একদিন নববর্ষা পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
172

একদিন নববর্ষা -৩০
অদ্রিজা আশয়ারী
____________

দিনের প্রথম প্রহর। সমুদ্রের আকাশে ঝকঝকে নীল রোদ। নারকেল গাছের পাতায় পাতায় মাখানো ঝিকিমিকি রোদ্দুরের প্রলেপ। আজকের আবহাওয়া মনোরম সুন্দর। সামুদ্রি ঝড়ের মাতাল বৃষ্টি টা ধরে গেছিল শেষ রাত্তিরে। আকাশের কোনো পার্শ্বে তারপর আর ধূসর মেঘেদের দেখা পাওয়া যায়নি।

প্রভাতের প্রথম রোদ্দুরে গা ভাসিয়ে বর্ষা আনমনে বসে রয় ভিলার সম্মুখের পুলের পার্শ্বে। ওর মনে ভাবনা’রা অসম্বদ্ধ হয়ে ফিরে আসতে থাকে।

বর্ষা অনুভব করে, ওর জড় জীবনটা সমুদ্রে এসে অনেকখানি নড়েচড়ে উঠেছে। অচঞ্চল জীবনে জোয়ার কিংবা ভাটা যাহোক কিছু একটা গতিময়তা এসেছে। এখানে এসেই ওর বর্তমান জীবনের চরম এক সত্যের মুখোমুখি হয়েছে সে। কেন আর পাঁচটা সাধারণ মানব মানবীর মতো নয় ওদের বিবাহিত জীবন তার কারণ টা আজ পরিষ্কার।

সহসা কাল রাত্রির কথা স্মরণ হয় বর্ষার । তখনি, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষানিক ভীত হয় সে। ওর জেদ যে অমন হালভাঙা জাহাজের ন্যায় দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে পারে, কাল রাত্রির ব্যাপার টা আপতিত না হলে সেকথা কখনোই জানা হতো না ওর!

পুলের কুসুমিত জলে হাত ডোবায় বর্ষা। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে ওর মন! ছোট বেলা থেকেই নিজের ব্যাপারে একটা বিষয় বরাবর খেয়াল করেছে সে। এবং সেই সঙ্গে ক্ষানিক ভীতিও এসে ভর করেছিল মনে। সেই ছেলে বেলা থেকেই, কখনো ওর রাগ হলে, জেদের বসে নিজের ক্ষতি করতে চাইত সে। খুব সাংঘা’তিক বাজে কিছু ঘটাতে মন চাইত। তবে অসংহত জেদটাকে সংবরণ করেই এসেছিল এতকাল। কখনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। কখনো আপন রাগের উষ্মায় ভস্ম করেনি অন্যকে। কিন্তু কাল যে কি হলো! কেন এমন বেসামাল হয়ে পড়ল ওর অমর্ষিত মস্তিষ্ক টা! ভাবতে গিয়ে চোখের কোণে জল জমে বর্ষার। কালকের আগে কখনো তো ওর মন এত ভয়ানক ভাবে আহতও হয়নি! তাই বুঝি, অধোগামী আঘা’তের প্রথম তীরটা বুকে বিঁ’ধতেই অত লাগামছাড়া হয়ে পড়েছিল ওর ক্রোধটা গতকাল!

এই রাগের বশবর্তী হয়েই কাল কিছু কঠিন কথা শুনিয়েছে সে নাব্যকে। অথচ এমন ক্রোধ আর বিষাক্ত বাক্যবাণ তো বর্ষার আদত চরিত্র নয়। ওর দ্বীন তো কখনো ওকে এমন শিক্ষা দেয় নি। ভুল করে যে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয়, তার জন্য তো নিশ্ছিদ্র ক্ষমার চাদর বিছিয়ে দিতে হয়। তাসত্ত্বেও বর্ষা কি অসঙ্গত বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেসময়! সন্দেহ নেই ভীষণ স্ববিরোধী কাজ করেছে সে। ভেবে নিজের কাছেই ভারি লজ্জিত আর অনুতপ্ত হয় বর্ষা। রাত্রিতে, ঝড়ের মুখে বেরিয়ে যাবার আগে নাব্যর করা আ’ঘাত টাকে তখন অল্পই মনে হয় নিজের অসংযত আচরণের তুলনায়।

হয়তো নাব্য সত্যি ছিল! ভালোবেসে ঠকেছে তো সে নিজেও। সেও নিশ্চয়ই তখন কম কষ্ট পায়নি! কিন্তু ওর ভালোবাসার পদ্ধতিতেই যে মস্ত ভুল ছিল। ভালোবাসা আদায়ের ভ্রান্ত পথ বেছে নিয়েছিল সে। তাই হয়তো শেষ পর্যন্ত ভালোবাসাটা আর অন্তিম গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে নি। মাঝ রাস্তায় ওকে ছেড়ে গেছিল। সেজন্য কি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া গুজার করা উচিত বর্ষার? বুঝেও যেন ঠিক বোঝে না সে। আজ যদি নাব্যর প্রথম প্রেম স্বার্থক হতো তবে কোনো কালহরণেই নাব্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো না ওর। নাব্যকে সে পেতো না অর্ধাঙ্গ রূপে। নাব্য ঠকেছিল, হেরেছিল ভালোবাসার কাছে। তাই তো আজ তার স্ত্রী পুরনো বর্ষা নয়। হয়েছে সে নিজে!

অনুচ্চারিত স্বরে বর্ষা নিজেকেই শুধায়। আপন কর্মের জন্য নাব্য সত্যিই অনুতপ্ত তো? নাকি বর্ষার ক্রো’ধানল কে তৎসময়ের জন্য মাটিচা’পা দেবার অভিপ্রায়েই রাত্তিরে অমন গলে জল হয়ে গেছিল সে? যদি সত্যিই সবটা নাব্যর অভিনয় হয়ে থাকে? ওকে ক্ষণিকের বুঝ দেবার জন্যই, নাব্যর একটা চতুর চাল হয়ে থাকে মাত্র! তখন বর্ষা কি করবে! কিভাবে আরও একবার, আ’ঘাতের কালো ঢেউ এলে, সামলাবে সে নিজেকে?

কাল রাত্তিরে কোনো এক সময়, মুহুর্তের জন্য ওর সত্যিই মনে হয়েছিল নাব্য ওকে ভালবাসতে আরম্ভ করেছে। খুব শীগ্রই হয়তো মন আর মস্তিষ্ক থেকে পুরনো বর্ষার স্মৃতি উগড়ে ফেলে, সেই স্থানে ওকে ঠাই দেবে নাব্য। অথচ এখন, এই দিনের আলোয় সেই সময়ের চিন্তাটা ওর নিজের কাছেই কেমন হাস্যকর ঠেকছে!

কাল রাত্রির প্রথম প্রহরে, খামের ভাঁজে সন্ধান পাওয়া সেই মেয়েটির মুখ আচমকা ভেসে ওঠে বর্ষার মানসপটে। নিসন্দেহে মেয়েটি সুন্দরী! ক্ষুরধার আভিজাত্যের ছোঁয়া মেয়েটির মুখের প্রতিটি ভাঁজে। সেই মেয়েটিকেই তো এককালে ভালোবেসেছিল নাব্য! নাব্যর অস্তিত্ব থেকে এখনো হারিয়ে যায়নি সেই অমীমাংসিত ভালোবাসার রেশ। নাব্যর সবটা জুড়ে এখনো ওই মেয়েটির স্মৃতিগন্ধ উর্ণাজালের মতো ছেঁয়ে আছে।

নাব্যকে পেতে হলে কি তবে ওই মেয়েটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে বর্ষার? কিন্তু তাহলে তো শুরুতেই গো-হারান হেরে বসে আছে সে! নাব্যর প্রাত্তন প্রেমিকা, বর্ষা নামের সেই মেয়েটির সঙ্গে এই নবীনতম বর্ষার তুলনাই যে দেয়া চলে না কখনো! সেই মেয়ের রূপ অগ্নিশিখার মতো অনুক্ষণ জ্বলজ্বলে।
অথচ ছলাকলা হীন, প্রাচীনপন্থী এই বর্ষার রূপে সে আগুন ধরানো তেজ নেই! নেই কোনো ঐকান্তিক আভার বিশেষণ!

বর্ষা প্রবল একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছুড়ে ফেলে পুলের শান্ত সলিলে। এই ভেবে যে, এখনো দিবাস্বপ্ন বিভোর হয়ে আছে সে। আদতে ওর কোনো যোগ্যতাই নেই নাব্যর পাশে দাঁড়ানোর। নাব্য চাইলেই ওকে মুহুর্তে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলতে পারে। কিছুই করার থাকবে না ওর। নিজের সামান্যতম পারকতা নিয়ে কোন প্রাবল্যের বলে ল’ড়বে সে নাব্যর সঙ্গে? নাব্য যদি এখন ওকে অস্বীকার করে তাহলে নিরবে পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকবে কি বর্ষার? ভেবে সঙ্গে সঙ্গে মনের আনাচে-কানাচে বিষাদ রঙের মেঘেতে ছেঁয়ে যায় বর্ষার।
বর্ষা আবারও ভাবতে চেষ্টা করে , এই অকরুণ জড়ভূমে কেন এতো অসহায় সে? কেন এত বিশেষ ভাবে নিঃসঙ্গ ওর গোটা জীবন?
সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য কণ্ঠে উত্তর আসে, ‘ জীবন তরীতে যে যত বেশি একা, রব হয় তারই তত বেশি আপন।’
অজান্তেই বর্ষার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে টুপটাপ।

পেছনে দরজায় তখনি একবার খট করে শব্দ ওঠে। দু’হাতে দুকাপ গরম ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ফিরে আসে নাব্য। সে বেশ ভালো কফি বানায়।
বর্ষার মতো পুলের পাশে না বসে, পেছনে রোদ্দুরে পাতা সানবেডে বসে সে। বর্ষা পূর্বেকার ন্যায় স্তিমিত হয়ে বসে রয়। ওর অমন নিস্পন্দ আচরণ আড়চোখে লক্ষ্য করে নাব্য জিজ্ঞেস করে,
–‘ কি হয়েছে? পায়ের ব্যাথাটা কি ফের বেড়েছে? কই দেখি।’ বলে সে বর্ষার ব্যা’ন্ডেজ বাঁধা পায়ের দিকে তাকায়।
নাব্যর দিকে পেছন ফিরে বসায়, বর্ষার মুখখানা অগোচরেই রয়ে যায় ওর। উত্তর না দিয়ে, চোখের অবাধ্য জল বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা সন্তর্পণে মুছে ফেলে বর্ষা স্রেফ মাথা নাড়ে দুপাশে।

-‘ এদিকে উঠে এসো। কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো!’

দ্বিতীয় বার নাব্যর গলার স্বর কর্ণগোচর হতেই বর্ষার মনে হয় এই স্বর রাতের সেই সহজ, আড়ম্বরপূর্ণ স্বর নয়। এর কোথায় যেন একটা অনুষ্ণ ভাব বিরাজমান। বর্ষা বোঝে, অকারণে কাঁদছে সে। এই চোখের জলের কোনো মূল্য নেই ওর বিশিষ্ট লেখক স্বামী নাব্য ইমতিহানের কাছে!

পুলের পার্শ্ব ছেড়ে উঠে নাব্যর পাশাপাশি সানবেডে গিয়ে সে বসে। কফিতে চুমুক দিয়ে, ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ভ্রুকুটি করে হঠাৎ শুধায় নাব্য,
-‘ কাঁদছিলে কেন? ফের কি হলো? ‘
বর্ষার উত্তর দিতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে নাব্য সহসা ওর হাত ধরে। সেই স্পর্শ রিরংসার নাকি ভালোবাসার ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বর্ষা। চোখের কার্নিশে ফের জল জমতে শুরু করেছে। এবার নিজের ওপরই বিরক্তি আসে ওর। কোনো কালে এমন ছিঁচকাদুনে মেয়ে তো সে ছিলনা! অথচ আজকাল কথায় কথায় এত কান্না পায়..

-‘সত্যিই বলবে নাকি….’

বর্ষা বোঝে আর লুকোনোর পথ খোলা নেই। কান্নায় বসে যাওয়া গলায় বলে,
-‘ কাল রাতের বাজে ব্যাবহারের জন্য আমি দুঃখীত। আমাকে ক্ষমা করুন। ‘

-‘ এটুকুই! এই সামান্য ব্যাপারের জন্য কাঁদছিলে?
তাহলে আমিও ভীষণ দুঃখীত। ক্ষমাপ্রার্থী তোমার গালে দীর্ঘস্থায়ী এই পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ বসানোর জন্য।
অ্যাই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি!’
বলে কফির কাপ নামিয়ে রেখে বর্ষাকে হঠাৎ আলিঙ্গনবদ্ধ করে নাব্য। ফেনীল জলরাশীতে দৃষ্টি স্থির রেখে চাপা স্বরে বলে,
-‘আজ সমুদ্র ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমরা। বিকেলের ফ্লাইটেই।’
চলবে……..
বারাকাল্লাহু ফিক🌻

একদিন নববর্ষা -৩১
অদ্রিজা আশয়ারী
_____________
কখনো কখনো সবটা অলীক মনে হয় বর্ষার কাছে। এইযে হঠাৎ জাগ্রত হওয়া নাব্যর এই প্রেমান্ধতা। কবোষ্ণ আচরণ ওর প্রতি। এসব যেন সত্যি নয়। তাই অনুরাগের আসঞ্জনে প্রতিবার আরও বেশি ভীত হয় বর্ষা। এক অপরিচিত বিরাগের সুর আতঙ্কের রূপ নিয়ে অনুক্ষণ ওর মনে খচখচ করতে থাকে। নাব্যকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে ওর ভয় হয়! অথচ নাব্যর আচরণ এমন যে, একে মেকি ভাবতেও বর্ষার বাঁধে। এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বেড়াজালে আটকে অহোরাত্র গোপনে জ্ব’লেপুড়ে খাক হয় আজকাল ওর দ্বিধাগ্রস্ত মন।

কালরাতে ওরা ফিরেছে কক্সবাজার থেকে। পড়াশোনায় নিতিন ব্যাস্ত ছিল বলে রাতে বর্ষার সঙ্গে দেখা হয়নি ওর। সকালে দাদির ঘরে প্রথম দেখা হলো। বর্ষাকে দেখেই নিতিন দৌড়ে কাছে এসে একটা অভাবনীয় কান্ড করল। পালঙ্কে দাদির মুখোমুখি বসে থাকা বর্ষাকে অতর্কিতে জড়িয়ে ধরে সশব্দে চুমু খেল। নিতিনের মন বোঝা দায়। কিছুকাল আগে পর্যন্ত বর্ষাকে নিজের দাভাইয়ের স্ত্রী হিসেবে মানতেই নারাজ ছিল। অথচ বর্ষার অনুপস্থিতিতে এ-কদিন রীতিমতো হাসফাস করেছে সে । বলতে নেই, সেই প্রথম দেখাতেই বর্ষাকে ভালো লেগে গেছিল ওর। অনেকটা আপন মানুষ মনে হয়েছিল শুরুতেই।

নিতিন তিড়িংতিড়িং থামিয়ে ধপ করে বর্ষার পাশে বসে পড়ল। রিনরিনে স্বরে কথার ঝংকার তুলে বলল ,
–” উফফ ভাবি! অবশেষে তুমি ফিরলে। এই কদিন ভীষণ ভীষণ মিস করেছি তোমায় আমি। এক বাক্স কথা জমিয়েছি তোমাকে বলার জন্য।
দাদি, তুমি থাকো। আমি নিয়ে চললাম তোমার নাতবউ কে। বায় বায়….
এসো ভাবি। আমার ঘরে চলো।’ বলে দু’হাতে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে চলল সে বর্ষাকে।
বর্ষা বিহ্বল হয়ে ওর পেছন পেছন গেল।

নিতিনের ঘরটা রুপকথার মতো। সাদা-গোলাপি রঙে রাঙানো প্রতিটি আসবাব, বেডশিট, পর্দা, চারপাশের দেয়াল। লাগোয়া বারান্দায় সাদা রঙের দোলনা। যেখানে সবুজ লতা জরানো। এঘরে এলে বর্ষার মনে পড়ে যায় নিজের ছোট কালের অপূরণ শখের কথা…। এককালে ওর ও খুব শখ ছিল এমনি একটি বসতঘরের। ধবধবে সাদা রঙে রাঙানো হবে যার দেয়াল, বিছানা, আসবাব……. সবকিছু।

নিতিন ওকে নিয়ে বসালো বারান্দার সাদা দোলনায়। কথার ফুলঝুরি খুলে বসল সে। সব কথার মাঝে একটা কথাই বর্ষার মনোযোগ কাড়ল। নিতিন ঘুরেফিরে বারবার একটি ছেলের প্রসঙ্গে ফিরে আসছে। যদিও তেমন বিশেষ কিছু নয়। স্কুল শেষে বেরিয়ে গোগ্রা’সে ওরা বন্ধুরা যখন ফুচকা গ’লঃকরণ করে। তখন রোজ রোজ দাঁড়িয়ে হা করে একটি ছেলে ওদের ফুচকা গেলা দেখে! অমন ড্যাপ ড্যাপ, বোকা বোকা চাহনি নিতিন আর কখনো দেখেনি।
বর্ষা মুচকি হেসে শুধালো,
–‘ হা করে কি সবার খাওয়াই দেখে। নাকি শুধু তোমার টা?’
নিতিনের মুখে ঈষৎ র’ক্ত ছলকে উঠল।
–‘ আমাকে একা কেন দেখবে? কিজানি! অতশত খেয়াল করিনি আমি। ‘

বর্ষা চোখ বাঁকিয়ে নিতিনের মুখে তাকায়। গলার স্বরে ঝরে পড়ে আন্তরিক হাসি,
–‘ বেচারাকেই বা দোষ দিই কিভাবে বলো! এমন খরশাণ সুন্দর মুখ খানি মুফতে দেখার সুযোগ মিললে কেউ কি আর ছাড়ে?
কি ভালো হতো যদি তুমি সৌন্দর্যটুকু আচ্ছাদনে আড়াল করে রাখতে! ‘

নিতিন হাসল।
–‘ তাই হবে। আচ্ছাদনেই আড়াল করে রাখবো। কিন্তু এখনি না। এখনো তো আমি বেশ ছোট। তত বড় হইনি। আরও কিছুদিন যাক…।
তাছাড়া আম্মাকে জানো তো? আমি বোরকা পড়লে আম্মা কিরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন ধারনা আছে তোমার?’

শাশুড়ী মায়ের কথা ভেবে খারাপ লাগলেও নিতিনের কথাটা ওর সত্যি মনে ধরল। সমাজের উচ্চ শ্রেণির মাঝে শৈশব, কৈশোর কাটানো নিতিন যে এতো অনায়াসে বোরকার মতো আচ্ছাদনকে স্বীকার করে নিয়ে এবং বিলম্বে হলেও নিজের জন্য সেই আচ্ছাদন কে বেছে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে সেই বা কম কি!

বর্ষা আদুরে গলায় ওর নাক টেনে দিয়ে বলল,
-‘ তাড়াতাড়ি বড় হও নিতিন পাখি। তোমাকে শশুড়ালয়ে পাঠিয়ে দিয়ে বাড়ি খালি করি।’
তারপর হঠাৎ মনে পড়েছে এমন স্বরে বলল, -‘আচ্ছা, এতদিন সালাত পড়ে পড়ে বাবার জন্য দোয়া করেছিলে তো নিয়মিত?’
নিতিন স্বগর্বে মাথা দোলালো।
বর্ষার উৎসুক হয়ে বলল,
-‘মনের অস্থিরতা কমেছে না?’
বাবার কথা উঠতেই নিতিনের চোখ টলমল করতে লাগল।
-‘ সত্যিই কমেছে ভাবি। তোমাকে থ্যাংকস। এত সুন্দর পথ বলে দেবার জন্য। এখন আর বাবার কথা ভেবে কষ্ট হয়না আমার। মন খারাপ হলেই সঙ্গে সঙ্গে দো’আ করি।’
কথা শেষ করে দু’হাতে চোখ মুছে নিতিন হেসে ফেলল।

প্রসঙ্গ পালটে মাথা নাড়িয়ে বলল
-‘ওসব কথা রাখো। আমাকে এখন বলো সমুদ্রে তোমাদের মধুচন্দ্রিমা কেমন কাটলো? ‘
এরপর সমুদ্রে যাওয়া নিয়ে সহস্র প্রশ্ন ছুড়ে বর্ষাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সে। বলার মতো গল্প যে খুব বেশি তৈরিই হয়নি নিতিন কে সেকথা বোঝানো দায়। নিতিন গল্প শুনতে আগ্রহী। সমুদ্রের তীরে কাটানো সময়ের বিবরণ জানতে আগ্রহী। কিন্তু বর্ষার কাছে বলার মতো খুব বেশি কথা নেই। সমুদ্রের কথা উঠতেই ঘুরেফিরে ওই একটি সন্ধ্যের স্মৃতিই ওর মনে বারংবার ফিরে আসে। ভেতরে ভেতরে কেমন অসুস্থ অনুভব করে সে। প্রতিবার এমন হয়। নাব্যর প্রাত্তন প্রেমিকা মেয়েটির কথা মনে পড়লেই নিজেকে অসুস্থ লাগে ওর।

সহসা বর্ষার মুখের এই লক্ষণীয় পরিবর্তন খেয়াল করে নিতিন চুপসে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হলো ওর দাভাই আর বর্ষার মাঝে তৃতীয় সেই একজনের উপস্থিতির কথা। যে না থেকেও সবটা জুড়ে আছে। কিন্তু এখনো কি ওরা সেই দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে নি? দাভাইয়ের মনে এতো পোক্ত আসন গে’ড়ে বসে আসে সেই ছলনাময়ী মেয়েটি!

___________________________

সকাল সকাল রান্নাঘরে পেয়াজ, মরিচের সাথে শুটকি তাওয়ায় সেঁকে সেগুলো ভর্তার আয়োজন করছে বর্ষা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সেসবের মিশেল ঝাঁঝালো গন্ধ। নিতিনের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা রান্নাঘরে ছুটে এসেছে। এ বাড়িতে বধূ বেশে পা রাখার পর থেকে ওর প্রিয় খাবার গুলোর আর মুখ দেখা হয়নি।
এবাড়িতে কেউ কোনো কালে শুটকির নাম শুনেছে কিনা সন্দেহ৷ খাবার নিয়ে এদের বিশেষ নখড়া আছে। সকালে ব্রেড, বাটার, সেদ্ধ ডিম আর জুস। দুপুরে অল্প একটু ভাত আর রাতে রুটি।
বর্ষা রীতিমতো হাপিয়ে উঠেছে। এসব ছাইপাঁশ খেতে খেতে। বাবার বাড়িতে রোজ সকালে রাতের ঠান্ডা ভাত আর কোনো একটা ভর্তা কিংবা বাসি তরকারিতে দিন শুরু হতো ওর। সেসব খাবারের স্বাদই যেন মুখে লেগে আছে এখনো।
বর্ষা বিরক্ত হয়ে ভাবে। এতো টাকা দিয়ে কি হবে যদি দুবেলা একটু মনের মতো খাবার খেয়ে সুখ না পাওয়া যায়! তবে এবার আর কোনো চান্স নয়। কক্সবাজার থেকে শুটকি নিয়েই এসেছে সে।

ভর্তা বানিয়ে চুলা থেকে সদ্য রান্না করা গরম ভাত নামাতে যেতেই গালে আরও একবার সশব্দ চুমু পড়ায় এবার প্রায় থমকে গেল বর্ষা। নিতিন মেয়েটাকে বোধহয় পাগলে পেয়েছে আজ। ভেবে পেছন ঘুরতেই অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে এল ওর মুখ দিয়ে। বর্ষা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল সামনে। ওর দুপাশে কিচেন কেবিনেটে দু’হাত রেখে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে নাব্য। বর্ষা মনে মনে ভাবল চুমুটা কি কংক্রিট সাহেব-ই দিয়েছে? ভাইবোনের হলো কি আজ! সকাল থেকেই দুজনে ওকে চুমুর ওপর রাখছে!

-‘কি হলো? ‘ নাব্য নির্বিকার স্বরে বলল।
-‘ কিছু না। আ..আপনি এখানে এসেছেন কেন? কিছু দরকার হলে আমাকে বলতেন। আমিই নিয়ে যেতাম। ‘
নাব্য ভেবে বলল
-‘তুমি পারবে না। কফি লাগবে। আমার কফি আমি নিজে তৈরি করতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করি।’
নাব্য হঠাৎ চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল।
-‘ একটা উৎকট স্মেল আসছে। এটা কিসের?’

বর্ষা ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বলল,
-‘ কি…কিসের আবার! খাবারের গন্ধ।’
-‘কি খাবার?’
-‘আপনি চিনবেন না। চুলা খালি আছে। দাঁড়ান আমি কফির জন্য পানি বসাচ্ছি।’
নাব্য তখনো দু’দিকে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে আটকে পড়ে বর্ষা মনে মনে বলল,
-“আরে ভাই সরেন না! এমনিতেই আমার শুটকি ভর্তা খাওয়ার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। এখন না সরলে আমি চুলায় পানি বসাবো কি করে?’

নাব্য জায়গা ছেড়ে না সরে ভ্রুকুটি করে বলল,
-‘ কি খাবার বললে না তো?’
-‘শুটকি।’
-‘ ইউ মেইড ইট?’
বর্ষা পানসে মুখে বলল,
-‘হ্যাঁ।’
-‘আমিও খাব!’
-‘কি! ‘ বর্ষার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
-‘ না না। আপনি এসব খেতে পারবেন না। অনেক কাটা আছে। আপনি তো মাছ ই খান না কাটার জন্য। কক্সবাজারে গিয়ে চিংড়ি ছাড়া কোনো মাছ ই খেলেন না।’

-‘কে বলেছে খাইনা? খাই, তবে নিজে কাটা সরিয়ে খেতে পারিনা। তাই আম্মা খাইয়ে দেয়।’

-‘ আম্মার তো প্রেসার বেড়ে গেছে। ঘরে শুয়ে আছেন। তাহলে আর কিভাবে খাবেন? আজ বরং থাক। আপনি কফি নিয়ে চলে যান।’

-‘তুমি খাইয়ে দেবে। নিতিনও কাটা সরিয়ে খেতে পারে না। তাই ওর ও খুব একটা মাছ খাওয়া পড়েনা। ওয়েট, নিতিনকেও ডাকছি। তুমি আমাদের শুটকি দিয়ে ভাত খাইয়ে দাও।’

নাব্যর কথা শুনে বর্ষার রীতিমতো ভিমড়ি খাওয়ার যোগার। একে সামলাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে এর মাঝে আবার অন্যটিকেও ডাকা চাই। পাগল আর কাকে বলে!

বর্ষা বলল,
-‘আপনি বুঝতে পারছেন না। শুটকি একদমই ভালো খাবার নয়। কাটা ভর্তি, বাজে গন্ধ। নিতিন খেতে পারবে না। ‘

-‘আচ্ছা নিতিন থাকুক। তুমি আমাকে খাইয়ে দাও। খেতে ভালো হলে তারপর নিতিন কে ডাকব। ‘ বলে নাব্য সরে দাঁড়াল।

কিছু বলা অর্থহীন বুঝে বর্ষা বিরস মুখে ভাত মাখাতে মাখাতে মনে মনে ভাবল কি চরম ভুলই না সে করেছে সকাল সকাল এই ভর্তা খাবার আয়োজন করে। এরচেয়ে শুটকি গুলো বাক্সবন্দি করে বাপের বাড়ি নিয়ে গিয়ে খেলে কতো ভালো হতো। অন্তত এই উটকো ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যেত!

____________________________

বর্ষার পেলব মৃদু মনখানি আজকাল হাওয়ায় ওড়ে সারাক্ষণ। মাটির ছোঁয়া পায় না যেন পা দুটো। নাব্যর মনে ওর জন্য ক্ষানিকটা স্থান আছে। এই অবিশ্বাস্য কথাটা কোনোমতেই বিশ্বাস হতে চায়না ওর! নাব্যময় দিনগুলো কি ভীষণ সুন্দর আর সর্বক্ষণ বিশেষ! এই বিশেষ সুন্দর দিন গুলিকে শার্সির ভেতর কোনো এক অজানা গোপন প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখতে মন চায় বর্ষার। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।
নাব্য যখন হাসে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। তখন ওর করা যাবতীয় অন্যায় ফিকে মনে হয় বর্ষার কাছে। অবিচার গুলো চোখে ধূসর হয়ে আসে। বর্ষা চোখের পাতায় নাব্যর জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না, চাইলেও স্থান দিতে পারে না বিষাদকে। থেকে থেকে মনে হয় নাব্য যদি আর কখনো বিরাগ হয় ওর প্রতি, তবে হয়তো এবার সে সত্যিই মরে যাবে।

বর্ষা ভাবে। ধীরে ধীরে বোধহয় সত্যি নাব্য হয়ে উঠছে ওর মনের মতো ভালো মানুষ! সে এখন নিয়মিত সালাত পড়ে। কখনো কখনো বর্ষার আগে সে-ই উঠে ডেকে দেয় ফজরের সালাতের জন্য। বর্ষা একদিন আন্তরিক হেসে নাব্যকে বোঝালো,
-‘কারো অতীত মনে রেখে প্রতিনিয়ত সেই অতীত অপরাধের জন্য মর্মাঘাতে পিষ্ট করা আমাদের দ্বীন নয়। আপনার যা কিছু অতীত সেসব এখন মৃত।
বর্ষাকে হারাম পন্থায় ভালোবেসে ছিলেন। আল্লাহর অনেক বড় অবাধ্যতা ছিল সেটা। কিন্তু আল্লাহ তো গফুরুর রহিম। সবচেয়ে দয়াবান এবং ক্ষমাশীল। তাই পুরোনো ভুলের জন্য রবের কাছে ক্ষমা চান। তিনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন।’
নাব্য সেদিন নিরবে মাথা নেড়ে মেনে নিয়েছিল বর্ষার কথা।

এক সন্ধ্যায় ব্যাগে নাব্যর কাপড়চোপড় গোছগাছ করছিল বর্ষা। রাতেই নাব্য বেরোবে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য। ব্যাবসায়ীক কাজে পুরো বিশ দিনের জন্য চট্টগ্রাম যাচ্ছে সে। ইত্যবসরে সমুদ্র ছেড়ে আসার মাস-দুই পেড়িয়েছে।
ওদের ঘরের চেহারায় ক্ষানিক অদলবদল ঘটেছে এরই মধ্যে। ঘরের এককোণে সযত্নে সাজিয়ে রাখা গিটার টা অদৃশ্য। সাউন্ড বক্স গুলোও নেই। সেসব নাব্য ঘর থেকে সরিয়ে ফেলেছে বর্ষার কথায়। আগে নাব্যর ঘরে গাঢ় রঙ্গের প্রাধান্য ছিল বেশি। এখন বেশিরভাগ জিনিস সাদায় মোড়ানো। বেডশিট, পর্দা, দেয়াল। বর্ষা এবার নতুন মিশনে নেমেছে। নাব্যর সিগারেট ছাড়ানোর মিশন। এই কাজটাই সবচেয়ে কঠিন। নাব্য কিছুতেই রাজি নয় সিগারেট ছাড়তে।

-‘সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়েছো তো?’ বাথরুম থেকে বেরিয়ে আরশিতে চুল ঠিক করতে করতে নাব্য জিজ্ঞেস করল।

বর্ষা ম্লান মুখে তাকাল ওর পাণে।
-‘হ্যাঁ শেষ। আপনি কি এখনি বেরোচ্ছেন?’
-‘হু।’
-‘কবে ফিরবেন?’
-‘বললাম তো কাজ শেষ হলেই। পনেরো বিশ দিন লাগবে। কেন তুমি থাকবে পারবে না একা? এতো বার করে বললাম সাভার থেকে ঘুরে এসো। সে কথাও তো শুনলে না।’
বর্ষা ঈষৎ হাসল।
-‘যাবো। আপনি যান। এর মধ্যে একসময় গিয়ে বেরিয়ে আসবো আমি।’
আরশি ছেড়ে সহসা বর্ষার নিকটে এসে দাঁড়াল নাব্য। গোছানো ব্যাগপত্র বিছানা থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুজনের মাঝখানের দূরত্ব ঘোচালো বর্ষা। এবং ওর স্বভাবসুলভ কাজ টা করল। সদ্য পরিপাটি করে আঁচড়ানো নাব্যর কাঁধ ছুই ছুই চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিল। নাব্যর মুখে একটু বিরক্তির আভা ফুটল। ভ্রুকুটি করল সে।
-‘মাত্র ব্রাশ করেছিলাম। এটা কি করলে?’
বর্ষা স্ব দর্পে হেসে বলল
-‘বেশ করেছি। পারলে চুলগুলো কেটে নিজের কাছে রেখে তারপর পাঠাতাম আপনাকে। কিন্তু সেটা তো হতে দেবেন না আপনি।’
-‘ আলবাত না! যখন তখন আমার চুলে হাত দিচ্ছ। অথচ এই বারাবারি মুখ বুজে সহ্য করছি সেইতো ঢের! নইলে কেউ কখনো আমার চুলে হাত দিক সেটা পছন্দ করি না আমি। এমনকি আম্মা ধরলেও না!’
-‘ আমি চুলে হাত দিলেও বুঝি খুব বিরক্ত হন আপনি?’
-‘সেকথা বলেছি কখনো? ‘
-‘না বললেও ঠিক বোঝা যায়! ‘
-‘তাহলে বলব তোমার বোঝাতেই ভুল আছে। শোনো বর্ষা…’
বলে বর্ষাকে দু’হাতের বেষ্টনে আবদ্ধ করে নিল নাব্য।
-‘ যেখানে যাচ্ছি। ওখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না সবসময়। কখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন হলে বেশি ভেবো না যেন।’
কিছুক্ষণ একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা। পুরুষোচিত সৌন্দর্যের অবাধ্য স্ফুরণ নাব্যর মুখের ভাজে ভাজে। নিজের এই মাত্রাছাড়া রূপবান বরটাকে বিনামূল্যে দেখার সুযোগ মেলে শতশত মেয়ের..। ভাবতেই বর্ষার হিংসে লাগে খুব। বিষন্নভার মাথাটা আলতো করে নাব্যর বুকে নামিয়ে রেখে মন খারাপের সুরে বর্ষা বলল,
-‘ভাববো না। আপনি আমাকে ভুলে যাবেন না তো?’
-‘তাই আবার হয় নাকি?’
-‘কে জানে! আমার ভয় হয়…’

চলবে……..

একদিন নববর্ষা -৩২
অদ্রিজা আশয়ারী
___________

একটি ফুটফুটে রাজপুত্র বর্ষার কোল জুড়ে দা’পাদা’পি করছে। দীর্ঘ ঘুম শেষে আড়মোড়া ভাঙছে হাত পা ছুড়ে। বর্ষা উৎসুক দৃষ্টি মেলে শিশুটিকে দেখছে। তার মুখে উজ্জ্বল হাসির রেখা। এই প্রথম সে কোলে নিয়েছে নিজের ভাতিজাকে। ওর চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। প্রথম অবস্থায় বাচ্চাদের চেহারা ভালো করে বোঝা যায় না। তবুও সবাই বলছে বাচ্চাটা নাকি একদম বর্ষার চেহারা পেয়েছে। সে একই মুখের আদল, একই হাসি আর চাহনি।

সেই চারমাস আগে বৌভাতের পর বাবার বাড়ি এসেছিল। তারপর এতোদিন পেরিয়ে বর্ষা ফের নিজ বাড়িতে পা রাখল। এসেই দেখা পেল নতুন অতিথির। গতকাল মাত্র ছেলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে ফাবিহা।

এক লাগেজ বোঝাই জামাকাপড় নিয়ে এসেছে বর্ষা। আর সঙ্গে সবার জন্য ছোটখাট কিছু উপহার। ঠিক করে এসেছে এবার অনেকগুলো দিন বাবার বাড়িতে কাটাবে। কিন্তু তিনদিন যেতে না যেতেই বর্ষার মনোভাব বদলে গেল। সে অবাক হয়ে খেয়াল করল এবাড়িতে আর কোনোভাবেই সে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। যতটা ওখানে করে আজকাল। মন টিকছে না এখানে। ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্থির অনুভব করছে সে। ও বাড়ির প্রতিটি মানুষের জন্য পুড়ছে ওর মন! বিশেষ করে দাদির জন্য।

নাব্য তো রয়েছে অনেক দূর। সারাদিনে এক-দুবার মাত্র কথা হয় ওর সঙ্গে। কখনো কখনো সেটুকুও হয়না। নেটওয়ার্ক বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মাঝখানে। আরও একজন আছে, যাকে ছাড়া মন পোড়ে। নিতিন। এই তিনদিনে নিতিন অসংখ্য বার কল করেছে বর্ষাকে। খানিক পর পর কল করে দু চারটে হাবিজাবি কথা…ব্যাস! বর্ষা জানে, নিতিন মেয়েটা কত ভালোবাসে ওকে। কিন্তু নাসিমা এসব বোঝেন না। নিতিনের কিশোরী সুলভ দুরন্তপনায় তিনি যারপরনাই বিরক্ত। কতবার তো মুখ ফুটে বলেও ফেলেছেন,
-‘মায়ের চেয়ে দেহি মাসির দরদ বেশি! জামাইরে তো দেহি না তোরে এতবার ফোন দিতে? এই মাইয়া এত ঢং করে কেন? সবখানে বড়লোকি না ফলাইলে চলে না। হুহ্!’
মা কে কিছু বোঝানো দায়। উত্তরে কিছু না বলে তাই বর্ষা নিরব থেকেছে।

এখানে চারপাশে এতো লোকজন। প্রত্যেকেই কতো আপন ওর। তবুও এতো খালি খালি লাগছে কেন সবকিছু! মাত্র তিন রাত্রি যাপন শেষেই বর্ষা সিদ্ধান্ত নেয় ওবাড়ি ফিরে যাবার। নাসিমা হাজার বলেও মেয়েকে ধরে রাখতে পারলেন না। বড় ভাই সোহাগের সাথে বর্ষা চলে গেল। যাবার আগে ভাতিজার কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিল। আর অজানা কারণে বাবার বুকে মাথা রেখে খুব কাঁদল। কেন এতো কাঁদল সেদিন, তার কারণ সে নিজেও জানে না। শুধু জানে বাবাকে ধরে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল!

____________________________

হেমন্ত শেষ হতে আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। বিকেলের উত্তরে হাওয়ায় শীত শীত ঘ্রাণ। বিছানার সঙ্গে লাগোয়া জানালা ঘেঁষে বর্ষা বসে আছে। ওখান থেকে বারান্দার ছোট ছোট টবে লাগানো লাল, সাদা ফুল নজরে আসে। ফুলগুলো তিরতির করে কাঁপছে হেমন্তের মাতাল বাতাসে। বর্ষা একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে আছে। মস্তিষ্ক টা শূন্য লাগছে। কোনোকিছুই ভাবতে ভালো লাগছে না ওর।

গুনে গুনে বাইশ দিন পেড়িয়েছে নাব্য চট্টগ্রাম গেছে। এখনো ফেরেনি। তার ওপর আজ সকালের পর থেকে একটি বারের জন্য কল করেনি বর্ষাকে। ও নিজে থেকে যে দেবে সে পথ বন্ধ। আজ সকালেই নাব্য কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করেছে ওকে। যেন সে আর কখনো নিজ থেকে কল না দেয়। যখন সময় হবে নাব্য নিজেই কল করবে। সাপেক্ষে যুক্তি দিয়েছে যখন তখন এভাবে কল করে কথার ফুলঝুরি খুলে বসে বর্ষা নাকি ওর কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। হিসেবনিকেশে গন্ডগোল বাঁধিয়ে দেয়। নিজের বিরুদ্ধে এমন অপমানজনক অভিযোগের আখ্যা শোনার পর বর্ষা কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিয়েছিল লাইনটা। তারপর নাব্যও আর কলব্যাক করেনি।

কিন্তু বর্ষার এবার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। নাব্যর সঙ্গে যোগাযোগ হীনতার মেয়াদ যত দীর্ঘ হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওর অস্থিরতা। ধীরে ধীরে নিশ্বাসের গতি শ্লথ হয়ে আসছে। বর্ষা বুঝতে পারছে না এটা তার ভ্রম কিনা! তবে যাই ঘটুক না কেন, আজ সে কিছুতেই নিজে থেকে কল করবে না ওই গোমড়া মুখো মেঘকে। ম’রে গেলেও না। অথচ মস্তিষ্কের এই সিদ্ধান্তটাও বেহায়া মন মানতে নারাজ। মন চাইছে একছুটে গিয়ে নাব্যর নাম্বারে ডায়াল করে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকতে।

শুধু একবার নাব্যর গলার স্বরটা শুনবে সে। আর কিচ্ছু না। তার পরই নিজ থেকে কেটে দেবে লাইন। এতেও কি বিরক্ত হবে নাব্য? রাগ দেখাবে বর্ষার প্রতি? বর্ষার খুব কান্না পাচ্ছে। আজকাল এমনি হয়। খুব অল্প, একেবারে সামান্য থেকে সামান্যতম ব্যাপারে চোখ ছলছল করে ওর। বর্ষা বোঝে না ধীরে ধীরে সে এমন কেন হয়ে যাচ্ছে? কেন এত ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে ওর ভেতর টা?

