বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২৫]
প্রভা আফরিন
_
শালুগঞ্জ
ঘুটঘুটে আঁধার জড়িয়ে রবিউল খন্দকার বসে আছেন চিত্রার ঘরে। বাইরে মানুষের আনাগোনায় এখনও পরিবেশ গমগমে। অথচ রবিউল খন্দকারের মনে হচ্ছে চারিদিক সুনসান। দূর থেকে দূর অবধি কোনো শব্দ নেই। নেই কোনো জনমানব। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, অনুভূতি সব যেন শূন্য। তবে এই শূন্যতার মাঝে ওনার ঘ্রাণশক্তি তীব্র হয়ে উঠেছে। বদ্ধ ঘরখানায় লম্বা শ্বাস টেনে তিনি একটি আপন সুবাস পাচ্ছেন। মায়ার সুবাস।
চিত্রার বিদায় হয়েছে ক্ষণকাল পূর্বে। যাওয়ার সময় সে আব্বা আব্বা বলে চিৎকার করে কেঁদেছে। বিপরীতে রবিউল খন্দকার সামান্য শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারেননি। মুখ ফুটে বলতে পারেননি হৃদয়ের মাঝে কতখানি মমতা পুষে রেখেছেন মেয়ের জন্য। শুধু মেয়ের মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন অল্প সময়ের জন্য। একফোঁটা চোখের জল কী গড়িয়েছিল! চিত্রা কী পেয়েছিল সেই উষ্ণতম জলের স্পর্শ। জুলেখা এখনও মেয়ের জন্য গুনগুনিয়ে কাঁদছে। রবিউল খন্দকারের আফসোস হয়। পুরুষরা মেয়েদের মতো সহজে কেন কাঁদতে পারে না? অনেক সময় না বলা অনুভূতি অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসে। অব্যক্ত কথাগুলো সহজে অনুমেয় হয়। হুট করে দূর থেকে আলো ভেসে এলো। ধীরে ধীরে দৃষ্টি স্পষ্ট হতে শুরু করছে। ঘোরগ্রস্ত চোখে রবিউল খন্দকার দেখলেন আলো নয়, ভেসে আসছে মায়া।
পালি হারিকেনখানা বিছানায় নামিয়ে রবিউল খন্দকারের পাশে বসল। তার গালে শুকনো জলের ছাপ। চুল এলোমেলো। বুবুর বিদায় বেলায় তার গলা জড়িয়ে কেঁদেছে সে। এক বছরে বুবুর সঙ্গে তার মানসিক সম্পর্কের দৃঢ়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। নানিকে যা বলা যায় না বুবুকে তা সে অনায়াসে বলে দিতে পারে। সেই বুবু আজ চলে গেল। তার জীবনে প্রিয় মানুষগুলো বড্ড বেশি অস্থায়ী।
পালি কী বলতে এসেছিল একদম ভুলে গেছে। সে চুপচাপ মামার পাশে বসে রইল। রবিউল খন্দকার নিঃশব্দে ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরলেন। খেয়াল করলেন ওনার সব অসার অনুভূতিরা জেগে উঠছে। আবারও মনটা ভরে উঠছে উষ্ণতায়। এ যে তার স্বপ্নে আসা সেই না হওয়া সন্তান। যাকে তিনি একদিন নিজের ভুলে পৃথিবী থেকে বিদায় দিয়েছিলেন। প্রকৃতি সেই ফাঁকা স্থান ভিন্নভাবে পূরণ করে দিয়েছেন।
____________
নিবাসপুর
রুপালি রাতের কোমল জ্যোৎস্নায় ভেসে সুসজ্জিত, আলোকিত বড়ো ট্রলারখানা স্রোতস্বিনী নদী পেরিয়ে সরু বিলে ঢুকে পড়ল। মোক্তার বাড়ির পেছনের ঘাটে নোঙর ফেলতেই চারিদিকে হৈ হৈ রব ভেসে উঠল। চিত্রা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ছইয়ের ভেতর বসে আছে। হাসনা ও হেনা তার দুপাশে এমনভাবে বসেছে যে সাম্য নতুন বউয়ের পাশে বসা দূর ঠিকমতো কথাও বলতে পারেনি। ঘাটে ট্রলার থামতেই হেনার স্বামী উজ্জ্বল বলে উঠল,
“এবার নতুন বউকে ছাড়ো তোমরা। তাকে নামতে দাও।”
হেনা স্বামীর কথায় মুখ বেঁকালো, “আমরা কী রাইতভর বউরে ধইরা বইয়া থাকমু কইছি?”
হাসনা ও হেনা সরে যেতেই সাম্য দ্রুতবেগে চিত্রার কাছে চলে এলো। সে এতই দ্রুত এলো যে চিত্রা নিজেও চমকে পেছনে হেলে গেছে। উজ্জ্বল শব্দ করে হেসে বলল,
“শা’লাবাবু, আরেকটু সবুর করো। এরপর পুরো রাতটাই তোমার।”
“তার পাশে বসে পুরো জীবনটাও যে কম, দুলাভাই।”
সাম্য সদ্য বিয়ে করা বউয়ের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসে। চিত্রার থুতনি বুকের সঙ্গে ঠেকে গেছে। নিচে থেকে কেউ চিৎকার করে বলে উঠল,
“আলাপ পরে কইরো। এহন বউ নিয়া নামো। বড়োরা বরণ করতে খাড়াইয়া রইছে।”
সাম্য যেন এমন কিছুই শুনতে বসে ছিল। দাত বের করে হাসি দিয়ে সকলের সামনেই স্ত্রীকে কোলে তুলে ছই থেকে বের হলো। চিত্রা আকস্মিক কান্ডে সাম্যের গলা জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু সাম্যের লাগামছাড়া হাসির সামনে সে চোখ বন্ধ করে নিল। ট্রলার থেকে নেমে ঘাটে উঠল তারা। চারিদিকে উৎসুক মানুষ সাম্যের কোলে থাকা রমনীকে উঁকিঝুকি দিয়ে দেখছে। কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে। বাড়ির সীমানায় ঢুকতেই হরেকরকম আলোর রোশনাই ছিটকে পড়ল তাদের গায়ে। পাশাপাশি দুটি দোতলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একটি দেখতে নতুন এবং অন্যটি পুরোনো। তবে সাজসজ্জা কোনোটারই কম নয়। সাম্য চিত্রাকে কোলে নিয়ে এগিয়ে গেল নতুন ভবনের দিকে। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন রাজিয়া ও বাড়ির সম্পূর্ণ মেয়েমহল। চিত্রাকে তাদের সামনে নামিয়ে দিয়ে সাম্য পাশে এসে দাঁড়ালো।
রাজিয়া সন্তুষ্ট চোখে পুত্রবধূকে দেখেন। ওনার ছেলের বউ তো এমনই হওয়ার কথা যার প্রশংসা লোকমুখে ঘুরে বেড়াবে। তিনি দুজনকে একত্রে দেখে চোখ জুড়িয়ে নেন। তার ছেলের মুখ থেকে আজ হাসি সরছেই না। চিত্রা শাড়ি-গয়নার ভারে ও ক্লান্তিতে নুইয়ে আছে। তা দেখে সাম্যের ফুপি শাহিদা মজা করে বললেন,
“মাইয়া দেহি শাড়ি গয়নার ওজনই সামলাইতে পারতাছে না। সংসারের ওজন কেমনে সামলাইব?”
“এই রাজিয়া যতদিন বাইচ্চা আছি আমার সংসারের ভার আমারই। বউয়ের কাম হইলো জামাইরে সংসারে ধইরা রাখা, বছর গেলে বংশের উত্তরসূরী দেওয়া। তা পারলেই হইব।”
চিত্রা শ্বাশুড়ির কথায় লজ্জা পেল ভীষণ। নাজনীন পেছন থেকে মিষ্টির থালা নিয়ে আয়েশি চালে এসে রাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বলল,
“দেখবেন আবার, ছেলেকে সংসারে বাধতে গিয়ে আঁচলে না বেধে ফেলে! তখন কিন্তু আপনাকেই সবচেয়ে বেশি কাঁদতে হবে।”
নাজনীন ঠোঁট টিপে হাসে। রাজিয়া মুখ শক্ত করে তাকান। উজ্জ্বল লাগেজসহ এগিয়ে এসে বলল,
“আগে নতুন বউকে ভেতরে নিয়ে যান। বেচারা দুটো আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?”
রাজিয়া পুত্রবধূকে মিষ্টিমুখ করিয়ে বরণ করে ঘরে তুললেন। তাকে প্রথমে নেওয়া হলো নিচতলার বিশাল দহলিজ ঘরে। এই ঘরখানা মূলত মোক্তারদের বৈঠক-সভার জন্য। তবে আজ দজলিজ ঘর গ্রামের মানুষে পরিপূর্ণ। সকলে নতুন বউ দেখতে এসেছে। চিত্রাকে প্রথমে দহলিজ ঘরে বসানো হলো। তখনই সে তলপেটে চিনচিনে একটি অনুভূতি টের পেল। সময় যত গড়ালো অস্বস্তি বাড়তে থাকল। কিন্তু সময় তো এখন নয়! চিত্রা মুখে জোর করে স্মিত হাসি টেনে সকলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলো। সকলকে ঠেলে সাম্য এক বয়স্ক মহিলাকে ধরে ধরে নিয়ে এসে দাঁড়ালো চিত্রার সামনে। বলল,
“বড়োবউ, এই তোমার সতিন। দেখো তো তোমার চেয়েও সুন্দর কিনা!”
