#পরীজান
#পর্ব ৪২
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
পরী শান্ত মেজাজে কবিরের গলায় ছু*রি বসিয়েছে।
যা কারো মাথাতে আসেনি। এমনকি শায়েরের ও না। নওশাদ ভেবেছিল এতো কিছু জানার পর পরী ভেঙে পড়বে। কিন্ত তা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে পরী নিজেকে আরো শক্তিশালী করে দাড় করিয়েছে। যখন টেবিলের পাশ ঘেষে পরী দাঁড়িয়েছিল তখনই ছু*রিটা হাতে নিয়েছিল এবং সুযোগ বুঝেই কাজে লাগিয়েছে। কবিরকে আঘাত করে পরী আর এক মুহূর্তেও দেরি না করে পা বাড়ালো নওশাদের দিকে। তবে নওশাদ একটু দূরে থাকার কারণে সে সতর্ক হয়ে গেল। শায়ের নিজেও পরীকে ঝাপটে ধরে। টেনে সবার থেকে দূরে নিয়ে আসে। কিন্ত পরী হাত পা ছুটোছুটি করছে। শায়ের বলল,’ছুরিটা ফেলে দিন পরীজান আপনার লেগে যাবে। একটু শান্ত হন।’
-‘ছাড়ুন আমাকে,ওকে না মারতে পারলে আমার রক্ত ঠান্ডা হবে না।’
আফতাব চেঁচিয়ে বলে,’এখনও সময় আছে শায়ের, পরীকে শেষ করে দাও। নাহলে ও তোমাকেও ছাড়বে না।’
আফতাবের কথাতে পরী স্থির হয়ে গেল। হাত থেকে ছু*রিটা আপনাআপনি পড়ে গেল। সে বলল,’কেমন পিতা আপনি যে নিজ কন্যাকে হত্যা করতে চাইছেন? আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করিনি তাহলে আমার উপর আপনার কিসের ক্ষোভ?’
-‘মেয়ে হয়ে যদি বাবাকে খুন করার ইচ্ছা পোষণ করো তাহলে আমি বাবা হয়ে কেন পারবো না?’
-‘আমি কবে আপনাকে খুন করতে চাইছি? আমি তো আপনাকে হত্যা করার কথা কখনও চিন্তাও করিনি।’
-‘এখন তো করতে চাইবে। সেটা আমি জানি। সোনালীর মতো তুমিও আমাকে মারতে চাইবে তাই তোমাকে আগেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’
-‘সোনা আপা আপনাকে মারতে চেয়েছিল? কিন্ত কেন??’
আফতাব কথা বলল না। তবে নওশাদ বলে উঠল, ‘তোমার বাবার যে সাম্রাজ্যের লোভ পরী। তা পেতে সে নিজের আপনজনদের বিসর্জন দিতেও পিছপা হবে না।’
আফতাব রাগন্বিত চোখে নওশাদের দিকে তাকালো। নওশাদ সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরায়। পরী তো সব জেনেই গেছে, এটুকু জানলে ক্ষতি কি?
-‘কি এমন লোভ আপনার যে নিজের মেয়েদের হত্যা করতে হবে? অল্প কিছু নিয়ে কি সুখে থাকা যায় না?
যে লোভে এতো পাপ করছেন, পরকালে কি জবাব দিবেন?’
-‘ইহকালে সুখ পেলে পরকালেও পাবো আমাকে নিয়ে তুমি এতো ভেবো না।’
-‘মূর্খ পিতা আপনি। ইহকাল পরকালে আকাশ পাতাল তফাত। তবে একটা কথা শুনে রাখুন, যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে আপনি বাঁচবেন না। সাম্রাজ্যের লোভে আপনি, আর আমার প্রতিশোধের আক্রোশ। কার জয় হয় দেখা যাবে। আমি নিশ্চিত এই যুদ্ধে আমার প্রাণ হারাবো আমি। কিন্ত রক্তারক্তি ছাড়া আমি মরবো না। ভুলে যাবেন না আপনার রক্ত আমার শরীরে আছে। তাই আপনার মতো তলো*য়ার
আমিও চালাতে পারি। আর আমার লক্ষ্য কখনো বিফলে যাবে না।’
আফতাব গর্জে ওঠে। তার সামনেই মৃত্যুর হুমকি দিচ্ছে তার মেয়ে। আর তিনি শুনছেন। শায়ের কে সে বলে,’পরীকে রেখে চলে যাও শায়ের নাহলে আজ তোমাকেও শেষ করে দেবো।’
আফতাবের কথা শুনে শায়ের হাসলো। একহাতে পরীকে জড়িয়ে ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনার কোন চামচার সাহস নেই আমাকে ছোঁয়ার।
এসব বলে নিজেকে হাসির পাত্র বানাবেন না। চলুন পরীজান। আমাদের যেতে হবে।’
শায়ের পরীর হাত ধরে সবার সামনে দিয়ে বাগান বাড়ি ত্যাগ করলো। সব রক্ষিরা শায়ের কে আটকানোর পরিবর্তে তাকে যাওয়ার রাস্তা করে দিলো। কিছুটা দূর এসে পরীর শক্তি যেন সব শেষ হয়ে গেল। সে মাটিতে বসে পড়ল। শায়ের পরীর হাত ছেড়ে দিলো। পরী চিৎকার করে কাঁদছে,বোরখার নেকাব টা টেনে খুলে ফেলেছে সে। জীবনের এতগুলো বছর সে ভুল মানুষদের সাথে কাটিয়েছে সেটা ভাবতেই ঘৃণা বাড়ছে ওর। মাটিতে বসে সে হাত পা ছুড়ছে আর কাঁদছে।
জ্যোৎস্নার আলোতে ভরে গেছে চারিদিক। চাঁদের আলো সবারই প্রিয় কিন্ত সময় যেন সবকিছুতে আজ বিষ ঢেলে দিয়েছে। নিঃশ্বাস ছাড়তেও কষ্ট হচ্ছে পরীর। কিছুক্ষণ ওভাবে বসে থেকে উঠে ছুট লাগালো পরী। শায়ের পরীকে দাঁড়াতে বলছে আর ছুটছে। পরী ছুটে গেলো সোনালীর কবরের কাছে। কবরের মাটি আঁকড়ে ধরে মাথা রাখে মাটিতে। এই রাস্তা দিয়ে কতো চলাফেরা করেছে অথচ পরী জানতেও পারলো না এই কবরটা ওর প্রিয় মানুষটার। রাখাল কদম গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসেছিল। পরীকে এইভাবে কাঁদতে দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে এসে পরীর পাশে বসে ওকে দেখার চেষ্টা করে। পরী আগের মতোই কাঁদছে। রাখাল পরীকে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে বলে,’এই ওঠ, কান্দস ক্যান এতো। রানীর ঘুম ভাইঙা যাইবো।’
পরী মাথা তুলে রাখালের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে
ঠোঁট ভেঙে আবারো কেঁদে উঠল। সে বলল,’আপার ঘুম কখনোই ভাঙবে না। যদি কাঁদলে ঘুম ভাঙতো তাহলে বিশ্বাস করো আমি অনেক কাঁদতাম। তুমি কেন আপাকে বাঁচাতে পারলে না? আমার আপা কত কষ্ট নিয়ে দুনিয়া ছাড়লো।’
রাখাল পরীর কথার অর্থ বুঝলো না। বোঝার চেষ্টাও করলো না। সে আপন হস্তে সোনালীর কবরে হাত বুলাচ্ছে।
-‘কোন পাপের শাস্তি তুমি পেলে আপা? ওই পিশাচ গুলো তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আমি তোমার কবরের মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত আমি ওদের শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করবো। আর যাই হোক না কেন নওশাদ কে না মারা পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না। তোমার মৃ*ত্যুর প্রতিশোধ আমি নিবোই। মৃ*ত্যুর পরেও বিধাতার কাছে আর্জি জানাবো তোমার হ*ত্যাকারীর শাস্তির জন্য।’
চোখের পানি দুহাতে মুছে নিলো পরী। শক্ত কন্ঠে বলল,’দোয়া করো আপা,তোমার পরী যেন সব কাজে সফল হয়। তোমার ছোট্ট পরী আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। ভালো খারাপ আজ বুঝেছে। প্রতিশোধের মানে জানে। তোমার পরী কখনো ভেঙে পড়েনি আর ভাঙবে ও না। তোমার পরী হাসতে হাসতে মৃত্যুকে বরণ করে নেবে।’
আবার চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল পরী। পেছন ফিরতেই সে শায়ের কে দেখলো। শায়ের এতক্ষণ পরীর কথা শুনছিলো। পরীর চাহনি স্থির। শায়ের তা অন্ধকারে উপলব্ধি করতে পারলো না। তবে শায়ের এটা বুঝতে পারল যে আজকের পরী সম্পূর্ণ নতুন ভাবে তৈরি। শায়েরের জন্য তার মনে এটুকুও ভালোবাসা নেই। শায়ের পরীর দিকে এগোলো না পরী নিজেই আসলো। জমিদার বাড়ির দিকে যাচ্ছে পরী। শায়ের বলে উঠল,’ওখানে যাবেন না পরীজান। আমার সাথে ফিরে চলুন।’
ফিরে তাকালো পরী,’আপনার ভাবনা অসাধারণ। কিন্ত আমি ফিরে যাবো না। আমার প্রতিশোধ না নিয়ে আমি কোথাও যাবো না।’
-‘আপনি একা একটা মেয়ে হয়ে ওদের সাথে কিছুতেই পারবেন না।’
-‘সেটা আমি জানি তবুও প্রতিশোধ না নিয়ে আমি পিছপা হবো না। আপনি চলে যেতে পারেন।’
-‘আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না পরীজান।
চলুন আমরা অনেক দূরে চলে যাই!! আমরা ভালো থাকবো সেখানে।’
-‘বাহ!! কত সহজে কথাগুলো বলে দিলেন। আপনার মতো পাপিষ্টরা সব কিছুকে সহজ ভাবেই নেয়। কিন্ত আমার পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমার ভালোবাসা দেখেছেন কিন্ত এবার আমার ঘৃণা দেখবেন। আপনার পরীজান আপনাকে কতটা ঘৃণা করে তা এবার আপনি দেখবেন।’
শায়ের পরীর কাছে আসলো। পরীর হাতদুটো নিজের বুকে চেপে ধরে বলল,’আমি দোষী, আমি পাপী, আমি শাস্তির যোগ্য। আপনি আমাকে শাস্তি দিন। আমাকে জড়িয়ে ধরেই শাস্তি দিন। আমি সব মাথা পেতে নেবো। কিন্ত আমার থেকে দূরে সরে যাবেন না।’
পরী ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো শায়ের কে। চিৎকার করে বলল,’আপনার ছোঁয়া বিষাক্ত লাগছে আমার কাছে। আমি মানতে পারছি না আপনিও সবার মতো আমাকে মারতে চেয়েছিলেন। যদি আমাকে মারতেই চান তাহলে আগেই মেরে ফেলতেন। কেন আমার ভেতরে ভালোবাসার জন্ম দিলেন? আমার অনুভূতির সাথে নোংরামো করলেন?’
-‘অনুভূতি ভালোবাসা কখনো নোংরা হয় না পরীজান। নোংরা হয় মানুষ। আমার ভালোবাসা নোংরা না পরীজান।’
শায়েরের কথার পিঠে কথা না বলে পরী হেটে চলল।
শায়ের ও পরীর পিছু নিলো। অন্দরের উঠোনে এসেই বোরখা টা ছুড়ে ফেলে দিলো পরী। মালা এখনও বারান্দায় বসেছিল। পরীকে নিয়ে যাওয়ার পর মালা আর নিজ ঘরে যায়নি। পরীকে দেখে মালা ছুটে এলো। মেয়ের দুগালে হাত রেখে সারামুখে চুম্বন করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের উষ্ণতা পেয়ে পরী চোখের জলে বুক ভাসালো। মালা কেঁদে যাচ্ছেন পরীকে জড়িয়ে ধরে।
রুপালি নিজ ঘর থেকে দৌড়ে এসে মালাসহ পরীকে জড়িয়ে ধরে। তিনজন মিলে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। ভারি হয়ে উঠেছে সারা অন্দর। রুপালি নিজের চোখ মুছে বলে,’পরী তুই শায়েরের সাথে চলে যা ভালো থাকবি।’
-‘আমি যাবো না আপা। ওদের শাস্তি না দিয়ে যাবো না। কার সাথে যেতে বলছো আমাকে? যে কিনা আমাকে খুন করার জন্য বিয়ে করেছে।’
-‘আমি জানি সব। কিন্ত বিশ্বাস কর শায়ের তোকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলে তোকে বিয়ে করেছে। ও তোকে ভালোবাসে অনেক। তুই ওর সাথে ভলো থাকবি।’
পরী রুপালির কথার পিঠে কথা না বলে কুসুম কে ডাকলো। কলপাড়ে গিয়ে কুসুম কে বালতি ভরতে বলে নিজ কক্ষে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর পরী কলপাড়ে গিয়ে বসলো। কুসুম তখনও ছিল ওখানে। পরী কুসুমের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমি না বলা পর্যন্ত তুই এখানেই থাকবি।’
কুসুম মাথা নাড়ে। পরীকে আজ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে কুসুমের কাছে। ভেজা চুলগুলো লেপ্টে আছে ঘাড় গলা দিয়ে। ঠান্ডা পানি শরীরের পড়তেই কেঁপে কেঁপে উঠছে পরী। ঠোঁট দুটো নীল হয়ে আসছে। তবুও ইচ্ছামতো পানি ঢেলে শান্ত হলো পরী। ভেজা কাপড় ছেলে সিঁদূর রাঙা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘরে গেল। শায়ের এতক্ষণ পরীর আসার অপেক্ষায় ছিলো। পরীকে দেখে সে থমকে গেল। পরীর নুতন সৌন্দর্য প্রতিদিন আবিষ্কার করে সে। আজও করলো। তবে আজ যেন ভয়ানক সুন্দর লাগছে পরীকে। চুল মুছেনি,শাড়িটা ভিজে গেছে পানিতে। শায়ের গামছা এনে পরীর কাছে এগিয়ে আসতেই হাত উচিয়ে থামিয়ে দিলো পরী। বলল, ‘আমার থেকে দূরে থাকবেন। আমার সহ্য হয়না আপনাকে।’
-‘তবুও আমি আপনার কাছে আসবোই। আপনার কাছে আসা আটকাতে পারবেন না আপনি। যদি আমাকে মেরে ফেলেন তাহলে আমাদের দূরত্ব বাড়াতে পারবেন।’
-‘বলা বাহুল্য যে আপনাকে আমি ক্রোধের তাড়নায় মেরে ফেলতেও পারি। কিন্ত আমি নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করব। আপনাকে বাঁচতে হবে। দুনিয়াতেই আপনি বেঁচে থাকার শাস্তি পাবেন। আমার আপনার দূরত্ব আপনাকে শাস্তি দিবে।’
শায়ের কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পরীর দিকে। কোন ভালোবাসা নেই আজকের পরীর মাঝে। পাপ সবকিছু দিয়ে আবার কেড়ে নেয়। শায়ের আজকে তার প্রমাণ পেলো। কাছে থেকেও আজ পরী যেন অনেক দূরে। শায়ের জানে না আদৌ কোনদিন এই দূরত্ব মিটবে কিনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়ের বলে,’আমি খু*ন করে যদি পাপী হই তাহলে আপনিও পাপী। শশীল কে হ*ত্যা করে আপনিও পাপী। মানতে পারবেন এটা?’
-‘একটা নরপিশাচ কে শাস্তি দেওয়া পাপ না। পৃথিবীর বুক থেকে একটা জানো*য়ার তো বিদায় হলো।’
-‘বিন্দুর ধ*র্ষ*ণ কারিদের হত্যা করে তাহলে আমিও পাপ করিনি তাহলে।’
-‘তাহলে পালক??এবার বলবেন এটাও পাপ নয়?’
#চলবে,,,,
#পরীজান
#পর্ব ৪৩
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে পুরো জমিদার বাড়িতে। কোথাও কোন শব্দ নেই। ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও মুখ বন্ধ করে রেখেছে। তারাও বুঝেছে এই পুরোনো আমলের বাড়িটি একটা মৃ*ত্যুপুরি। এই বুঝি কোন শব্দ হলো! এই বুঝি লা*শ পড়লো। নতুন খেলা শুরু হয়েছে যেন! বাঁচা ম*রার খেলায় জয়ী হবে কে? তা বলা বাহুল্য।
পরীর দিকে তাকিয়ে আছে শায়ের। পালককে কেন মেরেছে তার উত্তর সে দেয়নি এখনও। দিবে কিনা তাও শায়েরের ভাবান্তর দেখে বোঝা যাচ্ছে না। সে শুধু পরীকে দেখছে। প্রিয়তমার সৌন্দর্যে ঝলসে যাচ্ছে হৃদয়,চোখ জ্বলছে তবুও মন ভরছে না। পরীর নতুন রূপের দগ্ধ হচ্ছে সে। চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে পরীর। সে পারছে না স্বামীর কাছে কঠোর হতে। এতো কিছু জানার পরেও ওর মনে হচ্ছে কোথাও একটা কিন্ত রয়ে গেছে। যা পরী এখনও জানে না। নওশাদ যে সম্পূর্ণ সত্য বলছে তার তো কোন প্রমাণ নেই। শুধুমাত্র নওশাদের কথার উপর ভিক্তি করে সে শায়ের কে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে? এটা হতে পারে না। পরী অশ্রুসিক্ত আঁখি মেলে শায়েরের দিকে তাকালো। কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,’আমাকে ভালোবাসবেন মালি সাহেব?’
চমকে তাকালো শায়ের। পরী আবার তার মত বদলে ফেলেছে। খানিকটা দূরে দাঁড়ানো পরী। শাড়ির আঁচল টা বুক থেকে নামিয়ে পরী শায়েরের দিকে এগোতে লাগল,’আমার শরীরে অনেক ক্ষত মালি সাহেব। আপনার ভালোবাসা দিয়ে সব সারিয়ে দিন।
আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছি না।’
দড়ি দিয়ে বাঁধার কারণে পেটে লম্বা দাগ হয়ে আছে। উ*ন্মুক্ত সেই স্থান নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। ফর্সা শরীরে তা জ্বলজ্বল করছে। এক পলক সেদিকে তাকিয়ে পরীর মুখ মণ্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শায়ের। পেটের ক্ষতের থেকে পরীর চোখের ক্ষত আরো গভীর। যা সারানোর ক্ষমতা ওর নেই। পরীর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল শায়ের। শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে দিয়ে পরীর চোখে চোখ রাখলো,’আপনি আমাকে ভালোবাসেন?’
হঠাৎই পরী শায়েরের বুকে সামুদ্রিক ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়লো। শায়ের নিজেও কালবিলম্ব না করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার পরীজানকে। অল্প সময় আলাদা ছিলো দুজনে অথচ মনে হচ্ছে বহুকাল আলাদা ছিলো দুজনে। পরী নিজেও সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরেছে শায়ের কে। ওরা দুজনেই খুব ভাল করে জানে ওরা একে অপরের থেকে দূরে থাকতে পারবে না কখনোই। শায়ের যত অন্যায় করুক না কেন পরী ওকে ছাড়তে পারবে না।
-‘আপনি কি পালককে সত্যিই হ*ত্যা করেছেন?’
শায়েরের বুকে মুখ গুঁজে বলে উঠল পরী। শায়ের দেরি না করেই জবাব দিলো,’আপনাকে মিথ্যা বলার সাহস আমার নেই পরীজান। হ্যা আমিই পালককে মে*রেছি।’
শায়েরের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে পরী। চোখের জল মুছে বলে,’কেন মে*রেছিলেন তাকে? সে কি ক্ষতি করেছিল আপনার?’
-‘আপনার আমার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি আমি পছন্দ করি না। তাই পালককে মরতে হয়েছে। শুধু তাই নয় শেখরকেও রাখি নি। ভবিষ্যতেও কাউকে আসতে দেবো না।’
বেশ শান্ত স্বরেই জবাব দেয় শায়ের। এতে কিছুটা রেগে গিয়ে পরী বলে,’এজন্য আপনি পালককে মারবেন কেন? ভালোবাসা চাওয়া কি অপরাধ? আপনিও তো বলেছিলেন মেয়েরা ফুলের মতো। তাদের শুধু ভালোবাসার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। লড়াই করার জন্য নয়। তাহলে আপনি কেন মারলেন তাকে?’
-‘আমি তার সাথে লড়াই করিনি। তাকে তার প্রাপ্যটুকু দিয়েছি। ভালোবাসা নিয়ে নোংরা খেলা আমি পছন্দ করি না।’
-‘কি এমন খারাপ দেখলেন তার মাঝে আপনি?’
-‘আপনার আমার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন আমি হতে দিবো না। আপনি ওই প্রসঙ্গ বাদ দিন। আমি আর এই বিষয়ে কোন কথা বলবো না।’
পরী মুখ ফিরিয়ে নিলো। বিতৃষ্ণায় ভরে যাচ্ছে মনটা।
সে আর শায়েরের দিকে তাকালো না। তখনই শায়ের কক্ষ ত্যাগ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলো। হাতে করে সে একটা মলমের কৌটো নিয়ে এসেছে। কাছে এসে পরীর হাত ধরে বলে,’এদিকে আসুন মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।’
যত রাগ শায়েরের উপর পরী দেখাক না কেন দিন শেষে শায়েরের স্পর্শ পেলে পরীর রাগ মিলিয়ে যায় নিমিষেই। এই পুরুষটিকে সে ফেরাতে পারে না কিছুতেই। পরীকে পালঙ্কের উপর বসিয়ে আঁচল সরিয়ে দেয়। শক্ত করে বাঁধার কারণে দাগটা হয়েছে। শায়ের হাত বুলায় নীলচে দাগে। তারপর মলমটা লাগাতে থাকে,’আপনাকে বেঁধেছিলো কে? নওশাদ??’
-‘নাহ কবির।’
-‘ওকে মে*রে ভালো করেছেন। নাহলে ওকে আমিই মে*রে দিতাম।’
-‘কেন?’
-‘আপনাকে ছুঁয়েছে সে। ওর বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’
মৃদু হাসে পরী,’আমাকে ছুঁয়েছে বলে আপনি কবিরকে মা*রতে চান। আর কবির আমার আপাকে ছুঁয়েছে বলে আমি তাকে মে*রে দিয়েছি। আপনার আমার মাঝে অনেক তফাত তাই না?’
-‘আপনার আমার মাঝে তফাত আছে পরীজান। আপনি পবিত্র একটা ফুল। আর আমি ভুল,ভুল মানুষদের প্রিয় থাকতে নেই। তাই তো আমার প্রিয় আমার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।’
-‘বলুন না পালক কি এমন পাপ করেছিল যে আপনি তাকে এই শাস্তি দিলেন?’
শায়ের দাঁড়িয়ে গেল,’বারবার একই প্রশ্ন কেন করছেন? এই প্রসঙ্গ বাদ দিন।’
-‘তাহলে বের হয়ে যান এখান থেকে।’
শায়েরের উত্তরের আশা না করে ওর হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিলো পরী।
দরজা ঘেষে মেঝেতে বসে পড়ল পরী। হাঁটুর উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো। পানিতে ভিজে উঠল ঘন পাপড়ি গুলো। পরী বলে উঠল,’আপনার সাথে আর যেন কখনও না দেখা হয় মালি সাহেব।’
-‘আপনার জন্য আর কেউ আসুক বা না আসুক আমি আসব পরীজান। আমার ভালোবাসা একটুও কমবে না পরীজান।’
সারারাত ওভাবেই কেটে গেলো দুজনের। পরী দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকাল হতেই সে ঘর থেকে বের হয়। দরজার পাশেই শায়ের কে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে। চোখ বন্ধ শায়েরের, বোঝাই যাচ্ছে সে ঘুমাচ্ছে। পরী ওখান থেকে চলে এলো। অন্দরের উঠোনে এসে পুরো বাড়িতে চোখ বুলালো।
পরীর মনে পড়ল সোনালীর কথা। কতো কানামাছি খেলেছে সে বোনের সাথে। সোনালীর চোখ বেঁধে পরী চারপাশে ছোটাছুটি করতো। সাথে রুপালিও এসে যোগ দিতো। তিন বোন মিলে মাতিয়ে রাখতো জমিদার বাড়ি। কিন্ত আজ সেই বাড়িকে মৃত্যুপুরি মনে হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে কতকিছু বদলে গেলো!
পরী রুপালির ঘরে গেল। পিকুল ঘুমাচ্ছে রুপালি বসে আছে। পরী ঢুকতেই রুপালি সোজা হয়ে বসে। পরী কিছুক্ষণ রুপালিকে দেখে বলে,’আব্বা কেন আমাকে মারতে চায় তা আমি পুরোপুরি জানি না আপা। তুমি কি জানো?’
-‘হুম।’
-‘আর কিছু না লুকিয়ে সব বলো আমাকে।’
-‘কাছে আয়,বস এখানে!’
পরী বসলো রুপালির পাশে।
-‘বড় আপা প্রাণবন্ত ছিলো জানিস পরী। সে না বলা কথা বুঝে যেতো। আম্মার মনের কথা সবচেয়ে বেশি বুঝতো বড় আপা। আপা যখন ছোট তখন সে দেখতো কাকা আম্মার সাথে খারাপ আচরণ করে। কিন্ত আব্বা কিছুই বলে না। সব জেনেও কেন আব্বা কিছু বলে না এটা আপার ভালো লাগেনি। সবসময় এসব চিন্তা করতো আপা। তবে তার উত্তর পেতো না। রাখালের সাথে প্রেম করার পর ওর প্রশ্ন গুলো চাপা পড়ে যায়। কিন্ত আবার সেই প্রশ্ন সামনে আসে যেদিন কাকা আম্মাকে বৈঠকে একা পেয়ে সুযোগ নেয়। ওইদিন আপা আম্মাকে বাঁচায়। সেদিন আব্বার সাথে আপার অনেক ঝগড়া হয়। যার ফল ভোগ করে আম্মা। আব্বা এখনও আম্মার গায়ে হাত তোলে। এজন্যই আম্মার শরীর সবসময় অসুস্থ থাকে। আমি এখানে না থাকলেও জানি,যে পালক সব জানতে পেরেছিল। আম্মার শরীরের দাগ গুলো দেখে পালকের বুজতে বাকি থাকে না এসব কিছু আব্বার কাজ। পরী আমাদের আম্মার ঘরে ঢোকা নিষেধের একটাই কারণ ছিলো তা হলো আমরা যেন এটা জানতে না পারি আব্বা একটা নর*পিশাচ। আমরা কোন ভুল করলে আব্বা আম্মাকে প্রচুর মারতো। ছোট আম্মাও কম মার খায়নি। জুম্মান কে আব্বা সাথে করে নিয়ে গেছে পরী। ওকেও আব্বা নিজের মতো তৈরি করবেন। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছোট আম্মা এখন নিজেই ঘরে বসে আছেন।’
-‘কি হয়েছে ছোট আম্মার?’
-‘জুম্মানকে সে খারাপ হতে দিবে না। এই প্রতিবাদই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আব্বা আঘাতে রক্তাক্ত করেছে তাকে। আম্মা এখন তার কাছেই আছেন। যাই হোক পরের কথায় আসি। পালক সব পুলিশকে বলে দিতো বিধায় তাকে মে*রে ফেলা হয়েছে।’
-‘আর সোনা আপাকে কেন মে*রেছে?’
-‘সোনা আপা সব সত্য জেনে গিয়েছিল। তুই জানিস বন্যার সময় অনেকে মারা গিয়েছিলো?’
-‘হুম।’
-‘ওরা অসুখে মারা যায়নি। ওদের মেরে ফেলা হয়েছিল। তারপর ওদের দামি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো চড়া দামে বিক্রা করে দেন আব্বা। এইকাজ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন তিনি। ডাক্তারদের ও নিজ আয়ত্বে রেখেছেন তিনি। ইতিহাসের কোন জমিদারের চরিত্র ভালো ছিল না। আজও নেই। তাদের দু চারটে র*ক্ষিতা না থাকলে চলেই না। আম্মা যে কি কষ্ট করেছে তা আমি বুঝেছি কবিরকে বিয়ে করার পর। মেয়েরা সবকিছুর ভাগ দিতে পারলেও স্বামীর ভাগ দিতে পারে না। এতে স্বামী যতোই খারাপ হোক না কেন? কবির যখন অন্য নারীর কাছে যেতো তখন আমি ওই রাতটা কীভাবে কাটাতাম তা তুই বুঝবি না পরী। তুই এমন একজন পুরুষ কে স্বামী হিসেবে পেয়েছিস যে শুধু তোর উপরেই আসক্ত। অন্য কোন নারীর দিকে সে চোখ তুলে তাকায়নি কখনো স্পর্শ তো দূরের কথা।
আব্বার এইসব জঘন্য কাজে আপা প্রতিবাদ করে। কিন্ত আব্বা তা মেনে নেয় না। তিনি আম্মার উপর জুলুম করে আপাকে থামাতে। এতে আপা ক্ষিপ্ত হয়ে আব্বাকে খুন করতে যায়। আরও অশান্তির সৃষ্টি হয় তখন। আম্মা তখন আপাকে দমিয়ে রাখে। তোর তখন চার বছর বয়স। কি বুঝবি অতটুকু বয়সে। আম্মা বুঝতে পেরেছিল যদি আপা বেশি কথা বলে তাহলে আব্বা আপাকে মারতেও দ্বিধা বোধ করবে না। তাই আম্মা আপাকে বাঁচানোর জন্য চুপ থাকতে বলে। কিন্ত তা আর হলো কই? রাখালের সাথেই পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়ে যায়। রাখাল কে অনেক মারে তখন। আপা সেটা দেখে আব্বার উপর আক্রমণ করে। তাই আব্বা সেদিন আপাকে মেরে ফেলে। কিন্ত গ্রামের সবাইকে এটা বলে যে আপা পালিয়ে গেছে।
তুই প্রতিশোধ প্রবণ সেটা তুই ভালো করেই জানিস। আপাকে তুই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস। অস্ত্র হাতে নেওয়ার সাহস তোর আছে। আব্বা সেটা ভাল করেই জানে। শশীল কে তুই মেরেছিস সেটা জানতে পেরে আব্বার মনে ভয় ঢুকেছে। কারণ সে জানতো তুই একদিন না একদিন ঠিকই আপার মৃ*ত্যুর কথা জানতে পারবি। আর সেদিন আব্বাকেও ছাড় দিবি না তুই। এজন্য তোকে আগেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্ত আম্মা তোকে এই বাড়ির ভেতর আগলে রেখেছেন বলে তোর কোন ক্ষতি হয়নি। আম্মা সবসময়ই অসুস্থ থাকে কি জন্য জানিস? তোকে বাড়ি থেকে বের করার জন্য বলতো আব্বা। কিন্ত আম্মা তা করতো না সেজন্য আব্বা খুব মারতো আম্মাকে। আমরা যাতে না জানতে পারি তাই আমাদের আম্মার ধারে কাছেও ঘেষতে দিতো না।
দাদীকে তুই খারাপ ভাবতি পরী। আমিও ভাবতাম কিন্ত একবারও ভেবে দেখিনি দাদী কেন এমন করতেন? দাদী নিজেও জমিদারের স্ত্রী ছিলেন। তাহলে সেও আম্মার মতোই কষ্ট পেয়েছেন। দাদী সবসময় আম্মাকে কাকার থেকে বাঁচিয়েছেন। শুধু কাকা নয় আরও খারাপ মানুষের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। সবার সামনে কঠোর থাকলেও আম্মার কাছে তিনি নিজের মা হিসেবে থেকেছেন। আমরা ভুল বুঝেছি দাদীকে।
জানি না এর শেষ কোথায়? আমার ছেলের ভবিষ্যত কি? কিন্ত পরী এখনও সময় আছে। শায়েরের সাথে চলে যা। তুই ওর সাথে ভালো থাকবি।’
পরী উঠে দাঁড়াল বলল,’একটা অপরাধীর সাথে আমি যেতে পারবো না। আব্বার সাথে সেও অপরাধ করেছে। শাস্তি তো তারও প্রাপ্য।’
-‘শায়ের অতোটা পাপ করেনি যা ক্ষমার অযোগ্য। তুই পারবি ওকে ক্ষমা করতে।’
-‘তাকে শাস্তি পেতে হবে তাহলেই সে ক্ষমা পাবে।’
কক্ষ ত্যাগ করে পরী। যাওয়ার সময় জেসমিনের ঘরে গিয়ে তাকে দেখে আসে। খুব বাজে ভাবে সে মেরেছে জেসমিন কে। যা দেখে রাগ দমাতে পারে না
পরী। তাই নিজ ঘরে চলে যায়। শায়ের কে সে আগের মতোই দেখে। তবে এবার সে জেগে ছিলো। পরীকে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল।
#চলবে,,,,