#নিরবতায়_হৃদয়_কোনে
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১৫
খোলা অন্তরিক্ষে চাঁদের স্নিগ্ধ হাসিটি ও আজ বি*ষা*ক্ত রূপ নিয়েছে। এ কেবল মিতালীর দৃষ্টিতে। জানালার ধারে শয্যা হওয়ায় বিস্তৃত গগনতল দৃষ্টি সম্মুখে স্পষ্ট দৃশ্যমান। খোলা জানালার ফাঁক গলিয়ে অদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কি যেন একটা ভেবে ভেবে ম*রি*য়া হয়ে উঠলো সে।
তৎক্ষনাৎ আব্বার ঈষৎ কাঁপা কন্ঠস্বরের ডাক পড়লো। ভাবনা তার ভাটা পড়লো। আব্বার আদর মাখা ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলোনা মিতালী। বিছানা ছেড়ে আব্বার কাছে গেলো।
মেয়েকে পাশে বসালেন মতিন সাহেব। পরম মমতায় চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বললেন,
-“তুই এত চিন্তা করিস না মা। তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়া আমি কিছুই করুমনা। তোর মা যা ইচ্ছা বলুক গা। তুই নিজেরে নিয়া ভাব।”
রোজী বেগম সবই শুনতে পেলেন। গরম তেলে একফোঁটা পানির ন্যায় ছ্যাৎ করে উঠলেন তিনি। ঘোড়ার গতিতে বাবা – মেয়ের মাঝখানে ঢুকলেন। কন্ঠে তেজ নিয়ে বললেন,
-“আমার কথার দাম থাকবে ক্যান? মাইয়ার উপর বইসা খাইতে ভাল্লাগবো। এত খাটাখাটুনিতে অল্প কয়েকদিনেই চেহারা যা ভাঙাচোরা হইছে। আরো কয়েকদিন গেলে কেউ আর বিয়া ও করতে চাইবোনা। এত ভালা পোলা, ভালা সম্বন্ধ পায়ে ঠে*ল*তা*ছো বাপ – মাইয়া মিল্লা। আমি আইজই চেয়ারম্যান সাহেবরে কমু বিয়ার বন্দোবস্ত করতে।”
স্ত্রীর আচরণে ক্ষু*ব্ধ হলেন মতিন সাহেব। হাঁক ছাড়লেন তিনি। বললেন,
-“বেশি লো*ভ করন ভালা না। বেশি খাইতে চাইলে পরে অল্পের নাগাল পাইবানা।”
মাথায় এক চিনচিনে অনুভূতি খেলা করলো। এমন ঝা*মে*লা আরো কিছুক্ষণ স্থগিত থাকলে পা*গ*ল হয়ে যাবে মিতালী। অস্থির লাগছে সবকিছু। রা*গ লাগলো ভীষণ। ঘরের সমস্ত জিনিস ভাঙচুর করার ইচ্ছে জাগলো। জীবন যখন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখন চারদিক থেকেই সমস্যারা ঝেঁকে ধরে। বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ম*রে যায়। তবুও এই মানুষগুলোর কথা ভেবে আবারও বাঁচার আকাঙ্ক্ষা জাগে।
মিতালী বিরক্ত হয়ে খানিক উচ্চস্বরে বলল,
-“চুপ করবে মা? বিয়ে করে নিলেই সব সমস্যা চুকে যাবে? আমার কোন ইচ্ছের দাম নেই তোমার কাছে? ভালো ছেলে, ভালো ঘর, ভবিষ্যতে আর কোন চিন্তা থাকবেনা। এটাই তোমার ভাবনা তো?
কিন্তু মা তোমার ধারণা ভুল ও তো হতে পারে। হতে পারে আমার জীবনটা বন্দি খাঁচার পাখির মত হয়ে গেল। তোমাদের জীবন আরো দুর্বি*ষহ হয়ে উঠলো। তোমরা এখন নিজের সারাজীবনের অর্জিত সম্পত্তি ভো*গ করছো। তোমাদের সেই সম্পদ তোমাদের সন্তান। অন্যকারো সন্তান নয়।
আমায় বিয়ে দিয়ে অন্যের দয়া নেবে? কেন নেবে? আজ নিজের চাহিদার কথা মেয়েকে যেভাবে মুখ ফোটে বলতে পারছো, তখন ও কী বলতে পারবে?
