বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব-১১+১২

0
321

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৫

একটি অলস বিকেল সাথে স্তব্ধ প্রকৃতি বিদ্যমান পরিবেশে। পত্র আর বিন্নী গ্রামের সরু পথটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে দু একটা কথা বলছে দু’জন নাহয় নিশ্চুপ, নীরবতা। আতস বাগানের জমিজমা নিয়ে একদিন কথা বলতে গিয়েছিল ঠাকুর জেঠার সাথে, জেঠা মসাই না থাকাতে দু’জনের বেশ প্রাণোচ্ছল ভাব জমে গিয়েছিলো। তারপর থেকেই নাকি দু’জনের টুকটাক আড্ডা হয়। এটা জেনে খুশি হলো পত্র। তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী আবার আগের মতন ডানা ঝাপ্টানো শুরু করেছে, সেটা তার কাছে পৃথিবীতে সদ্য নবজাতক জন্ম নিলে তার মা বাবা যতটা খুশি হয় ঠিক ততটাই খুশির মনে হয়েছে। বান্ধবী হাসছে, ছুটছে এটা যেন প্রকৃতির জীবন্ত রূপ। কিশোরীদের সবচেয়ে সুন্দর অলংকার তাদের চঞ্চলতা। সে বয়সে আবেগের ঘোরে তারা হাসবে, ছুটবে, উদাস হবে, স্বপ্ন বুনবে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। বরং এমনটা না হলেই কষ্ট লাগে। প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গন করা হয়।

হাঁটতে হাঁটতে বিন্নী আর পত্র পুকুর পাড়ে এসে বসলো। মাথার উপর তখন গাছপালার অবিরাম ছায়া। ছোটো হাই টানলো বিন্নী। মেয়েটাকে ক্লান্ত লাগছে। পত্রের মায়া হলো। তাই, বিন্নীর মাথাটা তার কোলে বিছিয়ে নিতে নিতে বললো,
“একটু ঘুমিয়ে নে খই আমি আছি তো।”

“না না বাবা, আমি ঘুমাবো না। যদি পিসি চলে আসে?”

বিন্নীর চোখে-মুখে ভয়। পত্র হাসলো সে ভয় দেখে। বিন্নীর মাথায় নরম, কোমল, আদুরে স্পর্শ করে বললো,
“পিসি আসার আগেই নাহয় আমরা চলে যাবো? আর পিসি আসবে না। পিসি তো আমাদের ভালোবাসতো। আমাদের কী কোনো ক্ষতি করতে পারে সে, বল?”

“না।”

মুখে না বললেও অন্তরে তো কিঞ্চিৎ ভয় থেকেই যায়। আবার চোখে মুখে ক্লান্তির মেঘ। তাই ভয়ের থেকে বিশ্রামকে সে বেশি গুরুত্ব দিলো। বান্ধবীর কোলে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে চোখ বন্ধ করতে করতে বললো,
“সন্ধ্যা নামার আগে আমায় তুলে দিস পাতা। সন্ধ্যার পর থাকা উচিৎ হবে না।”

