একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব-৫৮+৫৯

0
650

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৫৮
#WriterঃMousumi_Akter.

মৃন্ময় এমন ভাবে বেরিয়ে গেল, ওকে আটকানোর সুযোগটুকুও পেলাম না। আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলে রোশান স্যার, পিহু বুঝে যাবে। আমি দ্রুত আমাদের রুমে প্রবেশ করলাম। তরীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি রুমে প্রবেশ করতেই তরী ওর চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। অনিচ্ছাকৃত হাসল। কিন্তু হাসিতে কোনো প্রাণ নেই। চোখ-মুখ অন্যরকম লাগছে। আমার কাছ থেকে পালাতে বলল, ‘ভাবি রোহান কোথায়? ওকে দেখছি না যে।আমি রোহানকে দেখে আসি।’ বলেই রুম থেকে বেরোতে গেল।

আমি ওর পথ আটকে দাঁড়ালাম। শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘রোহান ওর বড়ো পাপ্পার সাথেই আছে। খুঁজতে যেতে হবে না।’

‘তাহলে রান্না ঘরে যাব ভাবি?’

‘কোথাও যেতে হবে না তরী। কী লুকাচ্ছ? আমি সবটা দেখেছি। কী করেছে মৃন্ময়?’

তরী কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। আমার দিকে তাকিয়ে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে শুধু। আর শুকনো ঢোক গিলছে।
তরীকে ঘাবড়ে যেতে দেখে ওর কাঁধে হাত রেখে নরম কন্ঠে বললাম,
‘মৃন্ময়ের গায়ে হাত তুলেছ? তুমি তো অকারণে কারো গায়ে হাত তোলার মতো মেয়ে নও তরী। হঠাৎ কী হল?’

‘ভাবি উনি, মানে– তোমার বন্ধু আমার মুখে হাত দিয়েছিলেন। উনি আমাকে ভালবাসার কথা বলছিলেন।’

‘সব স্পর্শতে পাপ থাকে না তরী। কিছু স্পর্শে সরলতাও মিশে থাকে। মৃন্ময়কে তুমি ভুল বুঝছ। আর যাই হোক, বাজে উদ্দেশ্য কাউকে স্পর্শ করার মতো ছেলে ও নয় তরী। আমার বন্ধু বলে বলছি না, ও সত্যি ভালো ছেলে।’

‘উনি ভালো ছেলে সেটা আমি জানি ভাবি। কিন্তু উনিতো এমন আচরণ আগে করেননি। হঠাৎ মুখে হাত রাখলেন। ভালোবাসার কথা বললেন। আমার কেমন যেন হচ্ছিল ভাবি। হঠাৎ ভ**য় পেয়ে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি প্রেম-ভালবাসা নামক শব্দ দুটোকে বড্ড বেশি ভ**য় পাই। আমি পুরুষ মানুষকে ভীষণ ভ**য় পাই। আমি পুরুষের স্পর্শ সহ্য করতে পারি না। শরীরের মাঝে ঘিনঘিন করে ওঠে। কেমন বাজে একটা অনুভূতি হয়। আমি ভয়ানক এক অতীত দেখে এসেছি। পুরুষ মানুষ কত বেশি ভয়ানক হতে পারে, আমি দেখে এসেছি। তাই আমি এসব সহ্য করতে পারি না। কানে শুনতেও পারি না।’

‘তুমি কি জানো, আমিও ভয়ানক পুরুষ দেখে জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ মানুষও দেখেছি? ছোঁয়াও দেখেছে। ‘

‘ভাবি সবার জীবন আর আমার জীবন এক না। আমি এই জীবনে আর কোনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারব না। আমার ভিতরে কোনো অনুভূতি নেই। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনার বন্ধুকেও বলুন ক্ষমা করে দিতে। ‘

এরই মাঝে দ্বীপ ঘরে প্রবেশ করে বলল, ‘তুমিই মায়াবিনী?’

‘আমিই মায়াবিনী মানে?’

‘মৃন্ময়ের মায়াবিনী।’

‘এসব কী বলছেন আপনি?’

‘তুমি ঝিকড়গাছার মেয়ে না?’

‘আপনি কীভাবে জানেন?’

‘আমি জানতাম না, মৃন্ময় জানিয়েছে।’

‘কী জানিয়েছে?’

‘ওর গ্রামের বাড়িও ওখানে।’

‘উনার গ্রামের বাড়ি ওখানে মানে?’

‘তরী, আমি তোমাকে মৃন্ময়ের সাথে রিলেশনে যেতে বলব না। তবে কিছু কথা তোমাকে বলতে চাই। না বললে ভারি অন্যায় হবে।’

‘কী বলবেন আপনি? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘ রিনি নামের একটা মেয়ে তোমার বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিল না?’

‘হুম ছিল তো।’

‘কখনো কোনো ছেলের কথা বলত, যে তোমাকে খুব পছন্দ করে?’

‘হুম বলত।’

‘রিনির চাচাতো ভাই মৃন্ময়। মৃন্ময়রা ইদে গ্রামে যেত। তুমি তখন এইটে পড়ো। মৃন্ময় নাইনে পড়ে। ওই কিশোর বয়সেই ইদের দিন রিনির সাথে তোমাকে দেখেই প্রেমে পড়েছিল। তখন ওর বয়স কম। ওই বয়সেই তোমার জন্য ওর মনে উথাল-পাথাল ঝড় উঠেছিল। সপ্তাহে ৩-৪ দিন করে গ্রামে যাচ্ছিল নিজের স্কুল কামাই করে। লেখাপড়া কোনো কিছুর প্রতিই মন ছিল না। মনটা সারাক্ষণই গ্রামে পড়ে থাকত। রিনিকে দিয়ে তোমাকে বলাত। তুমিও তখন ছোটো। এসবে পাত্তা দাওনি। আর এর মাঝেই তোমার বিয়ে হয়ে যায়। মৃন্ময় তোমার নাম দিয়েছিল ‘মায়াবিনী’। যার মায়ায় ও আসক্ত হয়েছিল। এর মাঝেই কীভাবে তোমার বিয়ে হয়ে গেল। মৃন্ময় আর কোনদিন খুঁজে পেল না তোমাকে। অন্য কেউ হলে সবটা ভুলে যেত কবেই। মৃন্ময় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল এক তরফা ভালবেসে। এসএসসি-তে রেজাল্টও খারাপ করল। আমাদের কাছে হাস্যকর লাগত, আমরা মজা নিতাম। ভাবতাম সামান্য এইটুকু ব্যাপারে কেউ এত সিরিয়াস হয়! আসলেই হয়, যদি ভালবাসাটা মন থেকে হয়ে যায়। সেই ভালবাসাটা আর কোনদিন ভোলা সম্ভব হয় না। ভালবাসার ক্ষেত্রে সময় কোনো ফ্যাক্ট নয়। কার সাথে কার কতদিনের পরিচয় সেটা ফ্যাক্ট নয়। ফ্যাক্ট হলো কে কতটুকু ভালবাসতে পারল। কেউ এক যুগ পাশে থেকেও বাসতে পারে না ভালোবাসা ধরে রাখতে পারে না।কেউ আবার একদিনের ভালোবাসা আজীবন মনে ধরে রাখে। এর পর মৃন্ময় স্বাভাবিক হয়েছিল ঠিক; তবে তোমাকে কখনোই ও ভোলেনি। ভুলতে পারেনি। আমরা ফ্রেন্ডরা অনেক মজা করতাম বিষয়টা নিয়ে। আসলেই হাস্যকর না ব্যাপারটা? সেই কত বছর আগে কাকে দেখেছিল তার জন্য প্রায়শই সিগারেটে আসক্ত হওয়া। একদিকে তুমি এমন একটা ছেলের কাছ থেকে এসেছো তোমার জায়গা দাঁড়িয়ে কাউকে ভালোবাসাটাই অসম্ভব ব্যাপার। আর এই দিকে মৃন্ময়ের শুদ্ধতম ভালোবাসার কথা ভাবলে একটা ছেলের প্রতি সম্মান হাজার গুণ বেড়ে যাওয়ার কথা। যেদিন তুমি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এলে, মৃন্ময় তোমাকে আনতে গিয়েছিল। এতগুলো বছর পরে তোমাকে দেখে ওর বুকের মাঝে ভয়ংকর প্রলয় শুরু হয়েছিল। ও তোমাকে পায়নি সেটা ওর কষ্ট নয়। ওর কষ্ট ছিল তোমার জীবনের করুণ পরিণতি দেখে। সেদিন থেকে মৃন্ময় আর একটা রাতও ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি । সিগারেটে আসক্ত হয়েছে বেশি । ও যাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছে তার জীবনের এমন অবস্থা দেখে যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। তোমাকে এক মুঠো সুখ এনে দিতে অনেক চেষ্টা করছে। তুমি আস্তে আস্তে সবই জানতে পারবে। ‘

আমি দ্বীপের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তরীই সেই মেয়ে?’

‘ হ্যাঁ তরীই সেই মেয়ে।’

দ্বীপ বেরিয়ে গেল রুম থেকে। তরীর চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি অনেক্ষণ তাকিয়ে দেখছি মেয়েটাকে। হঠাৎ কেমন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে। আমি শুধু বললাম, ‘কেঁদো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

রুম থেকে বেরিয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলাম।আমার সাথে ছোঁয়াও আছে। দ্বীপের কথাগুলো ভুলতে পারছি না। কেউ কাউকে এতটাও ভালোবাসতে পারে! এতটা গভীর ভালোবাসাও সম্ভব! একেকজনের ভালোবাসার ধরণ একেক রকম। একেকজনের গল্প একেক রকম, তাদের গল্পে তারাই প্রকৃত নায়ক। রান্না শেষে সবাই খেয়ে বেরিয়ে গেল। মৃন্ময়ের কথা উঠতেই বলা হলো ওর ইমারজেন্সি কাজ পড়ে গিয়েছে।

তরী যাওয়ার সময় ওর চিঠিটা ফেলে গিয়েছে। হয়তো পড়েই রেখে গিয়েছে।আমি চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলাম,

‘মায়াবিনী।’
আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসতে পারিনি আমি। যত্ন করে আগলেও রাখতে পারিনি। যদি পারতাম তোমার জীবনটা হয়তো এমন এলোমেলো হতো না।একজন প্রেমিক হিসাবে ব্যর্থ আমি। সে ছোট্ট কিশোর বয়সে তোমার চোখের মায়ায় ডুবেছিলাম, ভীষণ ভালোবেসেছিলাম।

এটুকু পড়তেই রোশান স্যারের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। দ্রুত চিঠিটা বিছানার নিচে রেখে দিলাম। উনার হাতে বাইকের চাবি। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,

‘মাই ডিয়ার বউ, আই মিস ইউ। নিড এ টাইট হাগ।’

আমি কিছু না বলেই উনার বুকে মাথা রেখে উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘সারাদিন তো চোখের সামনেই ছিলাম, তাও মিস করছেন কেন?’

উনি আমার চুলে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন, ‘সারাদিন সবার সামনে থেকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখতে পারিনি তোমাকে। আমার অভ্যাস, সারাক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে তোমাকে দেখা। একদম সূক্ষ্ম নজরে দেখি তোমাকে। আজ ভালো ভাবে দেখতে পাইনি। আজ সারারাত দেখব।’

‘আপনি এত ভালোবাসেন কেন আমায়, শ্যামসুন্দর পুরুষ? আপনার মতো গোছালো একজন মানুষ আমার মতো অগোছালো মেয়েকে ভালোবাসে কেন?’

‘তুমি বরং অগোছালো হয়েই থেকো, আমি রোজ গুছিয়ে দেব তোমায়।’

‘নিজেকে এত ভাগ্যবতী মনে হয় কেন?’

‘তুমি তো ভাগ্যবতীই। আমার জা*ন পাখিটা। চলো নির্জন রাস্তায় হেঁটে আসি।’

‘চলুন।’

ফাঁকা রাস্তা চাঁদের আলো। প্রকৃতির ঠান্ডা হিম বাতাস। শীত উপেক্ষা করেও দুজন দুজনার হাত ধরে হাঁটছি।অভিমানী কিশোরীর মতো চাঁদ মাথার উপর দাঁড়িয়ে সোনালি আলো ছড়াচ্ছে। প্রিয় মানুষটির সাথে নির্জন রাস্তায় হাঁটার অনুভূতিটাই অন্যরকম। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘আচ্ছা সারাহ, প্রিয় মানুষকে দেওয়ার জন্য বেষ্ট গিফট কী হতে পারে?’

‘তার প্রিয় কিছু।’

‘আচ্ছা তোমার প্রিয় কিছু চাও এখন, না কি আমার সঙ্গ?’

‘আমার প্রিয় তো আপনিই তাই আপনার সঙ্গ-ই চাই।’

‘আমি বাদে, ধরো পছন্দের কোনো গহনা বা শাড়ি চাও না কি আমার সঙ্গ?’

‘আপনার সঙ্গ।’

‘আমি জানতাম আমার সঙ্গই পছন্দ হবে।প্রিয়জনকে দেওয়া বেষ্ট গিফট হলো–সময়। সময় না দিয়ে সুন্দর মুহূর্ত না দিয়ে টাকায় কেনা উপহার কাউকে সুখ দিতে পারে না।প্রিয় মানুষের দেওয়া সময়ই হলো অমূল্য গিফট। তাই তোমার জন্য আমি এনিভার্সারী গিফট হিসাবে এমন একটি রাত ভেবে রেখেছিলাম।’

‘আপনি কত ভাবেন, দেখুন! আমার মন ভালো রাখার ম্যাজিক আপনি।’

‘মন খারাপ করলে, ভাবছ কিপ্টা বর এসব বলে গিফট এড়িয়ে যাচ্ছে?’

‘মোটেও না, আর আপনি কিপ্টাও নন।’

‘চোখ বন্ধ করো।’

‘করলাম।’

হাতের অনামিকা আঙুলে কিছু একটা অনুভব করলাম। চোখ খুলে দেখি একটা গোল্ডের রিং। উনি হাতের আঙুলে চুমু দিয়ে বললেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া তুমি। আল্লাহর দেওয়া বেষ্ট গিফট তুমি। তোমাকে না পেলে এ জনমে অনেক কিছুই পাওয়া হতো না।আমার শত জনমের সাধনা তুমি, আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা। আমার জীবনে আসার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

‘হ্যাপি এনিভার্সারী মাই লাইফলাইন।’

চলবে?..

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৫৯
#WriterঃMousumi_Akter.

পহেলা ফাল্গুন। কাক ডাকা ভোর, শহরে এখনোও কুয়াশার ছড়াছড়ি। ঘুম ভাঙল কোকিলের মিষ্টি সুরে। কোকিলের কণ্ঠে কী যেন একটা যাদু আছে! আমার দারুণ লাগে এই মিষ্টি সুরেলা কন্ঠের পাখিটি। মনে হচ্ছে বেলকনিতেই এসে ডাকাডাকি করছে।বিছানা ত্যাগ করতেই দেখি আড়ষ্ট দু’টো হাতের বাঁধনে আমি আটকে আছি। এই হাত দুটো রোজ আমাকে আগলে রাখে পরম আদর আর ভালোবাসায়। এই হাত দুটোর মালিকের হয়তো মনে হয় সে ঘুমিয়ে গেলেই আমি বোধহয় কোথাও হারিয়ে যাব নইলে এমন আষ্টেপৃষ্টে কেউ জড়িয়ে রাখে! তবে বেশ লাগে আমার কাছে। আমার জীবনে কারো দখলদারী আগে মেনে নিতে পারতাম না; অথচ আজ এই মানুষটার দখলদারী ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না।শুধু মনে হয় এই মানুষটানা থাকলে কী হতো আমার! আমার জীবনে তার অধিকারবোধ আমাকে ভাবায়, আমি কত বেশি স্পেশাল তার লাইফে। এই মানুষটার শরীরের ঘ্রাণে যেন আসক্ত আমি, এই মানুষটার উষ্ণ ছোঁয়ায় অভ্যস্ত আমি, এই মানুষটার ওষ্ঠের স্পর্শ আমার নিত্যদিনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। এই মানুষটা জীবনে না এলে শ্রেষ্ঠ অনুভূতিগুলো কিছু আমার অনুভব হতো না।আস্তে করে উনার হাত দু’টো ছাড়িয়ে নিয়ে উনার কপালে চুমু দিয়ে চুপিসারে উঠে গেলাম।বাইরে কুয়াশা, দু’একজন মানুষ হয়তো ঘুম থেকে উঠেছে। পুরো শহরই যেন তন্দ্রাচ্ছান্ন।বেলকনির দরজা খুলতেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছে দুই একটা ফুল এসেছে। কৃষ্ণচূড়া দেখলেই যেন চোখের তৃপ্তি হয়। সৃষ্টিকর্তার কী নিঁখুত সৃষ্টি! একটা কোকিল ওই গাছের ডালে বসেই কুহু কুহু স্বরে ডেকে যাচ্ছে। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ গায়ক কোকিল তার ডাকে এই শহরকে জানাতে এসেছে আজ পহেলা ফাগুন, আজ কৃষ্ণচূড়ার দিন, আজ বসন্তের আগমন, আজ ভালোবাসি বলার শ্রেষ্ঠ দিন। বসন্ত মানেই মনে হয় রঙিন অনুভূতির দিন। পৃথিবী নতুন সাজে সেজে ওঠে। রুমের দিকে তাকালাম, ঘুমন্ত মানুষটাকে এই কৃষ্ণচূড়ার থেকেও সুন্দর লাগছে।
আচ্ছা কৃষ্ণচূড়া, বলো তো কে বেশি সুন্দর, তুমি না কি আমার শ্যামসুন্দর পুরুষ? সাথেই সাথেই কোকিল ডেকে উঠে বলল, ‘ তোমার শ্যামসুন্দর পুরুষটিই বেশি সুন্দর। ‘ আমি মৃদু হেসে দিলাম। অদ্ভুত এক ভালবাসা নামক সুগন্ধি পেলাম নাকে। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম স্নিগ্ধ সকালের।

রুমে এসে পায়চারি করে যাচ্ছি। উনার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আছি। উনি কী আমায় ফাগুনের শুভেচ্ছা জানাবেন না, না কি এসব উনি বোঝেনই না! কে না চায় প্রিয় মানুষের থেকে শুভেচ্ছা পেতে। কাল রাতেও তো কিছু বললেন না। অবশ্য কাল রাতে উনি অনেক রাতে বাসায় ফিরেছেন। অথচ তন্ময় ছোঁয়াকে সুন্দর একটা হলুদ শাড়ি উপহার দিয়েছে। শাড়ি দিয়ে বলেছে,

‘বেঁচে থাকার জন্য, ভালো থাকার জন্য একশটা কারণ লাগে না। একটা কারণই যথেষ্ট। আমার কাছে সেই একটা কারণই তুমি। বসন্তের শুভেচ্ছা আমার জীবনের রঙিন বসন্তকে। তুমি পাশে থাকলে একদিন অনেক বড়ো হব। একটা বিশাল বড়ো বাড়ি তোমাকে আমি উপহার দিব। সেদিন গর্ব করে বলতে পারবে একটা বেকার ছেলের হাত ধরেছিলাম, যে ছিল শূন্য। আমি ছাড়া তার কিছুই ছিল না। আমি সেই ছেলের অর্ধাঙ্গী যে আমার হাত ধরে শূন্য থেকে আকাশ ছুঁয়েছে। প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের প্রতি সব মেয়েই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু একটা দরিদ্র বেকার ছেলের প্রতি আকৃষ্ট কয়টা মেয়ে হয়।আমার বউ আকৃষ্ট হয়েছে। তিন তলার দামি খাট, দামি গদি ছেড়ে এসে টিনসেটের ঘরে ঘুমোচ্ছে, শক্ত খাট, শক্ত বিছানায় ঘুমোচ্ছে, উনুনে আগুন জালাচ্ছে, রোজ আলুভর্তা খাচ্ছে, তাও নিজেকে সুখী দাবি করছে। এমন মেয়েকে পেয়ে সত্যি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।’

‘আমি এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করেছি যার তুলনা নেই। যে বয়সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে সেই বয়সে রোজ পায়ে হেঁটে অনেকগুলো টিউশনি করাচ্ছে, যে বয়সে রোজ ভিন্ন ভিন্ন মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করবে সে বয়সে আমাতেই আসক্ত হয়ে পড়ে আছে।যার সব আসক্তি আমাকে ঘিরে। যে আমার জীবনের সব দুঃখ মুছে সুখে রুপান্তরিত করেছে। আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছে। জীবনের নিভে যাওয়া প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে। এমন ভালোবাসার মানুষ আর কার আছে শুনি?’

ওদের ভালোবাসা দেখলেও শান্তি লাগে। ইশ! ভালোবাসা এত কিউট কেন? পবিত্র ভালোবাসাগুলো সত্যি অনেক সুন্দর হয়।ভীষণ রকমের সুন্দর হয়। পৃথিবীটা ভালোবাসাময় হোক। এমন ভালোবাসায় মানসিক তৃপ্তি পাক প্রতিটা মানুষ। হে পৃথিবী তুমি সত্যি সুন্দর, ভীষণ সুন্দর। যার জীবনে ভালোবাসা আছে তার কখনো সুখের অসুখ করবে না।

উনি কখন উঠে গিয়েছেন জানি না। দেখি বিছানায় নেই। ওয়াশরুমে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। এরই মাঝে উনি ওয়াশরুমের দরজা খুলে উঁকি দিলেন। জাস্ট মুখটা দেখা যাচ্ছে। উনাকে দেখেই আমি ঠান্ডায় শিউরে গেলাম। কীভাবে উনি রোজ সকালে গোসল করেন এত ঠান্ডায়! মুখে সাবানের ফেনা। আমাকে ডেকে বললেন,

‘সারাহ! টাওয়ালটা দিবে প্লিজ?’

উনাকে দেখে মনে হচ্ছে এসব ফাগুন টাগুন কিছুই বোঝেন না উনি। ভেতরে ভেতরে রা’গের পাহাড় জমছে আমার। বিয়ের আগে ভাবতাম বিয়ের পর প্রতিটা মুহূর্ত সিনেমাটিক হবে। কিন্তু ওই আধা বুইড়া মানুষের মাঝে সেসব ব্যাপার স্যাপারই দেখছি না। উনার থেকে বুইড়া টম আরও ভালো আছে। ৭৫ বছর বয়সে কীভাবে লাইভে এসে বউকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মাই বেবি, উম্মম্মাহ।’

উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘কী ভাবছ? টাওয়াল দাও।’

বেশ মুড নিয়েই বললাম,

‘নাহ! পারব না।’

উনি ভ্রুঁ উঁচিয়ে সন্দিহান ভাবে বললেন, ‘কেন পারবে না?’

‘আপনি জানেন না টাওয়াল লাগবে আপনার, তাহলে নিয়ে যাননি কেন?’

‘খেয়াল ছিল না। ‘ বিড়বিড় করে বললেন, ‘কী ঝ’গ-ড়ু’টে মেয়েরে বাবা!’

আমি চোখ পাকিয়ে উনার দিকে তাকালাম।আমি তাকাতেই উনি অকারণ হেসে দিলেন।উনার হাসি দেখে আরও রাগ হচ্ছে আমার।ঠেস দিয়ে বললাম,

‘আপনার তো অনেক কিছুই খেয়াল থাকে না। বিশেষ দিন, মাস, টাওয়াল কিছুই না।’

‘বয়স হচ্ছে তো। ‘

‘বাজে কথা ছাড়ুন।’

‘আচ্ছা টাওয়ালটা দাও; না হলে এভাবেই বেরিয়ে আসতে হবে।’

‘আপনার ন্যাকেড হয়ে বেরিয়ে আসাটাই উচিত। বেরিয়ে আসুন।’

‘আচ্ছা আসছি তাহলে।চোখ বন্ধ করতে পারবা না কিন্তু।’

‘ছিঃ! ভেবেই লজ্জা লাগছে আমার। দিচ্ছি, ওয়েট।’

‘না দিতে হবে না।আমি এভাবেই আসছি। ‘

দূর থেকে টাওয়াল ফেলে দিয়ে বললাম ‘নিন ধরুন! যত্তসব! ‘

টাওয়াল ক্যাচ নিয়ে বললেন,
‘এভাবে কেউ টাওয়াল দেয়?’

‘তো কীভাবে দিব?’

‘কাছে আসবে, এসে হাতে ধরিয়ে দিবে তো।
যেভাবে দিলে! টাওয়াল দিলে না কি মা*৷ *ই* র দিলে বোধগম্য হলো না।’

‘দেখুন আমার কিন্তু এমনি রাগ হচ্ছে।’

‘সেটা বুঝতে পারছি। বাট হুয়াই মিসেস?’

মনে মনে বললাম এটাও আমাকে বলে দিতে হবে যে কেন রা’গ করেছি। বলে বলে শুভেচ্ছা নিব আমি? আমি কি এতই ফেলনা!

‘আপনাকে বলব কেন?’

‘সকাল সকাল কী হলো আজ? বুঝেছি আজ না খেয়ে থাকা লাগবে।’

‘শুধু আজ নয়, কতদিন রান্না করব না তার হিসাব নেই।’

‘তো বলবে না তুমি, কী হয়েছে? জিনাতকে স্বপ্ন দেখেছ না কি?’

‘জিনাতকে আমি স্বপ্ন দেখব কেন?’

‘দেখতেও পারো যে, জিনাত আমার হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

‘কী বললেন আপনি? ওহ বুঝছি; তার মানে আপনি এইসব স্বপ্ন দেখেন জিনাতকে নিয়ে।’

‘আমি কেন দেখব? ভাবলাম তুমি দেখেছ।’

‘সকাল সকাল জিনাতের নাম বললেন কেন? নিশ্চয়ই আপনার আর জিনাতের কোনো চক্কর চলছে। আজ আপনার একদিন কী আমার একদিন। আমার দাদু যে কী খেয়ে আপনার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল! আজ ওই বুড়োর খবর আছে।’

‘আল্লাহ মালুম, আজ আর কার কার খবর আছে!’

বলেই উনি খালি গায়ে টাওয়াল পরে বেরিয়ে এলেন। শরীর ভরা পানি মুক্তার মতো চিকচিক করছে। এইভাবে বেরিয়ে এসে আমাকে ক্রাশ খাওয়ানোর ধান্দা এই লোকের। আমি আড় চোখে বারবার তাকিয়ে দেখছি উনাকে। উনি আমার রাগী মুডের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাপ রে।’

‘বাপ রে বললেন কেন?’

‘চোখ দেখে।’

‘আমার চোখে কী হয়েছে?’

‘শুধুই কি রা’গ করবে? কিছু একটা পরতে দাও, শীত লাগছে।’

আলমারি খুলে নাইটি ছুড়ে মেরে বললাম,
‘নিন।’

উনি ক্যাচ নিয়ে নাইটি মেলে ধরে বললেন,
‘নাইটি!’

উনার চোখে মুখে বিস্ময়।

‘কিছু পরতে চেয়েছেন তাই দিয়েছি। আপনার সাথে আমার বিয়ে না হওয়াই ঠিক ছিল।’

উনি বিছানা থেকে সিঙ্গেল কম্বল টেনে গায়ে জড়াতে জড়াতে বললেন,

‘উঁহু, মোটেও ঠিক ছিল না। অনেক ঝামেলা হতো তুমি আমার না হলে।’

‘কী হতো।’

উনি আমার কাছে এসে কানের সাথে ঠান্ডা ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বললেন,
‘তোমাকে পাওয়ার আন্দোলনে ছেয়ে যেত এ শহর।
চারদিক শ্লোগানে মুখরিত হতো “তোমাকে চাই”

‘যত্তসব পাম দেওয়া কথা। আপনার কাছে আমি মোটেও স্পেশাল না। একটুও বিশেষ কেউ না। কিছুও মনে থাকে না আপনার।আজ নাকি…’ এটুকু বলতেই আচমকা শিউরে উঠলাম। উনি আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উনার কম্বলের ভেতরে নিয়ে নিলেন। জামা সরিয়ে ঠান্ডা হাত পেটে চেপে ধরলেন। এমন অদ্ভুত কাজ কেউ করে! সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলাম। এই শীতে কেউ ঠান্ডা বরফের মতো হাত কারো পেটের উপর রাখে! আমি সাথে সাথে বকাঝকা করে উঠতেই উনি আমাকে থামিয়ে দিলেন।কোমরে পুরুষালি হাতের শক্ত বাঁধন পড়ল।গালে ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিলেন গাঢ় ভাবে।নেশালো কন্ঠে বললেন,

‘আজ নাকি ফাগুন এটাই বলতে চাইছিলে তো? তুমি আমার বারো মাসই ফাগুন।আলাদা ফাগুনের প্রয়োজন নেই আমার।আজ এ শহর কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে সেজেছে। সেজন্য সুন্দর লাগছে। শহরের কাছে নির্দিষ্ট কারণ আছে সুন্দর লাগার।আমার কাছে তোমাকে ভালো লাগার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই, কোনো যুক্তি নেই। শুধু জানি আমার বসন্তে ফুল ফোটে তোমার নামে, ফাগুন হাওয়ায় মন মাতোয়ারা অদ্ভুত সুবাস নাকে আসে তোমার ঘ্রাণে। ফাগুনের শুভেচ্ছা প্রণয়িনী।আমি ভুলিনি তোমাকে শুভাচ্ছা জানাতে।শুধু তোমার অভিমান দেখার অপেক্ষা করছিলাম। আদর করে রাগ ভাঙানোর সুযোগ খুঁজছিলাম।’

আকাশে এক খন্ড সাবানের ফ্যানার মতো সাদা মেঘ। তার মাঝে অর্ধখন্ডিত চাঁদ। যেন কেউ নিখুঁত হাতে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করেছে।চারিদিকে জোনাক পোঁকার মতো তারা মিট মিট করে জ্বলছে। সেই সাথে চাঁদের সোনালি আলো কিরণ ছড়াচ্ছে ধরণীতে।আকাশ জুড়ে চাঁদ তারার মেলা। আর সেদিকেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ছে। একটা রেখে আরেকটা সিগারেট ধরাচ্ছে। একান্তে সময় কাটাতে লেকের পাড়ে গিয়ে বসেছে।বিষাদের যন্ত্রণা একাকি ছাড়া ভোগ করা যায় না। মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ছে আর আকাশের পানে তাকিয়ে বলছে,
‘তুমি কি কোনদিন আমার হবে না মায়াবিনী? তুমি আমার না হওয়া প্রেম, না হওয়া ভালোবাসা, যে কাছে আসার আগেই আমাকে পুড়িয়েছ সহস্রবার। যদি আমারই না হবে তাহলে আবার কেন দেখা হলো আমাদের? কেন এতগুলো বছর পর আবারও আমার সামনে এলে? না পাওয়ার যন্ত্রণা কত ভয়াবহ তুমি বুঝবে না মায়াবিনী। ‘

তরী কী ভাবছে তা কেউ জানে না। এ বিষয়ে তরী আর কোনো কথা বলেনি। কখনো বলবে কি না কেউ জানে না। তরী কষ্ট পেয়ে পেয়ে পাথর হয়ে গিয়েছে। তাই প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি ওর নেই। বাকিটা আল্লাহ জানে।

কেটে গেল আরো কতগুলো দিন। বসন্তের শেষের দিকে।

চলবে….