#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৩৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
“লাভ নেই এসব বলে! আ/গু/ন নিভবে না কিছুতেই। আর একটুর জন্য ম/রে যাচ্ছিলাম আমি। বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার স্বপ্নের শহরটা ভে/ঙেচু/রে খান খান হয়ে গেল।”
অভিমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাফায়াত। মুখমণ্ডল তার খরতরভাবে কুঁচকালো। সেই আকাশচুম্বী অভিমান কখন যেন রাগে পরিণত হলো তা বুঝাও গেলনা! অয়ন্তীর দিকে ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করলনা রাফায়াত। অদম্য রাগে গজগজ করে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল! ভয় পেয়ে গেল অয়ন্তী। ভী’তস’ন্ত্রস্ত। রাফায়াতের রাগকে প্রচণ্ড রকম ভ/য় পায় সে। কারণ, রেগে গেলে রাফায়াত তখন নিজের মধ্যে থাকেনা। হিং’স্র রূপ ধারণ করে তখন। মহা তাণ্ডব ঘটে যায় প্রায়। কেঁদেকেটেও কুল কিনারা করা যায়না৷ রাফায়াত কারো কান্নায় ভুলবার পাত্র নয়! অসুস্থ শরীর নিয়েই অয়ন্তী গলা ছেড়ে পেছন থেকে রাফায়াতকে ডাকল। যদিও জানে রাফায়াত এই মুহূর্তে তার কথা শুনবেনা! হলোও ঠিক তাই। রাফায়াত শুনল না অয়ন্তীর কথা। এক মুহূর্তের জন্যেও পিছু ফিরে তাকালনা। মনে মনে সে জানত একবার পিছু ফিরে তাকালেই তার রাগ সব বরফের মত গলে বিশুদ্ধ পানি হয়ে যাবে! অয়ন্তীর মায়ায় ডুবে যাবে। আজ অয়ন্তী যে মা’রা’ত্নক ভুল কাজটি করেছে সেই কাজটির জন্য তাকে চরম একটা শা/স্তি না দিলে সে পুনরায় একই কাজ করতে দ্বিধাবোধ করবেনা। আর এক্ষেত্রে রাফায়াতকে যতটুকু কঠোর হওয়া প্রয়োজন সে ততটুকুই কঠোর হবে। কোনো প্রকার ছাড়াছাড়ি হবেনা।
রাফায়াতকে কেবিন থেকে বের হতে দেখে অয়ন্তীর মা এবং বাবা করিডর থেকে দৌঁড়ে এসে অয়ন্তীর কেবিনে প্রবেশ করলেন। অমনি দেখতে পেলেন অয়ন্তী চোখ বুজে অকাতরে চোখের জল ছাড়ছে! কপাল এবং ভ্রু জোড়া কুঁচকে বিরামহীনভাবে কেঁদে চলছে। রাফায়াতকে ডাকতে ডাকতে তার গলার শক্তি প্রায় শূণ্য। অসুস্থ শরীর নিয়ে এত ডাকাডাকি করা যায় নাকি? তাও আবার ভীষণ রকমের দুর্বল সে। তবে অয়ন্তী এখন তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত! তার তো অন্তত একটু অপেক্ষা করা উচিৎ ছিল। রাফায়াতের প্রতি ভরসা রাখা উচিৎ ছিল। মনে মনে তো তারও জানা ছিল রাফায়াত তাকে মুক্ত করতে ঠিকই আসবে। এত সহজে রাফায়াত তাকে অন্য কারো হতে দিবেনা। অয়ন্তীর কোনো বিপদের আঁচ পেলে যেখানেই থাকুক না কেন সবার আগে রাফায়াত-ই ছুটে আসে। তবুও কেন সে ধৈর্য্যশক্তি হারিয়ে নিজে নিজে এই ধুরন্ধর পাকামিটা করতে গেল? এখন যদি সত্যিই তার খারাপ কিছু একটা হয়ে যেত তখন রাফায়াতের কী হত? রাফায়াত তো তাকে ছাড়া বেঁচেও ম/রে যেত!
অয়ন্তীর মা এবং বাবা মাথা নুইয়ে অয়ন্তীর পাশে এসে বসলেন। তারা কোথা থেকে কী শুরু করবেন তা খুব মন দিয়ে ভাবতে লাগলেন। তাদের দুজনের উপস্থিতি যদিও অয়ন্তী টের পেয়েছে তবুও সে খামোশ খেয়ে রইল। নিজের কৃতকর্মের জন্য কেবল চোখের জল ছাড়তে লাগল! আগ বাড়িয়ে কথা বাড়াতে চাইলনা। অয়ন্তীর মা হঠাৎ হেঁচকি তুলে কেঁদে অয়ন্তীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। অশ্রুসজল গলায় বললেন,,
“আমাদের মাফ করে দে মা। আমরা ভু’ল করেছি। তোর সাথে অ/ন্যায় করেছি। তোর মতামত ছাড়া হুট করেই বিয়ে ঠিক করে ফেলা আমাদের একদমই উচিৎ হয়নি! কিন্তু কী করব বল? বড়ো মেয়ের মৃ/ত্যু/র পর তুই-ই তো আমাদের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল। তোকে ঘিরেই আমাদের বাঁচা ম”রা। সেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আমরা কীভাবে পারি বল একটা বাউ’ণ্ডু’লে, স/ন্ত্রা/সী সর্বোপরি একটা বেকার ছেলের হাতে তোকে তুলে দিতে? তোরও একটা ভবিষ্যৎ আছে তাইনা? বাবা-মা হিসেবে তোর ভবিষ্যতটাও আমাদের দেখতে হবে বল?”
রেগে গেল অয়ন্তী! কান্না থামিয়ে সে গরম চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। বার বার হেঁচকি তুলে কর্কশ গলায় বলল,,
“মা প্লিজ। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমরা এত ভাবতে এসো না। আমি জানি, তোমরা এসব নিজেদের বুদ্ধিতে করছনা৷ করছ সব জেঠা আর জেঠির বুদ্ধিতে! তারা চাইছে তাদের মত তোমরাও যেন সন্তানহারা হও! বড়ো আপু তো অনেক আগেই গেছে এবার আমিও যাই। তাহলে ইকুয়েল ইকুয়েল হবে না? জেঠা জেঠিরাও নিঃসন্তান সাথে তোমরাও! বুঝছ না লজিকটা?”
অয়ন্তীর মা এবং বাবা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে অয়ন্তীর দিকে তাকালেন। সত্যিই তো হিসেবটা তারা মিলিয়ে দেখেননি! পানির মত স্বচ্ছ এই হিসাব৷ তাদের বোকামির জন্যই আজনএকটুর জন্য হলেই তারা তাদের আদরের ছোটো মেয়েকে হারিয়ে বসতেন! হিতাহিত বুদ্ধি ফিরে পেতেই অয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন অয়ন্তীর মা। আ/হত গলায় বললেন,,
“না মা। এসব কথা ভুলেও আর মুখে আনিস না। বালাইষাট আমরা কেন নিঃসন্তান হব হ্যাঁ? পরীর মত ফুটফুটে একটা মেয়ে সন্তান জীবিত থাকতে আমরা কেন নিঃসন্তান হব? তুই যেভাবে বলবি সেভাবেই হবে মা। রাফায়াতের সাথেই আমরা তোর বিয়ে দিব!”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অয়ন্তীর বাবা। মাথা উঁচিয়ে তিনি মমতাময় দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। ম্লান হেসে ক্ষীণ গলায় বললেন,,
“তুই দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফির মা। রাফায়াত আমার মেয়ে জামাই হিসেবে ততটাও খারাপ হবেনা! বেকার হয়েছে তো কী হয়েছে? আমার এত এত সম্পত্তি কে খাবে? আমার সব সম্পত্তি আমি বরং তোর এবং রাফায়াতের নামে লিখে দিয়ে যাব। প্রয়োজনে রাফায়াতকে একটা ভালো চাকুরীরও ব্যবস্থা করে দিব। শুধু রাফায়াত আমাকে আশ্বস্ত করবে যে রা/জ/নীতির পথ সে ছেড়ে দিবে! এসব লাইনে কারো লাইফই সিকিউর নয় মা। তাই আমি এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে তোকে রাফায়াতের সাথে বিয়ে দিতে পারব না!”
খুশি হয়ে গেল অয়ন্তী! কান্না ভুলে সে খুশিতে হাসতে লাগল। মা এবং বাবা উভয়ের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে সে প্রফুল্ল গলায় বলল,,
“সব ঠিক আছে বাবা। আমি তোমার সব শর্তে রাজি৷ রাদিফকে আমি বুঝাব। আশা করি সে বুঝবে। এই ব্যাপারে তোমার সাথেও কথা বলবে। আর একটা কথা? আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেই কিন্তু আমাদের এনগেজমেন্টটা সেরে ফেলবা তোমরা! এরপর না হয় রাদিফের চাকরী বাকরীর পর জাঁকজমকভাবে আমাদের বিয়েটা হবে।”
অয়ন্তীর খুশি দেখে অয়ন্তীর মা-বাবাও যেন ভীষণ খুশি। একমাত্র মেয়ের কথা অতি অনায়াসেই মেনে নিলেন তারা। পৃথিবীর সব বাবা-মায়েরাই চায় তাদের ছেলে সন্তানরা সুখে থাকুক। তারা যেভাবে ভালো থাকতে চায় সেভাবেই ভালো থাকুক। এক্ষেত্রে অবশ্যই অয়ন্তী বাবা-মা ও তার অন্যথায় নয়।
হসপিটাল থেকে চঞ্চলকে নিয়ে বের হয়ে গেল রাফায়াত। দুজনই হসপিটালের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে টানা সি/গা/রে/ট ফুঁকছে! সীমাহীন রাগে রাফায়াত কিছুক্ষণ পর পর সামনের অগোছালো চুলগুলো কেমন টেনে ধরছে। ক্ষণে ক্ষণে কপালের রগগুলোও তার ফুলে ফেঁপে উঠছে। নাক-মুখ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে ভ’য়ঙ্ক’র গোঙানির শব্দ! দুপুরের পর থেকে এই অবধি খাওয়াদাওয়া বন্ধ তার। অয়ন্তী অয়ন্তী করেই অভুক্ত কাটিয়ে দিয়েছে দিন রাতের প্রায় অধিকাংশ সময়। চঞ্চল হাজার টেনেও তাকে কিছু খাওয়াতে পারেনি। এত দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে হঠাৎ করেই রাফায়াতের এহেন রাগের কারণ বুঝতে পারলনা চঞ্চল! তাই সে কৌতূহলী দৃষ্টিতে পাশ ফিরে রাফায়াতের দিকে তাকালো। নির্বোধ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কী রে? কী হলো? তুই সাপের মত এমন ফোঁস ফোঁস করছিস কেন?”
“চট্টগ্রামের বাস কখন ছাড়বে জানিস?”
“মানে? কেন?”
“কেন আবার? বাড়ি যাব।”
“অয়ন্তীকে হসপিটালে রেখেই?”
“তো আর কী করব? কাজ তো শেষ আমার।”
“অয়ন্তী এখনও অসুস্থ ইয়ার। হসপিটাল থেকে রিলিজ দেয়নি।”
“তার বাবা-মা আছে। তাকে সুস্থ করার দায়িত্ব তাদের। আমার কর্তব্য যতটুকু ছিল আমি ঠিক ততটুকুই পালন করেছি। আপাতত আমার কাজ শেষ।”
হাত থেকে সিগারেটটি ছুড়ে ফেলল রাফায়াত। কোনো দয়ামায়া ছাড়াই পা দ্বারা পিষে ফেলল সি/গা/রেটটি। এলোমেলো হয়ে নির্জন রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটা ধরল সে! রাফায়াতের পিছু পিছু চঞ্চল ও ছুটল। রাফায়াতের হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ সে বুঝতে পারলনা। এই মুহূর্তে রাফায়াতকে কোনো প্রকার ঘাঁটাতেও চাইল না। বরং যা হচ্ছে হতে দেওয়া যাক। রাগের পরিমাণ কমে এলে রাফায়াত নিজেই তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে।
ভোরের বাস ধরে রাফায়াত এবং চঞ্চল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল! রাতের বাকিটা সময় অয়ন্তী নির্ঘুম কাটিয়ে দিলো। হাজার চেষ্টা করেও রাফায়াতের সাথে যোগাযোগ করতে পারলনা সে! রাফায়াতের ফোনটা রীতিমত সুইচ অফ আসছে। বুঝতে আর বাকী রইল না তার রাফায়াত তার সাথে রাগ করে হয়ত চট্টগ্রাম ফিরে গেছে। রাফায়াতকে অক্ষরে অক্ষরে চেনা হয়ে গেছে তার। চিনতে আর বিশেষ কিছুর বাকী নেই। রাগ করে এখন সপ্তাহ খানিক তার সাথে আর যোগাযোগ করবেনা রাফায়াত! তার নামটাও অবধি শুনতে পারবেনা। এরপর আবার নিজেই পাগল হয়ে যাবে একটা সেকেন্ড কথা বলার জন্য! এ কেমন পুরুষ মানুষ বুঝে পায়না অয়ন্তী। যার রাগ মাঝে মাঝে ভালোবাসার থেকে বেশী হলেও কখনো আবার সেই রাগ ভালোবাসার কাছে অতি তুচ্ছ।
_________________________________
মাঝখানে কেটে গেল প্রায় সপ্তাহ খানিক। বেশ তোরজোরেই চলছে অয়ন্তী এবং রাফায়াতের আংটি বদলের প্রস্তুতি! দুই পরিবার থেকেই তাদের সম্পর্কটা অতি সহজে-ই মেনে নেওয়া হয়েছে। ভালো একটা চাকরী বাকরী পাওয়ার পর এলাহি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অয়ন্তীকে তু’লে আনা হবে তারও কথাবার্তা প্রায় ভা’ঙ’চু’র হয়ে আছে। তবে এত খুশির মাঝেও যেন অয়ন্তীর মনে শান্তি নেই! সেদিনের পর থেকে রাফায়াতের রাগ যেন কমছেই না। বরং দিন কী দিন ক্রমশ বাড়ছে। হাজারটা কল করার পরেও রাফায়াত তার একটি কলও তুলছে না। বরং বিরক্ত হয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিচ্ছে। কখনো আবার ফোনটা রিসিভ করে তার ভাবীর হাতে তুলে দিচ্ছে! তবে এই নয় যে, অয়ন্তীর খোঁজ খবর রাখছেনা সে। তিনবেলা অয়ন্তীর মায়ের কাছে ফোন করে খোঁজ-খবর রাখছে সে অয়ন্তীর! কখনও ইচ্ছে করে অয়ন্তী ফোনটা তুললেও ঝট করে কলটি কেটে দিচ্ছে সে! তবে এনগেজমেন্টের জন্য আবার না বলেনি। বরং সে নিজেই আজকের দিনটি ঠিক করেছে এনগেজমেন্টের জন্য! সেই অনুযায়ী সকাল হতেই রাফায়াত এবং তার পরিবারের সকল সদস্যরা মিলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে। তাদের সাথে অবশ্য চঞ্চলও রয়েছে।
দুপুরের দিকেই তারা ঢাকা এসে পৌঁছালো। অয়ন্তীদের বাড়ি পৌঁছাতে দুপুর প্রায় দুইটার কাছাকাছি বেজে গেল। অয়ন্তীর বাবা আগে থেকেই বাড়ির মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আগেভাগে রাফায়াতের পরিবারকে এগিয়ে আনার জন্য। অয়ন্তীর অধিকাংশ আত্নীয়স্বজনরাই বাড়িতে উপস্থিত। যেহেতু বাড়িতে আজ ছোটো খাটো একটি অনুষ্ঠান আছে। তাই আত্মীয়স্বজনদের উপস্থিতি একান্তই কাম্য। গাড়ি ভর্তি ফলমূল, মিষ্টি, পান, রসমালাই নিয়ে হাজির রাফায়াতদের দু’দুটো ভাড়া করা মাইক্রো গাড়ি। অয়ন্তীর বাবা খুব অবাক হয়েছেন তাদের এই এলাহি খরচপাতিতে। তাদের থেকে এতটাও আশা করেননি তিনি৷ তবে রাফায়াতের আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে জানা আছে উনার!
