বকুলের বাস্তবতা পর্ব-০৫

0
303

#বকুলের_বাস্তবতা
#পর্ব_৫
#লেখক_দিগন্ত
আবীরের আমার উপর এত বিশ্বাস এত ভরসা আদৃতার সহ্য হলোনা।আদৃতা তার ফোন থেকে একটি ভিডিও বের করে আবীরকে দেখালো।ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গতকাল আমার আর ফুফুর কথোপকথন।ফুফু যে আমার কাছে ১০ লাখ টাকা চাইছেন সেটাও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

আদৃতা আবীরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
-“দেখলি তো ভাইয়া এই মেয়েটা কত বড় ধড়িবাজ।১০ লাখ টাকা জোগাড়ের জন্যই মেয়েটা আমার রিং চুরি করেছিল আমি সিওর।তুই এই রিংটা তোর রুমেই পেয়েছিস নিশ্চয়ই?”

আবীর একবার আবার দিকে তাকাল।তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভরসা পেয়ে গেলাম।তার চুখ দুটো যেন আমায় বলছিল,
-“ভয় পাবেন না আমি আছি।”

আবীর আদৃতাকে বলে,
-“‘হ্যাঁ এটা ঠিক আমি এই রিংটা আমাদের রুমেই পেয়েছি।কিন্তু রিংটা রুমে যে বকুলই নিয়ে গেছে সেটা তুই নিশ্চিত হলি কিভাবে? তোর হাত থেকে পরে যেতেও তো পারে।

-“এতকিছুর পরেও তুই এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করবি ভাইয়া? আর তাছাড়া আমি তো অনেকদিন থেকে তোর রুমে যাই নি।”

-“বকুল ভাবি হয় তোর।ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”

-“ভাবি মাই ফুট।এরকম চোরের ঘরের মেয়েকে আমার ভাবি ভাবতে হবে এতটা দুঃসময় আমার আসে নি।”

আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না।এত অপবাদ আর আমার সহ্য হচ্ছিল না।

-“ভদ্র ভাবে কথা বলুন আদৃতা চৌধুরী।আপনি কোন প্রমাণ ছাড়া আমার ব্যাপারে এরকম কথা বলতে পারেন না।আমার পরিবার সম্পর্কে কোন খারাপ কথা অন্তত বলবেন না।যা বলার আমাকে বলুন।”

আবীর আমার দিকে তাকিয়ে শাবাশির হাসি দিল।তিনি যে আমার এভাবে প্রতিবাদ করায় খুব খুশি হয়েছেন সেটা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

আবীর এবার আদৃতাকে বলল,
-“আমার রুমের বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে সেটা তুই জানিস নিশ্চয়ই।তুই তো বললি অনেকদিন আমার রুমে আসিস নি।আমি বরং সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করি।তাহলে জানা যাবে তোর রিংটা কিভাবে আমার রুমে গেল।”

আবীরের কথা শুনে আদৃতার কপালে ঘাম জমতে লাগল।আদৃতা আমতাআমতা করে বলল,
-“তা…তার কোন দরকার নেই।আমি আমার রিং পেয়ে গেছি এটাই অনেক।তুই কাজটা ঠিক করলি না ভাইয়া।একটা বাইরের মেয়ের জন্য…”

-“তোকে কতবার বলব আদৃতা যে বকুল বাইরের মেয়ে নয় ও আমার স্ত্রী।”

-“তাহলে শিলার কি হবে?”

-“শিলার ব্যাপারটা তুই খুব ভালো করেই জানিস আদৃতা।আমার কখনোই শিলার প্রতি কোন ইন্টারেস্ট ছিলনা।শিলা আমাকে পছন্দ করতো অন্যদিকে তুই শিলার ভাই শায়নকে পছন্দ করতি।তুই শায়নকে প্রপোজ করার পারে শায়ন তোকে রিজেক্ট করে।তখন তুই অনেক কেঁদেছিলি এমনকি আ*ত্ম*হ*ত্যা করারও চেষ্টা করেছিস।শিলা অনেক বুঝিয়ে শায়নকে রাজি করিয়েছিল।তবে শায়নের একটা শর্ত ছিল যে যদি আমি শিলাকে বিয়ে করি তাহলে ও তোকে বিয়ে করবে।আমি শুধুমাত্র তোর খুশির জন্য তখন রাজি হয়েছিলাম।এখন যখন আমার বিয়েটা এরকমভাবে হয়ে গেছে তখন আর কিছু করার নেই।শায়ন যদি তোকে সত্যি ভালোবাসত তাহলে কোন শর্ত ছাড়াই তোকে বিয়ে করতে রাজি হতো।জোর করে ভালোবাসা হয়না এটা তুই মনে রাখিস আদৃতা।”
___________
আমি দুপুরে নিজের রুমে শুয়েছিলাম।আদৃত তখন কিভাবে আমার হয়ে কত কথা বলল সেটাই ভাবছিলাম।আবীরের জন্য আমার মনে সদ্য জন্ম নেওয়া এই অনুভুতির নামই কি তাহলে ভালোবাসা? সুইটি(আমার বান্ধবী) বলতো কেউ যখন কাউকে ভালোবাসে তখন সবসময় তার কথাই ভাবে।তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে।আমারও তো আবীরের প্রতি একইরকম ঘটনা ঘটছে।আবীরের ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছি।

হঠাৎ করে আবীর রুমে চলে আসলো।আবীরকে দেখে আমার মন হাওয়ায় উড়তে লাগল, হৃদস্পন্দন দ্রুতগতিতে বাড়তে লাগল।আমি অনুভব করতে পারলাম কত সুপ্তভাবে ওনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার মনে তৈরি হচ্ছে।আমার দুই নয়নে স্পষ্ট ওনার জন্য শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।আবীর কি বুঝলেন আমার এই চোখের ভাষা?

আবীর বললেন,
-“আপনি তৈরি হয়ে নিন বকুল।আমি গাড়ি বের করছি।আজ আমরা আপনার বাড়িতে যাব।”

বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে খুশি হতে পারলাম না।ফুফুর মুখোমুখি হওয়ার কোন ইচ্ছে আর আমার নেই।আবীর হয়তো বুঝতে পারলেন আমার মনোভাব।তাই বললেন,
-“ভয় পাবেন না।আমরা ওখানে যাচ্ছি তার একটা কারণ আছে।আপনার ফুফুর কাছ থেকে আপনার মায়ের ঠিকানাটা আমি জোগাড় করে দিতে চাই।ভিডিওতে তো দেখলাম আপনি এই নিয়ে কথা বলছিলেন।”

-“তার কোন দরকার নেই।ফুফুর সামনে গেলে…”

-“আমার উপর ভরসা রাখুন।”

আবীরের সরল আবদার যা আমি ফেলতে পারলাম না।

তাই সব সংকোচ পাশ কা*টিয়ে আমি তৈরি হতে লাগলাম।একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো ভাবে দেখে নিলাম।ততোটা সুন্দরী নই আমি।গোলগাল,ফর্সা একটা মেয়ে।আবীরের মতো সুদর্শন যুবকের পাশে আমি ততোটা মানানসই নই।তবুও কেন আমাকে না দেখেই বিয়ে করে নিলেন? আদৌ কি মন থেকে মেনে নিতে পারবেন কখনো উনি আমায়? এসব ভাবতে ভাবতেই আমি বাইরে এসে গাড়িতে উঠলাম।আবীর কত যত্ন সহকারে আমার গায়ে সিটবেল্ট লাগিয়ে দিল।এই সামান্য কেয়ারগুলো আমার মনে আশার সঞ্চার করছিল।
~~~~~~~
ফুফুর বাড়িতে এসে নামলাম আমরা।আবীর আমার হাত ধরে সাহস দিলেন ভিতরে যাওয়ার।ওনার হাত ধরে যাওয়ার সময় ভিতরে কারো চিৎকারের আওয়াজ কানে এলো।ফুফা বোধহয় ফুফুর উপর রাগারাগি করছেন।স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে ফুফার গলা,
-“তুমি এটা কিভাবে করতে পারলে মেহেরজান? অনাথ মেয়েটাকে এভাবে বিয়ে দিয়ে দিলে।আমাকে কিছু জানালে না।আমি জানলে কখনোই এই বিয়ে হতে দিতাম না।মেয়েটার কত ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করার।তুমি ওর ফুফু হয়ে কিভাবে পারলে ওর সাথে এত বড় অন্যায় করতে?”

-“আমি যা করেছি বেশ করেছি।ওই বোঝাকে নামাতে পেরেই আমি খুশি।”

আবীর দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন,
-“ভেতরে আসতে পারি।”

ফুফা আমাদের দিকে তাকালেন।আমাকে দেখে বলল,
-“বকুল তুমি।এসো ভেতরে এসো।আমায় ক্ষমা করে দিও আমার অবর্তমানে এতকিছু হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি।”

-“আমার কোন খারাপ কিছু হয়নি ফুফা।এই যে আমার সাথে যাকে দেখছেন উনি আবীর।আমার স্বামী।”

ফুফা আবীরের দিকে তাকালেন।আবীর ওনার সাথে সালাম বিনিময় করলেন।আবীর ফুফাকে সব ঘটনা খুলে বলল যে কেন কিভাবে সবকিছু ঘটেছে।সব শুনে ফুফুর চোখ রাগে লাল হয়ে গেল।ফুফুর দিকে একবার তাকিয়ে তারপর আমায় বললেন,
-“তুমি নিজের মায়ের সাথে কেন দেখা করতে চাও বকুল।যেই মহিলা তোমার আর তোমার বাবাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তাকে নিয়ে তোমার এত ভাবনা কেন? শুধুমাত্র তার সাথে দেখা করার জন্য তুমি এতকিছু করলে।”

আমি কেঁদে ফেললাম।কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
-“আমি দেখতে চেয়েছিলাম ফুফা আমার মা কেমন আছে।কতটা সুখী আছে এখন।কতদিন থেকে তার কোন খোঁজ জানিনা।তার কোলে মাথা রাখিনি।আমার যে আর আপন বলতে কেউ নেই।”

আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে ফুফার চোখেও জল চলে এলো।তিনি বললেন,
-“আমি জানি বকুল তোমার মায়ের ঠিকানা।আমি তোমায় সেখানে নিয়ে যাব।তার আগে এই নাও তোমার বাবার ব্যাংকের চেক।এই টাকার উপর অধিকার শুধুমাত্র তোমার আছে।”

আমি চোখের জল মুছে টাকাগুলো নিলাম।এই টাকাগুলো আমার কাজে লাগবে।

আবীর ফুফাকে বলল,
-“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।এখন শুধু বকুলের সাথে ওর মার দেখা করিয়ে দিন।মেয়েটা খুব কষ্টে আছে।”

আবীরকে যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি।এত ভাবেন উনি আমার কথা! অথচ কতদিনের পরিচয় আমাদের।এই কদিনেই এত আপন করে নিলেন। হঠাৎ আবীরের ফোনে কল এলো।একটা জরুরি কাজে ওকে যেতে হবে।একটা এ*ক্সিডেন্ট হয়েছে অনেক রোগী এসেছে হসপিটালে।আবীর যেহেতু মেডিকেল স্টুডেন্ট তাই ওকে যেতে হবে ডাক্তারদের সাহায্য করতে।

আবীর যাওয়ার আগে বারবার ফুফাকে বললেন আমার খেয়াল রাখতে।উনি পরে এসে নিয়ে যাবেন আমায়।আমাকেও বললেন নিজের খেয়াল রাখতে।উনি চলে যাওয়ার পর ফুফা আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল,
-“তোমার ফুফু তোর ক্ষ*তি করতে গিয়ে উপকারই করল।আবীরের মতো এত ভালো ছেলেকে যে তুমি স্বামী হিসেবে পেয়েছ এরজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো।”
(চলবে)