পরীজান পর্ব-৩০+৩১

0
675

#পরীজান
#পর্ব ৩০
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়,দেখতে আমি পাইনি। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে বাহির পানে চোখ মেলেছি,বাহির পানে। আমার হৃদয় পানে চাইনি,আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি।”

রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে গাইতে রুমালের সেলাই খুলছে চম্পা। তার প্রিয় ব্যক্তিকে যখন দেওয়ার অধিকার নেই তাহলে এসব রেখেই কি হবে? খুব যত্ন করে সে এগুলো বানিয়েছিলো। সেলাইয়ের প্রতিটি ফোড়ে ছিল নিত্য নতুন অনুভুতি গাঁথা। যা সে শায়ের নামক পুরুষটির জন্য রেখেছিল। কিন্ত সে পুরুষ টি আজ অন্য কারো দখলে। অন্য কারো হাসিতে সে তৃপ্তি পায়। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবে। আগে যদি জানতো এই পুরুষটি তার হবে না তাহলে কোন অনুভুতি সে জমিয়ে রাখতো না। দিতো না ওই পাষাণ পুরুষ কে মন।
শায়ের পরীকে বিয়ে না করলেও হেরোনা কিছুতেই শায়েরের কাছে চম্পাকে বিয়ে দিতেন না। দেখতে শুনতে তো মেয়েটা কম নয়। কোমড় ছড়ানো ঘন কালো চুল। ডাগর ডাগর চোখ,কি সুন্দর চেহারা!! এমন সুন্দর মেয়েকে তিনি অর্থহীন এতিম ছেলের কাছে কেন বিয়ে দেবেন? তার মেয়েকে তিনি আরো বড় ঘরে বিয়ে দেবেন। তবে যখন সে শুনেছে শায়ের জমিদারের মেয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে তখন থেকেই হিংসায় জ্বলে যাচ্ছেন। রূপবতী পরীকেও তার সহ্য হচ্ছে না। তাই তিনি খুসিনার সাথেও তেমন কথা বলেন না। কেননা খুসিনা খুব বড়াই করেন পরীকে নিয়ে। হেরোনার মেয়ের থেকেও দ্বিগুণ সুন্দরী মেয়েকে ঘরে তুলেছে শায়ের। এজন্য দুজনের মধ্যে চলে কথার প্রতিযোগিতা।
চামেলি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে বোনের কান্ড দেখতাছে। সে ভালোবাসার অর্থ বোঝে না বলেই বোনের কষ্ট বুঝতে ব্যর্থ। তাই চেয়ে চেয়ে দেখছে শুধু। পরীদের বাড়ি থেকে এসে অনেক গল্পই বলেছে পরীর বাড়ি সম্পর্কে। চম্পা শুধু শুনেছে।

বারান্দার মাটির তৈরি সিঁড়িতে চম্পা আর বারান্দার মেঝেতে চামেলি বসে আছে। পরী সেখানে আসতেই চামেলি খুশি হলো। তবে চম্পা পরীর উপস্থিতি পেয়েও নিজের কাজ করতে লাগলো। পরী কিছুক্ষণ চম্পার দিকে তাকিয়ে থেকে চামেলিকে বলল,’ঘরে একা একা লাগছিল তাই তোমার কাছেই ফুপু পাঠালেন।’
চামেলির বদলে চম্পা বলে,’কেন সেহরান ভাই নাই?’

-‘নাহ,উনি তো বাজারে গেছে। আসতে দেরি হবে।’

পরীর মুখে উনি শব্দটা শুনে মৃদু হাসলো চম্পা। চামেলি উঠে এসে পরীর হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে গেল। পরীকে চৌকির উপর বসিয়ে নিজেও বসলো। তারপর বলল,’নতুন ভাবী আপার লগে কথা কইও না। আপার মন ভালা না। দেখো না সেহরান ভাইয়ের লাইগা রুমাল বানাইছে এহন আবার খুলতাছে।’

-‘উনার জন্য রুমাল বানিয়েছে কেন?’
পরী বুঝেও না বোঝার ভান করলো। যাতে চামেলি সব কথা বলে।

-‘আর কইয়ো না নতুন ভাবি। খুসিনা ফুপু মা’রে কত্ত কইলো সেহরান ভাইয়ের লগে আপার বিয়া দিতে কিন্ত মা তোর রাজিই হয়না। আপা সেই আশায় রুমাল বানাইলো। কিন্ত দেহো শেষমেশ তোমারে ভাই বিয়া কইরা আনলো। যদি আপার লগে বিয়া হইতো তাইলে কি তোমার মতো সুন্দর ভাবি পাইতাম!!’

খিলখিল করে হেসে উঠল চামেলি। পরী আগেই বুঝেছিলো চম্পা শায়ের কে পছন্দ করে। কিন্ত পুরোপুরি সব সে জানে না। যদি হেরোনার মত থাকতো তাহলে হয়তো পরীর জায়গায় চম্পা থাকতো। পরী সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখে একটা ছেলের ছবি আর কিছু পোস্টার টানানো। পরী জিজ্ঞেস করে,’এসব কার ছবি?’

চামেলি যেন আকাশ থেকে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে বলল,’আল্লাহ গো!!হেরে চিনো না তুমি? সালমান শাহ,অনেক বড় নায়ক হেয়।’

-‘নায়ক!!’ পরী ঠিক বুঝলো না। ঘরবন্দি থাকাতে এসবের সাথে পরিচিত না সে। তাই বিখ্যাত নায়ককে চিন্তে পারলো না। চামেলি আবার বলল,’হ নতুন ভাবি। আমি আর আপা প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় টুনিগো বাড়িতে যাইয়া টেলিভিশন দেহি। তুমি দেখবা?’

-‘নাহ আমি দেখবো না। রাতের বেলা ফুপু বের হতে বারণ করেছে।’
-‘ওহ তুমি তো নতুন বউ। আহো আমরা তোমাগো ঘরে যাই। দেহি সেহরান ভাই আইছে নাকি?’

চামেলি গান ধরলো,’উওরে ভয়ংকর জঙ্গল দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল পূর্ব পশ্চিম দুই দিগন্তে নদী।’
চামেলি নাচতে নাচতে যেতে লাগল আর পরী হেঁটে হেঁটে। মেয়েটার দূরন্তপনা দেখতে ভালোই লাগে পরীর। কিন্ত চম্পার জন্য খারাপ লাগছে।

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেছে শায়ের। পরী মাগরিবের নামাজ শেষ করে বসেছিল। একাই ছিল সে,ফুপু পাশের বাড়িতে খোশ গল্প করতে গেছেন। চামেলি চম্পা টেলিভিশন দেখতে গেছে। পরী ঘরে সম্পূর্ণ একা। দরজার ঠকঠক আওয়াজ শুনে পরী দরজা খুলল। শায়ের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলো। পরী খেয়াল করেছে আসার পর থেকে শায়ের কেমন যেন আচরণ করছে। পরীর থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। কোন কারণে শায়ের এরকম করছে পরী তা ভেবে পাচ্ছে না!!
এতে খারাপ লাগছে পরীর। কেননা এই পুরুষটিকে যে তার ভিশন মনে ধরেছে। সেই প্রথম যেদিন সম্পানের নৌকাতে দেখা হয়েছিল সেদিন থেকেই। শায়েরের কথা গুলো শ্রুতিমধুর মনে হতো পরীর কাছে। এত সুন্দর আর গুছিয়ে বোধহয় কেউ কথা বলতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে যখনই পুরুষটির সাথে দেখা হতো তখন সে আবারো পরীকে মুগ্ধ করতো। আর আজ সেই পুরুষই পরীর স্বামী। স্বামীর অবহেলা তো প্রতিটি নারীকেই ব্যথিত করে। সেজন্য পরীর মনটাও ভিশন ব্যথিত। কাল থেকে শায়ের কোনো কথা বলেনি পরীর সাথে। পরী কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দিয়েছে শুধু। এর বাইরে একটা কথাও সে বলেনি।
পরনের পাঞ্জাবি খুলে একটা গেঞ্জি পরছে শায়ের। পরী তাকিয়ে আছে শায়ের দিকে। নিজেকে পরিপাটি করে পিছন ফিরতেই পরীর চোখে চোখ পড়ল। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো সে। বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পরী বলে উঠল,’কোথায় যাচ্ছেন??’

শায়ের না তাকিয়েই জবাব দিল,’কাজ আছে।’
-‘আমাকে একা রেখে যাবেন না।’

থমকে দাঁড়াল শায়ের। পিছন ফিরে বলল,’কেন? ফুপু নেই?’
-‘পাশের বাড়িতে গেছে।’
-‘আপনি একা থাকতে ভয় পান??’

পরী কয়েক কদম এগিয়ে এলো। শায়েরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’সূর্যাস্তের পর হৃদয়ের একাকীত্ব বাড়ে। তখন মানুষ সূক্ষ্ম একটা হৃদয় খোঁজে তার হৃদয়কে বাঁধার জন্য। একাকীত্ব দূর করতে চায়। ভয়ের থেকে মানুষ একাকীত্বে বেশি ভোগে। আপনি কি আমার একাকীত্ব বোঝেননি??’

এবারও পরীর চোখে চোখ রাখলো না শায়ের। তবে চোখ দুটো যেন অনেক কথা বলতে চাইছে। নিজেকে সংযত করে শায়ের চলে এলো। বাইরে গেলো না। পরী বলল,’কিছু বলবেন না??’
এবার শায়ের মুখ খুলল। কন্ঠে গম্ভীরর্যতা এনে বলল,’আমার জন্য একাকীত্ব ভোগ করতে হবে না আপনাকে। যেখানে আমি আপনার যোগ্য নই সেখানে আমার জন্য আপনি নিজেকে দূর্বল করবেন না। যদি কখনও আফসোস হয় তাহলে বলবেন আমি সরে যাবো আপনার পথ থেকে।’

পরীর মনে জানান দিলো যে শায়ের কিছু শুনেছে। তাহলে কি রুপালির বলা কথা শায়ের শুনেছে? তাই হবে নাহলে শায়েরের এতো পরিবর্তন হতো না। বাড়ি থেকে আসার আগে রুপালি পরীকে কিছু কথা বলে। শায়ের ছোট ঘরের ছেলে,পরীর যোগ্য না,বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিয়েছে এমনকি অনেক আফসোস করেছিল। কিন্ত পরী তখন একটা জবাব দিয়েছিল,’যদি টাকা পয়সা সুখ দিতো তাহলে তুমি কেন সুখি হলে না আপা?’
রুপালি তারপর আর একটা কথাও বলেনি। শায়ের বোধহয় অর্ধেক কথা শুনেই এসব বলছে।

-‘আমার মনের পথে যে একবার আসে তার ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আপনি ফিরবেন কীভাবে??’

শায়ের জবাব দিলো না। পরীর সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বললে নিজেকে সংযত রাখা অসম্ভব। তাই পরীর থেকে সরে গিয়ে পালঙ্কে বসলো। পরী এগোলো না শায়েরের দিকে। সে ভাবলো রুপালির মাথা খারাপ বলে কি শায়ের কেও মাথা খারাপ করতে হবে নাকি? রুপালি সবসময় পরীর সুখ চেয়েছে বিধায় এসব বলেছে। পরী তখন ভেবেছিল সে নিজের সুখকে দেখিয়ে দেবে বোনকে। কিন্ত শায়ের নিজেই তো বুঝতেছে না কিছু। পরী এগিয়ে গেলো জানালার দিকে। হাত বাড়িয়ে খুলে দিলো জানালা। হুড়মুড়িয়ে বেলি ফুলের সুবাস ঘরে এসে ঢুকলো। পরী পেছন ফিরে শায়েরের দিকে তাকালো। শুয়ে আছে শায়ের। অস্থিরচিত্ত নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আবারো জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।

এশার নামাজ পড়েই শুয়ে পড়ল পরী। শায়ের আগেই ঘুমিয়ে গেছে। ফুপু বলে গিয়েছেন শায়ের এলে যাতে ওরা খেয়ে শুয়ে পড়ে। তার আসতে দেরি হবে। পরীর খাওয়ার জন্য শায়ের কে ডাকলো না এবং নিজেও খেলো না। অর্ধেক রাত কাটলো এপাশ ওপাশ করে।

সকালে শায়ের আগেই ঘুম থেকে ওঠে। কালকে সে একটা কাজ যোগার করেছে। গ্রামের মাতব্বর শায়ের কে বেশ পছন্দ করেন। তিনিই তার আড়তে কাজ করতে বলেছেন শায়ের কে। আজকে সেখানেই যাবে শায়ের।
পরীও উঠে ফুপুর কাছে গেল। কাজ না পারলেও কিছু কিছু সাহায্য সে করে। রান্নাঘরে ছিলো পরী। তখনই একজন বৃদ্ধ মহিলা এলেন আজহারি করতে করতে। খুসিনা দৌড়ে গেলেন উঠোনে আর পরী বসে রইল। মিহিলাটি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘সেহরান কই?ওর বউ কই?’
শায়ের ও সেখানে গেলো। বাড়ির সকলেও উপস্থিত। মহিলাটি কাঁদছে আর বলছে,’হ্যারে সেহরান কোন অপয়া মাইয়া ঘরে তুললি। যে কিনা আমার পোলাডারে খাইয়া দিলো??’
কথাটা বুঝলো না শায়ের তাই জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে চাচি??’
-‘কি হয় নাই ক?? তোরে আর তোর বউরে আইনা আমার পোলাডা মইরা গেলো!! অলক্ষী মাইয়া আইতেই আমার পোলা খাইলো। তুই থাকবি কেমনে? তোরেও খাইবো দেহিস।’

শায়েরের মনে পড়ল এই চাচির ছেলের গাড়ি করে পরীকে প্রথম এই বাড়িতে এনেছে। ছেলেটা মারা গেছে!!সে বলে,’আপনার ছেলে মারা গেছে কখন?’

-‘কাইল রাইতে ভালা পোলা ঘুমালো সকালে আর উঠলো না। অহন বউ পোলাপান খাইবো কি? সব তোর বউর লাইগা হইছে। অলক্ষি,এই সংসার টিকবো না সেহরান। টিকবো না।’

শায়ের ধমকে মহিলাটিকে বের করে দিলেন। অতঃপর নিজের ঘরের দিকে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পরী। ছলছল নয়নে সে শায়েরের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে সেখানে না দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। শায়ের বুঝে গেল এতক্ষণের সব কথাই পরীর কানে গিয়েছে। সে দ্রুত ঘরে গিয়ে পরীর হাত টেনে ধরলো। পরী কাঁদছে দেখে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো সে।

#চলবে,,,,,,

#পরীজান
#পর্ব ৩১
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)

❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌

নারী যখন খুব বেশি কষ্ট পায় তখন কাঁদার জন্য একটা বুক খোঁজে। যেখানে নিজের সব কষ্ট ঢেলে দিতে পারে। অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ক্ষ্যান্ত হতে পারে।
একটা বিশ্বাসী স্নিগ্ধ মানুষের বুকে অশ্রু ঢালতে পারলেই সে নারীর কষ্ট লাঘব হয়। তেমনি পরী নির্ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে শায়েরের বুকে। শায়ের দুহাতে আগলে ধরেছে তার অর্ধাঙ্গিনীকে। মহিলাটির কথায় পরী কষ্ট পেয়েছে খুব। খারাপ লাগারই কথা। সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে। এখনো সংসার পাতানো হলো না। তার আগেই ভাঙ্গার কথা বলছে। একটা সুখি সংসার কেমন হয় তা পরী সোনালীর সেই খাতায় পড়েছে। কিভাবে সোনালী রাখালের সাথে ছোট্ট সংসার গড়ে তুলবে তা ব্যক্ত করেছিল খাতায়। পরীর ধারণা ও সেখানকার। কিন্ত ওই মহিলাটি শুরুতেই সব চুরমার করার কথা বলছে!! এজন্য ব্যথিত হয়ে নয়ন জলে ভাসছে পরী। শায়ের কিছুক্ষণ পরীকে আলিঙ্গন করে নিজের দিকে ফেরালো। আপন হস্তে পরীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’আপনি না সাহসী?? আপনার মন না শক্ত? তাহলে এভাবে বাচ্চাদের মত কাঁদছেন কেন?’

-‘উনি কি বলে গেলেন? আমি কি সত্যিই,,,’

মুখে হাত দিয়ে কথা আটকে দিলো শায়ের। তারপর গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,’মানুষের কথায় নিজের চরিত্রকে বিচার করবেন না। নিজের মানসিকতা দিয়ে নিজের চরিত্র কে দেখুন জানুন। পরের কথায় চোখের জল ফেলবেন না। কষ্ট পাবেন না।’
-‘উনি যদি মিথ্যা বলে থাকেন তাহলে আপনার আর আমার মাঝে কেন এতো দূরত্ব? বলুন!!সেটা তো আমার জন্যই তাই না!! আমিই পারি না কাউকে আপন করে নিতে। সেজন্যই তো উনি আমাকে এসব বলে গেছেন।’
দ্বিতীয়বারের মতো পরীকে জড়িয়ে নিলো শায়ের। তার করা ভুলটা পরী নিজের মাথায় নিয়েছে। শায়েরই ইচ্ছা করে দূরে থেকেছে। আসলে রুপালির কথাগুলো শোনার পর শায়ের ভেবেছে সত্যিই সে পরীর যোগ্য নয়। তাই সে দূরে থেকেছে। কিন্ত পরী যে তাকে অতি সন্নিকটে চায় তা শায়েরের জানা ছিল না। শায়ের বলল,’আমাকে ক্ষমা করুন পরীজান। ভুলটা আমারই। আমার থেকে আপনার দূরত্ব বাড়বে না কোনদিন। কথা দিলাম,আমি দূরে থাকলেও আমার রুহু সবসময় আপনার কাছে থাকবে।’

পরী নিজেও শক্ত করে ধরে শায়েরকে। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,’আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাব আপনি না থাকলে। আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবেন না। আমি শুধু ছোট্ট একটা সংসার চাই। এছাড়া আর কিছু চাই না আমি।’

-‘আপনি যা চাইছেন তাই হবে। এবার কান্না বন্ধ করুন।’
পরী কান্না থামালেও শায়ের কে ছাড়লো না। আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রাখে। পরীর এহেম কান্ড দেখে শায়ের হেসে ফেলল। বলল,’ছাড়বেন না আমাকে? আজ থেকে কাজে যেতে হবে।’
-‘আজকে যাওয়ার দরকার নেই। কাল থেকে যাইয়েন।’
-‘কেন??’
-‘আজকে আমার মন খারাপ। আপনি চলে গেলে মন আরও খারাপ হয়ে যাবে।’

আবারও হাসে শায়ের। আরেকটু গভীরতার সাথে আলিঙ্গন করে পরীকে। শায়ের কিছু বলতে যাবে তখনই খুসিনার গলার আওয়াজ ভেসে আসে। শায়ের পরী দুজনেই তড়িঘড়ি করে দুপাশে সরে দাঁড়ায়। খুসিনা ঘরে এসে বলে,’হ্যারে সেহরান তুই নতুন বউ রে লইয়া ফকিররে দিয়া ঝারা দিয়া আন।’

শায়ের গলা খাকারি দিয়ে বলে,’ফকির!!কেন?’
-‘কেউর নজর পড়ছে। দেহোস না ওই বেডি কি কইয়া গেলো? আমার ভালা ঠেকতাছে না তুই বিকালে বউরে লইয়া উসমান ফকিরের কাছে যাইস।’

-‘আচ্ছা যাবো। তুমি এখন যাও।’

-‘তুই তো আড়তে যাবি কইলি। তা যাবি না??’
-‘আজকে না কাল থেকে যাবো।’

খুসিনা মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। শায়ের আবার পরীর কাছে এসে বলল,’মন খারাপ যেন করতে না দেখি। বিকেলে গ্রাম ঘুরতে নিয়ে যাব। দেখবেন ভালো লাগবে।’

-‘ফুপু যে ফকিরের কথা বলল!’
-‘কুসংস্কারে আমি বিশ্বাস করি না। আমি থাকলেই আপনার উপর থেকে নজর কেটে যাবে।’

শায়ের পরীকে রেখে আড়তে যায়নি। ঘরে বসেই পায়চারি করেছে। সকালের নাস্তা সেরে তার কিছুক্ষণ পরেই খুসিনার সাথে রান্না করতে গেলো পরী। প্রতিদিন রান্না করতে করতে খুসিনা তার নিজের জীবন কাহিনী শোনায়। বিয়ের কয়েক বছর পরই তার স্বামী মারা যায়। তার ছেলের বয়স তখন চার বছর। স্বামী গৃহ থেকে বঞ্চিত হয়ে সে বড় ভাই শাখাওয়াত মানে শায়েরের বাবার কাছে আশ্রয় নেন।
বাকি তিন ভাইয়েরা বউদের কথাতে খুসিনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা’ই বা কি করবে?অভাবের সংসার নিয়ে নিজেরাই টানাপোড়েনে আছে।

শায়ের তখন সাত বছরের বালক। দূর্ভাগ্য বশত শায়েরের মা মারা যান। এবং একই বছরে খুসিনার ছেলে পানিতে পরে মারা যায়। পুত্র শোক কাটাতে শায়ের কে তিনি নিজ সন্তানের মতো আগলে রাখেন। বড় করে তোলেন শায়ের কে। সেই থেকেই শায়ের ফুপু ভক্ত। শাখাওয়াত মারা যাওয়ার পর শায়ের নিজেই পরিবারের হাল ধরে। কাজের জন্য দূর দেশে পাড়ি জমায়। প্রতি মাসে খুসিনার খরচ পাঠালেও সে আসে না। বছরে দুই কি তিনবার আসে। তবে এখন খুসিনা ভিশন খুশি। শায়ের এখন থেকে এখানেই থাকবে। সে প্রতিদিন শায়ের কে দেখতে পাবে। এতেই তিনি খুশি।
পরী ফুপুর পাশে বসে বসে রান্না শিখছে। খুব মন দিয়ে কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রান্না তাকে শিখতেই হবে।
রান্না শেষ হতেই ফুপু পরীকে গোসলে যেতে বলল। সিঁদূর রঙা শাড়ি আর গামছা হাতে পরী কলপাড়ে গেল। টিন দিয়ে চারিদিক বেড়া দেওয়াতে বেশ সুবিধা হয়েছে। কলপাড়ের দরজা খুলতেই চমকে ওঠে পরী। শায়ের সবে নিজের গামছা টা দঁড়িতে রেখেছে। পরী বলে উঠল,’আমি পরে আসবো।’

-‘দাঁড়ান! আপনি আগে গোসল করুন। আমি পরে করবো।’
-‘না,আপনি আগে এসেছেন আপনিই আগে গোসল করুন।’
শায়ের পরীর হাত টেনে ভেতরে এনে বলে,’আমি বালতি ভরে দিচ্ছি। আপনি আগে গোসল করুন।’

পরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। শায়ের কল চেপে বালতি ভরলো। তারপর চলে গেলো। দরজা আটকে দিয়ে গোসল করে নেয় পরী। অতঃপর গায়ে শাড়ি জড়িয়ে ভেজা চুলে গামছা পেঁচিয়ে বাইরে আসে। ধোয়া শাড়িটা রোদে মেলতে গেলো। খোলা বারান্দায় বসে আছে শায়ের। সদ্য গোসল করা পরীকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে। ফর্সা শরীরে যেন লাল রঙটা একটু বেশিই শোভা পায়। পানিতে শাড়ির কিছু কিছু অংশ ভিজে গেছে। যেখানটা উন্মুক্ত দেখাচ্ছে। দৃশ্য টা সুমধুর লাগছে শায়েরের কাছে। অপলক দৃষ্টি মেলে সেদিকে তাকিয়ে আছে শায়ের। নিজের কাজ শেষ করে পরী এগোলো ঘরের দিকে। শায়ের কে এখনও বসে থাকতে দেখে বলে, ‘আপনি এখন গোসলে যান। আমার হয়ে গেছে।’

-‘কিন্ত আমার হয়নি!!’
-‘কি??’
-‘আপনাকে দেখা!!’
-‘কিইই?’
পরীর মৃদু চিৎকারে হুশ ফিরল শায়েরের। চট জলদি দাঁড়িয়ে বলল,’কিছু না আমি যাচ্ছি।’
দ্রুত পদে শায়ের প্রস্থান করে। পরী কিছু বুঝলো না চেষ্টাও করলো না কারণ নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।

বিকেলে সূর্যের তেজ অনেকটাই কমে আসে। পশ্চিমে ডুবতে শুরু করে উত্তপ্ত দিবাকর। শীত কমতে শুরু করছে। আর কিছুদিন পর বসন্ত এসে উঁকি দিবে। গাছের পাতা ঝরে গিয়ে নতুন পাতা গজাবে। তখন প্রকৃতির আমেজটাই অন্যরকম থাকবে।
রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক দম্পতি। তারা আর কেউ নয়। শায়ের আর পরী। মন ভাল রাখার জন্য ঘুরাঘুরির প্রয়োজন। তাই পরীকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে শায়ের। নেকাবের আড়ালে থাকা পরীর চোখ দুটো সব দেখছে। পথে অনেকের সাথে কথা বলেছে। পরীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। পরী নিজেও পরিচিত হয়েছে। এই প্রথম সে এভাবে গ্রাম দেখতে বের হয়েছে। আগে সে রাতের অন্ধকারে গ্রাম দেখতো। এখন দিনের আলোতে চারিদিক দেখতে বড়ই ভালো লাগছে।
সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরলো ওরা। চম্পা বারান্দায় বসেছিল। শায়ের কে পরীর হাত ধরে আসতে দেখে নড়েচড়ে বসে। ওই হাতটা চম্পার ধরার কথা ছিলো কিন্ত দূর্ভাগ্য বশত আজ পরী ধরে আছে। হেরোনা সারাদিনের কাজ শেষ করে পুকুর থেকে গোসল করে আসলো। চম্পাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও তাকালো শায়েরের দিকে। ভেজা শরীর টা যেন জ্বলে উঠল ওনার। চম্পাকে ধমক দিয়ে বললেন,’সন্ধ্যার সময় এইহানে কি করস? যা ঘরে?’

চম্পা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’আমার জীবন শ্যাষ কইরা দিয়া এহন কথা কও তুমি?’
-‘তোরে অনেক বড় ঘরে বিয়া দিমু। তুই সুখি হবি। ওই এতিম পোলার আছে কি আর তোরে দিবো কি?’

চম্পা চাপা রাগ নিয়ে বলে,’সুন্দর একখান মন আছে তার। কিছু না দিতে পারলেও ভালোবাসা দিতে পারতো। তুমি আগে হিংসায় জ্বলতা,এহন আমি জ্বলি।’
চম্পা রাগে ফুসতে ফুসতে ঘরের ভেতরে চলে গেল। হেরোনা মেয়েকে গালমন্দ করতে করতে কাপড় বদলাতে চলে গেলেন। বারবার মেয়ের মুখে সেহরান সেহরান শুনতে ভালো লাগে না তার। ছেলেটার এখন বিয়ে হয়েছে তবুও তার নাম জবছে মেয়ে। মনে মনে শায়ের কে কটু কথা বলতে ভুললো না সে।

সন্ধ্যার আসরে গল্প জমাচ্ছেন খুসিনা। তবে আজ তিনি পরী আর শায়েরের সাথে গল্প করছেন। একথা সেকথা বাজে বকবক করছেন। পরী গালে হাত রেখে তা শুনছে। তার ফাঁকে ফাঁকে শায়েরের দিকে তাকাচ্ছে। শায়েরের চেহারায় কেমন উদাস উদাস ভাব। দেখে বোঝা যাচ্ছে সে ফুপুর কথাতে মন বসাতে পারছে না। পরী ঠোঁট টিপে হাসলো। পাশের বাড়ির একজন মহিলা ঘরে এলো। খুসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ও ফুপু তোমারে মায় কহন যাইতে কইছে। তুমি এহনও বইয়া আছো।’
তার পর তিনি শায়ের আর পরীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,’তুমিও না ফুপু!! সেহরান নতুন বিয়া করছে। কই ওগো এট্টু একলা সময় দিবা তা না। আমি হইলে সন্ধ্যার পর দুইজনরে ঘরে তালা দিয়া চইলা যাইতাম।’

মহিলাটির লাগামহীন কথাবার্তা শুনে গুটিয়ে গেল পরী। লজ্জা অনুভূত হতেই মাথা নুইয়ে ফেলল। এখানকার মহিলারা নির্লজ্জ। সব কথা সরাসরি বলে দেয়। বড় ছোট দেখে না তারা। খুসিনা ধমকে বললেন,’মুখে লাগাম টান। আমার ভাইর বেডা হয়। কথা কমাইয়া কইস।’
উওরে মহিলাটি হাসলো শুধু। খুসিনা ঘর থেকে বের হতে হতে পরীকে দরজা আটকে দিতে বলল। পরী উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আগের স্থানে এসে বসতেই শায়ের বলল,’ওখানে বসেছেন কেন? আমার পাশে এসে বসুন। আমাদের তো এখন সময় কাটাতে হবে।’
শায়েরের মুখের হাসি দেখে পরী বুঝলো সে মজা করছে। পরশু থেকে কথা বলেনি আজকে এসেছে সময় কাটাবে। পরী এসব ভাবতে ভাবতে পালঙ্কে গিয়ে বসে রুষ্ঠচিত্ত কন্ঠে বলল,’কাল সারাদিন এই কথা মনে ছিল কি? তখন তো দূরে দূরে থাকতেন। এখন এসেছেন সময় কাটাতে?’

পরীর হাত ধরে টেনে কাছে এনে দুজনের দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলে শায়ের। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,’ক্ষমা তো চাইলাম পরীজান। আবারো চাইবো??’

-‘নাহ থাক,এতো বার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। হাঁপিয়ে যাবেন।’

-‘আপনাকে পাওয়ার জন্য দুনিয়ার সব অন্যায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে হাজার বার ক্ষমা চাইতে আমি প্রস্তুত।’

#চলবে,,,,