জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-০১

0
1245

জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
||পর্ব: ০১||

‘বাদাম খেলে বুদ্ধি বাড়ে’ – কথাটা শোনার পর থেকে মেয়েটা আমার আধ কেজি বাদাম শেষ করে ফেলছে। এখন ঘরে-বাইরে যাচ্ছে, পেটে ব্যথায় বালিশ চাপা দিচ্ছে, ব্যায়াম করছে।

কথাটা বলেই উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন মা। কথাটা কর্ণকুহরে হানা দিতেই দ্রুত উঠে বসলাম। পেটে বালিশ চেপে শুয়ে ছিলাম আমি। সবে তন্দ্রা লেগে এসেছিল। টেবিলের উপর থেকে চশমাটা পড়ে নিলাম। ‘ছলছল নয়নে হাসি মাখা বদনে’ – অনুভূতি নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। বাড়িতে মেহমান। তাঁদের সামনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে চাইনা, তার দরুন এবারে শুয়ে থাকা। মা সেই কথা ফাঁস করে দিলেন। দোতলায় দাঁড়িয়ে অসহায় দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম। না! আর সহ্য করা যাচ্ছেনা।

সবাই বলে আমি বুদ্ধু। জ্ঞান-বুদ্ধির ছিটেফোঁটাও নেই আমার মাঝে। পড়াশোনা দিয়ে ভর্তি। ফাঁকা অংশে গোবরে ভর্তি। জ্ঞান-বুদ্ধি বৃদ্ধি করার উপায় লিখে সার্চ দেওয়া পর কতগুলো বাদামের ছবি দেখালো আমায়। বাদাম স্মৃতিশক্তি প্রবল করে, জ্ঞান-বুদ্ধি বৃদ্ধি করে। সরল মনে আমিও বাদাম খেয়েছিলাম। তবে পরিমাণ না দেখেই, অতিরিক্ত। এজন্য গত দুইদিন ধরে ভুগছি।

আমি অস্বস্তি নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। নিচ থেকে নানুমণি ডেকে উঠলেন। আজকেই দেশে ফিরেছেন। ছোটো ছেলের সাথে দেশের বাইরে থাকে সে। এবার থেকে পাকাপোক্ত ভাবে দেশেই থাকবেন। আমাদের বাড়ির পাশের বাড়িতেই থাকবেন। দুই বছর কাজ চলছিল। বাবাই দেখতেন। এখনও অনেকটাই বাকি আছে।
আমি একহাত ঘোমটা টেনে সবার সামনে উপস্থিত হলাম। সালাম বিনিময় হল। সবাই তখন আমাকে দেখতে ব্যস্ত। একজন ফর্সা দেখতে মহিলা আমার হাত ধরে পাশে বসালেন। তিনি নিঃসন্দেহে আমার মামুনি। গালে হাত রেখে আলতো আদর করে বললেন, “কেমন আছিস, আরু মা? অনেক বড় হয়ে গেছিস।”

আমি কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, “আমি শুধু বয়সেই বেড়েছি, বুদ্ধিতে নয় মামুনি। এজন্য ভালো নেই।”

“আহারে সোনাপাখি আমার। চিন্তা নেই। আমি এসেছি-না? এবার বুদ্ধি বাড়ার সব টিপস তোকে শেখাবো।”

মাথা নেড়ে মৃদু শব্দে বললাম, “আচ্ছা।”

পাশ থেকে একটা মেয়ে আমাকে মৃদু হেসে বলে, “তা আরু, বুদ্ধি বাড়াতে তো বাদাম খেতে হয়। মানুষের বুদ্ধি কমাতে মানে হাবা-টাবা করতে কি করতে হয় জানো? না-মানে ভাইয়া একটু বেশি চালাক তো!”

ও তুর। মামুনির একমাত্র মেয়ে। বয়স আমার সমান। তারপাশে ছেলেটি বসা। তিনি অপূর্ব। নামটা অচেনা নয়। বিদেশে অবস্থানরত সময়ে মা প্রায়ই তাদের সাথে কথা বলতেন। আমি শুনেছি।
আমি ফিচেল হেসে জবাব দিলাম, “আছে তো! কী জানো? কী জানো ছিল? মনে পড়ছে না। [একটু ভেবে]
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। প্রতি শনিবার আর মঙ্গলবার টাটকা দুপুরে এক ঘণ্টা গোবর মাথা দিয়ে রাখতে হবে। বেশি না তিনমাস। এক সাধুবাবা বলেছিলেন আমায়।”

আমার কাছে হাসির কথা না লাগলেও তাদের কাছে যথেষ্ট ছিল। সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এবার তুর বিদ্রুপ করে বলে ফেলে, “ভাই টিপস্ টা অ্যাপ্লাই করে দেখবো?

অপূর্ব ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার পানে। সাধারণ এমন দৃষ্টিতে কেউ তাকায় না। ”মাম্মা আমি আসছি বলে”, বেরিয়ে গেলেন তিনি।
মা এবার কড়া হুংকার দিলেন, “বিজ্ঞানী নিউটনের মাথায় আপেল পড়ে অভিকর্ষ বল আবিষ্কার হয়েছে আর তোর মাথায় তাল পড়ে গাধা আবিষ্কার হইছে।
মানছি তোর বুদ্ধি নাই, তাই বলে কোথায় কি কথা বলতে হয়। তা-ও জানিস না।”

‘আমি গাধা’ আবার সত্যি কান্না পেয়ে গেল আমার। ছোটো বেলায় তাল আমার প্রিয় ফল ছিল। আমি তালের জন্য গাছ তলায় কত গিয়েছি। তখন বয়স আমার চার কি পাঁচ হবে। গাছ থেকে পাকা তাল মাথার উপরে পড়েছিল। বেশি বড় ছিলনা গাছটা। তবে মাথা ফেটে গেছিল। মাসের বেশি সময় হাসপাতালেই অতিবাহিত হয়েছিল। দুরন্ত আমি তখন বোকা আমিতে পরিণত হলাম।

তুর আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি কি জানো? ভাইয়া একটা মাস্তানের মতো। কত ছেলেদের মে’রেছে তার হিসেব নেই। দুদিন পরপর বিচার আর বিচার। তাই তো দেশে ফেরা। তুমি তাকে মাথা ওগুলো দিতে বলছ, এবার তোমাকে যদি‌ মে’রে ফেলে।

বিস্মিত কণ্ঠে আওড়ালাম, “মানে?”
আমি ম’রতে চাইনা। আমার অনেক পড়া আছে।”
ছুটে ঘরে চলে এলাম। দরজার ছিটকিনি তুলে বিছানায় গুটিয়ে বসলাম। বারান্দার দরজা খোলা, জানালা খোলা। আমি দ্রুত দরজা জানালা বন্ধ করে দিলাম। পর্দা টেনে দিলাম। কাগজ বড় বড় করে লিখলাম, ‘এ ঘরে ভুত ছাড়া কেউ থাকেনা।’ দরজার বাইরে লাগাতে দিয়ে থেমে গেলাম। যদি ভুত এই লেখাটা পড়ে এই ঘরে কাছে চলে আসে, তখন? আমি বাস্কেটে ফেলে দিলাম। অন্য একটা কাগজে লিখলাম, ‘এ ঘরে কেউ থাকে না অর্থাৎ প্রবেশ নিষেধ।’ আমি কাগজটা দরজার সাথে ভালোভাবে লাগিয়ে দিলাম।
লাফালাফিতে পেটে ব্যথা বেড়েছে। বালিশ চেপে শুয়ে রইলাম বিছানায়। উপর থেকে কাঁথা মুড়ি দিলাম। ‘আমি ম’রতে চাইনা’

আমি আরশি। সবাই আরু বলেই ডাকে। নবম শ্রেণির ছাত্রী। অর্ধেক বছর পর দশম শ্রেণিতে উঠব। এই সরল ব্যবহারের জন্য সবাই আমাকে কাঠবিড়ালী বলে ডাকে।
___
মামাদের বাড়িতে রং মিস্ত্রী এসেছে। নকশা অনুযায়ী রং করছে দেয়ালে। বেশ কয়েকদিন লাগবে। ঘরে শুয়ে বসে আর পড়াশোনা দিয়ে দিন যেত আমার। আজ ব্যতিক্রম হল। তুর আমাকে নিয়ে যেতে এলো। হাতে তার পানির গ্লাস। তবে স্যালাইনে ভর্তি। আমি তখন বই পড়ছিলাম। আমাকে গ্লাস দিয়ে মায়ের কথা বলল। আমি খেয়ে শান্তিতে বসলাম। বাবা ওকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দিবে। কী মজা! আমরা একসাথে যাবো, থাকব। অবশ্য ওদের বাড়ির কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকবে। তুর মিষ্টি করে বলে, “আরু, আমাদের বাড়িতে যাবে। একা একা ভালো লাগছেনা।”

তুরের মিষ্টি কণ্ঠের আবদার ফেলতে নারাজ হলাম। সম্মতি দিতে গিয়েও গম্ভীর গলায় বললাম, “ইচ্ছে করতে না, তবে যেতে পারি। একটা শর্ত আছে।”

“কী শর্ত?”

