বিষ করেছি পান পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
789

#বিষ_করেছি_পান(২৯)

(কপি করা নিষেধ)
ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে বীনা আহাজারি করছেন। তার গলার আওয়াজ আশেপাশের প্রত্যেকটা বাড়ি থেকে শোনা যাচ্ছে। ঝিমা পাশে বসে বীনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কাঁধে চেপে ধরে সান্তনা দিচ্ছে।
— মা চুপ করো। কান্না থামাও। এভাবে কান্না করলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
— ওরে কি করবোরে… আমি মরে গেলেই বা তোর বাপ-ভাইয়ের কি এসে যায়? তোর ভাই তার বউকে ছাড়বেনা তোর বাপ তোর ভাইকে কিছু বলবেনা। মাঝখান দিয়ে আমার এতো বছরের সাজানো সংসার সব শেষ হয়ে যাবে। ওরে আমার এতোবছরের পরিশ্রমের কোনো মূল্য নেই। আমাকে কেউ দাম দেয়না। আমার বেঁচে থেকে কি হবে?
— মা প্লিজ তুমি থামো। ভাইয়া তোমার সব কথা শুনবে। তুমি একটু শান্ত হও।
— শুনবেনা। দেখলিনা একটু আগে কি বলে গেলো?ওরে মা কি কখনো সন্তানের খারাপ চাইতে পারে? কেনো বুঝিসনা তোরা তোদের মাকে? আমি যা করি সব তোদের ভালোর জন্যই করি।

বাঁধনের আর ভালো লাগছেনা। দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে যায়। একটু আগে বীনাকে মোক্ষম এক জবাব দিয়েছে। আজ সুমির জায়গায় নিজের মেয়েকে বসিয়ে দেখুক কেমন কষ্ট লাগে? সব সময় নীজের স্বার্থটা দেখা উচিত নয়। ডিভোর্স যদি করতেই হয় তাহলে সুমির সুস্থ হবার অপেক্ষা করতে হবে। অসুস্থ অবস্থায় একটা মেয়ের বীনা অনুমতিতে কখনোই কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা উচিত নয়। আর এটাতো দুটো জীবন নিয়ে খেলা করা হয়ে যায়। ঝিমাটাও আজকাল বাঁধনের বিরুদ্ধে চলে গেছে। বাঁধনের এসব আর ভালো লাগেনা। বাঁধনকে যদি কেউ সাপোর্ট করে সে হলো ছুটি। ছুটি চায়না বাঁধনের সাথে সুমির ডিভোর্স হোক। বাঁধন মনে মনে ভাবলো, ছুটিটা হয়তো পরিস্থিতি বুঝে। তবে সে নিজের দিকেই সব থেকে বোকামোটা করছে। এরজন্য তাকে পস্তাতে হবে। তবে বাঁধন এই ছোট মেয়েটার পাশে থাকবে।

আধঘন্টা হয়ে যায় বীনার বিলাপ এখনো থামেনা। বাঁধন সহ্য করতে না পেরে মায়ের কাছে যায়। বীনা ছেলেকে আগলে নিয়ে বলে,
— বাবা আমি দোষী। আমি তোর জীবনে এই বিপদ ডেকে এনেছি। আমিই তোকে রক্ষা করবো। তোদের ডিভোর্স করাবো।
— আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি মা। কিন্তু এভাবেতো হয়না। সুমির সাথে আমার কথা বলতে হবে।
— যেখানে আমি আছি সেখানে তুই কেনো? মায়ের উপর ভরসা করে যখন বিয়েটা করেছিস তখন মায়ের উপর আরেকটু ভরসা রাখ। তুই তো আর প্রেম করে বিয়েটা করিসনি।
— হয়তো তা করিনি। বাট আমার কিছু দায়িত্ব আছে মা।
— যতদিন বিয়েটা আছে ততোদিন দায়িত্ব। বিয়েটা শেষ দায়িত্ত্বোও শেষ।
— আমাকে ভাবতে দাও মা।
— বাবা তুই এরপর যাকে ইচ্ছা তাকে বউ করে আন আমি কিচ্ছু বলবোনা। বস্তি থেকে একটা অশিক্ষিত মেয়েকেও যদি তুলে আনিস আমি হাসি মুখে বরণ করে নিবো। মেয়ের মতো আগলে রাখবো। তোর পছন্দের গুরুত্ব দিবো। তবু কোন অপারগ মেয়ের হাতে আমার পরিবারের ভবিষ্যত তুলে দিতে পারবোনা। তুই আমার একটা মাত্র ই কলিজার টুকরাই আব্বা।
মায়ের ছলছল চোখ দেখে বাঁধনের প্রচুর কষ্ট হয়। তৎক্ষণাৎ সামনে থেকে উঠে যায়।

বিকালে সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাঠে নামে বাঁধন। ব্যাটিং করছে শিপ্রু। আর বল করছে বাঁধন। ঘন্টা খানেক খেলার পর খেলা ছেড়ে দেয় বাঁধন। শরীর এখনো ঠিক হয়নি। তবে এভাবেই আগের মতো শক্ত সামর্থ্য হতে হবে। নিজের মনের ছোট ছোট কথা বাঁধন এই ছেলেমেয়েগুলোর সাথে শেয়ার করে। বড়দের তুলনায় এরা বিশ্বস্ত। কখনো পাঁচকান করে না। রতন বলে,
— বাধন ভাই কি জানি বলবে ন?
— হুম। মা বলছে সুমির সাথে ডিভোর্স করিয়ে দিবে। আমি কি এগোবো? তোদের মাথা কি বলে?
— আমাদের মাথা তো ভালোই বলে। নতুন আরেকটা বিয়ে খেতে পারবো। এবার চারদিন আগে থেকেই ছুটির খাদ্য তালিকা আমাদের হাতে থাকবে। বাথরুমে দৌড়ানো নট এলাউড।
বাধন হাসে। বলটা ছুঁড়ে মারে।
— সব বদমাইশের দল।
— আব্বার জিগাই?!!!
— ভাব কম নে।
মিলি বলে,
— বাঁধন ভাই যা চাইবে তাই হবে। বাঁধন ভাইয়ের খুশিই আমাদের খুশি।
ছুটি ঝিমার গলা ধরে ঝুলতে ঝুলতে বলে,
— নিজের মন যা বলে তাই করা উচিত। আমরা আমাদের বাঁধন ভাইকে খুব ভালোবাসি।
বাঁধন আবার হাসে। ছুটির মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
— কিরে সয়াবিন তেল হয়ে গেলি?
— সবার মতামত চাওয়া হয়েছে। আমারটাতো একা চাওয়া হয়নি।
— একা চাওয়া হলে কি বলতি?
— সুমি মেয়েটা প্রেজেন্ট থাক
বাকি সব চুলোয় যাক।
যদি বাঁধন আবার বিয়ে করে
কারো গুহার মোমের বাতি নিভে যাবে।
এর সারাংশ যে জানে
সে আধারদিন চুপ রবে।
— বাহ ছুটি তুইতো ভালো ছন্দ তৈরী করিস।
— আমি আরো ছন্দ তৈরী করেছি। সেগুলো আরো সুন্দর। তবে সেটা শুধু পাঠকরাই জানে।
— আমাদেরো জানা।
— সেই সুযোগ মনে হয় এই জীবনে আর হবেনা।
ছুটির ছন্দময় কথার ধরনে সবাই খিল খিলিয়ে হাসে। শুধু একমাত্র ঝিমাই হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। একটার সাথে আরেকটা মেলাতে থাকে। সুমি মেয়েটা প্রেজেন্ট থাক! বাকি সব চুলোয় যাক?কেনো?কিসের জন্য? ছুটিতো বেশ বুদ্ধিমান। তাহলে কেনো চাইছে এই জীবন্ত লাশটাকে নিয়ে তার ভাই সংসারহীন থাক? ছুটিকে একা পেয়েই ঝিমা চেপে ধরে। ছুটি একটু থ খেলেও নিজেকে সামলে নেয়। জোর করে একটু হাসে। ঝিমাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
— দেখ ঝিমা তুই আমাকে না বুঝে অভিযোগ করিস না। তুই আমার প্রাণের দোস্ত। তোর কোন ক্ষতি হোক আমি চাইনা।
— এখানে ভাইয়ার ক্ষতির কথা আসছে আমার না।
ঝিমার তেজ দেখে ছুটি দমে যায়। কিন্তু ঝিমাকে বুঝাতে হবে ভেবে শ্বাস ছেড়ে আবার বলতে থাকে।
— দেখ ঝিমা বাঁধন ভাইয়ের বিয়ের আগেই তুই একটু একটু ডেমো দেখে নিয়েছিস যে ভাইয়ের বউ ননদদের গুরুত্ব না দিলে কেমন হতে থাকে। তুই কষ্ট পেয়েছিস অনেক ক্ষেত্রে এতে আমি সাক্ষী আছি। এই বিয়েতেতো বাঁধন ভাইয়ের দিক থেকে হচ্ছিলোনা হচ্ছিলো পরিবারের দিক থেকে। কিন্তু এখন হবে বাঁধন ভাইয়ের দিক থেকে। যে তোর ভাবী হবে তার আঁচলে বাঁধন ভাই গিট্টু দেওয়া থাকবে। ভাইকে সারাজীবনের জন্য হারাবি। বাবা মাও কিছু বলবেনা। তার উপর যদি তোকে নিয়ে ভাবী একটু হেত ক্যাত করে তারপর দেখবি তোর দুঃখের শেষ থাকবেনা। তুই সবে ক্লাস টেন। তোর এই বাড়ি ছাড়তে অনেক সময়। ততোদিন না পরিবারের অবহেলায় তুই কোনদিক থেকে পিছিয়ে যাস।
কিন্তু মনে মনে বলে, আমি চাইনা বাঁধন ভাই আবার বিয়ে করুক। নিজের চোখে সেই সংসার আমি দেখতে পারবোনা। যতদিন না দূরে চলে যাচ্ছি ততোদিন বাঁধন ভাই আমাদের হয়েই থাকুক। একটা দিন যে নিশ্বাস বন্ধ করা যন্ত্রনায় ছটফট করেছি আমি প্রতিদিন সেই যন্ত্রনা সহ্য করতে পারবোনা। আমি মোটেই স্বার্থপর নই। তবে আমি আমার জন্য বাঁচি। অন্য কারো জন্য নয়।

ঝিমা ছুটির কথায় ভাবুক হয়ে পরে। সত্যিই তো বলেছে। মায়ের যা ভাষ্য তাতে ভাবী এলে মা সংসার ভাবীর হাতে তুলে দিয়ে শেষ বয়সের আরামে নিজেকে সপে দিবে। গার্ডিয়ান হবে ভাই ভাবী। ভাবী যা বলবে তাই। ভাবী যদি নিজের মানুষ না হয়ে উঠতে পারে তাহলে সত্যিই কষ্টের সীমা থাকবেনা। তাই বলে ভাইকে এভাবে সিঙ্গেল রাখাও যাবেনা। আহত মন নিয়ে ঝিমা সগোক্তি করে,
— এরজন্যেই আজকালকার মেয়েরা বান্ধবীকে ভাইয়ের বউ বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে।
ছুটি কৌতুক করে বলে,
— তো আমাকে তোর ভাবী বানিয়ে নে না।
ঝিমা ছুটির দিকে তাকাতেই ছুটি খিলখিল করে হেসে উঠে। ঝিমা যেতে যেতে বলে,
— দাড়া ভাইয়াকে বলছি আমি।
ছুটি পেছন পেছন দৌড় দেয়। ঝিমাকে টেনে ধরে বলে,
— একদম না। আমিতো মজা করেছি। এটা শুনলে ভাইয়া তোর গাল দুইটা এখনি লাল করে দিবে।
— দোষ করিস তুই মার খাই আমি।ভাইয়া কখনোই তোকে মারে না। তোর ভাগের গুলো আমার গালেই পড়ে।
— আর তুই সহ্য করে নিস। এই না হলে আমার পেয়ারের বান্ধবী!
ছুটি ঝিমা গাল টেনে দেয়। দুই বান্ধবী একসাথে হেসে উঠে। হাসতে হাসতে ঝিমার চোখে জল চলে আসে। মনে মনে বলে,
— আমার ভাবী তুই যদি হতে পারতিস আমি হতাম এ পৃথিবীর সব থেকে সুখী একজন। আমরা যা চাই তা পাইনা। যা পাইনা তাই চেয়ে বসে থাকি।

বাঁধনের আর ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। মাকে জানায় সে ইন্টারভিউ দিবে নতুন চাকরির জন্য। বীনাও দেখে হ্যা এতে ভালোই হবে। ঘরে বসে বসে মনের উপর আরো চাপ পড়ে। নানান রকম চিন্তা ভাবনা এসে ভর করে। এর থেকে আগের ডেইলি লাইফে চলে যাক। বাঁধন কয়েকটা কোম্পানিতে এপ্লিকেশন করে। দুইদিন পরেই একটা কোম্পানি থেকে ডাকা হয়েছে ইন্টারভিউ এর জন্য। সকাল সকাল রেডি হয়ে মাকে বলে ইন্টারভিউ দিতে বেরিয়ে পড়ে। গলিতে যেতেই মুখোমুখি হয় রিতী আর ছুটির। বাঁধন রিতীর গেটাপ দেখে বলে,
— রিতী কোথাও যাচ্ছিস ?
— কোচিং এ যাই।
— আমিও সেদিকে যাচ্ছি। চল।
— নিউ জব?
— নারে ইন্টারভিউ।
ছুটি রিতীর পেছন থেকে বলে,
— অল দ্যা বেস্ট।
বাঁধন হাসে।
— থ্যাংক ইউ। দোয়া করিস।
বাঁধন রিতীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যাবার পথে মোড়ের দোকানে কি মনে করে উঁকি দেয়। সোহাগ বাইকের উপরে বসা। হাতে চায়ের কাপ। এক দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে। বাসে উঠে বাঁধন রিতীকে বলে,
— ছুটির খেয়াল রাখিস।
রিতী চমকায়।
— কি হয়েছে?
— টিনেজ চলছে। এবয়সে কত কি হয়! মনের ছটফটানো বলিশ আবার আশেপাশের নজর বলিস। কতদিক থেকে কত ফাঁদ তৈরী হয়! সাবধানে রাখিস। গতিধারা খেয়াল করিস। বয়সটাই খারাপ। কতদদিকে চোখ যায়!
রিতী বাঁধনের কথা আংশিক বুঝেছে। তবে ছুটি কি কোন আচরণ করেছে যে বাঁধন তাকে বলছে? ছুটির গতিধারা যদি কোনভাবে বাঁধন ভাই টের পেয়ে যায় তাহলে তো সর্বনাশ! বাঁধন ভাই মেরে একপাশে ফেলে রাখবে। বাবা মার কানে এই অবুঝ পাগলামির কথা কানে গেলে আর বাঁচা যাবেনা। একেতো তাকে নিয়ে বাবা মা এতো চিন্তায় থাকে তার উপর ছুটির এই বয়সে এতো বড় কান্ড! বাঁধন ভাইয়ের একটা রিয়েক্টে কলোনিতে মুখ রাখার জায়গা থাকবেনা। নানান চিন্তায় রিতীর সোহাগের কথা মনে পড়ে। সে যে সোহাগকে বিয়ে করেছে একথা ক্ষুনাক্ষরেও কেউ জেনে গেলে কি হবে ভেবেই রিতী থরথরিয়ে কেঁপে উঠে।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~

#বিষ_করেছি_পান(৩০)

(কপি করা নিষেধ)
— ওখানে কি করছিস? এদিকে আয়।
বাঁধনের ডাক পেতেই ছুটি একতলা থেকে লাফ দিলো। বাঁধন চমকে গিয়ে এই এই করতে করতেই ছুটি বাঁধনের সামনে মাটিতে খাড়া হয়ে পড়লো। বাঁধন থমকালো। কোমড়ে হাত রাখলো। শাসনের স্বরে বললো,
— বড় হচ্ছিস না? এতো গেঠোপানা কিসের?
— আমি কি গ্ৰামের মেয়ে? মোটেই নয়। এটাকে বলে প্রতিভা। এই প্রতিভা কজনের মধ্যে আছে? মূল্যায়ন করতে শিখুন।
— আমার কাছে মূল্য তখনি পাবি যখন দেখবো তোর আর ঝিমার খাতার নম্বর পাশাপাশি।
— খাতার নম্বর পাশাপাশি হোক বা না হোক বাড়িতো পাশাপাশি ।
— মুখে মুখে চাপা? অংকে ডাব্বা মারিস! শোন সন্ধ্যা করে আমার কাছে দেখিয়ে নিবি যা না পারিস।
— মান সম্মান আর থাকবেনা।
— কেনো?
— অংক স্যারের মেয়ে হয়ে আপনার কাছে পড়তে গেলে এই মুখ কাকে দেখাবো?
— ঢেকে রাখবি। এমনিতেই দিন দিন চেহারা ফুটে উঠছে আশেপাশের কু নজর লাগতে শুরু করেছে। রিতীর মতো রোরখা পড়বি। আমার কথা শুনে চলবি।
— আচ্ছা।

সন্ধ্যায় ছুটি পড়তে যায় বাঁধনের কাছে। বাঁধন ছুটিকে দেখেই চোখ উপরে তুলে ফেলে। ছুটি রিতীর ঢোলাঢালা বোরখা পড়ে আসছে। কালো বোরখায় ছুটিকে মাজারের রক্ষাকারী মনে হচ্ছে। বাঁধন একটু চেঁচিয়ে উঠে,
— এটা কি পরেছিস? সন্ধ্যা বেলায় বাসার ভিতরে তোকে এই ডিলেডালা আলখাল্লা পড়তে কে বলেছে? খুল এটা।
ছুটি বই সেন্টার টেবিলে রেখে সোফায় ধপ করে বসলো। মুখ দিয়ে ফু করে বাঁধনের দিকে তাকালো।
— উফফ! বারবার খুলা আবার পরা ভালোলাগেনা। একেবারে বাড়িতে গিয়েই খুলবো। রাস্তায় দেখলাম কয়েকটা লোক অনবরত যাতায়াত করছে। ওদের সামনে বোরখা ছাড়া যাই কি করে!
বাধন আর কি বলবে ভেবে পায়না।ঝিমা এসে রুমে ঢুকলো বই নিয়ে। ছুটির বোরখা দেখেই হাসতে হাসতে টানাটানি শুরু করে দিলো। ছুটি চেঁচিয়ে উঠলো।
— এই ছাড় ছাড়। এই বোরখা আপুর। কিছু হলে আমাকে খবর করে ছাড়বে।
ঝিমা জেদ করে বললো,
— আমাকে ছাড়া তুই বোরখা পড়া শুরু করেছিস। এতো বড় সাহস! তোকে আপুর হাতের মার খাইয়েই ছাড়বো।
ছুটি সোফার উপর উঠে গেলো। ঝিমা ছুটিকে নিয়ে পড়লো। বাঁধন ধমক দিচ্ছে। ওদের কানে গেলো না। দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটি বোরখায় পা বেজে দরজার চৌকাঠে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। বাঁধন ঝিমা একসাথে চিৎকার করে উঠলো। ছুটি তেমন ব্যাথা পেলো না। কিন্তু ওদের চিৎকার শুনেই ভয়ে সিটিয়ে উঠলো। ঝিমা দৌড়ে এসে ছুটিকে ধরলো। বাঁধন বাহু তুলে ছুটিকে ভেতরে নিয়ে গেলো। নাক বেয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে দেখে বাঁধন প্রচন্ড রেগে গেলো। রাগের বসে ঝিমার গালে সপাটে চড় বসালো।
— থামতে বলেছি কখন কানে যায়নি? একটা এক্সিডেন্ট ঘটিয়েই তোকে থামতে হলো। এই ছুটি বোরখা খুল। এক্ষুনি তোর এই আলখাল্লা খুলবি।
ঝিমা গালে হাত দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। শক্ত হাতের চড়! যখনি খায় তখনি মনে হয় গালের উপর দিয়ে ট্রলার মেশিন গৌড় দিলো। ফ্লোরের উপর থেকে পা তুলে আবার পা ফেলে ঘ্যান ঘ্যান করে
— সবসময় তুমি ওর জন্য আমাক মারো বলে নাকে কান্না করতে করতে চলে গেলো।
ছুটি ঝিমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাঁধন এসে একটানে বোরখা খুলে ফেললো। আঙুলে শাসালো,
— আর কোনদিন বোরখা পড়বিনা ঠিক আছে?
ছুটি মাথা দুলালো। বাঁধন কটন দিয়ে ছুটির নাক পরিষ্কার করে দিলো। গালে হাত রেখে বললো,
— আরো কোথাও ব্যথা পেয়েছিস?
— উহু।
নিচ থেকে বীনা চেঁচাতে চেঁচাতে রুমে ঢুকলো। ছুটিকে ধরে বললো,
— ব্যথা নাকি পেয়েছিস? দৌড়াদৌড়ি না করলে তোদের এর চলেনা না? আয় আয়তো দেখি। ইসরে নাকটা লাল করে ফেলেছিস। ব্যথা লাগছে না এখন?
— না।
ছুটির সোজাসাপটা উত্তর। এতোবড় একটা ব্যথা পেলো অথচ বলে ব্যথা লাগছে না! একফোঁটা চোখের জল ও পড়তে দেখা গেলো না। ঝিমা হলে এতোক্ষনে বিছানা ভিজিয়ে ফেলতো। বাঁধন ধীরে ধীরে সগোক্তি করলো,
— এই মেয়েটা এতো স্ট্রং কেনো?

বাঁধন একটা আমেরিকান কোম্পানিতে সিলেক্ট হয়েছে। ভালো স্যালারী। বাবার কথা আর কয়দিন পর স্টার্ট করলে হতোনা? বাধন আপত্তি জানায়। এতো ভালো চাকরী ছাড়াটা ঠিক হবেনা। সুযোগ সব সময় আসেনা। তাছাড়া আজকালকার বাজারে চাকরী পাওয়া এতোটা সহজ না। এপোয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পাবার পর বাঁধন জয়েন করে। দশটা টু পাঁচটা ওয়ার্ক টাইম। একটু দূরে হয়ে যাওয়ায় লাঞ্চ টাইমে আর ঝিমাকে ড্রপ করতে পারেনা। তবে যাবার সময় ড্রপ করে দেয়। আগে রিতীর সাথে স্কুলে গেলেও এখন ছুটির একা যেতে হয়। সেজন্য বাঁধন বাইকে এগিয়ে বসে ঝিমাকে বলে দু পা দুদিক দিয়ে বসতে যাতে ছুটির ও জায়গা হয়। ছুটিকে ডেকে ছুটির রিকশা ছুটিয়ে দেয়। ঝিমার মতো করে পেছনে বসতে বলে। ছুটি কি যেনো ভেবে চটপট উঠে বসে। প্রতিদিন সকালে স্কুলে ছেড়ে দেবার সময় অফিসে যাওয়ার আগে দুজনের হাতেই টিফিনের টাকা গুঁজে দিয়ে যায়। ছুটি ঝিমা খুশি মনে নিয়ে নেয়। একেতো বাবা মা দেয় তার উপর বাঁধনের থেকেও পায়। টাকা জমিয়ে জমিয়ে ছুটি ঝিমা এক্সটা ক্লাসের কথা বলে সিনেমা দেখে আসে। একদিন সিনেমা হলে গিয়ে টিকিট পায়না। দুজনের ই মন খারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে এক্সটা ক্লাসের কথা বলেছে এখন এই সময়টুকু কি করবে? ভাবতে ভাবতেই হল থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু পছন্দমতো কোন উপায় পায়না। যেটাতে তারা তুষ্ট হবে। গেইটে আসতেই মুখোমুখি হয় সোহাগের। ছুটি সোহাগকে দেখে লম্বা একটা হাসি টানে। ঝিমার হাত ধরে দৌড়ে যায় সোহাগের কাছে।
— দুলাভাই?
ডাকতেই সোহাগ ফিরে তাকায়। ভ্রু নাচিয়ে বলে,
— এখানে কি? স্কুল নাই?
— শেষ করেই আসছি। টিকিট পেলাম না। কত রিকুয়েস্ট করলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো তাও দিলোনা।
— কে দিলোনা? দেখি আসতো।
ছুটি সোহাগের পিছু পিছু যায়। সোহাগ টিকিট কাউন্টারে গিয়ে বলে,
— এইযে মামা। দেখছো দুজন! আমার শালিকা। যখনি আসবে সিটে বসিয়ে দিবে। খবরদার টাকা নেবে না।
— আচ্ছা মামা। চেনা থাকলো।
— হুম।
সোহাগ ওদের নিয়ে সোজা হলে ঢুকে গেলো। ছুটি ঝিমা তো খুশিতে গদগদ করছে। এবার থেকে আর টিকেট কাটতে হবেনা। ফ্রিতে মুভি দেখা যাবে। সোহাগ সামনে সিরিয়ালে গিয়ে তিনজনকে উঠিয়ে দিলো। ইশারায় ছুটি ঝিমাকে বসতে বললেই দুজনে হুরমুর করে গিয়ে বসলো। সোহাগ বেরিয়ে গেলো। ফিরলো কিছুক্ষনের মধ্যেই। দুজনের হাতে পপকর্ণ আর চিপস ধরিয়ে দিলো। ঝিমা ধন্যবাদ জানালো। সোহাগ ও ছুটির পাশে বসে পড়লো। ছুটি মুভি ইনজয় করছে। শাকিব বুবলির মুভি।
— আমার পিরিতীর খবর কি ?
সোহাগের প্রশ্নে ছুটি লাস্ট চিপসটা শেষ করলো। হাতে বারি দিয়ে সোহাগের দিকে চেপে বসলো।
— আপু এখন এডমিশন টেস্ট নিয়ে খুবই ব্যস্ত। বাবা বলেছে আপু যদি ঢাবিতে চান্স পায় তাহলে স্কলারশিপের আবেদন করতে অনুমতি দিবে। নয়তো আপুর সপ্নপূরণ বাংলাদেশেই অফ।
সোহাগ একটু নড়ে চড়ে বসলো। তার পিরিতি এতোদূর ভেবে রেখেছে! একটু অবাক ই হলো। এতো টেলেন্টেট জন্য ই তো সোহাগকে ট্রাপে ফেললো। মাথায় ঘিলুতে ভরপুর আর ভাবখানা দেখায় হাবাগোবা। সোহাগ বুঝতে পারছে কোন লেজে পা দিয়েছে। অন্য কেউ হলে ফিউচার বালিশ ভিজিয়ে এতোদিনে ধূয়ে যেতো। ঘরবন্দি থাকতো। আর তার পিরিতি জীবনের এতোবড় একটা কান্ড ঘটিয়ে তরতর করে গাছ বেয়ে চলছে। ধীরে ধীরে সগোক্তি করলো,
— এই মেয়েটা এতো স্ট্রং কেনো? ছুটিকে বললো,
— আমার কথা কিছু বলে?
— হ্যা। একটু একটু করে আপনার বুদ্ধি খুলছে বলেছে।
— কিরকম?
— আমি জানিনা। আপনি জেনে নিয়েন।
— তোমার আপু চান্স পেলে আমার তরফ থেকে গিফট আছে। গিফটা এক্সেপ্ট করানোর জন্য তোমার হেল্প লাগবে।
— কি গিফট?
— এইসব ছোটোখাটো সিনেমা হল ছেড়ে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সের টিকিট পাবে।যদি তোমার আপুকে নিয়ে আসতে পারো।
— সত্যি? আলবাদ পারবো। ওটাতো আপুর গিফট। আমার জন্য?
— আনলিমিটেড খাওয়া দাওয়া।
— তাহলে ঠিক আছে।

সন্ধ্যায় বাঁধনের কাছে পড়তে গেলে বাঁধন প্রশ্ন করে,
— তোদের কয়েকদিন পর পর এক্সটা ক্লাস কোন টিচার নেয়?
এইতো হয়ে গেলো! ঝিমা ছুটি একসাথে ঢুক গিলে দুজনের দিক তাকালো। ইশারা করলো
— এবার কি বলবে?
কোন স্যারের কথা বলবে? যদি গিয়ে ঐ স্যারের সাথে কথা বলে? তখন?
বাঁধন আবার জিজ্ঞেস করলে দুজনেই বাঁধনের কথা না শোনার ভান ধরে মন দিয়ে অংক করতে থাকে। যেনো কতো ভালো অংক পাড়ে! ছুটি পারছেনা ঝিমারটা আড়চোখে দেখে দেখেই খাতা ভরিয়ে তুলছে। ওদের ভাব সাব দেখে বাঁধন শক্ত গলায় বলে,
— সিনেমা হল আমার মতে কোনো খারাপ জায়গা নয় যে লুকিয়ে চুরিয়ে মিথ্যা বলে যেতে হবে। তবে এইটুকু বয়সে যদি অন্যকাউকে এড করো তাহলে সেটা অবশ্যই খারাপ কাজ। মনে করো না যে সারাদিন থাকিনা জন্য তোমাদের পথিবাক্য আমার জানা থাকবেনা। মা বাবা ঘাস খেয়ে চললেও ভাই ঘাস খেয়ে চলে না। ঐ সিনেমা হলে আমার পরিচিত অনেকের যাতায়াত আছে। কারো জন্য আমি মাথা নিচু করবোনা।মনে থাকবে?
ছুটি ঝিমা আমতা আমতা করতে থাকে। তার মানে বাঁধন ভাই সব জানে? বাঁধন খাতাটা ঝিমার সামনে থেকে হাতে তুলে নেয়। মিনিট খানেক চোখ বুলিয়ে বলে,
— লেখাপড়া ঠিক রেখে খারাপ কাজ ব্যতিত যা ইচ্ছা তাই করতে পারো। আমার তরফ থেকে কোন বাঁধা পাবেনা। তবে লেখাপড়াটা ঠিক রেখেই অন্যপথে এগোতে হবে নয়তো আমি মেনে নিবোনা।
ছুটি মাথা নাড়ে। বাঁধন ছুটির দিকে একচোখে তাকিয়ে বলে,
— সিনেমা হলে না গেলেই খুশি হবো।
ছুটি চটপট বলে ,
— যাবোনা।
— কেনো যাবিনা?
— আপনি বলেছেন তাই।
— আমি যা বলবো তাই করবি?
— হ্যা।
— বিনিময়ে কি চাই?
— সুমি আপুকে ডিভোর্স দেওয়া যাবেনা।
— এখানে সুমি কোথা থেকে আসছে?
— আমার মাথা থেকে। সুমি আপুর কথা সব সময় মাথায় ঘুরে। অসহায় একটা মানুষ। এই অবস্থায় তো ডিভোর্সের কথা মুখ থেকেও বের করা উচিত হবেনা।
— তুই কেনো আমাকে সাপোর্ট করিস?
— যেটা ভালো সেটা আমি সবসময় সাপোর্ট করি। তাই ঝিমা?
ঝিমাও সাথে সাথে মাথা নাড়ায়। সে সহমত। সেদিনের ছুটির কথা গুলো ঠিকঠাক তার মাথায় গেঁথে গেছে। অনেক চিন্তা করে দেখলো ছুটিই ঠিক বলেছে। তাই সে ছুটিকে সাপোর্ট করলো। বাঁধন অবাক হয়ে গেলো। যে বোন এতো দিন তার বিরোধিতা করলো সে আজ তাকে সাপোর্ট করছে। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? ছুটি কি ঝিমাকে বুঝাতে সক্ষম হলো?

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা

#বিষ_করেছি_পান(৩১)

(কপি করা নিষেধ)
ছানোয়ারের সপ্ন পূরণ হয়েছে। রিতীর ঢাবি সহ জাবিতে এবং জবিতেও চান্স হয়েছে। ছানোয়ার গিয়ে রিতীকে ঢাবিতে ম্যাথমেটিকস এ এডমিট করে এসেছে। সে যে রাস্তায় হেঁটে এসেছে সেই রাস্তায় তার মেয়েও হাঁটছে। একটা বাবার কাছে এর থেকে বড় কিছু আর পাওনা থাকে না। ছানোয়ার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে রিতীর হাত দুটো মুঠোয় ভরে নিলো। মুখের দিকে আকুল হয়ে তাকিয়ে বললো,
— আমার কাছে তুই কি চাস মা? বল। আজ যা চাইবি খাস দিলে তোকে দিয়ে দিবো।
বাবার এমন অফারে রিতীর গা শিরশির করে উঠলো। সুক্ষ চোখে বাবাকে পরখ করলো। ছানোয়ারের চোখে মুখ চিকচিক করছে। যেনো এক্ষুনি চামড়ার উপর সোনার পান বসানো হয়েছে। ঠোঁট দুটো অনবরত কাপছে। রিতী বুঝার চেষ্টা করলো তার বাবা কতটুকু সিরিয়াস। রিতীর মুখটা মলিন হয়ে গেলো। কথা ঘুরাতে চাইলো।
— আজ থাক বাবা। সময় সুযোগ বুঝে অন্যদিন চেয়ে নিবো। অনেক বড় কিছু চাইবো। যা তুমি কখনোই মানতে চাইবেনা।
— কে বললো চাইবোনা? আমার মেয়ে আজ যা চাইবে খাস দিলে দিয়ে দেবো। একটুও কার্পন্য হবেনা। আমি আমার মেয়েকে চিনি। খারাপ কিছু সে কখনোই চাইবে না।
রিতী শুকনো হাসলো। মুখটা শক্ত আবরণে ঢেকে নিলো।
— আমাকে কখনো বিয়ের জন্য প্রেশার দিবেনা বাবা। আমি আগে নিজের ক্যারিয়ার দেখবো তারপর সেটেল হবার কথা ভাববো।
— তা তো অবশ্যই। আগে ক্যারিয়ার তারপর সেটেল। আমি আমার মায়ের সাথে একমত পোষন করছি।
কথাতো হাসিমুখে ছানোয়ার দিয়ে দিলো। কিন্তু শেষ অব্দি সে কথা রাখতে পারবে কি?

ছুটি রিতি ঝিমা তুলি একসাথে এসেছে বসুন্ধরায় সিনেমা দেখতে। তুলিকে ছুটিই এনেছে। এর জন্য ওকে ঢের পোহাতে হয়েছে।তুলির সাথে আড্ডা দেবার নাম করেই রিতীকে নিয়ে এসেছে। ঝিমা ছুটির চিরসঙ্গী। ফ্রি ফ্রি সব অফার লুটে নিচ্ছে। তবে সে এর বিনিময়ে অনেক বড় একটা কাজ করে যাচ্ছে। যাকে বলে ‘see hear but not tell.’ সিক্রেসি বিষয়টা তার মধ্য বরাবরই ঠিকঠাক। তুলির সাথে দীর্ঘ দিন পর দেখা। দুই বান্ধবী দুজনকে মিনিট খানেক হাগ দেয়। তারপর ঘুরতে থাকে। সময় মতো টিকিট নিয়ে ঢুকে যায় মুভি দেখতে। সিটে বসার ঘন্টা খানেক পর রিতীর পঞ্চেদ্রীয় বলে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কে তাকিয়ে আছে? সবার চোখ এখন বড় পর্দায় থাকার কথা তবে কে তার দিকে তাকিয়ে থাকবে? চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটু পর পর খোঁজ ও করে। তবে কাউকে পায়না। হটাৎ ই পাশ থেকে কেউ বলে উঠে,
— তোমার প্রেম এদিকে।
চমকে লাফিয়ে সরে উঠে রিতী। সোহাগের মুখটা পাশের সীটে দৃশ্যমান হতেই অপর পাশে তাকিয়ে দেখে ছুটি ঝিমারা কেউ নেই। চোখ বুলাতে গিয়ে দেখে ওরা আছে কয়েকসিট পড়েই। সোহাগ ধ্যান ধরে তাকিয়ে আছে রিতীর অস্থির হওয়া মুখটার দিকে। গোলাপী১ ব্লাসনে ইস কী সুন্দর গাল দুটো টসটস করছে। হচ্ছে এখনি কামড়ে দিতে। সোহাগ তো রিতীকে কামড়াতেই চায়! পারে কি?
— সোজা হয়ে বসো।
সোহাগের ছোট কথায় রিতী একদম সামনে বরাবর সোজা হয়ে বসে। চোখ নিবদ্ধ হয় পর্দার দিকে। সোহাগ বিনা দ্বিধায় রিতীর বা হাতটা ধরে নিজের উরুর উপর রাখে। আকষ্মিক ঘটনায় রিতী স্তব্দ হয়। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলে সোহাগ রিতীর হাতের উপর নিজের হাত রেখে চাপ দেয়। রিতী উহ করে উঠে সোহাগের দিকে তাকায়। দুজনের চোখে চোখ আবদ্ধ হয়ে যায়।সোহাগ রিতীর হাতটা নিয়ে নিজের হাতের আঙুলের ভাজে ভাজে ঢুকিয়ে নেয়। রিতীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে বলে,
— পিরিতি? তোমার গোলাপী আভাযুক্ত স্কীনে হলুদ রংটা বেশ মানিয়েছে। হলুদ ফুলের মতো লাগছে। ইচ্ছে করছে এখনি ছুঁয়ে দেই।
— হাত ধরে তো বসেই আছেন। আবার কি?
— বুঝনা?
রিতী বিরক্ত হয়। সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আপনার সময় শেষ । হাত ছাড়েন। আমার বোনটাকে হাত করেছেন তাইনা? বড্ড ধান্দাবাজ আপনি।
— ধান্দাবাজ আমি না তোমার বোন। গুনে গুনে আমর থেকে তিনহাজার টাকা খসিয়েছে।
— বেশ করেছে।এখন তো আমার ইচ্ছে করছে আপনাকে খসিয়ে নিতে।
সোহাগ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। রিতীর রাগন্নিত মুখটা ভালোভাবে পরখ করে। আতঙ্ক গলায় বলে,
— সত্যি পিরিতি? বহুত চালাক তো তুমি। আমার কাছে এসে আমার সবকিছু ভোগ করার সপ্ন দেখছো নাকি?
রিতী জোড় করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
— কখোনো না। কোনদিন না। আপনার সম্পত্তির উপর আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। বার বার কেনো শুনতে হয় আমাকে এই একই কথা?
— তাহলে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করার মানে কি?
— যাতে আপনার মধ্যে একটু হলেও ভয় ঢুকে যে রিতী কি জিনিস! রিতীর থেকে দূরে থাকতে হবে।
সোহাগ ফিচেল হাসে। রিতীর হাতখানা আবার নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে বলে,
— তোমাকে ছোঁয়া যে এখনো আমার বাকি।
— হাত ছাড়ুন। আমি চলে যাবো এখনি।
মুভি না করেই চলে যায় রিতী। ছুটিরা মুভি শেষ করে দেখে রিতী নেই। রিতীকে খুঁজতে গেলে কিছুক্ষন পর সোহাগ আসে।
— তোমার আপু চলে গেছে।
— একা একা?
— নাহ আমার গাড়িতে।
— রাজি হলো?
— উবার নামক সোহাগের গাড়িতে যেতে রাজী হতে হয়না।
ছুটি যা বুঝার বুঝে গেছে। তুলি চলে যায়। ছুটি ঝিমার এবার ভূরিভোজের পালা। দুজন যা ইচ্ছা তাই অর্ডার করে। খেতে খেতে সোহাগ ছুটিকে আরেকটা আরজি জানায় যেটা শুনে ছুটির রাগ হবার কথা হলেও ছুটি একটুও রাগ করতে পারেনা। কেউ না জানলেও ছুটি জানে সোহাগ রিতী দুজন এখন স্বামী স্ত্রী। সোহাগের সোজাসাপটা প্রপোজাল।
— ছুটি রাণী! আজকের জন্য ধন্যবাদ। তোমার বোনটা আরো বেশি মাখনের মত নরম হয়ে গেছে। হাতটা কি তুলতুলে! আগে এমন ছিলোনা। যার কারণে তোমার বোনকে আমার পেতে ইচ্ছে করছে। ব্যবস্থা করো।

সোহাগের কথায় ঝিমা মুড বিগড়ে গেলো। নিরব দর্শকের খাতা থেকে প্রতিবাদী দর্শকের খাতাম নাম লিখালো। গুন গুন করতে করতে নাক সিঁটকালো,
— ছিহ! আপনার মন মানসিকতা এতো খারাপ দুলাভাই!এর জন্যই আপু আপনাকে দেখতে পারেনা।
সোহাগ ছুটিকে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
— এই বোবা শালী কথা বলে কেনো? একে চুপ থাকতে বলো।
— আমি সত্যি কথা বলি। কথা বলিনা দেখে আমাকে বোবা বলবেন?
— আমি তোমাদের বোনকে বিয়ে করতে যাই নি,তোমাদের বোন ই আমাকে চেপে ধরে বিয়ে করেছে।বোবাকে তো বোবাই বলবো। বোবা না হলে এতো দিন ধরে যে আমার ছুটি রাণি তোমার ভাইকে মন দিয়ে বসে আছে, কষ্টে চুপসে থাকে, বান্ধবীর প্রতি এতো টান আওয়াজ দাওনা কেনো?
কথাটা বলার সাথে সাথেই ঝিমা ছুটির মুখের দিকে তাকায়। ছুটিও ঝিমার দিকে তাকায়। ঝিমা আতঙ্ক ছড়িয়ে মৃদু চিৎকার করে,
— ছুটি!!
ছুটি তাড়াহুড়ো করে সোহাগকে বলে,
— অযাচিত কথা বলবেন না দুলাভাই।
ঝিমা জিজ্ঞাসা করে,
— কোনটা অযাচিত কথা?
ছুটি মনে মনে লাফাতে থাকে। বাঁচার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে। ঝিমা ছুটিকে চেপে ধরে,
— দুলাভাই এটা কি বললো ছুটি? তুই? আসলেই? সোহাগ ভাইকে তুই এই কথা কেনো বলেছিস?
ছুটি অনবরত মাথা নাড়াতে থাকে। সোহাগ হাসতে হাসতে বলে,
— ও কি বলবে? ওর চোখ মুখের এক্সপ্রেশন এর দিকে খেয়াল করলেই দেখা যায় সব চকচকা।
ঝিমার চোখে জল চলে আসে। বিরবিরিয়ে বলে,
— এতো বড় ধোঁকা! এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা? আমার বিশ্বাসের অবমাননা এভাবে করলি?
ছুটি কিছু বলার আগেই ঝিমা সব টুকু অভিমান কুড়িয়ে দৌড় দেয়। ছুটি শান্ত বদনে ঠাঁয় বসে থাকে। ছলছল চোখে সোহাগের দিকে তাকায়। ঝিমার এইটুকু রিয়েক্ট ছুটির চোখ পর্যন্ত জল এনে দিয়েছে। ঘায়েলটা ভালোই হয়েছে। ছুটির কাঁদতে ইচ্ছে হয় হাউমাউ করে। রাগে দুঃখে খাবারের প্লেটটা সোহাগের দিকে ঠেলে দেয়। সোহাগ হাত উঠিয়ে বলে,
— এতো কষ্ট পাবার কিছু নেই। তুমি আমার কষ্টের দিক মন দাও। তোমার ওসব ছুচকো কষ্ট আমি এক নিমেষেই দূর করে দিবো। ছুটি জামার হাতা দিয়ে চোখ ডলে নেয়। শান্তভাবে জিজ্ঞেস করে,
— কি হিসেবে চান আমার বোনকে?
— কি হিসেবে মানে?
— আমি যদি আপুকে আপনার কাছে পাঠাই কি হিসেবে পাঠাবো? বিবাহিত বোনকে আমি কিন্তু আমার মতো করেই পাঠাবো আপনি গ্ৰহণ করতে পারবেন তো?
— যা লাগবে নিয়ে যাও।
— আপনি যদি মেয়েলি নেশাটা না করতেন আমি সত্যি সত্যি আমার বোনের জন্য যা লাগবে তাই নিয়ে যেতাম।যেতে না চাইলে কলার ধরে নিয়ে যেতাম।
ধমকে উঠে সোহাগ।
— এই মেয়ে এই? একদম বোনের মতো কথা বলবেনা বলে দিলাম। খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।
— আমি তো ভালোই ছিলাম। খারাপ তো আপনি করলেন। কসম দুলাভাই! আপনে যে আগুনে ফু দিলেন সেই আগুন যদি আমার আর আমার ব্যক্তিগত বিষের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় আমার তৃষ্ণার জল টুকু শুকিয়ে ফেলে আমিও আপনার তৃষ্ণার জলটুকু কেড়ে নিবো। ধাপরিয়ে মরবেন আপনি।
— বাহ ভালোই ব্লাকমেইল করো সোহাগের শালী বলে কথা! আমিতো ভেবেছিলাম সব কথাই তোমার বান্ধবীর সাথে শেয়ার করো। এখন তো দেখছি নিজেকে লুকিয়ে বান্ধবীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো।
এরপর কি হবে ভেবে ছুটির চোখ দুটো আবার ভিজে উঠে। ধীরে ধীরে একা একাই বেরিয়ে আসে । সোহাগ পেছন থেকে ডাকে। একা একা যেতে পারবেনা সোহাগ পৌঁছে দিবে বলে। ছুটি দাঁড়ায় না। সোহাগের সাথে একপাও যাবেনা। সে রিতীর মতো বোকা না।

ছুটির এমন অবাধ্যতা সোহাগ মেনে নিতে পারেনা। এইটুকুই মেয়ে তার আচরণে এইটুকু বোঝা যায়না। ছুটির প্রতি রাগ হয়। ভেবেছিলো ছুটিকে কব্জা করে রিতীকে মন চাইলেই নিজের মতো ঘুরাতে পারবে তা না মেয়ের দেমাগে আটেনা। আবার থ্রেড ও করে দেয়। পেছন থেকে কেউ সিটি বাজায়। সোহাগ ঘাড় ঘুরাতেই দেখে বাদল আর ধলা। সোহাগকে দেখে বিশ্রি হাসি হাসছে। হসপিটালে এদের মারার পর থেকে এরা আর সোহাগের পেছনে আসেনা। ভাই বন্ধুত্ত্বের সম্পর্ক সেখানেই শেষ। সোহাগের আর এদের প্রয়োজন হয়না। সোহাগের রাজ্যে এখন শুধু রিতীই বিরাজ করে। রিতীকে ভেবেই তার দিন চলে যায়। বাদল আর ধলা সেদিনের পর একজোট হয়ে চলে। সোহাগকে দেখেই হাসাহাসি করে। সোহাগের তখন রাগ হয়। খুন করে ফেলতে ইচ্ছা করে রিতীকে। পুরুষ হয়েও সে একটা নারীর কাছে হেরে গেলো। তাও আবার সেই নারী তার পিরিতি ভীতু কোমল একটা মেয়ে। ধলা একটু জোরেই বলে, — আজ বড়লোকের পোলা না জন্য আমরাতো শালা একটা পাইনা। আর বড়লোকের পোলারা বড়টা ছোটটা সহ ই খায়।
— হ্যারে ঠিক বলেছিস। কচি থেকে যে কলিতে এসে থেমেছে সেটাতো আজ না দেখলে জানতাম ই না। দুই দুইটা পাখিই খাঁচায় ডানা ঝাপটায়।
সোহাগের বোঝার বাকি থাকেনা এরা কি বলছে। ধলা রাগে বিচ্ছিরি একটা গালি দিয়ে বলে,
— শিকারী শালা নিমুকহারামের জাত। কথা দিয়ে কথা রাখেনা।
বাদল উস্কে দিয়ে বলে,
— জাত পাত দেখোস নাকি আজকাল? তোর ও কি জাতপাত আছে নাকি? তাইলে খপ করে খাঁচা থেকে পাখিরে টেনে ধরস না কেন?
— ইসস পাখিযে আঘাত পাবে।
— পাখির রক্ত খাইছিস কোনদিন? খাবি নাকি? চল। ভীষন মজা।
সোহাগের আর সহ্য হয়না। উঠে গিয়ে কলার চেপে ধরে বাদলের। মুখের উপর মুখ নিয়ে বলে,
— ভীষন মজা? খুব লোভ না? শেষ করে ফেলবো একদম নজর দিলে। চোখ তুলে ফেলবো।
বাদল কলার ছাড়িয়ে নেয়।
— এই যা যা। বিশ্বাসঘাতক শালা। প্রতারক ।কথা দিয়ে কথা রাখস না। বলছিলি রিতীরে দিবি। শালা নিজেই খাইলি শুধু শুধু তোর পেছনে এতো দিন ঘুরছি। তোর কথা শুনছি। নয়তো কবেই ঐ রিতী আমাগো বিছানায় থাকত।
কথাটা শেষ হতেই সোহাগ ঘুষি মেরে দেয় নাক বরাবর। উল্টো পাল্টা আরো কয়টা লাথি দিতেই দুজনেই উল্টো সোহাগের গায়ে হাত তুলে। রেস্টুরেন্টে ছোটখাটো একটা মারামারি হয়ে যায়। সোহাগ চিল্লিয়ে বলে,
— শালা তোদের ভাই ভেবে আমি ভুল করছি। আমার পিরিতি তোদের ভাবী হয়। কুত্তা ভাবীর দিকে নজর দেস। চোখ তুলে ফেলমু একদম।
— ভাই বড় ধন আত্মার বাঁধন। যদি নষ্ট হয় নারীর কারণ। ঐ নারীর জন্য ই আজ আমাদের গায়ে হাত তুলছোস। তোর কির্তী কিভাবে শেষ করতে হয় আমার জানা আছে। বড়টারে রেখে এখন ছোটটারেও ধরছোস। বড়টা নয় তোর বউ। ছোটটা?
— আল্লার কসম লাগে আমার শালীর দিকে হাত বাড়াবিনা। বোনের চোখে দেখবি নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা।
— আর তুই কি বোনের লগে রঙ্গতামাশা করস!
— শালা কুত্তার বাচ্চা মুখ ছিঁড়ে ফেলবো তোর।
সোহাগ আবার এগিয়ে যেতেই সিকিউরিটি এসে সোহাগকে ধরে নিয়ে যায় অন্যত্র টানতে টানতে। রাগে দুঃখে সোহাগ বাড়ি ফেরেনা। এই রিতীর কারণে সব কিছু হয়ছে। রিতীকে সে কিছুতেই ছাড়বেনা।কিছুতেই না। বুকটা ভীষন জ্বলছে।। বারে বসে দুটো বোতল শেষ করে। তবুও বুকের জালা কমছে না। মদ ফেলে কার্ড খেলায় বসে। ঝোঁকের বসে লাখ টাকা বাজী ধরে একরাতেই কাবার করে। ভোরের দিকে সবাই চলে যায়। টেবিলে বসে সোহাগ গোঙাতে থাকে। ঘুম এসে হানা দেয় চোখে। ঠিক সে মুহূর্তেই বাবার কল আসে। না দেখেই কানে ধরে হ্যালো বলতেই রমিজউদ্দিন ধারালো গলায় চিৎকার করে বলে,
— এতো বড় সাহস তোমার আব্বা? আমাদের ‌না জানায়ে বিয়া করে বউ লুকাইয়া রাখছো। এখ্খন বাড়ি আসো। আজকে তোমার অপরাধের হিসাব নিকাশ করার পালা।

দেখতে দেখতেই উপন্যাসটি ৩০ পর্ব ক্রস করে ফেললো। আরো ৩০ পর্ব হবার আগেই শেষ হবে ইনশাআল্লাহ।গল্প পড়ার পর চুপি চুপি কেউ চলে যাবেন না। রেসপন্স অবশ্যই করবেন। যদিও আমি নিজেকে আনন্দ দেবার জন্যেই মূলত লেখালেখি শুরু করেছি তবে আমি যখন ঝিমিয়ে যাই আপনাদের সাপোর্ট ই আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণা যোগায়। এটা অস্বীকার করার সাধ্য আমার নেই। ধন্যবাদ সবাইকে।
চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা