বিষ করেছি পান পর্ব-২৪+২৫

0
503

#বিষ_করেছি_পান(২৪)

(কপি করা নিষেধ)
— সারাদিন কোথায় ছিলি?
— নদীর পাড়ে বেরাতে গিয়েছিলাম।
— কার সাথে?
— বাঁধন ভাই নিয়ে গিয়েছিল আমি আর ঝিমাকে।
— তুই কি জানিস বাঁধন ভাই আর সুমি ভাবীর ডিভোর্স হয়ে যাবে?
ছুটি উঁচু নিচু মাথা দোলায়। সে জানে।
— এরজন্যেই তুই বাঁধন ভাইয়ের সাথে মিশছিস না?শোন ছুটি একদম সেই পথে পা বাড়াবিনা। ঐ বাড়িতে আর যাবিনা। বাঁধন ভাইয়ের থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবি। যদি যাস তাহলে আমি কথাটা মার কানে দিবো
— ভয় পাচ্ছো কেনো আপু?
— ভয় পাবো না? তুই একটা বড়সড় কষ্ট পাবি। বাঁধন ভাইয়ের উপর দূর্বল হয়ে পড়বি। বাঁধন ভাই বিবাহিত একটু বোঝার চেষ্টা কর।
রিতী আকুতি মিনতি দেখে ছুটির বড্ড হাসি পায়। চেপে না ধরে ফিক করে হেসেও ফেলে। পেটে হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে বলে,
‘ আমি দুর্বল হলেও বাঁধন ভাই তো আর হবেনা। নতুন করে আর কিইবা দুর্বল হবো? আমার যা যাওয়ার তা গেছে। ফেরানোর উপায় নেই। ‘
‘ পাকামো কথা বলবিনা।বয়স কতো তোর? এরকম ছোট খাটো একটু আধটু ক্রাস টাস থেকেই থাকে। তার জন্য যে সব চলে গেছে এরকম ভাবার কোন মানে নেই।’

রিতীর কথা ছুটির কর্ণগোচরে পৌঁছায় না । সে তার মতো লাফাতে লাফাতে রুমে চলে যায়। চেঞ্জ করে দৌড়ে রিতীর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঐতো কোনাকুনি ভাবে বাঁধনের বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। বারান্দাটি কি আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে? নাকি ছুটির চোখেই সুন্দর লাগছে? কোই নাতো কোন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই আছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোঁখে পড়ে বারান্দায় কারো অবয়ব। অবয়বটি বাধনের। ছুটি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অন্যমনষ্ক হয়ে গেলো। আনমনে বলে উঠলো ‘বাঁধন! বাঁধন! বাঁধন! ‘
নামটি বাতাসের সাথে ফিরে ছুটির শরীর ছুয়ে দিলো। ছুটি কি একটু কেঁপে উঠলো? মূহুর্তেই ছুটির ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করলো। হৃদয়ে প্রচন্ড সুখ অনুভব হতে লাগলো।পা দুটো গুটিয়ে আসলো।ছুটি মোড়ায় আধবসা হলো। অবয়ব টিকে কেনো স্পস্ট দেখতে পাচ্ছে না? কেনো এতো দুরত্ত্ব ? আজ ছুটি কেনো এতো তৃষ্ণার্ত? গলাটা নিমেষেই শুকিয়ে এলো। তৃষ্ণা মেটাতে ছুটি এলোমেলো পায়ে রুমের ভেতরে এলো। একদিনেই এতোটা পাগল পাগল ছুটি কখনোই হয়নি। আজ কেনো হলো? ছুটি নিশ্বব্দে দরজার কাছে এলো। পা বাড়াবে নাকি না বাড়াবে দ্বিধায় চুপসে গেলো। অসহায় চোখে ঘাড় ফিরিয়ে রিতীর দিকে তাকালো। রিতী পড়ছিলো। ছুটির চলনবলনে চোখ পড়তেই মনোযোগ ছুটে গিয়েছিলো।‌ঘাড় বাঁকিয়ে এখন সে ছুটিকে দেখতেই ব্যস্ত। ছুটি মনে মনে আওড়ালো। মুখে বুলি ফুটবে নাকি ফুটবেনা দ্বিধাতে পড়ে গেলো। চেপে না রাখতে পেরে টলমলে চোখ দুটো বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিলো।

— ভালোবাসায় এতো সুখ কেনো আপু? আমি এখন ভীষন সুখ অনুভব করছি। এতো সুখ আমাকে ছুবে আমি কখনো কল্পনাও করিনি। আমি আমার সুখটুকু নিয়েই পড়ে থাকতে চাই। দুঃখ আশেপাশে এলে আমি নিজেই সাইড কেটে যাবো।তবুও এ হৃদয়ে দুঃখের পর্দা টানবোনা।সুখটুকু নিয়েই অনন্তকাল ধরে স্মৃতির মালা গাথবো।
রিতী অবাক হয়ে শুনে গেলো। ছুটি পা বিড়াতেই অবাকতা ভাব ঘুচে গেলো।জোর গলায় বললো,
— কোথায় যাচ্ছিস তুই?
— তৃষ্ণা মেটাতে।
— ছুটি এক পা বাড়াবিনা।‌
— ঠিক আছে। তবে দুই পা ই বাড়ালাম।

