প্রেমরোগ পর্ব-১৮

0
735

#প্রেমরোগ-১৮
#তাসনিম_তামান্না

চৌধুরী বাড়িতে শোকের ছায়া নেমেছে। প্রিয় জন হারানোর হাহাকার চারিদিকে গ্রাস করে আছে। কারোর চোখের পানি শুকাচ্ছে না। একদিনে অনাকাঙ্ক্ষিত চারজনের একসাথে মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছে না। চোখের সামনে বিভৎস দৃশ্যকল্প ভেসে উঠছে বার বার। মেঘা পাগলামি করছে। কুয়াশা নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। কে কাকে শান্ত না দিবে? এক এক জন যে ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। কেউ নিজেকে সামলাতে পারছে না। বাড়িতে চেনাজানা আত্মীয়স্বজনের সমাগম। ছেলেমেয়েগুলোর অবস্থা দেখে তাদের চোখেও পানি। তারাও আহাজারি করছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা কি না ঘটলে পারতো না? কাল থেকে কারোর মুখে কিছু টি পড়ে নি। মানুষের বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু মৃত্যু বিচ্ছেদে মানুষ গুলোকে চাইলেও ছোঁয়া যায় না কথা বলা যায় না। আসরের নামাজের পর মাটি হয়ে গেছে চারজনের। কুয়াশা নিয়ে যাওয়ার সময় পাগলামি করলেও এখন শান্ত হয়ে বসে আছে। একদম থম মেরে যেনো সময়টা থেমে গেছে। পাখির এই শরীরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। পাখির মা-বাবা, ভাই এসেছে। পাখিকে সামলাচ্ছে। জোর করে কয়েকবার খাইয়ে দিয়েছে এই অবস্থা না খেয়ে থাকলে আরেকটা বিপদ এসে জুড়বে। কুশান, মেঘ, মেঘা, কুয়াশার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মুখ শুকিয়ে একটু খানি হয়ে গেছে। আজ ওদের নামের পাশেও অনার্থ শব্দ টা জুড়ে গেলো। তিন অক্ষরের শব্দ কিন্তু কত ভারি শুনলেই বুকটা হু হু করে উঠে। সন্ধ্যা দিকে আত্মীয় স্বজনরা সকলে চলে গেছে। বাড়িতে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কেউ নেই। কুয়াশা শান্ত হয়ে বসে চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে। তিশা এসে কুয়াশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
” কাঁদলে হবে? খেতে হবে তো না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বি তো চল উঠ খাবি ”
কুয়াশা চুপ করে রইলো। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব মা বকাঝকা করে খাওয়া তো। অভিমান করলে নিজেও না খেয়ে থাকতো কুয়াশা কেও খেতে বলতো না। এই তো সেদিনও তো মা বকলো আদর করলো। আর আজ নেই। জীবন কি এতোটাই অনিশ্চিত? আজ আছে তো কাল নেই। কুয়াশার মনে হলো সে মা’কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। মায়ের কথা শুনে নি। অনেক মিথ্যা বলেছে। সব চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। বুকের ভিতর হুহু করে উঠলো আর একটিবার কি ফিরে পাওয়া যাবে না? ভুল গুলো ভুল ই থেকে যাবে? শুধরে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই? আর মার কোলে মাথা রাখতে পারবে না? অভিমান করে থাকতে পারবে না? কেউ আর বকবে না? বাবা আর ভুল গুলো ধরিয়ে বুঝাবে না? অভিমান করে থাকলে বাবা আর খাইয়ে দিবে না? মেঘা, মেঘের নামে মামনির কাছে আর নালিশ দেওয়া হবে না। বাবাই এর কাছে আর আবদার করে খাওয়ার এনে দেওয়ার কথা বলা হবে না।কত কিছু হারিয়ে ফেললো এক নিমিশেষে। কুয়াশার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। বসে থাকতে পারলো না ফুপিয়ে কেঁদে দৌড়ে চলে গেলো নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে ফ্যামেলি ফটো বুকে জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। তিশা কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিয়ে গেছে। কুয়াশা খুলেনি। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্তিতে দুচোখের পাতা এক হয়ে গেলো। তলিয়ে গেলো নিদ্রাদেশে। কিন্তু ঘুম হলো না ভেঙে গেলো ভাইয়ের আদুরে কন্ঠে বলছে
” বাবুইপাখি কি হয়েছে? দরজা খোল। বাবুইপাখি দরজা খোল। ভাইয়া ডাকছে তোকে ”
কুয়াশার চোখ লাল হয়ে গেছে। সবাইকে উপেক্ষা করতে পারলেও ভাই আর বাবা কে কুয়াশা কখনো উপেক্ষা করতে পারে না। ঢুলুঢুলু পায়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে ভাইয়ের শুকনো মুখের দিকে তাকালো। কুশানের হাতে খাবারের প্লেট। কুয়াশা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল
” খাবো না আমি এসব কেনো নিয়ে এসেছো? ”
কুশান খাবারের প্লেট নিয়ে বেডে বসে কুয়াশাকে বসিয়ে বলল ” না খেলে শরীর খারাপ করবে যে ”
কুয়াশা বাচ্চাদের মতো জিদ করে বলল ” তাও খাবো না সবাইকে এনে দাও। ”
কুশানের খুব অসহায় লাগছে নিজেকে এতোদিন বাবা নামক বটবৃক্ষের ছায়ায় ছিল কোনো ঝড় তাদের স্পর্শ করতে পারে নি। কিন্তু আজ সে তো সবার বড় সবাই কে সামলাতে পারছে না। বাবার কথা ও রক্ষা করতে পারছে না। কুশান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল ” এমন করে না ময়নাপাখিটা। ভাইয়ার যে এনে দেওয়া সাধ্য নাই। পারলে এখনি এনে দিতো ”
কুয়াশা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল
” এমন কেনো হলো ভাইয়া এমন হওয়ার কি খুব দরকার ছিল। ‘আব্বু-আম্মু নেই’ এই শব্দটা এতো ভারি কেনো ভাইয়া? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া ”
কুশানের চোখেও পানি চলে আসলো নিজেকে সামলিয়ে বলল ” আমরা কাঁদলে তো আব্বু আম্মুর কষ্ট হবে কাঁদে না সোনা। আমরা এভাবে থাকলে আব্বু আম্মু ই তো কষ্ট হবে। খেয়ে নে। না খেলে শরীর খারাপ করবে ”
কুশান অনেক বুঝিয়ে কুয়াশাকে খাইয়ে দিলো কয়েক লোকমা কিন্তু সেটা কুয়াশার পেটে সহ্য হলো না ওয়াসরুমে গিয়ে বমি করে সব বের করে দিলো। কুশান বোনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তুষার কুয়াশার রুমে এসে কুয়াশার অবস্থা দেখে বুঝলো গ্যাসটিক হয়েছে এটা না খাওয়ার ফল।
কুয়াশা ক্লান্ত অবশ শরীর নিয়ে বিছানায় শুতেই তুষার বলল ” ভাইয়া তুমি যাও খেয়ে নাও ভাবিপু কে-ও খাইয়ে দাও মেঘা খেয়েছে মেঘ কেও খাইয়ে দিও আমি এখানে আছি কুয়াশার গ্যাসটিক হয়েছে আমি মেডিসিন দিচ্ছি ”
কুশান মাথা দুলিয়ে চলে গেলো ও ও আর পারছে না শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। কুয়াশার বন্ধ চোখের পাতা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তুষার কুয়াশার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
” মাথা ব্যথা করছে? ”
কুয়াশা উত্তর না দিয়ে ছলছল চোখে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল ” আব্বু আম্মুর কাছে নিয়ে যাবেন প্লিজ ”
তুষার চুপ থেকে বলল
” কাল নিয়ে যাবো। উঠে মেডিসিন গুলো খেয়ে নাও
কুয়াশা চুপচাপ খেয়ে নিলো। তুষার ইচ্ছে করে একটা ঘুমের ঔষধ ও দিয়ে ছিল। না হলে কুয়াশা না ঘুমিয়ে কান্নাকাটি করতো। কুয়াশা ঘুমালে তুষার নিচে আসলো। কুশান মেঘ কে বোঝাচ্ছে
” না খেয়ে তুই কি চাইছিস অসুস্থ হতে? চুপচাপ খেয়ে উঠবি আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না। তারা কখনোই আমাদের এভাবে দেখতে চাই নি আর এখনো চাই না ”
মেঘ কুশানের গলা দিয়ে খাবার নামছে না তবুও একটু জোর করে খেলো। না খেলে তো জীবন চলবে না আর এভাবে থাকলে একে একে সকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তখন কে কাকে দেখবে। সবাই রাতে ঘুমালেও কুশানের নির্ঘুম রাত কাটলো। মেঘ ঘুমালেনও একটু পর পর জেগে উঠছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