পরীজান পর্ব-২৪+২৫

0
645

#পরীজান
#পর্ব ২৪
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

কোলাহল পূর্ণ শহরের রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা। গাড়ির হর্ণে কান তব্দা দেয়। ফুটপাত জুড়ে রয়েছে ছোটখাট দোকান। মানুষের ভিড়ে চলাফেরা করা মুশকিল। গ্রামে শীতকাল চললেও শহরে শীতের ছিটেফোটাও নেই। এ যেন চৈত্র মাস। লোকজনের মাঝে শীত নিজেই ঢুকতে পারছে না। কথাটা বেশ হাস্যকর মনে হলেও এটাই বাস্তব।
নাঈম রিকশায় বসে আছে। জ্যামে আটকে গেছে সে। আটকেছে গিয়ে একেবারে সূর্যের নিচে। গাছের ছায়া ও নেই সেখানে। তপ্ত গরমে ঘেমে একাকার সে। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। লাল বর্ণ ধারণ করেছে ফর্সা মুখখানা। পকেট থেকে রুমালটা বের করে ঘাম মুছে নিলো সে। জ্যাম ছাড়তেই রিকশা চলতে লাগল। শেখরের বাসার সামনে নামলো নাঈম। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল সে। চারতলা বিল্ডিং এর দোতলায় থাকে শেখর। কলিং বেল চাপতেই শেখরের ছোট বোন এসে দরজা খোলে। নাঈম কে দেখে সে খুব খুশির হলো। ভাইয়ের বন্ধু হিসেবেই অত্যন্ত ভালো জানে সে নাঈম কে। নাঈম সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তারপর সোজা শেখরের ঘরে চলে গেল। শেখর কে কিছু বলতে না দিয়েই বলল,’কি রে আমাকে না জানিয়ে চলে এলি?আমাকে বললে আমিও তো আসতাম।’

শেখর সোজা হয়ে দাঁড়াল বলল,’কাজ ছিলো।’
-‘কাজ তো থাকবেই বিয়ে বলে কথা। আমাকে একবার জানালি না। আর তুই নাকি আমাদের সাথে সম্পর্ক রাখবি না।’
-‘আরে আসিফ আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলো তাই ওসব বলেছি।’
-‘আসিফ তোর মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল না। সত্যি কথা বলতেছিল। এমনটা করার কারণ কি শেখর? তুই সব জেনেও এমন সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলি?’

-‘শোন,তুই কিন্ত পরীকে দেখিসনি। আমি দেখেছি। আমি বললে ভুল হবে আরো অনেকেই দেখেছে।’

-‘এক দেখাতে মোহ সৃষ্টি হয় শেখর। তুই তোর পরীকে ভালোবাসিস না। আর জানিসই তো আমি পরীকে,,’

নাঈম কে থামিয়ে শেখর বলল,’তুই তোর দেখিসনি তাহলে তুই কিভাবে ভালোবাসিস বল? আমি দেখে ভালোবাসতে না পারলে তুইও পারিসনি নাঈম। হ্যা মানছি আমি পরীর সৌন্দর্যে মোহিত হয়েছি তাহলে তো তুইও হয়েছিস। দেখিসনি পরীকে কিন্ত মুখের কথা শুনেই তোর এই অবস্থা আর আমার দেখে কি অবস্থা হয়েছে ভাবতে পারছিস?’

ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নিলো নাঈম। ছিঃ!!এতোটা জঘন্য মনের মানুষ শেখর তা আজ জানলো নাঈম। শেখরের দৃষ্টিভঙ্গি এতোটা কুৎসিত!!ওর মতো ছেলে পরীকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
-‘তোর দৃষ্টি যে এতো নোংরা তা আমার জানা ছিল না
শেখর। ওই মেয়েটার দিকে ভালোবেসে তাকানোর বদলে ললুপ দৃষ্টি দিচ্ছিস?’
-‘আমি খারাপ নজরে দেখিনি পরীকে। তুই যদি তখন একবার পরীর স্নিগ্ধ মুখশ্রি দেখতে তাহলে তুইও এক দেখায় আবার নতুন করে মেয়েটির প্রেমে পড়তি। বিশ্বাস কর আমি খারাপ চোখে দেখিনি। আমি কেন কোন পুরুষ ই বিকৃত নজরে দেখার কথা ভাবতেও পারবে না। মোহে আটকে গেলেও একদিন ঠিকই ভালোবেসে আগলে রাখব।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নাঈম বলে,’আমি মানতে পারছি না শেখর। বন্ধু হয়ে এইভাবে বেঈমানি করে ঠিক করলি না।’
-‘নিজের পছন্দ কে পাওয়াটা বেঈমানি নয়।’
নাঈম আর কথা বলল না। চলে যেতে উদ্যত হয়েও ফিরে তাকালো। শেখর কে উদ্দেশ্য করে বলল,’যদি কোনদিন শুনি পরী তোর কাছে ভালো নেই সেদিন তোকে খুন করতেও আমি পিছপা হবো না।’

——-

শশ্মানে কাঠ পোড়ার ধোঁয়া উঠছে এখনো। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে বিন্দুর চিতায়। দূরে মাটিতে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্পান। নাহ আজ তার চোখে এক ফোটা জল নেই। সব শুকিয়ে গেছে। বিন্দুর কথাগুলো মনে পড়ছে খুব। বিন্দু তো বলেছিল সে সম্পান কে ভুলবে না। তাহলে আজ কেন ওকে ভুলে রেখে গেল? সম্পান কেও তো সাথে নিয়ে যেতে পারতো? হঠাৎই সম্পান শুনলো বিন্দু আগুনের ভেতর থেকেই যেন বলছে,’তোমার নামের সিঁদুর ছাড়া অন্য নামের সিঁদুর আমার মাথায় পড়ার আগেই যেন আমার মরণ হয়। আমি তোমার বউ হমু মাঝি।’
সম্পান তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়াল। ‘বিন্দু’ বলে দৌড়ে এগিয়ে গেলো আগুনের দিকে। কিন্ত তার আগেই কয়েকজন লোকেরা টেনে ধরে সম্পান কে। চেতনা হারিয়ে সম্পান ঝাপ দিতেও পারে ওই আগুনে। সম্পান চিৎকার করে বলতে লাগল,’আমি তোরে সিঁদুর পরাইছি বিন্দু। তাও আমারে রাইখা যাইস না। তোরে ছাড়া আমি ভালো থাকমু না বিন্দু।’

মহেশ সম্পানের পাগলামো দেখতেছে আর চোখের পানি ফেলছে। এখন মহেশের মনে হচ্ছে সম্পানের সাথেই বিন্দু ভালো থাকতো। ছেলেটা সত্যিই বড্ড বেশি ভালোবাসে তার মেয়েকে। কিন্ত এখন এসব বলে কি লাভ?? সেই বিন্দুটাই তো নেই। মহেশের এখন মনে হচ্ছে এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র দায়ী চন্দনা। চন্দনা যদি রাজি হতো সম্পানের সাথে বিন্দুকে বিয়ে দিতে তাহলে এসব হতো না। আদরের মেয়ে বিন্দুর এমন পরিণতি হতো না।
বিন্দুর শেষকৃত্য সম্পন্ন হতেই সবাই চলে গেল। সম্পান হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে কিছুটা ছাই হাতে নিলো। পানি দিয়ে আগুনের আভা কমানো হলেও এখনও ছাই বেশ গরম। তবে প্রেমিক পুরুষ সম্পানের হাত তা সয়ে নিলো। ছাই নিয়ে সে ছুটলো। গন্তব্য কোথায় তা সে নিজেও জানে না।

——

জমিদার বাড়িতে আজ যেনো ছোটখাটো অনুষ্ঠান। অন্দরের উঠোনের খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বসে আছে তিনজন মধ্যেবয়স্ক নারী। তারা তাদের ব্যাগ থেকে নানা ধরনের শাড়ি বের করছে। আবেরজান আর শেফালি একটা একটা করে পরীর গায়ে ধরে দেখছে। কোনটাতে পরীকে বেশি মানাচ্ছে। সবগুলো রঙেই পরীকে সুন্দর লাগছে। পরী নির্জীব হয়ে বসে আছে। রঙহীন হয়ে আছে মুখখানা। বিন্দু চলে গেছে আজ সাতদিন পার হয়ে গেছে অথচ কোন খবর পরী পায়নি। কে মারলো বিন্দুকে তাও জানেনি কেউ। পরী রোজ কুসুম কে দিয়ে খবর নেয়। সেদিনের পর থেকেই পরী ঘরবন্দি। আজকেই তাকে বাইরে আনা হয়েছে। আর আজকেই পরী জানতে পারলো যে শেখরের সাথে তার সামনের মাসে বিয়ে। অন্য কোন সময় হলে পরী হয়তো কিছু বলতো কিন্ত আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। প্রাণহীন মনে হচ্ছে নিজেকে। পরীকে নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে আবেরজান বলল,’এই,এমনে চুপ থাকলে হইবো?চোখ ঘুরাইয়া দেখ কোনডা পছন্দ হয়?’
বিরক্ত হলো পরী বলল,’তুমিই দেখো দাদি।’

-‘কাপড় পইরা তো আমি জামাইর কাছে খারামু না তুই?দেখ।’
পরী এবার বেশ চটে গেল। মোড়া থেকে দাঁড়িয়ে বলল,’তুমিই দেখো বুড়ি। একটা কাপড় পরে দাঁড়াও আমি তোমাকে আকাশে ছুড়ে মারি। নিজের জামাইকে তখন দেখাইও।’
-‘তোর আর কইতে হইবো না। তোর মতো বয়সে কতো দেখাইছি।’
-‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে আমাকে এর মধ্যে টানবে না বুড়ি।’

পরী নিজের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রুপালি কুসুম কে দিয়ে কয়েকটা শাড়ি পাঠালো পরীর ঘরে। পরী তখন পড়ার টেবিলে বসে সোনালীর খাতাটা নেড়ে দেখছিল। কুসুম আস্তে করে পরীর পাশে দাঁড়িয়ে বলে,’আমার অনেক কষ্ট হইতাছে বিন্দুর লাইগা আপা। আপনেও কষ্ট পাইতাছেন জানি। কিন্ত এখন আপনার বিয়া না দিলেও পারতো। আপনার মনডা তো ভালা নাই। আপনে চইলা গেলে আমি আর জুম্মান থাকমু কেমনে আপা?’
পরী কুসুমের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ জোড়া জলে ভরা। তবুও পরী ঠোঁটে হাসির রেশ ধরে বলে,’আমার রুপা আপা আর তার ছেলেকে দেখে রাখিস কুসুম। ওদের দায়িত্ব আমি তোকে দিয়ে গেলাম। যেকোন বিপদে তুই ওদের পাশে থাকবি।’

-‘কথা দিলাম আপনেরে আমি হ্যাগো পাশে থাকমু।’

পরী হাসলো। কুসুম ওকে অনেক বিশ্বাস করে। পরী জানে কুসুম তার কথার খেলাপ করবে না। এতে ওর প্রাণ সংকটে হলেও না।

আজ রাতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল শায়েরের। সামনের মাসে পরীর বিয়ে। জমিদার বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা। এখন থেকেই টুকটাক কাজ সারতে হবে। সেজন্য শায়ের শহরে গিয়েছিল। আসতে আসতে তাই অনেক রাত হয়ে গেছে। বৈঠকে গিয়ে আগে কলপাড় থেকে হাতমুখ ধুয়ে নিলো। তারপর নিজের ঘরে গেল। হারিকেনের আচ কমানো ছিল। সেটা বাড়িয়ে দিয়ে পেছন ফিরতেই দুকদম পিছিয়ে গেল শায়ের। সামনের জলচৌকিতে কেউ বসে আছে। সেটা যে পরী তা শায়েরের বুঝতে বেগ পেতে হলো না। নেকাবের আড়ালে থেকেই পরী বলল,’ভয় পেলেন নাকি?’
-‘এতো রাতে আপনি আমার ঘরে কেন এসেছেন?’

পরী শান্ত গলায় জবাব দিলো,’বিন্দুকে কারা মেরেছে?’
-‘আমি এখনো জানতে পারিনি। তবে পুলিশ তদন্ত,,,’

বাকিটুকু শায়ের বলতে পারলো না। পরী মৃদু চিৎকার করে বলে,’কথা ঘোরাবেন না। আমি জানি আপনি সব জানেন।’

#চলবে,,,,,

#পরীজান
#পর্ব ২৫
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

হারিকেনের টিমটিম আলোতে পরীর চোখে প্রকাশিত পাচ্ছে ক্ষোভ। শায়ের চুপ করে আছে পরীর ধমকে। পরী উঠে দাঁড়াল শায়েরের সামনে। আশেপাশে তাকিয়ে শায়ের দেখলো কেউ আছে কি না? যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে পরীকে কিছু বলবে না কিন্ত শায়ের কে অনেক কিছুই শুনতে হবে তার। সে বলল,’কেউ দেখলে খারাপ ভাববে। তাছাড়া আপনার সামনে বিয়ে। একটু ভেবে কাজ করবেন।’

-‘আমাকে নিয়ে ভাবতে আপনাকে হবে না।’
-‘আপনাকে নিয়ে ভাবছি না আমি। নিজেকে নিয়ে ভাবছি। কেউ দেখে ফেললে আমারই বিপদ।’

-‘ওসব কথা থাক। বিন্দুকে কারা মেরেছে?’
-‘আমি সত্যিই জানি না। আমাকে জানার অধিকার আপনার বাবা দেয়নি।’
বিষ্মিত হলো পরী। বলে,’মানে?ভাল করে বলুন।’

-‘আমাকে এই ব্যাপার থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। দেখুন আমাকে ঠিক যতটা বলা হয় ঠিক ততটুকুই করি। আপনি কেন ভুলে যাচ্ছেন যে আমি আপনার বাবার গোলাম মাত্র। আমাকে তিনি যা বলেন আমি তাই করি। প্রশ্ন করার অধিকার আমার নেই। বিন্দুর মৃত্যুর কথা জানলেও কাউকে বলতে আমি পারবো না। আপনার বাবাই সবাইকে বলবেন।পুলিশ এখনও কাউকে ধরতে পারেনি।’

-‘আমার বিশ্বাস হয় না আপনার কথা। আপনি মিথ্যা বলছেন। বলুন না বিন্দুকে কারা মেরেছে?’

শেষ কথাটাতে অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। পরীর চোখের পানি স্পষ্ট দেখতে পেল শায়ের। খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই শায়েরের। একটু ভেবে শায়ের হাত বাড়িয়ে দিলো পরীর দিকে বলল,’বিশ্বাস না হলে শাস্তি দিতে পারেন। হারিকেনটা ওখানে আছে।’

পরী একপলক হারিকেনের দিকে তাকিয়ে আবার শায়েরের দিকে তাকালো। এই মুহূর্তে সে কিছুই বিশ্বাস করতে চাইছে না। তবে শায়েরের কথা শুনে মনে হলো সে মিথ্যা বলছে না। তাহলে সত্যিটা কি?বিয়ের পর তো এখানে আসতে পারবে না পরী। তাহলে সত্য উদঘাটন করবে কীভাবে?ছোট্ট মস্তিষ্কে আর চাপ নিতে পারছে না পরী। তাই বিনা বাক্যে প্রস্থান করলো।

বিন্দুর চলে যাওয়ার আজ বাইশ দিন। পুলিশ এখনও কোন হদিস পায়নি। তাদের ধারণা আসামীরা
গা ঢাকা দিয়ে আছে। এখন ওদের ধরা অসম্ভব। তাই কেসটা এমনভাবে সাজাতে হবে যেন সবাই ভুলে গেছে বিন্দুর কথা। তবে ওত পাতাই থাকবে। এখন শুধু আসামীদের বের হওয়ার পালা। সন্দেহ তাদেরই করা হয়েছে যারা যাত্রাপালায় ছিল কিন্ত বিন্দুর মৃত্যুর পর তাদের কোন খবর নেই।
কুসুম এসে কথাগুলো পরীর কানে তুললো। পরী কিছু বলল না। কুসুমের খারাপ লাগছে পরীকে এভাবে দেখে। যে মেয়েটা সারা অন্দর ঘুরে বেড়াতো সেই মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কুসুম হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে,’আচ্ছা আপা আপনে যে খুন করলেন আপনের ডর করে নাই?’

কুসুম ভেবেছিল পরী রাগ করবে ওর কথায়। কিন্ত পরী তা করলো না। বলল,’মানুষ যখন কোন খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখন কোন ভয় থাকে না তার। আমার ও তাই হয়েছিল। তখন কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই রাগের বশে খুন করে ফেললাম।
পরে অবশ্য আমি নিজেও ভয় পেয়েছিলাম। কিন্ত আপাকে বুঝতে দেইনি।’
-‘আপনের অনেক সাহস আপা। আমি তো মুরগি জবাই দেখতে ভয় পাই। আর আপনের মানুষ জবাই করলেন!!’
-‘জানোয়ার জবাই করতে ভয় কিসের??’

কুসুম দাঁত বের করে হাসলো। সবসময় সঠিক জবাব পায় সে পরীর থেকে। মালাকে আসতে দেখে কুসুম হাসি বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলো। মালা পরীর মুখোমুখি বসলো। হাতে একটা কাপড়ের তৈরি ব্যাগ। ব্যাগ থেকে বেশ কিছু গয়না বের করে বলল,’দেখ তো পছন্দ হয়?’
পরী গয়না গুলোর দিকে তাকালো না। মালার দিকে তাকিয়ে রইল। কুসুম উঁকি দিয়ে বলে,’একদম খাঁটি সোনা আপা। একবার দেখেন?’
হেসে পরী বলে,’আমি খাঁটি সোনা’ই দেখতাছি কুসুম।’
মালা অবাক হয়ে তাকালো পরীর পানে। কাঁদছে পরী। মালার নিজের চোখেও অশ্রুরা ভিড় করলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’কান্দোস ক্যান?’
-‘আপনাকে রেখে আমি যাবো না আম্মা।’
মালাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে পরী। কাঁদতে কাঁদতে বলে,’আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না আম্মা। আমি আপনার কাছে থাকতে চাই।’
মালাও কাঁদছে। পরীকে যতটুকু শাসন করেছে তার দ্বিগুণ ভালোবেসেছে। পরীকে বুঝতে দেয়নি। পরীর সুরক্ষার জন্য কসম দিয়ে ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন মালা। তিনি চাননি সোনালী আর রুপালির মতো কাউকে পছন্দ করে ঠকুক তার ছোট মেয়ে। কষ্ট পাক,তাছাড়া সকল খারাপ দৃষ্টি থেকে আগলে রেখেছে পরীকে। না জানি পরীর স্বামী তাকে কতটা সুরক্ষা দেবে? কিন্ত মালা তার পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তার এখন কোন আফসোস নেই। উপরওয়ালার কাছে সে সম্মানের সহিত ছোট মেয়ের কথা বলতে পারবে। এটাই তার প্রশান্তি।

পরীকে শান্তনা দিয়ে মালা বললেন,’সব মাইয়া গো একদিন পরের ঘরে যাইতে হয় রে। দোয়া করি তুই যেন সুখি হোস। শহরে তুই ভালো থাকবি। ওইখানে ভালো স্কুল কলেজ আছে তুই পড়ালেখা করবি।’

পড়ার কথা শুনে মালাকে ছেড়ে দিল পরী। কান্নাও বন্ধ হয়ে গেল। পড়ার প্রতি মনই টানে না পরীর। যেদিন প্রথম পড়ার জন্য স্কুলে মার খেলো সেদিনই শাপলা বিলে এসে পরী ওর বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে বিলের পানিতে। মাছ,ব্যাঙ আর সাপ দের খাওয়ার জন্যই দেয় বই গুলো। এজন্য মালার কম মার খায়নি পরী। কিন্ত পরী তবুও পড়াশোনায় মন দিতে পারেনি। মাধ্যমিক দেওয়ার পর সে পড়াই বাদ দিয়েছে। গ্রামে তো কোন কলেজ নেই এটাই মূল কারণ। এতে পরী ভিশন খুশি ছিল। যাক আর পড়তে হবে না। কিন্ত মালা এখন আবার কি বলল!! মাথা ঘুরছে পরীর।
মালা এটাই চেয়েছিলেন। পরী যাতে কান্না বন্ধ করে। সেজন্যই পড়ার প্রসঙ্গ তুলেছেন।

মালা মেয়ের হাত ধরে কাছে টেনে বলে,’শহর কেমন তা আমি জানি না। সাবধানে থাকবি একলা বাইর হবি না। জামাইরে নিয়া যাবি।’
জামাই শব্দটাতে যেন বিষম খেলো পরী। সে তো শেখরকে ঠিকমতো চেনেই না। কীভাবে মানিয়ে নেবে শেখরের সাথে পরী? চিন্তায় পড়েছে সে। মালা ততক্ষণে চলে গেছে কুসুমও গেছে। পরীর চেতনা ফিরতেই চোখের সামনে ছড়িয়ে রাখা গয়না গুলো দেখতে পেলো। তাতে হাত বুলিয়ে বলল,’এই গয়না কি সুখ দিতে পারে?টাকা পয়সা কি শান্তি দেয়? তাহলে এতো ঐশ্বর্য থাকতে আমি কেন এক টুকরো সুখ পাই না? অট্টলিকায় সুখ না থেকে যদি কুঁড়ে ঘরে সুখ থাকে তাহলে আমি ওই কুঁড়ে ঘরে যেতে চাই।’

পরীর ইচ্ছা গুলো রঙ ওঠা চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ রইলো। তারাও যেন বুঝে গেছে পরী কি চায়!!জীবনে যে ভালোবাসাই সব। ধন সম্পদ দিয়ে কি হবে যদি ভালোবাসা না থাকে। পরী ভাবছে শুধু। তার জীবনে কোন মানুষটা সঠিক হতে পারে?

দিন পেরিয়ে রাত,রাত পেরিয়ে দিন। প্রকৃতির নিয়ম মেনে সময় এগিয়ে যাচ্ছে। ঘনিয়ে আসছে জমিদার কন্যার বিয়ের দিন। উৎসবে মেতেছে পুরো গ্রাম। দলে দলে মেয়েরা অন্দরে ঢুকছে নববধু কে দেখার জন্য। বিদায় দেওয়ার পূর্বে পরীকে সবাইকেই দেখে নিচ্ছে। বয়স্করা পরীকে দোয়া দিচ্ছে। আর পরী চুপচাপ তা মাথা পেতে নিচ্ছে। নতুন সাজে সাজানো হচ্ছে জমিদার বাড়িকে। সবকিছুর তদারকি করছে শায়ের। দম ফেলানোর সুযোগ নেই তার। গায়ে হলুদের সব জিনিস পত্র গুনে গুনে অন্দরে পাঠাচ্ছে সে। একটু পরেই গায়ে হলুদ শুরু হবে।

হলুদ কাপড় পরিয়ে পিড়িতে বসানো হয়েছে পরীকে। রুপালিও এসেছে,ছেলেকে শেফালির কাছে রেখে এসেছে। হলুদ বাটছে একজন মহিলা। পরী অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। পিঠ ছড়ানো চুল গুলো,হাতে চুড়ি আর হলুদ রঙে পরী যেন ঝলমল করছে। এই পরীকে দেখে আজ যেন প্রকৃতি হিংসে করছে। তাইতো সূর্যকে আজ লুকিয়ে রেখেছে। রুপালি তাড়া দিয়ে বলে,’আপনারা তাড়াতাড়ি করুন। এই শীতের মধ্যে কতক্ষণ বসে থাকবে। এরপর গোসল করাতে হবে। কুসুম গরম পানি নিয়ে আয় না।’
সবাই খুব তাড়াতাড়ি সব করতে লাগল।
প্রথমে পরীকে মালা হলুদ ছোঁয়ালো। কপালে গাঢ় চুম্বন করে বলে,’সুখি হ।’
জেসমিন এই প্রথম পরীকে ছুঁয়ে দিলো। মন্দ লাগলো না পরীর। ওর মায়ের স্পর্শই যেন পেল। চোখ তুলে জেসমিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। জেসমিন ও কপালে চুমু এঁকে দিলো। পরীর সারা শরীরে হলুদ মেখে দিলো এক এক করে। আবেরজান তা দেখে বলে,’অতো হলদি মাখিস না। আমার নাতনি এমনেই সুন্দর। অহন গোসল দে।’
আরেকজন রসিকতা করে বলে,’নাত জামাইর যে চান কপাল। আমাগো পরীর মতো মাইয়া পাইছে।’

-‘হ,এই চান দেখলে তো আর ছাড়তে চাইবো না।’

হাসাহাসির রোল পড়ে গেল সবার মধ্যে। পরী আগের মতোই বসে আছে। কুসুম গরম পানি আনলো। গোসল করানো হলো পরীকে। গরম পানিতে গোসল করেও শীত লাগছে পরীর। ঠকঠক করে কাঁপছে। ঠোঁট দুটো নীল হয়ে আসছে। সারা শরীরে হলুদ মাখানোর ফলে হলদেটে হয়ে আছে ফর্সা দেহখানা। রুপালি আবার তাড়া দিতেই পরীকে ঘরে নিয়ে গেল। হলুদ শাড়ি পাল্টে লাল শাড়ি পরানো হলো। আর কিছুক্ষণ পরেই বর আসবে।

এরই মধ্যে মালা এলেন হাতে পায়েশের বাটি নিয়ে। নিয়ম অনুসারে পরীকে তিনবার খাইয়ে দিলো মালা। তারপর বাকিটুকু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেতে দিলেন। গায়ে হলুদের আগেই পরীকে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল স্বয়ং জেসমিন। আজ পরী কাউকে না করেনি। জেসমিনের খুব ভাল লাগলো পরীর আচরণে। নিয়ম মতো পরী গায়ে হলুদের পর আর কিছুই খেতে পারবে না। শুধু ওই পায়েশ বাদে।
নিয়ম শেষে লাল বেনারশিতে সাজানো হলে পরীকে। বোনকে নিজ হাতে সাজালো রুপালি। সবশেষে লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে বলল,’মাশাল্লাহ তোকে রাজকন্যার চেয়েও সুন্দর লাগছে পরী। বরের নজর ব্যতীত আর কারো নজর যেন না লাগে!!’
হাসলো রুপালি। পরী কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো রুপালির দিকে। এটা কেমন দোয়া?? বরের নজর পড়বে শুধু। পরীও হাসলো রুপালির দোয়া বুঝতে পেরে।
আছরের আযান পড়ে গেছে। এখন বরযাত্রী এসে পৌঁছায়নি। শহর থেকে আসছে বিধায় আরো দেরি হচ্ছে। ঘুম এসে গেছে পরীর। ওর পাশে বসে থাকা মেয়ে গুলোও ঝিমাচ্ছে। এই মুহূর্তে বিয়ে টাকে অসহ্য লাগছে পরীর। এতক্ষণ বসে থাকতে ভালো কার লাগে!!
সময় পার হতে হতে মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। এখন পরীর বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে শাড়ি গয়না টেনে খুলে ফেলতে। রাগ প্রকাশ করতেও পারছে না। তখনই কয়েকজন মহিলা এসে পরীকে নিয়ে গেল বৈঠকে। পুরুষ নেই বৈঠকে। আফতাব, কাজি আর বর ই পুরুষ। মেঝেতে খেজুর পাতার তৈরি বড় পাটিতে বসানো হলো। সামনে টানানো হলো পাতলা চাদর। উসখুস করছে পরী। শুধু কবুল বললেই আজ সে এক পুরুষদের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবে। তার উপর সমস্ত অধিকার পাবে পরী।
কাজী সাহেব উচ্চস্বরে বলতে লাগল,’নূরনগর গ্রামের জমিদার আফতাব উদ্দিনের কনিষ্ঠ কন্যা পরীকে বিশ হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ করতে আপনি কি রাজি? রাজি থাকে বলুন কবুল!’

পরী মাথা নিচু করে শুনছে। এই মুহূর্তে ওর অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছে। পরী ভাবছে এরকম অনুভুতি কি সব মেয়েরই হয়? অপর পাশ থেকে বেশ দেরি করেই উত্তর এলো। শেখর কি মেয়েদের মতো লজ্জা পাচ্ছে নাকি? অসহ্য লাগলো ব্যাপারটা।
এরপর কাজি পরীকে উদ্দেশ্য করে বলে,’নবীনগর গ্রামের শাখাওয়াত সাহেবের একমাত্র পুত্র সেহরান শায়ের আপনাকে বিশ হাজার এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া বিবাহ করিতে ইচ্ছুক। আপনি কি রাজি? তাহলে বলুন কবুল!!’

#চলবে,,,,,