বাঁধনের সামনের চেয়ারে বসে টুকে টুকে ভাত খাচ্ছে ছুটি। খেতে সে একদমি পারছেনা। আড়চোখে দৃষ্টি অন্যদিকে থাকলে না দেখে ভাত খাওয়া যায়না। বীনা বললো,
— তোকে আরেকটু ঝোল দেই ঝিমা?
— ছুটিকে দাও মা।
ছুটির পাতে অনেক ঝোল। ঝোলে ভাত দেখা যাচ্ছেনা। বীণা ছুটিকে ঝোল দিলো না । নিজে খেতে বসে এক লোকমা ছুটির মুখে ধরলো।
— নে হা কর। কিছুইতো খেতে পারছিস না । আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
ছুটি নিজের প্লেটটা সামনে ঠেলে দেয়। মুখ বাড়িয়ে বীনার হাতে খেয়ে নেয়। বাঁধন আড়চোখে একবার তাকিয়ে নিজের খাবারে মনোযোগ দেয়। ছুটি ঠিক করেছে আজ এখানেই থাকবে। তার কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছেনা। যেই ভাবা সেই কাজ। ঝিমার আগেই গিয়ে ঝিমার খাটে শুয়ে পড়েছে। মাথায় তার নিত্য নতুন অনেক কিছুই ঘোড়াঘোড়ি করছে। সব কিছুই বাঁধন কে নিয়ে। ঝিমাও এসে ছুটির পাশে শুয়ে পড়ে। ছুটিকে জিজ্ঞেস করে,
— তুই এখানে থাকবি বলে এসেছিস?
— সময় কোথায়?
— এতো ব্যস্ত হয়ে গেছিস?
— হ্যা। এখানে যখন আসতে মন চাইলো তখনি চলে আসতে হলো। মাকে বলার সময় ই পেলাম না।
— চিন্তা করবেতো।
— আমি এখানে আছি সে বুঝে যাবে।
— হুম ঘুমা এখন।
ঝিমা ছুটি যখন কাঁচা ঘুমে তখনি ছুটিকে ডাকতে আসে রুম্পা। এসেই শুনে ছুটি ঘুমিয়ে গেছে। রুম্পা আপত্তি জানিয়ে বলে,
— রিতীর বাবা এখনো না ঘুমিয়ে অপেক্ষা করছে। ছুটিকে নিয়ে যেতে হবে।
— থাকনা ভাবী। ভাইজানকে বলে দিলেই তো হবে।
— আজ নিয়ে যাই ভাবী। মানুষ টার কোন কারণে মন ভালো নেই। কেনো নেই জিজ্ঞেস করলাম বললোও না। এখন আমাকে পাঠিয়ে দিলো ছুটিকে নিয়ে যেতে।আমিই বললাম ঝিমার সাথে ঘুমিয়েছে থাক। না করে বসলো। এক্ষুনি মেয়েকে নিয়ে যেতে বলেছে।
— ওহ।তাহলে তো যেতেই দিতে হয়।
রুম্পা,বীনা ঝিমার রুমে আসে। সিঁড়িতে রুম্পা জিজ্ঞাসা করে,
— বাঁধনের কি খবর?
— ছেলেটা আমার একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে। পুরুষ মানুষ বাজারে টাজারে আড্ডা দিবে তানা শুধু ঘরে বসে থাকে। আজতো বেরিয়েছিলো ঝিমাকে নিয়ে। বাইরে টাইরে এভাবে গেলে তো মন ভালো থাকবে।
— ছেলে মেয়েরা কি করে? ছুটিদের দলটা বাঁধনকে সময় দিলেই তো বাঁধনের মন ভালো থাকবে। বাঁধন এদের অনেক স্নেহ করে।
— কাল সবাইকে ডেকে এনে বলতে হবে বাঁধন যতদিন কাজে যাচ্ছে না ততোদিন বাঁধনকে কোম্পানি দিতে।
— চাকরীতে ঢুকবে বলেছে?
— আর কিছু দিন যাক। আরেকটু সুস্থ হোক। তারপর ইন্টাউভিউ দিতে বলবো। আগের চাকরি টাতো তখনি চলে গেছে। এখন আর পোস্ট খালি নেই।
— সেটাই ভালো হবে।

ছুটি ঝিমা একজন আরেকজনের উপর পা দিয়ে শুয়ে আছে। পুরো বিছানা তাদের দখলে। কাথাটা ফ্লোরে ঝুলে আছে। রুম্পা গিয়ে ছুটিকে ডাকে। ছুটি তখন গভীর ঘুমে। ঘুম পাগল মেয়েটাকে অনেক চেষ্টা করেও তুলতে পারেনা। বীনা বলে কয়ে রুম্পাকে পাঠিয়ে দেয় ‌। ছুটির বাবা কিছু বললে বুঝিয়ে বলতে বলে। এতোবড়ো মেয়েকে কোলে নিয়ে যাবার সামর্থ্য রুম্পার নেই। তাই ছুটিকে না নিয়েই বাড়িতে ফিরে আসে। ছানোয়ার সাহেবকে বলে,
— ঘুমিয়ে পড়েছে।এতো ডাকলাম শুনলোনা। জানোই তো কেমন ঘুম পাগল মেয়ে। ওকে তোলা আমার কর্ম না।
— আবার যাও যেভাবেই হোক ডেকে এনো।
— আরে তুমি এতো রেগে যাচ্ছো কেনো? এর আগেও তো ঐ বাড়িতে কত থেকেছে। আজ এভাবে রিয়েক্ট করছো কেনো?
— আমার মেয়েরা আমার বাড়ি ছাড়া কোথাও থাকবেনা। সব সময় আমার সামনে থাকবে। রিতীকে দেখে আসো যাও কি করছে?পড়ছে নাকি কি করছে?
— পড়ছে।
— দেখে আসো।
রুম্পা বিরক্ত হয়ে রিতীর রুমে যায়। রিতী পড়ছে। রুম্পা দরজা থেকেই ডেকে বলে,
— তোর বাবার কি হয়েছে রে?
— জানিনাতো মা। কেনো?
— হুট করেই মেয়ে মেয়ে করা শুরু করেছে।কিছু বলছেও না। ভালোভাবে পড়।
রুম্পা চলে গেলে রিতী মাথা না ঘামিয়ে আবার পড়তে থাকে।

প্রতি রাতেই ছানোয়ার মেয়েদের কয়েক বার করে দেখে যায়।ছুটি রিতী পড়া ব্যতীত অন্য কিছু করলেই এসে ধমকাতে থাকে।বাবার ধমকে এখন ছুটিও বই নিয়ে বসে থাকে। তবে বই সামনে থাকলেও মন পড়ে থাকে বাঁধনের কাছে। বাঁধনের বাড়িতে আর রাত করে থাকতে দেয়না তাকে।সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হয়। আগে রাত পেরিয়ে গেলেও কোন কথা ছিলো না। বাবার হুটহাট এতো কড়া হয়ে যাওয়াটা রিতী ছুটি কেউই মেনে নিতে পারছেনা। ছুটি রিতীকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে রিতীও যে অবগত নয় তা শুনে হতাশ হয়। আগে দুবোনে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নিশ্চিন্তে ফোন চালাতে পারতো। এখন ফোনটা হাতে নিয়েও কাঁপতে হয়। কখন না জানি বাবা দেখে ফেলে। এদিকে সোহাগ মোটেই রিতীকে শান্তি দিচ্ছেনা। ফোন দিয়ে বিরক্ত করেই যাচ্ছে। না ধরলে না কথা বললে শুরু করে হুমকি দেওয়া। পরিক্ষার মাঝে রিতী কোন চাপ নিতে রাজি নয়। আল্লাহ আল্লাহ করছে পরিক্ষাটা কোন মতে শেষ হলেই ভার্সিটি এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হয়ে বডিং এ থাকা শুরু করবে। রিতীর কলেজের এক আপু গতবছর ডাবিতে চান্স পেয়েছে। তার সাথে কথা হয়েছে। সে যে কোচিং এ ছিলো সেই কোচিং এ ভর্তি ও হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে। তখন আর রিতীর জীবনে থাকবেনা এই সোহাগ নামের কোনো বখাটে। দেখতে দেখতে রিতীর পরিক্ষা প্রায় শেষের দিকে। আর দুটো আছে। বাবার সাথে পরিক্ষা দিতে যায় আর বাবার সাথে আসে। রিতী অবশ্য নিজেকে আড়াল করেই যাতায়াত করে। ছানোয়ার ও রিতীর সাথে যাতায়াত করেনা। এটা ছানোয়ারের প্লান। এতে কোনো বখাটে ছেলের নজরে রিতী পড়বেনা। কিন্তু ছানোয়ার এটা জানেনা প্রতি রাতে রিতীর ফোনে কল আসে। এবং শেষ চার্জ অব্দি সেই কলেই থেকে যায় সোহাগ। রিতী রিসিভ করে নিজের মতো পড়তে থাকে। সোহাগকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে । রিতী অবশ্য মাঝে মাঝে সুযোগ বুঝে ফোন কানে ধরে সোহাগকে গালাগালি করে। এতে সোহাগ ও চটে যায়। নানারকম থ্রেট দেয়। নতুন সিম রিতী নিতে পারেনা। তার আইডি কার্ড নেই। বাবা অথবা মারটা চাইতে গেলেই নানারকম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। প্রথম প্রথম রিতীর প্রচুর বিরক্ত লাগলেও এখন সয়ে গেছে। এটা প্রত্যেহ দিনের ব্যপার। রিতী এখন টুকটাক কথাও বলে। বাঁধন কে জিজ্ঞেস করে,
— আপনি কি ক্লান্ত হন না? কি চান আপনি? এভাবে ডিস্টার্ব করতে থাকলেও আপনার কোন লাভ হবেনা।
— একবার আমার তৃষ্ণা মিটিয়ে দাও। আমি আর কোনদিন তোমায় ডিস্টার্ব করবোনা।
এতো জঘন্য প্রস্তাবে রিতীর কোন কথা থাকতে পারে না। বার বার পাওয়া এই জঘন্য প্রস্তাবটাও এখন আর কোনো ঘৃণা বা অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেনা। সোহাগ বলে ,
— পিরিতি আমি কেনো পরিক্ষার হলের সামনে তোমাকে খুঁজে পাইনা? তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমি কিছুতেই মেটাতে পারছিনা। পিরিতি তুমি কি আরো সুন্দর হয়ে গেছো? ঘরে বসে বসে গুলুমুলু হয়ে গেছো? আমি আর নিজেকে আটকাতে পারছিনা।

রিতী কিছুই বলেনা। বরং নিরবে হাসে। সোহাগের কথাবার্তা প্রেমিকের মতো। তবে সে প্রেমিক নয়। দেহলোভী এক পুরুষ। এটা জেনে বুঝেও রিতীর কোন অনুভুতি আসেনা। রিতী অভ্যস্ত দেহলোভী সোহাগের দেহের জন্য হাহাকার শুনতে। সবকিছু সে স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছে। নিজেকে ভালো রাখার জন্য নিতে হচ্ছে। তবুও মাঝে মাঝে ভয় হয়। বাবার কড়া গার্ডে সোহাগের সাথে যোগাযোগ করতে ভয় হয়। আর সেই ভয়ের কারণ ছুটি। মেয়েটা প্রচুর দুরন্ত। সন্ধ্যার পর বাড়ি থাকে জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ি থাকেনা। কোথায় কোথায় যায় জানেনা। ভয় হয় প্রচন্ড ভয় হয়। তার কারণে না হয় কখনো ছুটির কিছু হয়।

