#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৫)
ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরছে ছন্দ তুলে সেই সাথে বাতাসের তান্ডবও থেমে নেই। ঘড়ির কাটায় রাত তখন সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। আয়নাদের বসার ঘরে এখন রাতের খাবার নিয়ে মেহমানদের সাথে সাধাসাধি পর্ব চলছে। কথা এমন ছিলো না তবুও এমনটাই হয়ে গেল। আবহাওয়া আর মানুষের মন কখন যে কেমন করে বদলে যায় তা কারো বোঝার সাধ্যি নেই। সন্ধ্যার পর মেহমানরা যখন আংটি পরাতে চাইলো তখন আয়নার বাবা অনেকটা বিনয়ের সাথে বাধ সাধলেন। এহসানের মা দমে গেলেও তার ভাবনা ছিলো সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই করবেন সবটা। ছেলে যে এই মেয়েটাকে ভীষণরকম ভালোবেসে ফেলেছে তা তিনি সেদিনই বুঝে গেছেন যেদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি নাকি নিজের জন্য একটা মেয়ে পছন্দ করেছো ঠিকানা দাও দেখে আসি।”
এহসান হকচকিয়ে গিয়েছিলো মায়ের কথায় সে তো মাকে বলেনি এমন কিছু! পরবর্তীতে খুব নম্র স্বরে বলেছিলো, “মেয়েটি আমার চেয়ে অনেক ছোট আম্মা আর আমি এখনই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই না। নিজেই তাকে ভালোলাগার কথা জানিয়ে তার মতামত জানতে চাই। সে আমাকে পছন্দ করলেই তোমরা যাবে না করলে আর এগোবো না সেদিকে।”
মেয়েটির মনের কথা সে আগে ভেবেছে পরে সম্পর্কে জড়াতে চেয়েছে এটা খুবই ভালো লেগেছে এহসানের মায়ের। নিজের ছেলে বলে নয় সত্যিই এহসান সততার সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চায়। আর আজ মেয়ে দেখতে এসে কেন জানি মনে হলো মেয়েটির মনে কিছু চলছে। কিন্তু মেয়েটির পরিবার যে তাদের ছেলেকে পছন্দ করে সেকথা মেয়েটির মামী আর মেয়ের বাবার কথাবার্তায় বোঝা হয়ে গেছে। তাই তিনি আংটি নিয়ে তোড়জোড় করছিলেন। এরই মাঝে আবহাওয়া নরম হলো হঠাৎ করেই। প্রথমে বাতাস কিছুক্ষণ পরেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আংটি বদল পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে কিন্তু এহসানের বাড়ির লোকেরা আর বের হওয়ার সুযোগ পায়নি। রাত যখন প্রায় নয়টা বাজে তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই এসে হাজির হয় আয়নাদের গেইটের সামনে। সুপ্রভার বড়দাকে ফোন দিয়ে গাড়িও পাঠাতে বলে সে। এহসান যখন তার মাকে ফোন দিয়ে বলল, কোনমতে বেরিয়ে গেইটে আসো তোমরা সোহরাব ভাই গাড়ি পাঠিয়েছে। তখন পাশ থেকে তাসিনের মামীও বোধহয় শুনলেন এহসানের মায়ের কথা৷ সেও সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলো না। তিনিই বললেন, “আপা আপনার ছেলেটাই কি আপনাদের নিতে এসেছে!”
এহসানের মা কিছুটা ভড়কে গেলেন তবে জবাব দিলেন ‘হ্যা’ পাত্র নিজেই এসেছে। ব্যস, মামীও শুরু করলেন, “বৃষ্টিতে ছেলেটা বাইরে কেন তাকে ভেতরে আসতে বলুন। এই সুযোগে ছেলে মেয়ে দুটোকে কথা বলতে দেয়া যাক। বিয়েটা তারাই তো করবে আর মেয়ের মাও ছেলে এখনই দেখে নিবে!”
