জ্বালাতে রং মশাল পর্ব-১১

0
503

#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ১১

জ্ঞান ফিরতেই নিজ বিছানায় উপলব্ধি করলাম। শিউরে বসে মামুনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। ডাক্তার নেই। হাতের স্যালাইন চলছে। অপূর্ব ভাই বুকে হাত গুঁজে সাহেবি ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমার উপর বেশ ক্ষিপ্ত সে। সবাই বসে আছেন ঘরে। গুরুতর বিষয় আলোচনা হচ্ছে। মামা বললেন, “ডাক্তার আরুর অবস্থা দেখে চিন্তিত। গুরুতর রোগ দানা বেঁধে নেই তো। আল্ট্রাস্নোগ্ৰাফি করাতে বলেছেন।”

অবিলম্বে মা বলেন, “ওনি ডাক্তার মানুষ। সামান্য ব্যাপার ধরতে পারবেন না, এমনটা হতে পারেনা। তিনি বুঝেছেন। তাই আল্ট্রা করে সিউর হতে বলেছেন। এজন্য পারিবারিক ডাক্তার এনেছি, না-হলে ডাক্তার আনতাম না। আল্ট্রা করাতে যাই, এতটুকু মেয়ের প্রেগন্যান্সি নিয়ে ঝামেলা হোক, লোক জানাজানি হোক। তারপরে আমাদের ছিঃ! ছিঃ! করুক। এজন্য ওকে হাসপাতালে নেইনি।”

বিষাদময় শ্বাস নিলাম। মা-ও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কেন যেন আল্ট্রাস্নোগ্ৰাফি করে সিউর হতে চাইছে মন। বারবার কিটটাকে অবিশ্বাস করতে বলছে। কিন্তু পারছিনা।
আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে মামুনি বললেন, “এইতো আমাদের আরুর জ্ঞান ফিরেছে।”

তৎক্ষণাৎ সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল আমার পানে। আমি অশ্রুসিক্ত চোখে দৃষ্টি আড়াল করার প্রয়াস চালালাম। মামুনি আবার বললেন, “প্রেগন্যান্ট অবস্থায় কেউ মাথায় এভাবে আঘা’ত করে? সিরিয়াস কিছু হয়ে গেলে কী হতো।”

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, “ভালোই হতো। আমার জন্য তোমাদের নিন্দা শুনতে হতো না।”

মামুনি গম্ভীর গলায় বললেন, “বাবা-মায়ের সামনে এমন কথা কেউ বলে?”

“তারা হয়ত এটা শোনার অপেক্ষায় আছেন।”
নিঃশব্দে গাল গড়িয়ে ঝরে পড়ল অশ্রু। বাবা সর্বদা মায়ের থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। আজ তিনিও নিশ্চুপ। পরিস্থিতি আমার জন্য বড্ড অসহায়।
গভীর দৃষ্টিতে স্যালাইনের ক্যানেলের দিকে তাকিয়ে আছি। ফোঁটা ফোঁটা করে ঝরছে। আচ্ছা এখানে যদি বি’ষ থাকতো। বাবা মা খুশি হতো, তাইনা?

সন্ধ্যার পর মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে লাল বেনারসীতে মুড়ে দিল আমায়। মেকআপ ছাড়া হালকা সাজ। চোখে কাজল ঠোঁটে লিপস্টিক। কাজল প্রায় লেপ্টে গেছে। কাজি নিয়ে সবাই ঘরে এলেন। ছোটো করে মাথায় ঘোমটা দেওয়া। অপূর্ব ভাই কবুল বলেছেন। তিনবারের জড়তার ইতি টেনে ‘কবুল’ উচ্চারণ করলেন। ঘরোয়া ভাবে বিয়ের পাট চুকে গেল। বয়স কম থাকাতে হলনা রেজিস্ট্রি। মিষ্টি মুখ করল সকলে। কাজি সাহেব বিদায় নিলেন। অপূর্ব ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, “আরু প্রয়োজনীয় কিছু থাকলে গুছিয়ে নে দ্রুত। আমরা বের হবো।”

মামুনি হেসে বললেন, “আমি সবকিছু কিনে দেবো। থাকুক আরেকটু। এখানেই তো বাড়ি।”

অপূর্ব ভাই এক গাল হাসলেন। মাধুর্য নেই হাসিতে। আমার হাত ধরে বললেন, “তোমার আমার বউ-কে কিনে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আমি তোমাদের সাথে থাকব না। আমরা এখুনি এখান থেকে চলে যাবো।”

সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল। আমি ফট করে অপূর্ব ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। অপূর্ব তার মুখটা। লাল পাঞ্জাবিতে অপূর্ব লাগছে। রাগে মুখটা লাল হয়ে আছে। আজ থেকে তিনি আমার স্বামী। আমার চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। অপূর্ব ভাই-কে বলেছিলাম, আমি তার বাচ্চার মা হবো, রান্না করে খাওয়াবো, সংসার করব। এখন থেকে আমি তা করবে পারব। কিন্তু আমি এখন আর সেইসব চাইনা। এই সমাজ থেকে বেরিয়ে বাঁচতে চাই। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাই।
মা বললেন, “ও কেন তোর সাথে যাবে? তুই চাকরি করিস না, ওকে খাওয়াবি কী?”

“ফুফু তুমি তোমার স্বামীর সাথে থাকছ, তার কথা মানছ। তোমার মেয়েও তো তাই করবে। আমি চাকরি করি কিংবা না করি, তাতে তোমার কোনো সমস্যা হবে বলে আমি মনে করিনা।
স্বামী খাওয়াতে পারলে খাবে, না-হলে না খেয়ে থাকবে। এটাই বাঙালি মেয়েদের রীতি।”

আমি আনমনে হাসলাম। নিজের মানুষের আশেপাশে থেকে লাঞ্ছনার থেকে দূরে গিয়ে না খেয়ে থাকা শ্রেয়। আমি ধীরে ধীরে বললাম, “আমি আপনার সাথে যাবো।”

অপূর্ব ভাই বললেন, “বিবি রাজি। তাহলে আর থাকছি না।”

মামা বাঁধা দিয়ে বললেন, “তোর মাথা খা’রা-প হয়েছে অপু। কীসব বলছিস? ও ছোটো। বাবা-মায়ের অভিমানে তোর সাথে যেতে চাইছে। বোঝার চেষ্টা কর ছোটো, তার উপর একটা বেবী। যত্ন নিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাবে। ঘর সামলাবে না-কি নিজেকে।”

অপূর্ব ভাই ত্যাড়া গলায় বললেন, “ওতো কিছু আমি জানি না। বিয়ে হলে মানুষ ছোটো থাকে। এতই যখন ছোটো বিয়ের আগে ভাবা উচিত ছিল না?”

মামা মামুনি অপূর্ব ভাই-কে বোঝাতে লাগলেন। অপূর্ব ভাই শুনতে নারাজ। এক পর্যায়ে এসে মানলেন তিনি। তবে গুরুত্বর শর্ত আরোপ করলেন। “আমার দু’টো শর্ত আছে। মানলে আমি আমাদের বাড়িতে থাকতে রাজি।
প্রথমত, আরুর সাথে কোনো যোগাযোগ রাখতে পারবেনা। আরু খেলো কি খেলো না, কোনটায় নয়। চেষ্টা করলে আমার চেয়ে ভয়ংকর কেউ হবেনা এবং কোনো খাবার দেওয়া যাবেনা। আমি বাজার করব, আরু রাঁধবে, তারপরে খাবে। রান্নাঘরেও কথা হবেনা। মাস শেষে ঘর ভাড়া দিবো।
আমার দ্বিতীয় শর্ত, বেবী হওয়ার পর ডিএনএ টেস্ট করব। বেবী আমার নয়, ১০০% গ্যারান্টি। আরুর মতো বোকা ক্যাবলা মেয়ের সাথে সংসার আমি করবনা। তখন আইনি ব্যবস্থা নিবো।”