এবারও গম্ভীর গলায় বললাম, “তুই করে বলতে হবে। আমি আর তুমি এখন থেকে একই বেঞ্চিতে, একই ক্লাসে, একই স্কুলে পড়াশোনা করব। তুমি ডাকটা মানাচ্ছে না।”

উৎফুল্লিত হয়ে বলে তুর, “তাহলে তুইও কিন্তু তুই বলবি।”

“হম।”
আমি ওর সাথে গেলাম। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এই বাড়িতে প্রথম এসেছি এমন নয়। মাঝে মাঝে বাপির সাথে আসতাম। তুর হাঁটতে হাঁটতে অন্যদিকে গেল। একজন রং মিস্ত্রী আমাকে দেখে বললেন, “নিচে ইট স্তরে স্তরে রাখা আছে। ওখান থেকে চারটা ইট এনে দিতে পারবে?”

“জি, অবশ্যই পারব।” বলে ইট আনতে নিচের দিকে অগ্ৰসর হলাম। উপর থেকে একটা ইট তুলতেই হাত সরে গেল। বাড়িতে একগ্লাস পানি খেতে হয়না, আর এখানে ইট বহন করতে হচ্ছে। আমি দুই হাতে দু’টো ইট নিয়ে ধীরে ধীরে উপরে গেলাম। অপূর্ব ভাই তদারকি করছেন। আমি ইট মাটিতে রেখে হাতের দিকে অবলোকন করলাম। লাল টকটকে হয়ে গেছে। পুনরায় তুলে সামনের দিকে এগোলাম। আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন অপূর্ব ভাই। হাসি দিয়ে বললেন, “এই চাচি আম্মাকে ইট আনতে কে বলেছেন? নিজেই চলতে পারে না আবার ইট। একটা ইট পায়ে পড়লে আর বাঁচা হবেনা। রাখো এখানে..

কেঁপে উঠলাম মুহূর্তে। তার কথাটা সত্যি হল এবার। ভারসাম্য হারিয়ে হাত খসে পড়ল ইট দু’খানা। তবে আমার নয়, অপূর্ব ভাইরে পায়ে। তার আর্তনাদ করার কথা থাকলেও সেই কাজটা আপাতত আমি করলাম। অতিশয় ভয়ে চ্যাঁচিয়ে বললাম,

“মা, মা-গো। আমার পা গেলো। ইট পড়েছে। পা ছিলে গেল গো।”

তিনি বিস্মিত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে নির্বোধ কণ্ঠে বলেন, “সমস্যা কী? চ্যাঁচাচ্ছো কেন?”

আমি ভীত কণ্ঠে আওড়ালাম, “সত্যিই তো! চ্যাঁচাচ্ছি কেন? মনে পড়ছে না। হ্যাঁ মনে পড়েছে, ইট পড়েছে পায়ে তাই।”

অপূর্ব ভাই এবার ক্ষেপে গেলেন। তার সেই ভয়ংকর চাওনি। টেনে টেনে বললেন, “ইট আমার পায়ে পড়েছে, চ্যাঁচালে আমি চ্যাঁচাবো। তুমি কেন চ্যাঁচাচ্ছো? হুয়াই?”

মাথা চুলকে পায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। সত্যি তো! ইট আমার পায়ে পড়েনি, তাহলে আমি কেন চ্যাঁচালাম। অস্ফুট কন্ঠে বললাম, “ভয়ে।”
অপূর্ব ভাই কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
মনে-মনে নিশ্চয় আমাকে বকছেন। ততক্ষণে তুর অন্য ঘর থেকে সেখানে উপস্থিত হল। একবার আমার আরেকবার অপূর্ব ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে বলে, “কী হলো বলতো?
চিৎকার শুনলাম আরুর। এসে দেখছি তুই। ব্যাপার কী?”

অপূর্ব ভাই ইট সরাতে সরাতে বলে, “চিৎকারটা ইন্টারন্যাশনাল গাধা দিয়েছে।”

“ইন্টারন্যাশনাল গাধা, সেটা আবার কী? এখানে গাধা এলো কোথা থেকে?”

“তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, তাকে জিজ্ঞেস কর। ফুফুজান ওকে কীভাবে সামলায় সত্যি বুঝি না। ও শুধু গাধা নয়,
ইন্টারন্যাশনাল গাধা। গরু হলে তা-ও কুরবানীর হাটে বিক্রি করে ঝামেলা মুক্ত হওয়া যেত। কিন্তু ওকে নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। বিরক্তিকর।”

আমি কেঁদে উঠলাম। সামান্য একটা চিৎকার করেছি বলে গাধা। যেই সেই গাধা নয়, ইন্টারন্যাশনাল গাধা। মামুনি..

চলবে।