সোহাগের দিন রাত সব এক হয়ে গেছে। রিতীর জন্য তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। একটা মেয়ে কিভাবে তার জীবনে অধিপত্য ছড়াচ্ছে সেটা সে ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তবে মানতে পারছেনা।সে কারো জন্য মানসিকভাবে এতোটা দুর্বল হবে ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা অনুভব করবে সেটা কিছুতেই মানতে পারছেনা। একটার পর একটা মেয়ের পিছনে ঘোরা তার স্বভাবে আছে। কিন্তু কারো জন্য এতোটা অস্থিরতা কখনো ফিল হয়নি। নিজেকে সামলাতে না পেরে একের এর মদের গ্লাস খালি করে প্রতিদিন। তবে কখনো আগ বাড়ানোর কথা ভাবেনি। আজ কড়া মাল খেয়ে মাঝরাতে বাড়ি ছেড়েছে। চ্যালা দু’জনকে নিয়ে সাহস করে এসেছে রিতীর বাড়ির সামনে। শুনশান পাকা রাস্তায় বসে রিতীকে ফোন দেয়। রিতী তখন বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। ফোন সাইলেন্ট করা। বেশ কয়েকবার কল দেয়। সোহাগের রাগ হয়। প্রচন্ড রাগ হয়। রিতীর রুমের আলো জ্বলছে। মেয়েটা ইচ্ছে করে ফোন তুলছে না। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে সোহাগ আবার কয়েকবার কল করে। রিতী এবারো ফোন তুলেনা। সোহাগের মাথায় জেদ চেপে বসে। আজকে রিতীকে না দেখে এক পাও এখান থেকে নড়বেনা। ছোট্ট একটা টেক্সট পাঠিয়ে দেয় রিতীকে।
‘ নিচে আসো। আমি অপেক্ষা করছি। ‘
আধঘন্টা হয়ে গেলো এখনো রিতীর কোন রেসপন্স নেই। দেখতে দেখতেই রিতীর রুমের লাইট অফ হয়ে গেলো। সোহাগের চরম মেজাজ খারাপ হলো। ধলার হাত থেকে বাংলা মদের বোতল টা নিয়ে অর্ধেকের বেশি গলায় ঢেলে দিলো। এতোক্ষণ ঠিক থাকলেও এবার তার নেশা হওয়া শুরু হয়েছে। আরো চারবার রিতীর ফোনে কল দিয়ে যখন না পেলো তখন সোহাগ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাথা চক্কর কাটলে ধলার কাঁধ চেপে নিজেকে সামলিয়ে নিলো। উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো,
— ঐ পিরিতি!ঐ ! পিরিতি?! পিরিতি?ঐ শালী নিচে আয়।
রিতীর কানে যেতেই রিতী ধচমচিয়ে উঠে বসলো। মাত্র ই বালিশে মাথা রেখেছে। তারমধ্যেই বাইরে থেকে চিৎকার আসছে। একটু ধাতস্থ হতেই কানে বাজে ডাকটি ‘ পিরিতী!’ পিরিতি? সোহাগ? বিছানা ছেড়ে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে উঁকি দেয়।পাশের বাড়ির বাইরের লাইটের আলোতে আবছা সোহাগকে চিনতে পেরে রিতী কলিজা ধক করে উঠে। বারান্দায় রিতীকে দেখে সোহাগ আরো জোরে গালি দিয়ে বসে,
— ঐ শালী ঐখানে দাড়ায়ে কি করছ? নিচে আসতে বলিনি? পাগল বানিয়ে দিবি নাকি?
রিতী আর দাঁড়ায় না। এক দৌড়ে এসে বারান্দার দরজা অফ করে দেয়। বিলম্ব না করে ছুটির রুমে গিয়ে ছুটিকে ডেকে তুলে। ইতিমধ্যে যা ঘটার তা ঘটে গেছে। গভীর ঘুমের ছুটি উঠতে উঠতেই বাহিরে লোকজন জমা হয়ে গেছে। ছানোয়ার রুম্পা নিচে চলে গেছে। সোহাগ এসে ছানোয়ারের সাথে অসভ্যতামি শুরু করেছে। মুখ দিয়ে যা নয় তাই বলছে। বার বার শাষাচ্ছে।
— ঐ মেয়েকে লুকিয়ে রাখিস?তাইনা?তোর মেয়ে আমার ঘুম কেড়ে নিছে?ওকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি।এখুনি বের করে দে। নইলে তোর ঘর বাড়ি পুরিয়ে ফেলবো আমি।
ছানোয়ার রেগে মেগে মাতাল সোহাগের গালে পর পর দুইবার চড় লাগিয়ে দেয়। বাঁধন এসে আটকায় ছানোয়ারকে।
— কাকা কি করছেন? ছেলেটা মাতাল হয়ে আছে।
— মাতাল তো মাতাল হবেই। ওর সাহস কত্ত বড় বাড়ি বয়ে এসে মাতলামি করছে। তুই তুকারি করছে। কে আছো ধরো একে। আমার মেয়ের পিছু লেগেছে। মেরে তক্তা বানিয়ে রাস্তার ধারে ফেলে আসো একে। সোহাগকে ধরে কলোনীর ছেলে গুলো বেধরম পেটাতে থাকে।

ছুটি উঠে বসে ঘুমে চোখ খুলতে পারছেনা। রিতী ছুটির কাধ ধরে ঝাঁকিয়ে অস্থির হয়ে বলে,
— ছুটি তাড়াতাড়ি চোখ খোল। সর্বনাশ হয়ে গেছে। সোহাগ নিচে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। বাবা মা জাগার আগে তুই তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে চলে যেতে বল। জানাজানি হলে মান সম্মান আর থাকবেনা। বাড়ি বয়ে এসে বখাটেরা চেঁচামেচি করে এটা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে যাবে।উঠ উঠ।
ছুটি রিতীকে এড়িয়ে চোখ ডলতে ডলতেই দৌড় দেয়। পেছনে পেছনে রিতীও দৌড় দেয়। মেইন দরজা দিয়ে বাঁধনের চোখ পড়ে ছুটির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। পেছনে রিতী চিৎকার করে ছুটছে,
— ছুটি চোখ খুলে যা। পড়ে যাবি নাহলে।
সোহাগের সাথে ছুটিকে বাঁধন আরো দেখেছে। তখন তেমন কিছু সিরিয়াসলি না নিলেও আজ সবটা খোলসা হয়ে গেছে। এইটুকুনি মেয়ে রাস্তার বখাটের সাথে মেলামেশা শুরু করেছে। বাড়ির মান সম্মান মেশাতে বসেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে বাঁধনের। বড় বড় পা ফেলে রিতীকে যেতে দিয়ে ছুটির হাত শক্ত করে ধরে আঁটকে ফেলে।
চলবে,

