বকুলতলা
৩৬.
সুনসান, ঝিমানো পরিবেশ। হাসপাতালের লম্বা করিডোরটা শূণ্য, ফাঁকা। রাত কয়টা বাজছে? বারোটা? একটা? সাথে হাত ঘড়ি কিংবা মোবাইল, কিচ্ছু আনেনি তরী। আনার সময়টাও ছিল না। রফিক সাহেবের সকাল থেকেই প্রেশার লো ছিল। রাতের খাবার-দাবারের পর সেটা হুট করেই বেড়ে যায়। প্রণয় তখনো বাসায় ফিরেনি। কল করলেও শুধু রিং হচ্ছিল। ওপাশ থেকে কেউ ধরছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে আবদুল, তরী আর আয়েশা খাতুনই তাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। নূরী আসেনি। মেয়েটা একটু বেশিই অসুস্থ কি না!
পাস্টিকের চেয়ারগুলোর একটাতে হেলান দিয়ে বসে ছিল তরী। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে। এত ঘুম পাচ্ছে! কোনোমতে জোড় করে চোখের পাতা খুলে রেখেছে সে। হামি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। ঝাপসা দৃষ্টিতে হঠাৎ দেখলো, হন্তদন্ত পায়ে প্রণয় ছুটে আসছে। খুব ব্যস্ত ভাবে। পা জোরা তরীর সামনে থামিয়ে লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “বাবার কি অবস্থা? কোন কেবিনে?”
তরী ততক্ষণে সোজা হয়ে বসেছে। ঘুম উবে গেছে বহু আগে। উত্তরে আস্তে করে বললো, “মামা ঠিক আছেন। সামনের কেবিনে আছেন।”
প্রণয় একপলক তাকালো। স্থির চাহনি। মেয়েটাকে অনেকদিন পর দেখছে সে। আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছে বোধহয়। তবে মুখটা একটু মলিন, বিষণ্ণ। সে নজর ফিরিয়ে দ্রুত কেবিনের দিকে ছুটলো। তরী যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো তখন। লোকটার মুখোমুখি হলে ভীষণ অস্বস্তিরা কোত্থেকে যেন উড়ে এসে জেঁকে বসে। সম্পর্কটা স্বাভাবিক নেই বলেই হয়তো।
সময় গড়ালো। প্রণয় কেবিন থেকে বেরুলো অনেক্ষণ পর। আস্তে ধীর শরীরটাকে টেনে টেনে তরীর পাশে ধপ করে বসে পরলো। পরনে এখনো বাহিরের জামাকাপড়। হাসপাতাল থেকে হয়তো সরাসরি এখানে এসেছে।
—“কেমন আছো?”
সরব, প্রণয় আস্তে করে শুধালো। তরী প্রথমে ভেবে পেল না সে কি বলবে। প্রণয়ের সাথে কথা বলতেও তার এখন জড়তা কাজ করে। কিন্তু সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। সম্পর্কটায় এত বেশি জ’টিলতা আসলেই অসহ্যকর। এভাবে তো ভালো থাকা যায় না। লোকটার জন্য তার ভীষণ মায়া হয়। ইচ্ছে করে, কাউকে ধরে এনে প্রণয়ের সাথে প্রণয় ঘটিত কিছু করে দিতে। পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, তা যদি সম্ভব হতো!
তরী একটু সরে বসেছে। প্রণয় তাকিয়ে তাকিয়ে তরীর জড়তাটুকু, এই সরে বসা কাঁটার মতো গিলে নিলো। অথচ সেটা দেখতেই পেল না তরী। উত্তরে বললো, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
—“আছি।”
—“মামার কি জ্ঞান ফিরেছে? কথা বলেছেন?”
—“হ্যাঁ।”
—” কি বলেছেন মামা?”
প্রণয় এবার আড়নয়নে তাকালো। তরীকে একবার পরখ করে বললো, “কি বলবে? তোমাকে বিয়ে করতে জোড় করছিল।”
—“তো আপনি কি বললেন?”
প্রণয় কেমন একটা সুপ্ত নিশ্বাস ফেললো। অতি সন্তপর্ণে। তরীর টের পেল না একদমই। অকপটে বললো, “করবো না বলেছি।”
—“ভালো করেছেন।”
প্রণয় বুঝলো, মেয়েটা আসলেই নিষ্ঠুর। নিজের ওপর তার খুব হাসি পেল। হাসলোও ক্ষীণ। কিন্তু বেহায়ার মতো তার তবুও তরীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বেহায়াপনার প্রশ্রয় বাড়িয়ে বললো, “তুমি যাচ্ছো না কেন কেবিনে? বাবার সাথে দেখা করে আসো।”
তরী তখন শুকনো হাসলো,
—“মামী আমার এখানে থাকা পছন্দ করছেন না। আবদুল ভাইয়া আসলেই উনার সাথে বাসায় চলে যাবো। নূরী ভাবীও তো বাসায় একা।”
—“খুব ভালোবাসো মাহাদকে, তাই না?”
হুট করে এক অদ্ভুদ প্রশ্ন করে বসলো প্রণয়। প্রশ্নটা করার পরই বুঝলো, করাটা উচিত হয়নি। অথচ তরীর ঠোঁটের কোণে তখনো সূক্ষ্ণ হাসিটা লেগে আছে। সে ওভাবেই উত্তর দিলো, “আমি আগেও বলেছি, তাকে ভালোবাসি কি-না আমি বুঝতে পারছি না। হয়তো ভালোবাসি। নয়তো ভালোবাসতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু তাকে প্রচন্ড রকমের অনুভব করি আমি। তার ভেতরকার তাকে দেখতে পাই। সে আমাকে ভালোবাসি বলে বলে বিরক্ত করে বলেই কিন্তু নয়। মাহাদের চোখে আমাকে হারানোর ভয় দেখেছি। তার চেয়েও বড় কথা, সে আমাকে পুরোনো ভেঙ্গে পরা তরী থেকে নতুন তরী হতে সাহায্য করেছে। খুব বিরক্ত করেছে, ভীষণ আগলে রেখেছে, মন খারাপের সময় হাসিয়েছে। অথচ লোকটাই কিন্তু ভালো নেই! একটা কথা বলি প্রণয়? মনে কিছু নেবেন না। আপনি আমাকে কখনো বিশ্বাস করতে পারেননি। ভুল বুঝে কষ্ট দিয়েছেন। কিন্তু যত কিছু হয়ে যাক, মাহাদ আমাকে কখনো কষ্ট দেয়নি। আপনি বরাবরাই অধৈর্য। আমাকে আগে থেকে ভালোবাসলেও এখন পর্যন্ত ভালোবাসাটা ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারেননি। আমাকে বুঝতে দেননি। সেখানে মাহাদ পদে পদে আমাকে আগলে রেখে বুঝিয়েছে ও আমাকে কতটা চায়। এমন মানুষকে আমি বলেই হয়তো এতদিন লেগে যাচ্ছে ভালোবাসি শব্দটা উচ্চারণ করতে।”
তরী থামলো। লম্বা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বুঝিয়ে দিলো, সে নিজেকে আজকাল কতটা সুখী ভাবে।
এরপরের সময়টা কাটলো রয়েসয়ে। বাতাসের ঝাপটাগুলো বেড়ে চললো তীব্র থেকে তীব্র ভাবে। বৃষ্টি হবে নাকি? নাহ্। অনেক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরও বৃষ্টির দেখা মিললো না। বরং বাতাস কমে গিয়ে ভ্যাপসা গরম হয়ে উঠলো আশপাশ। হাসপাতালের নিজস্ব একটা গন্ধ চারিদিকে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। এরমাঝে কেবিন থেকে বের হয়ে আব্দুল তরীকে তাড়া লাগালো বাসায় যাবে বলে। তরী প্রণয়কে একটু দেখে নিলো তখন। মুচকি হেসে বললো, “আমি আসলেই আপনার প্রতি মায়া ছাড়া কখনো কিছু অনুভব করতে পারিনি। যে মায়া আপনার কাজে লাগবে না। কিন্তু আমি আপনাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। সেই শ্রদ্ধা থেকেই একটা অনুরোধ করবো, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। এতদিন আমার সাথে অভিমান করে যেভাবে ছিলেন? এখনো অভিমান করে সেভাবে থাকুন। কিন্তু মামার জন্য হলেও এমন চুপচাপ থাকবেন না প্লিজ। মামা আপনাকে অনেক ভালোবাসেন।”
তরী আব্দুলের সাথে চলে গেল। বিশাল করিডোরে একা, চুপচাপ বসে রইলো প্রণয়। চোখ বুজে অনুভব করলো, তার তেমন একটা কষ্ট হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? তরী তাকে নিয়ে একটু হলেও চিন্তা করে বলেই হয়তো।
–
বাঁধন বরাবরই শক্ত ধাঁচের মেয়ে। ডি’ভোর্স হওয়ার সময়টাতেও সে কাঁদেনি। বরং খুশি হয়েছে এমন একটা ব্যক্তি থেকে মুক্তি পেয়ে, যে তাকে কখনো ভালোই বাসেনি। ফোন করে শুধু তরীকে তার আনন্দের কথা বলে। কিন্তু তরী তো জানে, তার আপা ওই লোকটাকে অনেক ভালোবাসে। শুধু হাসলেই কি সেটা মন থেকে হাসা হয়? মাহাদও তো কথায় কথায় হাসে। কই? সে তো ভালো নেই।
তরী গ্রামে যাবে বলে ভাবছে। দুইতিন দিন সেখানে থেকে আসবে। বাঁধনও বলছিল। কিন্তু বরকত সাহেব রাজী ছিলেন না। কারণ অবশ্য একটাই। অর্ণব। অস’ভ্য ছেলেটার উৎপত্তি বেড়েছে। বাজারে সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেরায় সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে। শুনে তরী বলেছিল, “তাই বলে কি আমি তোমাদের সাথে দেখা করতে আসবো না? আমার গ্রামে যাবো না? ওই লোকটাকে ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকবো? তোমার মেয়ে আর আগের মতো নেই বাবা। রুখে দাঁড়ানোর শক্তি আছে। বাজে কিছু করতে চাইলে পিটি’য়ে ছাড়বো একদম।”
বরকত সাহেব ভালো করেই জানেন, বলা যত সহজ, করা কিন্তু অত সহজ না। কিন্তু তবুও তিনি মেয়েকে অত আটকালেন না। আসতে দিলেন। রফিক সাহেবও তরীর গ্রামে যাওয়া নিয়ে কিছু বলেননি। ওইবারের মতো প্রণয়কেও তাকে দিয়ে আসার কথা উচ্চারণ করেননি একবারও। নীরবে সম্মতি দিয়েছিলেন শুধু।
–
গ্রামে এসে তরীর দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু অর্ণবের ভয়ে বরকত সাহেব তাকে ঘর থেকে বেরুতে দিচ্ছিলেন না। বেশি হলে বাড়ির আশেপাশে একটু হাঁটতে যেতে পারতো সে। সেদিন বরকত সাহেবও বাসায় ছিলেন না। কি যেন কাজ পরেছে তার। বাঁধন ঘরে কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তিতির তখনো স্কুলে। তরীর একা একা ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। কত দিন নিজ গ্রাম ঘোরা হয় না! সেই কবে দেখেছিল তিতিরদের বিদ্যালয়ের পাশে একটা নতুন পার্ক বানানো হচ্ছে। এতদিনে হয়তো হয়েও গেছে। এদিকে আবার তিতিরের ছুটি হতেও বেশি দেড়ি নেই। ওড়না ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে তরী বেড়িয়ে পরলো ঘর থেকে। পার্ক দেখে নাহয় তিতিরকে নিয়ে আসবে। দু’বোন গল্প করতে করতে আশপাশ ঘুরবে।
কিন্তু মাঝপথেই অর্ণবকে টং দোকানে দেখতে পেল তরী। বড় বড় ছেলেদের নিয়ে তা’স খেলছে সে। মুখে কি উপচে পরা হাসি! তৎক্ষণাৎ তরীর পা থেমে গেল। যতই সাহস দেখাক সে, এই মানুষটার সামনে নিজেকে বোবা প্রাণী মনে হয় তার। একঝটকায় যেন অতীতের সব কিছু চোখে ভাসে। তরী আর সামনে এগোলো না। পেছন ফিরে চলে আসতেই নিচ্ছিলো, অর্ণব দেখে ফেললো। না ফিরেও অর্ণবের হইহই কলরব শুনতে পেলে তরী। সে চিৎকার করে ডাকছে,
—“এই মেয়ে, দাঁড়া! তোরে চেনা চেনা লাগতাছে কেন?”
কি অভিনয়! অর্ণব জানে তরী এসেছে। এটা যে তরী, এটাও বুঝেছে। তার ছেলেপেলে তো আছেই বলার জন্য!
তরী তবুও দাঁড়ালো না। দ্রুত পা চালিয়ে চলে যেতে চাইলো এখান থেকে। কিন্তু অর্ণবের পালা চাকরগুলো সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো। যেন কোনো কঠিন দেওয়াল! অর্ণব এলো ধীরেসুস্থে। তরীর চোখেচোখ রেখে কেমন বিশ্রী হাসলো। দাঁতগুলো হলদেটে। বাজে দেখাচ্ছে। নে”শা করার কারণে চোখদুটো লালচে হয়ে আছে। রোগা-পাতলা শরীর। খিকখিক করে হেসে বললো, “পাখি আমার তো দেখি সুন্দর হয়ে গেছে। শহুরে বাতাসে কি আমাকে ভুলে গেছ জানেমন?”
তরী ভয় পাচ্ছে। প্রচন্ড ভয়। তবুও চোখ-মুখ শক্ত করে বললো, “আমাকে যেতে দিন।”
—“এত সহজে? তোমাকে কতদিন কষ্ট দেই না! হাত যে নিশপিশ করছে জানেমন।”
আবারও খিকখিক করে হাসলো অর্ণব। তরী কিছু বলতেই নিচ্ছিলো, হঠাৎ এক পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল। মাহাদের কণ্ঠস্বর। তরীর চিনতে একটু ভুল হয়নি।
—“হাত নিশপিশ করলে কেটে ফেলুন ভাই। এমন হাত রাখতে নেই।”
আসলেই এটা মাহাদ। এইযে, সামনে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখশ্রী দারুণ কঠিন। তরী ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ চমকালো। বিমূঢ়, হতবুদ্ধি চাহনিটা ওভাবেই আটকে রইলো মাত্র। অথচ অর্ণব তবুও হাসছে। হিসহিসিয়ে বললো, “নতুন নাগর নাকি? তোমার তো দেখি অনেক সাহস বাড়ছে। ব্যাপার না। তোমার এই জেদটা আমার পছন্দ হয়েছে। ভা’ঙ্গতে মজা হবে কিন্তু। ছেলেটাকেও শ’ক্তপোক্ত মনে হচ্ছে। কিছু একটা না করলে তো আমার এ গ্রামের মাতব্বর হওয়াটাই বৃথা!”
মাহাদকে একবার দেখে অর্ণব চলে গেল। সে ভুলেও এসব জনসমাগমে কিছু করেনা। ছেলেটাকে পরে দেখা যাবে।
—“আপনি এখানে কিভাবে?”
তরীর উৎক’ণ্ঠা গলার স্বর।
মাহাদ তখনো অর্ণবের যাওয়া দেখছে। প্রশ্ন এড়িয়ে বললো, “এটাই কি অর্ণব?”
—“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমি তো দুইদিন পরই আসতাম, তাই না? তবুও কেন এলেন এখানে?”
মাহাদ এবার ঠান্ডা চাহনিতে তরীকে দেখে নিলো। মেয়েটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। লহু স্বরে বললো, “আসার প্লেন ছিল না। দাদী মা”রা গেছেন কাল রাতে। সেজন্যই এসেছিলাম।”
—“আমাকে জানান নি কেন?”
—“জানিয়ে কি হবে?”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মাহাদের দাদীর কথা শুনে খারাপ লাগলেও তার চিন্তা অন্যদিকে। এই বেপরোয়া ছেলেটাকে কোনোভাবেই এখানে থাকতে দেওয়া যাবে না। যদি অর্ণব কিছু করে ফেলে? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিঁজিয়ে বললো, “আপনি কখন যাবেন ঢাকা? আজকেই চলে যান, বিকালের বাসে।”
কথাটা মোটেও ভালো লাগলো না মাহাদের। ভ্রু কুঁচকে বললো, “তুমি কি ঐ ইঁন্দুরটাকে ভয় পাচ্ছো? আশ্চর্য!”
—“ওই লোক ইঁন্দুর দেখতে হলেও কাজকর্ম কিন্তু মোটেও ইঁন্দুরের মতো না! বুঝতে পারছেন না কেন?”
—“তোমার মনে হয় আমি ওই টিনি ইঁন্দুরকে এমনি এমনিই ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো?”
—“কি করবেন আপনি?”
আঁ’তকে উঠে বললো তরী। মাহাদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। তরীর মাথার ওড়নাটা আরেকটু টেনে বললো, “তুমি যা ভাবছো, তাই।”
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
বকুলতলা
৩৭.
মাহাদের স্পষ্ট মনে আছে, এই উঠোন জুড়েই সে ছোটবেলায় দৌঁড়ে বেড়াতো। তার পিছু পিছু ভাতের থালা নিয়ে ছুটতেন তার মা। রডের তৈরি গেটটার ঠিক ডান পাশের মাটির রান্নাঘরে মাকে সবসময় পাওয়া যেত। রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে ভীষণ পাজি মাহাদকে পাটিতে বসিয়ে পড়ালেখা করাতেন তিনি। মাঝে মাঝে সুতীর শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘর্মাক্ত ঘাড়, গলা, কপাল মুছতেন। আবার যখন মাহাদ পড়া বাদ দিয়ে দুষ্টুমীতে লেগে যেত, উঠে এসে শক্ত হাতের একদু’টো চড় দিয়ে অনায়াসে পিঠ জ্বালিয়ে দিতেন। সে কি ব্য’থা! ভাবলেই মাহাদের হাসি পায়। বাঁধাহীন ভাবে প্রাণখোলা হাসিটা জায়গা করে নেয় পুরো ঠোঁট জুড়ে। চওড়া, বিস্তর হাসি। অথচ এই হাসিতে কোনো উল্লাস নেই। আনন্দ নেই। চোখের পাতা কেঁপে উঠে শুধু। এই বুঝি একটুখানি জল বাম চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরলো! ইশ! তার মা যে এই উঠোনেই মৃ’ত্যু’যন্ত্র’ণায় কাতরেছে। ছটপট করেছে। সেই করুণ দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। হাঁসফাঁস করতে থাকা মন বি’ষি’য়ে উঠে। বুক ভারী হয় প্রবল বিতৃষ্ণায়। চারিদিকে এত ক’ষ্ট! যেন সেই ক’ষ্টের মাঝেই মায়ের বকুনি, খিলখিলানো হাসি স্পষ্ট শুনতে পারছে সে।
মাহাদ বেশি কিছু ভাবতে পারলো না। উদাস মনটায় হঠাৎ লাগাম টেনে নূপুর প্রশ্ন করলো, “কি হয়েছে ভাইয়া? কি ভাবছিস?”
মাহাদ সেকথার উত্তর দেয় না। সময় নেয় অল্পক্ষণ। মাটির রান্নাঘরটার দিকে একাধারে তাকিয়ে থেকে বলে, “মা এখানে সবসময় বসে থাকতো, জানিস? পাটি বিছিয়ে আমাকে পড়াতো, তোর সাথে খেলতো, রান্না করতো। তোর মনে আছে?”
—“মনে নেই ভাইয়া।”
আনমনেই উত্তর দিলো নূপুর। তবে তার সত্যিই মনে নেই। মাটির রান্নাঘরটাকে এখন আসলে আর রান্নাঘর বলা যায় না। বড়োজোর ভাঙ্গাচোরা একটা স্টোররুম বলা যেতে পারে। লাড়কি, কিছু মরিচিকায় ভরপুর পুরানো টিনের স্তুপ পরে আছে সেখানটায়। এ বাড়িটায় আগের মতো কিচ্ছু নেই। রশিদ সাহেব সব নতুন করে তৈরি করেছেন। একতলা বাড়িটা দু’তলা করেছেন। টাইলস করা মেঝে, এটাচ্ বাথরুম! মাহাদের কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয়, কোনো অচেনা পরিবেশে চলে এসেছে সে। যেখানে তার মায়ের হাতের স্পর্শ নেই। কোনো স্মৃতি নেই।
ভাইয়ের মন খারাপের কারণ নূপুর সহজেই বুঝলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ের হাতটা আলতো করে ধরলো সে। আস্তে করে শুধালো, “ভাত খাবি না? আমি নিজে আজকে রান্না করেছি। আয়।”
মাহাদ আস্তে করে জবাব দিলো তখন, “আসছি।”
রশিদ সাহেবকে দেখে মাহাদ মুচকি মুচকি হাসছে। কারণটা অদ্ভুত! মায়ের মৃ’ত্যুর একদিনেই তার হাল বেহাল হয়ে গেছে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরা জলকণা গুলো সেকেন্ডে সেকেন্ডে গাল ঘঁষে মুছছেন তিনি। কিন্তু অশ্রুরা যেন ফুরাতেই চাইছে না! ফ্যাকাশে, মলিন হয়ে আছে শ্যামলা মুখ। মাহাদ হাসতে হাসতেই বললো, “কেমন লাগছে আব্বা?”
প্রশ্ন শুনে ভীষণ চমকালেন রশিদ। গলায় ভাত আটকে খুকখুক করে কাশতে লাগলেন। মাহাদ বেশ শান্ত ভাবেই ভরাট পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। আবার বললো, “দাদী তো তাও স্বাভাবিক ভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে আব্বা। বয়স হয়েছে। একদিন না একদিন ম’রতোই। অথচ আমার মাকে তুমি মে’রে ফেলেছিলে। আমার সামনে। নূপুরের সামনে। এক মাকে সন্তানের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে আবার সেই মায়ের জন্যই কান্না করাটা বেমানান। কেমন বিশ্রী দেখায়। তুমি আর কেঁদো না তো!”
সত্যি সত্যি রশিদের কান্না থেমে গেল। ছেলের দিকে কিছুক্ষণ অসহায় নয়নে চেয়ে রইলেন তিনি। ভেতরকার আর্ত’নাদটা বের হওয়ার আগেই নূপুর বললো, “আব্বাকে আর এসব বলে কষ্ট দিস না ভাইয়া। আব্বা শুধরে গেছে। তার কাজের জন্য সে অনুতপ্ত।”
—“তার অনুতপ্ত হওয়া কি আমাদের কাছে আমাদের মাকে ফিরিয়ে আনবে?”
—“এটা কিভাবে সম্ভব?”
ভাত খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে বহু আগেই। প্লেটেই হাতটা ধুঁয়ে উঠে দাঁড়ালো মাহাদ। চলে যেতে যেতে বললো, “তাহলে আমার দ্বারাও ভালো ব্যবহার করা সম্ভব না। সরি।”
রশিদও আর ভাত খেতে পারলেন না। তার বুকটা খা খা করছে। অনেকদিন পর সাহানার জন্য দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ তুলে নূপুরের দিকে তাকালেন তিনি। বিবশ গলায় বললেন, “মাহাদ না কোন মাইয়ারে পছন্দ করে বললি? মাইয়ার নাম কি? বিয়ার প্রস্তাব পাঠাইলে কেমন অয়?”
নূপুর আধখাওয়া প্লেটগুলো একটার ওপর একটা রাখতে রাখতে বললো, “ভাইয়াকে না বলে আগেই কিচ্ছু করতে যাইও না। পরে হিতে বিপরীত হবে।”
–
সকাল থেকেই বরকত সাহেব খুশিখুশি আমেজ নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। বাজার থেকে কারণ ছাড়াই দু’প্যাকেট মিস্টিও এনেছেন তিনি। তরী প্রথমে বাবার এসব কান্ডে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। পরে জানতে পারে, অর্ণবকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সকালেই। আপাতত রিমান্ডে আছে সে। তরীর সাথে ডিভো’র্সের পর অর্ণব যে ভালো ছেলে হয়েছিল, তা কিন্তু নয়। চুপিসারে, আড়ালে আবডালে বিভিন্ন কু’নৈ’তিক কাজ করে গেছে। কয়েকটা মেয়ের জীবনও নষ্ট করেছে ধ’র্ষ’ণের মাধ্যমে। এতদিন ক্ষমতার জোড়ে অসহায় মানুষেরা কিছু করতে পারেনি। সয়ে গেছে শুধু। এবার পালা তাদের রুখে দাঁড়ানোর।
টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, সোশ্যালমিডিয়াসহ সব জায়গাতেই অর্ণবকে ধিক্কার জানিয়ে পোস্ট করা হচ্ছে অহরহ। তরী জানে, এসব মাহাদের করা। সে ছাড়া এসব করবেই বা কে? মনে মনে ভীষণ শান্তিতে সিক্ত হয়ে উঠলো তরী। যাক, সে যা ভেবেছিল অনতত তা হয়নি। মাহাদ মা’রপিট করেনি ভেবেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো বেশ কয়েকবার। কিন্তু তার এই স্বস্তি বেশিক্ষণ টিকলো না। বিকাল হতে না হতেই মাহাদের মেসেজ এলো,
—“তোমার বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার বাপ কি এখানের এই জঙ্গলগুলো পরিষ্কার করে না? এত মশা কেন? তাড়াতাড়ি আসো তো। কিছু নিয়েও এসো। ক্ষুধা লেগেছে।”
তরী ঠিক ঠিক তা-ই করলো। তখনো বিকাল হয়নি। ঘড়িতে তিনটা বেজে ত্রিশ মিনিট। চো’রের মতো গা ঢাকা দিয়ে তরী বরকত সাহেবের আনা কয়েকটা মিস্টি আর দুটো পরোটা প্লেটে করে নিয়ে নিলো। পেছনের দরজা দিয়ে বের হতেই দেখলো, মহাবিরক্ত মাহাদ সাহেব সবসময়ের মতো চোখ-মুখ কুঁচকে, বিরক্ত হয়েই দাঁড়িয়ে আছেন। নাক এমন ভাবে কুঁচকে রেখেছে যে, দেখতে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। তরী ধীর পায়ে আরেকটু কাছাকাছি হতেই খেয়াল করলো, মাহাদ ভালো নেই। তার কপাল জুড়ে সাদা ব্যান্ডেজ উঁকি দিচ্ছে। গালের একপাশ ফুলে আছে। ঠোঁটের কোণে র’ক্ত জমাট বাঁধা। তরী তার পায়ের গতি বাড়ালো। দ্রুত এগিয়ে আসতে আসতে মৃদু গলায় শুধালো, “আপনার এই অবস্থা কেন?”
হাতের ছোট ছোট লাল দাগগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে মাহাদ প্রবল অসন্তুষ্টি নিয়ে বললো, “জানো না কেন? তোমার বাবার গাফলতির জন্যই মশারা আজ আমাকে পেয়ে বসেছে। উফ!”
—“আমি মোটেও মশার কামড়ের কথা বলছি না। আপনার শরীরে এমন কাঁটাছেড়া কেন? কার সাথে মা’রপিট করে এসেছেন?”
মাহাদ যেন শুনলোই না। তরীর হাতের প্লেটের দিকে চেয়ে চেয়ে বললো, “কি এনেছো? আমার কিন্তু অনেক ক্ষুধা লেগেছে! আসো, খাইয়ে দেবে।”
তরী দমলো না। ক্ষীণ রাগী কণ্ঠে বললো,
—“আপনি আগে আমার কথার উত্তর দিন।”
মাহাদের একরোখা উত্তর, “এ গ্রামের মাতব্বরের সাথে হা-ডু-ডু খেলতে গিয়েছিলাম কাল রাতে। খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। সামান্য ব্যাপার।”
তরী ক্লান্ত শ্বাস ফেললো। মলিন নেত্রে মাহাদের কুঁচকানো মুখটা আরেকদফা দেখে নিয়ে বললো, “কি দারকার ছিল এসবের? পুলিশে তো দিয়েছেনই।”
—“পুলিশে দিয়েছি তো কি? মনের একটা শান্তি আছে না? ওকে মেরে যে কি শান্তি পেয়েছি! একেকটা ঘু’ষি দেওয়ার সময় বেয়াদ’বটা যেভাবে চেঁচা’চ্ছিল! উফ! আমার কানটা ধন্য হয়ে গেছে!”
আবার ত্যাড়া কথা! তরী ভীষণ হতাশ হলো। এ বিষয়ে আর একটাও কথা বললো না। ওড়নার ভেতর থেকে প্লেট বের করে বললো, “অর্ণব জেলে যাওয়ায় বাবা খুশি হয়ে মিস্টি এনেছেন। নিন। এগুলো খেয়ে জিভও ধন্য করুন।”
মাহাদ সাথে সাথে খুশি হয়ে কিছু বলতে নিচ্ছিলো। তরী থামিয়ে দিলো। ধমকের মতো করে বললো, “আগে খেয়ে শেষ করুন। তারপর কথা।”
—“কিন্তু আমি তো তোমার হাতে খাবো।”
—“এটা কি খাওয়ার পরিবেশ? আমি কিভাবে খাওয়াবো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?”
—“আমি সেটা বলেছি? একটু দূরেই গাড়ি পার্ক করা আছে। চলো।”
তরী অবাক হয়ে শুধালো, “গাড়ি কোথায় পেলেন?”
মাহাদ ততক্ষণে তরীর হাত নিজের হাতের ভাঁজে টেনে নিয়েছে। এদিক-ওদিক পরখ করে বললো, “ফ্রেন্ড থেকে ধার নিয়েছি। বলেছি, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরবো। সেও দিয়ে দিয়েছে।”
—“আপনি কি কখনো শুধরাবেন না?”
মাহাদ ঘাড় ঘুরিয়ে তরীর দিকে তাকালো তখন। ফিসফিসিয়ে বললো, “শোকর করো মেয়ে। আমার মতো প্রেমিকপুরুষ তুমি এই পৃথিবীতে আর পাবে না। তোমার উচিত পৃথিবীকে ধন্যবাদ জানানো।”
______________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা