একদিন নববর্ষা -৩৯
অদ্রিজা আশআরী
___________
ফেব্রুয়ারী মাস। সাভারে বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে শীত। সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত কুয়াশায় আচ্ছন্ন রয় চারপাশ। দুপুরের আগে সূর্যের দেখা পাওয়া দুষ্কর বলা চলে।
আজ প্রায় তিনদিন পর সকালে একটু রোদের দেখা মিলল। নাহয় দুপুর গড়ালেও আকাশের সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব টা রোজ তেমনি রয়ে যায়।
শৈত্যপ্রবাহের কারণে গত তিনদিন কেটেছে পুরোপুরি রোদহীন! একটু রোদ্দুর পেয়ে তাই বর্ষা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। উঠোনে কিঞ্চিৎ সময় হাটাহাটি শেষে বসল চৌকাঠের নিচ থেকে শুরু হওয়া সিড়ির প্রথম ধাপে। সকালের মখমলি রোদ, আলোছায়ার আবর্তে ছুটে বেড়াচ্ছে ওকে ঘিরে। বাড়ির সামনে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আম গাছটির পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুকরো রোদেরা এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। সকালের আকাশে আজ পাখির আনাগোনা বেশ। সেদিকে তাকিয়েই বর্ষা বুঝতে পারে। ওরা সবাই বহু প্রতীক্ষিত রোদের আগমনে আনন্দিত। তাই সূর্যের আলোকে ঘিরে ওভাবে বৃত্তাকারে ঘুরছে।
নির্মল শুভ্র মেঘের আস্তরণ পড়েছে সকালের নীল ঝকঝকে আকাশে। এমন দিনে সবকিছু ভালো লাগে। অকারণে মন বারবার পরিতোষের কল্লোলে ভাসে।
————
তার ঘন্টা-দুই পরের চিত্র।
বর্ষা তখনো বসে আছে সিড়ির ধাপে। রোদটা এবার বেশ চড়া হয়েছে। খানিক আগেও যে রোদ ত্বকে মখমলি পেলবতা ছড়াচ্ছিল, সে রোদ এখন গা পুড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ বর্ষা বোধহীন। নির্বিকারে স্বস্থানে বসে আছে। রোদের তেজী উত্তাপ গায়ে লাগছে, তবুও জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছে না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে। যেখানে কয়েকটি পিঁপড়ে খড়খুটোর একটি ছোট টুকরো টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের গোপন আস্তানায়।
বাম চোখের কোলাজ থেকে জলের একটি বিন্দু তখনি নামল ওর গাল বেয়ে। নিজের দুঃখী মনটাকে আর প্রশ্রয় দিতে চায় না। তাই চোখ কাঁদলেও আজ ওর মন অবিচল! সে কথা প্রমাণ করতেই যেন অকম্পিত, স্থির চোখে পিঁপড়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল সে।
ভেতর থেকে নাসিমার চড়া গলার কথা শোনা যাচ্ছে। সেসব অবশ্যই সুখের কথা নয়। গলা উচ্চগ্রামে চড়িয়ে তিনি বলে চলেছেন পোড়া কপালি মেয়েকে নিয়ে নিজের দুর্ভোগের কথা। শত শ্লেষাত্মক কথার আঘা’তে, মর্মভেদী অভিশাপে জর্জরিত করছেন মেয়েকে। ফাবিহা নিজের ঘরে বাচ্চা নিয়ে ব্যাস্ত। তবে ওর মনেও কোথাও যেন একটু চিত্তপ্রসাদের তৃপ্তি।
ফাবিহার মতো নাসিমা আজকাল বর্ষার এখানে পড়ে থাকাটাকে ভালো চোখে নিচ্ছেন না। ফাবিহা যথেষ্ট চতুর মেয়ে। সে সোজা কথায় কিছু বলে না কখনো, বর্ষার এখানে থাকা নিয়েও ওর যা আপত্তি সেসব আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েই খান্ত ছিল। কিন্তু নাসিমা ব্যাতিক্রম। কোনো প্রকার ভদ্রতারই ধার ধারেন না তিনি। কোনো কিছু অপছন্দ হওয়া মাত্র মুখের ওপর সেই কথা বলে দেয়া স্বভাব তার। তাই যখনি বুঝলেন বর্ষা এখানে নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য আসেনি। এসেছে অগণিতকালের বোঝা হয়ে। স্বামীর সঙ্গেও ওর সম্পর্ক ঠিক সুবিধের যাচ্ছে না। হয়তো আগে থেকেই বর্ষাকে এখানে গছিয়ে দেবার অভিপ্রায় ছিল নাব্যর। এইবার সুযোগ পেয়ে সে কাজটাই করেছে। নয়তো অমন গা-ছাড়া কেন হবে ওদের ভাব একে অপরের প্রতি? সেই প্রথম থেকেই, মেয়েকে স্বামী সঙ্গে কখনোই সখ্য গড়তে দেখেননি তিনি।
এতে অবশ্যি নাব্যর দোষও খুব বেশি দেখেন না নাসিমা। ও হলো পুরুষ মানুষ। মন তো একটু উড়ো উড়ো থাকবেই। সেটা সামলে নেয়া তো স্ত্রী হিসেবে বর্ষার কর্তব্য ছিল। কিন্তু ওই অপয়া, অভাগী মেয়ে একাজেও ব্যার্থ হয়েছে। স্বামীর মন জয় করতে পারেনি। যার দায় এখন নাসিমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। তার নির্ঝঞ্ঝাট সোনার সংসারে উটকো ঝামেলা এসে জুটেছে।
বর্ষার প্রতি নাসিমার আচরণে এখন সর্বদাই প্রবল আগ্রা-সী ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রতিদিন, বর্ষার কখনো শেষ না হওয়া ভুলগুলো নতুন ভাবে আবিষ্কার করেন তিনি। সাজিয়ে বসেন অভিযোগের পসরা। রোজ রোজ অকথ্য গা’লিগালাজ, তিরষ্কারের লাঞ্ছনায় বিদ্ধ করেন মেয়েকে। ততক্ষণ পর্যন্ত থামেন না, যতক্ষণ না মেয়েকে অপমানে, আঘাতে নিষ্পেষিত করে আত্মতুষ্টি লাভ হয়। এসবের শুরু সেদিন থেকে, যেদিন ফাবিহা কথা তুলেছিল বর্ষার স্বামী ও শশুড়ালয় নিয়ে। রাখঢাক হীন ভাবে একে একে সব কথা উগ্রে দিয়েছিল নাসিমার কাছে।
সেই কষ্ট গুলো, যেগুলো খুব সন্তর্পণে এতকাল বাবা মায়ের কাছ থেকে গোপন করে এসেছিল বর্ষা। স্বামীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক যত ফিঁকেই হোক, সেখানে ওর অবস্থান যত নিচেই থাকুক। ও কখনো চায়নি নিজের পরিবারকে সেসব জানাতে। চিরকাল মেয়েকে বোঝা মনে করে এসেছে যারা, নতুন করে তাদের মনে আর কোনো শংকার জন্ম দিতে চায়নি সে।
অথচ কিছুই আড়াল রইল না। বর্ষার অনভিলাষ সত্ত্বেও সবাই সবটা জেনে গেল। জানল চিরকাল যে মেয়েটি ভালো সন্তান হবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বারবার হেরে গেছে, সে আজ স্ত্রী হিসেবেও হয়েছে পুরোদস্তুর ব্যার্থ। যে সন্তান আসছে, হয়তো তার ভালো মা হিসেবেও এবার মেয়েটি ব্যার্থ হবে। ব্যার্থতা আর সে যেন জন্মলগ্ন থেকেই একে অপরের সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত।
আজ যেন নাসিমা একটু বেশিই খেপেছেন। ফাবিহার ছোট ভাই ভার্সিটি কোচিং এর জন্য এখানে এসে থাকছে। আরও বেশ কিছু দিন থাকবে। এতে নাসিমা অবশ্যি খারাপ কিছু দেখেন না। বোনের বাড়িতে ভাই প্রয়োজনে এসে থাকতেই পারে। তার ওপর ফাবিহার বড় ভাইয়ের জন্যেই আজ সোহাগের চাকরিতে বেশ পদোন্নতি ঘটেছে।
কিন্তু সমস্যা হলো এবাড়িতে মোটে দুটো মাত্র ভালো শোবার ঘর, সামনে একটি বসার ঘর আর সিড়ির নিচে রয়েছে আরো একটি ছোট ঘর। ফাবিহার ভাই আসার পর থেকে বসার ঘরেই মেঝেতে বিছানা পেতে শুতে হচ্ছে ওকে। অন্য বড় ঘরটিতে ফাবিহা নিজে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকে। পাশের ঘরে থাকেন নাসিমা। আর ছোট ঘরটিতে বর্ষা। থাইরয়েডের সমস্যা কারণে শীতকালেও নাসিমা বেশ ঘামেন। রাতে পাশে কারো ঘুমালে তার অস্বস্তি হয়। তাতে গরম বেশি লাগে। সেজন্য তিনি নিজের ঘরটা ছেড়ে বর্ষার সঙ্গেও থাকতে পারছেন না। তাছাড়া বর্ষা বলতে গেলে প্রায় অর্ধেক রাত জেগেই কাটায়। শরীরিক যন্ত্রণার জন্য ঘুম আসে না। অর্ধরাত্র পর্যন্ত ওর ঘরে বাতি জ্বলে। সেখানে গিয়ে তিনি নিজের ঘুমটাকে মাটি করতে চান না। ফলাফল ফাবিহার ভাইকে প্রথম থেকেই ওই মেঝেতে রাত কাটাতে হচ্ছে। যা নিয়ে ফাবিহা মহা অসন্তুষ্ট। দিনরাত ফোঁসফোঁস করছে ।
এই একটি কারণে বর্ষার এখানে থাকাটা আরও বেশি ক্রোধ উদ্রেক করছে নাসিমার। বর্ষা চলে গেলে সে ঘরটিতে অবিলম্বে ফাবিহার ভাই দখল নিতে পারে। কিন্তু বর্ষাকে কিভাবে বিদেয় করবেন তিনি? রাফিয়া যোগাযোগ রাখেন ঠিকই। কিন্তু চলেন গা বাচিয়ে। শেষ সময়ে এসে এই পোয়াতি মেয়ের সেবাযত্নের ভার যেন নিজের কাঁধে না চাপে। সেই ভয়েই হয়তো !
তাহলে নাসিমাই বা কেন করবেন এতকিছু? যে আসছে সে তো তার বংশের কেউ নয়। আজ তিনি মেয়েকে, নাতিকে কলিজা ছিড়ে ভালোবাসবেন। দুদিন পর হয়তো দেখা যাবে রাফিয়ার নাতির জন্য দরূদ উথলে উঠেছে। টাকার গরম দেখিয়ে ওদের নিয়ে চলে যাবেন। তাহলে নাসিমার রইল কি!
এইসব হিসেব নিকেষ বহু আগেই কষে রেখেছেন নাসিমা। আগ বাড়িয়ে আর কিছুই করবেন না তিনি। এবার ভালোয় ভালোয় মেয়েটা ঘাড় থেকে নামলে বাঁচা যায় !
নাসিমা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
-‘জামাই কবে নিতে আসব তোরে?’
বর্ষা উত্তর করল না। চুপচাপ সিড়ির ওপর বসে রইল।
নাসিমার রাগটা উত্তরোত্তর বেড়ে চলল। কি মেয়েকেই জন্ম দিয়েছেন তিনি! শত অপমানের বিপরীতে মুখে একটিও রা নেই। বর্ষার এই নিশ্চুপ থাকাটা নাসিমার ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সকাল থেকে গলা চড়িয়ে চিৎকার করছেন তিনি। অথচ যাকে উদ্দেশ্য করে এসব বলা তার কোনো বিকার নেই। অমন তেজি মেয়ে হলে কবে এই বাড়ি চিরতরে ছেড়ে যেত। আর একে বলেই বা কি লাভ! এর তো যাওয়ার কোনো জায়গাও নেই!
নাসিমার মস্তিষ্কে বিকৃত ক্রোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো। ক্রমশ হুশজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি। অকস্মাতে বর্ষার খুব কাছে এগিয়ে এসে ওর গায়ে জোড়ালো একটা ধা-ক্কা দিলেন।
–‘ কথা কস না কেন? কবে ছাড়বি তুই এই বাড়ি? দিনের পর দিন এইভাবে বাপের বাড়ি পইরা থাকতে তোর লজ্জা করে না?’
বর্ষা মাথা নিচু করে বসে রইল। সত্যিই এই প্রশ্নের জবাব নেই ওর কাছে। কি বলবে! কোথায় যাবে সে, ছেড়ে এই বাড়ি? স্বামী নামক সেই লোকটির আশ্রয়ে? সে কি আদতেও বর্ষার প্রত্যাগমনে খুশি হবে? হবে না। এখানে কিংবা ওখানে, স্থান যেটাই হোক। ওকে আসলে কেউ-ই চায় না। বর্ষা খুব বোঝে। মাঝেমধ্যে ভেবে অবাক লাগে ওর। এতো বড় পৃথিবীতে, এতো ভয়ংকর নিঃস্ব কেন সে! আজ ওর কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। কারো বুকে মাথা রেখে, চিৎকার করে কেঁদে কষ্ট গুলো বলার সুযোগ নেই। আজ নিজের প্রাণ নিয়ে যেখানে সে এতো বেশি অসহায়। কিছুদিন পর অন্য প্রাণটি ভূমিষ্ঠ হলে তখন সে কি করবে? কার কাছে একটু সত্যি আশ্রয় মিলবে? বর্ষা ভাবে, আরও আগেই কেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল না। এই অনাগত সন্তান নিয়ে এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে একটু মাথা গোজার ঠাইয়ের জন্য?
নাসিমা শীতল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের এই নির্বিকার ভাব যত দেখছেন তত আগুন ধরে যাচ্ছে তার মাথায়। হাতদুটো নিশপিশ করছে।
–‘ এতো বড় ঘর পাইলি। তবুও তুই সেইহানে টিকতে পারলি না। নিজের স্বামীরে ধইরা রাখতে পারলি না। এহন তো জামাই তোর খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয় না।
বাপ তো গেছেই। এহন ভাইয়ের অন্ন ধ্বংস করতে আইসস। সারাটা জীবন তুই খালি আমারে জ্বালায়া গেলি। হতভাগী ম’রতে পারোস না তুই। এহন তোর মুখ দেখলেও আমার… ‘
কথার মাঝখানে এসে একেবারে অকস্মাৎ থেমে গেলেন নাসিমা। উঠোনের অন্যপাশে গেইটের বাইরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকালেন সেদিন। গেইট টা শব্দ করে খুলে যেতেই মুহুর্তে নাসিমার মুখের রঙ বদলে গিয়ে পাংশু বর্ণ ধারণ করল। কাগজের মতো ফ্যাকাসে চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন সেদিকে।
মায়ের হঠাৎ এই নিশ্চুপ হয়ে যাবার কারণ কি বুঝতে না পেরে বর্ষা মাথা ওপরে তুলল। তারপর মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল গেইটের পানে। সেখানে নাব্য দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের মতো কঠিন মুখ করে।
ফাবিহা অনেকক্ষণ ধরেই বুঝতে পারছিল আজ একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছেন নাসিমা। ভেবেছিল এইবার এসে মাকে একটু শান্ত হতে বলবে। কিন্তু আসি আসি করেও আসা হচ্ছিল না। বলতে নেই, ওর বেশ ভালোই লাগছিল বর্ষার প্রতি নাসিমার এই বাক্যবাণ শুনতে।
এবার হঠাৎ কেন সব নিশ্চুপ হয়ে হয়ে গেল। তার কারণ অনুসন্ধান করতে ফাবিহা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। চৌকাঠে পা রাখতেই নাব্যকে দেখে কপালে উঠল ওর চোখ। এদিকে সিড়ির দুপাশে মা মেয়ে দুজন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। থতমত খেয়ে গেল ফাবিহা। তবে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল,
–‘আরে আম্মা ভেতরে যান আপনি। আপনারাও না! মা মেয়েতে সারাদিন শুধু মিছে ঝগড়া! ‘
মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে গেইটের দিকে এগিয়ে গেল সে,
–‘আরে ভাইয়া আপনি দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন প্লিজ। এসে বসুন। কতদিন পর এলেন আমাদের বাড়ি। বর্ষা দেখে যাও কে এসেছে। ‘
বর্ষা তখনো মূঢ়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। নাব্য ওদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ফাবিহাকে সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে গলা চড়িয়ে বলল,
–‘আমি অপেক্ষা করছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে এসো। ‘
নাব্যর স্বরে এমন দৃঢ়তা ছিল যে বর্ষা জায়গা থেকে নড়তে বাধ্য হলো। এবং পাঁচ মিনিট পেরোনোর আগেই গায়ে বোরকা জড়িয়ে বেরিয়ে এল। হাতে একটা মাঝারি আকারের কালো ব্যাগ নিয়ে। ওটা নিয়ে উঠোন পারি দিতেই ওকে বেগ পেতে হচ্ছিল। গেইটের কাছাকাছি এসে সে ফের মাথা নিচু করল। হয়তো অবাধ্য যাতনার ফলিত বাহ্যিক রূপ, চোখের জলগুলো আড়াল করবার জন্যই। নাব্য সেইসব কিছুর পরোয়া করল না। বিনাবাক্য ব্যয়ে ব্যাগ তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে হাটতে শুরু করল। বর্ষা একবার পেছন ফিরল। নাসিমা ফ্যাকাসে মুখে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। কয়েক মুহুর্ত কাটল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে।
–‘আসি ভাবি। আসসালামু আলাইকুম। ‘ বলে বেরিয়ে এলো বর্ষা।
ফাবিহার হতভম্ব ভাবটা তখনো পুরোপুরি কাটেনি। কি থেকে কি ঘটে গেল মাথায় ঢুকছে না ওর। কেনই বা আজই নাসিমা বর্ষার ওপর এতো চড়াও হলেন। আর কেন আজই নাব্যকে আসতে হলো। ফাবিহার মনে বড় আফসোস হলো। কি কান্ডটাই না ঘটিয়েছেন তার শাশুড়ী মা। আজকের পর নাব্যর পরিবার ওদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবে কিনা সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নাব্য কোনো কথা বলছে না। বর্ষা নিরবে কেঁদে চলেছে। কান্না নিঃশব্দে হলেও, খানিক পর পর শব্দ করে হিচকি তুলছে। মাথায় আর চোখে বাজে রকমের ব্যাথা হচ্ছে। বর্ষা দুচোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দিল। এতে যদি ব্যাথাটা কিছুটা প্রশমিত হয়। অথচ হলো তার বিপরীত। ব্যাথাটা ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগল। হঠাৎ বর্ষা সোজা হয়ে তড়িতে বলল,
–‘গাড়ি থামান। আমি বমি করব। ‘
নাব্য দ্রুত রাস্তার পাশে নিয়ে গাড়ি থামাল। মধ্যদুপুরের হাইওয়ে বেশ ফাঁকা। দুপাশে ঘন রেইনট্রি গাছের প্রাবরণ। তারপর থেকে শুরু হয়েছে বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। পাশাপাশি সরিষা ফুলের হলুদ মাঠ। তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অন্যপাশের দরজা খুলে দিল নাব্য। আশেপাশের অনেক দূর পর্যন্ত ওরা ছাড়া কেউ নেই বুঝতে পেরে নিকাব টেনে নামিয়ে বর্ষা বাইরে বেরিয়ে এলো। দু পা এগিয়ে গাছে হাত রেখে উবু হয়ে বমি করতে শুরু করল। নাব্য পানির বোতল আনতে গাড়ির কাছে গেছিল। ফিরে এসে বর্ষাকে ধরতেই ওর গায়ের ওপর হেলে পড়ল বর্ষা।
–‘ পানি খাও।’ ব্যাস্ত হয়ে বলল নাব্য। তারপর নিজেই পানি খাইয়ে দিল ওকে। দীর্ঘ সময় ধরে কান্না, মাথার যন্ত্রণা আর তারপর এই বমি। সবকিছু মিলে বর্ষার অবস্থা দাঁড়াল ভয়ংকর। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চোখ রক্তজবার মতো লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। মুখখানা ক্লান্তিতে ফ্যাকাসে। নাব্য আজলা ভর্তি পানি নিয়ে ওর মুখ ধুইয়ে দিল। গাড়ির কাছে এনে, ওকে নিয়ে নিজেও গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বর্ষা চুপ করে ওর বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ খুলছে না। বড় বেশি নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ওর মাথায় হাত রেখে নাব্য বলল,
–‘তুমি বরং পেছনের সিটে শুয়ে ঘুমোতে চেষ্টা করো। বাড়ি পৌঁছে তোমায় ডেকে দেব আমি। ‘
বর্ষা তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। কিঞ্চিৎ সময় পর ধীর গলায় উত্তর করল,
–‘ পেছনের সিটে শুতে আমার ভয় করে। গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করলে যদি সিট থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাই?’ ওর কথা আর কথার ভঙ্গিমায় হাসি পেল নাব্যর। অনেকদিন পর একটুমাত্র শব্দ করে নিজের বিশেষ হাসিটা সে হাসল । বর্ষা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে লাগল বুকে ঝড় তোলা সেই হৃদয় বিধ্বং’সী ভ’য়ংকর সুন্দর হাসি।’
–‘আচ্ছা থাক। পেছনে শুতে হবে না। এখন গাড়িতে উঠে বসো। ‘
বর্ষা পূর্বের স্থানে গিয়ে বসলো। নাব্য ভেতর এলো পেছনের সিট থেকে দুটো কুশন নিয়ে। কুশন দুটো নিজের কোলের ওপর রেখে বলল,
–‘এখানেই শুয়ে পড়ো আপাতত। বাড়ি পৌঁছে ভালো করে ঘুমিও।’
ব্যাথায় বর্ষা দুচোখে অন্ধকার দেখছিল। এই ব্যাথা সহ্য করে যাওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই ওর। কারণ চাইলেও যেন-তেন ওষুধ নিতে পারবে না। সেসব এখন ওর জন্য সম্পুর্ন নিষেধ। তাই কিছু না বলে সে কুশনে মাথা রেখে সিটে শুয়ে পড়ল। মাথাটা ঠেকল নাব্যর বুকের কাছে গিয়ে। নাব্যর হৃদস্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল সে। পালস্ রেট গুনতে গুনতেই বোধহয়। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে, ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল বর্ষা।
যখন ঘুম ভাঙল তখন দুপুর গড়িয়ে দিন বিকেলে হেলে পড়েছে। নাব্য ডেকে বলল ওরা বাড়ি চলে এসেছে। বর্ষা ঘুম ভেঙে উঠে বসল ভয়ানক মন খারাপ নিয়ে। ঘুমের মধ্যে আজকের ঘটনা গুলোই বারবার ঘুরেফিরে আসছিল স্বপ্নের রূপ নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের করা অসদাচরণ গুলো একে একে মনে পড়ে গেল ওর। বর্ষার আবারও কান্না পেল। কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল সে। কিন্তু গাড়ি থেকে বেরোনোর আগে নাব্যর শেষ কথাটা শুনে শব্দ করে কেঁদে ফেললো বর্ষা। নাব্য দরজা খুলে গম্ভীর মুখে বলল,
–‘ আর কখনো ওবাড়ি যাওয়ার নাম মুখে আনবে না তুমি। ওদের সাথে আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ!’
চলবে ইন শা আল্লাহ ……….।
একদিন নববর্ষা -৪০
অদ্রিজা আশআরী
___________
নিতিনের কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে কেউ জানে না। নিতিন কাউকে জানতে দেয়নি। সে শুধু নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। প্রজ্জ্বল আভায় পূর্ণ মোম বাতাসের ঝটকায় যেমন হুট করে নিভে যায়। নিভে যাওয়া মোমের অবশিষ্ট সুতোর কালোরঙা ধোঁয়া শেষ উষ্মাটুকু বাচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় এঁকে বেঁকে ছড়িয়ে পরতে থাকে চারদিক। নিতিনের বেলায়ও যেন তাই ঘটেছে। সেই অবশিষ্ট সুতোর নলের মতো এখন শুধু ওর দৃষ্টি অস্থির ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে। কেউ কিচ্ছু জানে না। শুধু বোঝে কোনো এক ঝোড়ো সন্ধ্যার, কয়েক মুহুর্তের দুর্বিষহ কোন একটি ব্যাপার নিতিনকে শেকড় থেকে স্তিমিত করে দিয়েছে।
নিতিনের সঙ্গে একটা সখ্য আছে বলেই নিতিনের এই বিশেষ নাজুক ব্যাপারটিতে বর্ষার অবগতি অন্যদের চেয়ে বেশি হয় তা নয়। সেও বাকিদের মতো কেবলি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রয় সবটা শুনে। রাফিয়াই তাকে জানায় কিভাবে হাজারিবাগের বাসিন্দা এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার মাধ্যমে সেদিন নিখোঁজ নিতিনের খোঁজ পেয়েছিলেন তারা মধ্যরাতে। ঘটনা বেশিদিনের পুরনো নয়। মধ্যে তিনটে রাত পেরিয়েছে কেবল। এরই মাঝে রাফিয়া চেহারার দুত্যি হারিয়েছেন, চোখের নিচে মোটা বাদামি আস্তরণ পড়েছে মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা করে।
নিতিন কে শারিরীক ভাবে অক্ষতই পেয়েছিলেন তারা। কিন্তু মন! হয়তো ব্যাখারও অতীত, এমনি কোনো এক বিমর্ষতায় আচ্ছন্ন ছিল সেসময় নিতিনের কোমল বাৎসল্যপূর্ণ মন!
বর্ষাকে মনে মনে অনেক সাহস সঞ্চার করতে হলো নিতিনের কাছে যাবার জন্য। দরজায় কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভেতরে কারো সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। তবু খানিকক্ষণ বাদেই সহসা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নিতিন। নাহ! নিতিনকে দেখে বর্ষার সেরকম ভয় হয়নি, যতটা হবে বলে আশা করেছিল। কেবল মেয়েটির চোখের উজ্জ্বলতা হারিয়ে গেছে। নিতিনের চোখে আলো নেই, মুখে পেশির ঘনঘন সঞ্চার নেই। নিতিন মিইয়ে গেছে ঝরা পাতার সিন্ধুনীল রঙের মতোন!
বর্ষা চিরকালই বড় নির্মল মনের মেয়ে। কোনো কালেই কাউকে আগলে রাখার বেলায় সে ভূমিকা করতে জানে না। ভালোবাসা রচনার বাঁধাধরা নিয়ম মেনে চলে না। সেখানে ভূমিকা, ভাবসম্প্রসারণ, উপসংহারের নেই কোনো বালাই।
দু’পা এগিয়ে সে নিতিনকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরল। মুখ ফুটে কথা বলল খানিক বিলম্বে।
–‘আমার আপু। কি হয়েছে তোমার? সবাইকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছো? নিতিন যে সকলের প্রিয় দুরন্ত চড়ুইছানা। সে সারাক্ষণ উড়ে বেড়াবে, ছটফট করবে, বিষম অনাচারে মাতিয়ে রাখবে সারাবাড়ি। তা না করে এভাবে চুপচাপ রুদ্ধ ঘরে বসে থাকলে কি হয়? ভালো দেখায় বলো তো? ‘
নিতিন নিরুত্তর থেকে বর্ষার কাছে এগিয়ে আসে। তারপর হঠাৎ অক্লেশে গ’লা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। অনেকটা শব্দ করে।
তিন দিন পর এই প্রথম বাঁধ ভাঙে ওর কান্নার। এতদিন নির্বাক থেকে সকলকে বিষম পীড়ন করে সে যেন বর্ষাকেই একান্ত করে খুঁজছিল। পাওয়া মাত্র সকল রুদ্ধ আবেগের দেয়াল একসঙ্গে আছড়ে পড়েছে। টাল সামলাতে বর্ষা একটু হিমশিম খায়। গভীর মমতায় ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
–‘ নিতু, যত ইচ্ছে তুমি কাঁদো। কিন্তু এই কান্নার শেষে যেন একটা স্বচ্ছ হাসিমুখ দেখতে পাই। এই কান্নার পর আর কখনো কাঁদবে না তুমি।’
বর্ষার কথা হয়তো নিতিনের কানেই যাচ্ছিল না। কিন্তু তার ছোয়ায় যে আন্তরিকতা ছিল, তার মাধুর্যে নিতিন খুব দ্রুত বিবশ হয়ে পড়ল। বর্ষাকে আশ্রয় করে দীর্ঘ সময় নিজের মতো দুঃখবিলাস করল। বর্ষা বাঁধা দিল না। সে জানে। একটা সময় নিতিন নিজেই খুলে বলবে সবটা।
অশ্রুজলে লালিমায় ছেয়ে যাওয়া চোখ মুছে একসময় কথা বলতে আরম্ভ করে নিতিন।
–‘ভাবি তুমি জানো আমার অপরাধের কোনো ক্ষমাই হয় না। কখনো হয় না। তুমি ভাবতে পারবে না তোমার সামনে বসে থাকা এই মেয়েটা কত জঘন্য কাজ করেছে।
আমার খুব বাজে কোনো শাস্তি পাওয়া উচিত। সবাই জানতো নিতিন বাবার জন্য প্রাণ দিতে পারে, সবার মন থেকে মুছে গেলেও নিতিনের মনে তার বাবা চিরকাল নিজ স্থানে অম্লান থাকবে। অথচ সেই আমি, একটা সস্তা ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে আমার বাবাকে ভুলেছিলাম!
তুমি বলেছিলে না প্রেম হারাম? হারামে জড়ানো মানে জেনেশুনে আল্লাহর অবাধ্যতা করা। অথচ দিনের পর দিন অসঙ্কোচে আমি তাই করে এসেছি। আমি আমার আল্লাহর বিধান অমান্য করেছি, বাবার কথা ভুলেছি। আর..আর কি করেছি তুমি জানো?
দাভাইয়ের টাকা চুরি করেছি। রচনার মতো অনর্গল মিথ্যা বলেছি কাছের মানুষ গুলোর কাছে।
ভাবি, বলো তো আমার মতো বাজে মেয়ে আর আছে?’ নিতিনকে দারুণ মরিয়া দেখায়। সে হঠাৎ দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ায় স্বস্থান ছেড়ে। অধীর হয়ে বলে,
–‘ তুমি দূরে থাকো ভাবি। আমার কুল’ষিত ছোয়া যেন তোমার গায়ে না লাগে। আমি খুব খারাপ মেয়ে। চিরকাল যারা ভালোবেসেছে, সস্তায় পাওয়া দুদিনের প্রেম তাদের সবাইকে ভুলিয়ে দিয়েছে আমার মন থেকে। ভাবতে পারো তুমি? আমি আমার আল্লাহকেও মনে রাখিনি সেই দিনগুলোতে। তখন যদি আল্লাহ আমার মৃত্যু লিখে রাখতেন! আমি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পেতাম না। চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বল’তাম। কিন্তু আল্লাহ এর পরও আমাকে দয়া করেছেন, সুযোগ দিয়েছেন। তাই এখন আমি দিনরাত শুধু ক্ষমা চেয়ে যাই। কখনো যদি আল্লাহ আমাকে কবুল করে নেন। ‘
নিতিন শিশুর মতো কাঁদছে। বর্ষার বুক ভেঙে গেল। মেয়েটা কত সহজে নিজের যা কিছু ভুল ছিল, সেসব স্বীকার করে নিয়েছে। তবুও ওর ভেতরটা আগুনের হল্কাবন্দী হয়ে আছে। চিরকাল কি এভাবেই সরলেরা কষ্ট শুধু পায়? ওদের ভুল যত না অন্যকে আঘাত করে, তার চেয়ে অনেক বেশি ওরা নিজেরাই জ্বলেপুড়ে অঙ্গার হয়। বর্ষা বোঝে নিতিনের ভুল ভাঙানো দরকার। অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়ার পর ক্বলবে আর কোনো পাপ অবশিষ্ট থাকতে পারে না।
–‘ নিতিন, আল্লাহ কে তুমি কতটা জানো? একটা গল্প শুনবে?
একদিন এক লোককে তার বাচ্চা ছেলে জিজ্ঞেস করল, বাবা আকাশ কত বড়? লোকটির মুখ মেঘে ছেয়ে গেল। বলল, ‘অনেক বড়। কিন্তু যত বড়ই হোক। আমার পাপের পরিমাণ ওই আকাশের চেয়েও বিশাল। ‘
লোকটি পাপী ছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল নিজের অগণিত পাপের জন্য অনুশোচনা কারী। তুমি জানো? শুধু মাত্র এই কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। কারণ সে নিজের পাপ সম্পর্ক অবগত ছিল। এবং জানতো আল্লাহর রহম ছাড়া এই পাপের শাস্তি থেকে তার মুক্তি নেই।
তোমার পাপ কি আকাশ ছুয়েছে নিতিন? আকাশ ছোয়া পাপও নির্দ্বিধায় এক মুহুর্তে ক্ষমা করেন যিনি। তিনি তোমার এই সামান্য অপরাধ ক্ষমা করবেন না বলে ভাবছো?
কুরআনে রব্বে কারীম কি বলেছেন জানো,
‘যে গুনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়।’ [১]
তাহলে তুমি কেন হতাশ হচ্ছো, এতটা ভেঙে পড়ছো নিজেকে নিয়ে?
নিশ্চয়ই পাপ করে যে তওবা করে নেয় আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন।’
বর্ষার কথা নিতিনের অন্তঃস্থিত কোণ ভেঁদ করে যেন আরও গহীনে, লুকায়িত ক্বলবের প্রাচীরে আ’ঘাত করল। ক্ষণিকের মাঝে ওর মুখের সকল পেশির সঞ্চারণ স্পষ্ট হল। মনে হয় যেন পথহারা এক নিঃসঙ্গ রাহী, আলোহীন পথে চলতে চলতে হঠাৎ দৃঢ় অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে। নিতিনের চোখের ভাস্বরতা ক্রমে ফিরে আসছিল।
বর্ষাকে অবাক করে দিয়ে নিতিন কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ হেসে উঠল। সত্যিকারের হাসি।
-‘ ভাবি, তুমি কি জাদু জানো? এইমাত্র আমার সব আফসোস দূর হয়ে গেছে। যে আফসোস আমাকে দিনরাত কাঁদাচ্ছিল, পোড়াচ্ছিল, কষ্ট দিচ্ছিল। তোমার কথার প্রভাবে এটা হয়েছে। আল্লাহ চেয়েছেন তোমার মাধ্যমেই আবার আমার হারানো আমিকে খুঁজে পাই।
আমি সব ভুলতে চাই। আল্লাহকে ভালোবাসতে চাই। আবারও আব্বাকে রোজ রোজ দো’আয় স্মরণ করতে চাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে তো?’
হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে ওর মুখে অপলক তাকিয়ে রইল বর্ষা। আল্লাহর কাছে বারবার নিতিনের জন্য দো’আ করছিল সে। কিন্তু আল্লাহ এত সহজ করে দেবেন সবকিছু সে ভাবেইনি।
তবুও বর্ষা গোপনে একবার প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের জন্য!
ওর দুঃখ গুলো যদি নিতিনের দুঃখগুলোর মতো এমন পলকা হয়ে হাওয়ায় ভেসে যেত। আহ! যদি এভাবেই ওর জীবনের হারিয়ে যাওয়া সকল আলোরা এক এক করে আসতো ফিরে!
বর্ষা নিজের ঘরে ফিরে এলো। হঠাৎ বড় বেশি হাসফাস করছে ওর ভেতর টা। মনে হচ্ছে যেন নিতিনের সকল কষ্ট, আর সেই কষ্টের ছটফটানি গুলো সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে, ওর গায়ে পুশ করে দিয়েছে কেউ। বর্ষা বুকে হাত রাখে। এতো কষ্ট কেন হচ্ছে! ভেতরে যেন দাউদাউ করে জ্বলছে দাবানল। সেই দবানলের উৎস কি তা সে জানে না। একে কি মুড সুইং আখ্যা দেয়া যায়? মুড সুইং কখনো এতো বিভৎস হয়?
নাব্য কোনোদিন ওকে ভালোবাসেনি, নাব্যর বুকের বা-পাশে, হৃৎপিণ্ড টা ওর জন্য স্পন্দিত হয়নি কখনো। অথচ নাব্যর একটা অংশ দিনের পর দিন সে নিজের দেহে ধারণ করে বেড়াচ্ছে। কত ভয়াবহ শারীরিক মানসিক যাতনার মধ্যে দিয়ে রোজ রোজ আগামীর জন্য বাচিয়ে রাখছে সেই প্রাণের অংশ টুকুকে। এত কষ্টের প্রতিদানে, প্রাপ্তির খাতা আজও শুধু শূন্যতায় খা খা করে!
এইতো, আজ ভরদুপুরেই। নিজের মা ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কত জঘন্য ছিল সেই পদ্ধতি। অভিশাপ আর অকথ্য গা’লির বাক্যবাণে মা আজ ওর বুক পূর্ণ করে দিয়েছে। এর পর আর কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না। রাখার স্থানও বোধহয় সংকুলান হতো।
না চাইতেও এমন শত শত দুর্বি’ষহ মুহুর্তের ছবি বর্ষার মনের চিত্রপটে ভেসে ওঠে। নিজের ওপর এতো ভয়ানক রাগ জন্মায়। যে রাগে অন্ধ হয়ে সে দাঁতে দাঁত চে’পে কাঁদতে শুরু করে। না চাইতেও এতো কিছু কিভাবে ঘটে গেল ওর জীবনে?
সেই যে একটা সময় ছিল। বর্ষা কিশোরী ছিল যখন। সারাক্ষণ আনন্দে নেচে গেয়ে বেড়াতো, তখন কোনো দুঃখই ওকে ছুতে পারতো না। ইচ্ছে হলেই মনটাকে নিয়ে কল্পনায় পাখির মতো উড়ে বেড়তো সে। সকল দুঃখ ফিঁকে হয়ে আসতো। স্কুল পালিয়ে ফুচকার দোকানে ভিরতো, রাস্তার সস্তা আঁচারে মন ভরাতো, ফুচকার ঝাঁঝে চোখ বেয়ে জল গড়ালেও মুখে থাকতো বিশ্ব জয়ের হাসি!
সেই দিনগুলো যেন অন্য এক জীবনের কথা! আজকের রূঢ় বাস্তবে সেসব প্রহসনের মতো মনে হয়। সত্যিই কত বদলে গেছে সে।
নাহ! এতো এতো প্রাপ্তির মাঝে নিজের করে কিছুই পাওয়া হয়নি ওর। বর্ষা বোধহয় আর কিছু পেতেও চায়না। সে মেনে নিতে শিখে গেছে। যাকিছু ঘটুক, সবই আজকাল মেনে নিয়ে আরাম বোধ করে।
খুব ধীরে ধীরে অপ্রকৃতস্থতার পর্যায়ে পৌছোতে থাকে বর্ষার বিচ্ছিন্ন চিন্তা পূর্ণ মস্তিষ্ক। বিছানায় হেলে মাথা চে’পে ধরে বসে থেকে হঠাৎ গন্ধটা টের পায়। প্রথমে কয়েলের গন্ধ ভেবে একটু স্বস্তি হলেও পরমুহুর্তেই ব্যাপার টা ওর মাথায় ধরে। ঘরে ও ছাড়া দ্বিতীয় কারো অস্তিত্ব নেই, তবে কয়েল জ্বালল কে?
তেমন কিছু না ভেবে খেয়ালের বসেই ভিরানো দরজা ঠেলে বর্ষা বারান্দায় নামে। এবং থমকে দাঁড়ায়। মনে হয় যেন এই মাত্র ওকে দশ ইঞ্চি পুরুত্ব বিশিষ্ট একটা কংক্রিটের দেয়ালের নিচে চা’পা দেয়া হয়েছে।
অন্ধকার বারান্দায় নিমগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে নাব্য। মুহুর্তে অন্তরটা ভয়ানক আ’ঘাতে ছেয়ে যায় ওর। এবার সত্যিই সহ্যের সকল সীমা অতিক্রান্ত করে বর্ষার উন্মনা মস্তিষ্ক। সে বোধহয় মনে মনে দু একবার আল্লাহর কাছে আর্জিও জানায় ক্রোধ টা দমন করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে! খেই হারিয়েছে ওর সমস্ত বোধশক্তি। এই লোকটা একদিন তাকে কথা দিয়েছিল আর কোনোদিন সিগারেট স্পর্শ করবে না৷ অথচ ক’টা দিন পেরিয়ে, আবেগ টা একটু থিতু হতেই কি সহজে সেসব ভুলে ফের পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছে!
মুখের ভাষা হারিয়ে বর্ষা নির্বাক তাকিয়ে থাকে। মৃদ্য পায়ে হেটে দাঁড়ায় নাব্যর পাশে। পাশ ফিরে অকস্মাৎ ওকে দেখে নাব্য চমকায়। বোধহয় ওর হৃদকম্পন একটু দ্রুত হয়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে ফের সিগারেটে মন দেয় সে। তাকে দেখে আর বিচলিত মনে হয় না।
বর্ষা গোপনে গোপনে আবারও অনুচ্চারণে বলে,
ও আল্লাহ, তুমি আমাকে একটু ধৈর্য দাও। সবর দাও।’ বারবার একথা বললেও বর্ষা ভুলে যায় সবরের পরীক্ষা টা একান্তভাবে নিজেকেই দিতে হয়। সবরের শেষে হয়তো রবের কাছথেকে মিলবে পুরষ্কার। কিন্তু সহসাই বর্ষার ধৈর্য চুত্যি ঘটে।
দাঁত চেপে কাঁপা কাঁপা স্বরে উচ্চারণ করে,
-‘ আপনি বলেছিলেন আর কখনো… কখনোই এসব খাবেন না? বলেন নি?’
নাব্য নিরুত্তর।
পায়ের রক্ত মাথায় উঠে শিরায় শিরায় আগুনের হল্কা ছড়াতে থাকে। বর্ষার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসে। যন্ত্রচালিতের ন্যায় সে একই কথা কয়েকবার উচ্চারণ করে, ‘আমি মরে গেলেই ভালো। আমি মরে গেলেই আপনি খুশি হবেন তাইনা?’ তারপর জড় মস্তিষ্কে সেদিনের মতো ফের একটা অঘটনের পুনরাবৃত্তি করে। নাব্যর হাত থেকে একটানে সিগারেট ছিনিয়ে নিয়ে সেটা নিজের দু ঠোঁটের ভাজে রেখে জোড়ালো একটা শ্বাস টানে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাশির দমকে পুরো শরীরে কাপুনি উঠে যায় ওর। নাব্য তখনো নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে বিমূঢ়ের ন্যায়। হঠাৎ মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।
–‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? এটা কি করলে?’
বর্ষা নিজেও হতভম্ব হয়ে যায়। এক লহমায় ফিরে আসে ওর স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি। দেহ ছেড়ে অপ্রকৃতস্থ আত্মাটা মুহুর্তে ছুটে পালায়। শরীরে প্রবল কষ্টের একটা ঢেউ এসে বাড়ি খায়। তার প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী হয় বর্ষা। হড়বড় করে মুখভর্তি বমি করে, নাক দিয়ে রক্তের নোনা স্রোত বয়ে যায়। নাব্যর চোখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তে কি থেকে ঘটে গেল বুঝে উঠতে পারে না।
বমিটা সম্পুর্ন তার শার্টের ওপর পড়েছে। বর্ষার মুখ জমে যায় ত্রাসিত যন্ত্রণা আর ভয়ে। ও ভাবে সমুদ্রের বুকে, সেই ঝড়ের রাতের মতো নাব্য আজও ওকে একটা জোড়ালো চ’ড় কষাবে।
–‘আ…..আমি ইচ্ছে করে করিনি। এক্ষুনি পরিষ্কার করে দিচ্ছি…।’ বলতে বলতেই গ্রিলে হাত রেখে হেলে পড়ে বর্ষা। উপস্থিত শারিরীক যাতনার কথা ভুলে নিজের হয়ে অনেক কথা সে বলতে চায়। নাব্যর সম্ভাব্য আ’ক্রমণ থেকে বাচবার জন্য। কিন্তু তার আগেই ক্রমে চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসে ওর দু’চোখে। চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে যাবার আগে পিছলে গিয়ে ফুলের টবে মাথায় একটা বা’রি খায়। মাটিতে পড়ে যাবার আগে নাব্য ওকে ধরে ফেলে। হুশ হারানোর আগে এইটুকু ভেবে বর্ষার স্বস্তি হয়। আজ নাব্য ওকে চ’ড় মা’রেনি!’
চলবে…..
একদিন নববর্ষা -৪১
অদ্রিজা আশআরী
___________
নিতিনের সকল নিষ্প্রভতার স্থায়ী অবসান ঘটে সেই সকালে। যেদিন নিজেকে নতুনতম আবরণে জড়িয়ে, দীর্ঘ দু মাস পর নিতিন পা রাখে বাড়ির বাইরে। চৌকাঠে পা ফেলতেই বৈশাখের প্রথম দুর্নিবার মাতাল হাওয়া, তীব্র প্রতাপে ওর গায়ে এসে বা’রি খায়। মাখিয়ে দেয় স্নিগ্ধতার প্রলেপ। দ্বিতীয় পদক্ষেপ ফেলার আগে নিতিন থমকায় অল্পকালের জন্য।
কখনো আবেগতাড়িত মেয়ে সে ছিল না। অথচ আজ কিছু হারিয়ে, কিছু পেয়ে ওর ভেতর টা ওলটপালট হয়ে গেছে হাহাকারের নিঃসীম আবেশে। বাবাকে হারানোর পর রাশিকের দেয়া আঘাতটা ছিল বড় বেশি আগ্রাসী।এলোমেলো করে দিয়েছিল নিতিনকে ভেতর থেকে। আঘাতের পর আঘাত। হারানোর পর আবার কিছু হারানো…
কিন্তু এর বিনিময়ে আজ যা পেয়েছে, তার জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় হয়তো কখনো শেষ হবে না আল্লাহর কাছে। পড়নের আকাশী রঙা বোরকা আর সাদা হিজাবের ওপর চোখ রেখে নিতিন সেকথা ভাবে। ওর বোরকা পড়ার সিদ্ধান্তে বিরোধীতা করেনি কেউ। যে নিতিন থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট, ছোট ছোট টপস্ পড়ে অনায়েসে বাড়ির বাইরে চলে যেত আজ তার গায়ে এই অতি মার্জিত পোশাক দেখেও চোখ রাঙায়নি একজনও!
জীবনে হঠাৎ আসা ঝড়ের তান্ডবে গুমরে যাওয়া নিতিন আচমকাই সিদ্ধান্ত নেয় জীবনের গতিপথ বদলে ফেলার। মূলত এই আঘাতটাই ওকে ইন্ধন যোগায়। অনলাইন থেকে বোরকা নেয়। ঘরের আবহ বদলায়। যে ঘরে দিনরাত সাউন্ড বক্সে ইংরেজি গান বাজতো সেঘরই মুখরিত হয় নিতিনের দ্বিধাজড়িত ভাঙা সুরের কুরআন তিলাওয়াতে। নিতিন সারাক্ষণ ল্যাপটপে মুখ গুজে ইমানদীপ্ত লেকচার সিরিজ গুলো শোনে। রেইনড্রপস মিডিয়ার ‘সীরাহ’, নোমান আলী খানের লেকচার, ইসলামের মৌলিক বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জনের জন্য ছোট ছোট অডিও ক্লিপ।
প্রকৃত মেধাকে কেউ কখনো লুকিয়ে রাখতে পারে না। সে যে পরিস্থিতিতেই থাকুক, মেধা নিজেকে প্রকাশ করবেই। এই সুক্ষ্ম মেধাশক্তির নিমিত্তেই কিনা, অল্প কদিনে নিতিনের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তার ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। নিতিন বোঝে এবার গন্তব্যে বাছাইয়ে সে কোনো ভুল করেনি।
ভাইয়ের বেপরোয়া স্বভাবের কিছুটা ছোট কাল থেকেই নিজের মধ্যে ধারণ করেছিল নিতিন। সেই বেপরোয়া মানবীয় ধাত, ওকে শিখিয়েছিল অন্যের ধ্যান ধারণা সম্পর্কে নির্লিপ্ত হতে। ওকে নিয়ে কে কি ভাবছে, ওর আচরণ অন্যের মনে কি প্রভাব ফেলছে এই নিয়ে কখনো বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনি নিতিন। ধীরে ধীরে এর প্রভাবেই ওর মাঝে একটা প্রবল আগ্রাসী মনোভাবের আভাস পাওয়া গেছিল।
নিতিনের সেই বেপরোয়া স্বভাবটাই আজকের এই নতুন পথচলাকে ওর জন্য সহজ করে দেয়। বোরকা পরিহিতা নিতিনকে দেখলে কে কি ভাববে তা নিয়ে কোনো সংকোচ ওর মধ্যে আসেনা। তবুও নিতিনের প্রবল ধারণা হয়েছিল প্রথম আঘাত টা হয়তো মায়ের দিক থেকেই আসবে। আর যাকেই হোক, মাকে তো সে এড়াতে পারেনা!
মা বিরোধিতা করলে নিশ্চিত ভাবে নিতিনকে পরাস্ত হতেই হতো। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এইযে নিতিনের এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী পরিবর্তনে রাফিয়া অনুমাত্র প্রতিবাদ করেন না। সেদিন সকালে নিতিন যখন বোরকা পড়ে স্কুলে যাবার জন্য বেরিয়ে আসে, রাফিয়া থমকান ঠিকই। কিন্তু পরমুহূর্তে প্রায় হাসিমুখে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতে রাজি হন। হয়তো ভাবেন ছোট কাল থেকে বাবা ভাইয়ের অতিরিক্ত আহ্লাদে মেয়ের ভাবপ্রবণতার যেরকম বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছিল, সেই দুর্ঘটনাটার পর নিতিন স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেও অস্বাভাবিক হতো না। তার চেয়ে এই পরিবর্তন টা ভালো। অন্তত অল্পের ওপর দিয়েই দায়টা মেটানো তো গেছে!
বৈশাখের মাতাল হাওয়ায় থমকে যাওয়া পা জোড়া নিয়ে, উদ্ধেলিত বক্ষস্থলের দ্রিমদ্রিম শব্দটাকে বহু কষ্টে আড়াল করে নিতিন চৌকাঠ পেরোয়। কলের পুতুলের মতো গাড়িতে উঠে বসে। একসময় ওর হৃদকম্পন স্বাভাবিক হয়। ব্যাক সিটে মায়ের পাশাপাশি বসে সেদিন পুরনো শহর দেখে নিতিন নতুন চোখে। সেই একই পুরনো ফেনীল আকাশ, রোজকার শহুরে রাস্তায় সেই একই তীব্র যানজট। তবুও আজ সবকিছু বড় অর্বাচীন আর আনকোরা হয়ে ধরা দেয় নিতিনের দুচোখে। উচ্ছ্বাসিত শিশুর মতো এই সাধারণ দৃশ্য দেখে নিতিন উৎফুল্ল হয়। আর বোঝে এই উচ্ছ্বাসের সবটুকু কৃতিত্ব ওই একফালি আচ্ছাদনের।
সেই মুহুর্তে নিতিন একটা কঠিন সত্যি প্রগাঢ় ভাবে অনুধাবন করে। বোঝে সেদিনের সেই সন্ধ্যাটা ওর জন্য বিশাল একটা ব্লেসিং হয়ে এসেছিল রবের পক্ষ থেকে। সেই কালরাত্রিটা না এলে কখনো নিতিনের উপলব্ধি বোধ জাগ্রত হতো না। নিজেকে আমুল বদলে ফেলে এই নতুনের পথে যাত্রাটা এতো সহজ হতো না কখনো। সবকিছু পূর্বাবস্থায় থাকলে রাফিয়াই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতেন। আকাশে ডানা মেলে ওড়ার বয়সে স্বেচ্ছায় নিতিনের এই ডানা ছেটে ফেলার সিদ্ধান্তকে কখনো নিরবে মেনে নিতেন না তিনি। নিতিনের মনে পড়ে কুরআনের সেই আয়াত টা। ‘নিশ্চই কষ্টের পর রয়েছে স্বস্তি। ‘
নিতিন জানালা থেকে মুখ ফেরায়। রবের কাছে কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে আসে ওর মস্তক। আজ যা কিছু পেয়েছে তা শুধুই রবের দান। ওর কোনো কৃতিত্ব নেই। বিন্দুমাত্র নেই। এমনকি কখনো এই দিনের জন্য রবের কাছে দুহাত তুলে আর্জি পর্যন্ত করেনি সে। তবুও তিঁনি শুনেছেন। নিতিনের অব্যক্ত চাওয়া গুলো এতো সুন্দর উপায়ে পূর্ণ করে দিয়েছেন। এক হাতটি দ্বারা অন্য হাতের মুঠো শক্ত করে চে’পে ধরে সে। অশ্রুরা নিরবে এসে হাজির হয় তার চোখের কোলে।
————–
স্কুলে নিতিনের এই নতুন বেশভূষা নিয়ে বিশেষ শোরগোল করে না কেউ। ক্লাসের মেয়েরা নিতিনের বর্তমান জীবনের দুর্যোগ সম্পর্কে অনেকটাই অবগত ছিল। এসব খবর কখনো চাপা থাকে না। তবুও নিতিনের এই নবরূপটা ওদের মনে আবার নতুন করে কৌতুহলের উদ্রেক করে। যদিও নিতিনের অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখ আর নির্লিপ্ততা দেখে একসময় সেটুকুও দূর হয়।
সেদিন বিকেলে নিতিন বাড়ি ফেরে একটা ঝরঝরে প্রশান্ত মন নিয়ে। ফ্রেশ হয়ে দু’মুঠো খাবার মুখে পুরেই ওপরের ঘরে রওনা দেয়। সেখানে গিয়ে বর্ষাকে না পেয়ে উদাসভাবে নেমে আসে নিচে। রিনি জানায় রাফিয়া বর্ষাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেছেন। অতএব শেষ ভরসা হিসেবে নিতিন দাদির ঘরে উঁকি দেয়।
দরজার ফাঁকে ওর একফালি মুখ দেখে দাদি বিচিত্র ভঙ্গিমায় হেসে ওঠেন। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকেন।
নিতিন ছুটে এসে দাদির গা ঘেঁষে বসে। আড়চোখে দাদির সহাস্য মুখখানা দেখে ভ্রুকুটি করে। দাদির ভাঁজ পড়া গাল দুটো আলতো ভাবে টেনে দিয়ে বলে,
–‘এই ওল্ড বিউটি। তুমি এভাবে হাসছো কেন?’
–‘আমি বুড়া মানুষ। মাথায় কত কি ঘুরে। সেইসব ভাইবা হাসি পাইবার ই পারে। আমার কথা ছাড়। তোর কথা ক।
তুই নাকি আজ বিরাট এক কাম করছস?’
উত্তর না দিয়ে নিতিন মুখ টিপে হাসে একটু।
–‘এইডা কুনু কথা! তুই বুরকা পইরা স্কুলে গেলি সেই খবর আমার জানতে হইল রিনির কাছে? একবার এই বুড়িরে দেহায়া গেলে কি হইতো? নিজ চোক্ষে দেখতাম আমার নাতনিরে বুরকায় কেমন লাগে! ‘
আরক্ত মুখে নিতিন বলে
–‘সরি দাদি। আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু.. এমন লজ্জা করছিল। কতবার তো ভাবলাম আজ বরং থাক। কাল থেকে নাহয় বোরকা পড়ে যাবো। তারপর অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের মনকে সুস্থির করলাম। তোমার কাছে এলে নির্ঘাত বোরকা ফেলেই চলে যেতাম। তাই আর আসিনি।’
দাদি পরম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন তার একসময়কার উগ্র আর ভীষণ আধুনিকা নাতনির মুখপানে। আজ নিতিনের চোখের চাহনিতে, গলার স্বরে কোনো উগ্রতা নেই। বরং ভীষণ এক নম্রতার স্নিগ্ধ আবেশে আচ্ছন্ন সব। দাদির বুঝতে বাকি রইল না কিসে তার অমন উন্নাসিক, আত্মানুরাগী নাতনিকে এমন বিনয়ের চাদরে ঢেকে দিয়েছে।
ভাবনাটা মনে আসতেই দাদি ভীষণ প্রবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বর্ষার আগমনে এই পরিবারে যে বিশাল এক বিপ্লব ঘটে গেছে তার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি নিজে। আশির কোঠা পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছে অনেক কিছুই আজকাল তিনি সাধারণের আগে আঁচ করতে পারেন।
বর্ষাকে কিছুই করতে হয়নি। ওর উপস্থিতিটুকুই ছিল যথেষ্ঠ। যার প্রভাবে রাফিয়ার মতো ভীষণ দুনিয়া মুখী মানুষ পর্যন্ত নিজ জায়গা থেকে টলতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাফিয়া চিরকাল ভালো গৃহিণী হবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ঠিকই অথচ কখনো হতে পারেননি সন্তানের জন্য আর্দশ মা। তার চোখের ওপর দিয়ে নাব্য দিনদিন উচ্ছনের পথে গেছে, নিতিন উগ্র হয়ে উঠেছে। তিনি কখনো বাঁধা দেননি।
ছেলেমেয়ের বিপথে যাবার বাজে প্রভাব যখন পরিবারে পরেছে কেবল তখনি বিষম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। হা-হুতাশ করেছেনে, কেঁদেকেটে একাকার হয়েছেন।
বর্ষা তাকে উপলব্ধি করিয়েছিল হা-হুতাশ করার চেয়ে সন্তানের জন্য রবের কাছে দুহাত তুলে দুফোঁটা চোখের জল ফেলা কত উত্তম! বর্ষার সংস্পর্শে এসে রাফিয়া সালাতে নিয়মিত হয়েছিলেন। টিভিতে সারাক্ষণ মত্ত হয়ে হয়ে থাকার বদলে হাতে তুলে নিয়েছিলেন বই।
আর অন্য নির্দশনটি তো তার চোখের সামনেই উপস্থিত! দাদি জানেন নিতিনের এই বদলে যাওয়ার পেছনে কোথাও না কোথাও বর্ষার অধিষ্ঠান রয়েছে। উপস্থিতি প্রচ্ছন্ন রেখেই আর সকলের মতো নিতিনের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে ওর সৎ আদর্শ।
অথচ! অথচ নিজের সবচেয়ে বড় খুটি, ঝড়ের মুহুর্তে শেষ অবলম্বন। নিজ স্বামীকে একবিন্দু বদলাতে পারেনি বর্ষা। ভালোবাসার কাছে হার মানেনি নাব্যর কোনো স্বকীয়তা। সে আগে যেমন বন্য, বেপরোয়া ছিল এখনো তাই রয়েছে। ব্যাপার টা শোনায় প্রহসনের মতো। এ যেন সারা পৃথিবী শুচিতায় মুড়িয়ে শেষে নিজ ঘরেই নোংরা জলের ছড়াছড়ি!
————-
দিন হারিয়ে যায়, আবার দিন আসে। পুরনো সে দিনের সুখ, স্মৃতি আর সময়ের ওপর এসে পড়ে নতুন দিনের প্রলেপ। আবারও সুখ আসে, স্মৃতি গড়ে ওঠে, সময় রঙিণ হয়। দিনশেষে হারিয়ে যায় পুরনোর পথ ধরে।
সময়ের সেই রেশ ধরেই আবার বৈশাখ এসেছে। বৈশাখ মানে যেন প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনেও কিছু উত্তাল ঝোড়ো দিনের আবির্ভাব। ঘনঘন দূর্যোগের তাণ্ডব, ভয়-ভীতি আর অনিশ্চয়তার শংকা…
বৈশাখ যেন শোকে মাতম হবারই মাস। তাই বুঝি নাব্যর পুরনো ক্ষত চুইয়ে আবার রক্তক্ষরণ হয়। হৃদয়ে হয় অপ্রতিরোধ্য ভাঙচুর।
আমার ক্লান্ত মন ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন,
ঘর ভরা দুপুর,
আমার একলা থাকার সুর,
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায় কতদূর।
মাতালের মতো এলোমেলো ভারী আওয়াজে কথাগুলো আওড়ায় নাব্য। ঝড়ের রাতের নির্বাক একলা পথে চলতে চলতে একসময় সে খেই হারায়। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হয় মেঘের গর্জন। নির্জন হাইওয়ে ধরে শো শো শব্দ তুলে মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি পাশ কাটিয়ে যায়।
সুরহীন ভাঙা স্বরে নাব্য আবারও আওড়ায়..
আমার ক্লান্ত মন ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন….
শ্রান্ত পায়ে হেটে একসময় বাড়ি পৌঁছায় সে। গেটের দারোয়ান তখন ঘুমে বিভোর। হয়তো ভেবেছিল গাড়ির হর্ন শোনা মাত্র শশব্যাস্ত হয়ে উঠে গেট খুলে দেবে। কিন্তু আজ নিজ পদযুগল দ্বারা হেটেই বাড়ি ফেরে নাব্য। অবিরত কিছুক্ষণ ধা-ক্কা দেয়ার পর দারোয়ান গেট খোলে। পরম বিস্ময়ে তাকায় নাব্যর পানে। নাহ, পেছনে কোনো রিকশা, ক্যাব কিছুই নেই। তবে কি গাড়ি ছাড়া ফ্যাক্টরি থেকে এতটা পথ হেটে ফিরেছে নাব্য?
নাব্য ওর প্রশ্নাতুর চাহনির পরোয়া না করে পা বাড়ায় ভেতরে। অনেক আগে থেকেই বর্ষা ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে আজ ঘরে পৌঁছে প্রথমেই চোখ স্থির হয় বর্ষার জাগ্রত অনুসন্ধানী চোখের ওপর। সেই পঙক্তি গুলো নাব্যর আবার উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে করে,
‘প্রতিনিয়ত যুঝতে যুঝতে আজ আমি বড় বেশি ক্লান্ত। তুমি কি পারো আমার সমস্ত মনের শ্রান্তি, চোখের অবসাদ দূর করে দিতে? দুঃখ শোনানোর মতো আমার যে আর কেউ নেই। এক জোড়া একান্ত ব্যাক্তিগত শ্রবণেন্দ্রিয় আমার ভীষণ প্রয়োজন, যে কর্ণকুহরদ্বয় শুধু আমার কষ্ট শুনেই খান্ত থাকবে। আর কারো দুঃখ সে জানতে চাইবে না কখনো…’
অনেক দিন পর নাব্যর মনটা আজ সেই সমুদ্রের বুকে ঝড়ের রাতের মতো বর্ষার দিকে একপেশে ভাবে হেলে পড়ে। ওর মনে হয় বর্ষার একটুখানি অনুগ্রহ ছাড়া আজ পাওয়ার মতো ওর আর কিছুই নেই। অথচ সেটুকুও কত কঠিন। অবাস্তব মনে হয়। বর্ষার অনুগ্রহ পাওয়ার অধিকার যে হারিয়েছে সে বহুকাল আগেই..
এইযে তার ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মন কাউকে একটা খুঁজছে দুঃখ গুলো বলে হালকা হবার জন্য। হয়তো আরও একটু বেশি কিছু চাইছে। কিন্তু কেন বর্ষা আজ ওর কথা শুনবে? ছুয়ে দেবে দুঃখ গুলোকে?
সেই প্রথম থেকে, বর্ষাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই তো দেয়নি সে। বর্ষার চাওয়া গুলো এতো বেশি সামান্য ছিল। অথচ সেটুকু পূরণ করতেও অপারগতা প্রকাশ করেছে চিরকাল। তবে আজ কেনই বা বর্ষা সহানুভূতি দেখাবে ওর প্রতি?
বিছানায় বসে বর্ষা তীব্র কটাক্ষবাণে নাব্যকে পর্যবেক্ষণ করে, মুখে একটিও শব্দ উচ্চারণ না করে। আলো আধারির নিস্তব্ধ ঘরে একটা নিঃশব্দ স্নায়ু’যু-দ্ধ চলতে থাকে ওদের মাঝে। বর্ষার তীব্র কঠিন শ্যেন দৃষ্টি দেখতে দেখতে নাব্যর ক্লান্ত মন আরও শ্রান্ত হয়ে পড়ে। ইচ্ছে হয় বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে এলোমেলো কিছু কথা বলে নিজের বিশৃঙ্খল মনটাকে একটু স্থানে আনতে। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অদৃশ্য এক দেয়াল। দিনে দিনে, তিলে-তিলে যে দেয়াল স্বেচ্ছায় গড়ে তুলেছিল সে। এতটা দূরে চলে গেছিল যে আজ একবার জড়িয়ে ধরার জন্য মনে মনে হাজারবার অনুমতি প্রার্থনা করতে হচ্ছে!
সাদা চোখে দেখলে হয়তো মনে হতে পারে বিবাহিত জীবনে হঠাৎ প্রাত্তন প্রেমিকার পুনরাগমনই নাব্যকে এতো দূরে ঠেলে দিয়েছে। গরানবনের সেই মাতাল প্রেম ও বিচ্ছেদের পর বর্ষার অচিন্তনীয় আগমনে নাব্য এতটা মোহাবিষ্ট হয়েছে যে স্ত্রীকে ভুলে, প্রাত্তনে মত্ত হয়েছে অনায়েসে। অথচ নাব্য জানে এসব সত্যি নয়। সে দ্বিচারিতা করতে চায় নি কখনো।
বর্ষা এসেছিল। নাব্য ওকে চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু বর্ষা যায়নি। বরং ডালপালা মেলে নাব্যর পাশেই একটা স্থায়ী ভিত গড়ে তুলেছে।
সেই প্রথমের দিনগুলোতে, রাহিলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বর্ষা পুনরাগমন করেছিল যখন। নাব্য বারবার ওর স্ত্রীর কাছেই আশ্রয় খুঁজেছিল। বলতে চেয়েছিল, ‘গরানবনের বর্ষাকে আমি আর চাইনা। ও যখনি আমার পাশে ভীরেছে, ভীষণ যন্ত্রণা আর অভিঘাতের আতিশয্যে আমার জীবনকে আচ্ছন্ন করেছে।’
কাতর অনুরোধে জানাতে চেয়েছিল, চলো আমরা অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে বর্ষার ছায়াও কখনো ভীরবে না। সেখানে আমরা একটা নির্মল জীবন গড়ব। কোনো দ্বিধা, সংকোচ, রোষাবেশ যেখানে আমাদের মাঝে থাকবে না। বর্ষার অপচ্ছায়ার বিষে কখনো বিষাক্ত হবে না সেই ভূখণ্ডের মাটি।’
অথচ নাব্য বলতে পারেনি। ঝোড়ো হাওয়ার মতো যখনই ওই অভিশপ্ত প্রেম এসে ওর শান্ত জীবন ওলট-পালট করে দিয়েছে, তখন নাব্য নিজের স্ত্রীর কাছে ছুটে যেতে চেয়েও বারবার পথ হারিয়েছে। অপরাধ না করেও নিজেকে ওর অপরাধী মনে হয়েছে। অশুচিতার ভয়ে স্ত্রীকে সে ছুতে পারেনি। নিজের ওপর তিলে তিলে জন্মানো ক্রোধের হল্কা অজান্তেই ছড়িয়েছে ওই নিরীহ মেয়েটির গায়ে। আর নাব্যর স্ত্রী ভেবেছে নাব্যর পুরনো প্রেম জেগে উঠেছে। তাই সে আজ আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে নাব্যর চোখে।
এভাবে দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। একে অপরকে ভুল বুঝতে বুঝতে… ভুলের একটা আস্ত প্রাসাদ গড়ে তুলেছে ওরা দুজনে। এখন আর কেউ এই দুর্ভেদ্য প্রাসাদ পেরিয়ে কাছে আসতে পারছে না। একটা দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, ভুল বোঝাবুঝি ক্রমে ওদের নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে…..।
চলবে……