#বিষ_করেছি_পান(২৫)

(কপি করা নিষেধ)
রিতী দৌড়ে এসে রুম্পার পাশে দাঁড়িয়েছে। রুম্পা রিতীকে দেখা মাত্রই বুকে আঁকড়ে নেয়। সোহাগের রক্তাক্ত মুখ দেখে রিতীর শ্বাস আটকে আসে। ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে রুম্পাকে আরো শক্ত করে ধরে। রুম্পা বুঝতে পারে মেয়ে ভয় পাচ্ছে। তাই রিতীকে নিয়ে সরে যেতে চায়। কিন্তু রিতী থায় দাঁড়িয়ে থাকে। হু হু করে কেঁদে উঠে। বাবা,বাবা, বাবা বলে কাঁদতে থাকে। বাবাকে বলতে চায় ‘ বাবা আর মেরোনা,ছেলেটা মরে যাবে। ‘ কিন্তু মুখ থেকে বাবার পর আর একটা শব্দও বের হয়না। রিতীর গলা শুনে সোহাগ রিতীর দিকে তাকায়। অশ্রু মাখা মুখটা দেখে শরীর অবশ হয়ে আসে। তার তৃষ্ণা না মেটার আগেই চোখ দুটো নাফরমানি করে বসে।

ছুটিকে বাঁধন শক্ত করে ধরে আছে। ছুটি চোখ টেনে বড় বড় করে খুলে দেখার চেষ্টা করে। জ্বলার কারণে আবার চোখ বন্ধ করে সময় নিয়ে খুলে। বাঁধনকে দেখেই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে লাফাতে থাকে।
— বাঁধন ভাই ছাড়েন। আমাকে যেতে হবে।
— কোথায় যাবি তুই? তোকে বাইরে যেতে হবেনা। পাগলা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। তুই গেলেই কামড়ে দিবে।
— আরে আমি না গেলে কামড়া কামড়ি কে থামাবে?
— আমি থামাবো। তুই যাবিনা ব্যাস। চল রুমে চল।
বাঁধন ছুটিকে টেনে রুমে নিয়ে যায়। ছুটির হাত ছাডলেই ছুটি আবার দৌড় লাগায়। বাঁধন চট করে হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে পেট জড়িয়ে টেনে ছুটিকে আটকায়। ছুটি ছাড়ুন, ছাড়ুন বলে হাট পা ছুটাছুটি করতে থাকে। বাঁধন আরো শক্ত করে ছুটিকে চেপে ধরে। ছুটির মনে হয় পেট থেকে নাড়িভুড়ি সব দুভাগ হয়ে উপর আর নিচের দিকে ফেটে পড়বে। ছুটি না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁধনের কাঁধ কামড়ে ধরে । বাঁধন আহ করে উঠে। ছুটি সেই সুযোগে আবার দৌড় দেয়। এদিকে বাঁধন রাগে ফুঁসতে থাকে।

ছুটি বেরিয়ে দেখে রিতী তার রুমে যাচ্ছে। ছুটিও রিতীর পিছু পিছু যায়। রিতী ছুটির সাথে কথা না বলে সটানে শুয়ে পড়ে।ছুটি দেখলো রিতী কথা বলবেনা। তাই সেও পেছন থেকে রিতীকে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুভব করলো রিতী ফুপাচ্ছে। হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছুটি উঠে বসলো। আবার আধশোয়া হয়ে রিতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে দু বোন ই ঘুমিয়ে পড়লো।

রিতীর সামনে সোহাগের আর পদচিহ্ন পড়লোনা। সবার মাথা থেকে ঝেড়ে গেলেও এলাকার কিছু কিছু লোকের মুখ থেকে রসিয়ে কষিয়ে নিউজ বানানো বন্ধ হলোনা। রিতী এসব কানে নিলোনা। তবে মাথা থেকেও বের হলোনা। বার বার সোহাগের কথা মনে পড়ে। বড়লোক নেতাগোষ্টী বাপের ছেলে! এতো গুলো মার খেয়ে গেলো অথচ এর কোনো রিভেঞ্জ ই নিলো না? বিষয়টা সত্যিই ভাববার বিষয়। তবুও চুপ থাকলো। সোহাগকে নিয়ে খবর পেলো শেষ পরিক্ষার দিন। পরিক্ষা শেষে হল থেকে বেরিয়ে তুলির সাথে বলাবলি করছিলো কে কোনটা কোনটা এনসার করেছে,কত পেজ করে লিখেছে।এরি মধ্যে কয়েকজন কমন ফ্রেন্ড এসে দাঁড়ালো। হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,
— কিরে? কি শুনি? মাঝে মাঝে বাইকে উঠিস। দেখা করিস। এতো দিন থেকে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস আর আমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করলিনা?আমরা জানলে বেশী বেশী হেল্প করতাম।
ওদের কথার আগা মাথা রিতী কিছুই বুঝতে পারেনা। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— মানে?
— ঐ থাম। একদম ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করবিনা। সোহাগ্গাইর সাথে তোমার প্রেম এটা অত্র কলেজের সবাই জানে। এখন ইনোসেন্ট ভাব ধরে লাভ নেই।
— একদম ফালতু কথা। আমার কারো সাথে কোন প্রেম নেই।
— সেজন্য ই তো পিরিতি পিরিতি করে অজ্ঞান হয়। কিন্তু দোস্ত! ছেলেটা বখাটে। তার সাথে রিলেশনে জড়ালি একাকি ঠিক হলো?
— আরে কিসের রিলেশন? কোনো রিলেশন নেই।
— বাজে না বকে ট্রিট দে। আজ লাস্ট ডে পরে আর তোর ছায়াও পাবোনা। আজি ট্রিট দে।
— পাগল নাকি? ঐ ছেলের সাথে আমার কোন রিলেশন নেই।
— বুঝি বুঝি। আগে বলতি শয়তান! এখন শয়তান থেকে ছেলে!
সবাই একজোড়ে হেসে উঠে। রিতী রাগে দুঃখে সেখান থেকে ধপ ধপ পা ফেলে এগিয়ে যায়। একজন বলে,
— আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো? কলেজের পুরো দেয়ালে তোর আর সোহাগের নাম জ্বল জ্বল করছে। রিকশাওয়ালা মামা থেকে ফুচকাওয়ালা সবাই জানে তোর আর সোহাগ ভাইয়ের কথা।
আরেকজন বলে,
— সোহাগ ভাইয়ের স্বভাব ভালোনা। এছাড়া সবি ঠিক আছে। ফর্সা সুন্দর হ্যান্ডসাম চেহারা। গাড়ি আছে,বাইক আছে। বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। কম কি! হ্যারে রিতী? কোনটা দেখে এগুলি?
রিতী থমথমে মুখ নিয়ে তুলিকে ছাড়াই বাবাকে বলা ছাড়াই কেন্দ্র কলেজ থেকে নিজের কলেজে পাড়ি জমায়। রিকশা থেকে দেখতে পায় গেইটের সামনে জ্বল জ্বল করছে রঙিন পোস্টার। সাহাগ+রিতী। ভাড়া মিটিয়ে ছুটি দৌড়ে ভেতরে যায়। সেখানে আরো ভয়ঙ্কর অবস্থা। দেয়ালে ইটের গুড়ি দিয়ে লেখা সোহাগ+রিতী। একটা অংশ ও বাদ যায়নি। এক গাছ থেকে আরেকগাছে দড়ি দিয়ে পোস্টার দেওয়া হয়েছে। জুনিয়র ছাত্র ছাত্রীরা রিতীকে দেখে আঙুলে ইশারা করে বলছে,
— এই দেখ। এই বোরখা পড়া আপুটার নাম ই না রিতী?
— হ্যা রে। সোহাগ মাতালের সাথে প্রেম করে।
রিতীর চোখ থেকে টুপ টুপ করে জল গড়িয়ে পরে। ধপ করে গাছের নিচে বসে পড়ে। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অফিস রুমে খবর পৌঁছায়। পিয়ন এসে রিতীকে সেখানে নিয়ে যায়। স্যাররা জিজ্ঞেস করে,
— পরিক্ষা কেমন হয়েছে?
— ভালো।
— আর এসব কতদিন থেকে চলছে? বাবা মা জানে? ছি ছি রিতী! আমি তোমাকে অনেক ভালো বুদ্ধিমান একটা মেয়ে মনে করেছিলাম। সেই তুমি কিশোরী বয়সের আবেগে এতো বড় একটা ভূল করে বসলে? কি হবে তোমার ভবিষ্যৎ?
রিতী উত্তর দিতে পারেনা। স্যাররা রিতীকে বুঝানোর চেষ্টা করে,
— দেখো টাকা পয়সা ক্ষমতা দিয়ে আর যাই হোক সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া যায়না। ভবিষ্যত এর জন্য প্রয়োজন স্বশিক্ষিত একটি সঠিক মানুষ। তুমি এতো ভালো একজন স্টুডেন্ট তোমার ভবিষ্যৎ নি:সন্দেহে সুন্দর হতে যাচ্ছে। সেখানে তুমি একজন ঝড়ে পড়া মানুষের সাথে নিজেকে জড়িয়ে কেনো নিজের ক্ষতি করতে যাচ্ছো? তুমি পারফেক্ট ভাবে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করো। একজন অশিক্ষিত মাতাল বখাটে ছেলে কখনোই তোমাকে ডিজার্ব করেনা। আবেগ থেকে সরে আসো। নয়তো এখানেই জীবন থেকে যাবে।

বাড়ি ফিরে আসতেই রুম্পা বকা দিতে শুরু করে। ছানোয়ার কে ডেকে বলে,
— ওগো তোমার মেয়ে বাড়ি ফিরেছে।
ছানোয়ার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। রিতীকে দেখে অস্থির চিত্তে জিজ্ঞেস করে,
— কোথায় গিয়েছিলি? দেখতে দেখতেই সামনে থেকে নেই।
— কলেজে বাবা। দরকার ছিলো।
— বলে তো যাবি? পরিক্ষা কেমন হলো?
— ভালো।
— যা গিয়ে রুমে ফ্রেশ হ।
— হুম।

ঘরে গিয়ে রিতী চুপচাপ হয়ে যায়। ছুটির সাথেও কথা বলেনা। ছুটি অনেক বার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পাত্তা পায়নি।‌স্বাভাবিক কথা বলাও বন্ধ করে দেয়। রুম্পা কথাটা ছানোয়ার কে জানাতেই ছানোয়ার টেনশনে পড়ে যায়। সন্দেহ প্রগাড় হয়। সেদিন পরিক্ষা শেষে হুট করে কলেজ চলে যাওয়া আবার ফিরে এসে এরকম চুপচাপ হয়ে যাওয়া অঙ্ক মেলাতে থাকে। স্কুল শেষে ছুটে রিতীর কলেজে। পা দিতে না দিতেই মস্ত বড় ধাক্কা খায় । মেয়ে তার কেনো চুপচাপ হয়ে গেছে তা আর বুঝতে বাকি থাকেনা। ছুটে যায় প্রিন্সিপালের রুমে। সালাম দিয়ে অভিযোগ করে,
— আপনাদের কলেজে এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেছে পুরো কলেজ পোস্টার দিয়ে ঢেকে গেছে, আমার মেয়ের নামে এরকম নোংরা একটা রটনা রটিয়ে দিয়ে গেলো কেউ আর আপনারা সেটার কোন প্রতিবাদ করলেন না? দুদিন আগে এই পোস্টার আমার মেয়ে দেখে গেছে এখনো কিভাবে লাগানো থাকে? আপনাদের কি রেপুটেশনের ভয় নেই?
— শান্ত হন স্যার। আমাদের রেপুটেশনের ভয় আছে। সেজন্য ই আমরা পারছিনা এই কলেজ নোংরা মুক্ত করতে। আমাদের উপরে যারা থাকে তাদের উপর কথা বললে হিতে না বিপরীত হয়ে যায়। যে ছেলে এসব করেছে তার উপরে হাত আছে । আর আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করেছি। বকাঝকা না করে রিতীকে বুঝিয়েছি। এসব ছেলেমানুষী না করে মান সম্মান বজায় রাখতে। এই বয়সে আবেগে গলে এদিক সেদিক বাইকে ঘুরাঘুরি, প্রতিদিন দেখাদেখি,মেলামেশা না করতে। নিজের লক্ষ্যের দিক নজর দিতে।

ঠান্ডা গালে সপাটে জুতোর বাড়ি পড়লো ছানোয়ারের গালে। এতোদূর…. ? বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরেই রিতীকে সামনে ডাকলো। রিতী মায়ের ডাকে বাবার কাছে এলো। পিছু পিছু ছুটিও এসে দরজায় দাঁড়ালো। ছানোয়ার ইশারায় বসতে বললে রিতী খাটের একপাশে বসলো। থমথমে গলায় ছানোয়ার সোজাসুজি বললো,
— কতদিন ধরে চলছে ঐ বখাটের সাথে ঘুরাফেরা?
রিতী চমকে উঠলো। বড় বড় চোখ করে বাবার দিকে তাকালো। ছানোয়ার আবারো বললো,
— তুমি কি মানো আমি তোমার বাবা?
এবার রিতী আরো অবাক হলো। চোখ ছোট করে প্রশ্ন করলো
— এটা কেমন প্রশ্ন বাবা?
— যদি আমাকে বাবাই মানো তাহলে এতো দিন ধরে কেনো চলছে এসব লুকোচুরি? বাইকে নাকি ঘুরতে যাও? প্রতিদিন নাকি কলেজে দেখা করো? হাসি ঠাট্টা নাকি লেগেই থাকে? মোরেও নাকি তোমাকে ইঙ্গিত দেয়?
— বাবা আমি কিছু করিনি। বলেই কেঁদে ফেলে রিতী। ছানোয়ার ধমকে উঠে বলে,
— তুমি কি করেছো তুমি নিজেও বুঝতে পারোনি। কি ভেবেছো? অনেক বড় হয়ে গেছো? প্রবলেম গুলো একা একা সলভ করবে? তাহলে বাবাকে কি দরকার? বাবাকে কোন প্রয়োজন নেই তোমার।
— বাবা আমি সরি। আমি ভেবেছিলাম তুমি জানলে ঝামেলা বাড়বে বয় কমবেনা। ঐ ছেলে বিরক্ত করতে করতে একসময় নিজেই বিরক্ত হয়ে চলে যাবে। আর তারা ভালো মানুষ না বাবা। ক্ষতি করে দিবে।
— তারজন্য ই আজ বাড়ি বয়ে এসে ঝামেলা করে। আজ তোমার জন্য তোমার বাবার গালে সটাটে চড় পড়েছে জানো তুমি? তোমার স্যারদের সামনে আমার মাথা হেড হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। আমি গিয়েছিলাম ছেলেটার বিচার নিয়ে তারা উল্টো আমার মেয়ের বিচার শুনিয়ে দিয়েছে। এইদিন দেখার জন্য আমি এতো কষ্ট করে বড় করেছি তোমাকে। তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছে করছেনা আমার। সর এখন সামনে থেকে। রিতী কিছু বলতে যাবে তখন আবার হুংকার ছাড়ে — যেতে বলেছিনা তোমায়? এখন কি বাবার সাথেও বেয়াদবি করবে? রিতী ঘরে এসে অঝোরে কাদে। বোনের কান্না দেখে ছুটির খুব মন খারাপ করে। আপুর পাশেই বসে থাকি।

রিতী কোচিং এ ভর্তি হয়েছে। কয়েক দিন ক্লাস করার নতুন শিফটেই পায় তার পরিচিত কয়েক সহপাঠীর মুখ। তারা কুশল বিনিময় আগে করতো কেমন আছো বলে। আর এখন করে রিলেশন কেমন যাচ্ছে? বলে। রিতীর এসব ভালো লাগেনা। এদের এড়িয়ে চলতে গেলে টেনে ধরে রসিকতা করে। একেকটা কথায় রিতীর গা শির শির করে উঠে। কোনভাবেই এড়ানো যায়না। কেউ কেউ আবার ঠেস দিয়ে কথা বলে। শপিং, খাওয়া-দাওয়া,গাড়িতে ঘুরাঘুরি কেমন হচ্ছে? যার মানে দাঁড়ায় রিতী টাকার লোভে ঐ বখাটেটার সাথে রিলেশনে জড়িয়েছে। এতোসব আর নিতে পারেনা রিতী। দিন দিন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। যে সময়ে তার রাত দিন এক করে সপ্ন বুনার কথা সে সময়ে সে উদাস হয়ে আছে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছেনা। রিতী বিভিন্ন উপায় ট্রাই করছে নিজেকে ভালো রাখতে। কোচিং থেকে বাড়ি ফিরে একদিন দেখে রুম্পা কয়েকটা ছবি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। কিছু হয়েছে ভেবে দৌড়ে আসে রিতী। — মা কাঁদছো কেনো? কি হয়েছে? বলতেই সজোরে গালে থাপ্পড় পড়ে। রিতীর সামনে ছবিগুলো মেলে ধরে হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে বলে ,
— এতো দিন ফোনেও কথা হতো তাইনা? একটা ছেলে যদি এসব না দিয়ে যেতো তাহলে তো জানতেই পারতাম না। তোকে বিশ্বাস করেছিলাম আমি আর তোর বাবা। এই প্রতিদান দিলি ? তোর বাবা জানতে পারলে শেষ হয়ে যাবে। পেটের থেকে আমি যে নিমুকহারাম বের করেছি।

রিতী ছবিগুলো দেখে। কখনো সোহাগের সাথে বসে আছে আবার কখনো দাঁড়িয়ে আছে। নানা ভাবে ছবি। চিরকুট খুলে দেখে তাতে বড় বড় করে লেখা,
— ফোন অফ করেছো কোন সাহসে? আজ না খুললে কাল এই ছবিগুলো তোমার বাড়ির গলি থেকে মোড় পর্যন্ত টাঙ্গানো থাকবে।
রিতী শূন্য হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর নিজেই উঠে রুমের দিকে পা বাড়ায়। যাওয়ার সময় রুম্পাকে বলে,
— বাবাকে কিছু বলোনা। আই প্রমিজ ইউ । এরপর থেকে আর কোন সমস্যা হবেনা।‌
রাগে জিদে সোহাগকে কল করে। সরাসরি প্রশ্ন করে,
— চি চান কি আপনে?
— ঐ হৈ পিরিতি! তুমি আমাকে কল দিলে? পেয়েছো বুঝি ছবিগুলো?
— হ্যা পেয়েছি। আপনার জন্য আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। এবার মনে হয় আমাদের দুজনের ডিসকাশনে আসা উচিত।
রিতীর কথা শুনে সোহাগ হো হো করে হেঁসে ফেলে। রিতীর রাগ হয়। রাগ চেপে প্রশ্ন করে,
— কি ঠিক কি কারণে আমার পিছু পড়ে আছেন?
— তোমার রুপের কারণে। পিরিতি তুমি কি জানো তোমায় যেদিন দেখেছিলাম সেদিন আমি পলক ফেলতে পারিনি। বলবনা যে তোমার থেকে সুন্দর মেয়ে আমি দেখিনি। তবে তোমার মতো সুন্দর আমার চোখে আজ অব্দি ভাসেনি। তোমার মধ্যে কিছু একটা আছে যা অন্য মেয়ের মধ্যে নেই। ছুটির মতো ছোট্ট ছিলে। দেড়বছরেই কেমন ফার্মের মতো বড়ো হয়ে গেলে। দেহে গড়নে বদনে ইসসসসস… মাথাটা পুরো আমার নষ্ট করে দিলে। আমি মেয়েদের পেছনে কখনো দশদিনের বেশী ঘুড়িনি। তোমার পেছনেও ঘুরতামনা। তোমার ভাব সাব আমার মোটেই ভালো লাগেনা। মেয়ে মানুষ হবে লজ্জাবতী ফুলের মতো। ধরবো আর নুইয়ে পড়বে। আর তুমি পুরো উল্টোটা।যতই‌ ধরি ততোই তেজে উঠো। তোমার পেছনে ঘুরা বাদ দিতে চাই। অনেক বার চেষ্টা করি। কিন্তু পেরে উঠিনা। বেহায়া চোখ দুটো সারাদিন তোমার শরীরে ঘুরা ঘুরি করতে চায়। ভাই ব্রাদারস দের সাথে তোমার আলাপচারিতা করে যাই। তোমাকে না দেখলে রাতে দু চোখের পাতা এক করতে পারিনা। তোমার জন্য আমার চোখের অসুখ করেছে। সেই অসুখ একমাত্র মিটবে তোমাকে পেলে।
— এতো খারাপ আপনি!
— লিসেন রিতী। আমি সিরিয়াসলি তোমাকে কিছু বলতে চাই। তোমাকে আমার ভালোলাগে। তোমার প্রতি মোহ কাজ করে। শুধু আমার না। আমার সাঙ্গ পাঙ্গ সবাই তোমাকে পাবার সপ্ন দেখে। তবে প্রথম চান্স আমারি।‌ ভালোলাগা মোহ মানেই ফ্যান্টাসি। তুমি হচ্ছো আমার সেই ফ্যান্টাসি। আমি শুধু আমার নিজেকে ভালোবাসি। নিজের ভালো থাকা, ভালোলাগাকে গুরুত্ব দেই। তোমার জন্য আমি প্রতিনিয়ত ডিস্টার্ব হচ্ছি। তোমাকে একান্তে যেদিন থেকে চেয়েছি সেদিন থেকে আমার অন্য কোন মেয়ে ভালোলাগেনা যা আমার স্বভাবের বিপরীত। আমি দেখতে পাচ্ছি আমি ধীরে ধীরে নিজের থেকে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে দেখলে আমার ঘোর কাজ করে। আমি আমার জীবনের এসব জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। শান্তিতে নিশ্বাস ফেলতে চাই। তোমাকে পাওয়ার মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব। আমি ঠোঁট কাটা তাই শুনতে খারাপ লাগে। তুমি জানো আমি জোর করতে পছন্দ করিনা। যদি করতাম তাহলে এতোদিন তোমার পেছনে বেকার লেগে থাকতাম না। একটা রাত আমার হও, আমার নেশা কাটিয়ে দাও কসম লাগে তারপর আর কখনোই আমার দ্বারা ডিস্টার্ব হবেনা। তুমি আমাকে ডিস্টার্ব করো জন্য ই আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করি নয়তো অপাত্রে মুক্তো ছিটানোর মতো ছেলে আমি না। তবে এরপর আমি আর তোমাকে রক্ষা করতে পারবোনা।
— কলঙ্কিত করে রাস্তায় ছেড়ে দিবেন আমাকে? রক্ষা করবেন না?
— আমার নেশা কাটিয়ে দাও তারপর আমি আর তোমাকে চিনিনা।
— বেশ। তবে তাই হবে।
— এতো সহজে রাজি হয়ে গেলে?
— সহজ ছিলো কি?
সোহাগ দাঁতে দাঁত চেপে হেসে উঠে।
— আমি আসবো আপনার কাছে। তবে মনে রাখবেন শুধু একরাতের জন্য। আমার কাছে এই একটা রাতই সময় আছে শুধু আপনার জন্যে।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~