বিষাদনীড়ে মায়াতরী পর্ব-৪৯ এবং শেষ পর্ব

0
490

বিষাদনীড়ে মায়াতরী [শেষপর্ব]
প্রভা আফরিন
_

খিলানচর

মহসিনের বয়স তখন সবে একুশ। রুগ্ন দেহের ছন্নছাড়া তরুণটি কাজের সন্ধানে এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। পেটের দায়ে যেখানে যেমন কাজ পায় তাই করে। দিনশেষে তার কাছে ভরা পেটে নিদ্রাযাপন মানেই সুখ। কাজের সন্ধানে সে চর ছেড়ে পা বাড়িয়েছিল দূরের পথে। নিবাসপুর গ্রামের পর রেলস্টেশন। তার গন্তব্য সেখানেই হওয়ার কথা ছিল। শুনেছে স্টেশনের আশেপাশে মিল-ফ্যাক্টরি গড়ে উঠছে। রিযিকদাতা সহায় হলে সেখানে একটা ব্যবস্থা হয়েও যেতে পারে। কিন্তু ভাগ্যের ওপর ভেসে বেড়ানো যুবকের তরীটি ভিড়ল শালুগঞ্জে। খন্দকার বাড়ির অভিমুখে এসেই তার ভাবনার বিচ্যুতি ঘটল। খন্দকার বাড়ির রেলিংবিহীন খোলা ছাদ তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। সেই প্রথম মহসিন মন থেকে উপলব্ধি করল খাওয়া-ঘুমের বাইরেও জগতে আরো সুখ আছে। সুখে থাকা কেবল এক দেহের খোরাক যোগানোতেই সীমাবদ্ধ নয়। তাতে মনেরও সমান ভাগ আছে। অবশ্য সুখের প্রকৃত ব্যাখ্যা স্বয়ং সুখী মানুষটাও পরিপূর্ণ রূপে দিতে জানে না। সেখানে মহসিনের জীবিকা কেন্দ্রিক ছন্নছাড়া জীবন তো অনেকাংশেই সুখের পরিধি সম্পর্কে অজ্ঞাত। প্রথম বুঝি জ্ঞাত হলো করবী নামক সম্মোহনীর দর্শন পেয়ে।

মহসিনের আর রেলস্টেশন যাওয়া হলো না। শালুগঞ্জকে কেন্দ্র করেই জীবিকার সন্ধানে লেগে গেল সে। কিন্তু কাজ মিলল না। অচেনা গাঁয়ের ছেলেকে কোনো প্রকার সুপারিশ ছাড়া কোন ভরসায় কাজে নেবে তারা? মহসিনের দিনাতিপাত কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। আশ্রয়হীনতায় ঘুরেফিরে অবশেষে এক পাটের আড়তদারের কাছে তিনবেলা খাওয়া-পড়ার বিনিময়ে কাজ পেল সে। সেই থেকে খন্দকার বাড়ির আশেপাশে তার আনাগোনা। বুদ্ধিমতি করবীর নারী চক্ষুর সামনে ধরাও পড়ে গেল অনায়াসে। করবী যে কোনোদিন তার সঙ্গে কথা বলবে তার ভাবনাতেও ঠাঁই পায়নি। অথচ তাই হয়েছিল। হুট করে সামনে এসে মেয়েটি তাকে পুরোদস্তুর চমকে দিলো। মেয়েটির অদ্ভুত কথায় ভড়কে গিয়ে মহসিন সেদিন কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিল। এরপর ধরা পড়ার ভয়ে তার সামনে যাওয়ার সাহস করেনি অনেকদিন।

এরপর সকল সংশয়কে পাশ কাটিয়ে যেদিন হৃদয়ের রো’ষান’লে পু’ড়ে ছুটে গেল, করবী তার শূন্য হাতটি জন্মের মতো আঁকড়ে ধরল। তাকে পাশে নিয়ে ভয়-ডরহীন, একরোখা মেয়েটি পরিবারের সামনে বিয়ের প্রস্তাব নয়, হু’ম’কি দিলো। ভীতস’ন্ত্র’স্ত, কাঙাল মহসিন সেদিন বিনা যু’দ্ধে এক রাজকন্যা পেয়ে বসেছিল। মনে মনে নিজেকে রাজা ভাবতেও কার্পণ্য করেনি। তবে সে কোনোদিন করবীকে জিজ্ঞেস করেনি করবী তার অঢেল সুখের জীবন ছেড়ে কেন তাকে বিয়ে করল, কেন বেছে নিলো অভাবে জর্জরিত শীর্ণ একটি জীবন? বরং সে রাজকন্যাকে ভালো রাখতে, নিজের দীনতা মেটাতে তখন দিশেহারা প্রায়। একলা চরে করবীকে রেখে তাকে ছুটতে হয়েছিল কাজের সন্ধানে। রেলস্টেশনে বাদাম, ছোলা, চানাচুর বিক্রি করেছে। সপ্তাহ শেষে বাড়ি ফেরার সময় একগাদা সংবাদপত্র নিয়ে আসত, করবী তা একবার করে পড়ে নিয়ে, কে’টে ঠোঙা বানিয়ে দিতো।

সেই সংসারে বছর ঘুরতে মেয়ের জন্ম হলো। সংসারের টানাটানি বেড়ে গেল। সপ্তাহের বদলে পনেরো দিন পর পর মহসিনের বাড়ি ফেরা নির্ধারিত হয়ে গেল। মহসিন প্রথম প্রথম করবীকে রেখে থাকতে পারতো না। কোনোদিন করবী ঘুম ভেঙে দরজা খুলতেই দেখত মহসিন দাঁড়িয়ে আছে, কোনোদিন বা রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর ডাকাতের মতো হানা দিতো। রাতভর আবারো রান্নার আয়োজন করতে হতো। মায়ের পাশে বসে বাবা-মেয়েরও চোখে ঘুম নামতো না। চাঁদ-তারা খচিত বিস্তৃত আকাশের নিচে বসে, মেয়েকে পায়ের ওপর শুইয়ে, পা নাচাতে নাচাতে মহসিন ছড়া কা’টতো,
আয় আয় চাঁদ মামা
টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালের চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।

বলেই চাঁদের দিক থেকে হাত ফিরিয়ে মেয়ের কপালের ছুঁইয়ে দিতো। সদ্য দুধের দাঁত ওঠা পালি মাড়ি বের করে হাসতো। জ্যোৎস্নার ধবল আলোয় সেই হাসি দেখে মহসিনের হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠত। ফিরে যাওয়ার পর আবারো মহসিনের দিন কাটত অনিশ্চয়তায়। যদি তার অনুপস্থিতিতে করবীর কোনো বিপদ হয়, সে যদি কোনো ঝামেলায় পড়ে? মেয়েটা যদি হুটহাট কোনো রোগ বাধায়? সে চিন্তায় মহসিন স্থির হতে পারত না। তবে সময়ই তাকে স্থির করে দিলো৷ সংসারের চাপে হৃদয়বিলাস আর হয়ে ওঠে না। মেয়ে বড়ো হচ্ছে, তার খরচ বেড়েছে। বিদ্যালয়ে যায়, খরচ আরেকদফা বেড়ে গেল। এমন করে অনেকদিন দুজনের মনের ঠিকঠাক যত্ন নেওয়া হয়ে উঠল না। করবী মেয়েকে মানুষ করতে লাগল আর মহসিন অর্থের খোঁজে। কিন্তু কে জানতো? প্রমত্ত নদীর বুকে একটি হৃদয় অধীর অপেক্ষায় গুম’রে ম’রে!

করবী দ্বিতীয়বার সন্তান সম্ভবা হলে মহসিন তার পরিশ্রম আগের চেয়েও বাড়িয়ে দিলো। ছেলেটি জন্মালে খরচ বাড়বে, সেই চিন্তায় স্থির হতে পারল না। যখন টাকা গুছিয়ে স্থির হতে চাইলো, পড়ল ডাকাতের কবলে। সব খুইয়ে শূন্য হাতে পরিবারের সামনে দাঁড়ানোর স্পর্ধাটুকু সে করতে পারল না। মেয়েটা প্রতিবার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার জন্য কি এনেছে দেখতে উদগ্রীব হয়। মলিন মুখটা সহ্য করবে কি করে? মহসিন আবারো ফিরে গেল। কিছু টাকা হাতে আসতেই একগাদা বাজার, মেয়ের জন্য খাতা-কলম, অনাগত সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে তা না জেনেই সে নতুন একজোড়া ফতুয়া, নতুন তোয়ালে কিনে ফিরল। কিন্তু সেই ফেরাই যে তার চূড়ান্ত ফেরা হতে চলেছে তা বোধহয় বিধাতা ছাড়াও আরো একজন আন্দাজ করতে পেরেছিল।

মায়ের অবস্থা দেখে পালি যখন আব্বার প্রতিক্ষায় পথ চেয়ে থাকত, করবী বলতো, ‘তোর আব্বা না আসুক। না আসুক সে।’ এই বারনের পেছনের কারণ পালি জানত না। মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে করবী একমনে চেয়েছে মহসিন না আসুক। এতদিন যখন হলো না শেষ সময়ে আর দেখা না হোক। তার বিদায় সইতে পারার মতো সক্ষমতা, শোক হজমের মতো সহনশীলতা মহসিনের মতো কোমল হৃদয়ের অধিকারী লোকটির নেই। অথচ তাই হলো। মেয়ের অনিশ্চিত জীবন, ভাইজানের প্রতিক্ষা ও ভাগ্যের প্রতি তীব্র অভিমানে মানুষটা যখন ইহজীবনের শেষ প্রান্তে, মহসিন এসে হাজির হলো। করবী তার কোলে মাথা রেখে নিজের আক্ষেপটুকু লুকায়নি। এই জীবনে সে অর্থ, স্বচ্ছলতার চেয়েও যা চেয়েছে তা হলো স্বামীর সান্নিধ্য। অথচ বড়ো ঘরের মেয়েকে নিজের কুঁড়েঘরে ঠাঁই দেওয়ার হীনমন্যতায়, করবীকে সুখী করতে, তার অভাব মেটাতে গিয়ে মহসিন সেই সময়টাই ঠিকমতো দিয়ে উঠতে পারেনি। মহসিনের প্রতিও তার তীব্র অভিমান জমে ছিল বুকের ভেতর। করবীর অন্তিম শ্বাস মহসিনের দেহে ধাক্কা দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করেছিল। সেই অভিমানে ঠাসা নিঃশ্বাসের ধাক্কা মহসিন সইতে পারেনি। আজও পারেনি। করবীর অভিমান মেটাতে সে আর তাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি।

খিলানচরের ঘোলা পানিতে আবদ্ধ হয়ে আষাঢ়ি কন্যাটি সপ্তদশীর ঘরে পদার্পণ করেছে। চারিদিকে থৈথৈ জলরাশি। কোনটা নদী আর কোনটা বাসভূমি তা বোঝার উপায় মাত্র নেই। স্রোতের ধাক্কায় ভেঙে গিয়েছে ঘরের নড়বড়ে বেড়া। চৌকিটাও পানির তলায়। হামিদ চাচার থেকে চেয়ে নেওয়া ছোটো নৌকাটিতে পালির ঠাঁই মিলেছে। বন্যায় আবদ্ধ জীবনের আজ বিশ দিন পেরোলো। এমন দীর্ঘ বন্যা সে তার জীবনে কখনো দেখেনি। খুটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘরের মরচে ধরা চালের সঙ্গে ভাসমান পালিদের নৌকাটি দাঁড়িয়ে আছে। খাওয়া, ঘুম সব নৌকার মধ্যেই। খাবার পানি নেই, স্যানিটেশন তো বিলাসিতা। পালির হাত-পায়ে ঘা হয়েছে। খুবই যন্ত্রণা করে। এরই মাঝে মানসিক ভারসাম্যহীন আব্বাকে নিয়ে তার অবস্থা দিশেহারা প্রায়। সারাদিন করবী করবী করে চিৎকার করে মহসিনের গলা ভেঙে গিয়েছে। পানিতে নেমে পড়তে কি যে প্রচেষ্টা! পালি হাউমাউ করে কেঁদে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। মহসিন যেন মেয়েকেও আর চেনেন না। বন্যার পানি বুক সমান উঠে আসা অবধি মহসিন করবীর কবরের পাশে থেকেছে। পানি এখন মাথার ওপর দিয়ে বইছে। মহসিন বারবার ছুটে যেতে চাইছে পানির নিচে ডুবে থাকা কবরের কাছে। খুদিবু নানান বুঝ দিয়ে তাকে নৌকায় বসিয়ে রেখেছে।

সন্ধ্যা নেমেছে সবে। চারিধার সুনসান। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কাঁঠাল গাছের পাতাগুলোর গায়ে আঁধার মেখে তা আরো কালো দেখাচ্ছে। গাছটা পালি জন্মের পর থেকে দেখছে। তার সমস্ত শৈশবের সাক্ষী গাছটি। তার মায়ের কবরের প্রহরী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার ডালে আশ্রয় নিয়েছে অসহায়, দলছুট একজোড়া শালিক। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি ভেজা গা ঝাড়া দিচ্ছে। বিকেলের পর বৃষ্টি থেমেছে। যতবার বৃষ্টি নামে ততবারই চরের ভাসমান প্রতিটি পরিবার উদগ্রীব, উৎকণ্ঠায় থাকে। সেদিন পানিতে পড়ে পূবের ঘরের বাচ্চা মেয়েটি মা’রা গেল। দুদিন যাবত বাচ্চাটির মায়ের আহাজারিতে পুরো খিলানচর মগ্ন ছিল। প্রতিদিনই কোনো কুকুর, বিড়াল বা অন্য কোনো প্রাণীর মৃ’তদেহ পানিতে ভেসে আসছে, আবার চলেও যাচ্ছে। শুধু রেখে যাচ্ছে ভয়, অজানা ভবিষ্যতের শঙ্কা। এমন বন্যা এই চরের মানুষ শেষ দেখতে পেয়েছে দশ বছর আগে, ১৯৮৮ সালে। পালির সেই বন্যার কথা তেমন মনে নেই। কারণ তখন মা ছিল। মা তাকে আগলে রেখেছিল। এবার মা নেই। তার হাতে-পায়ে ঘা হয়েছে, রাত বাড়লে যন্ত্রণায় দু-চোখের পাতা এক হতে চায় না। বৃষ্টি নামলে বড়ো গামলাটি মাথার ওপর ধরে রাখে। তাতেও শরীর ভিজে যায়। ঠান্ডা গলায় বসে গিয়েছে। অথচ যত্ন নেওয়ার জন্য কেউ নেই। এখন তাকে তার আব্বাকে দেখে রাখতে হচ্ছে। ছোটো নৌকায় তিনজন মানুষ তারা। খুদিবু, মহসিন ও পালি। রান্না হচ্ছে না দুদিন ধরে। শুকনো চিড়ামুড়ি খেয়ে দিন পেরোচ্ছিল। তাও শেষ। আজকে খিদে পেটে রয়েছে। কালকের দিনটি কীভাবে কাটবে পালি জানে না। এরই মাঝে মহসিন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পালির ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে আব্বার নিউমোনিয়া হয়েছে। রোগটির ব্যাপারে সে বইতে পড়েছিল। যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে এই মুহূর্তে নিষ্ঠিরতম সত্যি হলো চিকিৎসার কোনো উপায় নেই। টালিপাড়া এখান থেকে ঘন্টা দুয়েকের পথ। সেই গ্রামও ডুবে গেছে। পালিদের স্কুলের বিল্ডিং নাকি ভেঙে গিয়েছে। হতদরিদ্র এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র বলতে এখন কিছু নেই। চিকিৎসা কোথায় পাবে? থৈ থৈ পানির মাঝে পথ ঠাহর করে যাওয়ার উপায় নেই। স্রোত যেদিকে ভাসিয়ে নেবে সেদিকেই চলে যেতে হবে। কিন্তু তাও যে অসম্ভব! পালি অসহায় দৃষ্টিতে রুগ্ন গাত্রের আব্বার দিকে চেয়ে থাকে। চামড়া যেন বুকের খাঁচায় এঁটে বসেছে। পালির মন হুহু করে কেঁদে ওঠে।

মহসিন হাটু জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। নিঃশ্বাসের সাথে মৃদু বুক ওঠানামা ব্যতীত সামান্যতম নড়াচড়া তিনি করছেন না। উনার স্থির দৃষ্টি আঁধারঘেরা পানির দিকে। কি ভাবছেন কে জানে? পালির খুব ইচ্ছে হলো আব্বার মুখখানা দেখতে। কিন্তু কেরোসিন বা কুপি কোনোটাই তাদের কাছে নেই। পানিতে ভেসে গিয়েছে। সে ভাঙা গলায় ডাকল,
“আব্বা?”

মহসিন তাকালেন না। একইভাবে বসে আছেন। পালি একটু সরে এলো। সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটি দুলে উঠল। আব্বার বাহুতে হাত রেখে বলল,
“আব্বা? আমার সঙ্গে কথা বলবেন না?”
“যাহ যাহ, এইহানে ক্যান আইছোস তুই?”
পালিকে দু-হাতে সরিয়ে দিলেন তিনি। পালি ঠোঁট কামড়ে কান্না গিলতে চেষ্টা করে।
“আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না আব্বা? আমার দিকে তাকান, আমার চোখের দিকে তাকান একবার। আপনার মেয়েকে একটুও চিনতে পারছেন না?”
“মহসিন এবার রেগে গেলেন,
“সর সর। আমার কাছ থাইকা দূরে যাহ।”
খানিক বাদেই তিনি আবারো করবী করবী বলে ডাকতে লাগলেন। সেই ফ্যাসফ্যাসে ডাক যেন গহীন অরণ্যের ভেসে আসা আ’র্ত’চিৎকারের মতো শোনায়। গাছে বসে থাকা শালিক দুটিও কেঁপে ওঠে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে একে অপরের গা ঘেঁষে বসে। ক্ষণে ক্ষণে আব্বার মুখনিঃসৃত সেই শব্দবা’ণ পালির হৃদয়ে অদৃশ্য ছু’রি’কা’ঘা’ত করে। করবী শব্দটাও এত দরদ নিয়ে ডাকা যায় বুঝি! খুদিবু বললেন,
“কান্দিস নারে। হের মাথার ঠিক নাই। দেখবি পরে ঠিকই চিনছে।”

চোখে দেখতে না পাওয়া খুদিবু হাতরে পালির গা স্পর্শ করতেই চমকে উঠলেন,
“শইল গরম ক্যান? জ্বর আইতাছে তোর?”

পালি কোনো উত্তর দিলো না। ভেজা জামা দু-বার তার গায়ে শুকিয়েছে। শীতল বাতাসে মহসিন একনাগাড়ে খুকখুক কাশছেন। আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা। সূর্য ওঠে না কবে থেকে পালির খেয়াল নেই। সে বুকে একরাশ ভয় নিয়ে খুদিবুর কোলে মাথা গুজল। খানিক বাদেই গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। ঘুমে চোখ লেগে আসতেই ঝপাৎ করে বিকট এক শব্দ হলো কানের কাছে। পালি লাফিয়ে উঠল। মহসিন পানিতে ঝাপ দিয়েছে।

“আব্বা!”

চিৎকার দিয়ে পালি নিজেও লাফাতে চাইলো। খুদিবু তাকে ধরলেন। মহসিন ততক্ষণে সাঁতরে কাঁঠাল গাছের ডালে গিয়ে বসেছে। পালি ডাকল,
“আব্বা! ফিরে আসুন। দোহাই লাগে আব্বা। একটিবার আপনার মেয়ের কথা ভাবুন। এত নি’ষ্ঠুর হবেন না। আব্বা!”

মহসিন সে কথা শোনেনি। তিনি হাউমাউ করে কাঁদছেন। করবীকে তিনি সময় দিতে পারেননি। সারাজীবন অভাব দূর করার পেছনে ছুটেছেন। অথচ যাকে ভালো রাখতে এত ত্যাগ সেই সুখী হতে পারেনি। করবী সুখী হতে পারেনি। মহসিনের মাথায় শুধু এই কথাগুলোই ঘুরপাক খায়। তিনি করবী করবী করে আহাজারি করেন। করবী শোনে না। রাতটা ওভাবেই কেটে গেল। জ্বরের ঘোরে ধুকে ধুকে একসময় পালি ঘুমিয়ে গেল। ভোরের আলো ফুটতে সে চেয়ে দেখল মহসিনের ফুলে ওঠা দেহটি কাঁঠাল গাছের গা ছুঁয়ে ভাসছে।

পালির চোখে একফোঁটা পানিও এলো না। সে নির্নিমেষ সেই নিশ্চুপ দেহটির দিকে তাকিয়ে রইল। ফিসফিস করে বলল,
“নদী, তুমি আমারে চিরতরে নিঃস্ব কইরা দিলা।”

জুলেখা আকস্মিক আহ’ত হওয়ায় হিমাদের খিলানচর যাওয়া স্থগিত হয়েছিল। তাকে মাকে নিয়ে ছুটতে হয়েছে হাসপাতালে। রবিউল খন্দকারের অনুপস্থিতিতে এমনিতেই সবকিছুর চাপ তার ওপরে। আব্বার নিয়মিত চিকিৎসার মাঝে মায়ের আকস্মিক পা ভেঙে বসা, পালির কোনো খোঁজ না পাওয়া সব মিলিয়ে হিমাদ দিশেহারা প্রায়। এরই মাঝে স্মরণকালে প্রথমবার সম্পূর্ণ শালুগঞ্জ ডুবিয়ে বন্যা এলো। সারাদেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে। চারিদিকে অসুখ-বিসুখের ছড়াছড়ি। হিমাদ পালির কাছে পৌঁছালো দিন দশেক পরে। খিলানচর খুঁজে পেতে বেগ পেতে হলো। গ্রামের পর গ্রাম পানির তলায়। এনাম ছিল বলে শেষ অবধি তারা খিলানচরের নাগাল পেয়েছিল। জীর্ণশীর্ণ পালিকে একটি বাধা নৌকায় নিঃশেষপ্রায় অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখে হিমাদ বোবা হয়ে গিয়েছিল। এরপর তড়িৎ তাকে ছোটো নৌকাটি থেকে ট্রলারে তুলল। খুদিবুও বলহীন দেহটি নিয়ে তখন যেন মৃ’ত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন। হিমাদ তাদের বাঁচার ক্ষীণ আলো হয়ে সেখানে এসেছিল যেন। খুদিবু উনার নাতনির বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করলে এনাম সে দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিল। অনেকটা সময় পর অনাহারে ক্ষয়ে আসা দৃষ্টিতে পালি চোখ তুলে চাইলো। হিমাদের উৎকণ্ঠায় নিমজ্জিত দৃষ্টিজোড়া দেখে বলল,
“যদি আসারই ছিল তবে আরো আগে কেন এলে না? জানো, আমার আব্বা ভেসে গেছে। আমার ভাইয়ের মতো ভেসে গেছে। মায়ের মতো ছোঁয়ার অতীত হয়ে গেছে। আমার আর কেউ নেই। কেউ না। সবাই নদীতে মিশে গেছে।”
হিমাদ পালিকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে অপরাধীর মতো বলল,
“ক্ষমা করে দে।”
“তোমরা কেউ আমার জীবনে সময়মতো এলে না। আমি ক্ষমা করলেও হয়তো আমার চোখের জল করবে না।”
“এভাবে বলিস নারে।”
“আমায় ফেলে চলে যাও।”
“প্রাণ থাকতে না।”

পালি বুজে আসা দৃষ্টিতে কাঁঠাল গাছটার তলার বহমান ঘোলা পানিতে তাকিয়ে থাকে। করবী, বিষাদনীড়ে ভাসমান একটি মায়ার নাম। সেই মায়ায় জড়ানো মানুষগুলো তার বিষাদের জালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে। মহসিন হয়তো মুক্তি খুঁজে পেল। সেই মুক্তিতে কী পালির খুশি হওয়া উচিৎ? পালি হিমাদের গলা জড়িয়ে গগনবিদারী চিৎকার দেয়। কাঁঠাল গাছের ডালে বসা জোড়াবিহীন শালিক পাখিটিও তখন জলের মাঝে ব’ন্দী হয়ে সঙ্গী হারানোর বেদনায় কাতরাচ্ছে।
________________

শেষটুকু

তপ্ত দিন, সুপ্ত রাতের ছন্দে চলতে চলতে মাস চারেক সময় অতিবাহিত হয়েছে। রবিউল খন্দকার এখন স্পষ্ট কথা বলতে পারেন। তবে হাটাচলা করতে পারেন না। অন্যের সাহায্য নিতে হয়। বাম-পাশটা এখনো বলহীন প্রায়। তবুও ছেলের ঘাড়ে সমস্ত দায়িত্ব ফেলে না রেখে তিনি নিজেও এখন বাড়িতে বসে টুকটাক সবকিছুর তদারকি করতে চেষ্টা করেন। বেশি চাপ নিতে পারেন না। যা পারেন তাই ছেলের জন্য আরাম হবে ভেবে নিস্ফল হয়ে থাকেন না। মেহেরুন বানু আগের চেয়েও অন্তর্মুখী হয়েছেন। স্বভাবের কঠোরতা ভেঙে পড়ছে। এদিকে জুলেখা বাড়িতে থেকেও যেন নেই। এ বাড়ির কারো সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব নেই। ভাঙা এক পা নিয়ে বাড়িতে নিজের মতো পড়ে থাকেন। তাকে এই একাকিত্বে ঠেলে দিয়েছেন রবিউল খন্দকার। পক্ষাঘা’তগ্রস্ত হয়ে একাকিত্বের য’ন্ত্রণা তিনি হারে হারে টের পেয়েছেন। প্র’হারে বা অসুখে মানুষ যতটা না শারীরিক য’ন্ত্রণা পায়, একাকিত্বের জা’তাকলে তারচেয়ে অধিক মানসিক য’ন্ত্রণায় ভোগে। নিস্তরঙ্গ বাড়ি ও তার ভেতরকার মানুষগুলোর জীবন ছন্দহীন তালে বয়ে যাচ্ছে। পালির কলেজে ভর্তি হওয়াসহ হোস্টেলে থাকার সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কাল সে চলে যাবে কলেজ হোস্টেলে। সে নিয়ে পালির মাঝে উৎকন্ঠা রয়েছে। সব হারিয়ে নিঃস্ব মেয়েটা নিজেকে নিয়ে বাঁচার তাগিদ অনুভব করছে। মায়ের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চাইছে। সেই স্বপ্ন পূরণের একটি ধাপ হবে কলেজের গন্ডি ছোঁয়া। তবে বাড়ির সকলের মন ভারাক্রান্ত। পালি যেন এ বাড়ির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। তার দূরে চলে যাওয়ায় সকলেই ব্যথিত। বিশেষ করে মেহেরুন বানু। উনার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ এখন অনাথ মেয়েটির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। রবিউল খন্দকার পালিকে ছেলের বউ করার সিদ্ধান্তে এখনো নিরব সম্মত। মেহেরুন বানু তা নিয়ে বিশেষ গাইগুই করেন না। ভাগ্যে থাকলে হবে, এমনই ভাবনা উনার।

আজ নিবাসপুর হতে ফজিলা এসেছিল চিত্রার খোঁজ-খবর নিতে। তাকে চিত্রার শ্বাশুড়িই পাঠিয়েছেন। রাজিয়া ছেলের বিরহে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছে। দুটি ছেলের একটিও বাড়িতে না থাকায় মোক্তার বাড়ি এখন কিছুটা ছন্নছাড়া। রবিন দেশ ছেড়ে যাওয়ায় হেনা তার আশা ছেড়ে দিয়েছে। তাই স্বামীর সঙ্গে প্রায় ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া সম্পর্কটা পরিবার আবার জুড়ে দিয়েছে। বিনিময়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে অর্থ-সম্পদও পেয়েছে উজ্জ্বল। তবে বারবার বাচ্চা নষ্ট করে হেনা এখন গর্ভের সন্তানের স্বাদ হতে বঞ্চিত। এমনই নানান কথা বলে চিত্রাকে ভালোমন্দ বুঝ দিয়ে ফজিলা বিদায় নিয়েছে।

খন্দকার বাড়ির অদৃশ্যপ্রায় সদস্য হলো চিত্রা। বাড়িতে হাজারটা কান্ড ঘটে গেলেও সে নিজেকে কোনোকিছুতে জড়ায় না। আগ্রহবোধ করে না। অনুভূতিগুলো কেমন ভোঁতা। সে আনমোনে বইপত্র গোছাচ্ছিল। টেবিল গুছিয়ে ড্রয়ারে হাত দিতেই দুটো চিঠি নজরে পড়ল। যার একটি সে পড়েছে। অন্যটি অনাদরে পড়ে আছে। চিত্রা চিঠিখানায় হাত বুলালো। কি ভেবে যেন সেটা নিয়ে খোলা জানালার সামনে বসল। চিঠিখানা খুলতে তার হাত ঈষৎ কেঁপে উঠল যেন।

“শুরুর সম্মোধন তোমায় কোনো স্নেহের নাম দিতে সংশয় হচ্ছে৷ ভয়ও হচ্ছে। যে আমি নিজের হাতে নিজের স্বামীত্বের গৌরব খুইয়েছি, নিজেকে কাপুরুষ রূপে তোমার সামনে তুলে ধরেছি তার আদরের সম্মোধনে যদি বিরক্ত হও! শুরুতেই তোমার বিরক্তির কারণ হতে চাইলাম না।

তুমি জানো আমি অতি অধৈর্যবান এক পুরুষ। বাড়ির সবচেয়ে ছোটো সন্তান ও অতি আদরের হওয়ায় এবং চাওয়া মাত্রই সব হাতের নাগালে পেতাম বলেই ধৈর্য ধরাটা খুব সহজে পেরে উঠতাম না। আমার সেই স্বভাবে কিছুটা লাগাম পড়েছিল তোমার প্রতি আস’ক্ত হয়ে। অস্বীকার করব না আমি প্রথম দর্শনে তোমার রূপে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার প্রতি আকর্ষিত হয়েছি। আর যেদিন সামনাসামনি দেখা হলো, তোমার নিস্তরঙ্গ দৃষ্টি, ধা’রালো কথা আমায় প্রেমের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এইটুকুনি মেয়ের হৃদয় নাকি পাথরে মতো অনুভূতিহীন! সেই পাথর হৃদয়ের মেয়েটিকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার আকাশ ছুঁয়ে দিলো। পেয়েও গেলাম। কিন্তু তার হৃদয় ছুঁতে পারলাম না। জানতে চাইলাম না তার পাথর হৃদয়ের ইতিহাস। বরং এই হৃদয় ছোঁয়াছুঁয়ির খেলাটা আমার কাছে কেমন উপভোগ্য হয়ে উঠল। তুমি সময় চাইলে। আমি দিলাম, তবে তা আমার গন্ডির ভেতরে রেখেই। রোজ নিয়ম করে আমি তোমার প্রেমে আহ’ত হয়েছি, হাবুডুবু খেয়েছি। প্রণয় ভিখারি হয়ে চাতকের মতো তোমার হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার প্রতিক্ষায় থেকেছি। আমার নির্লজ্জ, লাগামহীন প্রেমিক সত্ত্বা ও দায়িত্বশীল স্বামী সত্ত্বা একইসঙ্গে তোমায় আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে এসে আমি পথ হারালাম। তোমার মনের পথে হাটতে গিয়ে আমি দিক ভ্রষ্ট হয়েছি চিত্রা।

সে রাতে বিক্ষিপ্ত মনে জেদের বশবর্তী হয়ে আমি আমার লালিত প্রেমকে গলা টিপে মে’রে ফেলেছিলাম। যার প্রতি নিজের আমার ধৈর্যহীনতার মহান পরিচয় দিতে চেয়েছি শেষেমেষ তারই কাছে চরম অধৈর্যশীলতার প্রমাণ দিয়েছি। একবুক ভালোবাসা নিয়ে ছুঁতে গিয়ে সবটাই অপবিত্র করে ফেলেছি। আমি কী পারতাম না সেদিন জেদ না করে তোমায় মাথায় হাত রাখতে? তোমার ভঙ্গুর মনটিকে একটু আশ্বাসের প্রলেপ দিতে? আমি তা পারিনি। ঠকে যাওয়ার য’ন্ত্রণা আমায় নিঃশেষ করে দিচ্ছিলো। যখন টের পেয়েছি লজ্জায়, ঘে’ন্নায় এই মুখটা তোমাকে দেখানোর সাহস হলো না। চোরের মতো তোমার অগোচরেই আমি বাড়ি ত্যাগ করেছিলাম। অ’প’রাধবোধ আমার সর্বাঙ্গে ধি’ক্কার জানাচ্ছিলো। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না৷ তোমায় নিয়ে চন্দ্রবিলাস করার স্বপ্ন, বিলের জলে ভেসে বেড়ানোর স্বপ্ন, হৃদয়ের উষ্ণতম অনুভূতি মেখে মাতাল হওয়ার স্বপ্ন আমি এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দিয়েছি।

তোমায় নিয়ে আমার মনে কোনো অভিযোগ নেই। সব জানতে পেরে বুকে পাথর বেধে আমি তোমায় মুক্ত করতে চেয়েছি। চেয়েছি তুমি সুখী হও। কিন্তু সত্যি হলো একদিকে যেমন মুক্তির বুলি আওড়েছি অন্যদিকে ভয়ে গুটিয়ে থেকেছি। তোমায় চিরতরে হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় রাতের পর রাত ঘুমাতে পারিনি। তুমি, ভাইজান দুজনই যেমন আমার প্রিয়, তেমনই তোমার প্রতি আমার নিবেদিত ভালোবাসাটুকুও আমার সুখের একমাত্র সম্বল। দীর্ঘ পাঁচটি বছর আমি ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছি চিত্রা। তোমায় না পাওয়ার অনলে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছি প্রতিনিয়ত। যখন বুজেছি তুমি বা ভাইজান আর একে-অপরকে চাও না, অজান্তেই আমার বুকের ভার নেমে গিয়েছে। কতবার শালুগঞ্জ গিয়ে ফিরে এসেছি। তোমার সামনে যাওয়ার সাহস হয়ে ওঠে না। চিত্রা, আমায় কি ক্ষমা করা যায়না? এই ভুলে ভরা, অসহিষ্ণু মানুষটাকে একটাবার কি সুযোগ দেওয়া যায় না?
আমি যে আজও তোমার প্রণয় ভিখারি। অনন্তকাল থেকে যাব।

ইতি
সাম্য”

চিত্রা চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ একইভাবে বসে রইল। শরীরটা ভারী লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। হুট করে বাইরে কারো গলার শব্দ পেয়ে সে সচকিত হলো। এলোমেলো পায়ে বের হতেই দেখল মেহেরুন বানু আপ্লুত হয়ে সাম্যকে আপ্যায়ন করে ভেতরে আনছেন। বাড়িতে কেমন ব্যস্ততার ধুম পড়ে গেল। চিত্রা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে। সাম্য ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি কি এসে ঠিক করলাম?”
“না।”
“চলে যাব?”
“না।”
“আমি কি আসতে খুব বেশি দেরি করে ফেলেছি?”

চিত্রা সে কথার উত্তর দিতে পারল না। তার চোখ ছাপিয়ে তখন অশ্রুমালা বইছে। সাম্য মুগ্ধ চোখে সবচেয়ে বিশুদ্ধতম কান্নার দেখা পেল।
_________________

পড়ন্ত বিকেলে পালি রঙিন শাড়ি পরে ছাদে উঠেছে। এই শাড়িটি তার মায়ের। মেহেরুন বানু মায়ের সম্পূর্ণ আলমারিটাই পালিকে দিয়ে দিয়েছেন। মায়ের সমস্ত জিনিসে এখন তার একান্ত অধিকার। পালি দু-হাত ভর্তি কাচের চুড়ি পরেছে। খোলা চুল লুটিয়ে আছে পিঠের ওপর। তার অলস দৃষ্টি সম্মুখের কদম গাছটার ডালে বসা ছন্নছাড়া কাকের দিকে। এমন সময় সিড়িতে পরিচিত ছন্দের পায়ের শব্দ শোনা গেল। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। হিমাদ এসে ঠিক তার পাশে দাঁড়ালো। সকাল থেকে তার মনটা বিক্ষিপ্ত। অকারণেই সবকিছু পানসে লাগছে। পালির মাথা থেকে পা অবধি চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
“সেজেছিস কেন? যাওয়ার খুশিতে পাখনা গজিয়েছে?”
“হয়তোবা।”
“এ বাড়ি ছেড়ে যাবার জন্য এত খুশি?”
“উহু, নিজেকে আরেকটু মেলে ধরতে পারার খুশি।”
“হোস্টেলের কিছু উড়নচণ্ডী স্বভাবের মেয়ে থাকবে। যাদের দিন-দুনিয়ার কোনো বালাই নেই। ভুলেও তাদের সঙ্গে মিশবি না। বন্ধুত্ব করবি বুঝেশুনে, দূরত্ব রেখে। শহরে যাওয়ার খুশিতে পড়াশোনা রেখে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করবি না। আর কোনো অসুবিধায় পড়লে চিঠি দিবি।”
পরক্ষণেই চিন্তিত হয়ে সঙ্গে যোগ করল,
“চিঠি পৌঁছাতে অবশ্য সময় লাগবে। এই অজপাড়াগাঁয়ে টেলিফোনও নেই। আমি আমার এক পরিচিতের টেলিফোন নম্বর দেব। ইমার্জেন্সি সমস্যায় তাকে টেলিফোন করবি। আমি দ্রুত খবর পেয়ে যাব।”
পালি একদিকে মাথা কাত করে বলে,
“আচ্ছা।”

কিছুটা সময় নিরবতা ছেয়ে রইল। হিমাদ বলল,
“একা এতদূর থাকতে পারবি তো?”
পালি সে কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি অপেক্ষা করবে তো?”
পালির উদ্বিগ্ন কণ্ঠ হিমাদের কান ছুঁয়ে দিলো অতি কোমলভাবে। হিমাদ মুখে কোনো উত্তর দিলো না। তার স্থির দৃষ্টিজোড়া একবার পলক ফেলে নিরবে যেন আশ্বাস দিলো। পালি সে আশ্বাস উড়িয়ে দিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে, নাক ফুলিয়ে বলল,
“নাকি আবার সেই টিয়া পাখির সঙ্গে উড়ু উড়ু করবে? পুরুষ মানুষের তো খালি ছুকছুকানি…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই হিমাদ তাকে প্রায় একহাতে তুলে নিয়ে ছাদের কিনারায় যেতে যেতে বলল,
“বে’য়াদব, অকালপক্ক মেয়ে, তোর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”
পালি শরীর ভেঙে হেসে ওঠে। বলে,
“এখান থেকে পড়লে বড়োজোড় একটু চো’ট পাবো। মা’রতে হলে আরো উঁচু ছাদ লাগবে তো।”
“এত বাজে বকিস কেন?”
“চুপ করে যাব বলছো?”

হিমাদ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইল। পালি পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“অকালপক্ক যে বললে অকালপক্কের দিকে নজর দিতে তোমার লজ্জা করে না?”
হিমাদ তার সদা গম্ভীর কণ্ঠে আরেকটু নির্লিপ্ততা ঢেলে ক’টা’ক্ষ করে উত্তর দিলো,
“তুই সেজেগুজে চোখের সামনে ঘুরতে পারলে আমি দেখতে পারব না কেন? একটু আগেই তো বললি পুরুষ মানুষের খালি ছুকছুকানি।”
পালি ঈষৎ আর’ক্ত হলো। বলল,
“আমায় খেয়াল করে দেখেছো!”
“দেখেছি।”
“কি দেখলে?”
“আষাঢ়ি মেঘখন্ডের একজোড়া প্রলয়ংকরী চোখ আছে। বৃষ্টিবিলাসী তাতে ঝড়ের আবাস পেয়েছে।”

পালি বিমূঢ় হয়ে কলমি লতার মতো নুইয়ে পড়ে। ফুরফুরে বাতাসে দোলায়মান চুলগুলো একটু পর পর গুজে দিচ্ছে কানের পিঠে। চুল গোজার দৃশ্যটুকু অতি চমৎকার। সে সময়টায় পালির দৃষ্টির সঙ্গে থুতনি ঝুকে যাচ্ছে, ঠোঁট প্রসারিত হচ্ছে। হাতে থাকা কাচের চুড়ি টুংটাং ছন্দ তুলছে। যেন তাদের অব্যক্ত কথা চুপিসারে শুনিয়ে যাচ্ছে। হিমাদ সুক্ষ্ণভাবে প্রতিটি জিনিস খেয়াল করে। ফিসফিসিয়ে বলে,
“সে ঝড় থামছে নারে। ক্রমেই তান্ডবে রূপ নিচ্ছে।”

অনুভূতি হাতে কলমে শেখাতে হয় না, বলেও দিতে হয় না। এটা শুধুই হৃদয় নামক ছলনাময়ীর ভেলকি। যাতে দুটি মন একই সূত্রে বাধা পড়েছে। পশ্চিমাকাশ একটু একটু করে সমস্ত আলো শুষে নিচ্ছে। রঙমিলান্তির অপরূপ দিনান্তে পালি নিবিড় আলিঙ্গনে মিশে গেল হিমাদের প্রশস্ত বুকে। সময়টা থেমে গেল মোহগ্রস্ত দুই মানব-মানবীর মাঝে। প্রেমানুভুতি মাতিয়ে তুললো পরিবেশ। বিবশ হল মন। এক পক্ষের আকর্ষণে, অপরপক্ষের সমর্পণে। হয়তো সেখান থেকেই শুরু হলো নতুন মায়ার গল্প!

_সমাপ্ত_