বৃষ্টির রাতে পর্ব-১৭+১৮

0
244

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(১৭+১৮)

বাতাসে এলোমেলো উড়ছে সুপ্রভার চুল। তাসিন তার ডান পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। তাদের মুখোমুখি দাঁড়ানো মুরাদ আর তার পাশে টিয়া। টিয়ার হাতে চায়ের ট্রে। ট্রে তে তিন কাপ চা আর এক পিরিচ নারকেলের বিস্কিট। টিয়া প্লাস্টিকের একটি মোড়া পেতে তাতে ট্রে রাখলো। হাতে তার অনেক কাজ। জীবনেও বিরিয়ানি রাঁধেনি অথচ আজ বান্ধবী এসেছে বলে খুশিতে বলে ফেলেছে চিকেন বিরিয়ানি করবে তাও কিনা বাসমতী চাল দিয়ে। মুরাদের আজ অফিস ছুটি ছিলো বিধায় বেচারা সকালে একটু ঘুমাতে চাইলো৷ কিন্তু সুপ্রভার আগমন তার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলো৷ তবুও ঠিক ছিল সব মুরাদ বউয়ের আবদার শুনে মুরগি, চাল, মশলা সবই এনেছে ইউটিউবে রেসিপি দেখে। কিন্তু এখন টিয়ার মুখ পেঁচার মত হয়ে আছে৷ মুরগি এনেছে মুরাদ জবাই করেই কিন্তু কাটাকাটি তো টিয়া জানে না৷ ভাগ্যিস আজ মুরাদের মা বাড়ি নেই নইলে টিয়া মুরাদ দুজনেরই বকা খাওয়া দিন চলতো। এমনিতেই সারা মাস টিয়াকে বকে, ধমকে কথা শুনিয়েই চলছে মহিলা। তাঁর একটাই আফসোস একমাত্র ছেলের বিয়েতে যৌতুক নিতে পারেননি। এখন কথা তা নয়, কথা হলো মুরগি রান্নাঘরের সামনে রেখে টিয়া চা বানিয়ে উঠোনের কোণে আরাম করে বসছে সুপ্রভার পাশে৷ মুরাদ বিরক্তি মাখা চোখে একবার দেখলো স্ত্রীকে তারপর তাসিনের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল৷ কিন্তু কিছু বলার আগেই তার মেজাজ খারাপ হলো তাসিনের দৃষ্টি দেখে। এতদিন পর এলো কই বন্ধুর সাথে গল্প করে হাল হাকীকত জানতে চাইবে তা না করে বন্ধুর বউয়ের বান্ধবীকে হা করে চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে। প্রচণ্ডরকম মেজাজ খারাপ হচ্ছে মুরাদের৷ মা বাড়ি নেই সকাল থেকে বউ শুধু দু কাপ চা আর বিস্কিটই দিচ্ছে খাওয়ার জন্য । সে হলো খাদক মানুষ এভাবে কি করে চলতে পারে!

“তোর কি যেন বলার ছিলো? ”

“এ্যা!”
মুরাদের প্রশ্নটা ঠিকঠাক শুনতে পায়নি তাসিন। রাগ হচ্ছে মুরাদের সে চিবিয়ে চিবিয়ে আবার বলল, “তখন ফোন করে না বললি কি যেন বলার আছে? চল রাস্তার দিকে যাই যেতে যেতে বল শুনি।”

“এখানেই বলছি সমস্যা নেই।”

তাসিনের এবারের কথায় মুরাদের রাগ আরও বাড়লো। সে ভেবেছিলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখন সে হোটেলে যাবে। পেট ভরে আগে কিছু খাবে পরে বাকিসব হবে। কিন্তু তাসিনের কি হলো কে জানে এখানেই আঠার মত লেগে থাকতে চাইছে।

“বল।”

“আমার প্রমোশন হয়েছে সাথে ট্রান্সফার।”

“আরেহ অভিনন্দন আপনাকে । মিষ্টি ছাড়া এ খবর শোনায় কেউ।” চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সুপ্রভা বলল কথাটা। মুরাদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনি সুপ্রভার ফোন বেজে উঠলো। ভাবী ফোন করেছে দেখে সে ফোন কানে নিয়ে একটু দূরে সরে গেল রিসিভ করতে। মুরাদ প্রশ্ন করলো তাসিনকে, “কোন শহরে?”

“ঢাকায়।”

টিয়া চুপচাপ শুনছে আর চায়ে চুমুক দিচ্ছে তার আপাতত চিন্তা মুরগিটাকে কি করবে। মুরাদ আর তাসিন আরো কিছু কথা বলে পা বাড়ায় বাইরে যাবে বলে। সুপ্রভার ততক্ষণে ফোনকল শেষ হয়েছে। টিয়া হঠাৎ মুরাদকে ডেকে বলল সে এই মুরগি কিছুতেই কাটতে পারবে না। ঝামেলা বেঁধে গেল এখন মুরগি টিয়া না কাটলে কাটবেটা কে? আস্ত মুরগি না কেটে, ধুয়ে ফ্রিজেও তো রাখা যাবে না। অন্তত ওপরের চামড়া আর ভেতরের নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার না করে। মুরাদ জীবনেও কাটাবাছার কাজ করেনি৷ বন্ধুরা মিলে বহুবার এদিক সেদিক ঘুরতে গিয়ে রান্না করে খেয়েছিল কিন্তু সেসবে রান্নার কাজ সুমন আর তাসিনই বেশি করতো। রিমন আর সে তো সবসময় খাওয়ার পর্বে থাকতো। সুপ্রভা হঠাৎ বলল, ” টিয়া দে আমি কেটে দেই।”

“হ্যাঁ আর ভেতরের জিনিস ভেতরেই গেলে দে তাই না!” টিটকারি সুরে বলল টিয়া। সুপ্রভা রান্নাঘরের ধারেকাছে কখনও যায়নি। তার পরিবারটাই এমন যে, তাকে যেতে হয়নি। তবুও আজ একটু শখ করেই কাটতে চাইলো। মুরাদ অবশ্য খুব একটা পাত্তা দিলো না টিয়া, সুপ্রভার কথায় সে মনে মনে চেপে ধরছে তাসিনকে। তবুও একটু দেখতে হয় মেয়ে দু’টো আসলে করেটা কি! সুপ্রভা একটা পিড়িতে বসলো৷ বঠি সামনে রেখে কোনদিক না ভেবেই সে মুরগিটাকে মাঝখান থেকে কেটে দু ভাগ করে ফেলল লম্বালম্বি ।আর তার দিকে উৎসুক ভাবে তাকিয়ে থাকা তিন জোড়া চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুরাদ তো হায় হায় করে উঠলো সুপ্রভার কাজ দেখে। একটু সময় নিয়ে তাসিন হেসে বলল, “শুধু আচরণেই তু’ফান না কাজের বেলায়ও সাইক্লোন বেগ আছে দেখছি!”

“কি বললেন?” রেগে প্রশ্ন করলো সুপ্রভা। আর রাগের বশেই হাতের মুরগি বোলে না রেখে মাটিতেই রেখে দিয়েছে। টিয়াও ভালো বিপদে পড়লো এসব দেখে। এমনিতেই শ্বাশুড়ি তাকে সকাল বিকাল কথা শোনায় খুব করে আজ আবার মুরগির যা অবস্থা করলো!

“যা শুনলে তাই বলেছি।”

“কেন বলবেন আপনি পারেন এসব? আমি তো তবুও চেষ্টা করেছি।”

“সফল কিন্তু হওনি।”

তাসিনের কথায় সুপ্রভার রাগ পারদের মত ওপরের দিকে উঠতেই লাগলো। তা দেখে মুরাদের মনে হলো এ দুজন নিশ্চয়ই ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলবে এখনই। কক্সবাজার দেখেছিলো সে এ দুজনের সাপে নেউলে আচরণ। তাই মুরাদ তাদের থামাতে বলল, “তোমরা দুজনই খুব কাজের এবার থামো। আমি দেখছি কোন একটা ব্যবস্থা করা যায় কিনা! তাসিন চল মুরগিটা কাকীর কাছে নিয়ে যাই। কাকি বা নুড়ি খালা কেটে দিবে।” মুরাদ আর ধৈর্য্য রাখতে পারলো কিন্তু কোনপ্রকার রাগও প্রকাশ করলো না। তাসিন দাঁড়ানোই ছিল এতোটা সময় হঠাৎ সে চেঁচিয়ে বলল, “এই সরো তো।”

হঠাৎ ধমকের সুরে চমকে গেল সুপ্রভা। সে পিড়ি থেকে সত্যিই উঠে পড়লো। তার দুহাতে মুরগির রক্ত লেগে লাল হয়ে আছে। মুরাদদের বাড়িতে মটর নেই টিউবওয়েল এর পানি ব্যবহার করা হয়। টিয়া ডাকলো আয় পানি দিচ্ছি হাত ধুয়ে নে। সুপ্রভা সরলো না সে ক্রোধান্বিত চোখ মেলে চেয়ে রইলো তাসিনের দিকে। তাকে অবাক করে দিয়ে তাসিন সুন্দর করে মুরগির এক অংশ তুলে দারুনভাবে চামড়া থেকে মাংসটা আলাদা করে নিলো। দ্বিতীয় অংশটাকেও একইভাবে আলাদা করে নিলো। টিয়াকে বলল পানি আনতে ততক্ষণে তাসিন মুরগির ভেতরের অংশ যা সুপ্রভা আগেই কেটে ফেলেছিল তা ভালো করে সরিয়ে নিলো। নাকমুখ কুঁচকে ফেলল তাসিন মেয়েটা নাড়িভুড়ির কি হাল করেছে! এতক্ষণে সুপ্রভার ক্রোধমাখা দৃষ্টি বদলে গেছে। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে চেয়ে আছে তাসিনের হাতে। কয়েক মুহুর্ত পর আচমকাই চোখ আটকে গেল তার খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি শক্ত চোয়ালে। ধীরে ধীরে কপাল, আর নাকটাতেও আটকে গেল। অপলক চোখে কেউ কারো দিকে তাকিয়ে থাকলে অপর ব্যক্তিটা টের পেয়ে যায়। তাসিনও হয়ত টের পেয়েছে এক জোড়া দৃষ্টিতে সে গাঢ় ভাবে বন্দী এই মুহুর্তে। টিয়া এক পাতিলে করে পানি আনলে কাটা মুরগি গুলো সেই পানিতে দিয়ে বলল, ধুয়ে নাও।

সুপ্রভা তখনও দেখছিলো তাসিনকে খুঁটিয়ে খুব মনযোগে। আর এই ব্যাপারটা বোধহয় মুরাদও খেয়াল করলো। সে শুকনো গলায় কেঁশে বলল, “চোখেই কি খাওয়ার চেষ্টা চলছে!”

“কি?” তাসিন প্রশ্ন করলো। সুপ্রভাও ভড়কে গেছে। চোখ সরিয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। টিয়া কিছুই টের পেলো না। বেচারি মাংস নিয়ে কলপাড়ে বসেছে মুরাদ এগিয়ে গেল সেদিকে। তাসিনেরও হাত ধোয়ার ছিল তাই সেও উঠে দাঁড়ালো। খুব ধীরে এবং অস্পষ্ট স্বরে সেও একটা কথা বলল, “খাওয়ার শখ জাগলে অন্যভাবে খাও চোখ দিয়ে খেয়ে কি মজা পাবে!”।

সুপ্রভা কিছু বোঝার আগেই তাসিন কলপাড়ে গেল৷ হাত ধুয়ে সে মুরাদকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে চাইলো৷ কিন্তু টিয়া তা হতে দিলো না। সে যে করেই হোক আজ বিরিয়ানি রান্না করবে এবং সবাইকে খাওয়াবেই বলে সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু তাসিনের বসে থাকতে ইচ্ছে করল না তাই সে ‘পরে আসছি’ বলে বেরিয়ে গেল। মুরাদ বাসমতী চালের আইডিয়া বাদ দিয়ে ঘরে থাকা ছোটদানা পোলাও চাল দিয়ে রান্না করতে বলল। টিয়াও বুঝতে পারলো তার পক্ষে সম্ভব নয় তাই সেই চালেই ইউটিউব দেখে রান্না বসালো। ছুটির দিন বলে মুরাদও একটু বাইরে যেতে চাইলো চলেও গেল। দু বান্ধবী মিলে অনেক পরিশ্রমের পর রান্না ঠিকই করলো শুধু চালটা পুরোপুরি হয়নি মনে হলো। প্রায় ঘন্টা দুই পর ফিরে এলো মুরাদ। জানতে চাইলো বিরিয়ানির কি অবস্থা। টিয়াও মিষ্টি হেসে বলল হয়ে গেছে আগেই। তবুও মুরাদের সন্দেহ রইলো। সে একবার দেখতে চাইলো কিন্তু টিয়া দিলো না।

” আগে গোসল করে আসো তাসিন ভাইয়াকে কল দাও একসাথে খাবে।”

“আচ্ছা ” বলেই মুরাদ প্রথমে তাসিন পরে রিমন আর সুমনকেও কল দিলো। সুমন এলাকার বাইরে আছে রিমনও মাত্রই নাকি বাড়ি ফিরেছে। তবুও বিরিয়ানির তো আলাদা একটা টান আছে তাই রিমন আর উপেক্ষা করতে পারেনি। বলল আধঘন্টার মধ্যে চলে আসছে। ঘড়ির কাটা ঠিক দুইটা পঁয়তাল্লিশ তাসিন আর রিমন এসে উপস্থিত হলো একসাথে। টিয়া খাবার বাড়লো। শসা, লেবু, পেঁয়াজ কেটে সালাদও দিলো। তাদের খাবার ঘরের চৌকিতে তাসিন, রিমন, মুরাদ তিনজনে বসতেই টিয়া প্লেট এগিয়ে দিল সবাইকে। সুপ্রভাকেও খেতে বলা হলে সে পরে খাবে বলল। মুরাদ খাবার মুখে দিলো কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। পরপর রিমন আর তাসিনও মুখে পুরলো কিন্তু দুজনেরই কপাল কুঁচকে গেল।

“কি হলো?”

প্রশ্নটা করলো টিয়া কারণ সেই লক্ষ্য করছিলো তিনজনকে। ভেবেছিলো বাকিরা না হোক অন্তত মুরাদ প্রথমবার মুখে দিয়েই কিছু একটা বলবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল বলেই সে বাকি দুজনকেও দেখছিল।

রিমন চাবাতে চাবাতেই বলল, “চাল সেদ্ধ হয়নি, মাংসে আদা রসুন কিছু একটা বেশি হয়েছে।”

তাসিন এর পক্ষে সম্ভব নয় এই খাবার গলা দিয়ে নামানো। সে বলল, “তোমরা খেয়েছো?”

“না” টিয়া জবাব দিলো।

“আচ্ছা এগুলো হাঁড়িতে রাখো আর চুলায় আগুন আছে?”

“না ভাইয়া আমি তো সিলিন্ডার গ্যাসে করেছি৷” মুখটা চুপসে গেছে টিয়ার। সকাল থেকে ঝামেলা কিছু না কিছু বাঁধছেই আজ। শ্বাশুড়ি মা বকাবকি করলেও কাজটাও করে দেয় অনেকাংশে কিন্তু আজ সবটা ইউটিউব দেখে নিজে করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। বিয়ে হয়েছে তাদের মাস পেরিয়ে গেছে অথচ সে এখন পর্যন্ত একটাদিন এক কাপ চা পর্যন্ত নিজে করে খাওয়াতে পারেনি কাউকে। শ্বাশুড়ি মা মুখে তিক্ততা প্রকাশ করলেও কাজেকর্মে হরহামেশাই তাকে সাহায্য করেছে, শিখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ সকাল থেকে এত পরিমান হোঁচট খেয়েছে কাজে যা এখন তার ভাবতেই লজ্জা লাগছে, কান্না পাচ্ছে৷ মুরাদ নেহায়েতই সরল মানুষ তাই কিছুতেই বিরক্তি প্রকাশ করে না৷ চোখ দুটো ছলছল করছে তার। সুপ্রভাও সকাল থেকেই সবটা দেখছে তারও এখন খারাপ লাগছে। তাদের মন খারাপ ভাবটা কেটে গেল চুটকিতে যখন দেখলো তাসিন হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘরে গেল। গ্যাস অন করে তাতে রুটি ছ্যাকার লোহার তাওয়া বসিয়ে দিল। তাওয়া হালকা গরম হতেই হাঁড়ি ভালো করে ঢাকনাবন্ধ রেখে দিলো কিছুটা সময় একদম নিভু নিভু আঁচে। গরম বিরিয়ানিটা আরো কিছুক্ষণ সেভাবে রাখতেই বিরিয়ানির চালটা একদম ঠিকঠাক হয়ে উঠলো। এরপর নামিয়ে পরেই খেল তাসিন, সুপ্রভা আর টিয়া। তবে মশলার গন্ধটা থেকেই গেল তবুও কোনরকমে সে পর্যায়ে খাওয়াটা হয়ে গেছে। এরপর আর বেশি দেরি করেনি সুপ্রভা। তার মেজদা গাড়ি নিয়ে এসেছে বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ভাগ্য ভালো ছিল সুপ্রভার ভাই মুরাদদের বাড়ির ভেতর আসেনি তা নয়ত আবারও তিনটে ছেলের সাথে বোনকে দেখে হয়ত কোন ঝামেলা পাকাতো।

সারাদিন মুরাদের বাড়ি, সন্ধ্যেটা বাজারে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে নিলো তাসিন। জৈষ্ঠের গরমে পাকা আমে বাজারে ম ম করছে ফলের দোকান। সকালেই মা বারবার করে বলেছিলো ফুপুর সাথে দেখা করে আসতে। কবে থেকেই ফুপু তাকে দেখে না বলে আক্ষেপ করছিলো। বাড়ির ফেরার পথে বাজারে আব্বাকে দেখে তাসিন ডাকলো, “আব্বা বাড়ি যান?”

“হ আব্বা আপনে এনে কি করেন?”

তাসিন খেয়াল করলো আব্বা তাকে আপনি বলে সম্মোধন করছেন তারমানে মেজাজ কোন কারণে ঠিক নেই। কিন্তু ফুপুর জন্য কিছু কিনবে বললে নিশ্চিত আব্বার মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে। সে আম কিনতে পারে না ভালো দেখে তাই এই মুহুর্তে আব্বার হেল্পটাই চাই তার।

“আমি তো আম কিনতে আসছি ফুপুর জন্য কিন্তু আম তো ভালো চিনি না।”

কথা বলার ভঙ্গি দেখেই গলে গেল আফছার মীর। তাঁর পাশে একজন লোক খুব সম্ভব তার ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের কেউ ছিলো। লোকটাও বলল, “আপনার পোলা এইডা? দেখতে, শুনতে তো মাশাআল্লাহ।”

“হ, আমার পোলা শহরে থাইকা পড়ালেখা করে আবার ভালা চাকরিও করে।” কথাটা বলতে গিয়ে যেন একটু গর্ববোধ করলো আফছার মীর। পাশে থাকা লোকটাকে স্বল্প কথায় বিদায় দিয়ে তিনি তাসিনকে নিয়ে ফলের দোকানে ঢুকলেন। খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে ফ্রেশ আর সুমিষ্ট আমগুলোই কিনলেন। টাকাটা অবশ্য আব্বার থেকে না নিয়ে তাসিন নিজ পকেট থেকেই দিলো। তাসিনের গাড়ি বাজারের গ্যারেজে রেখে গিয়েছিলো চেকিং এর জন্য। ঢাকায় গেলে সঙ্গে নিবে না বলেই বাড়িতে রেখে যাবে। গাড়িটাও এখন নিয়ে যাবে বলে তার বাবাকে বলল, “আব্বা দাঁড়ান গাড়িতে করে যাই। গাড়ি নিতে হবে এখন।”

আফছার মীর আমের দোকানেই দাঁড়ালো৷ বাজারের মোড় ছেড়ে একটু ভেতরে গ্যারেজ। তাসিন দ্রুত গিয়ে গাড়ি নিয়ে ফিরে এলো। আফছার মীর উঠে বসতেই তাসিন গাড়ি স্টার্ট দিলো। মিনিট সাতেক এর মধ্যে পৌঁছে গেল ফুপুদের বাড়ির সামনে। তাসিন এর সাথে তার আব্বাও নামলো তার বোনকে দেখতে। আয়না বারান্দার মত জায়গায় রাখা তাদের ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ছিলো। গ্রিলের ফাঁকে চোখের দৃষ্টি আটকালো বাইরে গেইটের দিকে৷ তাদের বাড়িতে মাত্রই কিছুদিন আগে লোহার গেইট লাগানো হয়ে সেটাও গ্রিলের মত ফাঁকা সেখান থেকেই গাছের ডালে বাঁধা বাতির আলোয় দেখা গেল দুজন মানুষকে। সারাদিন মনমরা হয়ে থাকা আয়নার মনটা হঠাৎই ফুরফুরে হয়ে গেল তাসিনের ওপর চোখ পড়তেই। সাদা শার্ট, কালো জিন্স, চুলগুলো উসকোখুসকো সবসময়কার মত। দু হাতে দুটো পলিথিন ব্যাগ।সম্ভবত খুব ভারী ব্যাগ দুটো তা তার ফোল্ড করে রাখা হাতার বাইরের হাত দুটোর অবস্থা দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। আয়না নিবিষ্ট মনে তাসিনকে দেখতে দেখতেই তারা সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘরে ঢোকার জন্যও বারান্দার সামনে লোহার গেইট। তাসিন আর তার বাবা গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকালো আয়নার দিকে। নাহ্ মেয়ের কোন হেলদোল নেই । মনে হচ্ছে সে তাদের দেখেও দেখছে না। তাসিন কিছু একটা বলবে ভাবছিল তার আগেই আফছার মীর বলল, “কি হইলো আম্মা গেইট না খুইলা চাইয়া আছেন ক্যা?”

মামার কথায় ধ্যান হটলো আয়নার। সে লজ্জায় পড়ে দ্রুত বসা থেকে উঠে এগিয়ে এলো। ততক্ষণে আয়নার মাও এসে বেরিয়েছে ঘর থেকে ভাইয়ের আওয়াজ শুনে।

“ওমা, ভাইজান, তাসিন আপনেরা কখন আইলেন!”

আয়না মাথা নিচু করেই মামাকে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো মামা?”

“আমি ভালোই আছি। আপনেরা কেমন আছেন আর সকালে আপনে গেলেন দেখা করলেন না ক্যান?”

শেষের প্রশ্নটা আয়নার উদ্দেশ্যে করলেন আফছার মীর। কিন্তু তাদের মামা-ভাগ্নীর কথার ওপর দিয়ে আয়নার মা তাসিনকে বলল, “বাবা তুই তো বড়ই পাষাণ হইয়া গেছিস। কবে থাইকা আমার পরাণডা জ্বলে তোরে দেখার জন্য অথচ তুই তো ভুইলাই গেছিস তোর যে একটা ফুপু আছে।” কথাটা বলতে বলতেই চোখ ছলছল করে উঠলো ফুপুর। তাসিন হাতের ব্যাগ দুটো আগেই টেবিলের ওপর রেখেছিলো৷ সে এবার ফুপুকে দু হাতে জড়িয়ে কপালে চুমু খেলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আরে আমার বোকা মেয়ে দেখি কাঁদছে। এমন করলে তো আমি আর আসবোই না।”

“তুই তো এমনেও আসোস না।”

“তাই বলে কাঁদতে হবে? আমি এলাম একটা খুশির সংবাদ দিতে কিন্তু এই কান্নাকাটিতে কিছুই বলবো না।” তাসিনের বাবা চেয়ারে বসে পড়েছেন৷ আয়নাও তার মামার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে আর একটু পরপর কিছুটা লুকিয়েই তাকাচ্ছে তাসিনের দিকে৷ ফুপুর কান্না চলছে একটু একটু সেই সাথে কথাও বলছেন৷ তাসিনকে জিজ্ঞেস করলেন কিসের খবর?

তাসিন দু হাতে ফুপির চোখ মুছিয়ে টেনে চেয়ারে বসালো। নিজেও আরেকটি চেয়ারে বসে বলল, “আমার প্রমোশন হয়েছে ফুপু। চাকরিতে উপরের একটা পদ পেয়েছি আর ছ মাসের জন্য ট্রান্সফার। ঢাকায় অফিস করতে হবে পরশু থেকে আর বেতনের টাকাও বেড়েছে।”

আয়না চুপচাপ শুনছে সব কথা একপাশে দাঁড়িয়ে। তাসিন ট্রান্সফার হলেই কি আর প্রমোশন হলেই কি! সে তো তাসিনের কিছু না। তাসিন ভাই তো তাকে পছন্দই করে না। দূরে থাকলেও যা কাছে থাকলেও তা। তাসিন ভাই তার জন্য আকাশের মত দূর। আয়নার মুখে হাসি বা দুঃখ কোন কিছুরই ছাপ দেখা গেল না। তাসিন কয়েকবার তাকালো আয়নার দিকে তার খারাপ লাগছে। সকালে আয়নার কথাগুলো শুনে আর মুখটা দেখেই খারাপ লাগছিল। কিন্তু তারই’বা কি করার আছে! চোখের সামনে বড় হওয়া পুচকে মেয়েটা যাকে সবসময়ই আপন বোনের মত আগলে এসেছে তাকে নিয়ে এখন প্রেম ভালোবাসা কি করে ভাববে!

তাসিনের ফুপু অনেকক্ষণ গল্প করলো ভাই আর ভাতিজার সাথে। এক ফাঁকে আয়নাকে পাঠালো তরকারিগুলো গরম করতে৷ জোর করেই ভাই-ভাতিজাকে রাতের খাবার খাইয়ে পাঠালো। বাড়ি ফিরে তাসিন বাবাকে বলল, “বড় ঘরের তালার চাবি কার কাছে আব্বা?”

“তোর আম্মার কাছেই আছে। কি করবি?”

“আমি কাল রাতেই চলে যাব। তুহিনকে তো আপনি গাড়ি চালাতে দেন না তাই ভাবছি গাড়িটা ওখানে রেখে যাব।”

“খোঁচা না মাইরা বাপের লগে কথা কইতে জানেন না?” আফছার মীরের মেজাজ আবার গরম হচ্ছে। ছেলেটাও সুযোগ পেলেই মায়ের মত পাড় মারে।

“খোঁচা কোথায় মারলাম আব্বা! ও তো শখে চায় মাঝেমধ্যে একটু চালাতে আপনার ভয়ে একদিনও এই গাড়ি চালাতে পারে নাই৷ ও কিন্তু মেট্রিকের পরেই নানী বাড়ি গিয়ে ড্রাইভিং শিখে আসছিলো।”

রাতের আঁধার গাঢ় হচ্ছে। গরমের তীব্রতা কমেনি একটুও অথচ গাছের পাতাগুলো নড়ছে হু হু বাতাসে। এই বাতাস কোথায় যায়, গায়ে লাগে না কেন বুঝে পায় না আফছার মীর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির আঙিনায় চারপাশে নজর বুলায়। এই যে বাড়িঘর তার এ সব চাইলেই আরেকটু পরিবর্তন করতে পারে। টিন শেড এর চার কক্ষের ঘরখানাকে সে অনায়েসেই দু তলা ইটের দালানেও তৈরি করতে পারে। কিন্তু কিছুই করছে না ছেলে-মেয়ে বিগড়ে যাবে এই ভয়ে। ভয়টা তার হয়ত যৌক্তিক না কিন্তু তাসিনের নানা বাড়িতে তার দু মামার ভাগাভাগি, লড়াই এবং শেষ পর্যন্ত সম্পত্তির ভাগ নিয়ে তাসিনের মায়ের সাথে ছোট ভাইয়ের বিবাদ এসবটার ভয়েই আফছার নিজের ব্যবসায়িক লভ্যাংশ খুব গোপনে ব্যাংকে জমা রেখেছে। সে মূর্খ মানুষ বটে তবুও তার চিন্তা ছেলে মেয়েরা অর্থ দেখলেই মানুষ থেকে ভয়ংকর প্রাণী হয়ে উঠবে। গাড়ি নিয়ে একবার প্রচণ্ডরকম অপমানের মুখে পড়ে তিনি তাসিনকে গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সেখানেও হাজারটা বাঁধা তৈরি করেছিলেন। যেন, ছেলেটা সবকিছু সহজ না মনে করে। বিষন্ন স্বরে বলল, “তোরা আমারে ভুল বুঝোস অনেক। আমি এই যে গাড়ি দিতে বাঁধা দেই এটা তুহিনের ভালোর জন্যই৷ মাইশারে আমি পায়ে হাইট্টা স্কুলে যাইতে কই এইটাও তার ভালোর জন্যই তোরা বুঝোস না। রিকশা ভাড়া ডেইলি অরে দেওয়া আমার জন্য কোন ব্যাপার না।”

তাসিনের খারাপ লাগলো বাবার কথা শুনে। সেও বেশি বেশিই বলে ফেলে !

“আব্বা আপনারে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলি নাই কথাগুলা। তুহিনের অনেক শখ… ”

“আমি জানি৷ গাড়ির চাবি তোর আম্মারেই তো দিবি তুই কইয়া যাইস মাঝেমধ্যে তুহিনরে চালাইতে দিতে। গত বছরেই তুই অর লাইসেন্স করাইছোছ সে খবর সবাই জানে।”

চমকে উঠলো তাসিন। আব্বা সব খবর জেনেও তাদের সামনে অজানার মত থাকেন! আর তারা কিনা আব্বাকে ধোঁকা দিয়ে কি অনিমেষ আনন্দ উপভোগ করতে চায়! বাপ- ছেলের কিছুটা মুহূর্ত কেমন যেন আবেগঘন হয়ে গেল আপনাআপনি। তাসিনের খুব ইচ্ছে হলো আব্বাকে একবার জড়িয়ে ধরার কিন্তু কেমন যেন সংকোচ হলো খুব। তাসিন মায়ের থেকে চাবি নিয়ে গাড়ি রাখলো পাকা ঘরটায়। পুরে বাড়িতে টিনের বেড়া আর টিনের গেইট৷ শুধু গাড়ি কেনার পরই বাবা ছাঁদ আর লোহার দরজা দিয়ে একটাই ঘর তৈরি করে দিয়েছেন গাড়ির গ্যারেজ হিসেবে৷ গাড়ি রেখে ঘরে ঢুকতেই দেখা গেল মায়ের অগ্নিরূপ। সেই সকালের পর থেকেই ছেলে বাড়ির বাইরে এখানে, সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ এমনিতেই কত মন খারাপ ছেলেটা ঢাকায় যাবে বলে তার ওপর কত কি রান্না করলো ছেলের জন্য সেগুলোও পড়ে রইলো৷ বাবার পরে এবার মায়ের সাথে কাটলো রাগ, অভিমানে আরো কিছু সময়। তারপরই সে সুযোগ পেল নিজের ঘরে যাওয়ার। ভাই বোন দুটো আগেই যার যার ঘরের দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়েছে। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে এক এক করে মনে পড়তে লাগলো সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো৷ মনে পড়লো বৃষ্টির রাতে অন্ধকারের মাঝে দেখা অস্পষ্ট সেই মুখটা। আজ তুফানটা তুফানের মত ছিলো না। আজকে সেই মুখটা একদম ভিন্ন ছিলো। আঁড়চোখে, লুকিয়ে লুকিয়ে বহুবার দেখেছে তাসিন সেই মুখটা। মেয়েটা কি একবারও টের পেয়েছে তাসিনের দৃষ্টি! ঠোঁটের ফাঁকে হাসির ঢল নামলো তার। পরনের কাপড় বদলাতেও উঠতে ইচ্ছে করলো না তার। কোনমতে বেড ছেড়ে বাতিটা বন্ধ করে আবার বিছানায় শুলো। শুয়ে শুয়েই শার্টটা খুলে ছুঁড়ে মারলো বিছানার এক কোণে৷ তারপরই চোখ বুঁজে কল্পনা করলো সেই বৃষ্টির রাত আর কক্সবাজার থেকে ঢাকায় যাওয়ার রাতটা, সেই ভোর আর বুকের ওপর পড়ে থাকা অগোছালো, চঞ্চল মেয়েটার মুখ৷ চোখের পাতায় ঘুম নেমে এলো আলগোছে তার৷

চলবে