পত্র মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানাতেই মিনিট দুইয়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো বিন্নী। তার ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়লো পত্রের কোলে। তা দেখে পত্রও দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটা বোধহয় অনেকদিন ঘুমোয় না। ঘাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলো পত্রও। কতো এলোমেলো হিসাব ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মাথায়। কিছু একটা গোপন গল্পের ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। অভ্রদা’র কল্যানে বহু বই পড়া হয়েছে তার জীবনে। কখনো ব্যোমকেশ বক্সী কখনো বা কাকাবাবু কখনো বা বিদেশি শার্লক হোমস নিয়ে জেনেছে সে। আর সেই সুবাধেই এই সকল অলৌকিক ঘটনা তার কাছে নিত্যান্তই সাজানো কোনো ছল মনে হচ্ছে। হয়তো একজন করছে এ কাজ, নয়তো অনেকে মিলে। প্রথম দিন পুকুর পাড়ে দেখা পিসি এবং অভ্রদা, দুটো অবয়বকে সে আলাদা দেখেছিল। অভ্রদাকে চোখের ভুল ভেবেছিলো কিন্তু পিসির অবয়বটাও যখন দেখতে পায় তখন ভীত হয়ে পড়ে সে। কিন্তু হুট করেই চা বাগানের বিশৃঙ্খলা তাকে ভাবাচ্ছে। পত্রের মস্তিষ্ক এসবের সাথে অভ্যস্ত নয় যার ফলস্বরূপ এক পর্যায়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সেও। দূর হতে গন্ধরাজের মোহনীয় ঘ্রাণ ভেসে এলো সাথে কতগুলো অচেনা পাখির কলরব। চোখের পাতায় আবছা আবছা কিছু দৃশ্য ভেসে উঠলো। মস্তিষ্ক হয়তো পত্রকে কিছু আভাস দিতে চায়। সাধারণ চোখ যা দেখেছে তার ভেতরের অসাধারণত্ব পত্রের মস্তিষ্ক হয়তো টের পেয়েছে কিন্তু ঘুমন্ত পত্রের কাছে তা নেহাৎই ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্নের ন্যায়।

মাঝে কেটে গেলো আরও কিছুটা দিন। চা বাগানের অস্বাভাবিক ঘটনা গুলো তখন রমরমা। প্রতিদিন নিত্যনতুন কোনো না কোনো বাঁধা, কোনো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেই চলেছে। এর কোনো বিরতি নেই।

অন্যান্য দিনের মতন আজও সকাল হলো তবে প্রকৃতিতে তখনও ঘন বরষার স্রোত। সকাল হতে টিনের চালে ঝুপঝাপ বৃষ্টির নৃত্য অবিরত চলছেই। পত্র রান্নাঘরে মায়ের সাহায্য করছে। ছায়া গোল গোল বেগুন গুলো গরম তেলে ছেড়েছেন। বৃষ্টির দিনে সমির বাবু খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা একটু বেশিই পছন্দ করেন। কেবল সমির বাবু না, সাথে পত্র এবং পত্রের পিসিও পছন্দ করতেন। পত্র হাতের সবজি কাটতে কাটতে হঠাৎ ছায়ার দিকে খেয়াল করতেই সে অবাক হলো। তার মা একা একা সামনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। পত্র বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মা হাসছে! মাকে খুব একটা হাসতে দেখে নি ওরা। খুব কমই হাসেন তিনি। আবার হাসেন না বললেও চলে। অথচ সে মানুষ একা একা হাসছে! পত্র অবাক কণ্ঠেই প্রশ্ন করলো,
“মা! হাসছো যে!”

ছায়ার ধ্যান ভাঙলো না তবুও। সে আগের ন্যায় মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগলো। ভাব এমন যে তার সামনে কেউ বসে মজার কিছু বলছে আর তা শুনেই হাসছে সে। ছায়া অবশ্য কখনোই এক দু ডাকে উত্তর নেয় না। যতক্ষণ না তাকে শরীর দুলিয়ে ডাকা হয়, ততক্ষণ সে ধ্যানেই থাকে। পত্র আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে ছায়ার শরীর ঝাকিয়ে বেশ জোরে বললো,
“হাসছো কেন, মা? কী হয়েছে?”

পত্রের ধাক্কানোর ফলে কড়াই থেকে কিছুটা তেল ছিটকে অসাবধানতা বশত ছায়ার হাতে এসে পড়লো। কিঞ্চিৎ ই বলা যায়। কিন্তু হুট করে পড়াতে ছায়া ব্যাথার চেয়ে বেশি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো এবং কড়াইয়ের ফুটন্ত তেলে থাকা গরম চামচটা নিয়ে লাগিয়ে দিলো পত্রের হাতে। সাথে সাথেই পত্রের হাতের বেশ খানিকটা চামড়া উঠে এলো চামচের গা ঘেঁষে। গগণ কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো পত্র। পত্রের চিৎকারে ছায়া কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সেই চিৎকার শুনে, সাথে সাথে ছুটে এলো পদ্ম এবং পুষ্প দুজনেই।

ছায়া ব্যস্ততা দেখালেন না। আগের মতন সটান বসে রইলেন। পদ্ম ততক্ষণে বোনকে বসা থেকে টেনে তুললো। পাশের কলসি ভর্তি জল উপুড় করে ঢালতে লাগলো চামড়া উঠে সাদা হয়ে যাওয়া হাতটায়। পত্রের গাল ঘেঁষে নোনা জলের স্রোত নিশ্চুপে বিসর্জিত হলো কিন্তু মুখ দিয়ে সে আর একটাও টু শব্দ করলো না। বোনের অসহায় মুখটা দেখে বেশ মায়া লাগলো পদ্মের। তাই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বান্তনার স্বরে বললো,
“বেশি ব্যাথা পেয়েছিস পাখি? থাক কাঁদে না। দেখি তো, ভালো হয়ে যাবে।”

পত্র ধীর গতিতে চোখের জল মুছে নিয়ে বোনের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো নিজের হাতটা। কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললো,
“মায়ের হাতেও তেল পড়েছে, বড়দি। তুমি ওষুধ লাগিয়ে দেও। আমি ঠিক আছি।”

কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না সে। এক ছুটে চলে গেলো ঘরে। বেশ শব্দ করে সে ঘরের দরজাটা বারি খেলো। পদ্ম বিস্মিত নয়নে তাকালো মায়ের পানে। মায়ের আচরণ আজকাল তার কাছে বড্ড অমানবিক ঠেকছে। মেয়েদের এমন অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টিতেও যেন কিছু এলো গেলো না ছায়ার। সে আরেকটি চামচ দিয়ে কড়াই থেকে বেগুন ভাজা গুলো বাটিতে নামিয়ে উঠে গেলো। পদ্মের দিকে তাকিয়ে আদেশের স্বরে বললো,
“বাকি বেগুন গুলো ভেজে নামিয়ে রাখ আর পুষ্পকে দিয়ে আজ তোর বাবার খাবার পাঠাবি। আমার ঘুম পেয়েছে।”

পদ্ম আর পুষ্প দু’জন কেবল দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। মা এতটা বেখেয়ালি কীভাবে হয়! একটুও মায়া হলো না তার এসব করতে! ছোটো শ্বাস ফেলে রান্নাঘরে গিয়ে বসলো পদ্ম। বেগুন ভাজা গুলোর দিকে তাকাতেই তার অতীতের হাসিখুশি পরিবারটার কথা মনে পড়লো। পিসি প্রতিদিন বেগুন ভাজা খেতেন। তার এতো পছন্দ ছিলো যে সে বেগুন ভাজা ছাড়া কিছু বুঝতের না। পিসি মারা যাওয়ার পর এ বাড়িতে আর বেগুন ভাজা হয় নি, এই প্রথম ই হলো। পিসিটা থাকলে কতো ভালো হতো! অন্তত পত্রের কষ্ট বুঝার তো কেউ থাকতো।

বাবার খাবার নিয়ে আজ পুষ্পই গেলো চা বাগানের কোয়াটারে। ছাতা মাথায় দিয়ে, হালকা রঙের একটা জামা পড়ে বড়ো চুল গুলো দুলাতে দুলাতে সে উপস্থিত হলো সেখানে। খুব অদ্ভুত ব্যাপার হলেও এটা ঠিক যে আজকাল পুষ্প বেশ সাদামাটা ই থাকে। আগে তো সে সবসময় গাঢ় লাল, নীল, হলুদ ইত্যাদি রঙের জামাকাপড় পড়তো। মুখ চোখে থাকতো প্রসাধনীর ছোঁয়া। স্নো, পাউডার মেখে একদম পরীর মতন। আজকাল আর সে সাজটা তেমন দোখা যাচ্ছে না। একদম গোপন পরিবর্তন বলা যায়। কিন্তু পুষ্পের এই ক্ষুদ্র পরিবর্তন ঢেকে গিয়েছে চা বাগানের বিরাট বিরাট পরিবর্তনের কোলাহলে।