এহসানের মা তাকে পুনরায় ফোন করে বললেন ভেতরে চলে আসতে। ছাতা মাথায় থাকলেও এহসান অনেকটা ভিজে গেছে। বসার ঘরে উপস্থিত হতেই আয়নার মা তড়িঘড়ি তাকে একটা তোয়ালে এনে দিলো হাতে। সামনে অনেকগুলো মহিলা বসে আছেন তাই আয়নার বাবা বললেন, “এককাজ করো তুমি পাশের ঘরে বসে একটু ভালো করে মুখ হাত মুছে নাও এসো আমার সাথে।”
এহসানও বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে গেলো আয়নার বাবার সাথে। ভালো করে মাথা মুছে ইউনিফর্মের ওপর দিয়েই হাত, মুখ মুছতে গিয়ে কেমন যেন একটু লাগলো তার। তোয়ালেটাতে কেমন ভিন্ন এক সুবাস। এটা কি শ্যাম্পু কি কোন শ্যাম্পুর সুবাস! তোয়ালেটা কি আয়নার! প্রেমিক মনের ভাবনা বোধহয় এমনই হয়। মিনিট কয়েকের মাঝেই তাসিনের মামী এলেন চায়ের কাপ হাতে এহসানের সামনে। সে তোয়ালেটা বিছানায় রেখে নম্রস্বরে বলল, “আমি বাইরেই আসছিলাম আন্টি।”
“একটু পরেই এসো বাবা। তোমার আম্মু আর মেয়ে পরিবার চাচ্ছে তুমি আর আমাদের আয়না একটু নিজেদের মধ্যে কথা বলে নাও তাই এখানেই নিয়ে এলাম চা’টা। আসলে কি বলোতো তোমার আম্মু আংটি পরাতে চাচ্ছিলেন তাই আমরা ভাবলাম বিয়েটা তোমাদের আলাপটাও তোমাদের হওয়া উচিত।”
এহসানও হয়ত এমন কিছুই ভাবছিলো মনে মনে তাই আর কথা বাড়ায়নি। তার মৌনতা তাসিনের মামি সম্মতি ভেবেই চা দিয়ে চলে গেলেন।
আয়নার ঘরে ঢুকে মিনতি তার চুল মুঠোয় পুরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “বেহায়াগিরি শেষ হয়ে থাকলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মুখে পাউডার মেরে ওড়না মাথায় দিয়ে বের হ। ছেলের সাথে এখন দেখা করবি আর অবশ্যই সে যাই জিজ্ঞেস করবে ভালোভাবে জবাব দিবি। আর যদি একটুও কোন ভুল কাজ করিস তবে আজকে রাতেই আমার ম’রা মুখ দেখবি।”
চুল ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আয়নার মা। সন্ধ্যায় যখন এহসানের বাড়ির মানুষগুলো এলো তখনই মিনতি মেয়ের ঘরে এসেছিলেন তাকে পরিপাটি থাকার কথা বলতে। দরজা আলগোছে লাগানো ছিলো আয়নার সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। তার মাথায় ঘুরছিলো তাসিনের বলা একটা কথাই, ” আমি একজনকে ভালোবাসি খুব খুব খুউব ভালোবাসি।”
এই একটা বাক্যই আয়নার ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ঝাঁজরা করে দিলো। মুহূর্তেই মনে হলো বেঁ’চে থেকে লাভ কি তার! অল্পবয়সী আবেগি মন তখন আবেগি ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ রইলো। শুধু মনে হলো তাসিন ভাইকে না পেলে ম/রে যাওয়াই শ্রেয়। সে যাকে ভালোবাসে সেই মানুষটা কেন তাকে ভালোবাসবে না! অযৌক্তিক এক ভাবনা মনকে বিষিয়ে তুলতেই তৎক্ষনাৎ গলায় ফাঁ’স দেওয়ার সহজ ভাবনটাই তাকে গ্রাস করেছিলো। পরনের শাড়িটা খুলে প্রথমেই বন্ধ ফ্যানটায় বাঁধতে চেষ্টা করছিল আর তখনি তার মা প্রবেশ করেন ঘরে। বলতে নেই এক মুহূর্তে মিনতির আত্মাটা দেহ ছেড়েই যেন বেরিয়ে যাচ্ছিল একমাত্র সন্তানের এমন অবস্থা দেখে। কয়েক সেকেন্ড এর স্তব্ধতার পর যখন তার হুঁশ এলো তখনি সে আয়নাকে টেনে খাট থেকে নামিয়ে পরপর কয়েকটা থাপ্পড় মেরেছিলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আয়নার মধ্যে একটুও পরিবর্তন হয়নি অথচ মিনতি থরথর করে কেঁপে যাচ্ছিলেন৷ থাপ্পড়ে আয়নার গাল লাল হয়ে উঠেছে তবুও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি। নিজেকে সময় নিয়ে ধাতস্থ করে মিনতি যখন ঘর ছাড়ছিলেন তখন বলেছিলেন মুখে ভালো করে মেকাপ দে। একটু পরই তোর মামী এসে নিয়ে যাবে। একটু আগের ঘটনা কেউ যেন টের না পায়। তাই হয়েছিলো, কেউ গাল, মুখ দেখে কিছু বুঝতে না পারলেও এহসানের মায়ের মনে হলো মেয়েটা একটু রূঢ় স্বভাবের তবে ছেলের পছন্দ বলে বেশি একটা ভাবেননি। আর এখন যখন এহসানের সামনে যেতে হবে তখন মিনতির মনে হলো মেয়ে এবার নিশ্চয়ই ঝামেলা করবে তাই একটু সাবধান করার চিন্তায় রাগ প্রকাশ করে মেয়ের চুলের মুঠি ধরেছিলেন । কিন্তু না তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়ে সত্যিই কোন ঝামেলা করেনি বরং প্রথমবারের মেকাপের ওপর আরো এক প্রস্থ ফাউন্ডেশন আর পাউডার মিলিয়ে গালের লালচে আভা দূর করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ এখনো আসেনি বৃষ্টিও কমার বদলে যেন আরো বেড়ে গেল। এবারও তাসিনের মামিই নিজ উদ্দোগে এগিয়ে আসছিলেন আয়নাকে নিয়ে এহসানের সামনে যেতে। তখনি মামির ফোন বাজল। আয়নার ঘরে না ঢুকে সামনেই বারান্দার মত জায়গায় দাঁড়িয়ে মামি কল ধরলেন। এদিকটাতে মোমবাতি কিংবা চার্জার বাতি কিছুই নেই বলে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলেও চোখে পড়ছে না। মামি ফোন রিসিভ করে নিচু স্বরে বললেন, “বল তাসিন।”
“ওদিকের কি অবস্থা মামী? ”
“সব ঠিকঠাকই আছে আর মেয়েটাও কোন পাগলামি করেনি। আল্লাহ ভরসা এখনও কোন ভুল করবে না। ও জানিস, পাত্র এসেছে এখন সবাইকে বলেছি মেয়ের সাথে তাকে আলাদা কথা বলতে দিতে।”
“কিন্তু মামী আয়না যদি এহসানকে কিছু বলে!”
চিন্তিত স্বরে বলল তাসিন।
“কি বলবে! আয়না তো আর একদমই বাচ্চা মেয়ে না। আর সুপ্রভা না তোকে বলল তার ভাই খুব ভালোবাসে আয়নাকে! ভয় পাওয়ার কিছু নেই দেখবি আয়না সুখী হবে ছেলেটার সাথে। সত্যি বলতে কি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। নিজের একটা মেয়ে থাকলে আমার মেয়ের জামাই করে নিতাম তাকে।” হেসে উঠলেন মামী। কথাবার্তা খুবই ধীরস্বরে বলছিলেন দুজনে। তারা কথার মাঝেই সুপ্রভাকে নিয়েও কথা বলে খুব হাসছিলেন। মামীর হঠাৎ মনে হলো তাঁর পেছনে কেউ আছে। বোধহয় কারো নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলেন। ঘাড় ফিরিয়ে ফোন তাক করলেন। ফ্ল্যাশের আলোয় কাউকেই দেখতে পেলেন না। আবার মনে হলো এত বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজের মাঝে নিঃশ্বাস শোনা ভ্রম ছাড়া কিছুই নয়। তাসিনকে ফোন রাখতে বলে তিনি আয়নার রুমে ঢুকলেন। সে ঘরেও বাতি নেই আয়নার ফোনের টর্চ জ্বলছে। মৃদু আলোতেও আয়নার মুখটা মিষ্টি লাগছিলো দেখতে। মামী মনে মনেই বলে বসলেন, “মেয়েটা খুবই সুন্দরী তাসিন কি হতো এই মেয়েটাকেই যদি ভালোবাসতি! তাহলে এইটুকুনি মেয়ের আবেগ অল্প বয়সেই যন্ত্রণায় ঝলসাতো না।”
কারো হাতেই কিছু নেই। ভাগ্যের সাজানো গল্প মানুষ বদলাতে পারে না। মামী আলতো হাতে আয়নার মাথায় হাত রেখে বললেন, “চলো আম্মু ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে।”
আয়না চুপচাপ বেরিয়ে এলো মামীর সাথে। বসার ঘর পেরিয়ে পরের ঘরটাতে মামী আয়নাকে নিয়ে ঢুকতেই এহসান বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তার হাতে চায়ের কাপটা খালি। মামী সেদিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “কাপটা আমাকে দাও তোমরা একটু কথা বলো। জড়তা রেখো না কেউই নিঃসংকোচে কথা বলাটাই জরুরি। ”
মাঝারি সাইজের এল ই ডি সাদা চার্জার বাতি জ্বলছে খাটের পাশে টেবিলের ওপর। বাতিটা তাসিন এনেছিলো চট্টগ্রাম থেকে কয়েক মাস আগেই। সামনেই মাইশার মেট্রিক পরীক্ষা আর এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই অনেক সময় ধরে কারেন্ট থাকে না কখনো দিনে কখনো রাতে। সেকারণেই এই বাতি আনা আজ কাজে লাগছে আয়নার মুখ দেখার। গাঢ় দৃষ্টিতে এহসান তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। একটুও ভালো দেখাচ্ছে না আজ তাকে অথচ কালও যখন রাস্তায় দেখেছিলো তখনও কতোটা স্নিগ্ধতা ছিলো এই মুখে। তার দেখা আয়নার সাথে এই আয়নার অনেক পার্থক্য কিন্তু সেটা কি তা বুঝতে পারছে না এহসান। কয়েক মিনিট পর আয়না যখন নিজেই চোখ তুলে তাকালো এহসানের দিকে তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না পরিবর্তনটা। খুব স্বাভাবিকভাবেই এহসান বলল, “এত মেকাপ না করলেও হতো৷ তোমাকে সম্ভবত মেকাপহীন খুব স্নিগ্ধ লাগে।”
আয়নার অভিব্যক্তিতে কোন পরিবর্তন ঘটেনি এহসানের কথা শুনে। এহসান আবারও বলল, “তোমার যা কিছু বলার, জানার বা জিজ্ঞেস করার আছে করো।”
সরাসরি এমন কাটকাট কথায় আয়না এবার একটু চমকালো। পাত্রী দেখতে এলে কি পাত্র এমনকিছুই বলে নাকি! কিন্তু তাসিনকে নিয়ে মনের যে বিধ্বস্ততা এ অবস্থায় অন্য ভাবনা বেশিক্ষণ মনের ভেতর টিকতে পারলো না। তবে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকারও কোন মানে হয় না৷ আর এমনিতেও এ ঘরে আসার কয়েক মিনিট পূর্বেই সে কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে৷ হোক তার সেসব সিদ্ধান্ত বেহায়াপনা অথবা অসভ্যতা তবুও সে বাস্তবায়ন করবেই সেসব৷ এহসান আরো কিছু বলার আগেই আয়না বলল, “আজ আংটি পরাতে চেয়েছিলো আমায় কিন্তু আমি চাই আকদ হোক।”
বৃষ্টি কমে এসেছে এখন কারেন্টও এলো । আয়না এ ঘরে এসেছে মিনিট পাঁচেক হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই আর কয়েক মিনিটের মধ্যে কেউ তাকে নিতে আসবে! এই ভেবেই সে দ্রুত নিজের কথাগুলো শেষ করতে চাইলো। কিন্তু সে একটাবারও তাকিয়ে দেখলো না তার কথা শুনে সামনের মানুষটার মুখে খুশির বদলে ভিন্ন এক ছায়া নেমেছে৷ আয়না আবারও বলল, “আমার ফাইনাল পরীক্ষা আর মাস ছ’য়েকের ভেতর তারপর অনুষ্ঠানাদি হবে এটাই শর্ত।”
বোকা মেয়ে লোকমুখে শুনেছে এহসান মাহমুদ তার প্রেমে পাগল দিওয়ানা৷ সে নিজেও দেখেছে লেকটাকে তার পেছনে এদিক ওদিকে কাজের বাহানায় দাঁড়িয়ে থাকতে। ধরেই নিয়েছে যে লোক তার জন্য পাগল সে লোক নিশ্চয়ই তার সব শর্ত মেনে নেবে। অপরিপক্ক মস্তিষ্কের ভাবনায় ঘাটতি কিছু নয় অনেকটাই ছিল তাই অল্পক্ষণেই নিজের মত ভেবে নিলো সবটা। এহসান মাহমুদ বয়সের চেয়েও এক কাঠি বেশিই চতুরতা দেখাতে পেরে সাধারণ পুলিশ থেকে পদবী অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে। কর্মদক্ষতা তার নিপুণ বুদ্ধি দিয়েই প্রতি পদে প্রমাণ করে আসা লোকটাকে পুচকে মেয়েটা কি ভেবে নিজের সাজানো ড্রামা দেখাতে চাইলো! আয়না প্ল্যান করেছে এহসান তাতে সম্মতিও দিলো৷ সে মিনিট দুই সময়ও না নিয়ে বলল, “শর্ত মানলাম। আর কিছু বলতে চাও?”
আয়না নিজেই অবাক হলো এবার৷ লোকটা কোন প্রশ্ন ছাড়াই তার কথা মেনে নিলো! সে মাথা নাড়িয়ে না বলতেই এহসান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আয়নার মা আর মামী মিলে রাতের খাবারের আয়োজন করে ফেলেছেন মোটামুটি রকমের। এহসান শুনতে না চাইলেও সকলের জোরাজুরিতে রাতের খাবার খেয়েই উঠলো৷ এহসানের মা যাওয়ার সময় বলে গেলেন তারা কবে যাবে যেন দ্রুতই জানায়৷
মামীর সাথে কথা শেষ হওয়ার পর থেকেই সুপ্রভার সাথে চ্যাটিং চলছে তাসিনের। যাই করছে কাজের ফাঁকেই একের পর এক মেসেজ আর জবাব দেওয়া চলছে অনবরত৷ খাবার খেতে বসে সুপ্রভাকে লিখেছিলো, “রাতের খাবার খেয়েছো?”
“কপাল মন্দ খাবো না।” সুপ্রভার রিপ্লাই।
“কেন?”
“ব্যাঙ্গের স্যুপ আর তেলাপোকার চাটনি আছে খাবারে আজ তাই।”
মাত্রই ভাতের লোকমা মুখে পুরে বা হাতে টাইপ করছিলো তাসিন৷ সুপ্রভার থেকে আসা মেসেজ দেখে মুখের ভাত গলায় আটকে গেল। তার পাশে আজ ডাইনিংয়ে কেউ নেই৷ আজকাল ফোনে ব্যস্ত থেকে প্রায় ডাইনিংয়ে লেট আসে তাসিন৷ সে কারণেই আজও সে একা খাচ্ছিলো। কিন্তু এই মুহুর্তে গলায় আটকে থাকা ভাত ওয়াক ওয়াক করতে করতে টেবিল, প্লেট সব ভরে ফেলল সে। ছিহ, মেয়েটা এসব কি লিখল! তাসিনের রিপ্লাই না পেয়ে সুপ্রভা আবারও লিখলো, “কি হলো রিপ্লাই দিচ্ছেন না কেন! তেলাপোকার চাটনির কথা শুনে কি জিভে জল এসে গেছে? খাবেন নাকি একটু! বলেন তো দেই একটুখানি।” লিখেই পাশে হা হা ইমোজি।
চলবে
#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৩৬)
আয়নার শর্ত মোতাবেক আংটি বদল লাগবে না আকদ হবে। আবার অনুষ্ঠানাদি হবে মাস ছয় পরে। এহসানের কিছুতেই আপত্তি নেই সে শর্ত মঞ্জুর বলেছে তাই বলে আকদ সে রাতেই হবে তেমনটাতে সায় দেয়নি। আয়না ভেবেছিলো সে রাতেই না আবার কবুল বলতে হয় এ নিয়ে খুব ভয়ে ছিলো সারাটা সময়। তার বয়সের সাথে ভাবনার পরিসরও ছোট ছিলো তাই নিজের ভাবনাগুলোই মূল্যবান তার কাছে। কিন্তু এহসান দুনিয়া দেখেছে, মানুষ চেনার মত ক্ষমতা তার কিছুটা হলেও হয়ে গেছে। চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসের সাথে হরদম বোঝাপড়া করে সেই ছেলে কি এইটুকুনি মেয়ের চোখের ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পারবে না! আয়না যখন তার শর্ত প্রকাশ করেছিলো তখন এহসান গভীর মনযোগে তাকিয়ে ছিলো আয়নার মুখে, তার চোখে৷ সপ্তদশী কন্যার উথাল-পাতাল আচরণ আর তার চতুরতা একটু হলেও চোখে বেঁধেছে তার। তাই খাওয়া-দাওয়া সেরে কোন কথা না বলেই চলে গিয়েছিলো। কিন্তু আয়নাকে অবাক করে দিয়ে ভোর সকালেই তার ফুপিকে দিয়ে ফোন করিয়েছে আয়নার মায়ের কাছে। সিদ্ধান্ত হলো কালই তারা পাত্রের বাড়ি যাবে এবং সব ঠিকঠাক হলে আরো একবার পাত্রপক্ষ আসবে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে। পরেরদিনই আয়না কলেজে গেল আর পথে নিয়মানুসার চোখে পড়লো এহসানকে। এই প্রথম আয়না ভালো করে দেখল তাকে। লম্বা, চওড়া পুরুষ। স্বাস্থ্যটা উচ্চতার কারণে হয়ত খুব একটা চোখে লাগে না লোকটার। চোখ জোড়ায় অন্যরকম এক কাঠিন্য তবে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। লোকটা দেখতে সুদর্শন ভালো লাগলো আয়নার কিন্তু সেই ভালো লাগা তো তাসিন ভাইয়ের মত নয়। তাসিন ভাইকে সে কৈশোরের প্রথম থেকে ভালোবাসে। কোন কিছুর বিনিময়েই সম্ভব নয় তাসিন ভাইকে ভোলা কিন্তু ওই সুপ্রভার জন্যই তো তাসিন ভাই তাকে অপছন্দ করে! সুপ্রভাকেই সে দেখে নেবে। গত রাতে মামীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলা সব কথা সে শুনেছিলো পেছনে দাঁড়িয়ে। ওই মেয়ের জন্যই তাসিন ভাই তাকে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে তাও কিনা সুপ্রভারই মামাতো ভাইয়ের সাথে! এই লোককে বিয়ে করেই সে ঝামেলা বাঁধাবে। এমন ঝামেলা তৈরি করবে যা কেবলমাত্র সুপ্রভার আত্মীয় হয়েই সম্ভব৷ এহসান আজও একটু দূরত্ব রেখেই দেখছে আয়নাকে। কলেজে ঢুকে আয়না প্রথমেই তার দুই বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে গতরাতের কথা বলল। সেই পুলিশটার সাথে তার বিয়ের কথা চলছে। আর তাসিন ভাই সেই লোকের বোনের সাথেই প্রেম করে। দু বান্ধবীর একজন খুব করে বোঝালো যা হয় ভালোর জন্য। সেই পুলিশ অফিসারটা বয়সে একটু বেশিই বড় তবুও তাকে খুব পছন্দ করে বলেই মনে হয়। আর গ্রামেও সুনাম লোকটার। অন্য বান্ধবীটির মতামত আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতোই কাজ করলো। আয়নাকে বোঝালো অন্যায় হচ্ছে তার সাথে আর সব দোষ ওই মেয়ের। কোথাকার কোন মেয়ে এসে তাসিন ভাইকে কব্জা করছে এটা তো মানা যায় না। আয়না তার সিদ্ধান্তে অটল ওই লোকটাকেই বিয়ে করবে তারপরই সে সুপ্রভাকে আলাদা করবে তাসিন ভাইয়ের থেকে৷ কাউকেই শান্তিতে থাকতে দেবে না সে।
“কি করছো?”
“পরীক্ষা নেই পড়তেও ইচ্ছে করছিলো না তাই মেহরিন আর সৌহার্দ্যকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পাসে চা আড্ডা দিচ্ছি।”
তাসিন মেসেজটা পড়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবলো সৌহার্দ্যটা কে! কিছু সময় মস্তিষ্কে জোর দিতেই মনে পড়লো সুপ্রভার বন্ধু সে। ওই যে সেই প্রথম দেখার রাতে সুপ্রভা তার ভাইকে বলেছিলো সে সৌহার্দ্যকে বিয়ে করবে না। মনটা খচখচ করতে লাগলো মেসেজটা পেয়ে কিন্তু তা অপ্রকাশিত। সবাই কাজে মনযোগী শুধু তাসিনই কাজ আর চ্যাটিং একসাথে করছিলো। সুপ্রভার মেসেজটা আপাতত আর তাকে চ্যাটিং করতে দিলো না। ফোনটা রেখে কম্পিউটারে তাকালো। ওপাশে রিপ্লাই না পেয়ে সুপ্রভা একটু ঘাবড়ালো কি! তার মনে হচ্ছে সৌহার্দ্য নামটা দেখেই মেসেজ সিন করেও রিপ্লাই দেয়নি তাসিন। রোদ আর মেঘ আজ পাশাপাশি। রোদে চারপাশ ঝলমলে অথচ আকাশে কালো মেঘও ভেসে বেড়াচ্ছে। সবুজ ঘাসের ওপর জুতো রেখে তার ওপর বসে আছে সুপ্রভা তার পাশে সৌহার্দ্য। মেহরিন মাত্রই বসা থেকে ওঠে গেছে গেইটের দিকে। একটা গাজরার মালা হাতে বাচ্চা মেয়ে ছিল ওদিকটায় নিশ্চিত মেহরিন মালা কিনবে। সৌহার্দ্য অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিলো কিছু একটা বলার জন্য। মেহরিন চলে যেতেই সে সরাসরি তাকালো সুপ্রভার দিকে।
“শেষ পর্যন্ত তোমারও প্রেমিক জুটে গেল!”
বক্রচোখে তাকালো সুপ্রভা সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “কি বলতে চাইছো?”
“যার সাথে আজকাল প্রায়ই হোস্টেলের সামনের রেস্টুরেন্টে আর নিউ মার্কেটে ঘুরতে যাও তার কথাই বলছি। প্রেম ছাড়া নিশ্চয়ই এমনি এমনিই ঘুরে বেড়াও না তোমরা!”
“তুমি কি করে জানলে আমি কারো সাথে রেস্টুরেন্টে যাই!”
“এ মাসেই প্রায় তিনদিন আমি মেহরিনের সাথে দেখা করতে গিয়ে তোমাদের দেখেছি সেখানে। আর ওই সেদিন তো ভদ্রলোক তোমার জন্য ক্যাম্পাসেই এলো।”
“এ্যাই এ্যাই তুমি মেহরিনের সাথে দেখা করতে যাও মানে! কি লুকাচ্ছো বলো তো!”
সৌহার্দ্য প্রাণোচ্ছল হাসলো মেহরিন তখন মাত্র ফিরে এসেছে তাদের কাছে। সে বসতে বসতে জানতে চাইলো কি হলো! সুপ্রভা কপট রাগের সুরে বলল, “হারামি তোরা আমাকেই কাঁটার মত তুলে ফেলে দিয়ে গোপনে কত কি করছিস তাই না!”
মেহরিন অবাক হয়ে বলল, “কি বলছিস এসব?”
“রাখ তোর ঢং!”
“আসলে আমরা নিজেরাও এখনো ঠিকঠাক বুঝতে পারছি না আমাদের তাই তোমাকে এখনও কিছু বলা হয়নি প্রভা। মেহরিন অবশ্য বলেছিলো তোমার সাথে শেয়ার করবে আমিই বারণ করেছি। আমরা আসলে ইন আ রিলেশনে নই তবে মেহরিনের অনুভূতি তো আমি জেনেছি। তোমাকে ভালো লাগে আমার এ নিয়েই তো কত ঝামেলা করলাম। কিন্তু তুমি আমাকে কখনো সেরকমভাবে দেখোনি আর আমিও এখন চাই আমার জীবনে এমন কেউ আসুক যে আমাকে চাইবে। তাই…”
বলতে বলতে থেমে গেল সৌহার্দ্য। সুপ্রভা খেয়াল করলো সৌহার্দ্যের মুখের পরিবর্তন। তার মনে হলো মাস খানেক আগেও তার সাথে ঝামেলা বাঁধানো ছেলেটা এটা নয়। সে সত্যিই বোধহয় মেহরিনের অনুভূতির কদর করতে চাইছে কিন্তু তাই বলে কি জোর করে মনে ভালোবাসা তৈরি করতে পারবে! তাসিনের পরিবার যদি এখন জোর করে তাকে আয়নাকে বিয়ে করতে! সে কি করবে তারপর আয়নাকে ভালোও বাসবে একসময়! আহ্ এত অস্থির লাগছে কেন তার এ কথা ভাবতে? তাসিন তো কখনোই তাকে ভালোবাসি বলেনি৷ কখনোই বলেনি ভালো লাগার কথা তাহলে সে কেন এত আশা পুষে রাখছে মনে কিসের ভরসায়! ভালো লাগছে না কিছুই এখন আর। কেন এসব কথা ভাবছে সে এখন! মেজদা ফোন করে বলেছিলো আজ আয়নার বাড়ির মানুষ যাবে এহসান ভাইয়াদের বাড়িতে। তাদের পক্ষ থেকে পজেটিভ জবাব এলে শিগ্রই আকদ করবে বলেছে৷ যদি জবাব নেগেটিভ হয়! না না এসব ভাবনা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। তার এই ভাবনার মাঝে চাপা পড়ে গেল মেহরিন, সৌহার্দ্যকে নিয়ে আলাপ আর তাসিনকে নিয়ে সৌহার্দ্যের জানার আগ্রহ। সুপ্রভা বসা থেকে উঠে পড়লো। ব্যাগ কাঁধে সে হোস্টেলের দিকে রওনা দিলো। মেহরিনদের বলল শরীরটা খারাপ লাগছে। বাড়ি ফিরে সে তার ব্যাগ গোছাবে ভাবছিলো পরে মনে হলো তাসিনকে জিজ্ঞেস করুক বাড়ি যাবে কবে!
মাছুমা আজ সকাল থেকে ভালোমন্দ আয়োজনে লেগেই আছে৷ তার বড়ভাবী অনেক বছর পর এসেছে তার বাড়িতে। খুব সম্ভবত মাইশা দ্বিতীয় কি তৃতীয় জন্মদিন ছিলো তখন এসেছিলেন শেষবার এরপর আর আসেননি। ছোট ভাই আর ভাবীও তখন এসেছিলেন। ছোট ভাবী তখন নতুন বউ ছিলেন ননদের বাড়ি এসে কি যে নাক মুখ সিটকেছে পাকা দালান আর গাড়ি নেই বলে। তাসিন যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলো চট্টগ্রামে তখন সে শখ করে ড্রাইভিং শিখলো৷ মামাদের সবার নিজস্ব গাড়ি আছে তাই ভেবেছিল সে চাইলেই ব্যবহার করতে পারবে৷ ড্রাইভিং শেখার নতুন অবস্থায় একবার ছোট মামার গাড়ি নিলো চালাবে বলে আর প্রথম দিনই ছোট্ট একটা দূর্ঘটনায় গাড়ির লাইট আর বনেটে ক্ষতি হলো। মামী খুব করে সেদিন তাসিনকে কথা শোনালো কারণ গাড়িটা তার বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া৷ তাসিনের বাবার ক্ষমতা নেই গাড়ি কেনার আবার গাড়ির শখ থাকবে কেন তার! এ ধরনের অনেক কথা বলেছিলেন আর সবটা তার ছোট মামার ছেলেই ফোনে ফুপিকে বলে দিলো৷ আর যাইহোক তাসিন ভাই তাদের খুব প্রিয় মানুষ তাই নিজের মায়ের আচরণ একটুও না লুকিয়ে সবটা বলল ভিডিও কলে আর তা সবটাই দরজায় দাঁড়িয়ে শুনলো সরল- সহজ মানুষ আফছার মীর। তারপরই লোকটা কেমন প্রচণ্ড রাগলো জীবনে প্রথমবার এবং সেই প্রথমবারই ছেলেকে কষে দু থাপ্পড় মারলেন৷ এরপর জমিজমা বিক্রি, ব্যবসায়ের লাভের অংশ সব মিলিয়ে ছেলেকে গাড়ি কিনে দিলেন। এখনো জমিজমা অনেক আছে টাকাকড়ি আছে তবে কুব বেশি নয়। আরে জমিয়ে রাখছেন বাকি দুই সন্তানকেও তাদের প্রাপ্য দেবেন৷ আর আজ মাছুমার চোখ ছলছল করছে সেসব পুরনো কথা ভেবেই। কাজের ফাঁকে আঁচলে চোখ মুছে নিচ্ছেন৷ বড় ভাবীও বুঝতে পারছেন স্মৃতিচারণ করেই তার ননদ চোখের জলে গাল ভাসাচ্ছে৷ কিন্তু এখানে আসার উদ্দেশ্য এখনি খোলাসা করা দরকার। কালকের মধ্যেই আবার তিনি ফিরে যাবেন চট্টগ্রাম।
“কান্না শেষ হলে বোলো ননদিনী আমি কিছু কথা বলব এবং তা খুব সিরিয়াস বিষয়।”
মাছুমা চোখ মুছে ভাবীর দিকে তাকালো। হাতে তার চালের গুঁড়ো সন্ধ্যায় চিতুই পিঠা বানাবে ভেবে রেখেছে। গরুর মাংস কষিয়ে চিতুই পিঠা আর ছিটা পিঠা নামক পিঠা তৈরি করবে। কিন্তু আপাতত ভাবীর মুখের কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে তাকালো। তারও কাল সন্ধ্যায় ভাবীকে দেখতেই মনে হয়েছিলো কিছু একটা হয়েছে নইলে এভাবে হুট করে এখানে এলেন কেন? তিনি তো ভয়েই এদিকে আসতে চান না তারওপর এখন বাড়িতে নুর একা আছে। জামাই গত সপ্তাহেই বিদেশ গেল ব্যবসার সুবাদে। বোঝা গেল কথাটা সত্যই খুব সিরিয়াস তাই সে কাজ রেখে ভাবীর দিকে মনোযোগ দিলো, ” কি কথা ভাবী?”
“তুমি তাসিনকে জোরাজোরি কেন করছো বলোতো!”
মাছুমা প্রথমে বুঝলেন না তার ভাবীর কথার অর্থ। সে কি নিয়ে জোরাজোরি করলো! পরমুহূর্তেই মনে পড়লো এমন ভঙ্গিতে বলল, “ওহ এই কথা! মন্দ কি আছে এতে? নিজেদের মেয়ে নিজেরাই রাখবো। পরের চেয়ে আপন ভালো তাই না ভাবী! আর এমনিতেও বাড়ির বড় বউদের অনেক দ্বায়িত্ব থাকে আর তা পরের মেয়ে পালন নাও করতে পারে।”
মাছুমা কথা শেষ করতেই ভাবী বললেন, “আমি কি দ্বায়িত্বে খুব হেলা করেছি মাছুমা!”
মাছুমা লজ্জা পেল এ কথায়। বড় ভাবী তাদের প্রতি সকল দ্বায়িত্ব বড় নিষ্ঠার সাথেই পালন করে এসেছে সবসময়। কিন্তু সেও তো কথাটা বড় ভাবীর উদ্দেশ্যে বলেনি বরং বর্তমান সময়টা ভেবে বলেছে। ভাবী আবারও বললেন, “পর আপন পরের কথা আগে বলো তো মনের সাথে মনের মিল ছাড়া সংসারটা কেমন হয়!”
” প্রাণহীন।”
এক শব্দেই বলল মাছুমা। ভাবী বুঝতে পারলেন তাঁর কথাটা মাছুমার খুব করে লেগেছে কিন্তু এখন এই লাগাটাই কাজের।
“তুমি তাসিনের সাথে আয়নাকে জুড়ে দিতে চাইছো তার কারণ আয়না ঘরের মেয়ে। তোমার সংসারে ভাগ বাটোয়ারা হওয়ার ভয়টা কম থাকবে। কিন্তু একটাবারও ভাবছো না যে ছেলেটা আয়নাকে বোনের বাইরে অন্যকোন ভাবে ভাবতেই পারছে না সে বিয়ে করে সংসারটা কি করে করবে! বিয়ে পবিত্র জিনিস হয়তো দৈহিক টানে এক হবে তারপর তাদের অস্তিত্ব দুনিয়ায় এলে না চাইতেও দুজন বছরের পর বছর একসাথে কাটিয়ে দিবে। একসময় হয়তো মায়ার একটা বাঁধন কিংবা অভ্যাসের টান থাকবে। অথচ ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও থাকবে না তাদের মাঝে। স্বস্তির কখনো নিঃশ্বাস ফেলা হবে না তাদের।”
একটু আগের ছলছল চোখের মাছুমার এবার পুরো দুনিয়াই যেন ঘুরে গেল। এক মুহূর্তে তার নিঃশ্বাসটা বুকের ভেতর কোথাও আটকে রইলো। ভাবী কি তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার সারাটা জীবন দেখিয়ে দিলো। ভাবী যা যা বলল ঠিক তা তাই ঘটেছে তার জীবনে। আফছার তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে সে টের পায় অথচ সে নিজেই লোকটাকে ভালোবাসতে পারেনি। দেহের টানে তাদের অস্তিত্ব দুনিয়ায় এসেছে কিন্তু মনের টানে কখনো তারা পাশাপাশি বসে দুটো কথা বলেনি। ঝুম বৃষ্টির রাতে কিংবা পূর্ণিমার রাতে দুজনের আলিঙ্গন গভীর হয়েছে অথচ সে কখনো আফছারকে মন থেকে অনুভব করতে পারেনি৷ আবার আফছার যখন অসুস্থ হয় তখন সে কাতর হয়ে কত সেবা শুশ্রূষা করে তাও কিনা মায়া হয় বলে। বাড়ি ছেড়ে দু রাত বাপের বাড়ি থাকলে সে ছটফট করে শুধু মাত্র নিজের দ্বায়িত্ব গুলোতে অবহেলা মনে করে। অথচ সেই ছটফটানির মূল কারণ তার দ্বায়িত্ব পালন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলে। আজ ভাবীর কথাগুলো শুনে তার হঠাৎই খুব অপরাধবোধ হতে লাগলো। নিজের জীবন দিয়ে সবটা ভোগ করেও সে সন্তানের ওপর তার মতোই এক জীবন চাপাতে চাইছিলো! কান্নার বেগ বেড়ে গেল মাছুমার। ভাবী তার পাশেই পিঁড়ি পেতে বসেছিলো। তিনি একহাতে মাছুমাকে জড়িয়ে নিলেন।
“এখনো দেরি হয়নি মাছুমা। আয়নার বয়স কম আবেগে পাগলামি করছে একটা সময় পর এসব থাকবে না। আর যদিও থাকেও তা এখনকার মত থাকবে না। আয়নাকেও জোর করে কোথাও বিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। পাত্র দেখছো দেখো আজ নয়ত কাল অন্য কাউকে তার ভালো লাগবেই। এমন কাউকে তাদের জন্য সিলেক্ট করো যার কাছে যাকে ভালো লাগে। আমাদের তাসিন একজনকে পছন্দ করে মেয়েটিও তাকে পছন্দ করে কিন্তু মুখ ফুটে বলেনি কেউ কাউকে। ”
মাছুমা একেকবার একেকটা বিষ্ময়কর কথা শুনে অবাক হতেও ভুলে যাচ্ছে। সে কিছু বলতে চাইছে না এখন অথচ পেছন থেকে আফছার মীর বলে উঠলেন, “মাইয়ার পরিচয় আর ঠিকানা জোগাড় কইরা দ্যান ভাবী।”
চলবে
(ভুলগুলো ক্ষমা করবেন)