জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-০৪

0
626

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
||পর্ব: ০৪||

এলার্জির ফলে রক্তিম মুখশ্রীতে যন্ত্রনায় সূচনা হয়েছে। দহনে প্রজ্বলিত হচ্ছে দেহ। অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। আমি ছুটে ঘরে গেলাম। মস্তিষ্ক অচল। ঘরের জিনিসপত্র ছুড়তে ইচ্ছে করছে। আমি ফুলদানি ছুঁড়লাম। কাঁধের ব্যাগটা ফেলে দিলাম। পিন বিহীন হিজাবটা খুলে ফেললাম। দহনের মাত্রার স্বাভাবিক নেই। কাবার্ডে রাখা মেডিসিনের বক্সে দেখা পেলাম না এলার্জির ওষুধের। ওষুধগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেললাম মেঝে জুড়ে। সবগুলো খুঁজতে লাগলাম। আমি মাথা চেপে বিছানায় বসলাম। জ্বলছে শরীর। মায়ের কাছে স্লিপিং পিল থাকতে পারে। মায়ের এলার্জি আছে, তিনি স্লিপিং পিল খেয়ে একটু ঘুম দিলেই এলার্জি সমস্যার সমাধান হয়। আমি মায়ের ঘরের দিকে দ্রুতবেগে অগ্ৰসর হলাম। মা দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়েছেন, বাবা আর মামা বাড়িতে নেই। মামাদের বাড়ির কাজের জন্য ইদানীং বাইরে থাকেন বেশিভাগ সময়।

মা তন্দ্রা আচ্ছন্ন। আমি শব্দ বিহীন ঘরে প্রবেশ করলাম। এই সময়ে তার তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে চাইনা, তিনি চিন্তা করবেন। শতবার খুঁজেও ওষুধের বক্সটা পেলাম না, এবার নিজের প্রতি ধৈর্য রাখতে ব্যর্থ হলাম। ধীরে ধীরে কোমল গলায় ডাকলাম, “মা, তোমার ওষুধগুলো কোথায়?”

মা এতটা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন যে, আমার শান্ত গলা তার কর্ণকুহরে পৌঁছালো না। আমি একটু এগোলাম। স্পর্শ করলাম মায়ের হাত। তিনি একটু নড়েচড়ে উঠলেন। নিভু নিভু দৃষ্টিতে আমার পানে অবলোকন করে পুনরায় তন্দ্রা বিলাসে ব্যস্ত হলেন। আমার বাঁধ ভাঙল। কিছুটা তেজ‌ গলায় বললাম, “মা, তোমার ওষুধের বক্সটা কোথায়?

মা সময় নিয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, “ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখা আছে। কী করবি।”

আমি দ্রুত ড্রেসিং টেবিলের কাছে ছুটে গেলাম। ড্রয়ার খুলে স্লিপিং পিলের পাতা নিলাম। তিনটা পিল বের করলাম। বিছানার পাশে থাকা ছোটো সেন্টার টেবিলের উপর থেকে জগ নিলাম। অর্ধ গ্লাস পানি ভর্তি করে নিলাম। পিল তিনটা খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিছুতেই কমছে না। গ্লাসটা তখন হাতে। আমি পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেললাম। অতঃপর ঘরে চলে এলাম। গ্লাস ভাঙার শব্দে মায়ের তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটেছে নিশ্চয়।

ঘরে এসে সোজা ওয়াশরুমের দিকে গেলাম। শাওয়াল ছেড়ে বসলাম নিচে। হিম জল তখন হিম করতে ব্যস্ত আমায়। জামা থেকে চুইসে চুইসে পানি ঝরছে। মাথা ধরে রয়েছে। নেত্রযুগল থেকে তখন অবিরাম ধারায় অশ্রু ঝরছে। ক্ষান্ত আমি এখন ক্ষিপ্ত।
পায়ের শব্দ পেলাম। একসময় স্থির হয়ে গেল। মাথা ব্যথা নিয়ে পাশে দেখলাম। অপূর্ব ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।‌ আমি দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছি। চোখ পড়তেই নামিয়ে নিলেন দৃষ্টি। অপূর্ব ভাই স্যরি বলে চলে গেলেন। পরক্ষণে মা এলেন। উদাস তার চাওনি। আমাকে দ্রুত জড়িয়ে নিলেন তার হৃৎপিণ্ডের সাথে। দ্রুতি কণ্ঠে বললেন, “আরু মা, কী হয়েছে তোর। এমন লাগছে কেন?”

“আমার গলা, বুক জ্বলে যাচ্ছে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে। প্রচুর ঝাল লাগছে। মাথা ভারি হয়ে গেছে। তোমার ঘর থেকে স্লিপিং পিল খেয়েছি, তাও কমছে না। কী করব। অপূর্ব ভাই জোর করে আমাকে ঝাল খাইছে।”

ততক্ষণে শরীরে দহন কিছুটা ক্ষান্ত হয়েছে। ঠান্ডায় কাশি এলো। মা তুর-কে জামা কাপড় আনতে নির্দেশ দিলেন। জামা কাপড় পাল্টে ঘরে এসে বসলাম। স্লিপিং পিলের কাজ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। বিছানায় শুয়ে পড়লাম সোজা হয়ে। কম্বল জড়িয়ে নিলাম। তন্দ্রা বিলাসের চেষ্টা করলাম। মা পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হলাম ঘোরতর।

যখন তন্দ্রা ভঙ্গ হল নিজেকে অচেনা, অজানা জায়গায় আবিষ্কার করলাম। তখনও তন্দ্রায় নেত্রপল্লব গ্ৰথণ হয়ে আসছে। মাথার কাছে মাকে পেলাম। কিন্তু নিজের ঘরে নয়। হসপিটালের বিছানায়। সকালের প্রথম কিরণ গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েছে। নরম কোমল রোদ। ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ রোদ। তবে আমার মস্তিষ্ক জানান দিল বিকেলের নরম তেজহীন রোদ। হাই তুলে উঠে বসার প্রয়াস করলাম। পাশে আধশোয়া অবস্থায় থাকা মা ধরফরিয়ে উঠে বসলেন। বিচলিত কণ্ঠে বললেন, “কী, কী হয়েছে আরু। উঠছিস কেন? শুয়ে থাক।”

আমি শুয়ে থাকতে পারলাম না। উঠে বসলাম। মামুনি নিচে বিছানা করে ঘুমিয়েছেন। বিস্মিত হলাম আমি। হাসপাতালে কখন নিয়ে এলো। আমি হতাশা প্রকাশ করলাম, “মা, কী হয়েছে? আমি হাসপাতালে কেন? একটু ঘুমালাম আর ওমনি নিয়ে এলে।”

মা হাসলেন।‌ স্যালাইন ফুরিয়ে গেছে। এবার পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। হটপটে খাবার এনেছেন। বক্সটা সামনে এনে খুলেন। খিচুড়ি রান্না করেছে। মায়ের হাতের ল্যাটকা খিচুড়ি আমার অনেক পছন্দের। চামচ দিয়ে খিচুড়ি মুখে দিলেন। এখনও গরম আছে। হেসে হেসে বললেন, “তুই ঘুমাস নি মা। আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে ঘুমিয়েছিস। দুপুরের পর ডেকেও তোকে ঘুম থেকে তুলতে পারিনি। বারোটা পর্যন্ত বাড়িতেই চেষ্টা করেছি। উপায়হীন হয়ে মাঝরাতে ভর্তি করতে হল।”
___
এই ভর দুপুরে কেবিনের ভেতরে মশা ঘুরছে। ভনভন করে গান গাইছে। আমি বিরক্ত হলাম। মানছি ছোটোখাটো নার্সিং হোম। তাই বলে, প্রোপার ব্যবস্থা থাকবে না। আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ঘুমের রেশ এখন বিদায় নিয়েছে। জানালার কাছে গিয়ে দিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ ভার হয়ে আছে। সেগুন গাছে পাখি বাসা করেছে। চিউচিউ ডাকছে। বৃষ্টির দরুন মশার উপদ্রব বেড়েছে। শীতের স্নিগ্ধতার আভাস পেয়ে আশ্রয়ের জন্য ঘরে এসে ঢুকেছে। তোদের থাকতে ইচ্ছে করছে থাক-না। কানের কাছে বিশ্রী গলায় গান শুনাচ্ছিস, রক্ত চুসছিস। কিন্তু কেন? আশ্চর্য!

আমি জানলা বন্ধ করে বিছানায় বসলাম। মেঝেতে কয়েলের ছাই জমে আছে। পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের পাশে কয়েলের স্ট্যান্ড পড়ে আছে। আমি ফ্যানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ফ্যানে হাওয়া কম। আমি বিদ্যুতিক সুইচ বোর্ডের দিকে অবলোকন করলাম। আচ্ছা শকেটের ভেতরে কয়েলের স্ট্যান্ড দিয়ে দেই, তাহলে কি কোনো কাজ করবে। একটা এক্সপেরিমেন্ট করা দরকার। আমি দ্বিতীয়বার সেই ধ্যানের পুনরাবৃত্তি না করেই উঠে দাঁড়ালাম। কয়েলের স্ট্যান্ড নিয়ে শকেটে দিয়ে দিলাম। যা হওয়ার তাই হলো। জুতা ছিলনা পায়ে, যাতে একটু বেশিই প্রতিক্রিয়া দেখালো। দুই সেকেন্ডের জন্য আমাকে স্তব্ধ করে দিল। পরক্ষণেই ধাক্কা দিল স্ব-জোরে। মাথা ঘুরে উঠল। হাত সরে গেল। কয়েলের স্ট্যান্ড তেমনই রয়ে গেল। আমি ছিটকে পড়লাম। মেঝেতে পড়ার পূর্বেই ধরে নিল কেউ। বলিষ্ঠ পুরুষালি হাতের সহায়তায় আঁকড়ে ধরল আমায়। আমি ঝাপসা দৃষ্টিতে অপূর্ব ভাইয়ের মুখ দর্শন করলাম। এতক্ষণ মশা আমার কানের কাছে বেসুরো গলায় গান ধরেছিল, এবার আমি ধরলাম। “আমি, এখানে আমি। আমি কি বেঁচে আছি?”

অপূর্ব ভাই আমার ছেড়ে দেওয়া শরীরের ভর সামলাতে হিমসিম খেয়ে গেল। অবিলম্বে কোলে তুলে নিল আমায়। পরক্ষণে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। হাতের তালুতে ঘষতে লাগলেন। দ্বি ক্ষণে হাত ছেড়ে পায়ের তালুতে ঘষতে আরম্ভ করলেন। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছি, দৃষ্টির নড়চড় নেই। নেই মুখে বুলি। অপূর্ব ভাই পানি ঢালেন গ্লাসে। মাথার নিচ থেকে ধরে পানি খাওয়ানোর প্রচেষ্টা করলেন। গলা থেকে পানি নামল না। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক সচল হল। অস্ফুট স্বরে বললাম, “অপূর্ব ভাই, আমি কি বেঁচে আছি?”

অপূর্ব ভাই একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। ভীত হলাম একটু আধটু। গ্লাসের পানিটুকু এবার এগিয়ে দিলেন। গলা শুকিয়ে এসেছে। আমি পানিটুকু পান করলাম। বিকট শব্দে গ্লাস রেখে বললেন, “ইয়ার্কি করিস আমার সাথে। বেঁচে না থাকলে পানি খাচ্ছে কে? তোর বোধবুদ্ধি হবেনা এই জীবনে। কয়েলের স্ট্যান্ড। শক তো খাবিই। তোকে সাইন্সের ছাত্রী বলা যায়না, তুই পা’গলা গারদের ছাত্রী। বিরক্তকর।”

আমার সেই মুহূর্তে তন্বির কথা মনে পড়ল। আমাকে বিদ্যুতে ধরেনি, আমাকে প্রেমের ভুতে ধরেছে। তন্বি সিরিয়াল দেখতে ভালোবাসে। ‘কোনো ছেলেকে দেখে বুকের ভেতরে ঘণ্টা বাজলে, শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে, মাথা ঘুরলে, শরীর অচল হয়ে পড়লে’ – এগুলো সব প্রেমের পূর্ব লক্ষণ। আমি নেশাক্ত দৃষ্টিতে অপূর্ব ভাই’কে পর্যবেক্ষণ করলাম। সুদর্শন, সুপুরুষ এবং বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। কল্পনায় থাকা রুপকথার রাজকুমারের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে তবু গলার নিচে নোনা ঘাম জমেছে। ঘামটুকু মুছে নেশাগ্ৰস্ত মানুষের মতো টেনে টেনে বললাম, “অপূর্ব ভাই আমাকে আরেকবার কোলে নিবেন। প্লীজ নেন না। আমি দেখতে চাই, আগের মতো শক করে কি-না, প্লীজ।”

না বুঝার স্বরে বললেন, “আমি কোলে নিলে তোকে শক করবে কেন, আমি কি বিদ্যুৎ? তুই বিদ্যুতিক শক খেয়েছিস।”

কিন্তু মানতে নারাজ আমি। শক খেলে এতক্ষণ বেঁচে থাকতাম না, সোজা উপরে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি বেঁচে আছি। অপূর্ব ভাই জীবনে প্রেমে পড়েনি, তাই বলছে শক খেয়েছি। আমি মৃদু হেসে বললাম, “অপূর্ব ভাই আমি আপনার প্রেমে পড়েছি। প্রেমিকের হাতের উষ্ণ স্পর্শেও প্রবল ঠান্ডা অনুভব হয়। শরীরে কম্পনের সৃষ্টি করে। সবকিছু ধোঁয়াশা লাগে। হৃৎপিণ্ড ঘণ্টার মতো বাজতে থাকে। ডং! ডং! ডং!
আপনি স্পর্শ করার পর থেকে এমন হচ্ছে, আমি সত্যি প্রেমে পড়ছি।”

অপূর্ব ভাই হতভম্ব হল। ডান হাতের সহায়তায় কপালে চপল দিলেন। চ্যাঁচিয়ে বললেন, “ডাক্তার, নার্স। কোথায় আপনারা। ওকে দেখুন। বোকা বোনটা শক খেয়ে মাথার তাল ছিঁড়ে গেছে।”

“আমাকে প্রেমের ভুতে ধরেছে, ডাক্তার নার্স কিছু করতে পারবেনা।”

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]