রাফায়াতের পুরো পরিবারকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন অয়ন্তীর বাবা। এক এক করে সবাইকে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করিয়ে তিনি সবার খাতির, যত্ন, আদর-অ্যাপায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সাথে অবশ্য অয়ন্তীর মা ও রয়েছেন। প্রথমেই তারা ট্রে ভর্তি চা, নাশতা, শরবত, পেপসি, ফলমূল এবং হরেক রকমের মিষ্টি সাজিয়ে দিলেন। তবে তাদের মাঝে চঞ্চল এবং রাফায়াতকে দেখা গেলনা। তারা দুজন আলাদা বাইকে করে আসছে! সেই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা! শো-অফেরও হয়ত একটা ব্যাপার স্যাপার আছে। তাছাড়া ছেলেরা আর যাই পারুক বা না পারুক বাইক একটা নিয়ে ভালো ফুটুনিই দেখাতে পারে!
অয়ন্তীর আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে তার তিনটি দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই-বোনরাও উপস্থিত আছে। বোন দুটো অয়ন্তীর থেকে প্রায় এক, দু’বছরের বড়ো হবে। একজনের নাম সায়মা এবং অন্যজনের সায়রা। ভাইটা অয়ন্তীর থেকে প্রায় চারবছরের বড়ো। নাম তার ফারহান মির্জা। দেখতেও অমায়িক সে। যেমন ফর্সা তার গাঁয়ে রঙ তেমনি তার উচ্চতা। আর গানের গলা তো এতটাই শ্রুতিমধুর যে, সবাই তার গানের গলার প্রেমে পড়তে বাধ্য। যদিও অয়ন্তী কখনো ফারহান বা তার এত শত গুনের প্রেমে পড়েনি!
অয়ন্তীকে সাজানোর কাজে সায়মা এবং সায়রা খু্বই ব্যস্ত৷ গোলাপী রঙের একটি মকমলের শাড়ি পড়েছে অয়ন্তী! কোনো রকম সাজগোজ ছাড়া শুধু শাড়িটিতেই অয়ন্তীকে অপ্সরী লাগছে! না জানি সাজলে কতটা সুশ্রী দেখাবে তাকে। কতটা বেসামাল হয়ে উঠবে রাফায়াতের হৃদস্পন্দন তখন! তা ভেবেই যেন হয়রান অয়ন্তী। অনুষ্ঠান রাতে হলেও সাজগোজের শুরু এখন থেকেই তার! কেননা আজ যেকোনো ক্রমেই হোক রাফায়াতের রাগ ভাঙাতে হবে তার। নয়ত দেখা যাবে ফুলসজ্জার রাতেও রাফায়াতকে পাওয়া হবেনা তার!
অন্যদিকে, ফারহান ব্যস্ত বাড়ির সমস্ত এরেঞ্জমেন্টের কাজে। রাতে বাড়ির ছাদে এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান হবে। সেই অনুযায়ী ইভেন্ট প্ল্যানারদের সাথে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সে। এসব করতে করতেই তার চোখ দুটোও কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে! কারণ, একটা সময় ফারহান অয়ন্তীকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসত! মাঝখানে অনিক এসে সব ঘেঁটে দিয়েছিল। তার জায়গায় হুট করেই অনিকের সাথে অয়ন্তীর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেই দুঃখে তখন সে কানাডা চলে গিয়েছিল। অনিকের মৃ’ত্যু’র খবরটি শুনে সে দ্রুত কানাডা থেকে ব্যাক করেছিল। ভেবেছিল এবার অন্তত অয়ন্তীকে পাওয়া হবে তার। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের এবারও তাকে হেরে যেতে হলো! তার জায়গায় অন্য কারো সাথে আজ অয়ন্তীর এনগেজমেন্ট হলো হলো বলে!
বিকেল ঠিক চারটায় রাফায়াত এবং চঞ্চল অয়ন্তীদের বাড়ি এসে পৌঁছালো! হুট করেই একটা কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিল তারা। যদিও কী কাজ কেউই কিছু মুখ খুলে বলেনি! সবাই তাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুপুরের খাবারটাও খায়নি। রাফায়াত এবং চঞ্চল আসার পরই সবাই দুপুরের খাবার দাবার খেয়ে রেস্ট নিলো। খাবার টেবিলেও রাফায়াত একটিবারের জন্য অয়ন্তীর দিকে চোখ তুলে তাকায়নি! অনেক ইশারা ইঙ্গিত করেও রাফায়াতের দৃষ্টি হরণ করতে পারেনি সে! খাবার শেষে রাগে অয়ন্তী উপরে ওঠে গেল। রাগে গাঁ থেকে শাড়িটা খুলে ফেলল। কোনো মানেই হয়না এই গরমের মধ্যে এত ভারী শাড়ি পড়ে থাকার। মুখভর্তি মেকাপ করে রাখার। যেখানে রাফায়াত একটি বারের জন্যও তার দিকে ফিরে তাকালো না। সেখানে এভাবে সং সেজে থাকার কোনো মানেই হয়না।
শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে অয়ন্তী বিছানার উপর উবুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। দরজা লক করেছে কিনা সেদিকে খেয়াল নেই তার। অনেক যাবত কান্নাকাটির পর সে খেয়াল করল কেউ তার পাশে শুয়ে আছে। বিছানাটা কেমন যেন নড়েচড়ে উঠেছে। কান্না থামিয়ে অয়ন্তী হুড়োহুড়ি করে চোখ তুলে পাশ ফিরে তাকালো। অমনি দেখল রাফায়াত মাথায় রেখে লম্বা হয়ে তার পাশে শুয়ে আছে! চোখ দুটো বন্ধ তার। অবাক হয়ে অয়ন্তী কিছু বলার পূর্বেই রাফায়াত শীতল গলায় অয়ন্তীকে বলল,,
“তোমার এই উ’দো’ম শরীর দেখতে আমি আসিনি। শাড়ি গাঁয়ে পড়ার জিনিস। যেখানে সেখানে ফেলে রাখার মত জিনিস নয়।”
ঝড়ের বেগে অয়ন্তী শোয়া থেকে ওঠে বসল। ফোলাফোলা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে অবশেষে শাড়িটা তার ড্রেসিং টেবিলের নিচে পড়ে থাকতে দেখল। তাড়াহুড়ো করে শাড়িটা সে গাঁয়ে প্যাঁচিয়ে নিলো। অমনি রাফায়াত তার চোখজোড়া খুলল। কপাল থেকে হাত সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় অয়ন্তীর লাল হয়ে থাকা কান্নাজড়িত মুখমণ্ডলের দিকে তাকালো। ঠাণ্ডা মেজাজে শুধালো,,
“রুমের দরজাটা তখন লক করলে না কেন? আমার জায়গায় যদি অন্যকেউ এসে রুমে ঢুকত তখন কী হত?”
অয়ন্তীর ত্যাড়া উত্তর,,
“ঢুকলে ঢুকত! তো কী হত? যাকে দেখাতে চাই সে যেহেতু দেখতে চায়না এরচেয়ে ভালো আমি বাকিদের দেখাব!”
রাফায়াত যেন তেড়েফুড়ে এলো অয়ন্তীর দিকে! হেঁচকা টানে অয়ন্তীকে তার দিকে ঘুরিয়ে নিলো। অয়ন্তীর থুতনী চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“কী বলছস? আবার বল?”
“কেন? শুনতে পান না আপনি? কানে কালা নাকি?”
“বাড়তি কথা নয়। যা শুনতে চাইছি তা আবার বলো?”
“আবার তুমিতে কেন? তুই-ই তো সুন্দর দেখাচ্ছিল!”
“রেগে গেলেই আমি তুই তুকারি করি। আশা করি এটা নতুন শুনছ না?”
“গালে ব্য’থা পাচ্ছি। ছাড়ুন।”
“আর কখনো দরজা লক না করে গাঁ থেকে কাপড় চোপড় খুলবা?”
“খুলব! একশবার খুলব। এতে আপনার কী হ্যাঁ? এতকিছু করে ও তো আপনার চোখ আমার দিকে পড়েনা। বাইরের বেটি মানুষের উপরেই পড়ে! লাভ কী আপনার কথা শুনে?”
“আশ্চর্য! কার দিকে আমার আবার নজর পড়ল?”
“দেখি নাই? আপনি যে ভাবির চাচাতো বোনের ছবিতে সো প্রিটি বলে কমেন্ট করেছেন। তার প্রতিটা ছবিতেই আপনার কমেন্ট! শুধু আমার ছবিতেই আপনার কোনো কমেন্ট নাই। বাইরের মেয়ে মানুষই সুন্দর। নিজেরটাই কুৎসিত।”
#চলবে…?
#এক_খণ্ড_কালো_মেঘ
#পর্ব_৩৮
#নিশাত_জাহান_নিশি
“দেখি নাই? আপনি যে ভাবির চাচাতো বোনের ছবিতে সো প্রিটি বলে কমেন্ট করেছেন। তার প্রতিটা ছবিতেই আপনার কমেন্ট! শুধু আমার ছবিতেই আপনার কোনো কমেন্ট নাই। বাইরের মেয়ে মানুষই সুন্দর। নিজেরটাই কুৎসিত।”
তাজ্জব বনে গেল রাফায়াত। সচকিত দৃষ্টি ফেলল অয়ন্তীর অতি রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে, কঠোর রুক্ষতায় নিমজ্জিত মুখমণ্ডলে। অতিরিক্ত কান্নার দরুন তার চোখ দুটোর পাশাপাশি মুখটিও কেমন ফুলেফেঁপে উঠেছে। অতিশয় যেন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে তার শুভ্র মুখের আদলটি। অয়ন্তীর এহেন অতিরঞ্জিত সন্দেহের ধাঁচ দেখে কপাল কুঁচকালো রাফায়াত। হয়রান হয়ে গেল সে। খরতর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“ভাবির কাজিনের ছবিতে কমেন্ট করেছি বলেই কী আমি খারাপ হয়ে গেলাম হ্যাঁ? আমার নজর এখন অন্য মেয়ে মানুষের দিকে চলে গেল? এসব অফেন্সিভ জিনিস তুমি ভাবো কীভাবে? সারাদিন মাথায় ফাও চিন্তা নিয়ে ঘুরো।”
“এসব অফেন্সিভ জিনিস হ্যাঁ? অফেন্সিভ জিনিস? নজর যদি আপনার অন্যদিকে নাই যেত তাহলে নিশ্চয়-ই উনার প্রতিটা ছবিতে আপনার লাইক, কমেন্ট থাকত না? শুধু তাই নয় আপনার অধিকাংশ মেয়ে ব্যাচমেটদের ছবিতেও আপনার একের অধিক কমেন্ট থাকত না! বাহ্ বাহ্ কমেন্টের যা ছিরি! দেখেছি তো এই এক সপ্তাহে আপনি ঠিক কী কী করেছেন। সারাক্ষণ ফেসবুকে শুয়ে বসে থেকে শুধু মেয়েদের ছবিতেই একের পর এক লাভ রিয়েক্ট করে গেছেন আর প্রেম মাখানো কমেন্ট করেছেন। আমি ইনবক্সে নক করলেই শুধু আপনার ভাব বেড়ে যেত। আমার মেসেজ সিন করতে রিপ্লাই করতেও আপনার কষ্ট হত। বেডা মানুষ তো এমনই! আমারই ভুল ছিল। অতিরিক্ত বিশ্বাস করা আর এত এত এক্সপেকটেশন রাখা।”
ব্যগ্র হেসে উঠল রাফায়াত। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও সে কদাচিৎ হাসল। দেখে মনে হলো যেন পরিস্থিতি সব শান্ত। অয়ন্তীর এহেন টইটম্বুর রাগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা তার বেশ ভালো ভাবেই জানা! চালু এই বিষয়ে সে। টুপ করে অয়ন্তীর কপালে দীর্ঘ এক চু’মু এঁকে দিলো রাফায়াত! চু’মু খেতেই খেতেই সে আদুরে গলায় বলল,,
“হয়েছে হয়েছে থামো। আর কিছু বলতে হবেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাও যদি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে না? আমার নজর তখনও অয়ন্তীকে ছাড়া অন্যকারো দিকে যাবেনা! অয়ন্তী আমার জীবন, অয়ন্তী আমার মরণ। এই দুই কালের মধ্যে কোনো কালেই অন্য কোনো মেয়ে মানুষ আমার জীবনে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই! তাই এসব ভ্রান্ত ধারণা মাথায় রেখে অযথা চাপ নিওনা। ঐদিন তুমি যে ভুল কাজটি করছিলে না? তার শাস্তি এতদিন পেয়েছ। শাস্তির পালা শেষ। এবার শুধু ভালোবাসার পালা।”
প্রশান্তিতে চোখজোড়া বুজে নিলো অয়ন্তী। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল সে। খুশিতে দীর্ঘ এক স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অবিলম্বেই রাফায়াতের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরল সে। মৃদু স্বরে বলল,,
“নিজেকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আর কখনো সু’ই’সা’ই’ড করবার প্রয়োজন পড়বে না আমার। আপনার একটুখানি অবহেলাতেই আমি প্রতিবার ম*রে যাই রাদিফ! মৃ*ত্যুর মত যন্ত্রণা হয় তখন। এই সাতদিনে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে আমি বুঝি রোজ একটু একটু করে ম’রে যাচ্ছি। আপনার একরত্তি অবহেলাও আমার সহ্য হয়না রাদিফ। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অয়ন্তী। সাতদিনের শাস্তিটা একটু বেশিই হয়ে গেল মনে হচ্ছে। এতটাও কষ্ট দেওয়া উচিৎ হয়নি অয়ন্তীকে। অতি আবেগী হয়ে উঠল রাফায়াত। ইচ্ছে করেই অয়ন্তীর কষ্টের কারণ হতে হয়েছে বলে তার নিজেকে কেমন যেন নিকৃষ্ট মনে হতে লাগল ! যাকে এত বেশী ভালোবাসে তাকে ইচ্ছাপূর্বক ভাবে কষ্ট দেওয়াটা কী আদো সাজে? আবেগ আপ্লুত হয়ে রাফায়াত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল অয়ন্তীকে। শিথিল কণ্ঠে অয়ন্তীকে কিছু বলার পূর্বেই হঠাৎ দরজার ওপার থেকে ফারহানের গলার স্বর ভেসে এলো। উঁচু গলায় দরজায় সে কড়া নেড়ে বলল,,
“অয়ন্তী শুনছ?”
অবিলম্বেই রাফায়াতকে ছেড়ে দাঁড়ালো অয়ন্তী। বিষয়টায় বিরক্তবোধ করল রাফায়াত। ব্যক্তিগত মুহূর্তে হঠাৎ কারো আগমন যেন বিষের ন্যায়! রাফায়াতের এমন একটা ভাব যেন কতযুগ পর তার অয়ন্তীকে কাছে পাওয়া! সব ব্যথা ভুলে একটুখানি স্বস্তির সন্ধান পাওয়া। এরমধ্যেই হঠাৎ তৃতীয় ব্যক্তির আগমন। মেজাজটাই আগু’নের ন্যায় গরম। দরজার ঐ পাড়ের ব্যক্তিটির মাথা ফা’টাতে ইচ্ছে হলো তার। হম্বিতম্বি হয়ে অয়ন্তী রুমের দরজাটি খুলে দিলো। অমনি দরজার ওপারে অস্থির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহানের দিকে সে উদগ্রীব দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তৎপর গলায় শুধালো,,
“কী হয়েছে ফারহান ভাই?”
“তোমাকে খালামনি ডাকছেন।”
“ওহ্। আচ্ছা আপনি যান। আমি একটু পরে যাচ্ছি।”
“না না। এখনি যাও। ইট’স আর্জেন্ট।”
“খুব বেশিই আর্জেন্ট?”
“খালামনি তো আমাকে তাই বললেন। তুমি গিয়ে দেখে আসতে পারো।”
পিছু ফিরে রাফায়াতের দিকে তাকালো অয়ন্তী। অপারগ হয়ে মৃদু গলায় বলল,,
“আপনি একটু বসুন। আমি আসছি।”
রাগে মুখ ঘুরিয়ে নিলো রাফায়াত। হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। রাফায়াতের রাগের কারণ যদিও অয়ন্তী বুঝতে পেরেছে তবে এই মুহূর্তে তার নিচে যাওয়াটা জরুরি মনে হলো। ফারহানকে ডিঙিয়ে অয়ন্তী রুম থেকে বের হয়ে গেল। অমনি ফারহান ফট করে এসে রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে এসে ক্ষিপ্ত রাফায়াতের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ক্রুর হেসে তার ডান হাতটি রাফায়াতের দিকে এগিয়ে দিলো। বিনয়ের স্বরে বলল,,
“হায়। আমি ফারহান।”
বিব্রতবোধ করল রাফায়াত। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে একবার ফারহানের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। হঠাৎ-ই সে ভ্রু যুগল খরতরভাবে কুঁচকে নিলো। হাত দুটি বুকের উপর গুটিয়ে দাঁড়ালো। অতিরিক্ত ভাব দেখিয়ে বলল,,
“আমি রাফায়াত।”
চরম অপমান বোধ করল ফারহান। সঙ্গে সঙ্গেই সে তার তার হাতটি গুটিয়ে নিলো। যথেষ্ট ধৈর্য্য নিয়ে চুপচাপ থাকার চেষ্টা করল। দাঁতে দাঁত চেপে সব অপমান সহ্য করল। জোর পূর্বক হেসে বলল,,
“তো বলুন? আর কী খবর আপনার? আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
“না তো! কে আপনি?”
“অয়ন্তীর খালাতো ভাই।”
“আগে কখনো দেখিনি।”
“দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই।”
“ওহ্।”
“তো? অয়ন্তীকে চিনেন কতবছর ধরে?”
“আগে বলুন। অয়ন্তীকে আপনি ভালোবাসেন কতবছর ধরে?”
হকচকিয়ে উঠল ফারহান! পাঞ্জাবির কলারটা টেনে ঠিক করল সে। তোতলানো গলায় বলল,,
“মামামানে?”
উচ্চশব্দে হেসে উঠল রাফায়াত। মিনিট কয়েক বাদে সে তার তাচ্ছিল্যের হাসি থামালো। নাক টেনে ভাবশূণ্য গলায় বলল,,
“কিছুনা।”
ফারহানকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল রাফায়াত! দাঁতে দাঁত চাপল। কঠিন গলায় ফারহানকে লক্ষ্য করে বলল,,
“উপর ওয়ালা যখন থেকেই আমার ভাগ্যে অয়ন্তীকে লিখে রেখেছে তখন থেকেই আমি অয়ন্তীকে চিনি। আমাদের মাঝখানে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির একছটা আর্বিভাবও মানে হলো আমার কাছে যু’দ্ধ’ক্ষে’ত্র! নেক্সট টাইম থেকে যেন না দেখি আমার কাছ থেকে আমার অয়ন্তীকে আলাদা করার জন্য বাড়তি কোনো এক্সকিউজ দেখাতে। আই ডোন্ট লাইক দিস টাইপ অফ ডেম বিহেভিয়ার।”
উগ্র মেজাজে রাফায়াত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই হঠাৎ অয়ন্তীর মুখোমুখি পড়ে গেল। জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে অয়ন্তী উপরেই উঠছিল। এরমধ্যেই হঠাৎ রাফায়াতের সম্মুখীন হয়ে যাওয়া। রাফায়াতকে দেখ মৃদু হাসল অয়ন্তী। হাসিখুশি গলায় বলল,,
“উপরেই যাচ্ছিলাম আমি। জুসটা আপনার জন্য।”
রাগে নাকের ডগা লাল হয়ে উঠল রাফায়াতের। ক্ষিপ্র দৃষ্টি ফেলল সে অয়ন্তীর দিকে। চোঁয়াল উঁচিয়ে শুধালো,,
“ফারহান ছেলেটি তোমাকে পছন্দ করে?”
ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হলো অয়ন্তী। হঠকারি দৃষ্টিতে রাফায়াতের দিকে তাকালো। উজবুক গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,
“মানে?”
অয়ন্তীর মুখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে ধরল রাফায়াত। অয়ন্তীকে শাসিয়ে ক্ষোভমাখা গলায় বলল,,
“এরপর থেকে যদি ফারহানের ধারে কাছে তোমাকে দেখিনা? এর ফল কিন্তু ভালো হবেনা। ওয়ার্ণ করলাম তোমাকে।”
“কী হয়েছে আপনার বলুন তো? আপনি এমন করছেন কেন? তাছাড়া আপনাকে কে বলল যে ফারহান ভাই আমাকে পছন্দ করে?”
“বলতে হয়না। চোখ দেখলেই বুঝা যায়। আমি এত কথা বুঝিনা। ফারহানের থেকে দূরে থাকতে বলছি তোমাকে থাকবা। আর কোনো কথা না।”
জুসটা না খেয়েই অয়ন্তীকে উপেক্ষা করে রাফায়াত বাড়ি থেকে প্রস্থান নিলো। বেকুব বনে গেল অয়ন্তী। নিশ্চল দৃষ্টিতে সে রাফায়াতের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। এরমধ্যেই হঠাৎ আবির্ভাব ঘটল ফারহানের। অয়ন্তীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সে রুক্ষ গলায় বলল,,
“এই রাফায়াত ছেলেটা কী পাগল অয়ন্তী? এ কাকে বিয়ে করছ তুমি? একটা পাগল ছাগল ছেলেকে? যার মধ্যে নেই কোনো নূন্যতম মেনারস! নেই কোনো ভদ্রতা, সভ্যতা। রীতিমতো বে’য়া’দব একটা ছেলে!”
চোখ লাল করে উঠল অয়ন্তী। রাফায়াতকে নিয়ে ছোটো বড়ো কোনো কথাই যেন তার হজম হয়না! মাথায় আ’গু’ন জ্বলে ওঠো। অবিলম্বেই ফারহানের দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অয়ন্তী। শোধ বোধ হারিয়ে উঁচু গলায় বলল,,
“মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ ফারহান ভাই। আমার রাদিফ সম্পর্কে আর একটা বাজে কথাও যদি আপনার মুখে শুনেছি তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবেনা। আমার রাদিফ অভদ্র হোক, অসভ্য হোক কিংবা বে’য়া’দব হোক ইট’স মাই প্রবলেম। ইট’স নট ইউর প্রবলেম। তাছাড়া আপনি তো একটা মিথ্যেবাদী! আপনি না ঐসময় বলেছিলেন আম্মু আমাকে ডাকছে? মিথ্যে বলেছিলেন আপনি তখন। হয়ত আমার রাদিফ যাই সন্দেহ করছিল তাই ঠিক! আপনার থেকে দূরে থাকতে হবে আমাকে। ক্ষতিকর আপনি আমার জন্য!”
ফারহানকে কিছু এক্সপ্লেন করার সুযোগ না দিয়েই অয়ন্তী উপরে উঠে গেল। ফারহানের চাপা ক্ষোভ এবার ক্রমশ বাড়তে লাগল! ভাবতে লাগল কী উপায়ে দুজনের দম্ভ ভাঙা যায়! দুজনের ভালোবাসা একসাথে বি’না’শ করা যায়।
সন্ধ্যার পর পরই এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। সুষ্ঠুভাবে এনগেজমেন্ট সম্পন্ন হলেও রাফায়াতের মনে সংশয় কাজ করতে লাগল! কী যেন এক অদৃশ্য দ্বিধায় সে জ্ব’লে পু’ড়ে ছাই হতে লাগল। ফারহান তার চ’ক্ষুশূল হয়ে উঠল৷ অয়ন্তীর কাছাকাছি ফারহানের অস্তিত্ব যেন রাফায়াতকে ভেতরে ভেতরে দ্বগ্ধ করতে লাগল। এনগজমেন্টের অনুষ্ঠান শেষ হতেই রাফায়াত খাওয়াদাওয়া ছাড়াই বাইক নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল! এখানে থাকলেই তার ফারহানের প্রতি খারাপ মনোভাব অনায়াসে বাড়তে থাকবে। হয়ত অয়ন্তীর সাথেও মিস বিহেভ করে ফেলতে পারে! সে নিজেই তার রাগকে ভয় পায়! এই মুহূর্তে সে চায়না তার মাত্রাতিরিক্ত রাগের জন্য অয়ন্তী আবারও কষ্ট পাক। আবারও হাসিখুশি অয়ন্তীর চোখে জল আসুক।
________________________________
সপ্তাহ খানিক পর। রাত প্রায় দুইটার কাছাকাছি তখন। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অয়ন্তী। হঠাৎ তার রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। বেগতিক বাড়তে লাগল সেই কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম। শোয়া থেকে ধরফড়িয়ে উঠল অয়ন্তী। আবিষ্ট দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকালো৷ ঘুম জড়ানো গলায় উচ্চ আওয়াজে বলল,,
“কে?”
দরজার ঐপাশ থেকে নিচু গলায় উত্তর এলো,,
“দরজাটা খোলো।”
রাফায়াতের গলার স্বর চিনতে বেশী দেরি হলোনা অয়ন্তীর! লাফিয়ে উঠল সে বসা থেকে। ওড়না ছাড়াই এক প্রকার দিশেহারা হয়ে সে দরজার কাছে দৌঁড়ে গেল৷ দ্রুত হাতে দরজার খিলটা খুলে দিতেই রাফায়াতকে র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় দেখতে পেল সে! সঙ্গে সঙ্গেই আ’ত’ঙ্কে চিৎকার করে উঠল অয়ন্তী। ভীরু গলায় বলল,,
“কী হয়েছে আপনার?”
ইতোমধ্যেই অয়ন্তীর গাঁয়ে ঢলে পড়ল রাফায়াত! শরীরের সমস্ত শক্তি খুইয়ে সে অবচেতন প্রায়। ম্লান গলায় অয়ন্তীকে বলল,,
“আই নিড টু রেস্ট অয়ন্তী। তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমুতে দিবে? এই প্রথম কা’টা ছে’ড়া’য় আমার এতটা ভয় লাগছে। শরীরে ব্যথা লাগছে।”
ম*রা কান্না জুড়ে দিলো অয়ন্তী। র*ক্তা*ক্ত রাফায়াতকে টে*নে হেঁছ*ড়ে সে রুমের ভেতর ঢুকিয়ে নিলো। জোর করে বিছানার উপর শুইয়ে দিলো তাকে। গাঁ থেকে শার্টটা খুলতেই দেখতে পেল বুকের কয়েক জায়গায় কা’টা ছে’ড়ার দাগ! গভীর ক্ষত হয়ে আছে জায়গাগুলোতে। হাত-পা কাঁপতে লাগল অয়ন্তীর। কণ্ঠনালী যেন বসে গেল। আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারছেনা সে। রাফায়াতের বিমূর্ষ মুখমণ্ডলে সে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। থরথরে গলায় বলল,,
“কেকেকে মে’রে’ছে আপনাকে?”
দুর্বল গলায় রাফায়াত প্রত্যুত্তরে বলল,,
“আজ থেকে আমি মুক্ত অয়ন্তী। রাজ’নী’তির পথ পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি আমি! এই মুহূর্ত থেকে আমার নতুন জীবন শুরু। কারো সাথে আর কোনো বিবাদে জড়াব না আমি। খুব শীঘ্রই আমাদের ছোটো একটা সংসার হবে। শারীরিক এবং মানসিক ভাবে প্রস্তুত আমি।”
হেঁচকা টানে রাফায়াত অয়ন্তীকে তার বুকের মাঝে চেপে ধরল। কা*টা স্থানগুলোতে তার ব্যথার অনুভূতি হচ্ছে তবুও সে অয়ন্তীকে বুকের মাঝে সঁপে নিলো। শিথিল গলায় বলল,,
“ব্যথাগুলো সব দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবেই কিছুক্ষণ জড়িয়ে থাকো আমাকে। ডক্টর ডাকার কোনো তাড়া নেই। এত সহজে আমার মৃ*ত্যু নেই।”
#চলবে…?