#জ্বালাতে_রং_মশাল 🖤
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২১
মাঝরাতে বাড়ি ফিরলেন অপূর্ব ভাই। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন। সেদিনের ঘটনা মনটা মিইরে দিয়েছে আমার। ড্রয়ারে মলম খুঁজতে ব্যস্ত ছিলাম। রান্নার দিকটা সেরে ফেলেছি ইতোমধ্যে। আহত দৃষ্টিতে অপূর্ব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। খাবার নিয়ে আসবেন আগে বলতেন, শিলপাটায় বেটে ভর্তা করেছি। মরিচ ছাড়া ভর্তা করা অসম্ভব ব্যাপার। মরিচ বাটতে গিয়ে হাত জ্বলছে। কত রকমের ভর্তা। আমায় দেখামাত্র ভ্রু কুঁচালেন তিনি। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে ফেললাম। হাতে তার খাবারের প্যাকেট। আমি যে রান্না করে ফেলেছি। তিনি ঘরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম আমার কপালে হাত রাখলেন। কিছুটা ইতস্তত বোধ জাগল। কম্পন অনুভব করলাম। মাথা ঘুরছিল, এবার শরীর ঘুরছে। জ্বর কিছুটা আয়ত্বে এসেছে। সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেরিতে যাওয়ার ফলে ফিরতেও দেরি হয়েছে। বুঝতে পারলে, যাওয়ার সময় তোর খাবার রেখে যেতাম। এবার খেয়ে ঘুমিয়ে পর।”
বলেই তার দূর্বল পা এগিয়ে দিলেন ওয়াশরুমের দিকে। হতাশাগ্ৰস্থ গলায় বললাম, “অপূর্ব ভাই আমি রাতের খাবার রান্না করেছি।”
“কী রান্না করেছিস?” পা জোড়া থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে।
জানি আমার ভর্তার আছে তার খাবারের তুলনা হয়না, তবুও বললাম, “ভর্তা করেছি কয়েক রকমের।”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললেন, “তোর না-কি জ্বর, বমি। তাহলে রান্না করলি কীভাবে? না-কি ঢঙের জ্বর।”
আমি হা হুতাশ করতে করতে বললাম, “আপনি আগেই বলেছেন, আমাকে বউয়ের মতো ব্যবহার করতে হবে। রান্না করতে হবে।”
“আমাকে এতটা নিচ মনে হয় তোর? তোর জ্বর থাকার পরেও কাজ করতে বলবো?”
আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। প্রত্যুত্তর নেই। তিনি কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। আমি জগ ভর্তি পানির ভেতরে হাত ডুবিয়ে দিলাম। হাতটা অসাড় হয়ে গেছে। পুনরায় মলম খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
অপূর্ব ভাই শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে এলেন। চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন নিকটে। আমার সামনে বসে বললেন, “নে, স্বামীর সেবা কর। দ্রুত চুলগুলো মুছিয়ে দে।”
আমি হাত তার মাথায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। ধীরে ধীরে চুল মুছিয়ে দিতে লাগলাম। ভেজা চুলে স্পর্শ লাগতেই আরাম লাগছে বেশ। ইচ্ছে করেই হাত লাগলাম। কিছুক্ষণ পার হয়ে গেল। অপূর্ব ভাই সরে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “তোর হাত এত গরম কেন আরু? আমার ঠান্ডা মাথা গরম হয়ে গেছে। জ্বলছেও! তুই কী মরিচ হাতে মিশিয়ে মাথায় লাগিয়ে দিচ্ছিস?”
“না, কেন অপূর্ব ভাই?”
এপিঠ ওপিঠ করে বললাম, “ভর্তা বাটার পর হাত জ্বলছে, তাই এমন লাগছে।”
তিনি সামনে এসে হাত পরখ করে নিলেন।
লাল হয়ে গেছে। কিছু বলেন না। বিছানায় বালিশের পাশ থেকে মলম এনে হাতে লাগিয়ে দিলেন। তার তৃষ্ণার্ত চাওনি। আমি তার মুখশ্রীর ভঙ্গিমা পান করতে ব্যস্ত। অপূর্ব ভাইয়ের কোলে বসে পড়লাম। মাথা তার বুকে রেখে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। এত শান্তি লাগছে কেন? তিনি তার হাতটা আলতো করে পিঠে রাখলেন। অপূর্ব ভাইয়ের দিকে অবলোকন করতে গিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল তার গলার ছোট্ট তিলটাতে। অবিলম্বে ফট করে চুমু খেয়ে বসলাম। তিনি অবাকের চূড়ায় পৌঁছেছেন। সন্দিহান গলায় বললেন, “সেদিন আমি না-হয় নে’শা করে তোর সাথে ওমন উগ্র ব্যবহার করেছি। কিন্তু তুই? তোকে নে’শা দেয় কে?”
