হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব-৩৭+৩৮

0
576

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৭
নতুন ভোর সাথে রোদের লুকোচুরি। জানালার পর্দা সরে যাওয়া স্থান দিয়ে সূর্যিমামা তার কিরণ প্রবেশ করাচ্ছে। প্রিয়া চাদর পেঁচিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওর চোখে-মুখে রোদ এসে পরছে বলে চোখ-মুখ কুঁচকে নিচ্ছে। জারিফের ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ। সে এখন প্রিয়ার মুখশ্রী থেকে রোদকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। বালিশের পাশ থেকে হাতরে ফোন নিয়ে সময় দেখে। সকাল ছয়টা বাজে। প্রিয়া হালকা স্বরে ডাকলো উঠার জন্য। প্রিয়া নড়েচড়ে আবার ওপাশ হয়ে শুয়ে পরলে জারিফ হেসে প্রিয়াকে সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করলে প্রিয়া আচমকা উঠে বসে। গায়ের চাদর সরে যাচ্ছিল তা টেনে জড়িয়ে লজ্জা মুখ লুকিয়ে বসে রয়। জারিফ প্রিয়ার কান্ড দেখে নিঃশব্দে হাসে।

“উঠো। ফ্রেশ হয়ে নাও তারপর নাস্তা করে আমরা হিমছড়ি ঘুরে মহেশখালী যাব তো।”

প্রিয়া লাজুক কন্ঠে বলে,
“আরেকটু পর। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তারপর আমি যাব।”

“উঁহু। উঠো।”

আচমকা জারিফ প্রিয়াকে কোলে তুলে নিলে প্রিয়া হালকা স্বরে চিৎকার করে উঠে। জারিফ বাঁকা হেসে বলে,

“এখন আমরা দুজনে একসাথে ফ্রেশ হবো!”

প্রিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে হড়বড়িয়ে বলে,
“এই না! নামান আমাকে। আমিই আগে চট করে ফ্রেশ হয়ে আসছি। একটুও লেট করব না প্রমিস।”

“এখন তো শুনব না। সময় বাঁচাতে এই পদক্ষেপ তো নিতেই হবে।”

অতঃপর উনারা এক ঘণ্টা লাগিয়ে ফ্রেশ হলেন!

________

পিহু ঢাকা যাবার জন্য প্রচুর উৎসাহী। গতকাল রাতেই যা লাগবে গোঁছানো শেষ। পিহুর মায়ের মন কাঁদছে। একটা মাত্র মেয়ে তার। বিয়ের পাঁচ বছর পর আল্লাহ্ তাদের সন্তান আশা পূরণ করেছিলেন। বহু ডাক্তার দেখিয়েছিলেন তার জন্য। আশেপাশের মানুষজন অনেক কথা বলতেন কিন্তু তার মানসিক শান্তি ও সাপোর্টে ছিলেন তার স্বামী, বাবার বাড়ির মানুষজন ও শ্বশুর-শাশুড়ি। ছোটো জালও মাঝেমধ্যে বাহিরের মানুষের প্ররোচনায় পরোক্ষভাবে খোঁটা দিতেন। সব তিনি সহ্য করেছেন তার কাছের মানুষদের ভালোবাসায়। আজ সে স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখী। স্বামীর চাকরিসূত্রে খাগড়াছড়ি এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। শ্বশুর-শাশুড়ি গত হয়েছেন বছর পেরিয়েছে। তারা দুই ছেলের বাড়িতে ঘুরেফিরে থাকতেন।

পিহুর মা প্রান্তি বেগম ব্যালকনিতে স্বামীকে বসে থাকতে দেখে পাশে গিয়ে বসলেন।
“মেয়েকে যে অনুমতি দিলেন এখন কি থাকতে পারবেন?”

পিহুর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
“পারতে হবে প্রান্তি। বোর্ডে ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছি। যদি আবেদন গ্রাহ্য হয় তবে আমরাও যাব। ”

“কিন্তু মেয়ে যে একটা ছেলের জন্য ঢাকা যাচ্ছে, যদি সেই ছেলেটার মনে পিহুর জন্য কিছু না থাকে? মেয়ে আমার ভেঙে পরবে।”

“অতোকিছু জানিনা। এক-দুই মাস সে কেমন মনম*রা হয়ে থাকত। আমাদের মেয়ে নিজে সবকিছু আমাদের সাথে শেয়ার করেছে। যদি ছেলে ভালো না হয় তবে ওকে আমি বুঝাব। আমার কথা সে শুনবে আমি জানি।”

আজকে সকালের বাসে পিহুকে নিয়ে ওর বাবা ঢাকা যাবেন। পিহুর খালার বাড়িতে পৌঁছে দিবে। পিহুর একটা খালাতো বোন ও ভাই আছে। খালাতো বোন এবার এইচএসসি দিলো আর ভাইটা স্কুলে পড়ে।

_______
হিমছড়ির পাহাড়ের উপর উঠে ছবি তুলছে প্রিয়া। তার ক্যামেরাম্যান জারিফ। রৌদ্রস্নাত সকাল। ঝলমল করছে চারিপাশ। পাহাড়ের উপর থেকে সবকিছু সবুজ সবুজ লাগছে আর সমুদ্রটাকে আরও সুন্দর লাগছে। নিচের ঝর্ণাটার পানি কমে গেলেও পাহাড়ের উপর থেকে সুন্দর লাগছে। সকাল নয়টার কিছু সময় বেশি বাজে। জলদি ফিরে যেতে হবে। প্রিয়া আর জারিফ সেখানে বসে কচি ডাব খেলো তারপর আচার খেতে খেতে প্রিয়া পাহাড় থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,

“এখান থেকে পরে গেলে কী হবে?”

জারিফ কপাল কুঁচকে বলে,
“পরে গিয়ে দেখো কী হয়!”

“না থাক! আমার তো নিচে তাকাতেই ভয় করছে। হিমালয় পর্বত তো এর থেকেও অনেক উুঁচু। সেখানে উঠার সময় নিচে তাকালে তাহলে কেমন লাগবে! আ*ত্মা বেরিয়ে যাবে আমার।”

জারিফ রম্যস্বরে বলে,
“নেক্সট হা*নি*মুন তবে নেপালে যাই চলো। হিমালয় পর্বতমালার কাছে গিয়ে এড*ভেঞ্চা*র হা*নি*মুন ট্রিপ করে আসি।”

প্রিয়া হড়বড়িয়ে বলে,
“না না। নেপালে ঘুরতে যেতে পারি কিন্তু এড*ভেঞ্চা*রের দরকার নাই। আমার একটুস খানি হৃৎপিন্ড!”

জারিফ হাসলো তারপর ওরা পাহাড় থেকে নেমে গিয়ে ঝর্ণাতে একটু হাত-পা ভিজিয়ে সমুদ্রপাড়ে হেঁটে মহেশখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করলো। সেন্টমার্টিন ওরা আগামীকাল যাবে কারণ কক্সবাজার থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন যাওয়ার জাহাজ সকাল সাতটায়।
মহেশখালী যেতে বাঁকখালি নদীটাই বেশি পরে। শেষের দিকে সাগরের খানিকটা পরে তখনি কিছুটা বেশি ঢেউয়ের কবলে পরতে হয়। মহেশখালী যাওয়ার এই ভ্রমণটাই বেশি আকর্ষণীয়। সূর্যের প্রখর রোদে পানি নীল বর্ণের দেখায় তাছাড়া দূরের ম্যানগ্রোভ বনগুলোকে অনেক সুন্দর দেখায়। মহেশখালী পুরোটাই ম্যানগ্রোভ গাছগাছালিতে ভরপর। এই গাছগুলো মহেশখলী দ্বিপকে বড়ো ঢেউ ও ঝড় থেকে রক্ষা করে।

জারিফ প্রিয়াকে হাত ধরে স্পিডবোট থেকে নামায়। মহেশখালীর এই ব্রিজটা অনেক সুন্দর। ব্রিজে দাঁড়িয়ে বনের ভিতরে দেখা যায়। বনের মাঝে এই ব্রিজটা। ব্রিজের উপর অটো, সিএনজি দাঁড়ানো যাত্রী বহন করার জন্য। জারিফ প্রিয়ার মুগ্ধ দৃষ্টি বনের দিকে দেখে মুখ চেপে হেসে কানের কাছে ধীর স্বরে বলল,

“বনে যাবে?”

“ইশ যেতে ইচ্ছে করছে অনেক। কী সুন্দর লাগছে গাছগুলো।”

প্রিয়ার কন্ঠে উৎফুল্লতা। জারিফ প্রিয়ার হাত ধরে বলে,
“তবে চলো!”

প্রিয়া অবাক কন্ঠে বলে,
“আপনি কি আমাকে এই কাঁদার মধ্যে নামাবেন? না না। এই কাঁদাতে নামব না। যদি বোটে করে বা শুকনো পথে যাওয়া যায় তবে চলুন।”

“এমন করে যাওয়ার পথ আমার জানা নাই। গেলে এভাবেই। নাহলে এখানেই দাঁড়িয়ে দেখো।”

জারিফ দূরবীন দিয়ে দূরে দেখতে লাগল। এরপর ওরা একটা সিএনজি ভাড়া করে এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর বাহির থেকে দেখে আসলো। ভ্রমণের পথে মহেশখালীতেই দুপুরের খাবার সেরে নিয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে বিকেল হয়ে এলে ওরা বিকেলের আবহাওয়া উপভোগ করতে আবারও মহেশখালী ব্রিজে এসেছে। বিকেলে বাতাস থাকে প্রচুর। ঘোরাফেরা শেষে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। নামাজ পড়ে ও ফ্রেশ হয়ে সমুদ্রপাড়ে দুজন রাতের আকাশের নিচে হাত ধরে হাঁটছে। প্রিয়া ঝালমুড়ি খেতে খেতে হাঁটছে। প্রিয়া জিজ্ঞেস করে,

“আচ্ছা? ছুটি আর কতোদিন আছে?”

“ওরিয়েন্টেশন আর দুইদিন পর।”

“ওমা! আমরা কী তবে সেন্টমার্টিন একদিন থাকব? এটা ঠিক না। প্রবালদ্বীপে যাবো আর সেন্টমার্টিনে ঘুরব না?”

প্রিয়ার অভিমান মিশ্রিত কন্ঠস্বরে জারিফ প্রিয়াকে পেছোন থেকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে সমুদ্রপানে দৃষ্টি স্থীর রেখে বলে,

“কালকেই আমরা প্রবালদ্বীপ বাদে সব ঘুরে ফেলব তারপর পরশু প্রবালদ্বীপ দেখে দুপুর তিনটার জাহাজে কক্সবাজার ফিরে আসব। সেখান থেকে বাই এয়ার ঢাকা।”

প্রিয়া লজ্জা পেলেও অভিমানী কন্ঠস্বরে বলে,

“তাও। সেন্টমার্টিন নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘দারুচিনির দ্বীপ’ ও ‘রূপালী দ্বীপ’, মুভি ও বই পড়ে আমার আগ্রহ আরও বেড়েছে। কোন ছোটোবেলাতে বাবা নিয়ে গিয়েছিল ঠিক করে কিছু মনেও নাই। সেখানে তো হুমায়ূন আহমেদের বাড়িও আছে।”

প্রিয়ার অভিমান ভাঙাতে জারিফ বলে,
“তোমার চোখের তৃষ্ণা মেটানোর দায়িত্ব আমার মিসেস। সবকিছু তুমি উপভোগ করতে পারবে।”

প্রিয়া নিরব হাসলো। সারাদিন জার্নি করে ক্লান্ত তাই রেস্তোরাঁ থেকে রাতের খাবার খেয়ে ওরা জলদি হোটেলে ফিরে গিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। সকাল সাতটার জাহাজ তো ধরতে হবে।

__________

সারাদিন পর রাতে মোবাইলে নেট অন করে মেসেঞ্জারে যেতেই ভার্সিটি ও ফ্রেন্ডদের গ্রুপ মেসেজ সাথে আরও মেসেজ আসতে লাগলো। পিহুর আইডি থেকে মেসেজ দেখল প্রায় সাত-আটটার মতো। মেসেজের সারমর্ম হলো, পিহু ঢাকা আসছে। রওনা হওয়ার আগে ও পৌঁছানোর পর মেসেজ। সাথে কোন স্টপে এসেছে এসব মেসেজ। আবার মেসেজ সীন করছে না বলে মন খারাপের মেসেজ। আয়ান এসব দেখে হাসলো। আজকে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছিল সিরিজ দেখতে তারপর বিকেলে খেলতে যাওয়া, চায়ের আড্ডা। আয়ান পিহুকে লিখল,

“ওও। আমি সারাদিন নেটে ছিলাম না। সরি ফর লেট রিপ্লাই। জার্ণি করে এসেছ রেস্ট করো। ”

পিহু অনলাইনেই ছিল,
“আর কিছু বলবেন না? এটুকুই?”

“কী বলব? আমি এমনিতেও কম কথা বলি। পড়ালেখা, খেলাধুলা, মুভি, সিরিজ দেখেই সময় চলে যায়।”

আয়ানের মেসেজ দেখে পিহুর মন খারাপ হলো।
“আমি যে এতোদূর থেকে আসলাম?”

আয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“পড়াশোনা করো পিহু। ঢাকায় এসেছ বলে প্রতিদিন দেখা-সাক্ষাত হবে এমন না। এই শহরে পড়ালেখার প্রতিযোগিতা চলে। এতো প্রেশার যে তোমারও মনে হবে সময় কম। মাসে একবার তোমার আবদার পূরণ করতে পারি দেখা করার। এজন্যই তোমার ভাবা উচিত ছিল। অ্যাই অ্যাম সরি।”

পিহুর নয়নযুগল ভিজে উঠেছে। সংক্ষেপে লিখে,
“হুম। আচ্ছা বায়।”

বাচ্চামি তো সে করেছেই। আয়ানের প্রতি দুর্বল হয়ে এতোদূর চলে এসেছে। কতোকিছু ভেবে বসেছিল তার কাল্পনিক মন। কিছুক্ষণ নিরবে কেঁদে ফোনে দেখে আয়ানের একটা মেসেজ,

“টাইম ক্যান ফিক্স এভরিথিং। বি পেইশেন্ট।”

আয়ান মেসেজটা পাঠিয়ে নিউজফিড স্ক্রল করতে চলে গেছে। সে জানে পিহুর মন খারাপ এটাতে কিছুটা হলেও কমবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,
ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#নুুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৮(সমুদ্রবিলাশ)
সাগরের ঢেউয়ের সাথে মোকাবেলা করে জাহাজ এগিয়ে চলেছে সাথে গা*ঙচি*লেরা উড়ে উড়ে সঙ্গী হচ্ছে। জাহাজের যাত্রীরা বাদাম, বিস্কিট ওদের ছুঁ*ড়ে দিলে ওরা লুফে নিচ্ছে। জাহাজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রিয়া ওদের দিকে বাদাম ছুঁ*ড়ে দিচ্ছে ছবিও তুলছে। জার্নিটা এই পাখিগুলোর জন্য আরও আনন্দদায়ক হয়েছে।
সেন্টমার্টিন পৌঁছে ওরা দুপুরে খাবার খেয়ে আধ ঘণ্টার মতো বিশ্রাম শেষে সমুদ্রতটে যায়। নীল পানি ও নারিকেল গাছের জন্য পরিচিত এই সেন্টমার্টিন দ্বীপটি। এই দ্বীপটিকে নারিকেল জিজ্ঞিরাও বলে থাকে। প্রিয়া ও জারিফ দুজনে সাগরে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা নির্জন। প্রিয়া উৎসুকতার সাথে বলে,

“এখানে যদি আমাদের নিজস্ব একটা ঘর থাকত! ইশ! শান্ত সবকিছু। মন শান্ত হয়ে গেছে।”

জারিফ চুপ করে প্রিয়ার উৎসুকতা দেখছে। ভেজা বালুতে প্রিয়া নিজেদের নাম লিখছে। ঝিনুকও কুড়িয়েছে কিছু। জারিফ কিছু বুনোফুল এনে প্রিয়ার কানের পিঠে গুঁজে দেয় আর বলে,

“আমার প্রহর এখানে থমকে যাক! আমি মুগ্ধনয়ন ভরে তোমায় দেখি এই সাগরপাড়ের কন্যা রূপে।”

প্রিয়া চমৎকার হেসে তার অর্ধেক আঁকিবুঁকির দিকে দেখিয়ে বলে,
“সাগরতটে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেলাম।”

জারিফও প্রিয়ার পাশে বসে প্রিয়ার সাথে মিলিয়ে লাভ শেইপটা পূর্ণ করে। আগেই ডাব কিনে এনেছিল এখন তারা নারিকেল গাছের গোড়াতে বসে খাচ্ছে। সমুদ্রতটে বড়ো বড়ো নৌকা বাঁধা। সারা বিকেল ওদের তীরে হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের কাঠের বাড়িটাও দেখে এসেছে। কী শৌখিন করে বানানো। ছুটি কাটাতে একটা উপভোগ্য শান্তির জায়গা। সেন্টমার্টিন এতোটাই মনোরোম যে যদি কক্সবাজার ঘোরার আগে সেন্টমার্টিন আসা হয় তবে কক্সবাজার গিয়ে অতোটা নজরকারা লাগে না। নারিকেল গাছে বেষ্টিত ছোটো আকারের দ্বীপটিতে সাত হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে।

ছোটো দ্বীপটিতে সন্ধ্যা নামল। সেই সাথে আ*তঙ্কও। যারা দূরে ঘুরতে যান তাদেরকে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসতে বলা হয়। প্রিয়ারা এখন হোটেলের সামনে সমুদ্রপাড়ে আছে। বন*ফা*য়া*র জ্বা*লিয়ে বসা সাথে আরও কিছু দম্পতিও। তাদেরও হা*নিমু*ন! সবাই মিলে আনন্দ করতে করতে সময় চলে যায়। ওরা সবাই আগামীকাল একসাথে প্রবালদ্বীপ যাবে বলে প্ল্যানিং করে। রাতের খাবার শেষে হোটেলের সামনে গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে নারিকেল গাছগুলোর আড়ালে রাতের সাগর দেখছে। শান্ত প্রায়। জারিফ কফি হাতে প্রিয়াকে পেছোন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“নিন আপনার কফি।”

“থ্যাংকিউ সো মাচ।”

জারিফ বারান্দার ম্যাটে বসল সাথে প্রিয়াকেও বসালো।
“মাই প্লেজার। রাত কিন্তু অনেক হলো। এখানে রাত এগারোটা মানে গভীর রাত।”

প্রিয়া বিবশ হয়ে বাহিরের দিকে নজর রেখে কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,
“আজ নাহয় না ঘুমালাম। এখানে বসেই কা*টিয়ে দেই চলুন। ইচ্ছে ছিল সেন্টমার্টিন দ্বীপে সারারাত সাগরপাড়ে আপনার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকব। কিন্তু সতর্কতার জন্য হলো না।”

জারিফ প্রিয়ার মুখটা আঁজলা ভরে নিজের দুইহাতের মুঠোয় নিলো। বলল,

“রজণী তার আপন গতিতে যাক,
প্রহর শেষে নতুন ভোরে আমি তোমাকে চাই!”
_________তিথী

_________________

প্রবালদ্বীপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে টলার ছুটছে। মেয়েরা সবাই গানের কলি খেলছে আর ছেলেরা সেটা উপভোগ করছে। আধ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলো ওরা। টলার থেকে ছোটো নৌকা করে দ্বীপে যেতে হয় কারণ এখন জোয়ারের সময় পানি বেশি। প্রবালদ্বীপ স্বচ্ছ নীল পানির নিচে প্রবালগুলো বড্ড সুন্দর লাগে কিন্তু সাবধান! ধা*রালো সেই প্রবাল। বেকায়দায় পা পরলে কে*টে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জারিফ প্রিয়ার বিভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলছে। দুজনের কাপল ছবিও তোলা হয়েছে। প্রিয়া দুটো ছোটো সাদা প্রবাল পেয়েছে পানি থেকে। জারিফকে দেখিয়ে দেওয়ার পর জারিফ এনে দিয়েছে। দুজনের পরনে আকাশি রঙের ড্রেস। প্রিয়া পরেছে আকাশি কুর্তি সাথে সাদা টাইস ও ওড়না। জারিফ আকাশি শার্ট ও সাদা জিন্স। খোলাচুলে কানে ফুল গুঁজা প্রিয়াকে সমুদ্রকন্যাই মনে হচ্ছে।

সুন্দর সময়গুলা জলদি চলে যায়। প্রবালদ্বীপ থেকে ফিরে ওদের সেন্টমার্টিনকে বিদায় দেওয়ার সময়ও চলে এসেছে। প্রিয়ার মন খারাপ। মুখ ভাড় করে সে জাহাজে বসে আছে। জারিফ কিছু শুকনো খাবার এনে প্রিয়ার পাশে বসে বলে,

“এবার আক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছ। পরেরবার দ্বিগুন উৎসাহ পাবে। কিছু না কিছু আক্ষেপ জীবনে থাকতে হয়। আংশিক হলেও।”

“হুম। খুব মিস করব পুরো ট্যুরের সময়টাকে। আপনি খেয়াল করেছেন? আমি কিন্তু ছবি ও পোস্ট করা ছাড়া ফোন খুব একটা ব্যাবহার করিনি।”

জারিফ সন্দেহের সাথে বলে,
“তাই তো। তবে কি তুমি আরও ভুলোমনা হয়ে গেলে? এমনেতিই তোমাকে ফোন করে আমার অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো।”

প্রিয়া কপট রা*গ দেখিয়ে জারিফের বাহুতে মে**রে বলে,
“কথা কই থেকে কই নিয়ে গেলেন! সময়টা সুন্দর কেটেছে তাই ফোন ইউজের ফুসরত ছিল না। আর আপনি!…..”

জারিফ হেসে বলে,
“ওকে ওকে। খিদে পেলে খেও। ভাবীদের সাথে গল্প করো। আমি উপরে গেলাম।”

পরেরদিন,,
সকালে ঢাকা এসে পৌঁছে। প্রিয়াকে বাড়িতে দিয়ে জারিফ ওরিয়েন্টেশনের জন্য চলে যায় ভার্সিটিতে। এগারোটার দিকে শুরু হয়েছে। এদিকে প্রিয়া আজকে মেসেঞ্জার ইন্সটল করে তারপর ব্যাচ গ্রুপে কিছু মেয়ের প্রিয়া ও জারিফে নিয়ে বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা দেখে মন বি**ষিয়ে যায় তার। রেজাল্ট ভালো হওয়ার কারণ নাকি জারিফের দু*চো*খা নীতি! সাথে বিয়ের আগে খা*রাপ স*ম্পর্কের ই*ঙ্গিত! অবশ্য সেসবে প্রিয়ার বন্ধুরা চরম বি*রোধীতা করেছে কিন্তু কিছু মেয়ে সেগুলোকে খোঁ*চাতে বড্ড পছন্দ করে কী-না!

প্রিয়া দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদে অতঃপর মেসেঞ্জার ডিলেট করে তামান্না ভাবীর কাছে গিয়ে তুতুলকে নিয়ে বসে থাকে।

“ছোটোআম্মু, তোমার মন খারাপ?”

তুতুল বাচ্চাটার আধোবুলিতে প্রিয়া হালকা হাসে।
“না বাবা। টায়ার্ড তো ছোটোআম্মু তাই। তুমি নাকি আম্মুকে অনেক জ্বা*লিয়েছ?”

“একটুও না। সত্যি। আমি তো ভালো ছেলে।”

“হুম হুম।”

তামান্না কাপড় ভাজ করছিল আর ওদের কথা শুনছিল। সেও ভেবেছিল প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করবে তার আগে তার পা*ক*না ছেলেই করে ফেলেছে। তামান্না বলে,

“ওর কথা শুনো না একদম। চঞ্চল ছেলে আমাকে হাঁপিয়ে তুলেছে। তোমাকে এখন জ্বা*লাবে দেখো। কতোটা জার্নি করলে রেস্ট করো গিয়ে নাহয়। বিকেলে শাশুড়ি-বউয়েরা মিলে জম্পেশ আড্ডা হবে। মা একটু কাল তার বাবার বাড়ি গেছেন। বিকেলেই ফিরে আসবেন।”

“না সমস্যা নাই ভাবী। তুতুলের সাথে ভালোই লাগছে।”

তামান্না প্রিয়ার প্রত্যুত্তরে হেসে কাজে মনোযোগ দেয়।

__________
মুন্নিদের ড্রয়িংরুমে মুন্নির বাবা-মা, রাদিফ বসে আছে। রাদিফ নিজেই সাহস করে এসেছে। মুন্নিকে তার পছন্দ সেটাও জানিয়েছে। মুন্নির বাবা চুপ করে থাকায় ঘরের পরিবেশ গম্ভীর। মুন্নি অবশ্য বাড়িতে নেই। বান্ধুবীদের সাথে ঘুরতে গেছে। চলে আসবে। মুন্নির বাবা চশমা খুলে বলেন,

“দেখো রাদিফ, তুমি ভালো ছেলে আমি মানি কিন্তু আমার মেয়ের জীবনে যে ঝড়টা একবার বয়ে গেছে সেই ঝড়টা আমি দ্বিতীয়বার চাইনা। তাই তুমি নিজে আগে সিওর হও সব ব্যাপারে তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নিও। সময় নাও। ছেলে হিসেবে তোমাকে আমার খারাপ মনে হয় না। আমার মেয়ের সাথে সারাজীবন থাকতে পারবে কিনা সেটা ভেবে নাও। সে হয়তো তোমাকে মন থেকে মেনে নিতে পারবে না।”

রাদিফ লম্বাশ্বাস নিয়ে বিনয়ের সাথে বলে,
“আমি সব ভেবেই এসেছি। তার অতীত না জানলেও বর্তমানে আমি সন্তুষ্ট। আপনি রাজি থাকলে আমি আমার বাবা-মাকে আসতে বলব। মায়ের মুন্নিকে পছন্দ হয়েছে।”

“আমি মুন্নির থেকে জেনে নিই। জানাব তোমাকে।”

রাদিফের মন শান্ত হলো কিছুটা। মুন্নি মানা করবে বলে তার মনে হয় না। সে বিদায় নিয়ে চলে আসে।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,