বাবার খাবার নিয়ে পৌঁছতেই পুষ্প দেখে কোয়াটের ভেতর ছাউনি দিয়ে শহরের সেই ছেলে দল গুলো কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। তার একটু দূরেই কোয়াটারের সাথে লাগোয়া বাহিরের বারান্দায় মুখটা ছোটো করে দাঁড়িয়ে আছে সমির বাবু। পুষ্প বাবার মুখ চোখ দেখে বেশ অবাক হলো। তাদের বাবা এমন একজন মানুষ যে হাজারো ঝড়-ঝাপটায় নিজের শুদ্ধতম হাসিটা মুখে বজায় রাখতে ভুলেন না। অথচ আজ সে মানুষটার মুখ আঁধার!

বাতাসে ছাতাটা সামলাতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছিলো,পুষ্পের। সে কোয়াটারের বারান্দায় দ্রুত প্রবেশ করেই প্রথমে ছাতাটা বন্ধ করলো। সমির বাবুও ততক্ষণে মেয়ের উপস্থিতি টের পেলেন। মেয়েকে দেখে মলিন, ঝাপসা একটা হাসিও দিলেন। পুষ্পও সে হাসির বিপরীতে হাসি ফিরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলো বাবার দিকে। হাতের টিফিন বক্সটা বাবার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
“আজ খিচুড়ি হয়েছে, ধরো। খেয়ে নেও।”

সমিরবাবু মেয়ের হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে পাশে রাখলেন। ছোটো একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
“আজ বৃষ্টির মাঝে কষ্ট করে আসতে গেলি কেন? আর এই কাজ তো পত্র করে, আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে শুনি?”

বাবার কথায় মিছিমিছি মুখ চোখ কুঁচকালো পুষ্প। ভেংচি কেটে বললো,
“কেনো? আমি এসেছি বলে তুমি খুশি হও নি?”

“তা হবো না কেন? তোরা তো সবাই ই আমার মা। মাদের দেখলে এমনেতেই মন ভালো হয়ে যায়।”

“কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ। কী হয়েছে, বাবা? কোনো সমস্যা?”

“চা বাগানে আমাদের শান্তির দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে মা।”

বাবার বুক ভার ভার কথার মর্ম বুঝলো না পুষ্প। কেবল বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই শহুরে ছেলেদের আলোচনার দিকে তাকালো পুষ্প। কয়েকদিন নভ নামের ছেলেটিকে অবশ্য দেখা না গেলেও আজ ঠিক দেখা যাচ্ছে। কী গভীর আলোচনা। বাবা কিএই আলোচনাকেই ইঙ্গিত দিয়ে কিছু বললো!

_

সারা দিন বৃষ্টির পর বিকালের আকাশ তখন একদম পরিষ্কার। তুলোর মতন মেঘ রাশি উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। সমিরবাবু আজ তাড়াতাড়িই ফিরেছেন বাড়ি। বলতে গেলে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফিরে এসেই দেখে বাড়ির পরিস্থিতি শীতল। যে যার ঘরে ঘুমিয়ে আছে। ছায়াও বিছানার এক কিনারায় কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। কাঁথার আস্তরণে ঢেকে আছে ছায়ার মাঝারি আকারের শরীরটা। সমির বাবু ঘরের উত্তর দিকের জানালাটার একদিক খুলে দিলেন। ছায়া সবসময়ই জানালা, দরজা খুলে রাখেন। আর বেশিরভাগ সময় সে জানালার সাথে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। অন্যান্য আর পাঁচটা মহিলার মতন না সে। গালগপ্পো তে তাকে তেমন দেখাও যায় না।