রমিজা চোখের মোটা চশমাটি ভালোমতো ঠেলে দিয়ে চিত্রার মুখে হাত বুলিয়ে দেন। ভঙ্গুর গলায় বলেন,
“এমন সোনার টুকরা প্রতিপক্ষ আনছো দাদু। সংসার বুঝি ভাঙল আমার। বুড়া বয়সে আরেকবার জামাই ছাড়া হইলাম বুঝি।”
“না না, আমার মনে বিশাল জায়গা বুঝছো। শুধু দুই সতিন মিলেমিশে থাকলেই হবে।”
রমিজা সাম্যের কথায় ফোকলা হেসে চিত্রার পাশে বসলেন। তোবড়ানো গাল, কুচকানো চামড়ার বেটে মহিলাটিকে দেখে ও সাম্যের কথা শুনে চিত্রার বুঝতে অসুবিধা হয় না ইনিই তার দাদি শ্বাশুড়ি। চিত্রা ওনাকে সালাম করে। রমিজার পেছনে আরও একজন মহিলা এসেছে। সম্পর্কে তিনি সাম্যের মেজো চাচি ফিরোজা। তিনি চিত্রার হাত ধরে বললেন,
“ভালো আছো, মা?”
চিত্রা এই প্রথম এ বাড়ির কারো কন্ঠে কোমলতার ছোঁয়া পেল। সে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিতেই দোতলা থেকে হেনা ছুটে এলো। ফিরোজাকে জিজ্ঞেস করল,
“চাচি, রবিন ভাইজান আইলো না ক্যান?”
“কই কই ঘুইরা বেড়ায়, বাড়িত আইলেও বাপ-চাচাগো লগে ঘুরে। তার খবর কী আমি কইতারমু? তোর আব্বারে জিগাইলে হয়তো জানতে পারবি।”
সাম্য অভিমান করে বলল,
“তাই বলে বিয়েতে আসবে না? নাকি ছোটোভাই বড়োভাইয়ের আগে বিয়ে করায় লজ্জা পেয়েছে?”
“মোক্তার গুষ্টির পোলাগো আবার শরম! হাসাইস না বাপ। কম চেষ্টা তো করলাম না। এইবার ছুডুডারে সংসার করতে দেইক্ষা যদি এট্টু শরম হয়।”
চিত্রাকে দোতলায় নিয়ে যাওয়ার পথে বিপুল মোক্তারের সঙ্গে দেখা হলো। চিত্রা সালাম দিলে তিনি মাথা নেড়ে প্রস্থান করলেন। রাত তখন অনেকটা গড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে চিত্রার অস্বস্তি। রাজিয়া যখন হাসনা ও হেনাকে বললেন চিত্রাকে বাসর ঘরের জন্য তৈরি করতে তখন সে মুখ খুলল। হাসনার কানে কানে নিজের সমস্যার কথা জানাতেই মেয়েদের মুখ থমথমে হয়ে গেল। এতক্ষণের বয়ে চলা উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল। রমিজা তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। ওনাদের সময়ে মেয়েরা রজঃস্বলা হলে স্বামীদের থেকে বিছানা আলাদা করে ফেলা হতো। এখন অবশ্য সেসব রীতি কেউ মান্য করে না। কিন্তু নবদম্পতির প্রথম রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মান্য করা হবে বললেন রমিজা। তিনি বাসর ঘর স্থগিত করতে বললেন। তবে বউভাতসহ বাকিসব অনুষ্ঠান ঠিক থাকবে। সাতদিন পর বউ সুস্থ হলে পুনরায় আয়োজন করে বাসর ঘরের ব্যবস্থা করা হবে। রাজিয়া শ্বাশুড়ির কথায় একমত হতেই রমিজা সাম্যকে ডেকে পাঠালেন। তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সিদ্ধান্তের কথা জানালে সাম্য বেঁকে বসল। বলে উঠল,
“একঘরে থাকতে কী সমস্যা? আমার অর্ধাঙ্গিনী অর্থাৎ আমার অর্ধেক শরীর অসুস্থ হলে যদি তার সেবা করতে না পারি তাহলে আমি কিসের স্বামী?”
চিত্রার ইচ্ছে হয় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে। একটা মানুষ এতটা নির্লজ্জ হতে পারে! নাজনীন ঠেস দিয়ে বলল,
“মোক্তার গুষ্টির ছেলেদের এত খারাপ সময় এলো যে বউয়ের সেবা করতে হবে? বিয়ের রাত না পেরোতেই এই কথা?”
সাম্য বিরক্ত হয়ে বলল,
“সহজ বিষয় এত প্যাচাও কেন? অন্তত এই সময়টায় ওর সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হয়ে যাবে। আমাদের জড়তা কে’টে যাবে।”
রাজিয়া এসে সরাসরি চিত্রাকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কী চায়? চিত্রার এমনিতেই সবকিছু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার নিজেরও কিছুটা সময় প্রয়োজন। এই সুযোগে সে বলে দিলো দাদি শ্বাশুড়ির মতের ওপর তার কোনো দ্বিমত নেই। সাম্য ব্যথিত নজরে তাকায়। চিত্রা ভ্রুক্ষেপহীন। অবশেষে রমিজার কথাই রইল। চিত্রার ঘুমানোর ঘর ঠিক হলো হেনার ঘরে। হেনা নিজেই সে প্রস্তাব দিলো। তাদের সঙ্গে থাকবে হাসনার বড়ো মেয়ে তমা। সে কথা শুনে উজ্জ্বল রাগ করল বটে কিন্তু হেনার কাছে পাত্তা পেল না। উজ্জ্বল সাম্যের দলে যোগ দিয়ে বলল,
“আমাদের কপালে বউ নেই, ভাই।”
সাম্য ঘুমাতে যাওয়ার আগে আবার এলো চিত্রার কাছে। মুখ ফুলিয়ে বলল,
“তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে অন্যায় করলে, চিত্রা।”
“ন্যায় করতে চাই। কিন্তু আমার সময় দরকার।”
“নাও, কিন্তু সময় শেষে আমার বুকে ফিরতে হবে বলে দিলাম। নয়তো তুলে নিয়ে যাব।”
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২৬]
প্রভা আফরিন
_
ভোরের আলো ফোটার আগেই চিত্রাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন রাজিয়া। ঘুম জড়ানো চোখে চিত্রার প্রথমে ঠাহর করতে কষ্ট হলো সে কোথায় আছে৷ আবছা আলোয় শ্বাশুড়ির মুখ দেখেই সে ধড়ফড়িয়ে ওঠে। এলোমেলো আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দেয়। রাজিয়া মৃদু স্বরে বললেন,
“উইঠ্যা গোসল দেও। সূর্য ওঠার আগে চুলায় রান্ধা চড়াইতে হইব। আজকে সকালের খাওন তুমি রানবা।”
ঘুমন্ত তমাকে ডিঙিয়ে চিত্রা খাট থেকে নেমে গেল। হেনাও ততক্ষণে উঠে পড়েছে। সেই চিত্রাকে গোসলখানায় নিয়ে গেল। গোসল শেষে নতুন শাড়ি পড়ে হেনার সঙ্গে নিচতলার পাকের ঘরে গেল। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন রাজিয়া ও ফিরোজা। চিত্রা বিচলিত। রান্না সে পারে না এমন নয় তবে খুব যে ভালো হয় তাও নয়। চর্চা নেই কিনা! ফিরোজা চিত্রার মুখ দেখে বোধহয় আন্দাজ করতে পারলেন। বললেন,
“ডরাইয়ো না। বড়ো ঘরের মাইয়াগো যে রান্ধার অভ্যাস নাই তা আমরা জানি। আমগো বাড়ির মাইয়ারাও এমনেই বড়ো হইছে। কিছু ভুল হইলে দেখাইয়া দিমুনে।”
কথাটা চিত্রার ভালো লাগল। সে আলতো মাথা নাড়ে। তবে রাজিয়া কিছু বললেন না। তিনি কোচকানো ভ্রু নিয়ে পুরোটা সময় চিত্রাকে পর্যবেক্ষণ করে গেলেন। মাছ ভাজা, হাঁসের মাংস, সুগন্ধি চালের ভাত ও হালুয়া রান্না করতে করতে বাড়ির পরিবেশ গমগমে হয়ে উঠেছে। বাকিটা নিজেরা করে নেবে বলে চিত্রাকে ঘরে গিয়ে সেজেগুজে তৈরি হতে বললেন ফিরোজা। সকাল থেকেই বাইরের মানুষের আনাগোনা লেগে থাকবে। বউ দেখতে আসবে অনেকে। চিত্রাকে খাবার পরিবেশনের সময় ডাকা হবে আবার। ওর সঙ্গে দোতলায় এলো ফজিলা, এ বাড়ির কাজের লোক। হেনার ঘরে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল চিত্রা। ভেতর উজ্জ্বলের অসন্তুষ্ট কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে যেতে পারো না, হেনা।”
হেনা উত্তেজিত গলায় জবাব দিলো,
“দেহো, বিয়া বাড়িত ঝামেলা করবা না। আমার সিদ্ধান্ত বদলাইব না আগেই কইছি।”
হেনা ও উজ্জ্বলের মাঝে যে কোনো বিষয় নিয়ে দ্ব’ন্দ্ব বেধেছে বুঝতে অসুবিধা হয় না চিত্রার। সে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু তার আগেই দরজা ঠেলে উজ্জ্বল বেরিয়ে এলো। বোধহয় চিত্রাকে আশা করেনি সে। দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। উজ্জ্বল ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আরেহ, তোমাকেই তো খুঁজতে এসেছিলাম। সাম্য বলল তোমায় নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”
“রান্নাঘরে ছিলাম।”
উজ্জ্বল ঝুকে এসে দোতলতার সর্ব দক্ষিণের ঘরখানার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে বলল,
“পারলে একবার দেখা দিয়ে এসো। বেচারা ঘুম থেকে উঠে তোমায় না দেখে মুখ শুকিয়ে রেখেছে।”
হেনা ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। উজ্জ্বলও আর দাঁড়ালো না। চিত্রাকে ভ্রু কুচকে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফজিলা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল,
“কত রঙ্গ যে দেখবা নতুন বউ। দুইদিন পর পরই কাহিনি হয়।”
“কেন?”
“পুরুষ মানুষ বিলাই হইলে যা হয়। বড়ো বংশের মাইয়া দেইক্ষা বে’হা’ইয়াপনা মানতে হইব?”
“কী করেছে?”
“বাদ দেও হেগো কথা। হুদা হুদা মুখ খারাপ হইব। কেউ হুনলে আমার খবর আছে। তুমি কিন্তু কাউরে কইয়ো না বউ।”
“বলব না।”
“তুমি যাইবা সাম্য ভাইয়ের ঘরে? আমি বাইরে থাইকা পাহারা দিমুনে।”
চিত্রা অপ্রতিভ হলো। একপলক সেই দরজার দিকে তাকিয়ে গলা ঝেড়ে বলল,
“একটু পর খাবার পরিবেশন করতে ডাকবে। আমি বরং হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হই আগে।”
বড়ো খাবার টেবিলে মোক্তার বাড়ির ভেতরের প্রায় সব সদস্যই উপস্থিত। নাজমুল ও বিপুল মোক্তারের সাথে আজ নুরুল মোক্তার এবং শাহিদাও উপস্থিত। নাজমুল মোক্তারের আব্বা দুই বিয়ে করেছিলেন। পাশাপাশি দুটি বাড়ি মূলত তিনি দুই স্ত্রীর জন্যই বানিয়েছিলেন। নাজমুল মোক্তার ও বিপুল মোক্তার প্রথম পক্ষের সন্তান। শাহিদা এবং নুরুল মোক্তার দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ রমিজার সন্তান। এদের মধ্যে বিপুল সবার ছোটো। তার জন্মের সময়ই প্রথম স্ত্রী মা’রা যায়। রমিজাই তাকে মানুষ করেছেন। অবশ্য সৎ মা বলে নাজমুল বা বিপুল কখনো রমিজাকে অসম্মান করেনি। তাদের মা মা’রা গেলে বিপুলকে লালন করার সুবাদে দুই বাড়ির মানুষ একই ছাদের নিচে বসবাস শুরু করেছিল। বিপত্তি বাধলো যখন পুত্রবধূদের আগমন ঘটলো। শ্বাশুড়ি-বউদের ঝা’মেলা, হিং’সা, দ্ব’ন্দ্বে সব কেমন ছাড়া ছাড়া হয়ে গেল। আপন-সৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ফলে নুরুল মোক্তার মা আর বোনকে নিয়ে আবারও আলাদা হলো। তবে মোক্তারদের ভাইবোনে মিল-মহব্বত আছে বেশ। এমনকি ছেলে-মেয়েদের মাঝেও আপন পর বলে ভেদাভেদ নেই। কিন্তু এক বাড়িতে অনুষ্ঠান ছাড়া সকলে একত্রিত হয় না। আজ অনেক দিন পর সব ভাইবোন এক টেবিলে খেতে বসেছে। সঙ্গে বসেছে হাসনা, হেনা ও তাদের স্বামীরা। সকলকে দেখে রমিজার চোখ ভিজে যায়।
সাম্য গম্ভীর মুখে খেতে বসেছে। টেবিলে ভাত দেখে বলল,
“তিনবেলা ভাত খেতে ভাল্লাগে না।”
হাসনা বলল, “আইজ তোর বউ রানছে সবার লইগ্যা।”
সাম্য থতমত খেয়ে গেল। গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে মৃদুস্বরে বলল,
“মাঝে মাঝে খাওয়াই যায়।”
সে কথা শুনে উজ্জ্বল মুখে পানি নিয়ে ফিচ করে হেসে ফেলল। সাম্য চোখ ছোটো করে তাকালো। চিত্রা তখন সকলকে পরিবেশন করে তার দিকে এসেছে। ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হলো দুজনের। তাতেই সাম্যের অভিমান কর্পূরের মতো উবে গেল।
____________
দুপুর নাগাদ চিত্রাকে আরও একবার ভারী সাজে সাজতে হলো। আজ তার বউভাত, সেই সঙ্গে নাইওর। বাপের বাড়ির মানুষ ওকে নিতে আসবে। চিত্রা উদগ্রীব হয়ে আছে তাদের জন্য। এমন সময় সাম্য ঘরে ঢুকে সবাইকে বের করে দিলো। চিত্রার পাশে বসে তাকে নিবিড় চোখে দেখে বলল,
“মাশাআল্লাহ, লম্বা ঘোমটা টেনে রাখো তো। নজর না লাগে।”
“এমন কেন করলেন?”
“কী করলাম?”
“ওরা কী ভাববে?”
“ভাবতে দাও যা খুশি। তুমি আগে আমার অধিকার পরে বাকিদের। অথচ একের পর এক আচার-অনুষ্ঠানের নামে আমাকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে! তুমিও যে ওদের সঙ্গ দিচ্ছো বেশ বুঝতে পারছি।”
চিত্রা কী বলবে ভেবে পায় না। লোকটার সপ্রতিভ আচরণ তাকে বারবার অতীতে নিজের করা আচরণগুলো মনে করিয়ে দেয়। সেই বেপরোয়া চিত্রা আর এই চিত্রার মাঝে এখন বিস্তর ফারাক। তাই হয়তো সাম্যের অনুভূতি সে খুব ভালো বুঝতে পারে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে মন থেকে সাড়া আসে না।
খানিক বাদেই খন্দকারদের ট্রলার এসে থামল মোক্তার বাড়ির পেছনে। নেহাৎ কম সংখ্যার আত্মীয় আসেনি তাদের তরফ থেকে। মেহেরুন বানু ঘাটে নেমে পালিকে আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন,
“আমার কাছ ছাড়া হবি না। লগে লগে থাকবি কইলাম। কেউ ডাকলে যাবি না।”
“আচ্ছা।”
পালি অবশ্য সে কথা ভুলে গেল খানিক বাদেই। চিত্রাকে দেখে পালি বুবু বলে ছুটে গেল। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল,
“ও বুবু, তোমাকে অনেক মনে পড়েছে আমার।”
“বুবুরও তোকে খুব মনে পড়েছে রে।”
নাজনীন এলো সবার পরে। তার সাজসজ্জা নতুন বউয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সম্পর্কে চাচি হলেও বয়সে সে হাসনার সমান। দেখতেও বেশ সুন্দরী। এ নিয়ে দাম্ভিকতাও আছে বেশ। পালিকে দেখেই সে ভ্রু কুচকালো। চিত্রাকে জিজ্ঞেস করল,
“ও কে? বুবু বলে ডাকল যে?”
“আমার ফুপির মেয়ে আম্রপালি।”
নাজনীনের দৃষ্টি সরু হলো। অনেকটা সময় চুপ থেকে খুটিয়ে খুটিয়ে পালিকে দেখল। ঘরভর্তি মানুষের সামনে হঠাৎ বলে উঠল,
“ও কী নিগম সেনের মেয়ে?”
মুহূর্তেই কয়েক জোড়া চোখ বি’স্ফো’রিত চোখে তাকালো। পালি নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়েছে। নিগম নামটা সে আগেও শুনেছে। মেহেরুন বানু এগিয়ে এসে পালিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললেন,
“ওর বাপের নাম মহসিন। মায়ের নাম করবী। এই দুইজন ছাড়া দুনিয়ার কারো সাথে তার রক্তের সম্পর্ক নাই।”
বিপুল মোক্তার সবে দরজায় পা রেখেছিল। কথাগুলো শুনে সে আর ভেতরে গেল না। মেহেরুন বানু নাজনীনের দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আবার বললেন,
“ওর কথা বাদ দেও। তা তোমার কয়খান পোলাপাইন?”
খো’চাটা ঠিক জায়গায় গিয়ে লাগল যেন। নাজনীনের মুখটা অপমানে থমথমে হয়ে গেল। মেহেরুন বানু পালিকে টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ধমকে বললেন,
“তরে কইছিলাম না আমার কাছ থাইকা সরবি না? আইজ থাইকা তর বেড়ানি বন্ধ।”
চলবে…
বিষাদনীড়ে মায়াতরী [২৭]
প্রভা আফরিন
_
শালুগঞ্জ
চিত্রা একাই বাপের বাড়ি নাইওর এসেছে। সাম্যের আসা আটকে দিয়েছে রাজিয়া। তবে সাম্য তাতে শান্ত হলো না। পরেরদিন বিকেলে চিত্রা যখন সবে পুকুরপাড়ে পা বিছিয়ে বসেছে সাম্য এসে হাজির হলো শ্বশুর বাড়ি। জুলেখা ব্যস্ত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে এনামকে হাটে পাঠালো। সাম্য বলল,
“ব্যস্ত হবেন না, আম্মা। আছি একদিন। রয়েসয়ে জামাই আদর করবেন।”
চিত্রা ভীষণ বিরক্ত হলো সাম্যের আগমণে। তার কপালে ফুটে ওঠা ক্ষীণ ভাজে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। জুলেখা চলে যেতে সে বলল,
“আম্মা জানে, আপনি যে এখানে?”
“না জানলে কী আমায় তাড়িয়ে দেবে?”
“তা করব কেন?”
“দিলেই বুঝি আমি যাচ্ছি! চিন্তা কোরো না, আম্মা জেনে গেছে এতক্ষণে।”
চিত্রা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো।
“মানে না জানিয়েই বেরিয়েছিলেন?”
“কী করব বলো? সামনের এই নারীকে না দেখলে যে মন বে’হায়া বড়োই উতলা হয়ে যায়।”
চিত্রা কোনো কথা বলল না। উত্তর দেওয়া মানে লাগামছাড়া জিভটাকে উশকে দেওয়া। সাম্য আলতো করে তার হাত মুঠোয় পুরে নিল। চিত্রা চমকে দরজার দিকে তাকায়।
“সত্যি করে বলোতো, কাল থেকে আমায় মনে পড়েছে তোমার?”
চিত্রা স্থির হয়ে ভাবল, মনে পড়েছে কী? সাম্য নরম গলায় আবার বলে,
“একটুও মনে পড়েনি?
চিত্রা অন্যভাবে উত্তর দিলো,
“ভুলিনি, কাজেই মনে পড়ার প্রশ্ন ওঠে না।”
চিত্রা হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে যায়। অন্যদিকে তার ছোট্ট একটি বাক্যে সাম্যের গ্রীষ্মছায়া হৃদয়ে বসন্তের হাওয়া দিয়ে গেল।
উত্তপ্ত দিনের শেষে টুপ করে সূর্যটা ডুবতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। এনাম উঠানে বসে চারটে হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে নিয়ে, হারিকেনে কেরোসিন ভরে আ’গুন জ্বা’লালো। একটা গেল রান্নাঘরে, একটা রবিউল খন্দকারের ঘরে, একটা চিত্রার ঘরে এবং আরেকটা গিয়েছে হিমাদের ঘরে। বিয়ের উৎসবে পালির পড়াশোনা নেই বেশ কয়েকদিন যাবত। সে উঠানে পাটি বিছিয়ে, চামেলির কাছ থেকে কুপিয়ে ধরিয়ে এনে এনামকে ধরে বলল,
“এনাম মামা, গল্প শোনান।”
“কিয়ের গল্প হুনবা?”
“ভূতের। দাঁড়ান বুবুকে ডেকে আনি।”
এনাম আটকানোর আগেই পালি ছুটে ভেতরে চলে গেল। চিত্রার সঙ্গে সাম্যও এলো। পাটির মাঝখানে কুপি রেখে সকলে গোল হয়ে বসল তাতে। চিত্রা নিজের ও সাম্যের মাঝে ইচ্ছে করেই পালিকে বসালো। হিমাদ বেরিয়ে এসেছে কিন্তু পাটিতে না বসে দাওয়ায় বসল। মেঘলা বরণ আকাশে আজ চাঁদ নেই। চারিদিক ঘুটঘুটে আঁধারে ডুবে আছে যেন। বাতাসবিহীন গুমোট পরিবেশে কুপির শিখা অবিচল। তাদের আড্ডা জমজমাট করতে মেহেরুন বানু গামলায় করে মুড়িমাখা দিয়ে গেলেন। এনাম আলাদা করে কিছু মুড়ি তার লুঙ্গিতে নিয়ে গালভরে চিবোতে চিবোতে গল্প বলতে শুরু করে,
“ছুডুকালে আমার ফলপাকড়ার দিকে ঝোক আছিলো মেলা। আমের দিন আইলে আম্মায় আমারে ঘরেই রাখতে পারত না। খালি চিন্তা করতাম বেহানবেলা হগলের আগে গিয়া সব আম টোকাইয়া আনমু। কার আগে কেডা আমটোকা যাইব এইডার প্রতিযোগিতা চলতো আমাগো মাঝে। এমনও রাইত গেছে না ঘুমাইয়া চাইয়া থাকতাম কহন ফজরের আযান দিবো। আম্মায় কইতো আযান দিলে নাকি জ্বীন-ভূত বান্ধা পড়ে। হের লইগ্যা আযানের আগে বাইর হওনের সাহস পাইতাম না। তো একবার করলাম ভুল। ঘুম ভাইঙ্গা জানালা দিয়া বাইরে চাইয়া দেহি আন্ধার ফকফকা। ভাবলাম আযান বুঝি দিয়া ফালাইছে। সবার আগে আমটোকা না গেলে কপালে আম জুটব না। হেই লোভে আম্মারে না জানাইয়া চুপে চুপে দরজার বেড়া সরাইয়া গেলাম বাইর হইয়া। কয়েক যায়গায় আম টোকাইতে টোকাইতে দেহি চাইরধার তহনো ফরসা হয় নাই। সুযোগ পাইয়া চইলা গেলাম ঘোষপাড়া। মিত্তির বাড়ির আমগাছের আম কড়া মিষ্টি আছিলো। ভাগে পাওন যাইতো না। হেদিন গিয়া আমও পাইলাম মেলা। আতকা মিত্তির বুড়ি কইয়া উঠল, ‘কিরে ছেড়া, বেহান না হইতেই আইয়া পড়ছোত? যা ভাগ এহানতে।’
আমি ডরে দিলাম দৌড়। বাড়িত ঢুকতেই আম্মায় দিলো এক ধমক। ফজরের আযান না দিতেই কিয়া বাইরে গেলাম হের লইগ্যা পিডে দুম্মুর দুম্মুর কয়ডা লাগাইয়া দিলো। চোক্ষের ভুল হইলো নাকি! বাইরে চাইয়া দেহি জোছনায় ভ্রম হইছিলো। হেদিন পূর্ণিমা আছিলো দেইক্ষা আঁতকা ঘুমের চোক্ষে ভাবছিলাম ভোর হইয়া গেছে। ঠিক তহন আমার মাথায় আইলো মিত্তির বুড়ি তো আরও বছরখানিক আগেই ম’ইরা গেছে!”
এনাম থামতেই দেখল পালি গুটিয়ে গেছে। হাটু বুকের সঙ্গে বেধে নতজানু হয়ে আছে সে। ছমছমে আঁধারে এই বুঝি মিত্তির বুড়ি চলে এলো। এনাম এবার আগের চেয়েও ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
“হেই আমগাছ এহনো আছে। আমের দিনে অনেকে নাকি মাঝরাইতে হেই পথ দিয়া গেলে মিত্তির বুড়িরে গাছে বইয়া আম খাইতে দেহে।”
এমন সময় দমকা একটি হাওয়া দিয়ে কুপি নিভে গেল। পালি ভয়ে মৃদু চিৎ’কার দিয়ে চিত্রার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। ঠিক তখনই সে টের পেল তার পিঠের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে কিছু একটা হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ‘চকাস’ মতো অতি ক্ষীণ একটি শব্দ হয়ে দমকা হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেল। ঠিক তার পর পরই চিত্রা কেঁপে উঠে পালিকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল। আড্ডা সেখানেই ভাঙল। রাতে ঘুমানোর সময় চিত্রা সাম্যকে নিজের ঘরে বিছানা করে দিয়ে নিজে চলে এলো দাদির ঘরে। আসার সময় সাম্যের চোখজোড়া এবারও খানিক ব্যথিত ছিল। কিন্তু চিত্রা ঘুমের কবলে বেশিকিছু ভাবতে পারল না। বিছানায় পড়া মাত্রই ঘুমে তলিয়ে গেল।
এদিকে এনামের গল্প শুনে পালির চোখে ঘুম নেই। সে নানিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আঁধারের মাঝে কেউ ছুটে এলো তার দিকে। যেদিকে তাকায় সেদিকেই মস্তিষ্ক আবছা কিছুর অবয়ব বানিয়ে ফেলছে। পালি চোখ বুজে নেয়। নানান কিছু ভাবতে ভাবতে হুট করে জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা নানি, তুমি কোনোদিন আমাদের বাড়িতে যাওনি কেন? আমি তো এখানে আসার আগে কোনোদিন তোমায় দেখিনি।”
মেহেরুন বানু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তর মায় চায় নাই।”
“কেন?”
“তার অভিমান বেশি। সেই অভিমানের কবলে যে একবার পড়ব জীবনেও মুক্তি পাইব না। আমিও তার কবলে পড়ছি।”
“মা তোমার ওপর অভিমান করেছে কেন?”
মেহেরুন বানু ক্ষীণ শব্দে ধমক দিলেন,
“এত প্রশ্ন ভালা না। ঘুমা এইবার। অনেক হইছে ফাঁ’কিবাজি। কাইল থাইকা ফজরে উইঠ্যা মক্তবে যাবি।”
ভোরের নরম কোমল বাতাসে পালি মক্তবে গিয়েছিলো। ফিরল সূর্য ওঠার পর। তার হাতে একটি কাঠের রেহাল, তার ভেতর আমপারা। সুতি একটি ওড়না হিজাবের মতো পেচিয়ে পরায় কোমর অবধি ঢাকা। মক্তবে অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উচ্চস্বরে আরবি পড়েছে বলে তার গলায় এখন জোর নেই। পালি সড়ক ধরে ফেরার পথে একটি হাঁসের দলকে হেলেদুলে পুকুরে দিকে যেতে দেখে। সে-ও মনের খেয়ালে তাদের পেছনে পেছনে হাটার ভঙ্গি নকল করার চেষ্টা করে হেলেদুলে এগিয়ে যায়। মুখ দিয়ে নিজে শুনতে পাবে এমন আওয়াজে ‘প্যাক’ ‘প্যাক’ করতে থাকে। বাড়ির সামনে গিয়ে পালি হকচকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। হিমাদ আজব কিছু দেখছে এমন ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পালি মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল। মক্তবের হুজুর বলে দিয়েছে প্রতিদিন বাড়িতে ঢুকতে যাকে আগে পাবে তাকে যেন সালাম দেয়। সেই কথা মাথায় আসতেই পালি গেইট দিয়ে ঢোকার সময় অনভ্যাসে ইতস্তত করে নিচু গলায় হিমাদকে সালাম দিলো। হিমাদ সালাম নিল কিনা বোঝা গেল না। তবে সে বিড়বিড় করে বলল,
“হাঁসের ছাও।”
পালি বোকার মতো হিমাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সালামের উত্তরে কেউ হাঁসের ছাও বলে! হিমাদ ভাই নিশ্চয়ই তাকে ব্যঙ্গ করল। সে কথা ভাবতেই ওর মুখটা গোমড়া হয়ে গেল।
চলবে…