প্রমত্ত অঙ্গনা পর্ব-৩৫+৩৬

0
361

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(৩৫)

আঁখি আদৃত আবারও হাসপাতাল চলে আসলো,আদৃতের মনের সব রাগ ধুয়ে গিয়ে পেলো সুখের ঠিকানা,আঁখিকে আবারও ফিরে পেয়েছে সে,আর খুব জলদি তাকে নিজের করে জীবনে নিয়ে আসবে,আশায় ভরে উঠল মন।অপরদিকে আঁখির মনের সুখের দোলা দোলছে,এতবছর পর আবারও নিজের সত্য ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েছে সে,তবে মনে আছে বেশ দ্বিধাদ্বন্দও,এতো কিছুকে অদেখা করে কিভাবে সে আদৃতের জীবনের সাথে জড়িয়ে যেতে পারে,আদৃত তো তাকে দু’দিনের সময় দিয়েছে তবে সে কি পারবে দু’দিনের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে?না আংটিটাও খুলে নেওয়ার ক্ষমতা কুলিয়ে উঠতে পারবে না আঁখি।এতবছর পর ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেয়ে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।

হাসপাতালে আসতেই দু’জনের উপর পরল আবার অজস্র কাজের চাঁপ,আদৃত তাড়াতাড়ি তার সকল কাজ সেরে নিচ্ছে, আঁখির সাথে সে কিছু সময় কাটাতে চায় একান্তে, তার মনে জমে থাকা অজস্র কথা তাকে জানাতে চায়।

আঁখির হঠাৎ একটা কাজ পরে ডা.আশরাফ খানের সাথে।উনার কেবিনের সামনে গিয়ে দরজায় নক করবে তখনি ভিতরে ইন্সপেক্টর জিসানকে দেখতে পায়,আশরাফ খানের বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে আছে সে,দরজা বেশ খানিক খোলা থাকায় তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলো আঁখি।আঁখি ভিতরে না গিয়ে বরং বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল।

″হুম ইন্সপেক্টর জিসান,তা আপনার এখানে আসার কারণ জানতে পারি?″

″ডা.আশরাফ খান,আমি এখানে এসেছি অনেক জরুরি একটা প্রয়োজনে।″

″কি সাহায্য করতে পারি আমি আপনার?″

″ড্রাইবার মফিজ মিয়াকে তো আপনি চিনেন?শুনেছি উনি আপনার বাড়িতে আগে ড্রাইবার হিসেবে ছিলেন।″

″হ্যাঁ ও অনেক ভালো লোক,অনেক বিশস্তও,আমার বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে,কিন্তু গত ৪ বছর আগে ও হঠাৎ আমার চাকরি ছেড়ে দেয়,কারণ জিজ্ঞেস করলে তেমন কিছু বলতে চায় না,কিছুদিন পর জানতে পারি সে তার পরিবার নিয়ে তার দেশের বাড়ি চলে যায়।″

″সে জায়গাটা কোথায় বলতে পারবেন?″

″যতটুকু জানি ওর আসল বাড়ি বরিশালে,কিন্তু সঠিক জায়গা বলতে পারব না।″

″উনার কোনো আত্নীয় আছে এখানে আপনার পরিচিত?বা এমন কাউকে চিনেন যেখানে উনি কাজ করতেন?″

″না,এমন কাউকে আমি চিনি না,আর ও আমাদের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও চাকরি করে নি কখনও।তা আপনি এতসব কেন জানতে চাইছেন?″

″আপনাকে আমি বেশি কিছু বলতে পারব না,তবে এটুকু বলতে পারব যে একটা কেসের জন্য উনার খোঁজ করছিলাম আমি,কিন্তু উনার ঠিকানায় এসে জানতে পারলাম উনি এখন আর সেখানে থাকেন না।আচ্ছা চলি তাহলে।″

জিসানকে উঠে আসতে দেখে আঁখি সেখান থেকে সরে দাঁড়ালো, জিসান তাকে না দেখেই চলে গেল।আঁখি মনে মনে এক গভীর ভাবনায় ডোব দিল।
____________

আদ্রিশ কক্ষে প্রবেশ করল দূর্বল শরীর নিয়ে,ম*দে*র নেশায় মশগুল হয়ে এসেছে,শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত তার,অবশ্য চিকিৎসা নিয়ে এসেছে,রিদিকা তখন বিছানায় বসে ছিল,আদ্রিশকে উক্ত অবস্থায় দেখে রিদিকা বিচলিত হয়ে তার পাশে ছোটে আসলো।

″কি হয়েছে আদ্রিশ তোমার?তোমার শরীরে এসব ব্যন্ডেজ কিসের?″

রিদিকা আদ্রিশের ক্ষতগুলোতে হাত বুলিয়ে কথা বলতে লাগলে আদ্রিশ তাকে সজোরে এক ধাক্কা দেয়,যাতে সে ছিটকে ফ্লোরে গিয়ে পরে।এবার আদ্রিশ গর্জে উঠে বলতে লাগে।

″বা*জে,নোং*রা নারী আমার পাশে আসার চেষ্টাও করবি না,আজ তোর জন্যই আমার এ হাল,তোর দিকে তো তাকাতেও ইচ্ছে করে না এখন আমার।″

″তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ আদ্রিশ,আমি শুধুই তোমার,আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে, তুমি যা দেখেছ সব বানোয়াট।″

″জানিনা কি বানোয়াট কি সত্য,কিন্তু যেদিন তোকে হাতেনাতে পেয়ে যাব সেদিন তোর আমার বাড়িতে শেষ দিন হবে,এখন সর আমার চোখের সামনে থেকে।আমার সামনেও পরবি না বলে দিলাম।নিজেকে যদি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারিস তবে আমার কাছে আসিস ভেবে দেখব তোর কথা।″

″ও তাই,আমার কোনো দোষ আছে কি না তার প্রমাণ ছাড়াই আমাকে দোষী মানলে,আমার সাথে বাজে ব্যবহার করছ,আর ওই আঁখি,যে কি না তোমাকে এতো অপমান করল,তোমাকে মারলো ও,তোমার পরিবারকেও নিয়ে গেল,তারপরও ও ভালো,বড় তো সেদিন চেঁচিয়ে বলছিলে ওর নামে কেস দিবে,কোথায় কি করলে শুনি?″

আদ্রিশ তেড়ে গিয়েই এবার রিদিকার থুতনী চেঁপে ধরল।রাগে ক্ষোভে ক্ষেপে উঠে বলে এবার।

″ওই নোংরা মুখে যদি আর একবারও আমার আঁখির নাম নিয়েছিস তবে ওই মুখ সেলাই করে দিব আমি,রাগে বলেছিলাম বলে আমি আমার আঁখির বিরুদ্ধে যাব কি করে ভাবলি তুই!আমি ওকে ভালোবাসি,ও আমাকে প্রাণে মেরে ফেললেও ততটাই বেসে যাব,আমার তো ভুল হয়েছে তোর মতো নোং*রা*কে এনে ঘরে তোলা,তকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া,সত্যি বলতে আমি তোকে কখনও ভালোবাসি নি, তোর প্রতি আমার ছিল অল্প ভালোলাগা,তোর ডং করা নম্র ভদ্র ব্যবহারে আমি অল্প আকর্ষিত হয়েছিলাম তোর প্রতি,তোর সৌন্দর্য আর শরীর কেমন জানি টানত আমাকে তোর কাছে,তাই তোকে পেতে চেয়েছিলাম,কিন্তু কেন জানি তোকে বিয়ে করতে গেছিলাম!তোর মতো নোংরাকে বিয়ে ছাড়াও তে ভো*গ করতে পারতাম, কিন্তু না মোহকে আমি ভালোবাসা ভেবেছি,কিন্তু এখন বুঝতে পারছি,সত্যি বলতে এখন আর তোর প্রতি কোনো আকর্ষণ আসে না আমার।তোর কাছে আসতেও কেমন জানি বিচ্ছিরি অনুভুতি আসে,তোকে তো দেখতেও মন চায় না।সর আমার চোখের সামনে থেকে।″

রিদিকাকে আবারও প্রবল ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেল আদ্রিশ তার কক্ষের বাইরে।
_____________

″আচ্ছা চলি ডা.আদৃত,আর কালকে দেখা হচ্ছে।″

″এই যে আঁখির মিস্টার ড্রাইবার আপনার ম্যাডাম আজ বাড়ি আসবেন না বাড়ি চলে গিয়ে বলে দিবেন বাকি সবাইকে,এবার যান আপনি।আর ডা.সাহেবা আপনি বরং আমার সাথে চলুন।″

″দেখুন রাত হয়ে গেছে বাড়ি যেতে হবে।″

″আমি কোথায় বলছি এখন দিন,আর আমিও তো তোমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।″

″আপনার বাড়ি!″

″হ্যাঁ বাড়িটা আমার কিন্তু কিছুদিন পর তোমারও হবে।″

″এতো কনফিডেন্ট!অভার কনফিডেন্ট কিন্তু ভালো না।″

″আহনাফ আদৃত মির্জার কনফিডেন্ট কখনও সস্তা বা লোক দেখানো হয় না।″

″ফ্লার্ট করছেন আমার উপর?″ভ্রু নাচিয়ে বলল আঁখি।

″আমি তো ভালবাসা প্রকাশের অল্প প্রচেষ্ঠা করছি মাত্র,কেউ ফ্লার্ট মনে করলে আমার কি করণীয়,তবে যাই করছি নিজের হবু স্ত্রীর সাথেই তো করছি।″

আলতো স্বরে মিনমিনিয়ে আঁখির চোখে চোখ রেখে আদৃতের বলে যাওয়া কথা আচমকা এক লজ্জায় ফেলে দিল আঁখিকে,মুচকি হেসে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল।

″আপনি বড্ড ফাজিল হয়ে গেছেন,নিরামিষ ছিলেন সেটাই ভালো ছিল।″

″হুম চলুন এবার,মা বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে,আজ থাকতে হবে তোমায় আমাদের বাড়িতে।
তবে চলুন আমার মায়ের ছেলের হবু বউ,থুক্কু ডা.আঁখি।″

″আপনি সত্যিই বড্ড পাজি হয়ে গেছেন।″

কথাটা বলে আঁখি লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে আর আদৃতের দিকে না তাকিয়েই গাড়িতে উঠার জন্য দরজা খোলতে হাত বাড়াবে তার আগে আদৃত এসে হালকা টানে দরজাটা খুলে দিল।

″এবার ভিতরে যাও।″

আঁখি উত্তরে মৃদু হেসে ভিতরে ঢুকে গেল।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে,আজকে আদৃতের চেহারা থেকে হাসি যেন নামছেই না,আলতো এক বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণে স্থির রেখে গাড়ি চালাতে মনোনিবেশ করেছে আদৃত,আঁখি লক্ষ্য করছে তাকে খুব তীক্ষ্ণ নজরে।ফর্সা চেহারাতে খোঁচা দাঁড়ি তার বড্ড মানানসই,বাইরের বাতাস তার চুল দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, আজ বাতাসের সাথেও বেশ হিংসে হচ্ছে আঁখির,প্রেমিক এই পুরুষের সানিধ্যে নিজেকে ছাড়া সে কাউকেই মেনে নিতে যে চাই নি কখনও,হোক না কেন সে অস্তিত্বহীন কোনো কিছু।
আঁখির ধ্যানে বাঁধা দিয়ে সামনে দৃষ্টি স্থির রেখেই বলল আদৃত এবার।

″আমার কি নতুন করে রূপ ফুটেছে?″

″কেন?″

″না মানে,ছয় বছর পর আজ কাউকে আবারও বিমোহিত হয়ে তাকাতে দেখতে পেলাম অপলকে।″

″আড়চোখে আমাকে দেখছেন বুঝি!″

″আমার মন তো তোমারই পাশে,সে তো সর্বক্ষণ তোমাকেই দেখে যায়।″

″কথা শিখে গেছেন বড্ড।″

″তোমার সান্নিধ্যের পাওনা। তা গান শুনবে?″

″গান শোনা কখন থেকে পছন্দের তালিকায় এলো?″

″যখন থেকে প্রেমে পড়েছি তোমার। ″

আঁখি আবারও মৃদু হেসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল।আদৃতও মুচকি হাসিতে একটা গান বাজিয়ে দিল।

কি করে বলব তোমায়!
আসলে মন কি যে চায়,
কেন সে পালিয়ে বেড়ায়,তোমার থেকে।
তুমি জানতে পারো নি কতো গল্প পোড়ে যায়।
তুমি চিনতে পারো নি আমাকে হায়…

গানটির একপর্যায়ে আদৃত লক্ষ্য করতে পারে আঁখি কান্না করছে,সাথে সাথে গান বন্ধ করে গাড়ি আটকিয়ে আঁখির জন্য পেরেশান হয়ে উঠে।

″কি হয়েছে আঁখি?কাঁদছ কেন?″

″আমাকে কি আপনি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন?হয়ত আমার ভালোবাসার কাছে দমে গিয়ে আমাকে নিজের জীবনে ভরে নিতে চাইছেন,কিন্তু মন থেকে কি কখনও ক্ষমা করতে পারবেন?″

″কিসের ক্ষমা আঁখি?কি বলতে চাইছ তুমি?″

″এই তো,আপনি আমায় ভালোবেসে আর কাউকে জীবনে ভরে নিতে চান নি,এক আমিতেই সীমাবদ্ধ থাকলেন আপনি আর আমি অনায়াসে জীবনে এগিয়ে গেলাম,আসলেই আমার ভালোবাসায় খুঁত ছিল তাই তা পুর্ণতা পায় নি,নিঁখুত তো ছিল আপনার ভালোবাসা যা আমার ভালোবাসার কাছে মান হারিয়েছে।″

আদৃত এবার আঁখিকে টেনে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল।

″কখনও না আঁখি,এমনটা আর কখনও বলো না।তোমার ভালোবাসায় কোনো খুঁত ছিল না,বরং তোমার অসহায়ত্ব আর দূর্বলতার সুযোগ আদ্রিশ নিয়েছে এতে তোমার কোনো দোষ ছিল না।″

″জানেন আপনি যখন চলে গেছিলেন তখন আমি অনেক ভেঙে পরেছিলাম,কোথাও গিয়ে মনের শান্তিটুকু পেতাম না,ভাইয়া বাবার সাথে ফ্রি থাকলেও তখন তাদেরও কিছু জানাতাম না,কারণ আমি জানতাম এসব জানালে উনারা আমার সুখের জন্য আপনাকে আমার কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন,যা ব্যাঘাত ঘটাত আপনার সুখের জীবনে,আঙ্কেল আর বাবার সম্পর্ক নষ্ট হতো।তখন একমাত্র আদ্রিশই ছিল যার সংস্পর্শে শান্তি খোঁজে পেতাম,মনের শান্তির লোভে তার সাথে থাকতাম প্রায় সময়,সে সত্যিই তখন আমার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার পাশে চলে এসেছিল,ওকে ছাড়া থাকতেই পারতাম না,ও আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছিল,যখনই আপনার স্মৃতি আমাকে জ্বা*লা*ত*ন করত ছোটে যেতাম ওর কাছে,ওর প্রতি একটা টান সৃষ্টি হয়েছিল আমার মনে,জানিনা সেটা ভালোবাসা ছিল না কি অন্য কিছু,কিন্তু ওকে আমি হারাতে চাই নি,মন ভাঙার ব্যথা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা আপনাকে হারিয়ে বুঝেছি,তাই সে ব্যথা আমি দ্বিতীয়বার সহ্য করার ক্ষমতা জুটিয়ে উঠতে পারি নি।মনের শান্তির পরিণামস্বরুপ ওকে পেতে স্বার্থপর এর মতো সব ত্যাগ দেই আমি।আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আপনি?″

″পাগলি কি যে বলে।ওই আদ্রিশ তার কর্মফল নিশ্চয়ই পাবে,এখানে তোমার কখনও কোনো দোষ ছিল না,তাছাড়া আমার সুখপাখির মুখে ক্ষমা চাওয়া আমি কখনও মেনে নিব না।দেখো তোমার কান্নায় আজ আকাশটাও কান্না করে দিয়েছে,চলো না এই বেদনার জলে দু’জন সুখ মাখাই।আজ যে আমার এই নিরামিষ মনটাও উতলা সে বৃষ্টির জলে নেচে উঠতে চায় আঁখি তোমার সনে,ভিজবে কি আজ আমার সাথে?″

″আঁখির চোখের জল মুছে তার দিকে হাত বাড়িয়ে প্রস্তাবটা দিল আদৃত।″

চলবে…

#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(৩৬)

আঁখি নির্দ্বিধায় আদৃতের হাতে হাত রাখল।অতঃপর দু’জন বৃষ্টির তালে তাল মিলাতে এগিয়ে গেল।আঁখির চেহারায় ফুটে উঠল আবার চওড়া হাসি,হাত মেলিয়ে গায়ে মাখিয়ে নিতে লাগল আকাশের বুক থেকে আগত জলের অজস্র বিন্দুকণা,বৃষ্টির প্রতিটা কণা আজ তার মনে সুখের দোল দোলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, নিজের সাথে করে যেন নিয়ে যাচ্ছে আঁখির মনের সকল বিষাদের ছোঁয়া,সকল তিক্ত অনুভুতি। আপলকে তাকিয়ে আছে তার প্রেমে মশগুল যুবক তার পানে।যতবার এই রমণীকে দেখে সে ততবারই যেন নতুন করে তার প্রেমে মুগ্ধ হয়।এই এক রমণীর প্রেমে যেন জীবনের নাশটাও হাসিমুখে গ্রহণ করে যাবে সে।আজ বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না নিজের ভাগ্যে,অবশেষে কি তবে পেয়ে গেল সে তার সুখপাখিকে?সবকিছুই যেন এক সুন্দর সপ্নের মতো মনে হচ্ছে তার,ভয়ও আছে খুব–যদি ভেঙে যায় কবু সে সপ্ন।আঁখির হঠাৎ খেয়াল গেল আদৃতের দিকে, আলতো হেসে জিজ্ঞেস করে গেল তাকে।

″কি দেখছেন এভাবে দাঁড়িয়ে?″

″দেখছি আমার সুখপাখিকে, দেখছি তার অকৃত্রিম সেই হাসি যা এতোদিন তিক্ততার নিচে চাপা পরে ছিল।″

কথাটা শুনে আঁখির হাসি কোথাও যেন উধাও হলো আঁখি,মুহুর্তেই যে আবার মনে বিরাজমান হলো তিক্ত কিছু অনুভূতি, আদৃত বেশ অস্থিরতা নিয়ে এবার এগিয়ে এসে আঁখির দু’গাল নিজের দু’হাতের ফাঁকে আগলে ধরে বলল।

″না সুখপাখি,এই বিষাদ আর সহ্য করে উঠতে পারব না আমি তোমার চেহারাতে।″

″ভয় হয় এখন প্রাণ খুলে হাসতেও, যদি তা আবার মলিন হয়।″

″না পাখি,যতদিন বেঁচে আছি এই হাসি ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করব,ভয় পেয় না তুমি।″

″এতো সুখ আর ভালোবাসা কি কপালে সইবে আমার?″

″কেন বিশ্বাস হয় না এই পা*গ*ল প্রেমিকের প্রতি।″

″আছে,কিন্তু ভাগ্য যদি আবারও মোড় নেয়।″

″ভাগ্যের লিখন তো আমাদের কর্মে হয় আঁখি,আমরা একে অপরকে এতো ভালোবাসব যে আল্লাহ তায়ালাও আমাদের উপর উনার রহম বজায় রাখবেন,ইনশাআল্লাহ।″

″কথা দিন কখনও ছেড়ে যাবেন না।″

″কথা দিলাম।″

আঁখি অতি আবেগে জড়িয়ে ধরল আদৃতকে,আদৃতও জড়িয়ে ধরল তার সুখপাখিকে।অল্পক্ষণ পর আঁখির হুশ ফিরল,কি করে গেছে সে!একরাশ অস্বাভাবিকতা ভর করল তার উপর,লজ্জাময় একটা ভাব নিয়ে ছাড়িয়ে নিল আদৃতকে অতঃপর আদৃতের দিকে আর না তাকিয়ে গাড়ির দিকে চলে গেল বেগতিক পায়ে,আদৃত মাথা চুলকিয়ে অল্প হাসল অতঃপর সেও গাড়ির দিকে হাঁটা ধরল।
_______________

আদ্রিশের আজ ঝরছে চোখের জল,নে*শা*য় এতোটাই মাতাল যে সোজা হয়ে বসতেও পারছে না,তাও ছাঁদের একপ্রান্তে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে আকাশের পাণে একধ্যানে তাকিয়ে। মনে পরছে আঁখির সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো,ছাঁদের প্রান্তে বসে প্রায় রাতেই তার কাঁধে মাথা রেখে রাতের চাঁদ দেখার জেদ করত আঁখি,আজ বড্ড মনে পরছে তার আঁখির কথা,শরীরের টানে সে কত বড় ভুল করে গেছে তা আস্তে আস্তে উপলব্ধি করতে পারছে,মরিচিকার পিছন ছোটতে গিয়ে সে হিরে হারিয়ে বসেছে কি করে তা মেনে নিবে!আজ বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হচ্ছে তার।

ছাঁদের দরজার ধার ঘেষে আদ্রিশকে লক্ষ্য করছে রিদিকা।

″আমি জানি আদ্রিশ তুমি সবকিছু নেশার ঘোরে বলে গেছ,তুমি শুধু আমাকেই ভালোবাসো আদ্রিশ,তুমি দেখো আবারও আমার রূপের নেশায় পা*গ*ল হবে।রিদিকার রূপ অদেখা করে আজও কেউ যেতে পারে নি,আর এই রিদিকা তোমাকে নিজের রূপে বাঁধবেই।যাতেই বাঁধতে হোক না কেন,আমি তোমাকে বেঁধে রাখব,তোমাকে আমার হয়েই থাকতে হবে,তুমি হলে আমার হবে নইলে আর কারো না।″

মিন মিন করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজে নিজে কথাগুলো বলে স্বাভাবিক ভাবে স্থান ত্যাগ করল রিদিকা।

____________

বৃষ্টি থেমেছে সেই কবেই,আঁখি আদৃত মির্জা হাউজে এই মাত্র ঢুকল,আদৃত গাড়ি থেকে নেমে এসে আঁখির পাশের দরজা খুলে দিলে আঁখি নেমে পরল।

″এতো আদিখ্যেতা দেখানো ভালো না ডা.আদৃত।″

″ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম কখনও লোক দেখানো আদিখ্যেতার মধ্যে পরে না সুখপাখি।″

″তাই!″

″হুম।″

আঁখি আবারও আলতো হেসে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল।

″জলদি এসে কাপড় চেঞ্জ করুন নয়ত জ্বর চলে আসবে আবারও।″

″তুমি আগে আমার সাথে আসো আগে তোমায় কাপড় দেই,ভিজে তো তুমিও আছো।″

″আরে আমি ইশিকার থেকে নিয়ে নিব,আপনি কোথায় কাপড় পাবেন আমার।″

″আমি এনে রেখেছি।″

″মানে!″

″কারণ আজকে তোমাকে আচমকা মির্জা বাড়িতে নিয়ে আসব তা আমার আর মায়ের পূর্বপরিকল্পিত ছিল,সে হিসেবে কিনে আনা।″

″আপনিও যা পারেন।″

″হুম,এখন চলুন ম্যাডাম।″

দু’জনের কর্মকাণ্ড ছাঁদের উপর থেকে দেখতে পেলেন আরিয়ান মির্জা, আঁখির সাথে আদৃতের এমন মেলামেশা মোটেও মেনে নিতে পারলেন না উনি।

আঁখি আদৃত ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল।

″আরে আঁখি মা,আয় আয়, কতো সময় ধরে পথ চেয়ে বসে আছি।এ কি দু’জন দেখি ভিজে আছিস!আদৃত রুমে গিয়ে চেঞ্জ কর,আঁখি তুই আমার সাথে আয়।″

″ওর কাপড়?″

″আমি নিয়ে এসেছি তোর রুম থেকে।″

″কেন,আমি ওকে দিতে পারতাম না?″

″আরে ভাইয়া রাগো না,বিয়ের পর একান্তে যা শাড়ী চুরি দেওয়ার দিয়ে দিও,এখন না হয় তোমার জিনিস আমরাই দেই,হা হা।″

″কথাটা শুনে আঁখি মুচকি হেসে দেয়,আদৃত বেশ লজ্জায় পরে গিয়ে,তাড়া করে ইশিকাকে।″

″তকে না আমি।″

″মা দেখো না তোমার ছেলে আমায় মারতে আসছে।″

″হয়েছে যা এখন ফ্রেস হয়ে নে।আয় মা আয়।″
_____________

আঁখি কাপড় পাল্টে নিতেই ইশিকা আর শায়েলা মির্জা ওর কাছে চলে আসেন,বর্তমানে তিনজনই হরেক গল্পে মগ্ন,গল্পের এক পর্যায়ে বলল ইশিকা।

″আঁখি,দেখো না,বেড়াতে এসে দিনগুলো তাড়াতাড়ি চলে যায়,নিশার জন্মের দু’দিন পর এখানে এসেছিলাম চলে যাব আরও দু-তিনদিনে,আবারও মা বাবা একা পরে যাবেন,আমি তো সবসময় এখানে থাকতে পারব না,তোমার মনে হয় না ভাইয়ার বিয়ে করে নেওয়া উচিৎ? ″

″হ্যাঁ কেনো নয়,তা কনে দেখেছ?″

আদৃতের বিয়ে শুনে মনটা মোচড় দিয়ে গেলেও আঁখি স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলল।এবার জবাবে ইশিকা হেসে উত্তর দিলো।

″কনে তো আমরা সেই সাত বছর আগেই দেখেছি,এখন সে রাজি হলেই হলো।″

″কে সে?″

″আরে পাগলি একটা,কে হবে আবার সে।আমাদের সামনেই তো বসে আছে আমার একমাত্র ছেলে বউ।″

কথাটা শুনে আঁখি অবাকত্বের শির্ষে চলে গেল।

″কি বলছ মামুনি,আমি!কিন্তু আমি ডিভোর্সি এতে কোনো আসে যাবে না তোমাদের?

একটা চড় দিব আরেকবার যদি কথাটা বলেছিস,ডিভোর্স হয়েছে তো কি হয়েছে?তোর একটা চোখ কানা হয়েছে না দাঁত পরে গেছে,কোনটা?আর যদি এমনটা হতোও তারপরও তোকেই ছেলে বউ বানাতাম।এবার বল রাজি কি না?″

″আমার একটু ভাবতে হবে মামুনি।″

″আর কি এতো ভাবাভাবি,আমার ছেলেটা যে বুড়োর কাতারে চলে যাচ্ছে।″

″কি যে বলো মামুনি তুমি।″

″তো আর কি বলব বল,আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না,আমি বিয়ের সব ব্যবস্থা করছি।″

″না মামুনি এখন না।″

″কেন রে?″

″আসলে আমি এখন আর জীবনে এগুতে গেলে মা বাবা ব্যতীত এগুব না।আগেও আমার সংসার টিকে নি কারণ মা বাবার মনের অভিশাপে সন্তানের সুখ কখনও চিরস্থায়ী হতে পারে না।বাবা মায়ের দোয়া ব্যতীত কোনো সম্পর্কের শুরুই বৈধতা পায় না,এমনকি বিয়েও বৈধতা পায় না তা আমি আগে জানতাম না,আইনত বৈধভাবে এতদিন বিয়ে নামক বন্ধনে থাকলেও ধর্মানুযায়ী অবৈধভাবে ছিলাম,জানিনা এই পাপের পরিণামে কি পাব।দেরিতে হলেও বিষয়টা বুঝে গেছি আমি।″

″ও আচ্ছা তাহলে এই ব্যপার,চিন্তা করিস না,ভুল করে বান্দা অনুশোচনার সহিত সঠিক রাস্তায় ফিরে এলে আল্লাহ ঠিকই ক্ষমা করে দেন,আর কথা যেখানে তোর মা বাবার,তুই সব আমার উপর ছেড়ে দে,আমি দেখে নিব।″

″সত্যিই তুমি আমার বাবা মাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে?″

″তুই শুধু অপেক্ষা কর,আমি আছি তো।″

″হুম বুঝলাম, তা রিংকি কোথায়?″

″কি জানি বাড়ি ছেড়ে বিনা বাক্যে চলে গেছে।তবে যাই হয়েছে ভালোই হয়েছে,না গেলে আমিই বার করতাম।″

আঁখির মন আজ বড্ড খুশি,শায়েলা মির্জা আর ইশিকা একটু আগে কক্ষ ত্যাগ করলেন,বর্তমানে আঁখি হাতের আংটিটায় হাত বুলাচ্ছে আর ভাবছে আদৃতের কথা,মনে লেগেছে নতুন রং,নতুন শুরুর আমেজ,প্রথম ভালোবাসাকে দ্বিতীয় সুযোগে ফিরে পায় ক’জন, নিজেকে আজ ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে।জীবনসাথী হিসেবে আদৃতের মতো এমন একজন আর শ্বশুর বাড়ির লোকজন হিসেবে এতো সুন্দর একটা পরিবার কার কপালেই বা জোটে।আঁখির ধ্যান ভঙ্গ করে ফোনে আসলো হঠাৎ মেসেজ নোটিফিকেশন। আদৃত মেসেজ করেছে।

″সুখপাখি ছাঁদে আসো,চাঁদ দেখব একসাথে।″

″আর যদি না আসি।″

″একটু অধিকার খাটিয়ে হয়ত নিয়ে আসার প্রচেষ্ঠা করব,কোলে উঠানোর ক্ষমতা আমার এখনও যায় নি কিন্তু। ″

″আমি কিন্তু আগের সেই পিচ্চি আঁখি নই যাকে কোলে নিয়ে জব্দ করার চেষ্টা করবেন আপনি।″

″আমার আঁখি তো আমারই,হোক না কেন সে কোনো পিচ্চি মেয়ে, নয়ত বোঝদার,থাকবে তো আমার কাছেই আমার প্রিয়সী হয়ে।″

″হয়েছে আর কথার ফুল বাঁধতে হবে না,দাঁড়ান আমি আসছি।″

মুখ ভরা হাসি নিয়ে খুশি মনে এবার ছাঁদের পানে হাঁটা ধরল আঁখি কিন্তু হঠাৎ সামনে প্রকট হলেন আরিয়ান মির্জা।

″আরে আংকেল আপনি?″

″তোর সাথে কিছু কথা ছিল আঁখি।″

″হুম আংকেল বলুন?

″একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।আমার সাথে চলো।″

″হুম,চলুন।″

আরিয়ান মির্জা আঁখিকে নিয়ে একটা কক্ষে গেলেন,সেখানে উনি প্রায়ই বসে বই পড়েন এছাড়াও বিভিন্ন জিনিস লেখালেখিও করেন।সরকারি ভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন উনি দীর্ঘবছর, অবসরের সময়টা এখন ভালোই কাটে।

সেই কক্ষের একটা সোফায় উনি নিয়ে বসতে বললেন আঁখিকে,নিজেও তার ঠিক সামনের সোফার দিকটায় বসলেন।

″কি বলবেন আংকেল বলুন?

″দেখ মা,তোর বাবা আমার অনেক ভালো বন্ধু।প্রফেশনাল লাইফে আসার পর থেকেই ওর সাথে আমার পরিচয়।তাছাড়া এই সম্পর্ক আরও গভীর হয় তুই ইশিকার সাথে বন্ধত্ব গড়ে তোলার পর থেকে,তাছাড়া তুই প্রায়ই আমাদের এখানে আসতি,ভালোই লাগত আমার তা,তোর বাবা আর আমি ভেবে নিয়েছিলাম আদৃত আর তোর বিয়েটা করিয়ে দিব,এতে করে আমাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হবে।সব ঠিকঠাক ছিল,কিন্তু না জানি কি থেকে কি হয়ে গেল।আদৃত হুট করে আমেরিকা চলে গেল,তারপর থেকে যতবারই ওর সাথে তোর কথা বলতে চেয়েছি ততবারই এটা ওটা বলে কথা ঘুরিয়ে গেছে।তিনবছর আগে যখন তোর বাবা তোর আর আদৃতের বিয়ের কথা বলেছিলেন আমায় তখন আমি আদৃতের সাথে এ নিয়ে কথা বলার পূর্বেই জানতে পেলাম তুই আদ্রিশকে পছন্দ করিস,আদৃতকে বিয়ে করতে চাস না।সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম আমি,কিন্তু সবার জীবনে নিজেদের পছন্দ থাকতে পারে এতে কোনো দোষ বলে মনে হলো না আমার।কথাটা এটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিল আঁখি,কিন্তু এখন কিছুই ঠিক হচ্ছে না।″

″ঠিক হচ্ছে না মানে?আপনি কি বলতে চান আংকেল একটু বুঝিয়ে বলবেন?″

″দেখ আঁখি তুই আমায় ভুল বুঝিস না,তুই অবিবাহিত থাকলে মানা যেত,কিন্তু তুই ডিভোর্সি,আর এদিকে আদৃত অবিবাহিত, এ নিয়ে সমাজে কতটা কথার সামনে পড়তে হবে আমাদের বুঝতেই পারছিস,জীবনে তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্মান কি করে ধোলায় মিশে যেতে দেই অল্পতে।তাও তোর কথা মাথায় রেখে মেনে নিতাম কিন্তু উপর থেকে তুই কখনও মা হতে পারবি না,এদিকে নিজের বংশধর আজকাল কে বা না চায় বল।আদৃত শায়েলা তো অতি আবেগী তাই ওসব ভাবছে না,কিন্তু যখন সমাজের সামনে পরবে তখন হয়ত তাদের ভাবনাও তেমনই হবে,এবার তুই বল সব জেনে শুনে কি তুই জীবনে দ্বিতীয়বারও ভুল করে জাবি।″

কথাগুলো আঁখির বুকে তীরের ন্যায় আঘাত করল,তবুও পাথর ভঙ্গিতে বসে রয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল।

″আমি বুঝতে পারছি আংকেল আপনি কি বলতে চাইছেন,আপনি চিন্তা করবেন না,আপনাকে নিরাশ করব না আমি।″

কথাটা বলে ছুটন্ত পায়ে চলে আসল নিজ কক্ষে আঁখি,অতঃপর দরজা লাগিয়ে মুখ চেঁপে কান্না করে দিল।

চলবে…