বার দুয়েক ঠকঠক কড়া নেড়ে নিতিন দরজার বাইরে থেকে মুখ বাড়াল।
–‘ভেতরে আসব?’
পেছন ফিরবার আগেই বর্ষার খেয়াল হলো ওর দুই গাল সিক্ত করে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। নিজের কাছেই এবার ভারি লজ্জিত বোধ করল সে। চোখের জলের এমন অবাধ্য অহনির্শি পতন অবশ্যই অন্যকে জানিয়ে বেড়াবার মতো বিষয় নয়। বর্ষা দ্রুত চোখ মুছে ফেলল। নিতিন দরজায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিল। কাছে এগিয়ে এলো।
-‘ কি করছিলে?’ জিগ্যেস করে পাশে বসল সে। তারপর আলাপে মশগুল হয়ে পড়ল সমবয়সের ও সমমনের দুই সখী।

বাইরে তখন ঘোর সন্ধ্যা। পশ্চিম আকাশ জুড়ে রক্তিম মেঘের ছড়াছড়ি। নীড়ের সন্ধানে বিহঙ্গের দল উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের পাণে, সেই লালিমাকে লক্ষ্য করে। সব পাখিরা কেন সন্ধ্যায় পশ্চিম মুখী হয়েই ফেরে জানতে ইচ্ছে করে বর্ষার। চায়ে চুমুক দিয়ে কথাটা বলবার উদ্দেশ্যে সে নিতিনের অভিমুখে ফিরল। কিন্তু তখনি অকস্মাৎ কাশি শুরু হলো বর্ষার। ধীরে ধীরে কাশিটা বাড়তে লাগল। বর্ষা শাড়ি আঁকড়ে ধরল। কাশির সঙ্গে এখন বমিও পাচ্ছে ওর। বমি নামক জিনিসটা কে সে ছোট কাল থেকে ভীষণ ভয় করে। এবং যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করে। এখনো তাই করল। কিন্তু ক্রমাগত কাশতে কাশতে সহসা ওর মুখ রক্তিম হয়ে উঠল।
চোখের সামনে অন্ধকার ঠেকল সবকিছু। চোখ বুজেই একসময় মেঝেতে উবু হয়ে বসে পড়ল সে। গড়গড় করে বমি করতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে ভীত স্বরে আর্তনাদ করে উঠল নিতিন। ওর চিৎকারে ভারি হয়ে উঠল চারপাশের বাতাস।
নিতিন কিছু বলতে পারছে না। চিৎকার দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বর্ষার দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপছে।

পুরো ব্যাপারটা ঘটে গেল কয়েক মুহুর্তের মধ্যে। অতর্কিতে সৃষ্ট এই পরিস্থিতি আর নিতিনের তারস্বরে চিৎকার বর্ষাকে আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে। এবার সত্যিই নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। শ্বাস নেয়ার জন্য মুখটা ক্ষানিক ওপরে তুলল সে। চোখাচোখি হল নিতিনের সঙ্গে। নিতিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার নিজের নাকে হাত রাখল। হাতে তরল জাতীয় কিছু একটা ঠেকল।
হতবিহ্বল বর্ষা নিতিনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে এই প্রথম নিজের হাত ও মেঝের দিয়ে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল ওর। তার পরের ব্যাপার গুলো আরও দ্রুত ঘটল। নাক দিয়ে তখনো র’ক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। সেই অবস্থাতেই ঘুম কিংবা অচেতনতায় মেঝেতে গা এলিয়ে পড়ে গেল বর্ষা।
চিৎকার শুনে রাফিয়া ততক্ষণে কাজের মেয়ের সঙ্গে ছুটে এসেছেন। নিতিন তখনো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বর্ষার নাক ও মুখ থেকে নির্গত টাটকা র’ক্তের দিকে।

___________________________

তার দুদিন পর সন্ধ্যায় ফিরল নাব্য। এই দু’দিনে রাফিয়া অসংখ্য বার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। সফল হননি একটি বারের জন্য। গত কাল রশু ফোন করে জানিয়েছে নাব্য নিজের সেলফোন টা হারিয়ে ফেলেছে। আপাতত কথা বলবার পথ নেই। সে ঢাকায় ফিরেই একবারে কথা বলবে। রাফিয়া ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন,
-‘নবুকে ডাকো। বলো তোমার ফোন দিয়েই আমার সঙ্গে দু মিনিট কথা বলতে। জরুরি দরকার। ‘ উত্তরে রশু মিনমিনে গলায় জানাল নাব্য ওর পাশে নেই। চাইলেও নাব্যকে এখন ফোনটা ধরিয়ে দিতে পারবে না সে।

রাফিয়া অস্থির হলেন। দুশ্চিন্তায় পড়লেন সেই আগেকার মতো। বরং তখনকার চেয়েও বেশি৷ যখন নাব্য পরোয়াহীন হয়ে, কাউকে না জানিয়ে দিনের পর দিন পরিবার ছেড়ে বন জঙ্গলে পড়ে থাকত।

নাব্য ফিরল সন্ধ্যা লগ্নে। রাবেয়া মঞ্জিলে শুনশান নীরবতা। নিচে কারো দেখা না পেয়ে নাব্য সোজা ওপরে উঠে এলো। বর্ষা সালাত শেষে সবে জায়নামাজ ভাজ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। নাব্যকে ঘরে আসতে দেখে সে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে গেল। মুহুর্তে আড়ষ্টতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল ওর দেহমন। ওকে এতটা আড়ষ্ট হতে দেখে নাব্য কিছুটা অবাক হলো। মনে হলো কিছু একটা যেন আজ অন্যরকম। আজ ওকে দেখে সালাম দিতেও এগিয়ে আসেনি বর্ষা। অথচ কখনো সে এই ব্যাপারে ভুল করে না।

-‘কি হয়েছে? ‘
কয়েক পা এগিয়ে বর্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধাল নাব্য।
বর্ষা অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর করল,
-‘কিছু না।’
-‘এদিকে তাকাও। কি হয়েছে বলো? আমি কি কোনো ভুল করেছি?’
বর্ষা নিশ্চুপ।
-‘কিছু বলবে না? আমি চলে গেলে খুশি? তবে আমি চলে যাচ্ছি.. ‘
নাব্য সত্যি ঘুরে দরজার দিকে যেতে লাগল। তাই দেখে বর্ষা ছুটে গিয়ে ওর জামা টেনে ধরল।
-‘কোথায় যাচ্ছেন? ‘
নাব্য ফের ঘুরে তাকাল বর্ষার দিকে।
-‘ আমার ফেরাতে তো কেউ খুশি হয়নি তাই চলে যাচ্ছি।’
-‘ কেউ খুশি হয়নি বলেছে আপনাকে?’ বর্ষার গলার স্বর কাঁপছে। কম্পন টের পেয়ে নাব্য এবার হেয়ালি ছেড়ে গম্ভীর হয়। স্বরে আদ্রতা মিশিয়ে বলে
-‘কি হয়েছে বর্ষা? ইজ এভরিথিং ওকে?’
বর্ষা উত্তর না দিয়ে দু পা এগিয়ে নাব্যর গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। নাব্য দু’হাতে ওকে আলিঙ্গন করতেই ওর বুকে মুখ লুকিয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে সে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায় একসময়। বর্ষা তবুও থামে না।
জড়ানো স্বরে সে কিছু একটা বলতে থাকে। কিন্তু কান্নার প্রকোপে ওর বলা কথা অস্পষ্ট শোনায়। অনেক চেষ্টার পর নাব্য বর্ষার কথার অর্থোদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
বর্ষার মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করবার জন্য বলে
-‘ আসতে কেন দেরি করেছি? ব্যাস এটুকুই ! এই সামান্য ব্যাপারের জন্য এভাবে কাঁদে কেউ? কাজে আটকে গেছিলাম। সেজন্য ফিরতে দেরি হয়েছে। এর মধ্যে সেলফোনটা হারিয়ে গেল। রশুকে বলেছিলাম তোমাদের ইনফর্ম করতে। কেন রশু কিছু বলেনি?’
নাব্য বুঝল বেকার কথা বলছে সে। বর্ষা কিছু শোনার বা বোঝার মতো অবস্থায় নেই। কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। নইলে অত অবুঝ মেয়ে তো বর্ষা নয়!

সে কিছুটা সময় দিল বর্ষাকে সামলে ওঠার জন্য। তারপর ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘বর্ষা, এবার কি বলবে আমাকে কিছু? প্লিজ ?’
কান্নায় বসে যাওয়া গলা আর ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে বর্ষা নাক টেনে বলল,
-‘আমি বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচবো না।’ তারপর সেদিন সন্ধের ঘটনাটা জানাল নাব্যকে। শেষে বলল,
-‘আমি মরে গেলেই আপনি ওই বর্ষাকে বিয়ে করবেন। তাই না?’ ফের কাঁদতে শুরু করল সে।

নাব্য এবার সত্যি কিছুটা বিরক্ত।
-‘নাক, মুখ দিয়ে র’ক্ত বেরোলেই কেউ মরে যায় না বর্ষা। আচ্ছা আমি দেখছি। কাল ডক্টরের কাছে যাব আমরা। ‘

নিচ থেকে রাফিয়ার ডাক ভেসে এলো। নাব্যর ফেরার খবর টা নিশ্চয়ই এতক্ষণে প্রচার হয়ে গেছে।
আরও খানিকক্ষণ বর্ষাকে বুঝিয়ে নিচে চলে গেল নাব্য। ডাইনিং এর এককোণে বসে নিতিন ওটস খাচ্ছিল। নাব্য তার পাশের চেয়ার টেনে বসল।
নিতিনের নাক টেনে দিয়ে বলল,
-‘ কেমন আছিস বুড়ি?’
-‘ভালো।’
-‘একি নবু! ফ্রেশ না হয়েই চলে এসেছিস যে?’ রান্নাঘর থেকে ফিরে রাফিয়া বললেন।
-‘আর ফ্রেশ! আসতে না আসতেই বর্ষা বিলাপ করে কান্না জুড়ল। ও নাকি আর বেশিদিন বাঁচবে না। নাক, গলা দিয়ে র’ক্ত বেরিয়েছিল তাই!’

নিতিনের খাওয়া শেষ। তিনবার দম নিয়ে ঢকঢক করে পানি গলঃধকরণ করে ডাইনিং ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সে জিজ্ঞেস করল,
-‘আর কিছু বলেনি ভাবি?’
-‘আর কি বলবে?’
-‘আচ্ছা বাকিটুকু নাহয় এখন আম্মার মুখেই শুনে নাও। আমি গেলাম। ‘ বলে নিতিন সত্যি সত্যি হাওয়া হয়ে গেল। বোকার মতো হা করে তাকিয়ে রইল নাব্য।
রাফিয়া ফিরে এলেন পুত্রের প্রিয় ধোঁয়া ওঠা আলুর পরোটা নিয়ে।
-‘নিতিন কি বলছিল আম্মা? আচ্ছা, ওসব ছাড়ো। রশুকে বলেছিলে জরুরি কথা বলবে আমার সঙ্গে। বলো কি জরুরি কথা।’
নাব্য গুরুতর মুখ করে মায়ের পানে তাকিয়ে রইল। রাফিয়া বিলম্ব করছেন দেখে গ্লাসে পানি ঢেলে মুখে দিল সে। পরোটার ওপর ক্ষানিক ঘি ছড়াতে ছড়াতে তখনি রাফিয়া বললেন,
-‘বর্ষা প্রেগন্যান্ট। এখনি বেশকিছু কমপ্লিকেশন ধরা পড়েছে। আপাতত একজন ডক্টরের সঙ্গে কনসাল্ট করেছি আমরা। তবে ওনার ওপর আমার ঠিক ভরসা হচ্ছে না। তুই একটু খোঁজ নিয়ে দেখিস তো ভালো…..’
রাফিয়ার কথার মাঝখানেই গলায় পানি আটকে নাব্য উজিয়ে উঠল। গ্লাসের পানি পড়ে ভিজে গেল পরনের বাদামি রঙা শার্ট। কাশতে কাশতে এবার নাব্যর চোখ মুখও লাল হয়ে উঠল।
রাফিয়া চিন্তিত হয়ে বললেন,
-‘আরে… আরে…শার্টটা পুরো ভিজে গেছে। তুই ঠিক আছিস তো নবু?’
নাব্য যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল
-‘হ্যাঁ। ‘
-‘ খাচ্ছিস না কেন? ঠান্ডা হয়ে যাবে তো!’
-‘ পরে খাবো আম্মা। শার্টটা বদলে আসি।’ রাফিয়ার আর কোনো বারণ না শুনে নাব্য সিড়ি ভেঙে ওপরে চলে গেল।

চলবে……