পরিস্থিতি সামাল দিতে সবাই অপূর্ব ভাইয়ের শর্ত রাজি হলেন। দূরে থাকলে মেয়ে-কে চোখের দেখাও দেখতে পারতেন না। এখন অন্তত দেখতে পারবে। তাছাড়া অপূর্ব ভাইয়ের শর্তে রাজি হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আইনি ব্যবস্থা নিলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না।
অপূর্ব ভাই নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। আর পাঁচদিনের মত আজকের ঘরটা‌। ফুলের সাজ নেই বললেই চলে। এখন থেকে এই ঘরটাই আমার স্থান। অপূর্ব ভাই ধপাধপ পায়ে হেঁটে বারান্দায় গেলেন। আমি বিছানায় গিয়ে বসলাম। হাতে খাবারের প্লেট। পাশের সেন্টার টেবিলে রাখলাম। আজ শেষবারের মতো এই বাড়ির খাবার খাওয়ার অনুমতি দিলেন। অপূর্ব ভাই ঘরে এলেন। কাবার্ড থেকে নিজের জামা কাপড় বের করলেন। অতঃপর ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। ধপাস করে দরজা দিলেন। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম।
নীল সাদা রঙের সংমিশ্রণে তৈরি দেয়াল। জানালায় বড়ো বড়ো পর্দা টানা। নতুন হওয়াতে কোনো ছবি টানানো নেই। আগে বেশ কয়েকবার এসেছি। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় নি। আজ থেকে বোন হিসেবে নয়, তার অর্ধাঙ্গিনীর হিসেবে থাকা শুরু।
প্লেট হাতে নিয়ে খাওয়াতে মন দিলাম। বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। মায়ের হাতের স্বাদ। খাওয়া শেষ হওয়ার আগে বেরিয়ে এলেন তিনি। চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। শেরোয়ানি বদলে ফেলেছে। শার্ট ও জিন্স পড়েছে। এতরাতে বাইরে যাবেন তিনি? পোশাক দেখে সন্দিহান আমি। আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি বের হচ্ছেন?”

“হ্যাঁ।” সংক্ষিপ্ত উত্তর।

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“এখন তোকে বলে, বাইরে যেতে হবে? একদম বউগিরি দেখাবি না। খাবার খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকবি। আমার অপেক্ষা করবি না। আমার আসতে দেরি হবে, আবার নাও আসতে পারি।”

“খাবেন না?”

“তোর বাপের বাড়ির খাবার তুই খা। তোর আত্মসম্মান নেই? আমার আছে। ফুফু মা’র-ল। কথা বলা বন্ধ করে দিল। অবিশ্বাস করল। তবুও গিলছিস।”
আগে কত সুন্দর করে মাধুর্য ছড়িয়ে কথা বলতেন। কয়দিন ধরে চ্যাঁচিয়ে, গলা তুলে, কখনো বা রাগি গলায় কথা বলেন। মাথা নিচু করে বললাম, “প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে, এসময় নিয়মমাফিক খেতে হয়।”

অপূর্ব ভাই তাকিয়ে রইল। শার্টের বোতাম খোলা। বোতাম লাগাতে লাগাতে চেয়ে থাকলেন। তিনি কাজ করেন না, আমাকে খাওয়াবে কী? আমি বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি না। প্রথমে পেটে ব্যথা, পরে মাথা ঘুরে। সত্যি কি এখন থেকে না খেয়ে থাকতে হবে? অপূর্ব ভাই বারান্দায় টাওয়াল মেলে দিলেন। হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিলেন। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল পায়ের শব্দ। হতবাক হলাম না। এমনটা যেন হওয়ারই ছিল।
বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। এতক্ষণের জমিয়ে রাখা অশ্রুগুলো‌ এবার শব্দ করে ঝরছে। বুক ফেটে যাচ্ছে। বালিশের মুখ গুঁজলাম। আমি বাঁচার আশা খুঁজে পাইনা
‘না করা অন্যায়ের’ শাস্তি হিসেবে আজ থেকে এই ঘরে বদ্ধ থাকতে হবে। অন্যের শরীরে সাথে, মনের সাথে, ইচ্ছের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। আলো জ্বলছে। মাথার উপর সিলিং ফ্যান চলছে। অন্য রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]