#ইতি_নিশীথিনী
#৪১তম_পর্ব
পেনড্রাইভের ফোল্ডার ওপেন করা হলো। সেখানে রয়েছে কিছু ছবি। যা ঈশান এবং নিশীর। ছবিগুলো লুকিয়ে তোলা হয়েছে। প্রায় ছবি ই কলেজ প্রাঙ্গনে তোলা। কিছু ছবি লাইব্রেরীতে তোলা, কিছু শেখ ভিলার সামনের রোডে। কিছু ছবি একাডেমিক বিল্ডিং এর নিচতলায়। প্রতিটি ছবি যে লুকিয়ে তোলা হয়েছে সেটা স্পষ্ট। ছবিগুলোর দিকে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশী। বিস্মিত আঁখিজোড়া স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। বিস্ময়ের মাত্রা তখন বাড়লো যখন চোখের সামনে আসলো কিছু এমন ছবি যার অস্তিত্ব নেই। সেই ছবিগুলোর মাঝে কিছু এমন ছবি রয়েছে যা এডিট করা। বেশ নিপুণ ভাবে এডিট করা। দক্ষ চোখ ছাড়া কখনোই প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে ছবিগুলো এডিট করা নয়। ছবিগুলোতে ঈশান এবং নিশীকে হাসতে দেখা যাচ্ছে। কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। যা ইহজীবনেও ঘটেছে কিনা নেই। রবিন এবার দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“এই ছবিগুলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নিশী হক এবং ঈশান মাহমুদের সম্পর্কের গাঢ়ত্ব। নিশী হকের সাথে ঈশান মাহমুদের এই গভীর সম্পর্কের জন্যই সে আমার মক্কেল মাহাদী শেখকে খু*ন করার চেষ্টা করে”
“অবজেকশন ইউর অনার, যদি মাহাদী শেখকে আহত করার উদ্দেশ্য ঈশান মাহমুদ ছিলো। তবে কেনো নিশী হকের মেডিকেল রিপোর্ট কেনো বলছে তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে?”
“রিপোর্ট তো মিথ্যেও হয়”
“ছবিও এডিট করা যায়। আর এখানে স্পষ্ট এই ছবিগুলো লুকিয়ে তোলা হয়েছে। একজন মানুষকে স্টক করে তার প্রাইভেসির গলা কে*টে এই ছবি তোলা হয়েছে। একটা ছবি, যেখানে একটি ছেলে এবং মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতে কি প্রমাণ হয়! ঈশান মাহমুদ এবং নিশী হক একই কলেজে পড়েন। সুতরাং তাদের মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ইমাদের সাথেও দেখা হতো নিশী হকের। তবে কি ইমাদের সাথেও তার সম্পর্ক রয়েছে। ইউর অনার, কেনো সবসময় আমাদের মস্তিষ্কে এটাই আনা হয় একজন ছেলে মেয়ে কথা বললেই তারা কোনো সম্পর্কে আবদ্ধ। কেনো আনা হয় মেয়েটির চরিত্রের সমস্যা রয়েছে কারণ সে একজন পুরুষের সাথে কথা বলছে। আমার উকিল বন্ধুর কাছে আমার একটি প্রশ্ন মেয়েদের কি পুরুষদের সাথে কথা বলা নিষিদ্ধ কোনো আইন? তাহলে তো আপনি আগামীকাল আমার সাথেও আমার মক্কেলের সম্পর্ক তৈরি করে দিবেন। কারণ আমার মক্কেল আমার সাথেও কথা বলে। কারণ আপনার মতে পুরুষ নারী কথা বললেই তাদের সম্পর্ক রয়েছে। তা উকিল সাহেব আপনার বুঝি কখনো কোনো নারীর সাথে কথা হয় না?”
প্রণয়ের কন্ঠের প্রখরতা বাড়লো। প্রণয়ের যুক্তিতে রবিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগলো। অন্যদিকে কোর্টে হাসির লহর উঠলো। বিচারক বেশ কঠোর ভাবেই পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনলেন। রবিন নিজেকে সামলে বললো,
“অহেতুক কথা বলে কোর্টের সময় ব্যয় করবেন না। এই ছবিগুলো যে মিথ্যে তার প্রমাণ কি?”
“ইউর অনার আমি আমার দ্বিতীয় সাক্ষীকে কাঠগড়ায় ডাকতে চাই। জনাব ঈশান মাহমুদ। আশা করি যাকে নিয়ে এতোটা কাদা ছোড়াছুড়ি তার সাক্ষী নেওয়াটাও দরকার”
ঈশান মাহমুদ সাক্ষী দিবে এটা যেনো কখনোই কল্পনা করে নি রবিন। সে আড়চোখে তাকালো সোলাইমান শেখের দিকে। দাম্ভিক সোলাইমান শেখের অহংকার আজ চূর্ণবিচূর্ণ। তার চোখে মুখে এক অদ্ভুত ভীতি। কপালে ক্ষীন ভাজ। তিনি কড়া নজরে তাকালেন ইমাদের দিকে। ইমাদ শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“চাচা, অসম্ভব। আমি তো ওর ব্যাবস্থা করছিলাম”
“কি ব্যবস্থা করেছো সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি”
ইমাদ আর কথা বাড়ালো না। নতমস্তক বসে রইলো। ঈশানকে দেখে খুব একটা অবাক হলো না নিশী। সে জানতো ঈশান তার হয়ে সাক্ষী দিবে। ঈশানের আচারণ বরাবর ই তার নিকট অনেক ঘোলাটে। তার কার্যকলাপে ধোঁয়াশা থাকে। তবে সুহাকে বাঁচানোর জন্য নিশী তার নিকট কৃতজ্ঞ। ঈশান কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ নিলো। রবিন থমথমে মুখে বসে রয়েছে৷ তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে যাচ্ছে ঈশানকে। ঈশানের এতে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ হলো না। প্রণয় তার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলো,
“ঈশান মাহমুদ, আপনাকে যা জিজ্ঞেস করবো সেটার উত্তর বিনা লুকিয়ে আজ আপনি কোর্টে দিবেন”
“জ্বী”
“নিশী হক কে কবে থেকে চিনেন আপনি?”
“আমি নিশীকে কলেজে ভর্তি থেকেই চিনি”
“আমি যতদূর জানি আপনি তার সমবয়সী নন। বেশ সিনিয়র আপনি। তাহলে তাকে চিনার কোনো উপলক্ষ?”
“অবশ্যই আছে। কাঁচ এবং হিরে দেখতে একই হলেও তাদের বৈশিষ্ট্য কিন্তু আলাদা৷ নিশীও তেমন হিরে, ওরে পরখ করেই চেনা যায়। ওর প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয় তখন যখন মাহাদী তামিম নামক ছেলেটিকে পি*টি*য়ে আধ*ম*রা করে ফেলে। নিশীই কেবলমাত্র মানুষ ছিলো যে ঘটনাটিকে দেখেও অদেখা করে নি। শুধু তাই নয় সে মাহাদীর উত্যক্ত করাটিকে কখনোই সহ্য করতো না। মাহাদী যখন কলেজ প্রাঙ্গনে তার অনুমতি বিহীন হাত টেনে ধরে নিশী তাকে চ*ড় অবধি দিয়েছিলো। নিশী এমন ই সাহসী, নির্ভীক। তাই নিশীকে চেনা এতোটা কঠিন নয়”
ঈশানের কথা শেষ হতেই প্রণয় বললো,
“পয়েন্ট টু বি নোটেড মাই লর্ড, মাহাদী মা*রপিট করতেন, শুধু তাই নয় তার উপর চার্জ ও লেগেছিলো”
রফিক এগিয়ে দিলো এই কাগজ গুলো। তারপর প্রণয় আবারো তার প্রশ্নোত্তর খেলা শুরু করলো,
“নিশীর সাথে আপনার চেনা পরিচয় ব্যাতীত কি কোনো সম্পর্ক ছিলো?”
