়ানি খাচ্ছি, চা-বিস্কিটটা না হয় নাই ধরলাম”

সোলাইমান শেখ সশব্দে হাসতে হাসতে বললেন,
“আপনি বেশ মজার মানুষ অফিসার”
“সবাই তাই বলে”

শেখ ভিলা থেকে বের হলো মোস্তাক এবং মোসাদ্দেক। পকেটে হলুদ খাম। তাতে রয়েছে কড়কড়ে বেগুনী হাজারের একশ টা নোটের বান্ডেল। মোসাদ্দেকের মুখে কথা নেই। সে শুধু আড়চোখে দেখে যাচ্ছে মোস্তাককে। মোস্তাকের মাঝে এতোটা পরিবর্তন কল্পনা করে নি। এতে অবশ্য সে মনোক্ষুন্ন ও হয়েছে। এতোদিনের আদর্শের এমন পরিবর্তন সে মানতে পারছে না। মনের মাঝে বহু প্রশ্ন জমে আছে, প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে মোস্তাককে। কিন্তু পারছে না। সিনিয়র অফিসারদের প্রশ্ন করা যায় না। পদের মর্যাদা এখানে অনেককিছু, অনেকটা বলা যায় সিনিয়র অফিসাররা তার জন্য মা-বাপ। তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয়। মোস্তাক অবশ্য মোসাদ্দেকের নিশ্চুপ প্রবৃত্তির কারণ বুঝতে পেরেছে। তাই নিজ থেকে বলে উঠলো,
“ছাগলকে বাঘের মাংস খেতে দেখেছো কখনো মোসাদ্দেক?”
“জ্বী স্যার?”

বেশ অবাক হলো মোসাদ্দেক। সাথে বিরক্ত ও। এইটা কেমন প্রশ্ন? ছাগল কি বাঘের মাংস খায় নাকি? ছাগল তো তৃণভোজী প্রাণী। সে তো হিংস্র নয়। উপরন্তু বাঘের মাংস খাওয়া কি যে সে কথা! মোস্তাক নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বললো,
“বললাম, ছাগলকে কি বাঘের মাংস খেতে দেখেছো?”
“এটা কি সম্ভব নাকি! এটা তো প্রকৃতির নিয়মের বাহিরে!”
“একদম ঠিক, তাহলে আমরা ছাগল হয়ে সোলাইমান শেখের মতো বাঘকে খেতে চাওয়াটা কি ভুল নয়!”

মোস্তাকের কথার মর্মার্থ এবার ঠিক বুঝলো মোসাদ্দেক৷ কিন্তু তার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। উলটো হতাশা যেনো তার বাড়লো। সে বিষন্ন কন্ঠে বললো,
“তাই বলে ঘুষ নিলেন স্যার?”
“আচ্ছা, বেতন কত পাও তুমি? রেশন টেশন ছাড়া?”

মোসাদ্দেক চুপ করে থাকলো। খুব আহামরি বেতন তার নয়। মেয়ে দুজন কলেজে পড়ে। তাদের স্যার, কলেজের খরচ সব মিলিয়ে হিমসিম খায় সে সংসার চালাতে। উপরি পাওনা নেই বলে সে যেনো হাপিয়ে উঠে। মোস্তাক এবার জিপে উঠতে উঠতে বললো,
“বুঝলে মোসাদ্দেক, উপরি পাওনা ছাড়া আসলেই এই জামানায় বাঁচা সম্ভব নয়। আমিও বুঝলে সৎ থাকতে চেয়েছিলাম। লাভ কি হলো! তুমি চিন্তা করো না। তুমিও ভাগ পাবে”
“লাগবে না স্যার। তবে একটা কথা! নিশী ম্যাডাম এবং প্রণয় সাহেবকে কি বলবেন? তারা তো আপনার থেকে একটা ফলাফল আশা করেছিলো”
“বলবো, খুঁজে পাই নি। আর এমনিতেও মাহাদী তো আ*ক্রমণ করে নি। এখন যদি সে কাউকে দিয়ে করিয়ে থাকে সেই কাহিনী আলাদা”

মোসাদ্দেক কথা বাড়ালো না। মোস্তাকের উপর তার খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে তাকে জিপ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে। এতোদিন তাকে নিয়ে গর্ব করতো সে। কিন্তু আজ বুঝছে খাদি পোশাকের আড়ালে সেও একজন অসৎ মানুষ________

মোস্তাক এবং মোসাদ্দেক বের হতেই দরজা আটকে দিলো ইমাদ। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“চাচা, ওরা গেছে গা”

সোলাইমান শেখ কিছু বলার পূর্বেই নিরেট পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো সোলাইমান শেখের,
“কত টাকা দিলেন আব্বা?”

সোলাইমান শেখ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালেন। দুহাত বুকে বেঁধে বসার ঘরের দরজার কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহাদী। তার মুখে সূর্যের তীব্র কমলা আলো আছড়ে পড়ছে। ঠোঁটে এক তীক্ষ্ণ হাসি। সোলাইমান শেখ কোমল কন্ঠে বললেন,
“তুমি কষ্ট করে উঠে এলে কেনো?”
“শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ লেগে আসছে। এতো শুয়ে থাকা যায়?”

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সোলাইমান শেখের পাশে বসলো মাহাদী। সোলাইমান শেখ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“আর তো অল্প কিছুদিন। তবে তুমি ওই মেয়েটার উপর আ*ক্রমণ করে ভালো করো নি। এখন প্রতিটি কদম মেপে ফেলাতে হবে”
“শোধ তো নিতেই হতো আব্বা”
“তুমি চিন্তা করো না, আমি ওই মেয়েকে যদি জা’হা’ন্না’ম না দেখাই আমার নাম সোলাইমান শেখ নয়। একবার শুধু তুমি এই কেসের ঝঞ্জাট থেকে বেড়িয়ে যাও। তারপর ওই তেলাপোকার পাখা ছাটবে তুমি। যেমনভাবে ইচ্ছে তেমনভাবে”

সোলাইমান শেখের কথা শুনতেই পৈশাচীক হাসি হাসলো মাহাদী। এখন শুধু কেসের শুনানীর অপেক্ষা______

******

নিশীর সামনে কফির কাপ। ধোঁয়া উড়ছে। একেই কপি খাবার অভ্যেস নেই তার। উপরন্তু কফিটি একেবারেই কালো। প্রণয় এই কালো কফি কি করে খায় বুঝে পায় না সে। এখন দেখছে শুধু প্রণয় নয়। মায়াও কালো কফি ই খায়। তাই তো সে তার জন্য কফি করে এনেছে। এনেছো ভালো কথা চুপ করে বসে থাকো। নাহ! সেকি সম্ভব। দু মিনিট পর পর বলছে,
“আপনি কফি খাচ্ছেন না যে?”
“আসলে খুব গরম খেতে পারি না”

নিশী কৃত্রিম হাসি হেসে কথাটা বললো। এতে অবশ্য মায়ার খুব কিছু যায় আসলো না। সে বেশ শব্দ করেই চুমুক দিচ্ছে তার কফির কাপে। নীরা এক কোনায় কিছু ইংরেজি বর্নমালার মোটা মোটা ব্লক কে সাজাচ্ছে। নিশী আজ ওকে অক্ষরজ্ঞান দিচ্ছে। সে প্রথমে প্রতিটি বর্ণকে চেনালো নীরাকে। এই কাজের জন্য তাকে দু সপ্তাহ ব্যয় করতে হয়েছে। অবশেষে সে এখন বর্ণ চিনে। তাকে যদি বলা হয় “W” দেখাও, নীরা দেখাতে পারে। আজ নিশী তাকে লেটারগুলো ক্রমান্বয়ে সাজাতে বলেছে। সে বিগত আধ ঘন্টা যাবৎ সেটাই করছে।সাজাচ্ছে, আবার এলোমেলো করছে। আবার সাজাচ্ছে। তার বেশ মজা লাগছে। ফলে নিশীর কাজ নেই। সেই ফাঁকে এই মায়া মেয়েটি টুপ করে এই ঘরে ঢুকেছে কালো বাজে কফি নিয়ে। এখন বাধ্য হয়ে তার উদ্ভট সব কথাগুলো চুপ করে শুনতে হচ্ছে নিশীর। কবে সে চুল নীল করেছিলো, কবে কাকে পানিতে ধাক্কা মেরেছিলো! এসব উদ্ভট কথা! এতে নিশী বেশ বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু মুখে কৃত্রিম হাসি অক্ষত রাখছে সে। মায়া একসময় বললো,
“আচ্ছা, আপনার জীবনের কোনো মজার কাহিনী নেই?”
“মজার কাহিনী বলতে?”
“মজার কাহিনী মানে এই ধরুন আপনি কখনো স্কুল পালিয়েছেন কি না! কখনো এমন কোনো কাজ করেছেন যেকারণে বকা ঝকা খেয়েছেন! কোনো ফানি স্টোরি আমার মতো!”

নিশী মেয়েটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মেয়েটিকে হুট করেই ভয় পাইয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। তাই হাসতে হাসতেই বললো,
“হ্যা, আসে তো। একজনের উপর খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিলো বুঝলে। সে আমাকে নষ্ট করতে চেয়েছিলো। তাই আমিও তার মা*থা ফাটিয়ে দিয়েছি। জেলে ছিলাম তিনদিন। প্রণয় সাহেব আমার কেস লড়ছেন”

কথাটা শুনতেই মায়ার হাসি মিলিয়ে গেলো। চোখে আতঙ্কের ছাপ দেখা গেলো। সে আর কথা বাড়ালো না। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মতো হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। মায়ার উবে যাওয়া চেহারাটা বেশ আনন্দ দিলো নিশীকে। ঠিক তখন নীরা তার কাছে এলো। গলায় শব্দ করে ডাকলো তাকে। দেখালো তার খেলা শেষ। সে সব বর্ণ ভালো করে সাজিয়েছে। নিশী সেটা দেখে তার কপালে চুমু আকলো। বললো,
“আমাদের নীরার মতো বুদ্ধিমতী দ্বিতীয়টি নেই। ভেরি গুড”

******

ঈশানের সাথে দেখা করতে এসেছে প্রণয়। ঈশানের বাসায় আসে নি। তার আড্ডা স্থলে এসেছে। এই আড্ডার জায়গার খোঁজ কি করে পেলো ভেবে পাচ্ছে না ঈশান। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। প্রণয় অবশ্য বেশ ভ্রুক্ষেপ দেখালো না। সে আয়েশ করে বসলো কাঠের বেঞ্চে। ঈশানের দলের ছেলেপেলে বেড়িয়ে গেলো প্রণয়কে দেখে। প্রণয় মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমটা দেখছে। এই ঘরে এদের মিটিং হয় হয়তো। প্রণয়ের হাবভাব দেখে ঈশান কঠিন কন্ঠে বললো,
“কি চাই এখানে?”
“আপনার সাথে কথা বলার সুযোগ। পাওয়া যাবে?”

প্রণয় হাসিমুখেই কথাটা বললো। ঈশান প্রতুত্তরে তাচ্ছিল্য মাখা কন্ঠে বলল,
“উকিল মশাই এর আমাকে চাই, ব্যাপারটা অদ্ভুত না? সেদিন তো আমাকে ভাগাতে পারলেই বাঁচতেন”
“সেটা সেদিনের কথা ছিলো। আজকের কাহিনী ভিন্ন। সেদিন তো জানতাম না, আপনি আমার মক্কেলের এতো ভালো চান। তাই তো লোক দিয়ে সুহার উপর আক্রমণ করলেন, আবার তাকে বাঁচাতেও গেলেন। সবাই ভাবলো মাহাদীর কাজ। কিন্তু কাজটি আসলে আপনার”………

চলবে