#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(৩৯)
আঁখি নিজের কক্ষে নিজেকে বন্ধ করে কেঁদে চলেছে নিঃশব্দে।বাম হাতের অনামিকা আঙুলের দিকে তাকাতে যেন কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল আঁখির।
″আমি ওটা খুলতে চাই নি ডা.সাহেব,সত্যিই ওটা খুলতে গিয়ে আমার বুকটা কেঁপে উঠেছিল তখন,আপনার ভালোবেসে দেওয়া যেকোনো অংশই যে আমার কাছে অমূল্য,আংটিটা যে মনে করিয়ে দিত আমায় আমি আপনাকে ফিরে পেয়েছি আবারও,কিন্তু হয়ত ভাগ্য তা চায় না,তাই তো চেয়েও আমি ধরে রাখতে পারি নি আপনাকে,আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
কেন সেদিন আমাকে ভুল বুঝে চলে গেলেন?সেদিন আপনি যদি এভাবে পিছু পরতেন,আমাকে পাওয়ার সংগ্রাম করতেন তবে আজ হয়ত আমরা এমন জায়গায় থাকতাম না।কেন এমনটা হলো আমাদের সাথে?″
আদৃত বাড়িতে পৌঁছাল, পা যেন তার চলছেই না,আঁখিকে ফিরে পাওয়ার কোনো দিশা পাচ্ছে না সে,না তো বেঁচে থাকার কোনো মানে খোঁজে পাচ্ছে। তখন আরিয়ান মির্জা ড্রয়িংরুমে বসে আদৃতের অপেক্ষা করছিলেন,মা দরজার আশেপাশে করছিলেন পায়চারী।আদৃতকে দেখে মা ছোটে গেলেন তার কাছে,বাবাও উঠে দাঁড়ালেন।
″বাবা তুই ঠিক আছিস তো?ঝড়ে ভিজেছিস কেন?তোর তো ঠান্ডা লেগে আছে এমনিতেই,কক্ষে চল।″
″তুমি সরো শায়েলা আমাকে কথা বলতে দাও ওর সাথে।″
″কোথায় গিয়েছিলি আদৃত?″
আদৃত অশ্রশিক্ত চোখ তুলে বসে যাওয়া কন্ঠে উত্তর দিলো।
″আঁখির কাছে গিয়েছিলাম বাবা,ফিরিয়ে দিয়েছে।″
″দেখলি তো,দেখ আদৃত আঁখ প্রতিষ্ঠিত আছে ওর জীবন নিয়ে কী চিন্তা আর, তুইও এখন জীবনে এগিয়ে যা।″
″আমার এগিয়ে যাওয়ার না তো আছে কোনো ইচ্ছে আর না তো আমি বাধ্য,আমি বিয়ে করলে আঁখিকেই করব,নয়ত অবিবাহিতই মরব,এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।″
কর্কশ গলায় জবাব দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলে আরিয়ান মির্জা বললেন।
″এমনটা হলে তোকে আমার আর আঁখির মধ্য থেকে একজনকে বেঁচে নিতে হবে আদৃত।″
বাবার কথায় থমকে দাঁড়াল আদৃত,অবাক হয়ে তাকালো বাবার মুখের পানে।
″দু’জনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে, মানে কি বোঝাতে চাইছ বাবা!″
″এটাই যে তুই আঁখিকে জীবনে আনতে চাইলে আমাকে ছেড়ে দিতে হবে।তুই নিজেকে আমার ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে পারবি না,আমি ভাবব তুই কখনোই আমার জীবনে ছিলি না,আর তুই যদি আমাকে বেছে নিস তবে তোকে আঁখিকে ভুলে যেতে হবে,আর আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।এখন বল,এখনও যদি তোর আঁখিকে চাই তবে চলে যা আমি তোকে আটকাব না।″
″তোমাকে বলার মতো ভাষা আমি হারিয়ে গেছি বাবা।যাকে আমি জীবনে আদর্শ মানতাম সেই এমনটা করল আমার সাথে।তোমার কাছ থেকে আমি এটা আশা করি নি বাবা,গর্ব করে বলতাম আমার বাবা কখনও নিজের ইচ্ছে আমার উপর ছুঁড়ে ফেলে না,উনি আমার বাবার থেকেও বেস্ট ফ্রেন্ড বেশি,কিন্তু আফসোস।
চিন্তা করো না বাবা,তোমাকে নিরাশ করব না,আমার কারণে তোমার সম্মান কখনও যাবে না,আর আমি এমন সন্তান যে পৃথিবী আমার বিপরীতে চলে গেলেও আমি কখনই মা বাবার অবাধ্য যাব না,তাদের ছেড়ে যাব না,তবে আমি আঁখিকেও ছাড়তে পারব না,কিন্তু উভয় জিনিসের সমাধান আমি দিবই।″
অতঃপর নিজের কক্ষের দিকে চলে গেল আদৃত,শায়েলা মির্জা পিছন গেলেন,আদৃত কক্ষে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল,শায়েলা মির্জা বাইরে থেকে ডেকে যাচ্ছেন ওকে।
″বাবা আমার কথাটা শুন,তোর বাবার কথা শুনিস না,বুড়ো বয়সে পাগল হয়েছে,তুই বেড়িয়ে আয়,আমি তোর বাবার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে দিব,তুই আয় মায়ের কাছে।″
আদৃত ভিতরে ঢুকেই এটা ওটা ভাঙতে শুরু করেছে অতিরিক্ত রাগে,ভাঙার এক পর্যায়ে হাঁটু গেড়ে বসে পরে ফ্লোরে, হাতের মুঠোতে এখনও আঁখির ফিরিয়ে দেওয়া সেই আংটি,আংটিটার গায়ে চুমু দিয়ে এবার অনেক শব্দ করে কেঁদে উঠল।
″কেন আল্লাহ ওকে আমার কপালে রাখলেন না?তাই বুঝি কখনও কাউকে অবহেলা করতে নেই,কখনও না বুঝে অবহেলা করেছি ওকে আজ বুঝতে পারছি তখন আমার অবহেলায় ওর কতটা খারাপ লাগত,আমি ওর অবহেলা আর নিতে পারছি না,আমি বাঁচব না ওকে ছাড়া,ও যখন ভাগ্যেই ছিল না তবে কেন আনলেন ওকে আমার জীবনে?কেন?ওকে কি ভিক্ষে হিসেবেও আমাকে দেওয়া যায় না?″
এতসময় শায়েলা মির্জা কক্ষের ভিতরের ভাঙাচোরার শব্দের সহিত আদৃতের কান্নার শব্দও অনেকাংশেই শুনতে পারছিলেন বাহির থেকে,কিন্তু এখন কিছুই শুনতে পারছেন না,কক্ষ টা কেমন জানি নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।শায়েলা মির্জার মনে চলতে শুরু হয়েছে আশঙ্কা, মায়ের মনের এ আশঙ্কা যেন বলে দিতে পারছে অনেক কিছুই,এবার উনি চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করলেন।
″আদৃত,বাবা কী হয়েছে?চুপ করে গেলি কেনো?দরজা খোল।″
″কে কোথায় আছো,জলদি আসে আমার ছেলে দরজা খুলছে না,কেউ আসে,আমার ছেলে না আবার কিছু করে যায়।″
ঘরের সবাই সেখানে ছোটে আসলেন,সবাই আদৃতকে ডাকছেন তবে কেউ সাড়া শব্দ পাচ্ছে না তার।সবাই এতে ঘাবড়ে যায়,বাকিরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করলেও সিয়াম ঘরের বাইরের দিকটায় বেড়িয়ে আদৃতের কক্ষের নিচে যায়,অতঃপর আদৃতের বারান্দা দিয়ে ঢোকে,বারান্দার দরজা খোলা থাকায় সহজে কক্ষে প্রবেশ করে যায়।
আদৃত বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে,চোখ দু’টো লাল বর্ণ ধারণ করে গেছে,ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে আর বার বার বিছানার চাদর খামছে ধরছে।সিয়াম লক্ষ্য করল নিচে একটা খালি প্যাকেট পরে আছে,সিয়াম ছুটে গেল আদৃতের কাছে।
আঁখি নিজেকে শান্ত করে নিয়েছে।জাহানারা মা আর শুভ্রতা,আদিলকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ করবে বলে।
″ভাইয়া আপনি বিজনেসটা চালিয়ে যান সবকিছু আমি দেখব,যা লাগে বলবেন আমায়।মা আপু তোমাদের যা লাগে আমার কর্মচারীদের দিয়ে আনিয়ে নিবে,আমি ওদের সবকিছু বুঝিয়ে বলেছি তোমাদের এখানে কোনো সমস্যা হবে না।″
″কেন আঁখি?কোথায় যাচ্ছো তুমি?″
″আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব ভাইয়া,দু’দিন আর আছি মাত্র,কিছু প্রয়োজনীয় কাজে দু’দিন দেরি করা।″
″কেন রে বোন আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?″
″তোমাদের ছেড়ে যাওয়ার তো কোনো ইচ্ছে নেই ভাইয়া,কিন্তু যেতে হবে,চিন্তা করো না প্রতিনিয়ত তোমাদের খোঁজ নিব।″
″অভীমানটা বুঝি আমাদের সাথে, তাই চলে যাচ্ছিস?″
তিনবছর পর মায়ের গলার স্বর চিনতে মোটেও ভুল হয় নি আঁখির,পিছন মুড়ে সয়ং মাকে দেখতে পেয়ে নিজেকে আটকে রাখতে পারল না,ছোটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল।
″মাম্মাম তুমি এসেছ!ক্ষমা করে দিয়েছ আমায়?আর মুখ ফিরিয়ে নিবে নাতো।″
″কেন তোর কি মনে হয় আমি এতই পাষাণ!তোর বাবাকে যথেষ্ট সম্মান করি তাই উনার সম্মানের উপর দিয়ে তোকে বুকে টেনে নিতে পারি নি,কিন্তু আজ আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না,আমি তো জানতামই না তুই আমাদের হাসপাতালে জয়েন করেছিস,কিন্তু আজ যখন জানতে পারলাম ওই বাপ বেটার কারণে আমার মেয়ে এতো কষ্ট পেয়েছে তখন আর নিজেকে আটকাতে পারি নি,ছোটে চলে এসেছি।″
″বাবা আর ভাইয়া আসে নি?″
″দাদু দিদুও এসেছেন।″
পিছন থেকে আঁখির দাদু আমিন খান বলে উঠলেন।
আঁখি তাকিয়ে দেখল মাইশা ব্যতীত পুরো খান বাড়িরই সেখানে উপস্থিত।
আঁখিকে আবাক করে দিয়ে তার বাবা বললেন।
″ভুল তো সন্তানেরা করতেই পারে কিন্তু তার মানে এই নয় বাবা মা তাদের সন্তানকে খারাপ সময়ে একা ছেড়ে দেয়।আমায় ক্ষমা করে দিস মা,দম্যের নিচে মেয়ের ভালোবাসা দমাতে গিয়েছিলাম,তবে ভুলে গিয়েছিলাম দিনশেষে এই বাবা তার মেয়ের কাছেই পরাজিত, আসবি না বাবার বুকে,বুকটা যে আজ তিনটে বছর ধরে হাহাকার করছে।″
আঁখি ছোটে চলে গেল তার বাবার বুকে।
″আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা,আমি আর কখনও তোমাদের অবাধ্য যাব না,তোমরা যা বলবে আমি তাই করব,আমাকে ক্ষমা করে দাও।″
এবার আশরাফ খান আঁখির চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন।
″আমি কিন্তু আমার মেয়েকে দূর্বল হয়ে পরে কান্না করার শিক্ষা দেই নি।আর যেন কাঁদতে না দেখি।″
″হুম তো শুধু মা বাবাদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হবে না কি?আমিও তো বড় ভাই হই,আমার কাছে ক্ষমা চা,তাও পা ধরে।″
″তোর কাছে ক্ষমা চাইতে আমার বয়েই গেছে।″
″তবে দাঁড়া তোকে এখনই দেখাচ্ছি।″
″মাম্মাম দেখো না তোমার পাগল মহিষটা ক্ষেপে গেছে।″
আঁখির কথা শুনে সবাই হেসে দিলো,এমন খুনসুটি আঁখি আহিলের যে লেগেই থাকত,এবার হাসিমুখে এগিয়ে গিয়েই আঁখি আহিলকে জড়িয়ে ধরল।
″ক্ষমা করে দিস ভাইয়া আমার।″
″পাগলি একটা আমি কি কখনও তোর উপর রাগ করে বেশিদিন থাকতে পেরেছি।ক্ষমা করে দিস,তকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।″
তখনই আশরাফ খানের ফোন বেজে উঠল।
″হ্যাঁ সামিরা বলো।″
″স্যার ডাক্তার আদৃত বিষ পান করেছেন,উনাকে উনার পরিবার আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন,আমরা এমারজেন্সিতে উনাকে ঢুকিয়েছি,ডাক্তারেরা উনাকে দেখছেন।″
″ওকে আমি আসছি।″
″কি হয়েছে বাবা?″
″আদৃত সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে,ওকে এমারজেন্সিতে ঢুকানো হয়েছে।″
″কি!″
আর কিছু না বলেই আঁখি বাহিরের দিকে ছুটতে শুরু করল।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আরিয়ান মির্জা,চোখের পানি বয়ে চলেছে। আদৃতকে গাড়িতে করে নিয়ে আসার সময় আদৃতের জ্ঞান ছিল,সিয়াম গাড়ি ড্রাইব করছিল আর আদৃতকে শায়েলা মির্জা আর উনি উনাদের মধ্যেখানে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।তখন যখন কেঁদে কেঁদে আরিয়ান মির্জা বলেছিলেন।
″তুই কেন এমনটা করলি আদৃত?আমি তো এমন কিছু চাই নি?আমার সন্তানই না থাকলে আমি সম্মান দিয়ে কি করব?
″
তখন অনেক কষ্ট করে জবাব দিয়েছিল আদৃত।
″বাবা আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না,কিন্তু আঁখিকে ছেড়ে দেওয়ার সাধ্যও আমার নেই।প্লিজ আমায় বাঁচিয়ো না বাবা,কারণ বেঁচে থাকলে আমি আঁখির পিছু ছাড়ব না কখনও।″
কথাটা বলার পর জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিল আদৃত,এবার বুঝতে পারলেন আরিয়ান মির্জা সম্মানের দোহাই দিয়ে তিনি নিজের ছেলের প্রাণ চাইছিলেন তার কাছ থেকে,ছেলের এই অবস্থার জন্য নিজেই দায়ী কীভাবে মেনে নিবে বাবা।
শায়েলা মির্জা চিৎকার করে করে কাঁদছেন।
″আমার ছেলেকে কেউ বাঁচিয়ে দাও,আমার ছেলের কিছু হলে আমি মরে যাব,আমি তোমাকে ছাড়ব না আরিয়ান,আমি তোমাকে ছাড়ব না,তুমি আমার ছেলে ফিরিয়ে দাও,নইলে আমি তোমাকে আসত রাখব না,কথাটা বলে এসেই আরিয়ান মির্জার কলার চেঁপে ধরলে সিয়াম আর ইশিতা উনাকে ছাড়িয়ে নেয় কিন্তু সেই ক্ষণেই উনি জ্ঞান হারান।
আঁখি ছোটে আসে হাসপাতাল,তার পরিবারও চলে আসে সেখানে,আঁখির চোখে মুখে জলের ছাপ,সাথে দুশ্চিন্তারও আভাস।পেরেশান হয়ে এসেই এমারজেন্সিতে ঢুকে পরল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আঁখি বেড়িয়ে এলো অন্য দু’জন ডাক্তার সহিত, আরিয়ান মির্জা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
″আদৃত কেমন আছে মা?″
″উনি আউট ওফ ডেঞ্জার,বিষ খুব স্ট্রোং ছিল তা বের করে দিতে পারলেও উনার যথেষ্ট দূর্বলতা থাকবে বেশ ক’দিন,তাড়াতাড়ি নিয়ে আসায় উনার প্রাণ বেঁচে গেছে।″
কথাটা বলে চোখের উপচে পরা জল মুছে নিলো আঁখি।আরিয়ান মির্জা এবার অনুতাপের স্বরে বললেন।
″আমায় ক্ষমা করে দাও আঁখি,আমি সম্মানের ভয়ে এতটা অধমে পরিণত হয়েছিলাম যে সব অনুভুতি মাটি চাঁপা দিতে গিয়েছিলাম।আমায় ক্ষমা করে দাও।আমার ছেলে তোমাকে ছাড়া বাঁচবে না,আর আমার ছেলের প্রাণ আমার কাছে বড়।আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও,চলে আসো আমার ছেলের জীবনে ফিরে।″
চলবে…
#প্রমত্ত_অঙ্গনা
#লেখিকা_আরোহী_নুর
(৪০)
আঁখি জবাব দিয়ে উঠার আগেই আশরাফ খান জিজ্ঞেস করলেন।
″কি হয়েছে আরিয়ান?কি বলেছিস তুই এমন আঁখিকে যে এখন ক্ষমা চাইতে হচ্ছে?″
অতঃপর আরিয়ান মির্জা সবকিছু হুবহু বলে গেলেন,কথাগুলো শুনে মুহুর্তেই আশরাফ খানের চেহারায় যেন কালো মেঘ নামল,রাগে চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করে গেল।
″তোর সাহস হলো কি করে আরিয়ান আমার মেয়েকে এতো তুচ্ছ ভাবার!আর এখন নিজের ছেলের প্রাণ বাঁচাতে আমার মেয়ের কাছে এসে অনুতাপের জল ফেলছিস,দ্বিতীয়বার তুই আমার মেয়েকে অপদস্ত করবি না তার কি নিশ্চয়তা আছে,আমার মেয়ের খারাপ দিক খোঁজে তার ভালো দিক ঢেকে দেওয়া লোকগুলোকে কখনও ক্ষমা করব না আমি,চলে আয় আঁখি।পারলে নিজের ছেলেকে সামলাক।″
আঁখি মাথা নিচু করে বাবার পাশে চলে গেল,আদৃতকে এ অবস্থায় ছেড়ে যেতে বুক কাঁপছে,এদিকটায় আর কখনও মা বাবার অবাধ্য যাবে না পণ করে নিয়েছে।আশরাফ খান আঁখির হাত ধরে হাঁটা ধরবেন তখনই আরিয়ান মির্জা সামনে চলে এসে উনাদের আটকালেন।
″আশরাফ আমি নিজের ভুল বোঝতে পেরেছি,শিক্ষিত হয়েও অধমের কাজ করেছি,আমাকে ক্ষমা করে দে,আমি কথা দিলাম আঁখিকে মাথায় তুলে রাখব সারাজীবন, তোর মেয়ে আমায় ভিক্ষা স্বরূপ দিয়ে দে।″
″আঁখি,আজ আমি তোর উপর নিজের চাহিদা চাপিয়ে দিব না,তুই যে সিদ্ধান্ত নিবি তার সমর্থন করব।তুই কি আরিয়ানকে একটা সুযোগ দিবি?″
″বাবা মানুষ মাত্রই তো ভুল,ভুল আমরা সবাই করতে পারি তবে তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে ক’জন? ডা.আদৃত সারাজীবন অনেক কষ্ট পেয়েছেন উনাকে আর কষ্ট দিতে পারব না আমি,একটা মানুষের প্রাণ থেকে বড় তো কিছু হতে পারে না।উনার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না,কখনও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারব না অনুশোচনায়।কিন্তু তুমি যদি না চাও বাবা তবে আমি তোমার অবাধ্যও যাব না।″
″পাগলি মেয়ে আমার এতো বোঝদার হয়েছে জানতাম না।তা আরিয়ান বিয়ের ডেট ফিক্স করবি না এখনও কিছু ইমোশনাল ড্রামা বাকি?″
আশরাফ খানের কথায় আরিয়ান মির্জা আলতো হেসে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,আঁখি লজ্জাময়ী হাসিতে স্থান ত্যাগ করল।
_____________
পরদিন সকালে,
রিদিকার অর্ধেক চুল পরে গেছে,চোখের তলটা অস্বাভাবিক ভাবে কালো হয়েছে,আরও তিনটে দাঁত উঠে গেছে আজ সকালেই,শরীরের চামড়ার যা তা অবস্থা। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই আঁতকে উঠল,ভয় হচ্ছে নিজেকে দেখতেই অন্যরা কেমনে দেখবে তাকে,আদ্রিশ তো চোখ তুলেও তাকায় না এখন,রাতে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে তিক্ত কথা শুনিয়ে যে চলে গিয়েছিল কোথাও এখনও ফিরে নি,পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও চোখ সরিয়ে রাখে এখন তার উপর থেকে,বাড়িতেও থাকে না তেমন,সকালে বেড়ুলে রাতে ফিরে।
হঠাৎ গাড়ি আসার শব্দে আদ্রিশ এসেছে বুঝতে পারল রিদিকা,তার সাথে শেষমেষ একটা কথা বলবে ভেবেছে, এদিকে আদ্রিশ ঘরে ঢুকতে নিলে দরজার পাশে একটা খাম পরে থাকতে দেখে, কৌতুহলবশত উঠায় সেটা,এভাবে কোনো খাম দরজার সামনে পরেই বা কেনো থাকবে!সেই চিন্তাতে খামটা উঠিয়ে ভেতরে দেখে,ভেতরে একটা রিপোর্ট দেখতে পায়,কিন্তু রিপোর্টটা পড়ার পর আদ্রিশের চোখ ছানাবানা হয়ে গেলে।চেঁচিয়ে উঠল রিদিকা বলে,ঘড়ের ভিতর তেড়ে গেল।
রিদিকা হুটহাট সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল,আদ্রিশ তার মুখের সামনে রিপোর্টটা ধরে চেচিয়ে বলল।
″এসব কী রিদিকা?তুমি প্রেগন্যান্ট হতে পারো কি করে?″
″হোয়াট,আমি প্রেগন্যান্ট,আমি প্যাগন্যান্ট নই আদ্রিশ,এমন কোনো সিনড্রোম এখনও আমি পাই নি,এ ভুয়া রিপোর্ট কে দিয়েছে তোমায় যে জায়গাতে আমি এখনও কোনো টেস্ট করাই নি? আর যদি প্রেগন্যান্ট হই তবুও কি সমস্যা?তুমি তো বাচ্চার দোহাই দিয়েই বিয়ে করলে আমায়!″
কথাটা কানে যেতেই আদ্রিশ রিদিকার গাল বরাবর জোরালো একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল, অতঃপর গর্জে বলল।
″যে জায়গাতে আমি কখনও বাবা হতে পারব না সেখানে তুই মা কেমনে হবি!বল এই বাচ্চা তোর কোন নাগরের?বল কার বাচ্চা এটা?নইলে তোকে প্রাণে মেরে ফেলব আমি।
রিদিকার থুতনিতে সজোরো চেপে ধরে বলল আদ্রিশ, রিদিকা কান্নার সহিত জবাব দিলো।
″আমার বিরুদ্ধে ষরযন্ত্র করা হচ্ছে আদ্রিশ,আমি এসবের কিছুই জানি না,আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি,আর আমি প্রেগন্যান্ট নই।″
″চুপ কর,নষ্টামি করে এখন অবলা সাজার ডং করছিস,ছিঃ তোর এমন অবস্থা কোন পুরুষ তাকায় তোর দিকে কে জানে!রাস্তার নোংরা মাথায় তুলতে নেই মানুষ ঠিকই বলে,আমাকে পা*গ*লে কু*কু*র কামরেছিল যে তোর মতো নোংরাকে ঘরে তুলেছিলাম,তোর জন্য আমি আমার আঁখি আমার পরিবারকে হারিয়ে গেছি,কিন্তু আর না,তোকে এভাবে বার করব না,ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করব ঘর থেকে অপেক্ষা করিস শুধু।″
আদ্রিশ এবার হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।রিদিকা অগ্নিদৃষ্টিতে আদ্রিশের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে বলল।
″তবে তোমারও সময় এসে গেছে আদ্রিশ,অপেক্ষা করো শুধু, রিদিকা তোমাকে তোমার ভাগের টা তোমায় এবার ঠিকই দিবে।″
_______________
আদৃত চোখ খোলে আঁখিকেই সামনে পেল নার্সদের সাথে কি জানি কথা বলছে দাঁড়িয়ে, আদৃতের উপর চোখ গেল আঁখির,চোখাচোখি হলো দু’জনের,আদৃত বেশ অভিমান নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।আঁখি মুচকি হাসল এতে।
নার্সদের হাতের ইশারায় চলে যেতে বলল।অতঃপর আদৃতের পাশে বসে গলা খাঁকারি দিলো।
″এই যে চোখা নাকওয়ালা, ডাক্তারের সাথে কিন্তু রাগ অভিমান মানায় না।″
″কে বলেছে আপনাকে আমার চিকিৎসা করতে,চলে যান,আমাকে আমার হালে ছেড়ে দিন।″
″হুম, এসেছিলাম তো চিকিৎসা করতে,তবে এসে রোগীরই প্রেমে পরলাম,কিন্তু রোগী তো আমার দিকে তাকাচ্ছেই না।″
″দেখুন মশকরা করবেন না,এমনিতেই ভালো লাগছে না কিছু,চলে যান।″
″যাহ, রোগীর চোখা নাকের প্রেমে পরেছিলাম কিন্তু অভিমান হয়ত তার নাকের ডগায় চরে বসেছে,যাক আমার আর কি হেরে যাওয়া মন নিয়ে চলে যাই।″
কথাটা বলতেই আদৃত ফিরে তাকালো আঁখির দিকে।রসকষহীন স্বরে বলল।
″কোথায় যাবে?যেখানেই যাবে আমাকে পাবে।পিছু ছাড়ব না আমি তোমার।″
″বাহ,একটু আগেই তো শুনছিলাম কেউ আমাকে আপনি করে ডাকছিল,মুহুর্তেই দেখি হাবভাব চেঞ্জ,তা পিছু না ছাড়ার কথা বলে আপনি যেভাবে হারিয়ে যেতে নিচ্ছিলেন।হা হা হা হা।″
কথাটা বলে আঁখি অট্টাহাসিতে ফেটে পরল,আদৃত হতভম্বের মতো তাকিয়ে বলল।
″হাসছ কেন?আমি মরে গেলে খুশি হতে বুঝি?″
″একদম চুপ,আবার যদি এমনটা বলেছেন তবে আর কখনও আপনার সামনে আসব না,এমন কোথাও চলে যাব যে আমাকে কখনও খোঁজে পাবেন না।″
হাসি থামিয়ে এবার ককর্শ ভাবে বলল কথাগুলো।আদৃত উঠে বসল এবার।
″আরে কি করছেন?আপনি দূর্বল উঠবেন না এখন।″
″আমি ঠিক আছি আঁখি,আগে বলো এই যে অধিকার,আমাকে হারিয়ে দেওয়ার ভয় যা আমি তোমার চোখে দেখছি তা মিথ্যে নয়,বলো তুমি কখনও আমায় ছেড়ে যাবে না,ভালোবাসো আমায়।বলো?″
আঁখি কিছু না বলে আদৃতকে জড়িয়ে ধরল,অতঃপর মৃদু স্বরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল।″
″ভালোবাসি আপনাকে।″
কথাটা আদৃতের কান বিশ্বাস করে উঠতে পারল না,আঁখিকে ছাড়িয়ে আশ্চর্যের সহিত জিজ্ঞেস করল।
″মিথ্যে বলছ না তো!″
″হতেও পারে,অসুস্থ মানুষকে শান্তনা প্রদান কিন্তু ডাক্তারের কর্তব্য।″
″ফাজলামো করো না আঁখি,সত্যিটা বলো।″
″আল্লাহ, পরলাম কোন চোখা নাকওয়ালার ধান্দায়,আরে আপনার বাবা আমার বাবা মিলে আমাদের বিয়ের ক্ষণ ঠিক করে ফেলেছেন,আমি রাজি না থাকলে কি করতেন তা?″
″কি!″
″হয়েছে আর অবাক হতে হবে না,যে কান্ড করেছিলেন আপনি।মজনু সাহেব বেঁচে থাকলে আজ আপনাকে দেখে হয়ত আফসোস করতেন।″
″আমি মজনু হতে চাই না আর না তো দেবদাস,আমি আঁখির আদৃত হয়েই থাকতে চাই,তার পাগল প্রেমিক রুপে।″
″জানেন আমার কি মনে হয় আপনার ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে লাভ গুরু হয়ে যাওয়া উচিত, যা শুরু করেছেন।″
আদৃত এবার অল্প টানে আঁখিকে নিজের বেশ কাছে নিয়ে গেল,আঁখির কপালের সামনা দিয়ে বেড়িয়ে আসা ছোট চুলগুলো কানের পিছন গুজে দিয়ে বলল।
″তোমার প্রেমে এই প্রেমিক যা তা হতে পারে।″
″হয়েছে এবার কথার ফুল না বেঁধে শুয়ে থাকুন,আমার আরও রোগী আছে।″
আঁখি আদৃতকে হালকা ধাক্কাতে ছাড়িয়ে ছোটে পালিয়ে আসতে লাগল।আদৃত পিছনে বলল।
″আমি ছাড়া কোনো পুরুষ রোগী দেখলে কিন্তু খবর আছে,কিন্তু তোমার না ওই পুরুষের।″
″পাগল একটা।″
আঁখি হাসতে হাসতে চলে গেল,আদৃতও জায়গায় বসে হাসছে।
চলবে…