“নাহ, ছিলো না। হবেও না। আমি শুধু তার শুভাকাঙ্ক্ষী”
“মাহাদীর সাথে আপনার শত্রুতাটি ঠিক কেমন ছিলো?”
প্রণয়ের হুট করে প্রশ্নে ঈশান থেমে যায়। কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে উত্তর দেয়,
“ক্ষমতা, সভাপতি হবার লড়াই। এটাই আমাদের শত্রুতা। কলেজের ইলেকশন এ আমার জয় হলেও সেই ইলেকশন কাউন্ট করা হয় না মাহাদীর ক্ষমতার জোরে।”
“কখনো তাকে খু*ন করার ইচ্ছে ছিলো কি?”
“মাহাদীর প্রতি আমার রাগ আছে, ছিলো। তবে মানুষ হ*ত্যা করার মতো ইচ্ছে আমার নেই। যতই হোক, আইন নিয়ে পড়ে তো আইন ভাঙ্গতে পারি না”
প্রণয় কিঞ্চিত সময় নিলো। তারপর ধীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“ইউর অনার, মাহাদী শেখ নিজের কৃতকর্ম ডাকার জন্য আমার মক্কেলের চরিত্র হ*ত্যার ষড়যন্ত্র করেন। ঈশান মাহমুদের সাথে তার শত্রুতা থাকলেও সেটা কখনোই জীবনের ঝুকি ছিলো না। তিনি যখন কোনো ভাবেই আমার মক্কেলকে দমাতে পারেন নি। তখন ঈশান মাহমুদের সাথে তাকে জড়িয়ে তার মানহানির প্রচেষ্টা করেন। ঈশান মাহমুদের সাথে কখনোই তার কোনো সম্পর্ক ছিলোই না। শুধু তাই নয়, ঈশান মাহমুদ যে ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেছেন, সৌভাগ্যবশত একটা ভিডিও ক্লিপ আমার হাতে আসে। যে ভিডিওটি করেছে তাকে পুলিশ প্রটেকশন দেওয়া হয়েছে। কারণ তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে”
রফিক আরোও একটি পেনড্রাইভ এগিয়ে দিলো। পেশকার সেই ভিডিওটি চালালো। ভিডিও শুরু হবার সাথে সাথেই ইমাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। ভিডিওটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নিশী সকলের সম্মুখে মাহাদীকে থা*প্প*ড় মেরেছে। মাহাদী তার সাথে রাগের বসে বেশ বাজে ব্যাবহার করছে, বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এক পর্যায়ে তাকে হু*ম*কি অবধি দিয়েছে। রবিনের মুখ পাংশুটে হয়ে গেলো। সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মুখ চেপে বসে রয়েছে। বেশ অবিন্যস্ত দৃষ্টি তার। প্রণয় তার বক্তব্য শেষে নিজ জায়গায় বসে পড়লো। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। রবিনের আত্মবিশ্বাস এখন নড়বড়ে। এদিকে নিশী অবাক চোখে প্রণয়কে দেখছে৷ কেনো যেনো চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না। সৃষ্টিকর্তার কাছে সে এই লোকটির জন্য কৃতজ্ঞ। সে না থাকলে সত্যি ই কি করতো নিশী!
রবিন প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করলো। সে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে শুধালো,
“নিশীর সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই, অথচ নিশী হকের যেকোনো বিপদে সবার পূর্বে আপনাকেই দেখা যায়৷ কেনো বলুন তো? নিশী হকের বর্তমান বাসাটির মালিক ও বোধ হয় আপনার আপন ফুপু। আমি কি ঠিক বলছি?”
নিশী রবিনের প্রশ্নটি শুনে বেশ অবাক হলো। বিস্মিত নজরে তাকিয়ে রইলো ঈশানের দিকে। আফিল গেটের বাড়িটি যে ঈশানের সেটা তার অজানা। এই মানুষটিকে সত্যি ই বুজে উঠতে পারে না নিশী। ঈশান আড়চোখে নিশীর দিকে তাকালো, তারপর একটু সময় নিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“হ্যা”
“তবুও বলবেন কোনো সম্পর্ক নেই?”
“যা নেই, সেটাকে হ্যা বলবো কেনো? আপনি জোর করে না কে হ্যা বানাতে পারবেন না। বিশ্বাস না হলে কলেজের কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর বাড়িটি আমার ফুপির, ব্যাপারটা কাকতালীয়। আমিও প্রথমে জানতাম না। পরে জানতে পারি”
“কেনো মিথ্যে বলছেন?”
“আমি সত্য বলছি”
“এই ছবিগুলো যেখানে আপনাকে এবং নিশীকে একসাথে দেখা যাচ্ছে, সেটাকেও আপনি মিথ্যে বলবেন?”
“মিথ্যে বলবো কেনো? সেখানে আমার চাচা জসীম আহমেদ ও ছিলেন৷ আপনার মক্কেলের ভাড়া করা ফটোগ্রাফার উনাকে তুলেন নি। আর লাইব্রেরিতে আমাদের দেখা হওয়াটা কাকতালীয় ছিলো”
“সব কিছুই তো আপনার জীবনে কাকতালীয়”
“অনেকটা তেমন ই”
ঈশানের বেপরোয়াভাবে বলা কথায় রবিন তাকে প্যাঁচাতে পারে নি। তার কাছে তেমন কিছু ছিলো ও না প্রশ্ন করার মতো। ঈশান নেমে গেলো কাঠগড়া থেকে। রবিন কেসটিকে শেষ অবধি টানতে বলে উঠে,
“কিন্তু এতে এটা মিথ্যে হয়ে যায় না যে নিশী হক আমার মক্কেলকে মা*রতে চেয়েছিলো। সে এখন প্যারালাইজড। যদি আমার মক্কেল দোষী ই হয় তবে আদালত তাকে শাস্তি দিবে, জীবন বাঁচানোর নামে আইন নিজের হাতে নেওয়াটা কখনোই যৌক্তিক নয়”
প্রণয় হেসে উঠলো। রবিন তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও যেনো কেসটিকে বাঁচাতে পারছে না। এবার প্রণয় উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“এখানেও একটি মজার ব্যাপার রয়েছে। মাহাদী শেখ কি আদৌও প্যারালাইজড? একটা ছোট্ট ইটের ভাঙ্গা অংশ কি এতোটা শক্তিশালী যে কাউকে প্যারালাইজড করে দিবে?”
“ঘুরিয়ে না বলে সরাসরি বলুন”
বিচারকের কথায় প্রণয় বললো,
“ইউর অনার, আমার শেষ দুজন সাক্ষীকে আমি কোর্টে পেশ করতে চাই। একজন প্যাথোলজি ল্যাবের কর্মকর্তা শামীম এবং দ্বিতীয় জন অসি মোস্তাক হোসেন”
মোস্তাকের কথাটা শুনতেই সোলাইমান শেখ যেনো আকাশ থেকে পড়েন। তার মুখে জমে আষাঢ়ের মেঘমেদুর। প্যাথোলজি ল্যাবের ছেলেটি কাঠগড়ায় উঠে। তাকে প্রশ্ন করতেই সে গড়গড়িয়ে বলে,
“নকল রিপোর্ট বানানোর জন্য আমাকে টাকা দেওয়া হয়। আমি তখন জানতাম না রিপোর্ট টা কোর্টে পেশ করা হবে”
রফিক পেশকারকে একটি চেকের স্ক্যানকপি পেশ করে। যেখানে সোলাইমান শেখের সাইন রয়েছে। রবিন ছেলেটিকে নানাভাবে প্রশ্ন করলেও সে তার জবানবন্দি পালটায় না। এরপর মোস্তাক কাঠগড়ায় আসে। মোস্তাককে জিজ্ঞেস করতেই সে সেদিনের ঘটনাটি বলে। তার সাথে মোসাদ্দেক থাকায়, মোসাদ্দেকের জবানবন্দি ও নেওয়া হয়। রবিন হাত কামড়ে বসে থাকে বহু সময়। প্রণয় কেস ক্লোজিং এ বলে,
“ইউর অনার, আমরা ২০২২ সালে বাস করি। অথচ চিন্তাধারাগুলো এখনো সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের। তবুও আমি বলবো ওই যুগের নারীকে সম্মান বেশি করা হতো। আজকের এই বিশ্রী সমাজ পান থেকে চুন খসলেও নারীকে দায় করে। একজন নারী তার সাথে হওয়া অন্যায়ের দাবি জানিয়ে যদি আইনের কাছে আসে তাকে আরোও হেনস্তা হতে হয়। আজ নিশীর সাথে সেই রাতে যে বর্বরতা হয়েছে সেটার বিচার পাওয়া তো দূর সে শুধু লাঞ্ছনা পেয়েছে। বিনা দোষে তার চরিত্র হ*ত্যা করা হয়েছে। তাকে খু*নের চেষ্টার দায়ে জেলে দেওয়া হয়েছে। যেখানে দোষী বিত্ত, ক্ষমতার জোরে অসুস্থতার ভান করে বসে রয়েছে। এটাই কি আইন? এটাই কি ন্যায় বিচার। যদি তাই হয় তবে ধিক্কার এই আইনকে। আজ যদি নিশী হক ন্যায় বিচার না পায়, সেই সকল নারী ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে যারা প্রতিনিয়ত এই বর্বর ক্ষমতাবান মানুষদের পায়ের তলে পিষছে। আজ যদি নিশী হক মিথ্যুক হয় তবে জামশেদ সাহেব, ঈশান, শামীম, মোস্তাক, মোসাদ্দেক সকলে মিথ্যুক। আজ যদি নিশী হক বিচার না পায়, তবে শুধু নিশী হারবে না, সেই সব নিশীথিনীরা হারবে যারা এই বিশ্রী সমাজের সাথে লড়ছে। দ্যাটস অল, ইউর অনার”
প্রণয় তার সিটে এসে বসলো। তার কন্ঠ কাঁপছে। সে একরাশ আবেগ নিয়ে তাকালো নিশীর দিকে। মেয়েটির চোখ ছলছল করছে। সাহসী মেয়েটির চোখে৷ অশ্রু অথচ মুখে লেপ্টে আছে নিখাদ হাসি। প্রণয় চোখের ইশারা করলো, বোঝালো,
“আমি আছি”
নিশী পলক ফেললো। একবিন্দু নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। বিচারক রায় ঘোষনার পূর্বেই কোর্টের সময় সীমা শেষ হলো। শুনানীর আগামীডেট পড়লো সামনের মাসের ২তারিখ। তখন শুধু রায় ঘোষনা করা হবে। মাহাদী শেখকে কাস্টেডিতে রাখা হবে এই ক দিন। সোলাইমান শেখের দম্ভ আজ চূর্ণবিচূর্ণ। সবাই বের হলেও সে বসে রইলো সেখানে। এদিকে রবিনের মুখোমুখি হলো প্রণয়। হেসে বলল,
“ভালো উকিল আপনি, শুধু ভালো মন্দ টা বিচার করতে পারেন নি”
রবিন উত্তর দিলো না। তার মুখশ্রী কঠিন। সে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো। কোর্ট থেকে বের হতেই প্রণয় স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আমরা জিতে গেছি নিশী, শুধু জয়ের ঘোষণা বাকি”
নিশী তখন মৃদু কন্ঠে বললো,
“আপনার সময় হবে কিছু বলার আছে”
“আপনার জন্য আমার সময়ের অভাব নেই”
সুহা মুচকি হাসলো। তারপর বলল,
“আমি ওদিক গেলাম”
নিশী কিঞ্চিত লজ্জা পেলো। সে অনেককিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু কথাগুলো জড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমে মস্তিষ্ককে শান্ত করলো সে। তারপর বললো,
“এই নিশীথিনীর অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি কবি নই, তাই গুছিয়ে বলার ক্ষমতাটাও নেই। শুধু একটা প্রশ্ন করবো, আমি অনেক উড়েছি, মুক্ত বাতাসে অনেক তো শ্বাস নিলাম। এবার আবদ্ধ হতে চাই, সেই আবেগের শেকলে। ফিরতে চাই। যদি ফিরে আসি তবে কি প্রণয়ের নিশীথিনী হতে পারবো? প্রণয় কি শুধু এই নিশীথিনীর যাত্রার সহযাত্রী ই হবে? নাকি হবে সঙ্গী? আপনসঙ্গী?”………..
চলবে
#ইতি_নিশীথিনী
#৪২তম_পর্ব
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমে মস্তিষ্ককে শান্ত করলো নিশী। তারপর বললো,
“এই নিশীথিনীর অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি কবি নই, তাই গুছিয়ে বলার ক্ষমতাটাও নেই। শুধু একটা প্রশ্ন করবো, আমি অনেক উড়েছি, মুক্ত বাতাসে অনেক তো শ্বাস নিলাম। এবার আবদ্ধ হতে চাই, সেই আবেগের শেকলে। ফিরতে চাই। যদি ফিরে আসি তবে কি প্রণয়ের নিশীথিনী হতে পারবো? প্রণয় কি শুধু এই নিশীথিনীর যাত্রার সহযাত্রী ই হবে? নাকি হবে সঙ্গী? আপনসঙ্গী?
প্রণয় বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিশীর দিকে। নিশীর গাঢ় নয়নে আজ শুধু তার প্রতিবিম্ব দেখতে পারছে। নিজ কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। যে অভিব্যক্তিটুকু শোনার প্রতীক্ষায় সে দীর্ঘদিন যাবৎ ছিলো, সেই অভিব্যক্তিগুলো এতোটাই আকস্মিকভাবে শুনবে কল্পনাও করে নি প্রণয়। নিশীর কথাগুলোর মাঝে কি যেনো ছিলো! মূহুর্তেই হৃদস্পন্দের বেগ বেড়ে গেলো। এতোদিনের ছাইচাপা ভালোবাসার আগুনটা ধপ করে জ্বলে উঠলো। মস্তিষ্ক ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলো। কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত জানা নেই প্রণয়ের। সে শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিশীর দিকে। নিশী উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু প্রণয়ের চাহনীতে কিঞ্চিত অপ্রস্তুত হলো সে। প্রণয় এমন ভাবে তাকিয়ে রয়েছে যেনো তার থেকে তার সম্পত্তির ভাগ চেয়েছে নিশী। আশপাশটা একবার চোখ বুলালো সে। কোর্ট গেটেই দাঁড়িয়ে আছে তারা। অনেকেই আসা যাওয়ার সময় একবার করে চোখ ঘুরিয়ে দেখছে তাদের। নিশী দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালো। সে কিছুটা ইতস্ততবোধ করছে। কোনো পুরুষকে এভাবে প্রেম নিবেদন এই প্রথম করছে সে। অথচ সেই পুরুষটি তার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। প্রণয়ের মুখশ্রী দেখে কেউ বলবে না এই একই মানুষটি ভেতরে চতুরতা দেখিয়ে কেস লড়েছে। নিশী গলা খাকারি দিলো। তারপর নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
“কিছু বলছেন না কেনো?”
“নিশীথিনী!”
এতো সময় প্রণয়ের কন্ঠ শুনতে পেলো নিশী। বেপরোয়া নিশীর হৃদয়ের ভেতরে উচাটন শুরু হলো। কেনো যেনো হাতপা অসাড় লাগছে। অস্পষ্ট কন্ঠে বললো,
“জ্বী?”
“আমাকে একটা চিমটি কাটবেন?”
“জ্বী?”
নিশী কপাল কুচকে হতবাক দৃষ্টিতে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় তার চাহনীকে উপেক্ষা করেই বললো,
“চিমটি কাটবেন একটু? আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশ্বাস হচ্ছে না যে নিশীথিনীকে ভালোবাসা শেকল থেকে মুক্ত করেছিলাম, সে নিজ থেকে আমার ভালোবাসার খাঁচায় ধরা দিচ্ছে। আমি সত্যি শুনছি তো। আপনি সত্যি ই আমার হতে চান? আমার নিশীথিনী?”
প্রণয়ের কন্ঠে আবেগের ঝলকানি। তার চোখ চকচক করছে। নিশীর মনে হলো, সে নীরার বড় একটা ভার্শন দেখছে। সেই আবেগ, সেই চাহনী। ছোট কোনো বাচ্চা বহুপ্রতীক্ষার পরে তার হারানো কাগজের নৌকাটি ফিরে পেলে যেমন অবিশ্বাস্য চাহনীতে তাকিয়ে রয়, প্রণয় ও তার দিকে সেভাবেই তাকিয়ে রয়েছে। নিশী নিঃশব্দে হাসলো, তারপর কোমল কন্ঠে বললো,
“সন্দেহ আছে?”
“আপনার হাতটা এবার ধরতে দিবেন তো?”
“একটা শর্ত আছে”
“কি শর্ত?”
“হাতটা ছাড়া যাবে না”
নিশীর নির্লিপ্ত কন্ঠে সশব্দে হেসে উঠলো প্রণয়। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমি এমনেই নাছোরবান্দা, কিছু মনে ধরলে তার পিছু ছাড়ি না। সুতরাং নিশ্চিন্তে থাকুন, আপনি আপনার পিছু ছাড়ছি না। আজীবন এভাবেই আপনার পাশে থাকবো। এভাবে শক্ত করে হাতটি ধরে রাখবো, আপনার সঙ্গী হয়ে, আপনসঙ্গী হয়ে”
বলেই নিশীর নরম হাতখানা নিজ হাতের মাঝে শক্ত করে আবদ্ধ করলো। নিশী আজ বাধা দিলো না। দূর থেকে অবশ্য একজোড়া চোখ নিশীকে দেখছে। তার হাস্যজ্জ্বল ঝলমলে মুখশ্রীটা অপলক নজরে দেখছে সে। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে ঈশানের। সে জানে জোর করে কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়। সে তো কখনোই নিশীকে পেতে চায় নি, শুধু শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে পাশে থাকতে চেয়েছিলো। তাহলে আজ কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে! আজ কেনো নিজের বুঝদার হৃদয়টা জেদ করছে! কেনো বারবার চিৎকার করছে- “আমি কেনো তার সঙ্গী হতে পারলাম না? আমি কেনো নিশীথিনীর প্রণয়টি হতে পারলাম না”। হৃদয়ের ভেতর চেপে থাকা দীর্ঘশ্বাসটি অচিরেই বুকচিরে বের হলো। ঈশান আর দাঁড়ালো না। পা বাড়ালো নিজ গন্তব্যে।
প্রণয় নিশীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু তার পূর্বেই যেখানে জামশেদ সাহেব এবং নিহিতার আগমণ ঘটলো। জামশেদ সাহেব হালকা কাশ দিলেন। সাথে সাথেই নিশী হাত সরিয়ে নিলো। প্রণয় ও তার হাত ছেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো। জামশেদ সাহেব এখনো বাড়ি যান নি, তিনি অপেক্ষা করছিলেন নিশীর জন্য। নিশীকে ধীর কন্ঠে বললেন,
“একটু কথা বলা যাবে?”
নিশী অবাক হলো ঠিক ই কিন্তু বাধা দিলো না। নরম গলায় বললো,
“কি কথা চাচা?”
“তুই বাড়ি যাবি না?”
জামশেদ সাহেবের কথায় হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিশী। ‘বাড়ি’ শব্দটি তার কাছে বড্ড অচেনা। কোন বাড়ি যাবে সে? চাচা বাড়ি! সে তো সেই কবেই ছেড়ে এসেছে। ছেড়ে এসেছে বললে ভুল হবে। তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তার অপরাধ ছিলো, কাঠামোগত সমাজের মতে তার স্বচ্ছ জীবনে কলঙ্ক লেগেছিলো। নিশী চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার মুখে ভাষা নেই। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। জামশেদ সাহেব আবারো শুধালেন,
“বাড়ি যাবি না?”
“ও বাড়ি তো আমার নয় চাচা”
“এখনো রেগে আছিস?”
অপরাধী কন্ঠে শুধালেন জামশেদ সাহেব। নিশী মৃদু হেসে বললো,
“রেগে থাকবো কেনো? চাচী যা করেছেন ভেবেই হয়তো করেছেন। আর আমি আমার পাওনা বুঝে নিয়েছিলাম। তাই ও বাড়িতে যাবার মানে হয় না”
“এভাবে বলিস না মা, আমি যে টুটুল কে মুখ দেখাতে পারবো না”
নিশী আবারো হাসলো। চাচাকে খুব অসহায় লাগছে, মায়াও হচ্ছে। কিন্তু আত্মসম্মান নামক জিনিসটির জন্য সে ওই বাড়িতে যেতে চায় না। চায় না মুখোমুখি হতে আবারো সেই জীবনের সাথে যাকে সে ছেড়ে চলে এসেছে। নিশী নরম স্বরে বললো,
“বাবা, আপনার উপর কখনোই রাগ করবে না। কখনো দায় ও দিবে না। কারণ মানুষটি আপনাকে খুব সম্মান করতো, ভালোবাসতো। আপনি চিন্তা করবেন না চাচা, নিজেকে দোষ ও দিবেন না। আমি ভালো আছি। তবে ও বাড়ি আমি আর ফিরবো না। যতই হোক, আমি চাই না আমার জীবনের কালিমা নিহিতাকে স্পর্শ করুক”
জামশেদ সাহেব মাথা নিচু করে ফেললেন। তার ভাতিজী এতো সুনদ্র ভাষায় তাকে ফিরিয়ে দিবেন কল্পনা করেন নি তিনি। তিনি একবার প্রণয়ের দিকে তাকালেন। কৃতজ্ঞ কন্ঠে বললেন,
“নিশীকে দেখো, আমরা ওর খেয়াল রাখতে পারি নি। তুমি রেখো। মেয়েটি অনেক একা”
প্রণয় জড়তাহীন কন্ঠে বললো,
“সে আমার দায়িত্ব, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা পালন করে যাবো। চিন্তা করবেন না”
জামশেদ সাহেব হাসলেন। বুড়ো মানুষটির চোখ ছলছল করছে। নিশীর খারাপ লাগছে। কিন্তু সে নিজ সিদ্ধান্তে অটল। ও বাড়ি সে ফিরবে না। সুহাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।
শরতের ঝড়ো বৃষ্টির মাঝে চলছে মোস্তাকের জিপ। মোসাদ্দেকের মন আজ খুব ভালো। স্যারের প্রতি বিশ্বাসটা তার অটুট রয়েছে, সেটাই শান্তির ব্যাপার। মোস্তাক বাহিরে দৃষ্টি অক্ষত রেখে বললো,
“কি মোসাদ্দেক বাঘের মাং*স কেমন লাগলো? আজ থেকে ছাগলও মাংসাশী, কি বলো?”
মোস্তাকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না মোসাদ্দেক। তার পূর্বেই একটি ট্রাক পিষে দিলো তাদের জিপ। রাস্তার এক ধারে পড়ে রইলো নিথর দুটো দেহ……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি