কুঁড়েঘর পর্ব-১৩

0
607

#কুঁড়েঘর
#লেখিকা–মার্জিয়া রহমান হিমা
। পর্ব ১৩ ।

রিধিশা আর জোতি ক্যাম্পাসের ডেকোরেশন দেখতে থাকে ঘুরে ঘুরে। জোতি খুশি হয়ে বললো
” কি দারুণ সাজিয়েছে রে রিধি!”
জোতি হাতে থাকা ফুল নিয়ে বললো
” আমার কয়েক ছবি তুলে দে।” রিধিশা জোতিকে ছবি তুলে দিতে থাকে।

দূড় থেকে নিশাদ রিধিশাকেই দেখে যাচ্ছে। আর কোনোদিকে চোখ যাচ্ছে না তার। যেদিকেই তাকাচ্ছে ঘুরে ফিরে রিধিশার উপরই পরছে।
পাশ থেকে রেহান নিশাদকে ধাক্কা দিয়ে বললো
” কিরে ভাই তোর ভাবসাব ভালো ঠেকতেছে না আমার কাছে। বারবার ওইদিকে কই তাকাস? ওইদিকে তো জোতি আর রিধিশাকে দেখা যায়।”
নিশাদ চোখ সরিয়ে বললো
” আমি ওইদিকে তাকাবো কেনো। আমি তো ডেকোরেশন দেখি।” রেহান খুঁচিয়ে বললো
” হ্যা, দেখতেছি। কালকে থেকে তোর ডেকোরেশন দেখা আর শেষ হয় না।” নিশাদ রেহানের মুখ বন্ধ করতে সেখান থেকে চলে গেলো।
.
নবীন বরণের অনুষ্ঠান শুরু হয় কিছুক্ষণের মধ্যে।
একে একে সবাই চেয়ারে বসে পড়ে। জোতি দ্বিতীয় সারিতে এখনও খালি দেখেই রিধিশাকে নিয়ে বসে পড়লো। রেহান এসে জোতির পাশে বসে আর নিশাদ গিয়ে রিধিশার অপর পাশে বসে পড়ে। রিধিশা ভ্রু কুঁচকে একবার নিশাদের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামনের সারিতে প্রিন্সিপ্যাল স্যাররা সহ অনেক টিচার এসে বসছে একে একে তাই বলতে পারলো না কিছু।
.
সূর্য নিশাদকে বলে উঠলো
” নিশাদ তোমার পাগলা প্রেমিকা কোথায়?” নিশাদ গম্ভীর গলায় বললো
” পার্লারে গিয়েছিলো সাজতে।” নিশাদের কথায় সূর্যদের সবার হাসির রোল পড়লো। পাগলা প্রেমিকা শুনে রিধিশা বুঝতে পারলো মিলির কথার বলছে তাই চোখ মুখ শক্ত করে রাখে।

জোতিও ফিকফিক করে হেসে বলে উঠে
” বিয়ে বাড়িতে আসবে নাকি? পার্লারে সাজছে!”
সাদি হেসে বললো
” তাই মনে হয়। মিলি আজকে কেমন সাজ দিবে ওই জানে। হরর সাজ না দিলেই হয়।” সবাই হাসিমজা করতে থাকে।
কিন্তু নিশাদের দৃষ্টি রিধিশার দিকেই। রিধিশা এক মনে সামনে তাকিয়ে আছে রোবটের কতো মাঝে মধ্যে জোতির সাথে কথা বলছে। নিশাদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখছেও না।

তানিম পানি খেতে খেতে গেটের দিকে চোখ পড়তেই পানি নাকে মুখে উঠে কাশতে থাকে বেচারা। সাদি উঠে তানিমকে ধরে। সাদিরও গেটের দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠে
” নিশাদ! তোর ক্যাটরিনা কাইফ এসেছে।”
নিশাদ চমকে চোখ বড় বড় করে গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে মিলি এসেছে। মিলিকে দেখে সবাই হা করে দেখে যাচ্ছে তাকে।
স্লিভলেস ব্লাউজ, পাতলা একটা শাড়ি এমনভাবে পড়েছে যে শরীরে কাপড় আছে কিনা বোঝা মুশকিল।
.
নিশাদ দাঁতে দাঁত চেপে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। এসব সাজ তার কাছে অশ্লীলতার সাজ মনে হয়। মিলি এসেই সূর্যকে উঠিয়ে দেবে তাই সূর্য আগেই উঠে দাঁড়ায়। মিলি এসে নিশাদের পাশে বসে পড়ে গা ঘেঁষে। মিলি হেসে বললো
” নিশাদ আমাকে কেমন লাগছে?”
নিশাদ শুনেও না শোনার ভান করে পাশে রিধিশার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। মিলি আরেকবার জিজ্ঞেস করলো একই কথা। নিশাদ বিরক্ত লুকিয়ে বললো
” ভালো।”

মিলি মুখ কালো করে বললো
” শুধু ভালো? যানো আমি তোমার জন্য সেই সকাল থেকে পার্লারে বসে সেজে এসেছি। এখনও কিছু খাইনি আমি।”
রেহান বললো
” নিশাদের মাথাই তো খাচ্ছো, এটা খেয়ে পেট ভরছে না তোমার?” রেহানের কথা জোতি, রিধিশা শুনতে পেয়ে হেসে দেয়। নিশাদও শুনলো তবে রিয়েক্ট করলো না মিলির জন্য। মিলির কানে হালকা হাসির শব্দ আসতেই মিলি শান্তর পাশে তাকায়। রিধিশাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো।
.
রিধিশাকে উদ্দেশ্য করে বললো
” এই মেয়ে তুমি নিশাদের পাশে কি করছো?”
রিধিশা ভ্রু কুঁচকে একবার নিশাদের দিকে তাকিয়ে বললো
” কেনো দেখছেন না বসে আছি?”
রিধিশার খাপছাড়া কথা শুনে মিলি রেগে গেলো। রেগে বললো
” কোনো ম্যানারস নেই তোমার? সেইদিন এতো কিছু বলার পরও এখানে ছ্যাঁচড়ার মতো নিশাদের পাশেই বসে আছো?”
নিশাদ মিলিকে ধমকে বলে উঠে
” মিলি আর একটাও বাজে কথা বললে খারাপ হয়ে যাবে। তোমার সমস্যা কোথায় ও এখানে বসলে?”
নিশাদের ধমক শুনে অনেকেই তাকায় ওদের দিকে।
মিলি চুপ হয়ে যায়।

নিশাদ সেখান থেকে চলে যায় রেগে। মিলি রেগে রিধিশার হাত চেপে বাইরে নিয়ে আসে। জোতি, রেহানরাও মিলির পেছন পেছন আসলো। সূর্য ঝামেলা হবে বুঝতে পেরে নিশাদকে খুঁজতে যায়।
মিলি রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” তোমার মতো মেয়ে আমি একটাও দেখিনি। সেইদিন এতো কথা শোনানোর পরও আজকে নিশাদের পাশে বসে ছিলে, লজ্জা বলতে কিছু আছে? নাকি নিজের ছ্যাঁচড়ার পরিচয়টা সবাইকে দেখাতে চাও?”

রিধিশা রেগে বললো
” আমাকে ছ্যাঁচড়া বলার আগে একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমি কি অন্ধ নাকি? আপনি নিজেই তো ছ্যাঁচড়ার মতো নিশাদের গা ঘেঁষে ঘুরে বেড়ান। উনি তো আপনাকে দেখলেই চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কে ছ্যাঁচড়া আর কি তার পরিচয় সেটা দূড় থেকে দেখলেই বোঝা যায়। আর সেইদিন যেই কথা গুলো শুনিয়ে এসেছে সেগুলো তো আপনাকে শোনানো উচিত ছিলো। সপ্তাহে দুদিন পার্লারে সেজেই নিজেকে বিশ্ব সুন্দরী মনে করেন নাকি?”
রেহান, সাদি হা করে রিধিশার দিকে তাকিয়ে আছে। মিলির বাবার দাপটের কারণে কেউ ভয়ে কখনো মিলির সাথে এভাবে কথা বলেনি। সাদি বিড়বিড় করে বললো
” সাহস আছে মেয়েটার।” সূর্যও নিশাদকে নিয়ে এসে পরেছে।

মিলির রাগের মাত্রাও বেড়ে যায়।
” তুমি নিজেকে কি মনে করো? তুমি তো নিশাদের পায়ের নখেরও যোগ্য নও আবার বড় বড় কথা। আমি তো দুদিন পার্লারে সাজি আর তুমি নিজেকে দেখেছো? পাগলের মতো চলে এসেছো। আমি কি জানি না তোমার ব্যাপারে? দু একটা টিউশনি করিয়ে দিন চালাও আবার নিশাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াও। আমি নিশাদকে ভালোবাসি আর নিশাদও আমাকে ভালোবাসে। তোমার মতো মেয়েরা নিশাদের আশেপাশে আসার আগে দশবার ভাবে।”

মিলির কথা শুনে রিধিশা কষ্ট পেলো খুব কিন্তু কাঁদলো না। নিজেকে শক্ত রেখে বললো
” আমি টিউশনি করাই আর যাই করাই নিজের টাকা নিজে উপার্জন করে খাই। তোমার মতো দাপট নিয়ে ঘুরে বেড়াই না। নিজের আত্মসম্মান বজার রাখার চেষ্টা করি।” রিধিশা কাঁদতে কাঁদতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যায়।
নিশাদ এগিয়ে এসে মিলির হাত চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বললো
” তোমার এতো সাহস আসে কোথা থেকে? এতোদিন চুপচাপ তোমাকে সহ্য করেছি বলে কি মাথা কিনে নিয়েছো? কি ভাবো তোমার বাবার ভয়ের দাপটে তোমাকে বিয়েও করে নেবো আমি? আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গো না। নিশাদকে কেনার সামর্থ কারো নেই। আজকে কাজিটা ঠিক করোনি।”

নিশাদও বেরিয়ে যায় ক্যাম্পাস থেকে। মিলি পেছন থেকে নিশাদকে ডাকতে থাকে কিন্তু নিশাদ তো মিলির ডাক শোনার মানুষ নয়। জোতি মিলির সামনে এসে বললো
” আমার বান্ধবী পাগলের মতো সেজে এসেছে না?
রিধিশা তো কোথায় কিভাবে সেজে যেতে হয় জানে তুমি তো তাও জানো না। তুমি যে নিজে একটা হরর মুভির চরিত্র সেজে এসেছো জানো? টিচারদের মাঝে কিভাবে শালীনতা বজার করে চলতে হয় জানো না?” মিলি রেগে বললো
” এই মেয়ে একদম মুখ সামনে কথা বলবে। তোমাদের মতো মেয়েরা এসব সাজ কি বুঝবে? কখনো তো পার্লারে গিয়ে এভাবে সাজোনি।”
জোতি হেসে বললো
” নাহ পৃথিবীতে তুমি একাই পার্লারে গিয়ে সাজো আর সবাই তো মাটি দিয়ে মেকাপ করে। তোমার থেকে দ্বিগুণ স্টেন্ডার পার্লারে যাই আমরা। এসব ভূত সাজতে যেই সেই পার্লারে যাই না।”
রেহান আর সাদি জোতিকে টেনে নিয়ে গেলো স্টেজের কাছে। মিলি এতো অপমান হওয়ার পর দিশেহারা হয়ে গিয়েছে, কি করবে বুঝতে পারছে না।

রিধিশা লেকের পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে আর চোখ মুচছে বারবার।
নিশাদ রিধিশার পেছন পেছন চলে এসেছে। রিধিশাকে কাঁদতে দেখে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। কিভাবে কথা বলবে? তার জন্যই তো এতো অপমানিত হয়েছে।
নিশাদ অনেক সময় নিয়ে রিধিশার পাশে গিয়ে বসে পড়লো। রিধিশা নিশাদকে দেখে চোখ মুছে নেয়। নিশাদ রিধিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” সরি। আমার জন্য তোমাকে আবারও মিলির কাছে অপমানিত হতে হয়েছে।”

রিধিশার হিচকি উঠছে কান্না কারণে। নিশাদের কথা শুনে আবারও কেঁদে দিলাও রিধিশা। নিশাদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। রিধিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে
” আপনার জন্যই তো। আপনি বারবার কেনো আসেন আমার কাছে? আমি আপনাকে বলেছিনা আমার থেকে দূড়ে থাকবেন?”
নিশাদ অনুতপ্ত স্বরে বললো
” সব কিছুর জন্য দুঃখিত আমি। তবে মিলি আর আমার মধ্যে সত্যি কিছু নেই। তুমি আজকে যেভাবে মিলির কথায় প্রতিবাদ করেছো আমার খুব ভালো লেগেছে।”
রিধিশা নাক টেনে বললো
” আপনার ভালো লাগার জন্য আমি করিনি। এটা আমার অভ্যাস তাই করেছি।” নিশাদ আলতো হেসে মাথা নাড়ায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
” মিলির আর কোনো কথায়ও কিন্তু কষ্ট পেয়ো না। তো..তোমাকে আজকে সত্যি সুন্দর লাগছে।”

রিধিশা নিশাদের দিকে অবাক চোখে তাকালো। নিশাদ ঢোক গিললো রিধিশার তাকানো দেখে। রিধিশা হুট করে বাচ্চাদের মতো কাঁদোকাঁদো গলায় আহ্লাদী হয়ে বললো
” সত্যি বলছেন নাকি আমার কান্না থামানোর জন্য বলছেন?” নিশাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাথা নেড়ে বললো
” একদম না। তিন সত্যি বলছি।” রিধিশা মুচকি হেসে চোখ মুছে নিলো। নিশাদ রিধিশার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো
” তোমাদের যেই ফুল দেওয়া হয়েছিলো যেটা কোথায়?” রিধিশা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে পাশে তাকায় সেখানেও না দেঝে পার্সের ভেতর খুঁজে দেখে বললো
” আসার সময় চেয়ারে রেখে এসেছিলাম হয়তো।”
নিশাদ রাগি চোখে রিধিশার দিকে তাকিয়ে উঠে গেলো।

রিধিশা পাত্তা দিলো না নিশাদের রাগকে। নিশাদকে কাঠ গোলাপের গাছের কাছে যেতে দেখে। রিধিশা কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছটার দিকে তাজালো। ওমা আজকে এটাতে ফুল নেই একটাও। যাও আছে গত রাতের হয়তো যেগুলো মাটিতে পড়ে পায়ের পা’রা খেয়ে ভরতা হয়ে আছে।
নিশাদ ফুল হাতে এগিয়ে আসে। রিধিশার কানে ফুল লাগিয়ে দিতে চাইলে রিধিশা মাথা পিছিয়ে নেয়।
নিশাদ মুখ ফুলিয়ে রিধিশার কান টেনে এগিয়ে আনলো।
কানের পিঠে কাঠগোলাপ লাগিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো
” এবার আরো সুন্দর লাগছে একদম ফুলের মতো। কিছু ফুলের সৌন্দর্য আগলে রাখা যায় তবে অনুভব করা যায় না কিন্তু তুমি ফুলের সৌন্দর্য আগলে রাখা আর অনুভব করা দুটোই যাবে।” রিধিশা মাথা নিচু করে হাসলো।

চলবে…….