সমির বাবু জানলাটা খুলে নিজেও একটু স্বচ্ছ বাতাস টেনে নিলেন। মনের মাঝ হাজারো আশংকা। এর মাঝেই তার চোখ গেলো জনালা বরাবর পুকুরের কিনারের বটগাছটার দিকে। সেখানে কিছু একটা রাখা আছে। সমির বাবু অবাক হলেন। ব্যস্ত পায়ে ছুটলেন কী ভেবে যেন। মিনিট কয়েকের মাঝেই সে গাছটার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং অবাক হয়ে গেলেন গাছের সামনে কলাপাতায় বিছানো খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা সাজানো পড়ে থাকতে দেখে। এটা দেখে কিঞ্চিৎ কেঁপেও উঠলেন তিনি। তার বোনটা যে কলাপাতায় খিচুড়ি খেতে বড্ড ভালো বাসতেন। তবে আজ কে রেখে গেলো এখানে এটা?

#চলবে,,,

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৬

উঠোনের মাচার উপর বসে আছেন সমির বাবু। সময়টা তখন রাতের প্রথম প্রহর। ছায়া রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে সমির বাবুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সমীর বাবুর তখন চিন্তিত মুখ। ভাবুক হয়ে কী যেন ভাবছেন। ছায়া গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“নেও, খাবারটা।”

সমির বাবু কী নিয়ে যেন একটা গভীর ভাবনায় ছিলেন। ছায়ার কথায় তার ধ্যান ভাঙলো। ধ্যান ভাঙতেই মুখ দিয়ে একটা গোঙানির মতো শব্দ হলো। এতে ছায়া চোখ মুখ কুঁচকালো। কিছুটা ব্যস্ততা মিশালো কণ্ঠে বললো,
“কী গো? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”

“না না, তেমন কিছু না।”

ছায়া আর কিছু বললো না। থালাটা সমির বাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে আবার দ্রুত ভঙ্গিতে রান্না ঘরে গিয়ে বসলো। চুলায় ডাল গরম করছেন। ডালের মাঝে চামচ নাড়াতে নাড়াতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“শুনছো, একটা কথা ছিলো।”

সমিরবাবু ভাতের লোকমা টা মুখে নিতে নিতে বললেন, “হ্যাঁ বলো।”

“পদ্ম’র ব্যাপারে কী ভাবলে? একবার তো বিয়ে ভাঙলো, আর কী চেষ্টা করবে না?”

সমির বাবুর ভাতের থালে থাকা হাতটা আপনা-আপনিই থেমে গেলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে চাইলেন স্ত্রীর দিকে। বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“মেয়েটার বয়স আঠারো হবে না যেন হলো হলো ভাব। এমন উঠেপড়ে লেগেছো কেন বুঝি না।”

ছায়া কিঞ্চিৎ খেপে উঠলো। কণ্ঠও আরেকটু উঁচু করে বললেন,
“আজকাল যুগ ভালো? বাগানে কত কিছু হচ্ছে। কখন কী খারাপ হয় সেটার কোনো ঠিক-ঠিকানা আছে? তোমার তো কেবল মেয়ে মেয়ে। যতোসব আহ্লাদী পনা।”

সমিরবাবুও বোধহয় খানিকটা রেগে গেলেন। হাতের হালটা ছুঁড়ে ফেললেন সুদূরে। মাটিতে পড়ে স্টিলের থালাটা ঝনঝন শব্দ করে উঠলো। যে শব্দ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পদ্ম,পত্র ও পুষ্প। সমির বাবুর হাতের রগ কিঞ্চিৎ ফুলে উঠেছে ততক্ষণে। চোখের ভেতর সাদা অংশটায় দেখা দিয়েছে লাল লাল সরু কিছুর আভা। সে মাচার পায়ে বেশ বড়সড় এক লাথি দিয়ে বেশ চেঁচিয়ে বললেন,
“তোমার ঠিক সমস্যা টা কোথায় শুনি? কী কারণে তুমি এমন পাগলের মতন আচারণ করো? যখন যা ইচ্ছে তা-ই সকলের মাথায় চাপিয়ে দিতে চাও। তোমার সিদ্ধান্তই কী সব! আমার মেয়েদের জীবন কিছু না?”

ছায়া স্বামীর এই শক্ত-পোক্ত চোহারার আদল দেখে বোধহয় স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কোনো মতে উচ্চারণ করলেন,
“আমি তো ভালোর জন্য ই বলেছিলাম।”

“রাখো তোমার ভালো। এ কেমন ভালো, যে অন্যের হাসি কেড়ে নেয়।”

সবাই কেবল নীরব রইলো। ছায়াও আর মুখে মুখে তর্ক করলেন না। অনেকটা সময় চুপ থাকার পর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ছায়া, একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
“হয় বিয়ের ব্যাপারে কথা শুরু করবে, না-হয় আমাকে চিরতরে হারাবে। বাকিটা তোমাদের ব্যাপার।”

“মা!”

পদ্মের চোখে-মুখে বিস্ময়। সাথে বিস্ময় পত্র ও পুষ্পের চোখমুখেও। ছায়া আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলেন না। ছুটে গেলেন নিজের ঘরে এবং শক্ত হাতে দোর দিলেন। সমিরবাবু যেন মুহূর্তেই স্তম্ভিত ফিরে পেলেন। ধপ করে বসে পড়লেন মাচার উপর। যে যার মতন নিজ নিজ জায়গায় চলে গেলেন। কেবল পত্র ধীর পায়ে এগিয়ে এলো তার বাবার দিকে। সে রাতে বাবা মেয়ে অনেকটা সময় চুপচাপ বসে রইলো। পত্র বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, বাবার আজ সঙ্গী দরকার। তাই সে ই হলো নিশ্চুপ সঙ্গী টা।

_

পরেরদিন ভোর হলো। কাক ডাকলো, সূর্য উঠলো, আকাশে ভেসে বেড়ালো তুলোর মতন মেঘেরা। কিন্তু ছায়া দরজা খুললেন না, শব্দ করলেন না। সমির বাবু মাচার মাঝেই ঘুমিয়ে রাত কাটালেন। বুকে জমে গেলো ঠান্ডাদের উৎসব। ভোর হতেই শুষ্ক কাশির দেখা মিললো। পত্রও কিছুটা আধো ঘুম, আধো জাগরণের মাঝে রাত্রি যাপন করলো। সকাল হতে হতেই উঠোন পরিষ্কার করে চা বসিয়ে দিলো চুলায়। বাবাকে চা মুড়ি দিয়ে, ভাত চড়িয়ে দিলো। সমির বাবু স্নান করে রোজকারের মতন কাজে চলে গেলেন। যেমন সাদামাটা চলে নিত্যদিন, ব্যস্ততার আবরণে ঠিক তেমনই সাদামাটা গেলো এই দিনটাও।

বিকেল হতেই পত্র পুকুরে গেলো কলসি ভরে জল আনার জন্য। কলসি ভরে জল নিয়ে ঘাটে উঠতেই দেখা মিললো আতসের। চোখে মুখে লেপ্টে আছে তার মায়া মায়া হাসি। এক বিশাল মোহনীয়তা। পত্রও আতসের হাসির পরিবর্তে ফিরিয়ে দিলো হাসি। আতস দু’কদম সামনে এগিয়ে এলো, বেশ মিষ্টি করে শুধালো,
“আছো কেমন?”

“বেশ ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো। তা আজকাল তোমার যে দেখা সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাপার কী?”

“খোঁজ নিলে ঈশ্বরকেও পাওয়া যায়, আমি তো সামন্য মেয়ে।”

পত্রের সুচালো কথায় আতসের ডান ভ্রু আপনা আপনি উপরে উঠে গেলো, বেশ প্রশংসার স্বরে বললো,
“ঈশ্বর আর মানুষের মাঝে এখানেই তো পার্থক্য। ঈশ্বর ব্যাথা বুঝেন কিন্তু মানুষ তা নয়।”

আতসের কথার বিপরীতে পত্র খিলখিল করে হেসে উঠলো। বেশ ঠাট্টা করেই বললো,
“যে ব্যাথা দেয়, তারও বুঝি ব্যাথা লাগে?”

পত্রের হেয়ালি কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো আতসের। সে যেন কিছু একটা আঁচ করতে গিয়েও করতে পারলো না। কেবল সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“ব্যাথা দিয়েছি! কাকে?”

“আরে মজা করেছি। তা চা বাগানে আপনাদের কিসের প্রজেক্ট যেন!”

“ঐ তো একটা কারখানা তৈরী করার। ও কিছু না। বুঝবে না তুমি।”

আতসের কণ্ঠনালী স্বাভাবিকের তুলনায় কাঁপছিল। মিথ্যা বলার সময় যেমন অন্যান্য মানুষের কাঁপে, ঠিক তেমন। পত্রের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক অব্দি সে কম্পন্ন ঠিক ধরা পড়লো কিন্তু সে আর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলো না। বাঁকা হেসে বললো,
“সত্যিই, ওসব শহুরে ছলচাতুরী আমাদের বোঝার সাধ্য নহে।”

আতস হয়তো আরও কিছু বলতো কিন্তু তন্মধ্যে কোথা থেকে যেন হুড়মুড় করে নভ চলে এলো। মাথায় একঝাঁক চুল, সাদা পাঞ্জাবি পড়নে। বেশ গুছানো হাবভাব। এসেই বলিষ্ঠ হাতে ছোটো চ/ড় লাগালো আতসের পিঠে। ব্যস্ততা মাখা কণ্ঠে বললো,
“এখানে কিরে শা° লা। চল তাড়াতাড়ি।”

“আমি আসছি, তুই যা।”

আতসের কথাকে বিশেষ পাত্তা দিলো না নভ। কেবল ব্যস্ততা, তাগা দিতে লাগলো। অতঃপর এক পর্যায়ে আতস না পেরে চোখের ইশারায় পত্রকে কিছু বলেই ছুট লাগালো নিজের গন্তব্যে। আতসের পিছে ধীর গতিতে নভও পা বাড়াতে নিয়ে আবার থেমে গেলো। পিছে ঘুরে পত্রের পা থেকে মাথা অব্দি একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। চারপাশে নিরেট নিশ্চুপতার দেয়ালকে ভেদ করে বললো,
“চুল গুলো আমার প্রিয় ছিলো।”

_

আরও একটা নিকোষ কালো রাত নামলো প্রকৃতির বুক চিরে। দূর হতে খেঁক শিয়ালের ডাক রাতটাকে দিয়েছে গা ছমছমে রূপ। ঠাকুর বাড়ির জেঠা মশাই এর আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেলো। বাহিরে তখন ভরা জ্যোৎস্না। সচারাচর বর্ষাকালে রূপসী চাঁদ থাকে না। তাই জ্যোৎস্নারও আমরা দেখা পাই না। তবে আজ ব্যাপার টা ভিন্ন। আজ চারদিকে কেমন আলো আর আলো। জেঠামশাই মানে দুলাল ঠাকুর নিজের খাট ছেড়ে উঠে বসলেন। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। ছেলেটা মা রা যাওয়ার পর থেকেই ঘুম হয় না তেমন৷ যার জন্য সে বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচে তাদের উঠোনে তাকাতেই তার শরীর শিরশির করে কেঁপে উঠলো। লাল শাড়ি পড়ে বধূবেশে বসে আছে কেউ। পায়ের নুপুর জোড়া বাজছে কী মিঠে শব্দে!

দুলাল ঠাকুর তৎক্ষনাৎ নিচে নেমে এলেন। এ শাড়ি, এ নুপুর জোড়া যে তার বড্ড চেনা। নিচে নামতেই দেখে নারী অবয়বটা আগের জায়গাতেই ঠাঁই বসে আছে। নেই কোনো নড়চড়। দুলাল ঠাকুর যেন বরফ হয়ে গেলেন জমে। কাঁপা কণ্ঠে বললেন,
“কে?”

নারী কণ্ঠটা তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললো,
“আমায় ক্যান ভালোবাসলা না?”

#চলবে,,