মাথা চুলকে বললাম, “আপনাকে যে দেয়, সে।”
একগাল হাসলেন। হাতের পিঠ, গলায়, কপালে আর ওষ্ঠদ্বয়ের উপর আলতো চুমু খেলেন। নাকের উপর আলতো কামড় দিয়ে বললেন, “আমার কেউ কিছু দিলে তার পাঁচগুণ ফিরিয়ে দেওয়া মানুষ আমি। তোর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন?”
আমি লজ্জার্ত মুখটা নিঃশব্দে তার বুকের গুঁজে দিলাম। তুলব না, একটু থাকি-না।
পরদিন শরীর একটু ভালো অনুভব করলাম। বিদ্যালয়ে যেতে চাইলে, দিল না যেতে অপূর্ব ভাই। গতরাতে ফলমূল নিয়ে এসেছে। সেগুলো খাইয়েছে। রোজকারের মতো আজও কাজে গেছেন। তবে একটু তাড়াতাড়ি গেলেন যাতে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারেন। রিপোর্ট নিয়ে বাড়িতে আসবেন।
সন্ধ্যা তখন ছয়টা। আমি ঘরে বসে আছি। আজ শাড়ি পড়তে মন চাইছে। একটু সাজতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পেটে ব্যথার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। তবুও স্পৃহা-কে অপূর্ণ রাখতে ব্যর্থ হলাম। বিয়ের সেই শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। অপূর্ব ভাই ব’কাঝকা করবেন একটু। অসুস্থতার কারণে বেশি করবেন না। ছলছল চোখে তাকালেই সব ভুলে ঠিক বুকে জড়িয়ে নিবেন। তাছাড়া একা-একা কি-বা করব। চুলোর কাছে যাওয়া নিষেধ আছে। ফিরার সময় খাবার নিয়ে আসবেন। আমি শাড়ি পড়তে ব্যস্ত হলাম। অপ্রত্যাশিত কিছু দেখে মিনিটের জন্য থমকে গেলাম। শাড়ি পড়া সেখানে স্থির রাখলাম। এখন আর ইচ্ছে নেই।
কটন কাপড় ব্যবহার করলাম। বিছানায় শুয়ে পেটের উপর বালিশ দিয়ে শুয়ে থাকলাম। প্রচণ্ড পেটে ব্যথা করছে। এত ব্যথা কখনো হয়নি। দুই তিন মাস না হওয়াতে এমন হচ্ছে। সারাদিনে ব্যথায় শরীর অসাড়। ঠিক এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট তখন অপূর্ব ভাই বাড়িতে ফিরলেন। রোজকারের মতো আজও ক্লান্ত তিনি। খাবার নিয়ে এসেছেন। মাথা তুলে একবার তার ক্লান্ত মুখশ্রী দৃষ্টিতে নিবদ্ধ করে শুয়ে পড়লাম। তিনি পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দেখলেন। উঠে গেলেন। আমি হাত ধরলাম তার। তিনি চমকে তাকালেন। তড়িগড়ি করে বললেন, “কী?”
তিনি হয়তো ভাবলেন রিপোর্টের কথা জানতে ইচ্ছুক, তাই নিজ থেকেই উত্তর দিলেন, “নেই। লেট করে ফেলেছি। চিন্তা করিস না, কাল সকাল-সকাল নিয়ে আসব। শুধু রাতটারই ব্যাপার। মেনেজ করে নে।”
আমি তো রিপোর্টের কথা জানতে চাইনি। অন্য প্রসঙ্গে বললাম, “রিপোর্ট না অন্য কিছু।”
“কী?” সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করলেন। একবার বলতে চেয়েও পারলাম না। নিজের অস্বস্তি আর জড়তার ইতি টেনে বললাম, “একটু ফার্মেসিতে যাবেন?”
ফার্মেসির কথা শুনে শার্ট খুললেন না। মানি ব্যাগ হাতরে ঘড়ি দেখলেন। এই সময়ে ফার্মেসি খোলা থাকবে কি-না? কিছু খুঁজতে খুঁজতে বললেন,
“শরীর খা’রাপ লাগছে? মেডিসিন লাগবে?”
চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বললাম, “আমার প্যাড লাগবে। প্লীজ এনে দিন।”
হতবুদ্ধ হলেন তৎক্ষণাৎ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, “মানে কী কীভাবে সম্ভব?”
“জানি না, পরে ভাববেন। যান-না একটু, প্লীজ!”
শোয়া থেকে এক টানে উঠিয়ে বসিয়ে দিলেন তিনি। তার চোখজোড়া সন্দিহান। তাকানোর দুঃসাহস নেই। পুনরায় বললেন, “তুই জানিস না, এই সময়ে পিরিয়ড হয়না।”
আমি অহমকের ন্যায় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমারও বোধগম্য হল বিষয়টা। তারমানে আমি প্রেগন্যান্ট না। অপূর্ব ভাই দ্রুত ফোন করলেন কাউকে। ঘরের এক কোণে থেকে অন্য কোণে পদচারণ করলেন। ক্ষণে ক্ষণে তার ভ্রু যুগল কুঁচকে আসছে। কালকে থেকে বেশ কয়েকবার রক্ত বমি হয়েছে। এটা কীসের লক্ষণ। তাকে জানানো দরকার। আমি সোজাসুজি দাঁড়িয়ে বললাম, “একটা কথা বলার ছিল।”
“দু সেকেন্ড সময়। এক সেকেন্ড বেশি নয়। তাড়াতাড়ি বলে যা এখান থেকে।”
বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ড তিনিই নষ্ট করলেন। বলতে পারতেন ‘হম, বল’!
“কাল রাত থেকে বেশ কয়েকবার রক্ত বমি হয়েছিল।”
তার কপাল জুড়ে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল।
অপূর্ব ভাই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “এতক্ষণে এইটা বলার প্রয়োজন বোধ করলি? আশ্চর্য!”
আমাকে রেখে একাই বেরিয়ে গেলেন। চিন্তিত আমি গুটিয়ে বসে থাকলাম বিছানায়।
বসে থাকতে থাকতে কখন দেয়ালে হেলান দিলাম জানা নেই। অজান্তেই পাড়ি জমালাম ঘুমের দেশে। যখন ঘুমের ঘোর থেকে বেরিয়ে এলাম তখন সকালের আলো প্রখর হয়েছে। রোদের খেলা চলছে। বিছানায় ধপাস করে কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে গেলাম। অপূর্ব ভাই শুয়ে আছেন। অর্ধেক শরীর বিছানায়, অর্ধেক নিচে। রিপোর্ট বিছানায় রাখা। চোখ বন্ধ করে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন। বুঝলাম তিনি জেগে আছেন এবং মাত্র ফিরেছেন। রাতে আমরা কেউ কিছু খাইনি। ধীরে ধীরে ডাক দিলাম তাকে। “শুনছেন?”
অপূর্ব ভাই চোখ মেলে তাকালেন। রক্তিম তার চোখ জোড়া। উঠে বসলেন। ওড়না দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে দিলাম দূর থেকেই। ফেকাশে তার মুখশ্রী। ক্লান্তির ছাপ। ধীর গলায় বললেন, “কাছে আয়।”
একটু এগিয়ে গেলাম। আমার ডান হাতের আঙুলগুলোর ডগা ধরলেন মুঠো করে। আবদার করে বললেন, “তোকে একটু জড়িয়ে ধরব আরুপাখি।”
‘আরুপাখি’ নামটা কানের কাছে পরপর কয়েকবার বাজল। প্রথমবার এমন সম্বোধন তার। ওষ্ঠদ্বয় নাড়ানোর পূর্বেই নিজের সাথে দৃঢ় করে আবদ্ধ করে নিলেন আমায়। আমার অনুমতি আমার কাছেই রইল। হতাশা প্রকাশ করলেন, “তোর কিছু হবে না আরুপাখি। অপূর্ব আহসান তোকে এভাবে সবসময় আবদ্ধ করে রাখবে। ডোন্ট ওয়ারি।”
[চলবে.]