পারবে না। কারণ তখন তোমার নিজের ও লজ্জা করবে এই ভেবে যে, পরের কাছে কত চাইবো?
কেউ খুশি হয়ে এক টাকা দেওয়া আর তাকে বারবার মনে করিয়ে দশ টাকা চেয়ে নেওয়া সমান কথা নয়।
ঘরে বাজারের সংকট হলে সন্তানকে যেমন নির্দ্বিধায় বলা যায়, তা মেয়ের জামাইকে বলা যায়না। সন্তান ভুলে গেলেও তাকে দ্বিতীয়বার মনে করিয়ে দিতে অস্বস্তি হবেনা। কিন্তু মেয়ের জামাইকে মনে করিয়ে দিতে ঠিকই তোমার অস্বস্তি হবে। অপমানে লাগবে।
হয়তো একসময় সেই মানুষটিও বিরক্ত হবে, কিন্তু মুখ ফোটে কিছু বলবেনা। তাহলে বলো তুমি কোনটা চাও? ধরাবাঁধা জীবন, না-কি এক টাকায় নিজের সংসারে সুখ?”
একঘেয়ে রোজী বেগম বুঝলেন না। তিনি চওড়া গলায় বললেন,
-“লম্বা লম্বা ভাষণ দিয়া জীবন চলেনা। তোর বিয়া চেয়ারম্যানের পোলার লগেই হইবো। এডাই আমার শ্যাষ কথা।”
শান্তশিষ্ট মেয়েটা মুহূর্তেই উশৃংখল রূপ ধারণ করলো। হিতাহিতজ্ঞান শূন্যে তুলে বে*য়া*দ*বি করে বসলো। সামনে থেকে মেলামাইন এর মগ তুলে আছড়ে ফেললো। মাটিতে টপকে টিনের সাথে গিয়ে ঝনাৎ শব্দে লাগলো। দু’টুকরো না হলেও ফেটে গেলো মগটি। মেয়ের এমন রা*গ দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন রোজী বেগম। হাত চালাতে আর দেরি করলেন না। বাঁ গালে স*পা*টে চ*ড় বসালেন।
-“একটা বে*য়া*দ*ব জন্ম দিছি আমি। এই দিন দেখার লাইগা তোরে পেটে ধরছি?”
মিতালীর চোখজোড়া পানিতে ভরে উঠলো। তার চৌচির হয়ে ফেটে যাওয়া ভেতরটা যদি কাউকে দেখাতে পারতো। পরিবারের কথা চিন্তা করে শতবার সে মনের বিরুদ্ধে লড়েছে। স্থান দিয়েছে মস্তিস্ককে। একটা মানুষ কতবার ভাঙলে তাকে আর ভাঙা যায়না? মায়ের আচরণ আজ তাকে পীড়া দিয়েছে। সে যে বেয়াদবি করেনি, এমনটা ও নয়। মা তো তার কঠিন মুহূর্তে পাশে থেকে তাকে সাহস যোগাতে পারতো। কিন্তু তিনি সেটা না করেই মেয়ের উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন।
মতিন সাহেব ধ*ম*কে উঠলেন স্ত্রীকে,
-“এত বড় মাইয়ার গায়ে হাত তোলন কোন অভ্যাস? তুমি আর আমার মাইয়া গো গায় হাত দিবা না। যা কওনের মুখে কইবা।”
মিতালীকে কাছে ডাকলেন। সে গেলোনা। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো গালে হাত দিয়ে। রোজী বেগম দপদপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন। মতিন সাহেব আবারও মেয়েকে ডাকলেন। মিতালী ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো।
তিনি নরম সুরে মেয়েকে বোঝালেন,
-“মায়ের লগে এমন আচরণ ঠিক না মা। তোর মায়ের রা*গ কমলে ঠিকই সব বুঝবো।”
-“আমি এখন যাই আব্বা।”
মিতালী আর দাঁড়ালোনা। ঘরে ফিরেই কাঁথার নিচে মুখ লুকালো। মুক্ত করলো দুঃখ নামক কিছু জলের ফোঁটা।
মাহা পড়ার টেবিলে বসেও পড়ায় মন দিতে পারেনি। অনিমিখ নেত্রে বিধস্ত বোনকে দেখে যাচ্ছে। তাদের জীবনে এত বি*ষা*দ কেন?
★★★
নির্ভীক আর বাড়াবাড়ি করলোনা। না কোনো কবিতা পাঠ করলো। পূর্বের সেই ভালো বন্ধুর মতো তার আচরণ স্বাভাবিক রইলো। তার মুখশ্রী ম্লান হয়ে আসা সূর্য রশ্মির মতোই দেখালো। সে যেমন দিনের শেষ ভাগে তেজ হারিয়ে নিস্তেজ অন্ধকারে তলিয়ে যায়, ঠিক তেমনি।
ঢিলে হয়ে আসা ঝুঁটি রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিলো মিতালী। তাদের মধ্যকার নিরবতা ছেঁদ ঘটালো নির্ভীক। বি*ষা*দ চিত্তে আলতো হেসে বলল,
-“তুই তো এখন আমাদের বাড়ির বউ হবি, বন্ধু থেকে ভাবি হয়ে যাবি আমার। ওহ্! ভুলেই গেলাম আমার তো বাড়িই নেই।”
মিতালী অসহায় চাহনিতে চাইলো। নির্ভীকের ভেতরটা তার অজানা নয়, বরং তার কাছে সহজ ভাষায় একটি খোলা বই। প্রত্যুত্তর করতে পারলোনা মিতালী।
হুট করেই তাদের মাঝে ইশরাকের আগমন ঘটলো। কোনো ধরনের ফর্মালিটি ছাড়াই নির্ভীকের উদ্দেশ্যে বলল,
-“মিতালীর সঙ্গে আমার কথা আছে। তুই একটু সরে দাঁড়া।”
নির্ভীক একবুক অভিক্ষেপ আর একরাশ অভিমান নিয়ে বিনা বাক্য-ব্যয়ে সরে গেলো।
মিতালী ধপ করে জ্বলে উঠলো। কঠিন গলায় বলল,
-“আপনাকে যা বলার আমি বলে দিয়েছি সেদিন। আপনার সাথে আমার না কথা আছে, আর না নির্ভীক এখান থেকে সরবে।”
ইশরাক ক্রো*ধ নিয়ে বলল,
-“কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা আছে। সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি এলাউ না।”
ততক্ষণে নির্ভীক বাড়ির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলো অনেকদূর। কাঁদতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু তার চোখদুটো বড্ড নিষ্ঠুরতা করলো তার সাথে। চোখ ফেটে একফোঁটা জল গড়ালোনা। অথচ ভেতরটা তচনচ হয়ে যাচ্ছে।
নির্ভীককে তৃতীয় ব্যক্তি বলায় কন্ঠের তেজ বেড়ে গেলো মিতালীর।
-“নির্ভীক কখনোই তৃতীয় ব্যক্তি ছিলোনা। বরং আপনি আমাদের বন্ধুত্বে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে শীঘ্রই ভাঙ্গ*ন ধরাবেন।”
ইশরাক রা*গ দমন করার চেষ্টা করে বলল,
-“নির্ভীকের কথা বাদ। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। মানলাম তোমার পেছনে ঘোরাঘুরি পছন্দ নয়,তাই আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। সেটা নাকচ করার কারণ কী?”
মিতালী বারবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। যার কার্যকলাপ পছন্দ নয় বলে পিছু ছাড়তে বলেছে, সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বুকের পাটা দেখাচ্ছে? নিজেকে শান্ত করে বলল,
-“আপনাকে নিয়ে আমি এসব কখনোই ভাবিনি।”
-“কেন? আমি কি খা*রা*প ছেলে? কোন বদ অভ্যাস আছে? বাড়িঘর, চাকরি এসব নেই? চেহারা খারাপ? কোনটা?”
স্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসলো মিতালী।
-“কোনোটাই না।”
-“তবে?”
মিতালী স্পষ্টভাষায় বলল,
-“মানুষ যাকে ভরসা করতে পারেনা, তার সাথে জীবন কাটানোর কথা ভাবতেও পারেনা। আমার ভরসার স্থানে আপনি নেই, সেখানে অন্যকারো বাস।”
অপমানে লাল হলো চোখজোড়া। ইশরাক মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত করে নিলো। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,
-“সেই ব্যক্তি কি নির্ভীক?”
মিতালী শক্ত মুখে জবাব দিলো,
-“যতটুকু জানানোর আমি জানিয়েছি। বাকিটুকু ব্যক্তিগত থাকতে দিন।”
#চলবে………
(দুঃখিত আজ রি-চেইক করার সময় হয়নি।)